#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ২৯
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
এক সপ্তাহ পরঃ
~~~~~~~~~~~~
এই এক সপ্তাহে যে কতকিছু ঘটে গিয়েছে! অরোরাকে উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ দুদিন আগে। শাহরিয়ারের সন্দেহই সঠিক ছিলো। রবিনই কিডন্যাপ করেছিলো অরোরাকে। পুলিশ কয়েকদিন রবিনকে সিভিল ড্রেসে থেকে অবজারভেশনে রেখেছিলো, তাকে ফলো করেই অরোরার হদিস পেয়েছে তারা। অরোরাকে উদ্ধার করে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। এক সপ্তাহ নিখোঁজের পর যখন তাকে উদ্ধার করা হয় তখন তার অবস্থা বেশ গুরুতর ছিলো, পুরো দেহে নির্যাতনের চিহ্ন, ভগ্ন স্বাস্থ্য সব মিলিয়ে তার পরিস্থিতি সত্যিই খারাপ ছিলো। এই কটা দিন না তাকে ঠিক মতো খেতে দেওয়া হয়েছে, না তার সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়েছে।
আইসিইউতে নেওয়ার চারদিন পর সোহাইল সাহেবের অবস্থা কিছুটা উন্নতির দিকে যায়। ডাক্তার বেশ আশা দেয় তাদের।
অরোরাকেও সেই হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে। বাবার অবস্থা জানার পর সে নিজের অবস্থা ভুলে একেবারে ভেঙে পড়েছে। অপরাধবোধে তার ভিতরটা একেবারে শেষ। তার জন্যই তো তার পরিবারের এতো ভোগান্তি হলো।
ঘরের প্রত্যেকে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মানসিক অবসাদ অনেকটাই কেটে গেছে প্রত্যেকের।
পুলিশ রবিনকে ধরে নিয়ে গেছে। তার উপরে একাধিক মামলা করা হয়েছে। শাহরিয়ার প্রাণপণে চেষ্টা করছে রবিনের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়।
এত সবের মধ্যে জ্যোতি একটা কাজের কাজ করেছে। জান্নাতকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রবিনের বিপক্ষে মামলা দায়ের করাতে পেরেছে। একাধারে প্রতারণা, জালিয়াতি, বিয়ের প্রতারণা, শারীরিক নির্যাতনসহ বেশ কয়েকটা মামলা দিয়েছে জান্নাত রবিনের বিপক্ষে। অরোরা এবং জান্নাত দুই পক্ষের এতগুলো পুলিশ কেসে আশা করা যাচ্ছে রবিনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড হবে।
জান্নাত প্রথমে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু জ্যোতি আর শাহরিয়ারের ফুসলনোর পর আশ্বস্ত হয়ে এই স্টেপ নিতে পেরেছে।
আপাতত সকলের মানসিক চাপ কিছুটা কমেছে।
আরও চারদিন পর অরোরাকে রিলিজ দেওয়া হলো, এরও চারদিন পর সোহাইল শাহবাজকেও বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে।
আপাতত ঘর পূর্বের মতো সকল মানুষে পরিপূর্ণ হয়েছে।
অরোরা অনেক কান্নাকাটি করে মাফ চেয়েছে সবার কাছে। সবাই যদিও তাকে মাফ করে দিয়েছে তার ভুলগুলোর জন্য, কিন্তু সে তবুও দাগ কেটে দিয়েছে সবার অন্তরে। এটা নিয়ে সকলের মনেই একটা শীতল ক্ষোভ রয়ে গেছে।
শাহরিয়ার পারতপক্ষে বোনের সাথে কথা বলছে না ক্ষোভে।যদিও ফারিয়া সব ভুলে মেয়েকে আগলে নিয়েছেন। ছেলেকেও বারবার বলছেন অরোরার সাথে স্বাভাবিক হতে। কিন্তু শাহরিয়ার বলেছে তার সময় লাগবে। আর সবকিছুর জন্য ক্ষমা করতে পারলেও অরোরার জন্য বাবার অবস্থা এতো অবনতির দিকে গিয়েছে এই বিষয়টার জন্য সে তাকে কখনো ক্ষমা করতে পারবে না।
অরোরা বহুবার মাফ চেয়েছে ভাইয়ের কাছে। কিন্তু শাহরিয়ারের সেই একই কথা। অরোরা নিজেও ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে অবগত। সে ভালো করেই জানে শাহরিয়ার এতো সহজে ঠান্ডা হবে না। সে নিজেও তো কাজ করেছে এমনই!
অরোরা এ ক’দিনে নিজ থেকে জ্যোতির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। জ্যোতির কাছেও ক্ষমা চেয়েছে তাকে অবিশ্বাস করার জন্য। সে পূর্বের সবকিছুর জন্য ক্ষমা চেয়েছে। জ্যোতি মেয়েটার অবস্থা দেখে তাকে আশ্বস্ত করেছে যে সে কিছু মনে পুষে রাখেনি। অরোরা যেন এসব নিয়ে আর চিন্তা না করে। বরং এই দুর্ঘটনা থেকে সে যে শিক্ষা পেয়েছে সেটা যেন সবসময় মনে রাখে, তাহলেই হবে।
___________________°___________________
জ্যোতি জুবায়েরকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে বসেছিলো। শাহরিয়ার বাইরে থেকে এসে রুমে তাকে দেখতে না পেয়ে বেলকনিতে উঁকি দিয়ে তাকে দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করলো,
“এখানে বসে আছো যে?”
জ্যোতি আঁতকে উঠে শাহরিয়ার হঠাৎ কথা বলায়।
“এভাবে কেউ ভয় দেখায়? আশ্চর্য!”
“আমি ভয় কখন দেখালাম? এখানে বসে আছো কেনো সেটাইতো জিজ্ঞেস করেছি শুধু।”
জ্যোতি উত্তর দিলো না। তার মন ভালো নেই নানা কারণে। শাহরিয়ার হয়তো বুঝতে পারলো স্ত্রীর মন ভালো নেই। তাই জুবায়েরকে কোলে নিতে নিতে জিজ্ঞেস করলো,
“কী চিন্তা করছিলে এতক্ষণ? মুড অফ কেনো?”
জ্যোতি এড়িয়ে গেলো প্রশ্নটা। শাহরিয়ার বিছানায় শুয়ে রেস্ট নেওয়ার সময় জ্যোতি আমতা আমতা করে বললো,
“আপনি অরোরার সাথে স্বাভাবিক বিহেভ করছেন না কেনো? ও কত বড় বিপদের মধ্য দিয়ে গেছে, এখন এসব নিয়ে রাগারাগি করলে এটা কি ভালো দেখায়?”
শাহরিয়ার শীতল কণ্ঠে বললো,
“আমি এই বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না জ্যোতি। ও দুধের শিশু না যে, যে যা বুঝাবে ও সেটাই বুঝবে। ও এইবার শুধু ভুল করেনি, গুরুতর ভুল করেছে। মা ওকে আশকারা দিতে দিতে এতো বেপরোয়া বানিয়েছে। কিন্তু এই ব্যাপারে আমার পক্ষ থেকে ওর জন্য কোনো ছাড় নেই। ওর সাথে এরচেও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো। আল্লাহ হেফাজত করেছেন বলে বড় কিছু হয়নি। ওর বুঝতে হবে ও কত বড় ভুল করেছে৷ এত সহজে মাফ করে দিলে ও কখনোই রিয়েলাইজ করতে পারবে না ওর ভুলটা।”
শাহরিয়ার একটু থেমে আবার বলে,
“ওর সব ভুল মাফ করতে পারলেও ওর জন্য বাবার যে অবস্থা গিয়েছে সেটা আমি কখনো ভুলতে পারবো না। কিছু কিছু ভুলের ক্ষমা হয়না জ্যোতি। তুমি ভাবতেও পারবে না সেদিন বাবাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার মধ্য দিয়ে কী গিয়েছে! কয়েক মূহুর্তের জন্য ভেবেই নিয়েছিলাম আমি বাবাকে হারিয়ে ফেলেছি।
ছেলেরা মায়ের ভক্ত হলেও আমার ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু ব্যতিক্রম। আমি বাবার সাথে ইমোশনালি বেশি এটাচড। বাবা আমার একজন বন্ধু, একজন মেন্টরের মতো। বাবার যদি সেদিন সত্যিই খারাপ কিছু হয়ে যেতো তাহলে আমি সত্যিই নিঃশেষ হয়ে যেতাম।
যেদিন আমি সেদিনের মূহুর্তগুলো ভুলতে পারবো সেদিন আমি ওকে একেবারে মাফ করে দিবো!”
জ্যোতি বুঝতে পারলো শাহরিয়ারের ইমোশনটুকু। ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো তার বুক চিঁড়ে। অরোরার কাতর আবেদনে সে ভেবেছিলো শাহরিয়ারকে বুঝাবে। কিন্তু শাহরিয়ারের কথা শুনে তার আর সাহস হলো না অরোরার হয়ে সাফাই গাওয়ার।
___________________°___________________
পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কদিন ধরেই জ্যোতির মাথায় একটা কথা ঘুরঘুর করছে। সবার সবকিছু ঠিকঠাক হলেও জান্নাতের জীবনটা একেবারে ওলটপালট হয়ে গিয়েছে। মেয়েটার বাকিটা জীবন তো এখনো রয়েই গেছে।
জান্নাতকে বলেছিলো ওর বাবা মায়ের কাছে ফিরে যেতে। মেয়েকে দেখলে নিশ্চয়ই আর অভিমান করে থাকতে পারবেন না তারা। কিন্তু জান্নাত রাজি হয়নি। তার বাবা মা যে তাকে ক্ষমা করবে না সেটা সে জানে। শুধু শুধু কাঁটা ঘাঁয়ে নুনের ছিটা লাগানোর কী দরকার?
কিন্তু জ্যোতি সেটা মানতে পারছে না। নিজের সন্তানকে অসহায় অবস্থায় দেখলে কোন পিতা মাতা মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারে?
জ্যোতি মনে মনে ঠিক করে নিলো সে জান্নাতের বাবা মায়ের কাছে গিয়ে তাদের মানানোর চেষ্টা করবে।
~~~~~~~
জ্যোতি সত্যি সত্যিই তাই করলো। জান্নাতের বাবা মায়ের সাথে দেখা করে তাদের মেয়ের কথা বলে তাদের অনেক মানানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রথমে তারা মানতেই রাজি ছিলেন না, তারা নাকি ভুলে গেছেন মেয়ের কথা। পরে জ্যোতি হতাশ হয়ে ফিরে আসে।
কিন্তু ঠিকই পরদিন জান্নাতের মা কাঁদতে কাঁদতে জ্যোতিকে ফোন করে। তারা উভয়ই মেয়ের সাথে দেখা করতে চান, জ্যোতি যেন তাদের দেখা করায়। জ্যোতি স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে রাজি হয় এতে।
যেদিন জান্নাতের সামনে তার বাবা-মাকে নিয়ে আসে সেদিন জ্যোতি অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের সাক্ষী হয়। মেয়ের সাথে বাবা-মার মিলনায়তনে জ্যোতির চোখে পানি চলে আসে। জান্নাত তার বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদে সেদিন, বারবার ক্ষমা চায় তাদের কাছে নিজের ভুলগুলোর জন্য। তার বাবা-মাও মেয়েকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ কাঁদে। নাতনীকে প্রথমবার দেখার পর তাদের আনন্দ উচ্ছ্বাস ছিলো দেখার মতো। জ্যোতি মনে মনে স্বস্তি বোধ করে। যাক, জান্নাতকে একা থাকতে হবে না অন্তত!
___________________°__________________
এক মাস পরঃ
~~~~~~~~~~~
জ্যোতি অনেক দ্বিধাদ্বন্দে ভুগে নওশাদের নাম্বারে ডায়াল করে। প্রথম বার রিং হওয়ার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হয়,ভেসে আসে নওশাদের পুরুষাশালী কন্ঠস্বর,
“হ্যালো?”
“আসসালামু আলাইকুম, আমি…. জ্যোতি।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, তোমার নাম্বার সেভ করা আছে আমার ফোনে।”
জ্যোতি কী বলবে ভেবে পেলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলে নওশাদ জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো? বাবু কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।… কোনো দরকার ফোন করেছো? মানে আগে কখনো তো কল করোনি তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
জ্যোতি একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“একটা আবদার ছিলো, জানি বিষয়টা অদ্ভুত কিন্তু আমি তবুও একবারের জন্য হলেও আপনাকে কথাটা বলতে চাই।”
ওপাশ থেকে নীরবতা ভেসে আসে। সে বুঝতে পারে, নওশাদ শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। জ্যোতি লম্বা করে দম নেয়, তারপর অস্বস্তির সাথে বলে,
“আমার যখন হাসবেন্ডের সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না তখন খালামনি চাচ্ছিলেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হোক,….মনে আছে?”
বলেই চোখমুখ খিঁচে দম আঁটকে চুপ করে থাকে সে। খুবই অস্বস্তি হচ্ছে তার পুরোনো বিষয়ে কথা বলতে।
“হুম, এখন কী হয়েছে?”
জ্যোতি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“আপনিও বলেছিলেন এক বাচ্চার মাকে বিয়ে করা নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা নেই। বরং আপনি তাকে নিজের সন্তানের মতো বড় করতে পারবেন।”
নওশাদ এবার অস্থির বোধ করলো, কেমন উদ্বিগ্ন স্বরে বললো,
“তুমি ঠিক আছো জ্যোতি? তোমার হাসবেন্ডের সাথে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে?”
“না না, এমন কোনো বিষয় না। আসলে… আমার এক বান্ধবী, ওর তালাক হয়েছে। একটা বাচ্চা মেয়ে আছে তার। আসলে ওর জীবনে অনেক কিছু ঘটে গিয়েছে। এর কিছুটা দায়ভার আমার উপরও বর্তায়। আপনার সাথে সামনাসামনি কথা হলে সব বুঝিয়ে বলতে পারতাম। ওর অবস্থা দেখে আমার খুব খারাপ লাগে, অপরাধবোধ হয়।”
এই পর্যন্ত বলে থামে সে। নওশাদ সম্ভবত আঁচ করতে পেরেছে জ্যোতি কী বলতে চাইছে। তবুও শিওর হওয়ার জন্য দম আঁটকে বলে,
“এখন?”
জ্যোতি মৌন হয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তার হৃদপিণ্ড দাপাদাপি করছে চূড়ান্তভাবে। তারপর ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
“আপনার যদি আপত্তি বা সমস্যা না থাকে তাহলে কি ওকে বিয়ে করতে পারবেন? ও অনেক ভালো একটা মেয়ে, ভীষণ সুন্দর। বাহিরটাও সুন্দর, ভিতরটাও সুন্দর। আপনার এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যাবে—”
জ্যোতির কথার মাঝখানে নওশাদ বলে উঠে,
“জ্যোতি, জ্যোতি শুনো। আগে আমার কথা শুনো। তুমি যখন এই প্রসঙ্গ তুলেছো তখন আমি খোলাখুলিই তোমাকে বলি, কিছু মনে করো না কিন্তু। আমি… আমি তোমাকে পছন্দ করতাম, ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতাম। এজন্যই সব অবস্থাতেই তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি ছিলাম। কিন্তু….. কিন্তু আমার ভাগ্য সহায় ছিলো না, কিংবা বলা যায় আমার ভাগ্যে তুমি ছিলে না। ….তুমি বুঝতে পারছো সমস্যাটা কোথায়?”
জ্যোতি চুপ করে যায়। নওশাদ এতোটা খোলামেলা ভাবে কথাগুলো বলে ফেলবে এটা সে ভাবেনি। অবশ্য সেও তো পুরোনো কথাই তুলেছে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলে,
“আমি বুঝতে পেরেছি বিষয়টা। আমি আসলে দুঃখিত এই প্রসঙ্গ তুলে আপনাকে বিব্রত করার জন্য। আসলে ভিতরে অপরাধবোধ হচ্ছিলো অনেক…. এজন্যই বলা আরকি। আচ্ছা যাইহোক, বিষয়টা তাহলে এখানে ক্লোজ করি!”
#চলবে…………