ঔজ্জ্বল্যের আলোক প্রহর পর্ব-০৩

0
1

#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর

#পর্বঃ৩

#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম

“সোহাইল সাহেব অনেক বড় মুখ করে বলেছিলেন, ❝ছেলের বউ নয়, নিজের মেয়ে নিয়ে যাচ্ছি।❞ মেয়ে করে রাখার এই নমুনা?”

হামজা সাহেব কঠোরভাবে প্রশ্নটা ছুড়লেন শাহরিয়ারের উদ্দেশ্যে। দেহকাঠামো তার একদম স্থির।

জায়গাটা শাহরিয়ারদের নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে, শাহরিয়ারের কেবিনে। সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে সুইভেল চেয়ারে বসা শাহরিয়ার ভ্রু কুটি করলো কথাটা শুনে।

“আঙ্কেল, ভালো হয় এই কথাগুলো এই জায়গায় না বললে। ঘরের সমস্যার সমাধান দপ্তরে হয় না।”

“যখন সমস্যা ঘরেও সমাধান হয় না তখন দপ্তরেই করা লাগে।”

শাহরিয়ার চোয়াল শক্ত করে বললো,

“ঠিক আছে, আপনি যেহেতু আলোচনা এখানেই করতে চাইছেন আমারও আপত্তি নেই। আমি শুধু আপনার সম্মানের খেয়াল করছিলাম!”

তারপর দরজার দিকে তাকিয়ে চেচিয়ে বললো,

“ফারুক! দুই কাপ চা পাঠিয়ে দেও।”

হামজা সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জামাতাকে পরখ করে চললেন। এত বড় ভুল হলো কী করে তার দ্বারা! আরও ভালো ভাবে খোঁজ নেওয়া দরকার ছিলো তার।

“আমার সম্মানের খেয়ালই যদি করতে তবে আমার মেয়েটার সাথে এমন করতে পারতে না তোমরা। তোমরা আমাকে ভীষণ হতাশ করেছো, শাহরিয়ার! আমাকে মানতে বাধ্য করেছো বাহ্যিক আভিজাত্য অভ্যন্তরীণ মানসিকতার প্রতিফলন নয়!”

“আপনার মেয়েও আমাদের হতাশ করেছে আঙ্কেল। তার আচরণ বরদাস্ত করার মতোন নয়।”

শাহরিয়ার ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো। আসলে সে আশা করেনি হামজা সাহেব এভাবে তার অফিসে চলে আসবেন এই বিষয় নিয়ে। এমনিতেই অফিসের দুনিয়ার ঝামেলা, তারউপর এখন এই ঝামেলা। বিরক্তই হচ্ছে সে।

হামজা সাহেব দুঃখে হেসে ফেললেন প্রায়।

“তাহলে চিন্তা করো কী পরিণাম জুলুম সয়েছে আমার শান্তশিষ্ট মেয়েটা যে এই পর্যায়ে নামতে বাধ্য হয়েছে!”

শাহরিয়ার তাজ্জব হওয়ার ভান ধরে বললো,

“আপনার মেয়ের উপর জুলুম করেছি আমরা?”

“অস্বীকার করতে পারবে? ফুলের মতো মেয়ে দিয়েছিলাম তোমাদের হাতে, অথচ তোমরা সেই কোমল ফুলটাকে দুমড়ে মুচড়ে আমার কাছে পাঠিয়েছো। খোদা সইবে না এতো জুলুম। অন্যের মেয়ের প্রতি এতো অবিচার করো, অথচ নিজের ঘরে এখনো তোমার এক অবিবাহিত বোন আছে সে কথা কীভাবে ভুলে যাও? খোদা না করুক, তোমার বোনের সাথে এমন হলে সহ্য করতে পারতে?”

শাহরিয়ার রেগে গিয়ে বললো,

“আঙ্কেল, লিমিট ক্রস করবেন না! আমার বোন জ্যোতির মতো বেয়াদব না! আপনার মেয়ে সংসার টিকাতে পারেনি এজন্য আমার বোনকে নিয়ে যা তা বলার অধিকার আপনি রাখেন না!”

শান্ত মেজাজের হামজা সাহেবেও ক্ষেপে উঠলেন এই পর্যায়ে,

“সংসার টেকানোর দায়িত্ব কি শুধুমাত্র মেয়ের? পুরুষের দায়িত্ব নেই? আমার বিরাট বড় ভুল হয়েছে তোমার মতো মেরুদণ্ডহীন লোকের কাছে আমার এতো সুশীলা মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া! এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন! মনে রেখো, আল্লাহ ইনসাফ করেন! তোমার মতো ছেলে আমার মেয়ের হেফাজত করতে পারবে না এটা আমার আগেই বুঝে নেওয়া দরকার ছিলো! ভুল যেহেতু আমি করেছি, এই ভুল ঠিকও এখন আমি-ই করবো!”

বলেই এক মূহুর্ত সেখানে না থেকে হামজা সাহেব ঝড়ের গতিতে চলে গেলেন। হামজা সাহেব যেতে না যেতেই ফারুক নামের অল্প বয়সী ছেলেটা চায়ের ট্রে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো।
টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,

“স্যার, চা।”

শাহরিয়ার রেগেমেগে বললো,

“তুমিই খাও! খেতে না পারলে চা দিয়ে গোসল করো! নিয়ে যাও এখান থেকে! গেট আউট!”

ফারুক ভয় পেয়ে দ্রুত ট্রে তুলতে গেলো। এবং তাড়াহুড়োয় ট্রে-টা হাত ফস্কে পড়ে গেলো। মূহুর্তেই চায়ের কাপ দুটো শব্দ করে মেঝেতে পড়ে ভেঙে চৌচির হলো! শুভ্র ফ্লোরটায় চায়ের বিশ্রী বাদামী রঙটার দিকে তাকিয়ে শাহরিয়ারের রাগ তরতর করে বেড়ে উঠলো। ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালো ফারুকের দিকে। যেন পারলে কাঁচাই চিবিয়ে খায়।
ফারুক সেই দৃষ্টি দেখে আতংকে পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম। কন্ঠনালী তার শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে ইতোমধ্যে।

“গেট লস্ট! দূর হও সামনে থেকে! কমসে কম দুই দিন আমার সামনে পড়বে না! যদি সামনে পড়ো তাহলে ফুটন্ত গরম চা ঢালবো তোমার গায়ে! বেরিয়ে যাও!”

ফারুক ভয়ে দৌড়ে বেড়িয়ে গেলো কামরা থেকে।

শাহরিয়ার মাথার চুল খামচে ধরে বসে পড়লো। রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার মতো অনুভূত হচ্ছে তার!

_______________°______________

ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে একটা রিকশার জন্য দাঁড়ালেন হামজা সাহেব। মনমেজাজ ভীষণ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। বাইরে তখন কড়া রোদ। দিবাকর তার রোষানলে ধরনীকে পোড়াতে যেন বদ্ধপরিকর।

কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা রিকশা অদূরে দাঁড়াতে থেকে সেটাতেই চড়ে বসলেন। রওয়ানা দিলেন সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেটের সামনে একটা গাড়ি দেখে ভ্রু কুঁচকে গেলো তার। গাড়িটা তার পরিচিত। জ্যোতির শশুর বাড়ি থেকে কেউ এসেছে?

চিন্তিত হয়ে রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকলেন। ডাইনিং টেবিলের উপর অনেকগুলো ফলের ঝুড়ি দেখে ভ্রুজোড়া কুঁচকে এলো তার। রত্নাকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,

“কে এসেছে বাড়িতে?”

রত্না স্বামীর গম্ভীর মুখ দেখে একটু ভড়কে গেলেন,

“জ্যোতির ননদ এসেছে, বড়টা।”

ফলগুলোর দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলেন,

“এসব ও-ই এনেছে?”

“হ্যাঁ।”

হামজা সাহেব তপ্ত কন্ঠে বললেন,

“ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বলো! না নিলে ডাস্টবিনে ফেলে দেও! ওই বাড়ি কিচ্ছু যেন আমার বাড়ি পর্যন্ত না আসে! আমার মেয়েকে শেষ করে আদিখ্যেতা দেখাচ্ছে! এসব গরু মেরে জুতা দান অন্য কোথাও গিয়ে দেখাতে বলো!”

রাগে হনহন করে নিজের ঘরে চলে গেলেন হামজা সাহেব।
রত্না ভীষণ ভড়কে স্বামীর যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। কী হলো মানুষটার? স্বামীর এরকম রাগ দেখে অভস্ত্য নন রত্না। সকালে ভীষণ হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যেন গেলো মানুষটা। বলেও যায়নি কোথায় যাচ্ছে। কোনো ঝামেলা হয়েছে নাকি কোথাও?

__________________°______________

“জ্যোতি, একটু এদিকে আয় তো।”

রত্না মেয়েকে ডাক দিলেন উঁচু আওয়াজে। জ্যোতি তখনও মাহিরার সাথে কথা বলছিলো।

মায়ের ডাক শুনে মাহিরাকে বসতে বলে উঠে এলো সেখান থেকে।

“কী হয়েছে আম্মু? ডাকছিলে?”

রত্না বেগম ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে গলার স্বর নামিয়ে বললেন,

“তোর আব্বুর কী যেন হয়েছে। বাহির থেকে ফিরেই কেমন রাগারাগি করছে। তোর ননদ এসেছে জানতে পেরে আরও আজব ব্যবহার করছে। বলছে যা যা এনেছে সব যেন ফিরিয়ে দিই। ফেরত না নিলে যেন ডাস্টবিনে ফেলে দিই। এখন কী করবো আমার মাথায় ধরছে না!”

জ্যোতি অবাক হয়ে বললো,

“আব্বু বলেছে এসব? অনেক রেগে ছিলো নাকি?”

“হুম।”

জ্যোতি চিন্তিত হলো। চিন্তিত কন্ঠে বললো,

“আচ্ছা, আমি পরে কায়দা করে বের করবো কী হয়েছে। তুমি টেনশন নিও না। মাহিরা ফলমূল এনেছে এটা আমারও ভালো লাগেনি। ওই বাড়ির কিছু আমারও রাখার ইচ্ছে নেই। কিন্তু ফেরত নেওয়ার কথা বললে কী রকম বাজে দেখা যাবে বিষয়টা! মাহিরা কষ্ট পাবে ভীষণ।”

“কী করবো এখন? তোর আব্বুর মেজাজ ভালো না।”

“তুমি সরিয়ে রাখো এগুলো, বাবার সামনে যেন না পরে। পরে দেখছি কী করা যায়।”

_________________°_______________

মাহিরা গিয়েছে প্রায় দুই ঘন্টা হলো। জ্যোতি এবং রত্না দুজনেই উদ্বিগ্ন হয়ে রইলো পুরোটা সময়। আব্বুর ঘরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না কেউ-ই। অনেকক্ষণ পর জ্যোতি সামান্য সাহস সঞ্চয় করে আব্বুর ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো।
ভিতর থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে দরজায় জোরে ধাক্কা দিতেই সেটা খুলে গেলো। ভিতরে অন্ধকার দেখে রীতিমতো অবাক হলো সে। আব্বু অন্ধকার অপছন্দ করেন না!

“আব্বু?”

কোনো সাড়া পেলো না সে।

কোনোমতে দেয়াল হাতড়ে লাইটের সুইচ অন করে দিলো সে।

হামজা সাহেব রকিং চেয়ারে বসে আছেন। মুখ তোয়ালে দিয়ে ঢাকা। জ্যোতি কেনো যেন ভয় পেলো ভীষণ আব্বুর এই নীরবতায়। দ্রুত আব্বুর কাছে এসে তোয়ালে সরালো। হামজা সাহেবের চোখ দুটো বন্ধ। জ্যোতির বুক ধ্বক করে উঠলো অনায়াসেই।

“আব্বু!!”

আব্বুর গায়ে মৃদু ধাক্কা দিয়ে জোরে ডাক দিলো জ্যোতি।
হামজা সাহেব চোখ মেলে মুখের সামনে মেয়েকে দেখলেন। চোখ দুটো তার ভীষণ শূন্য।

“আব্বু, কী হয়েছে তোমার? আমাকে বলো প্লিজ।”

হামজা সাহেব শীতল চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বললেন,

“বোস আমার পাশে। কথা আছে।”

জ্যোতি আব্বুর আদেশ মানলো। বাবার পায়ের কাছে বসলো উৎসুক দৃষ্টি মেলে।

“তুই বাচ্চাটা রাখবি?”

সোজাসাপটা প্রশ্ন করলেন হামজা সাহেব কোনোরকম ভণিতা না করেই।

আব্বুর প্রশ্নে জ্যোতির মাথা স্বয়ংক্রিয় ভাবে নত হয়ে গেলো। আড়ষ্ট অনুভব করলো ভীষণ। কখনো ভাবেনি বাবার সাথেও তার এই বিষয় নিয়ে কথোপকথন হবে।
কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না জ্যোতি।

“রাখবি?”

হামজা সাহেব শীতল কণ্ঠে পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন কথাটা।
জ্যোতি আলতো মাথা নেড়ে সায় জানালো।

“ঠিক আছে! ভুল আমি করেছি, তাই যতদূর সম্ভব সংশোধনও আমিই করবো। ওই বাড়িতে তুই আর যাবি না। তোর সন্তান হওয়ার পর তালাকের সকল কার্যক্রম আমি নিজে করবো। বাচ্চাও আমরাই রাখবো। মামলা করার দরকার হলে সেটাও করবো। দুনিয়ার তৈরি এমন কোনো আইন-আদালত নেই দুধের শিশুকে মা থেকে আলাদা করার। ততদিন পর্যন্ত ধৈর্য ধর। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।”

জ্যোতি কামড়ে ধরে মাথা নত করে কাঁদতে থাকে।

________________°_____________

গভীর নিশুতি রাত। চারদিকে শুনশান নীরবতা। ঘুমন্ত জ্যোতির তন্দ্রা আচমকাই ছুটে যায়। চোখ মেলে ঘুটঘুটে অন্ধকারের বদলে আবছা আলো দেখে জ্যোতি বুঝতে চেষ্টা করে সে কোথায় আছে। ডিম লাইট জ্বলছে। ধাতস্থ হওয়ার সময়টুকুর মধ্যেই কানে আসে কারো গুনগুনিয়ে মৃদুস্বরে কান্নার আওয়াজ। ত্রস্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে জ্যোতি।

আবছা আলোয় দেখতে পায় রত্নাকে জায়নামাজে বসে মোনাজাত ধরে আকুল হয়ে কাঁদতে। জ্যোতি উদ্বিগ্ন হয়। বুঝতে চেষ্টা করে কী হয়েছে। যখন বুঝতে পারলো মা তার জন্যই তাহাজ্জুদ নামাজে বসে কাঁদছে তখন তার ভিতরটায় অদ্ভুত টানাপোড়েন তৈরি হলো।
জ্যোতির সাথে আম্মু ঘুমান। জ্যোতি মানা করেছে, তবুও রত্না শুনেননি। মাঝরাতে যদি ওর কোনো প্রয়োজন হয় তখন কতক্ষণেই বা ডাকবে জ্যোতি?

আব্বু-আম্মু, এই দুটো মানুষ জ্যোতির জীবনে আল্লাহর দেওয়া সবথেকে সেরা উপহার। ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে গেলে বাবা সাইকেলের পিছনটা ধরে থাকতেন, মা ছুটতেন পেছন পেছন। দুর্ঘটনাক্রমে পড়ে গিয়ে হালকা চোটপ পেলে উদভ্রান্তের মতো দুজনে ছুটে আসতেন তার কাছে। জ্যোতির গায়ে হালকা আঁচড়টুকুও সহ্য করতে পারতো না দুজনের কেউ। নিজেদের সীমাহীন আদরে বড্ড নরম করে বড় করেছেন জ্যোতিকে। সেই জ্যোতির জীবনে এমন ঝড় বইছে এটা সহ্য করতে পারছে না কেউ-ই।

জ্যোতি নিঃশব্দে উঠে ওয়াশরুমে যায়। ওযু করে করে মায়ের পাশে আরেকটা জায়নামাজ বিছিয়ে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। রত্না মেয়ের উপস্থিতি পেয়ে কান্নার শব্দ বন্ধ করে ফেলেছেন।
জ্যোতি নামাজ শেষ করে মোনাজাত ধরে।

“ইয়া আল্লাহ! আমার আব্বু-আম্মু আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু তাদের থেকেও আমাকে বেশি ভালোবাসেন আপনি। আমার জীবনটাকে গুছিয়ে দিন ইয়া রব! যা আমার হকে ভালো হয়, তাই করুন রাব্বুল আলামীন!”

#চলবে…….