#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১০
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“আচার পৌঁছে দিয়েছিলে?”
মাহিরা ফোনের ওপাশ হতে শুধালো।
শাহরিয়ার নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“দিয়েছি।”
মাহিরা কিছুটা উৎসুক হয়ে বললো,
“কথা হয়েছে ভাবীর সাথে? কী কী কথা হলো তোমাদের?”
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বললো,
“আমরা অনেক বিস্তর আলোচনা করেছি।”
“কী?”
“কিছু না। কী কথা হবে? আমি কাজের জন্য গিয়েছি, কাজ শেষ হয়েছে চলে এসেছি।”
“আমি তো তোমাকে কথা বলার জন্যও পাঠিয়েছি।”
“এখন সবকিছু কথার উর্ধ্বে চলে গিয়েছে!”
“তোমরা আসলে কী বলো তো? কাউকে বুঝিয়ে পারছি না! কেনো এমন ছেলেমানুষি করছো দুজনে? ভাবী থাকতে চাইছে না, তুমিও রাখতে চাইছো না! আচ্ছা সার্কাস চলছে!”
শাহরিয়ার ধমকে বললো,
“মুখে যা আসে তাই বলে ফেলিস কেনো বেয়াদব? আমি রাখতে চাইছি না? ও থাকতে চাইছে না তাহলে কি আমি দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো, ফাজিল? আর এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার, তোর মাথা না ঘামালেও চলবে!!”
এই পর্যায়ে মাহিরাও ক্ষেপে বললো,
“তোমার যে রগচটা স্বভাব, কোন মেয়ে থাকতে চাইবে তোমার সাথে শুনি? নিজেকে চেঞ্জ করো একটু, নাহলে এভাবে সবার সাথেই দূরত্ব সৃষ্টি হবে তোমার, দেখে নিও!”
শাহরিয়ার একটু থমকে গেলো। বললো,
“আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমার সত্যিই এঙ্গার ইস্যু আছে?”
“কেনো? এর আগে কেউ বলেনি তোমাকে? স্ট্রেঞ্জ! বলবে কীভাবে? তোমার ধারেকাছে ভদ্র কাউকে ঘেঁষতে দেও তুমি?”
শাহরিয়ার চুপ করে গেলো। জ্যোতিও সেদিন এই কথাই বলেছিলো। শাহরিয়ার এবার সত্যিই ভাবনায় পড়লো।
মাহিরা আবার বললো,
“দাঁড়াও, আমি বাবাকে বলছি তোমার কাজ কমিয়ে দিতে। সারাদিন বাইরে বাইরে থাকবে আর বাসায় এলে যাকে পাবে তাকে ঝাড়বে! ত্যক্ত হয়ে গেছি তোমার এ সমস্ত আচরণে! ভাবী যে এসব এতোদিন সহ্য করেছিলো এটাই আশ্চর্যের!”
শাহরিয়ার ধমকে বললো,
“তুই ফোন রাখ! রাখ ফোন!”
মাহিরাও সমান তেজে ফোন কেটে দিলো।
মাহিরা বাবার কথা তোলার পর শাহরিয়ার চিন্তিত হলো। বাবাকেও একটা কল দেওয়া দরকার। ওদিকের অবস্থা কী সেটাও তো জানতে হবে।
শাহরিয়ার ল্যাপটপ অন করে বাবাকে ভিডিও কল লাগালো। কয়েকবার রিং হওয়ার পর সোহাইল শাহবাজ ফোন ধরলেন।
“আসসালামু আলাইকুম বাবা, কেমন আছো?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভালো। তোমার কী অবস্থা?”
একটা আপেলের খোসা ছুরি দিয়ে ছিলতে ছিলতে জবাব দিলেন সোহাইল সাহেব। উনি আপেল এভাবেই খান, খোসা ছাড়িয়ে।
“এইতো, ভালো।”
“ফ্যাক্টরির কাজ ঠিকঠাক চলছে?”
“হ্যাঁ, চলছে। তোমার ওদিকের কী অবস্থা? কবে আসবে দেশে?”
“নেক্সট উইকে কেসের ফাইনাল রীট। ঝামেলা পুরোপুরি মিটে গেলেই চলে আসবো।”
শাহরিয়ার বিষন্ন হলো। ওখানে ঝামেলা এখানের তুলনায় ঢের বেশি। শাহরিয়ারদের ব্যাবসা বিদেশেও প্রসারিত। কিন্তু সমস্যা হলো লন্ডনে তাদের কোম্পানির যে শাখা সেখানে কিছু সমস্যা হয়েছে। তাদের প্রোডাক্টের কোয়ালিটি গুণগত মানের ছিলো না। এটা নিয়ে একটা এজেন্সি মামলা করেছে। এসব কারণেই সোহাইল সাহেবকে প্রায় দুই মাসের মতো সেখানে পড়ে থাকতে হচ্ছে। ঝামেলা এখনও মিটছে না।
শাহরিয়ার হতাশ হয়ে বললো,
“উফফ! কেনো যে এই উটকো ঝামেলাটা হলো!”
সোহাইল সাহেব আপেলের খোসা ছিলতে ছিলতে বললেন,
“এটা উটকো ঝামেলা না। আমাদেরই অসাবধানতার ফল। আর যাই হোক, এটা অস্বীকার করা যাবে না যে ফল্ট আমাদের কোম্পানিরই। আচ্ছা শিক্ষা হয়েছে আমার। আর কারো উপর ব্লাইন্ড ট্রাস্ট করবো না। কত বড় বোকা হলে আমি ফরেইন শিপমেন্টের দায়িত্ব আরেকজনের উপর দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকি! এতদিন ধরে এসব হয়ে আসছে আর আমি নিজে একবার চেক করার প্রয়োজনও বোধ করলাম না! আসলেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছি দিনদিন। আমি সব ঝামেলা কাটিয়ে আসি শুধু, সবকটাকে ধরবো!”
“আচ্ছা বাবা শান্ত হও। এখন মাথা গরম করলে চলবে না।”
“আমি তো টেনশনেই ছিলাম আমাদের ট্রেড লাইসেন্স না আবার বাতিল হয়ে যায়!”
“আমিও তো এটাই চিন্তা করছিলাম। অল্পের উপর দিয়ে গেছে, আল্লাহর শুকরিয়া। আচ্ছা তুমি খেয়েছো?”
“এইতো, ঘন্টাখানেক আগে লাঞ্চ করলাম। তুমি খেয়েছো কিছু?”
“সন্ধ্যায় হালকা পাতলা খেয়েছিলাম কিছু। একটু পর রাতের খাবার খাবো।”
“বাসার সবাই কেমন আছে? তোমার মা, মাহি, অরু ওরা কেমন আছে?”
“আছে, সবাই ভালো আছে।”
“আচ্ছা শাহরিয়ার, আমি রাখছি এখন। একটু পর বের হতে হবে একটা দরকারে। পরে কথা হবে তোমার সাথে।”
শাহরিয়ার বিদায় নিয়ে কল কেটে দিলো। বেডে আধশোয়া হয়ে কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিন্তা করতে লাগলো।
ঝামেলা আর পিছু ছাড়ছে না তাদের। এদিকে ঝামেলা, ওদিকে ঝামেলা! অসহ্য লাগছে এখন সবকিছু!
______________________°__________________
“প্রোবাবিলিটি আছে বাবা নেক্সট উইকে চলে আসবে।”
খেতে খেতে বললো শাহরিয়ার। ফারিয়া খাওয়া থামিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন।
“তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার?”
“হ্যাঁ।”
“কই, আমাকে তো একটু কল দেয় না? এতো কিসের ব্যস্ততা?”
ফারিয়া অসন্তোষের সাথে বললেন।
শাহরিয়ার খাওয়া থামিয়ে বললো,
“কী হয়ে গেছে তোমার, মা? জানোই তো ওখানে ঝামেলা চলছে? আমার সাথেও তো ঠিকঠাক প্রতিদিন কথা হয় না। আমি নিজেই কল দিয়েছি। তোমার কথা বলতে ইচ্ছে করলে তুমি কল দেও, কেউ বারণ করেছে?”
ফারিয়া সন্তুষ্ট হলেন না তবুও। সোহাইল এতো ব্যস্ত যে তাকে নিয়ম করে প্রতিদিন একটা কল দিতে পারে না? ওখানে গিয়ে ভুলেই গেছে বাসার সবাইকে!
অরোরা এসবের কিছুই শুনছে না। সে একহাতে খাচ্ছে, আরেক হাতে ফোন দেখছে।
শাহরিয়ার এই দৃশ্য দেখে আরো বিরক্ত হলো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
“আর এই যে ম্যাডাম, আপনি! আপনি সারাদিন ফোনেই ঢুকে থাকেন। দুনিয়া উল্টেপাল্টে যাক আপনার কিছু যায় আসে না তাতে! খাওয়ার সময়ও ফোন হাতে রাখা লাগে? ম্যানারলেস!”
অরোরাও বিরক্ত হয়ে বললো,
“তোমরা তোমাদের ক্যাচাল করছো, এতে আমি ইনভলভ হয়ে কী করবো শুনি? দুজন মিলে ক্যাচাল করছো এটা কি যথেষ্ট হচ্ছে না? আরেকজনেরও ঢুকা লাগবে?”
শাহরিয়ার বিস্মিত হয়ে মায়ের দিকে তাকালো।
“মা দেখো, কী বেয়াদব হয়েছে এই মেয়ে! কী রকম অসভ্যের মতো কথা বলছে!”
অরোরাও তেজের সাথে জবাব দিলো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার চোখে তো এখন সবাই অসভ্য, বেয়াদব তাই না? বউ গেছে, এখন বউয়ের উপর রাখা সব রাগ আমার উপর ঝাড়ছে! খাবোই না আমি এখানে!”
বলেই নিজের প্লেট আর ফোন নিয়ে রুমের চলে গেলো অরোরা।
হতভম্ব শাহরিয়ার এবং ফারিয়া সেদিকে চেয়ে রইলো। শাহরিয়ার হতভম্ব ভাব কাটিয়ে উঠে মায়ের দিকে জলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো।
ফারিয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত বললেন,
“ওকে আমি পরে দেখছি। তুই খাওয়া শেষ কর বাবা!”
_________________°_________________
“আম্মু আমাকে একটু কাঁচা আমের শরবত বানিয়ে দেও না, প্লিজ।”
জ্যোতি একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো।
রত্না ধনিয়াপাতা কুঁচি করতে করতে বললেন,
“তোর আব্বুকে ফোন লাগা, আম আনতে বল। বাসারগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে।”
জ্যোতি আচার খেতে খেতে বললো,
“আমি কেনো কল দিবো? তোমার বর, তোমার সংসার, তুমি কল দিয়ে আনতে বলবে যা আনার!”
রত্না কাটা থামিয়ে জলন্ত দৃষ্টিতে চাইলেন মেয়ের দিকে,
“খেতে তোর ইচ্ছে করছে না? আর তুই কল দিলে কী হবে?”
“আমার মুড নেই।”
রত্বা গজগজ করতে করতে বললেন,
“তা থাকবে কেনো? মুড তো থাকবে সারাদিন ফোনে ঝগড়া করতে!”
জ্যোতি অবাক হয়ে বললো,
“মানে? আমি আবার কার সাথে ঝগড়া করি?”
“দেখি না মনে হয় যেন আমি! ওই বান্দা কল দেয় আর তুইও কল ধরে ঝগড়া করিস। বিয়ের পর এতো ঝগড়ুটে হয়ে যাবি আমি কল্পনাও করিনি!”
জ্যোতির চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।
“আম্মু, তুমি কি ইদানীং বেশি ওই লোকটার সাইড নিচ্ছো না? সংসার আমি করেছি, আমি জানি ওই লোক কেমন!”
রত্না বললেন,
“ঝগড়াই যখন করবি তাহলে ফোন ধরিস কেনো? তোর আব্বুর কথামতো না ধরলেই তো হয়?”
“না ধরলে চৌদ্দ বার কল দিবে, তারপর কল ধরলে ধমকাবে! তারপরও যদি না ধরি তাহলে বাড়িতে এসে পড়বে! এজন্যই তো ধরা লাগে!”
“সে তো চৌদ্দ বার কল দেওয়ার পরই ধরিস। এতো বুঝলে সাথে সাথে ধরলেই তো হয়!”
জ্যোতি নাকের পাটা ফুলিয়ে মায়ের দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে উঠে গেলো সেখান থেকে। এমনিতেই ক্ষণে ক্ষণে মুড সুয়িং হয়। এখন অযথা কথা বাড়ানোর দরকার নেই।
নিজের রুমে এসে জানালার ধারে বিষন্ন মনে দাঁড়ালো। জানালাটা দিয়ে বাগান দেখা যায়।
গাছের পাতাগুলো ভিজে আছে। মাটিতে এখনো কয়েক জায়গায় পানি জমে আছে। বৃষ্টি হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। এখন এমন রোদ ঝলমলিয়ে উঠেছে যেন কিছুই হয়নি! নেহাৎ গাছের পাতা আর মাটি ভেজা দেখে বৃষ্টির চিহ্ন রয়ে গেছে।
সত্যি বলতে জ্যোতি ওর আব্বু আম্মুকে সবটা খুলে বলেইনি। অনেক কিছুই রাখঢাক করেছে সে। শাহরিয়ারের গায়ে হাত তোলাটা, আরো অনেক কিছুই বলেনি। আসলে লজ্জায়, সংকোচে এসব বলতে পারেনি সে। তবুও যা যা বলেছে মনে করেছিলো তার সিদ্ধান্তকে মেনে নেওয়ার জন্য হামজা এবং রত্নার জন্য সেসবই যথেষ্ট হবে।
আব্বুর জন্য যথেষ্ট হলেও মনে হচ্ছে না আম্মুর জন্য যথেষ্ট হয়েছে। নয়তো ওই লোকটার হয়ে সাফাই কীভাবে গাইছে? জ্যোতির ভীষণ কান্না পেলো। আম্মুও কি তাকে বুঝতে পারছে না?
ভাবনার মধ্যেই জ্যোতির ফোনটা বেজে উঠলো। রাগ হলো কোন মানুষটা কল করেছে সেটা আন্দাজ করে। কড়া কয়েকটা কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফোনের কাছে এসে হতাশ হলো।
সীম কোম্পানি কল করেছে!
সীম কোম্পানিও আর কল করার সময় পায় না! সবসময় এমন সময় কল করে যেন রিং শুনলেই মনে হয় ইমারজেন্সি কোনো কল! যত্তসব!
জ্যোতি কল কেটে ফিরে জানালার ধারে আসার জন্য পা বাড়াতেই আবার রিং হলো। জ্যোতির মেজাজ এবার পুরোপুরি খিঁচড়ে গেলো। রেগেমেগে আবার ফোনের কাছে এসে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
মাহিরা কল করেছে!
দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে রিসিভ করলো।
“আসসালামু আলাইকুম, ভাবী। কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, তুমি কেমন আছো? আসলে আমিই ফোন করতাম তোমাকে। কিন্তু ফোনে ব্যালেন্স ছিলো না।”
“আরে সমস্যা নেই। আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আঙ্কেল আন্টি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার ভাইয়া আচার দিয়ে গেছে। আমার ভীষণ উপকার হয়েছে আচারগুলো পেয়ে। সারাদিনই টক মিষ্টি কিছু না কিছু খেতে ইচ্ছে করে।”
মাহিরা হেসে বললো,
“জানি। আমারও একই অবস্থা হতো মহসিনের সময়।”
দুজনে মিলে টুকটাক কথা বলার পর মাহিরা হঠাৎ সংকোচ নিয়ে ডাকলো,
“ভাবী… ”
“হ্যাঁ, বলো?”
“তুমি কি এখনও আগের সিদ্ধান্ততেই অটল?”
জ্যোতি আড়ষ্ট বোধ করলো।
“হু!”
“আচ্ছা তোমরা কেউ কাউকে বুঝতে চাইছো না কেনো বলো তো? তোমাদের সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দেওয়া কি উচিত না?”
“মাহি, আমরা এই টপিকে কথা না বলি? আসলে আমার অস্বস্তি হয় এই প্রসঙ্গে কথা বললে।”
মাহিরা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো!
#চলবে…….
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১১
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
২মাস পরঃ
~~~~~~~~
“তুমি যাবে না তাহলে আমিও একা একা ওই লোকের সাথে যাবো না ডাক্তার দেখাতে!”
রত্না অধৈর্য হয়ে বললেন,
“জ্যোতি, তুই কি দিনদিন ছোট হোস? আমার পায়ের অবস্থা দেখতে পারছিস না? মেঝেতে পা ফেলতে পারছি না, এমন মচকানো মচকেছে! আমি কীভাবে যাবো? গেলে তোর বরের সাথেই যেতে হবে।”
জ্যোতি পানসে চেহারা নিয়ে মায়ের পাশে বসলো ছয় মাসের ভারী পেট নিয়ে,
“সেটাই তো বলছি। আমারও ডাক্তার না দেখালে চলবে। আমি ওই লোকের সাথে একা যেতো চাচ্ছি না। তুমি যেতে পারলেও একটা কথা ছিলো। এর আগেরবার তো গিয়েছি তুমিসহ ওই লোকের সাথে, কোনো কিছু বলেছি?”
“জ্যোতি, মা,আর জ্বালাস না তো! ও বাঘও না, ভাল্লুকও না যে তোকে খেয়ে ফেলবে। ডাক্তার দেখাতে তো যাওয়াই লাগবে, তোর কথামতো তো সব চলবে না, তাই না?”
জ্যোতি মনমরা হয়ে উঠে গেলো।
ঘন্টাখানেক পর শাহরিয়ার গেইটের সামনে দাঁড়ালো গাড়ি নিয়ে। জ্যোতিকেও নিরুপায় হয়ে উঠতে হলো গাড়িতে। আজকে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।
শাহরিয়ার ড্রাইভ করতে করতে জ্যোতিকে লক্ষ্য করে নরম সুরে বললো,
“কী হয়েছে? মন খারাপ?”
“না।”
“আন্টির পায়ের অবস্থা কি বেশি খারাপ?”
“হু, কয়েকদিন ভুগাবে।”
“থাক টেনশন নিও না, ঠিক হয়ে যাবে। কোনো দরকার হলে তো আমি আছি।”
জ্যোতি শাহরিয়ারের মুখে তাকালো সাথে সাথে। সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে কথাটা বলেছে সে। হুট করেই জ্যোতির মন খারাপ যেন তিনগুণ বেড়ে গেলো।
এই কারণেই সে শাহরিয়ারের সাথে একা আসতে চায়নি। ইদানীং মনের সাথে তার ভীষণ যুদ্ধ চলে। শাহরিয়ারের কেয়ারে জ্যোতির ক্ষোভে যেন ভাটা পড়তে শুরু করে। নিজের কাছেই জ্যোতি নিজে দুর্বল হয়ে যাবে এই ভয়েই দূরে দূরে থাকতে চায় সে শাহরিয়ারের থেকে। কিন্তু নিয়তির হয়তো অন্য কিছুই মঞ্জুর!
ডাক্তার দেখিয়ে কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় রেবেকার সাথে অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হলো তাদের দুজনের। রেবেকা দেখেই চিনলো এই অদ্ভুত দম্পতিকে।
“আরে! শাহবাজ সাহেব না? ওয়াইফকে নিয়ে চেকআপের জন্য এসেছেন বুঝি?”
শাহরিয়ার চিনতে পেরে একটু লজ্জা পেলো সেদিনের ঘটনা মনে পড়ায়। লজ্জিত স্বরে বললো,
“জ্বি।”
“তোমার কী অবস্থা? বেবি ঠিকঠাক আছে?”
জ্যোতির দিকে তাকিয়ে হেসে প্রশ্ন করলেন রেবেকা।
“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”
“তারপর? আপনাদের মধ্যে সব ঠিকঠাক চলছে? এখন কোনো ঝামেলা নেই তো?”
রেবেকা ভ্রু নাচিয়ে কৌতুক করে প্রশ্ন করলো।
এইবার শাহরিয়ার এবং জ্যোতি দুজনেই অপ্রস্তুত হলো।
শাহরিয়ার কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে জ্যোতি দ্রুত বললো,
“জ্বি, সব ঠিকঠাক চলছে।”
শাহরিয়ার তীর্যক দৃষ্টিতে তাকালো সহধর্মিণীর দিকে। চোখে বিস্ময়।
দুজনে দ্রুত রেবেকার থেকে বিদায় নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে এলো।
জ্যোতি গাড়িতে উঠলে শাহরিয়ার গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বিড়বিড় করে বললো,
“আমার জীবনে কী কিছু ঠিকঠাক চলছে? আমার জীবনে সবকিছুতেই ঝামেলা চলছে!”
জ্যোতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো শাহরিয়ারের দিকে।
“কী বিড়বিড় করছেন?”
“তুমি শুনেই বা কী করবে?”
“ওকে ফাইন! আমি শুনতেও চাচ্ছি না!”
গাড়ি চলতে শুরু করলো হাইওয়ে ধরে। কিছুটা সময় পর শাহরিয়ার নরম সুরে প্রশ্ন করলো,
“ডাক্তারের কাছে সব সমস্যা বলেছো তো?”
“হু বলেছি৷”
তারপর দুজনেই চুপ। শাহরিয়ার চাইছে জ্যোতি কথা বলুক। দরকার হয় ঝগড়াই করুক, তাও কথা বলুক। কিন্তু জ্যোতি যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। জানালা দিয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখছে সে একমনে।
“কিছু খাবে?”
জ্যোতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
“এখন? এই রাস্তায় কে খাবার নিয়ে বসে আছে আমার জন্য?”
“সামনেই একটা রেস্তোরাঁ আছে। সাথে ছোটখাটো আরো কয়েকটা দোকান আছে। ওখান থেকে কিছু নেওয়া যাবে।”
জ্যোতি চুপ করে রইলো। শাহরিয়ার মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলো।
দশ মিনিট পর শাহরিয়ারের বামের একটা রাস্তায় গাড়ি ঢুকালো।
“কোথায় গাড়ি ঢুকাচ্ছেন? আমরা তো সামনে যাবো।”
“দোকান এদিক দিয়েই।”
দুই তিন মিনিট গাড়ি চালিয়ে শাহরিয়ার এক জায়গায় থামলো। এখান থেকে একটু সামনেই একটা রেস্তোরাঁ দেখা যাচ্ছে। এর পাশেই একটা চায়ের দোকান। গুটিকয়েক মানুষ বসে আছে সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে।
“কী খাবে? আমার সাথে যাবে? তাহলে মেন্যু দেখে যেটা মন চাবে নিতে পারবে।”
“শাহরিয়ার, আপনি ফিরে চলুন প্লিজ, আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”
শাহরিয়ার অবাক হয়ে বললো,
“তাহলে যখন গাড়ি এই রাস্তায় ঢুকালাম তখন মানা করলে না কেনো?”
জ্যোতি আমতা আমতা করে বললো,
“আমি ভেবেছি আপনার ক্ষিদে পেয়েছে।”
শাহরিয়ার হতাশ হয়ে বললো,
“আমি আরও ভেবেছি তোমার ক্ষিদে পেয়েছে।… আচ্ছা, চা খাবে? নিয়ে আসবো?”
জ্যোতি শাহরিয়ারের জিজ্ঞাসু চেহারা দেখে কেনো যেন মানা করতে পারলো না। মনে হলো এতে যেন মানুষটার আন্তরিকতায় ঝাঁটা মারা হবে। তাই সায় জানিয়ে বললো,
“আচ্ছা…আনুন।”
“তুমি বসো, আমি নিয়ে আসছি কেমন?”
জ্যোতি ঘাড় কাত করে সায় জানায়।
শাহরিয়ার গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে যায় চায়ের দোকানের দিকে।
“দুটো মালাই চা দিয়েন তো। নতুন কাপ দিয়েন, কাপসহ দাম ধরবেন।”
দোকানীকে বলে শাহরিয়ার একটু সরে দাঁড়ালো সেখান থেকে। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো সবটা।
কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর দোকানীকে দাম মিটিয়ে দুটো নতুন মাটির পেয়ালায় করে চা নিয়ে শাহরিয়ার গাড়িতে বসলো। জ্যোতির দিকে একটা পেয়ালা বাড়িয়ে ধরলে জ্যোতি সেটা হাত বাড়িয়ে নেয়। জ্যোতি মনে মনে ভাবে সুগন্ধটা তো বেশ ভালো আসছে!
শাহরিয়ার নিজের কাপে চুমুক দিতে দিতে জ্যোতির মুখে নজর রাখলো, উদ্দেশ্য তার অভিব্যক্তি দেখা।
জ্যোতি কয়েক চুমুক দিয়ে প্রফুল্লচিত্তে বললো,
“বাহ! দারুণ তো!”
শাহরিয়ার সাথে সাথে খুশি হয়ে গেলো।
“তাই, না? আমারও বেশ ভালো লাগে। এর আগেও কয়েকবার খেয়েছি।”
দুজনে চুপচাপ চা পান করছিলো। এরমধ্যে জ্যোতি চা খেতে খেতেই শাহরিয়ারের মুখাবয়ব গভীরভাবে দেখছিলো। শ্যামবর্ণ মুখ, হালকা চাপদাড়ি, সোজা নাক। চোখ দুটো দেখতে ভীষণ কোমল- স্নিগ্ধ, দেখে বুঝার উপায় নেই বান্দার সোজা নাকের ডগায় সবসময় একগাদা রাগ ঘাপটি মেরে থাকে! কপালের বাম পাশে একটা মোটা কাটা দাগ আছে, শাহরিয়ার বলেছিলো ছোটবেলায় বাবার আসার সময় উত্তেজনায় দৌড়ে দরজা খুলতে গিয়ে এক্সিডেন্টটা হয়েছে। টাল সামলাতে না পেরে একেবারে দরজার হাতলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো৷ হাতলটাও ছিলো একদম চোখা অবস্থায় রাখা। একেবারে কপালে ঢুকে গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনার চিহ্নই শাহরিয়ারের কপালে আজীবনের জন্য জ্বলজ্বল করছে।
আর ঠোঁট…. জ্যোতি শাহরিয়ারের সাথে থাকাকালীন যখন শাহরিয়ার বিছানায় বসে মনোযোগের সাথে ল্যাপটপ কাজ করতো, কিংবা ঘুমিয়ে থাকতো, তখন জ্যোতি গভীর মনোযোগ দিয়ে শাহরিয়ারের ঠোঁট জোড়া পর্যবেক্ষণ করতো আর বিস্ময় নিয়ে ভাবতো একজন পুরুষ মানুষের ঠোঁট এতো গোলাপি কেনো হবে?
জ্যোতির বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। সাদা পাঞ্জাবিতে বরবেশে শাহরিয়ারকে যখন প্রথমবার দেখেছিলো তখন হতবাক হয়ে ভাবছিলো,
“এই লোক পাগল নাকি! লিপস্টিক দিয়ে এসেছে কেনো?”
বিয়ের পর এই ভ্রান্ত ধারণা ভেঙেছে। কথাটা মনে পড়তে পড়তেই জ্যোতি ফিক করে হেসে ফেললো।
জ্যোতির মনোযোগ নিজের চেহারায় বুঝতে পেরে শাহরিয়ার এক ভ্রু উঁচিয়ে দুষ্ট হেসে বললো,
“কী দেখছো?”
“আপনাকেই দেখছি!”
“আমি ধন্য হলাম! তা আমার মধ্যে কী দেখছেন ম্যাডাম?”
জ্যোতি রহস্যময় কন্ঠে বললো,
“দেখছি আপনার একই অঙ্গে কত রূপ!”
শাহরিয়ার ভড়কে গেলো,
“মানে?”
জ্যোতি তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মন্তব্য করলো,
“এইতো, আপনার পরিবর্তন দেখছি। কারণ কী?”
শাহরিয়ার হতাশ হয়ে বললো,
“তোমাদের বুঝা আসলেই মুসকিল! যখন খারাপ থাকি তখনও সমস্যা, যখন ভালো হওয়ার চেষ্টা করি তখনও রহস্য খুঁজো! আসলে তোমরা মেয়েরা খুশি হও কিসে সত্যি করে বলো তো?”
জ্যোতির চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। ঠোঁটে টিটকারির হাসি ফুটিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো,
“এইতো স্বীকার করেছেন আপনি খারাপ ছিলেন!”
শাহরিয়ার এইবার থতমত খেয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমার পরিবর্তন তোমার ভালো লাগছে না?”
জ্যোতির চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে নির্বিকার কন্ঠে বললো,
“আমি কীভাবে জানবো আপনার মধ্যে পরিবর্তন ঘটেছে কিনা? ঘটলেও কেমন পরিবর্তন ঘটেছে? আমি কি চব্বিশ ঘন্টা আপনার সঙ্গে থাকি?”
শাহরিয়ার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো জ্যোতির দিকে। কিছুক্ষণ একইভাবে তাকিয়ে রইলো।
“কী দেখছেন এভাবে? চোখ ফিরান, আমার অস্বস্তি লাগছে!”
শাহরিয়ার কেমন নরম কন্ঠে বললো,
“তাহলে থেকে যাও! রাখতেই তো চাইছি!”
জ্যোতি হকচকিয়ে গেলো। একটু ধাতস্থ হয়ে বললো,
“সময় ফুরিয়ে গেলে পরিবর্তন হয়ে কী ফায়দা? আপনি পরীক্ষার সময় প্রিপারেশন না নিয়ে পরীক্ষা শেষে প্রিপ্রারেশন নিলে কি সেই পরীক্ষা আবার দেওয়ার সুযোগ পাবেন?”
শাহরিয়ার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“সেই পরীক্ষা দেওয়া যায় না সত্যি, কিন্তু রিটেক দেওয়ার সুযোগ ঠিকই থাকে!”
____________________°_________________
শাহরিয়ার জ্যোতিকে নামিয়ে দিয়ে গেইট থেকেই রত্নার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেছে। জ্যোতির সাথে টু শব্দটুকু পর্যন্ত করেনি। পুরো রাস্তাতেও চুপচাপ ছিলো।
বিষয়টা জ্যোতির মনে খচখচ করা আরম্ভ করে দিয়েছে। বান্দার ঢঙ দেখো! এখনও রাগ দেখায়, আশ্চর্য! যাকগে! তার কী!
“তোর আব্বু আমার সাথে অনেক রাগারাগি করেছে। রুমে আছে, গিয়ে দেখা করে আয়।”
জ্যোতি রত্নার কথা বুঝতে না পেরে বললো,
“কেনো? রাগারাগি করেছে কেনো?”
রত্না হতাশ হয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোকে একা শাহরিয়ারের সাথে কেনো পাঠিয়েছি তাই! উনার ভাব দেখলে মনে হয় আমি একটা মার্কা মারা সন্ত্রাসীর সাথে তোকে পাঠিয়ে দিয়েছি!”
মায়ের কথার ভঙ্গি দেখে জ্যোতি খিলখিল করে হেসে ফেললো। জ্যোতিকে এভাবে হাসতে দেখে রত্না মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,
“হাসিস না, হাসিস না, এভাবে হাসিস না! তোদের যুদ্ধে তোদের কিছু হোক বা না হোক আমার অবস্থা ঠিকই কাহিল!”
“তো তুমি বিরোধী দলে যোগ দিচ্ছো কেনো?”
রত্না অবাক হয়ে বললো,
“আমি বিরোধী পক্ষে আছি মানে? পাগল হয়েছিস? তোদের বাপ বেটির এই এক সমস্যা, যত দোষ নন্দ ঘোষের মতো আমার উপর সবকিছুর দায়ভার চাপিয়ে দেস! ভাল্লাগে না আমার আর এগুলা!”
বলেই রত্না রাগে সেখান থেকে চলে গেলেন।
________________°_______________
“আব্বু, ডেকেছো?”
হামজা সাহেব ঘরেই ছিলেন। শীতল কণ্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, ডেকেছি।”
জ্যোতি সংকোচ নিয়ে বললো,
“কিছু বলবে? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”
হামজা সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
“তোকে না বলেছি ওই ছেলের থেকে দূরে থাকতে? তাও কেনো গেলি ওর সাথে একা?”
জ্যোতি অপরাধীর মতো করে মাথা নিচু করে বললো,
“আম্মুর সাথেই তো সবসময় যাই। কিন্তু জানোই তো আম্মুর পা মচকে গেছে কালকে। এজন্যই যাওয়া লেগেছে।…… তাছাড়া হাসবেন্ড না নিয়ে গেলে ডাক্তারও অনেক প্রশ্ন করে।”
হামজা সাহেব কিছু বলতে উদ্যোত হয়েছিলেন, কিন্তু জ্যোতি শেষ কথাটা বলতেই থেমে গেলেন।
কিছুক্ষণ মৌন থেকে ধীমি আওয়াজে বললেন,
“আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছিলাম তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আচ্ছা থাক, যা হওয়ার হয়েছে।…তোর কিছু লাগলে আমাকে নয়তো তোর আম্মুকে বলিস, আমি এনে দিবো।”
জ্যোতি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলো৷ শাহরিয়ার নিজেই আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছে যা লাগবে তাকে যেন জানায়। কিন্তু আব্বুকে এই কথা বললে কী রিয়েক্ট করে বসে এজন্য আর জানালো না জ্যোতি।
শুধু মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে চলে এলো।
আব্বু শাহরিয়ারকে এখন একদমই দেখতে পারেন না। সেদিন তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছে জ্যোতি সেটা এখনও জানে না। কিন্তু এটা জ্যোতি বেশ বুঝতে পারছে তাদের মধ্যে স্বাভাবিক কোনো কথা হয়নি। নয়তো সেদিনের পর থেকে আব্বু শাহরিয়ারের উপর এতো ক্ষ্যাপা হবে কেনো?
__________________°________________
রাতে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে ফারিয়া হঠাৎ বললেন,
“তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো সোহাইল।”
সোহাইল সাহেব টেবিলে বসে কিছু কাগজপত্র ঘাটছিলেন। স্ত্রীর কথা প্রত্যুত্তরে বললেন,
“কোন বিষয়ে?”
ফারিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন,
“অরোরার বিয়ের বিষয়ে। মাহমুদা ওর মাহমুদের জন্য অরোরাকে নিতে চাইছে।”
সোহাইল সাহেব কাজ থামিয়ে ঘুরে বসলেন ফারিয়ার মুখোমুখি। ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“কবে বলেছে?”
“আরো আগেই বলেছে। তুমি দেশে ছিলে না, তাই বলেছি তুমি এলে কথা বলে দেখবো। কিন্তু আমার আর খেয়াল ছিলো না। আজকে আবার এই কথা তুলেছে ও।”
সোহাইল সাহেব চিন্তিত হয়ে বললেন,
“তুমি কী ভাবছো?”
ফারিয়া একটু থেমে কিছু ভাবলেন।
“আমার কাছে মন্দ মনে হচ্ছে না। মাহমুদ আমার চোখের সামনেই বড় হয়েছে। নম্র ভদ্র ছেলে। কিছুদিন আগেই ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। এখন জব তালাশ করছে। মাহমুদা বলেছে জব পেলেই বিয়ের কথা আগাবে।
অরুর সাথে ভালোই মানাবে, কী বলো? আমার তেমন কোনো অমত নেই।”
“তোমার আমার মত-অমত নিয়ে তো কিছু হবে না, তাই না? অরোরার মত থাকা লাগবে। ওর সাথে কথা বলেছো এ নিয়ে?”
“না, আমি তো বলেছিই আগে তোমার সাথে কথা বলে তারপর দেখবো। তুমি রাজি থাকলে অরুকে জানাবো। ওও যদি রাজি থাকে তাহলে বিষয়টা নিয়ে সামনে আগানো যাবে।”
“আচ্ছা, এখনই ওকে কিছু বলার দরকার নেই। মাহমুদ জব পেয়ে নিক, তারপর চিন্তা করা যাবে। তোমার বোনকেও জানিয়ে দিও এই কথা।”
ফারিয়া রাজি হলেন। এমনিতেও তিনিও একই কথা ভাবছিলেন। সব ঝামেলা শেষ করে তারপর অরুর বিয়ের বিষয়টা ধরবেন।
_____________________°____________________
শাহরিয়ার বেলকনিতে কয়েকটা নতুন ফুলের টব লাগিয়েছ। কয়েকটা লতানো চারাও লাগিয়েছে দেয়াল ঘেষে। নিজেই যত্ন নেয় গাছগুলোর, নিয়ম করে সকাল বিকাল পানি দেয় আর অপেক্ষায় থাকে প্রথম ফুল ফোটার।
বেখেয়ালি মনে ভাবে জ্যোতি এগুলো দেখলে ভীষণ খুশি হবে। হুশ ফিরতেই আগের সব কথা মনে পড়ে, পরক্ষণেই তাই আবার গম্ভীর হয়ে যায়। দূরত্ব আসলেই মানুষকে অনেক কিছুই বুঝিয়ে দেয়। মানুষের জীবনে কার গুরুত্ব কতটুকু সেটাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু আফসোস! ততক্ষণে সময় ফুরিয়ে যায়, দেরি হয়ে যায় অনেক……
হয়তো জ্যোতি আর তার মধ্যে আর কোনো কিছুই স্বাভাবিক হবে না….। আল্লাহই জানে উনি কী পরিকল্পনা করে রেখেছেন সামনের জন্য।
একটা হতাশার শ্বাস বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে তার। মনের সাথে এতদিনের যুদ্ধে নাস্তানাবুদ অবস্থা তার। সত্যি বলতে এখন সেও চায় না তাদের ডিভোর্স হোক। কিন্তু সংকোচে জ্যোতিকে বলতেও পারে না। তাছাড়া ফারিয়া ধরেই নিয়েছেন তাদের ডিভোর্সই হবে, উনি চাচ্ছেনও তাই। জ্যোতির ব্যবহারেও আগের থেকে অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, আগের সেই নমনীয়তা জ্যোতির মধ্যে এখন আর নেই। কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে গিয়েছে মেয়েটা।
স্বাভাবিক, মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন মরিয়া হওয়া ছাড়া উপায় নেই!
#চলবে………