#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৪
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“ভাইয়া, আসবো?”
মাহিরা দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করলো।
শাহরিয়ার কোলের উপরে ল্যাপটপ নিয়ে কিছু একটা করছিলো। বোনের কথায় ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বললো,
“হু, আয়।”
তারপর আবার ল্যাপটপে মনোযোগ দিলো।
মাহিরা বিছানায় ভাইয়ের থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসলো। মনোযোগ দিয়ে ভাইকে দেখতে লাগলো চিন্তিত মুখে।
“এভাবে কী দেখছিস? যা বলতে এসেছিস বলে ফেল।” শাহরিয়ার স্ক্রিনে চোখ রেখেই ব্যস্ত কন্ঠে বললো।
“ভাবীর সাথে আলোচনা করেছো?”
“কী নিয়ে?”
“আজব! বুঝতে পারছো না কী নিয়ে কথা বলছি? মিটমাট করার চেষ্টা করেছো? উকিলের থেকে এসেছো তো দশ দিন পার হয়ে গেছে। সময় এভাবে নষ্ট করছো কেনো?”
“তোর ভাবীরই সময় হচ্ছে না আমার সাথে কথা বলার, হাহ্! ফোন দিলে এতো ব্যস্ততা দেখায় যে কথাও বলে না। আলাদা দেখা করতে বলি সেটাতেও হা-না কিছু বলছে না। আমি আর কী করবো?”
“জুবায়েরকে দেখতে যাও না?”
“রেগুলার যাওয়া হয় না। লাস্ট গিয়েছি দুদিন হয়েছে। রেগুলার ভিডিও কলে যা একটু দেখি। আমি গেলে জ্যোতি কেমন যেন অকওয়ার্ড হয়ে যায়। আর আঙ্কেলের সামনে পড়লে আমি অকওয়ার্ড হয়ে যাই। এজন্য যেতেও কেমন যেন লাগে। কী একটা অবস্থা!”
“আসলেই! আচ্ছা, তুমি আন্টির সাথে কথা বলেছো?”
“কোন বিষয়ে?”
“এইযে, ভাবীর সাথে কথা বলার জন্য। কাউকে না কাউকে তো লাগবে বুঝানোর জন্য, তাই না?”
শাহরিয়ার ল্যাপটপ সরিয়ে বোনের দিকে শীতল চাহুনি মেলে বললো,
“তুই যা বলছিস ভেবেচিন্তে বলছিস তো? উনি জ্যোতিকে কী বুঝাবে? হাজার হোক, জ্যোতি উনার মেয়ে।”
“সেটাই তো! জ্যোতি উনার মেয়ে! আর তার মেয়ে একটা সন্তানের মা। তোমার কি মনে হয় উনি খুশিখুশি চাইবেন এই অবস্থায় তার মেয়ের ডিভোর্স হোক? কোন না-ই বা চাইবে? তাছাড়া জ্যোতির সারাটা জীবন তো এখনও পড়েই আছে!”
শাহরিয়ারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। মাথা এখন আর কাজ করে না ঠিক মতো। মানসিক অশান্তিতে আর ভোগাটা সম্ভব হচ্ছে না তার দ্বারা। কম তো হলো না! ছয় সাতটা মাস ধরে তো ভোগ করছে!
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হয় বছরখানেকের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কিন্তু চাইলেই কি তা সম্ভব?
ভাইকে চিন্তায় দেখে মাহিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আচ্ছা আমি দেখছি, বিকেলের দিকে যাবো জুবায়েরকে দেখতে। তখন পারলে কথা বলবো ওর সাথে।
….আর তুই একটু তোর শাশুড়ির মন গলানোর চেষ্টা কর। বলে দেখ জ্যোতির সাথে একটু কথা বলে দেখতে। আমার মনে হয় কাজে দিলেও দিতে পারে এটা। আমি যেহেতু একটা মেয়ে, তাই মেয়েদের সাইকোলজি একটু আধটু হলেও বুঝি।”
“হু। দেখবোনে কথা বলে।”
মাহিরা তারপরও ঠায় বসে রইলো সেখানে। কিছুক্ষণ পর শাহরিয়ার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললো,
“আর কিছু বলবি নাকি?”
মাহিরা কেমন সহানুভূতির ভঙ্গিতে চুক চুক করে বললো,
“আমি দেখছি, মানুষ আসলেই দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না। দাঁত গেলে তখন আবার আফসোস করে কূল পায় না!”
শাহরিয়ার কড়া দৃষ্টিতে তাকালো মাহিরার দিকে।
“তোকে কি কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়ার জন্য কোনো পারিশ্রমিক দিই আমি? তাহলে এমন বেকার খাটনি খাটছিস কেনো? কবে ধরে দাতা হাতেমতাঈ হলি?”
মাহিরা ভাইকে মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেলো। ভাইয়ের জন্য একধারে তার দুঃখ হচ্ছে, আবার পৈশাচিক আনন্দও পাচ্ছে। তখন তো সে কত বুঝাতো, কিন্তু ভাই তার কথা শুনলে তো! তখন যদি বোনের কথা শুনে নিজের স্বভাব একটু চেঞ্জ করার চেষ্টা করতো তাহলে এখন এই বিতিকিচ্ছিরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না!
_____________________°__________________
মাহিরা জুবায়েরকে কোলে নিয়ে কতক্ষণ ধরে বকরবকর করে যাচ্ছে একনাগাড়ে ভাইপোর সাথে। জুবায়ের কিছু বুঝুক বা না বুঝুক, হাত পা ছুড়ে যেভাবে পারছে নিজের আনন্দ প্রকাশ করছে।
জ্যোতি ওজু করে এসে একবার সেদিকে তাকিয়ে পাশের রুমে এসে আসরের নামাজ পড়তে শুরু করলো।
রত্না এক মনে মাহিরা এবং জুবায়েরের খুনসুটি দেখছিলো মুচকি মুচকি হেসে।
জ্যোতি অন্য রুমে গেলে মাহিরা সেটা লক্ষ্য করে রত্নার কাছাকাছি এসে গুরুতর ভঙ্গিতে বললো,
“আন্টি, আপনি ওকে একটু বুঝাতে পারেন না? এভাবে বিনা ডিফেন্সে ময়দান ফাঁকা ছাড়ার কোনো মানে হয়?”
মাহিরার আচমকা এমন কথায় রত্না একটু হকচকিয়ে গেলেন। দায়সারা ভাবে বললেন,
“আমি কী বুঝাবো ওকে? ওর জীবন, কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সেটা তো ও-ই বেশি ভালো বুঝতে পারবে তাই না?”
“তারপরও আন্টি, আপনি সময় সুযোগ পেলে একটু বুঝানোর চেষ্টা করেন। ওকে বলুন ভাইয়াকে একবার সুযোগ দিয়ে বাসায় ফিরে আসতে, তারপরও যদি একই অবস্থা হয় তাহলে আমি নিজে ওর সাপোর্টে থেকে ওদের ঝামেলা একেবারে ডিসক্লোস করে দিবো।”
“জ্যোতির আব্বু চাচ্ছে না ও ফেরত যাক। এখন আমি কী বলি এর মধ্যে বলো? ওর আব্বু পরে আমার উপর রাগ করে থাকবে।”
“আপনিও কি এটাই চাচ্ছেন?”
রত্না মনে মনে বললেন,
“কোন মা চায় নিজের মেয়ের সংসার ভাঙুক?”
কিন্তু মুখে কিছু বললেন না।
রত্নাকে চুপ করে যেতে দেখে মাহিরাও আর কথা বাড়ালো না।
_________________°________________
“ভাবী, এবার তো ইগো সাইড করে রাখো প্লিজ। আর কত বলো তো? ভাইয়াও এখন চেঞ্জ হয়ে গেছে।”
জ্যোতি শান্ত কন্ঠে বললো,
“তোমার কাছে যেটা ইগো মনে হচ্ছে আমার কাছে সেটা সেল্ফ রেসপেক্ট, মাহি।”
“সেল্ফ রেসপেক্ট দেখিয়ে যদি নিজের মূল্য না জানিয়ে চলেই যাও তাহলে কী লাভ হবে বলো তো? এখন তুমি ছেড়ে দিলে যেই কারণে তুমি এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছো সেটা তো ঠিকই পূর্বের মতো থাকবে, তাই না?”
“মানে?”
“তোমার উচিত নিজের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সেখানে নিজের সেল্ফ রেসপেক্ট দেখানো। এখন তুমি যদি নিজেকে জাহির না করে সরেই যাও তাহলে কী ফায়দা? যেই আম্মুর জন্য তুমি এখন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছো, নিজেকে ক্রমাণ না করে তোমার চলে যাওয়াতে কি তার মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আসবে? তারচেয়ে ভালো না সেখানে গিয়ে যারা যারা তোমার প্রতি বিরূপ আচরণ করছে, তাদের তোমার প্রতি ধারণা পাল্টে দেওয়া? আগে বিষয়টা কঠিন ছিলো ভাইয়ার সাপোর্ট ছিলো না দেখে। এখন তো ভাইয়ারও সাপোর্ট আছে। সবচেয়ে বড় কথা তুমি এখন শাহবাজ বংশের উত্তরাধিকারীর জননী। নিজের অধিকার, দাপট এভাবে হাসিল হওয়ার আগেই ছেড়ে দিবে কেনো?”
জ্যোতি খুব বিষাদগম্ভীর গলায় বললো,
“আমি যত যাই করি না কেনো, আমার প্রতি তোমার মায়ের ধারণা কখনোই বদলাবে না। আসলে আমাদেরই ভুল ছিলো, নিজেদের অবস্থানের দিকে না তাকিয়ে অপেক্ষাকৃত বড় অবস্থানের পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়া৷ উনি আমার এই ভুলটা আমার পাঁচ মাসের সংসার জীবনে এতো বেশি উপলব্ধি করাতে বাধ্য করেছন যে এখন আমি……..। যাকগে, বাদ দিই সেসব পুরোনো কথা।”
মাহিরা জ্যোতির হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে আবেগপ্রবণ কন্ঠে বললো,
“ভালো খারাপ মিলিয়েই তো মানুষ, তাই না? আম্মুকে তুমি যতটা খারাপ ভাবছো আসলে তিনি অতটাও খারাপ না। উনি একপ্রকার জেদের বশে এসব করছেন। চেয়েছিলেন নিজের ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বউ করে আনবেন। কিন্তু আব্বু রাজি হলেন না। এজন্য তোমাদের বিয়েতেও আম্মুর মত ছিলো না। যেদিন তাঁর জেদের দর্পণ ভেঙে যাবে, সেদিন দেখবে তিনি নিজেই গভীর অনুতাপে জর্জরিত হয়ে উঠেছেন। এতদিন সবর করেছো, দয়া করে আরেকটু সবর করো।”
জ্যোতি চুপ করে মাহিরার কথাগুলো শুনে গেলো।
___________________°_________________
রাত বাজে ১১ টা। ঘরের ম্লান আলো অন্ধকারের সাথে যুদ্ধ করছে। শাহরিয়ার বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে শেষমেশ ডায়াল করলো “আন্টি” লেখা নাম্বারটায়।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এলো।
“হ্যালো?”
শাহরিয়ার একটু থেমে নরম গলায় বললো,
“আন্টি, আসসালামু আলাইকুম, আমি… শাহরিয়ার বলছি।”
রত্না স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ শাহরিয়ার, বলো। এত রাতে ফোন করেছো?”
“আসলে আন্টি…. আপনার সাথে একটু কথা ছিলো।”
রত্না সম্ভবত আঁচ করতে পারলেন শাহরিয়ার কী বলতে চাইছে। তাই কন্ঠে কোনোরকম তারতম্য না ঘটিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ, বলো, শুনছি।”
শাহরিয়ারের কন্ঠে অনিচ্ছাকৃত ভাবেই এক কম্পন সৃষ্টি হলো, মৃদু কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আন্টি, আসলে অনেক দ্বিধায় ভোগে অবশেষে আপনাকে কল করেছি, কীভাবে না কীভাবে নেন বিষয়টা…। আমি… আমি আসলে জ্যোতির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। কিন্তু ও তো কিছুতেই শুনছে না। আপনি… আপনি ওকে একটু বোঝান, আন্টি?”
রত্না একটুখানি চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন,
“আসলে ওর অভিমানের পারদ এখন অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। এজন্যই এখন কারো কথা শুনতে চাইছে না। তুমি যদি শুরু থেকেই একটু হলেও ওকে বুঝতে তাহলে……”
রত্না চুপ করে যায়।
শাহরিয়ার অনুনয় করে বললো,
“আমি জানি, আন্টি… আমার অনেক ভুল হয়েছে। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি, ও কী চাইতো, কী দরকার ছিলো। আপনি শুধু ওকে বলুন, একবার আমার সঙ্গে বসুক। কথা বলুক। আমি সব ঠিক করতে চাই। জুবায়েরের মুখের দিকে তাকালেও…।”
রত্নার কন্ঠে এবার একটু নরম হয়,
“আমি জানি, তুমি খারাপ ছেলে নও। কিন্তু জ্যোতির কষ্টটা খুব গভীরে গেঁথে গেছে। জ্যোতি, সত্যি বলতে, নিজের ভাঙা মনটা আবার তুলে ধরার মতো শক্তি পাচ্ছে না।”
শাহরিয়ার তড়িঘড়ি করে বললো,
“আমি ওকে আমার পাশে চাই, আন্টি! শুধু এখনের জন্য নয়, সবসময়ের জন্য! যত দেরি হোক, আমি অপেক্ষা করবো ওকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আপনি শুধু ওকে বলুন একবার আমার ভুলগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমার কাছে ফিরে আসতে। এরপর ও যত চায় তত প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি আছি আমি। কিন্তু এভাবে বিচ্ছেদ তো না ঘটাক!”
শাহরিয়ারের শেষ কথাটায় ফুটে উঠলো নিদারুণ অসহায়ত্ব।
রত্নার খারাপই লাগলো ছেলেটার জন্য। কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগে শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“আমি চেষ্টা করব, শাহরিয়ার। কিন্তু মনে রেখো, কিছু জিনিস শুধরে নিতে সময় লাগে। আর…. কিছু সম্পর্ক নিজেকে নতুন করে গড়তে হয়। আমি নাহয় তোমার কথায় ওকে বুঝিয়ে বলবো, কিন্তু তারপরও তোমার উচিত হবে ওর সঙ্গে নিজে কথা বলা, নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা।”
“আমি ওকে কয়েকবারই অফার করেছি একা কথা বলার জন্য। কিন্তু ও বারবার জুবায়েরের অজুহাতে এড়িয়ে যায়।”
“আচ্ছা আমি ওর সাথে কথা বলবো যেন তোমার সাথে আলাদাভাবে দেখা করে কথা বলে। তুমি কালকে কল করে আরেকবার বলো ওকে।”
“আচ্ছা। কিন্তু আপনি রাখতে পারবেন জুবায়েরকে এতক্ষণ একা একা?”
“না, এটা করো না ভুলেও। জুবায়েরকে সাথে নিতে বলবে ওকে। চোখের সামনে নিজের সন্তানের নিষ্পাপ মুখ থাকলে, একজন মা এমন অনেক কঠিন সিদ্ধান্তও অবলীলায় নিয়ে ফেলতে পারে, যা অন্য সময়ে নিতে হলে তাকে বহুবার ভাবতে হতো, দ্বিধায় পড়তে হতো।”
শাহরিয়ার সম্মত হলো শাশুড়ির কথায়।
#চলবে……..
#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ১৫
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
“আজই তোর বিয়ে, এখনই।”
রত্না আচমকা এসে জ্যোতির হাতে একখানা লাল শাড়ি গুঁজে দিলেন। জ্যোতি হতভম্ব হয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। বিস্ময়ের ঘনঘটায় তার মনে কোনো প্রশ্ন ফুটে উঠার আগেই দেখলো কয়েকজন মিলে তাড়াহুড়ো করে যেনতেন ভাবে শাড়িটা তার গায়ে পরিয়ে দিলো। পুরো ঘটনাই জ্যোতির সামনে হচ্ছে, কিন্তু সে যেন কিছুই বলতে পারছে না।
এরপর দ্রুত তাকে কবুল বলার জন্য নির্দেশ দেয়া হলো। জ্যোতি একেবারে যন্ত্রের মতো বাধ্যগতভাবে তাই করলো।
এবার তাকে নিয়ে যাওয়ার পালা। জ্যোতি তাড়াতাড়ি জুবায়েরকে কোলে করে নিয়ে এলো ছেলেকে সাথে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হঠাৎই কেউ একজন হ্যাঁচকা টানে তার কোল হতে জুবায়েরকে কেড়ে নিলো। জ্যোতি চিৎকার করে ধরতে চাইলো, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই জুবায়ের তার হাতের নাগালের বাইরে প্রায় দশ হাত দূরে চলে গেলো।
পাশ থেকে একটা নির্মম কণ্ঠ ভেসে এলো,
“তোমার নতুন সংসারে আগের ঘরের ছেলেকে নিতে পারবে না, মেয়ে!”
জ্যোতি আঁতকে উঠে জুবায়েরের দিকে তাকায়। তীব্র আতংক নিয়ে দেখে রত্নার কোলে ছটফট করতে করতে ছোট্ট জুবায়ের তার দিকে হাত বাড়িয়ে কাঁদছে। কী ভয়ার্ত, অসহায়, বুকফাটা কান্না!
জুবায়ের কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে……
ছেলের কান্নার মর্মান্তিক শব্দে জ্যোতির বুক যেন চিরে যাচ্ছে!
জ্যোতির তন্দ্রা ছুটে গেলো আচমকাই। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। একটু ধাতস্থ দেখলো সে এতক্ষণ যাবত দুঃস্বপ্ন দেখছিলো। পুরো শরীর ঘামে নেয়ে গেছে ততক্ষণে। আর পাশেই, বাস্তবেই, তার জুবায়ের কাঁদছে। ছেলের কান্নার শব্দেই ঘুম ভেঙেছে তার।
জ্যোতি এক ঝটকায় ছেলেকে বুকে টেনে নিলো, যেনো এইবার আর কেউ তাকে কাড়তে না পারে। নিজের অশান্ত মন নিয়ে ছেলেকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালালো।
কিছুক্ষণ পর জুবায়ের তার বুকেই ঘুমিয়ে গেলো আবারও। জ্যোতি তারপরও ছেলে বুকে চেপে দোল দিতে লাগলো। বাঁধন আরও একটু শক্ত করে নিজের সাথে আরো লাগিয়ে রাখলো। দুঃস্বপ্নের রেশ এখনও কাটেনি তার।
আনমনে ভাবতে লাগলো রাতের কথা।
~~~
রাত তখন পৌনে বারোটা। জুবায়ের কিছুতেই ঘুমাচ্ছিলো না। বহুকষ্টে সবে একটু তন্দ্রমতন লেগে এসেছে জুবায়েরের, এমন সময় রত্না হঠাৎ রুমে এসে বললেন,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। জুবায়ের ঘুমিয়েছে?”
জ্যোতি কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের মুখের দিকে তাকায়। রত্না যখন খুব সিরিয়াস থাকে বা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে চায় তখন জ্যোতিকে এভাবে ‘তুমি’ করে সম্মোধন করে।
“আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, ঘুম পাড়িয়ে নেও তাহলে। আমি অপেক্ষা করছি।”
জ্যোতি জুবায়েরকে শুইয়ে দিয়ে মায়ের কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।
“কিছু বলবে, আম্মু?”
“হ্যাঁ, বসো পাশে।”
জ্যোতি বসলো। রত্না কিছুক্ষণ চুপ করে বললেন,
“দেখো, তুমি আমার মেয়ে, তোমার দিকটাই আমি সবার আগে দেখবো।”
জ্যোতি অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলো,
“এভাবে ফর্মালিটি মেইনটেইন করে কথা বলছো কেনো? ভালো লাগছে না। নরমাল টোনে কথা বলো।”
“আমি চাই তুমি আমার কথায় গুরুত্ব দেও। আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে, বলো তুমি।”
রত্না একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গম্ভীর হয়ে বললেন,
“দেখো, আমি বাস্তববাদী একজন নারী। বয়সে তোমার থেকে ঢের বড়, অভিজ্ঞতাও তোমার থেকে ঢের বেশি। আমি আমার জীবনে অনেক কিছুই চাক্ষুষ দেখেছি, অনেক ঘটনাই শুনেছি, কিন্তু কোনো মন্তব্য করার প্রয়োজনটুকু বোধ করিনি। কিন্তু বিষয়টা যখন আমার নিজের মেয়েকে ঘিরে, সেখানে আমার মন্তব্য করা, পরামর্শ দেওয়া উচিত।”
রত্না একটু থেমে সরাসরি তাকায় মেয়ের দিকে। আবার বলা শুরু করে,
“আমি জানি তুমি নিজেকে শক্ত করে গড়ে তুলতে চাইছো যাতে আর কেউ তোমায় ভেঙে গুড়িয়ে দিতে না পারে। এটা অবশ্যই ভালো কিছু, আমি এপ্রিশিয়েট করি। কিন্তু আমি এও জানি তুমি নিজেকে যতটা শক্ত ভাবছো তুমি আসলে ততটা নও। তোমাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি, এতো বছর নিজের সাথে আগলে রেখেছি তাই তোমার তুমি প্রতিটা শিরা-উপশিরা সম্পর্কে আমি অবহিত। একজন নারীর জীবন সোজা নয়, জ্যোতি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পাড় করে টিকে থাকতে হয় একটা মেয়েকে এই পৃথিবীতে। একটা মেয়ের নিজের ঘরের চৌকাঠ পাড় হওয়ার পর পৃথিবী বিকট হয়ে তার সামনে ধরা দেয়। চেনা পৃথিবী মূহুর্তেই অচেনা হয়। এটা তুচ্ছ কোনো বিষয় না। …..তুমি শুনছো আমার কথা?”
জ্যোতি ধীরে মাথা নেড়ে সায় জানায়।
রত্না আবার বলতে থাকেন,
“দেখো, কোনো মা-ই চাইবেন না তার নিজের মেয়ের সংসার ভাঙুক। কিন্তু আমি তোমার উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছি। তবুও আমার দায়িত্ব থাকে তোমাকে বুঝানোর। কথাগুলো তোমাকে আজ হোক, কাল হোক, আমি বলতাম-ই। তোমার বাবা ঠান্ডা মাথার মানুষ। কিন্তু একটা জিদ পেয়ে বসলে তাকে থামানো কঠিন। এতো বছর ধরে সংসার করছি আমি, আমি জানি তার বৈশিষ্ট্য। তোমাকে উনি পুতুলের মতোন করে বড় করেছেন। কোনো আঁচ আসতে দেননি কখনো। ছোট বেলায় তুমি কোনো ভুল করলে আমি শাসন করলে আড়ালে আমাকে শাসন করতেন। সেই মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভালো নেই এই ব্যপারটায় উনি বিশাল হিট খেয়েছেন। মানতেই পারছেন না। এটা মানার মতো বিষয়ও না। এজন্যই এমনভাবে ক্ষেপে গেছেন। ক্ষেপেছি আমিও, তুমি আমারও আদরের মেয়ে। কিন্তু তাই বলে আমি পারিপার্শ্বিক বিবেচনা করা ছাড়িনি।”
রত্না একটু থেমে দম নিলেন। হাঁপিয়ে উঠেছেন একটানা কথা বলতে বলতে।
“দেখো, আমি বাস্তব কিছু কথাই বলি। এখন সবকিছু যতটা ফকফকা দেখাচ্ছে বিষয়টা আদতে এতটা স্বচ্ছ না। তোমার মনে হতে পারে তুমি তোমার সন্তান নিয়ে বাকিটা জীবন একা কাটিয়ে দিবে, ঠিক যেমন আরও অনেকে করছে। কিন্তু এটা এতো সহজ না। আমরা তোমার বাবা-মা হিসেবে তোমাকে এভাবে দেখতে পারবো না, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হবে। বয়স কতই বা তোমার? সবে বাইশ! আল্লাহ হায়াত দিলে এখনো পুরো জীবন পরেই আছে সামনে। এরপর দেখা যাবে একসময় আমাদের চাপাচাপিতেই তোমাকে আরেকবার বিয়েতে সম্মত হতে হচ্ছে। এরপর হয়তো বিয়েও হবে। কিন্তু বিয়ের পর যদি তারা তোমার জুবায়েরকে ঠিক ভাবে না নেয়? মা হয়ে তুমি সেটা সহ্য করতে পারবে?”
জ্যোতি শক্ত করে বললো,
“এখন তুমি কী বলতে চাইছো?”
“এবার আমি আসল কথায় আসি। শাহরিয়ার কল দিয়েছিলো আমাকে। সে তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলতে চাইছে৷ তুমি একটু শুনো তার কথা, তারপর যা ভালো বুঝুো, যা ভালো মনে করো, করে দেখো। আমাকে বলেছে আমি যেন তোমার সাথে কথা বলি, একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। ও না বললেও আমি শেষ একবার তাই করতাম।”
“এখন তুমি চাচ্ছো আমি ফিরে যাই?”
“আমি চাচ্ছি তুমি তোমার সংসারটাকে আরেকটা সুযোগ দেও। দীর্ঘ কয়েকটা মাস কেটে গেছে তোমরা আলাদা আছো। একবার গিয়েই দেখো, সত্যিই কোনো কিছু বদলেছে কিনা। না বদলালে তুমি সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে আসবে জুবায়েরকে নিয়ে। একটা কথা মনে রেখো, আমি সব অবস্থায় তোমার পাশে আছি ইনশাআল্লাহ।”
জ্যোতি চুপ করে রইলো। রত্না কিছুক্ষণ থামলেন, অপেক্ষায় রইলেন জ্যোতি কিছু বলে কিনা সেটা শোনার জন্য।
“মা হিসেবে আমি তোমাকে উপদেশ এবং পরামর্শ, এই দুটোই দিতে পারি। সাহস তোমার ভিতর আছে। আমি চাই না তুমি ভবিষ্যতে সুযোগ দেওনি বলে আফসোস করো!”
~~~
জ্যোতি ভাবনার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এলো। কথা গুলো জ্যোতির মনে এতো বেশি চাপ ফেলেছে যে রাতে ঘুমের মধ্যেও দুঃস্বপ্ন দেখেছে!
____________________°___________________
“কোথায় যাচ্ছি আমরা? এতক্ষণ ধরে ড্রাইভ করছেন যে?”
জ্যোতি উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলো শাহরিয়ারকে। কোলে জুবায়ের ঘুমাচ্ছে।
দুপুরে শাহরিয়ার ফোন করে তার সাথে বাহিরে বের হতে বলেছে। জ্যোতি এবার রাজি হয়েছে। তাই আসরের নামাজের পরপরই বের হয়ে গেছে ওরা।
শাহরিয়ার সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে বললো,
“আমার নানাবাড়ি।”
“ফাজলামো করছেন? ”
“সত্যিই ওদিকে যাচ্ছি। এর আগে তো কখনো নিয়ে যাইনি ওখানে, তাই ভাবলাম আজকে ওদিকেই যাই।”
জ্যোতি ভড়কে গিয়ে বললো,
“আপনার নানার বাসায় উঠবেন?”
“না, নানা মাকে যে ফার্মহাউসটা দিয়েছেন ওখানে যাবো।”
জ্যোতি অসন্তোষের সাথে বললো,
“কেনো? আমি যাবো না ওখানে। আপনি অন্য কোথাও খোলামেলা জায়গায় চলুন।”
শাহরিয়ার জ্যোতির দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেনো?”
জ্যোতি চুপ করে রইলো। কিছু একটা চিন্তা করে গালদুটো লাল হয়ে উঠলো। দায়সারা ভাবে বললো,
“এমনি।”
“আচ্ছা, তাহলে ওদিকেই অন্য কোথাও চলছি।”
তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। জ্যোতি অস্বস্তির সাথে সেটা লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
“এভাবে হাসছেন কেনো? অদ্ভুত তো!”
শাহরিয়ারের হাসি চওড়া হলো। হাসতে হাসতে বললো,
“তোমার মাইন্ড রিড করে হাসছি!”
জ্যোতি চমকে উঠে তাকালো শাহরিয়ারের দিকে।
“কীহ!”
শাহরিয়ার জ্যোতির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো।
জ্যোতি রেগেমেগে বললো,
“মিথ্যুক!”
“মিথ্যা না, তুমি কী ভেবে যেতে চাইছো না সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। যদি আমার আবার পিপাসা পেয়ে বসে—”
জ্যোতি রাগে সামনে রাখা পানির ছোট বোতল ছুঁড়ে মারে শাহরিয়ারের দিকে। রেগেমেগে বলে,
“অসভ্য লোক! এমন কোনো চিন্তা ভাবনা থেকে থাকলে আজকে খবর আছে! সেদিন শকে কিছু করতে পারিনি দেখে আজকে কিছু করবো না ভেবে থাকলে—”
জ্যোতি কথা শেষ না করে মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে রাখে৷ কান দিয়ে তার ধোঁয়া বের হচ্ছে লজ্জায়।
শাহরিয়ার তখনও মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। তার হাসি দেখে জ্যোতি কটমট করে তাকালো। বদ লোকটার হাসি দেখে তার সুড়সুড়ি লাগছে, হাসি বহুকষ্টে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আটকে রাখতে হচ্ছে। তাই কপট রাগ করে বললো,
“হাসি থামান! জুবায়ের ঘুমাচ্ছে।”
শাহরিয়ার হাসতে হাসতেই জবাব দিলো,
“আমার হাসির তো কোনো শব্দ হচ্ছে না!”
“না হলেও, হাসছেন তো। বন্ধ করুন। আপনার হাসি দেখে আমার হাসি আসছে। আমার হাসিতে ঠিকই শব্দ হবে।”
জ্যোতির কথায় শাহরিয়ার এবার হো হো করে হেসে ফেললো।
এবার জ্যোতিও হেসে ফেললো শব্দ করে।
ইতোমধ্যে জুবায়ের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। সেদিকে এক ঝলক তাকিয়ে শাহরিয়ারকে বললো,
“দেখলেন? দিয়েছেন তো উঠিয়ে।”
“উঠুক। ওর আম্মু-আব্বু ডেটে যাচ্ছে আর ও ঘুমাচ্ছে ব্যাপারটা মানাচ্ছে না।”
“আমরা ডেটে যাচ্ছি?”
“তো কী?”
“ফাজিল!”
আরও অনেকক্ষণ পর শাহরিয়ার অবশেষে নির্জন একটা জায়গায় থামলো। মাঝখানে খোলা ছোটখাটো একটা ময়দানের মতো, চারপাশে অনেকগুলো বড় বড় গাছ, অনেকটা জঙ্গলের সদৃশ। এখান থেকে আরও কিছুটা সামনে ছোটখাটো একটা লেকের মতো অংশ দেখা যাচ্ছে।
“নামো।”
শাহরিয়ার আগে নেমে জ্যোতির সাইডের দরজা খুলে জ্যোতিকে নামতে বললো।
জ্যোতি জুবায়েরকে ভালোভাবে ধরে নামলো।
গাড়ি থেকে নেমে সে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে লাগলো বিস্ময়ে। জায়গাটা ভীষণ সুন্দর!
লেকের উপর দিয়ে শীতল বাতাস আসছে, থেকে থেকে এসে গায়ে ধাক্কা লাগছে বাতাসের, ভীষণ সুন্দর অনুভূতি।
জ্যোতি মুগ্ধ হয়ে জায়গাটা দেখতে লাগলো।
“কোথায় এনেছেন? জায়গাটা তো ভীষণ সুন্দর!”
শাহরিয়ার গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে সব দেখতে দেখতে বললো,
“ছোট বেলায় নানাবাড়ি আসলে আমরা সব কাজিনরা এখানে পিকনিকের জন্য আসতাম।”
“আপনার নানাবাড়ি এখানের আশেপাশেই?”
“না, পার হয়ে এসেছি। নানাবাড়ি থেকে এটা একটু দূরই। বাট জায়গাটা নানারই। এই এলাকার অধিকাংশ জমি নানাদের ছিলো।”
“এতো জমি?”
“হ্যাঁ, নানারা জমিদার বংশের ছিলেন। এখন অবশ্য অনেক জমি মামারা বিক্রি করে দিয়েছে।”
জ্যোতি চুপ করে রইলো।
“তোমার ভালো লেগেছে জায়গাটা?”
“হুম, ভীষণ!”
“দেখি, জুবায়েরকে আমার কাছে দেও। অনেকক্ষণ ধরে রাখছো। তুমি ঘুরেঘুরে দেখতে থাকো সবটা।”
বলে নিজে এগিয়ে এসে জুবায়েরকে জ্যোতির কোল থেকে আগ বাড়িয়ে নিলো।
ছেলের নাকে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে খুনসুটি করলো কিছুক্ষণ। ছেলেও বাবাকে পেয়ে খুশি।
“ফার্ম হাউসটা আরও সুন্দর ছিলো। থাক, আরেকদিন নিয়ে ঘুরিয়ে আনবো তোমাকে।”
জ্যোতিকে উদ্দেশ্য করে বললো শাহরিয়ার।
জ্যোতি কথা শুনে একটু থমকালো।
“লেকের ওদিকটায় বসার মতো জায়গা আছে?”
“গাড়ির ডিকিতে রেক্সিন আছে। সেটা বিছিয়ে বসা যাবে। তুমি যাও, আমি গাড়ি এগিয়ে নিয়ে আসছি।”
“জুবায়েরকে আমার কাছে দিন।”
জ্যোতি জুবায়েরকে নিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলো সামনে।
কিছুক্ষণের মধ্যে শাহরিয়ারও গাড়ি একটু এগিয়ে সেখানে নিয়ে এলো।
গাড়ি থেকে নেমে বললো,
“রেক্সিন বিছাবে?”
“না থাক, গাড়িতেই হেলান দিয়ে থাকতে ভালো লাগছে।
এরপর দুজনেই নীরব থাকলো অনেকক্ষণ। নীরবতা ভাঙলো জ্যোতিই,
“কী যেন বলবেন বলে নিয়ে এলেন?”
“উঁ? হু, কথা বলার জন্য এনেছি।”
জ্যোতি চুপ করে রইলো।
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নিলো। তারপর বললো,
“মি.সামিউল এক মাস সময় দিয়েছে। এক মাস শেষ হতে তো বেশিদিন নেই। কী ভাবলে শেষমেশ?”
“কী ভাববো?”
“আমার সাথে ফিরে যাওয়ার ব্যপারে?”
জ্যোতি চুপ করে রইলো।
শাহরিয়ার জ্যোতির চুপ থাকা লক্ষ্য করে বললো,
“আমি বুঝতে পারছি তুমি ইনসিকিউরড ফিল করছো। দেখো আমি আগের কিছু তো পরিবর্তন করতে পারবো না, কিন্তু সামনের সবকিছু যেন ভালো যায় সেটার চেষ্টা ঠিকই করতে পারবো। তোমার উচিত আমার উপর ট্রাস্ট করা। আমি চেষ্টা করছি সবকিছু স্বাভাবিক করার জন্য।”
জ্যোতি চুপচাপ শুনে গেলো।
“তুমি কোনো কথা বলছো না কেনো?”
“আপনি বলুন, আমি আজকে শুনতেই এসেছি।”
“দেখো, আমার নেচারই একটু রগচটা। আমি ব্যপারটা স্বীকার করি আর না করি, এটাই সত্যি। সবার সাথেই আমি এমন। ফ্যামিলির সবাই ছোট থেকে এটার সাথে অভ্যস্ত তাই তারা ইজিলি এটার সাথে ডিল করতে পারে। আমার ভুল হয়েছে আমি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের বদলে আমার সারাদিনের সমস্ত রাগ তোমার উপর ছাড়তাম। এজন্য সম্পর্কটা যে কখন তিক্ততায় মোড় নিয়েছে সেটা বুঝতে পারিনি। আ’ম স্যরি, ফর এভরিথিং হোয়াট আই ডিড বিফোর। কিন্তু আমি এখন এসব পরিবর্তন করতে চাচ্ছি, যাইহোক এভাবে তো আর জীবন চলবে না। আমি এখন নিজের কাউন্সিলিংও করাচ্ছি তোমার কথামতো, যেটা আমার আরও আগেই করা উচিত ছিলো।”
জ্যোতি অবাক হয়ে তাকায় শাহরিয়ারের দিকে।
শাহরিয়ার জ্যোতির বিস্মিত চাহুনি দেখে সায় জানায়,
“সত্যি। লাস্ট কয়েকমাস ধরে করাচ্ছি। তোমাকে জানাইনি ইচ্ছে করেই।”
জ্যোতি কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললো,
“দেখুন, আপনি নাহয় ভুল বুঝতে পারছেন, সব ঠিক করার প্রয়োজন অনুভব করছেন। আপনার বাসার সবাই করছে? আপনার আম্মু আমাকে পছন্দ করেন না। আমি আবার ফিরে যাই সেটাও তিনি চান না। তাহলে ওই বাসায় আমি কীভাবে থাকবো?”
“তাহলে তুমি কি আলাদা থাকতে চাইছো?”
“না, আমি কখনোই চাইনি এমনটা। আমি সবার সাথেই মিলেমিশে থাকতে চেয়েছি।”
শাহরিয়ার জ্যোতির কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
“শুনো, মা কী বলেছে সেটা আমলে নিও না। আমি তো থাকতে চাই তোমার সাথে, তাই না? আমি মায়ের সাথে কথা বলবো, উনাকে বুঝিয়ে বলবো। আজ হোক কাল হোক, উনি ঠিক বুঝবেন। কোনো প্রবলেম হলে আমাকে বলবে, আমি সিচুয়েশন বুঝে হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করবো। দেখো জ্যোতি, আমি তোমাকে-জুবায়েরকে যেমন ছাড়তে পারবো না, ঠিক তেমনি আমার ফ্যামেলিকেও ছাড়তে পারবো না। বাবা হার্টের পেশেন্ট, অরোরার বিয়ের কথাবার্তা চলছে৷ আমি না থাকলে আমার বাবা-মা একা হয়ে যাবে। তাঁরা আমাকে বড় করেছে, আমারও দায়িত্ব আছে তাদের প্রতি।”
“আপনি বারবার একই কথা বলছেন কেনো? আমি কখনো বলেছি আমার জন্য আপনার পরিবার ছাড়তে? তাহলে এতো ক্ল্যারিফিকেশন আসছে কেনো?”
“না, আমি আমার দিক থেকে ক্লিয়ার করলাম। তুমি আমার উপর ট্রাস্ট করো, আই উইল ট্রায় বাই বেস্ট।”
জ্যোতি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে,
“আমাকে ভাবার সময় দিন।”
“ভাবো, সময় কিন্তু বেশি নেই। আমাদের জুবায়েরের কথা চিন্তা করো একবার? ও যখন দেখবে ওর বোধ হওয়ার আগেই ও ডিভাইডেড হয়ে গেছে ওর বাবা মায়ের মধ্যে, তখন ওর মানসিক অবস্থা কী হবে, একবার ভাবো?”
জ্যোতির কপালে চিন্তার ভাঁজ, দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে জুবায়েরের দিকে তাকালো।
জ্যোতি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বুঝতে পেরে শাহরিয়ার আরেকটু চাপ দিলো,
“ও যখন স্কুলে যাবে, তখন যদি বুলি হতে হয় আমাদের সেপারেশনের কারণে তখন কি ও আমাদের ব্লেইম দিবে না? আরও যখন বড় হবে, একটু একটু বুঝতে শিখবে তখন আফসোস করে বলবে না ‘তোমাদের যদি সেপারেট হওয়ার ডিসিশনই ছিলো আগে থেকে তাহলে আমাকে কেনো পৃথিবীর মুখ দেখালে?’ তখন আমরা এর কী উত্তর দিবো বলো তো?”
জ্যোতির চেহারায় স্পষ্ট দিশেহারা ভাব ফুটে উঠলো।
শাহরিয়ার আবার বললো,
“এভরি চাইল্ড ডিজার্ভস আ ফ্যামিলি, জ্যোতি! আমাদের জুবায়েরও ডিজার্ভ করে। ওর তো এসবে কোনো দোষ ছিলো না, তাই না? তাহলে ও কেনো সাফার করবে? আমাদের সামনে সবকিছু ঠিক করার অপশন
থাকতেও কেনো ওকে সাফার করা অপশনটাই তুমি চুজ করতে চাইছো? জ্যোতি, নিজের চিন্তায় সন্তানের ভবিষ্যতকে পদদলিত করো না, আই রিকুয়েষ্ট!”
জ্যোতির মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বইছে। ভীষণ দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে একবার শাহরিয়ার দিকে, একবার শাহরিয়ারের কোলে থাকা জুবায়েরের দিকে তাকাচ্ছে সে চিন্তিত মুখে। তার স্নায়ুতে যে প্রবল চাপ পড়ছে সেটা বুঝতে পেরে শাহরিয়ার তৎক্ষনাৎ থেমে গেলো। দ্রুত গাড়ির কাছে গিয়ে পানির বড় বোতল নিয়ে বাড়িয়ে দিলো জ্যোতির দিকে।
“নেও, পানি খাও একটু।”
জ্যোতি সাথে সাথে সেটা খপ নিয়ে নিয়ে নিলো। কর্ক খুলে ঢকঢক করে পানি ঢাললো নিজের শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলায়। এটা এই মূহুর্তে ভীষণ দরকার ছিলো তার!
#চলবে……….।