#ঔজ্জ্বল্যের_আলোক_প্রহর
#পর্বঃ৭
#লিখাঃতাসফিয়া_তাসনিম
শাহরিয়ার বাসায় পৌঁছানোর পর থেকেই অস্থির বোধ করছে কোনো কারণ ছাড়াই। রুমে কিছুতেই শান্তি মিলছিলো না দেখে সে বেলকনিতে গেলো।
বেলকনিতে আসা হয় না তার খুব একটা। জ্যোতি অবশ্য রুমের থেকে বেলকনিতেই থাকতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করতো। বেলকনির দেয়াল ঘেষে কয়েকটা ফুলের টব রাখা। কিন্তু দীর্ঘদিন পানি ও যত্নের অভাবে সেগুলো সেই কবেই অক্কা পেয়েছে। মাটি পর্যন্ত শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে।
শাহরিয়ার মনোযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ সেগুলো দেখলো। পরে উঠে বেতের দোলনাটায় বসলো। জ্যোতি যখন ছিলো তখন এখানে বসে থাকতো ফাঁক পেলেই।
শাহরিয়ারের কানে সর্বক্ষণ একটা ছন্দ বাজছে, নতুন প্রাণের ছন্দ। ঘুরেফিরে সে ওই মুহুর্তটায় চলে যাচ্ছে যখন সে প্রথম তার সন্তানের হৃৎস্পন্দন শুনেছিলো।
জ্যোতির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও তার চোখে ভাসছে বারংবার। হঠাৎ দরজায় নক হলো।
শাহরিয়ার রুমে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো ফারিয়া দাঁড়িয়ে আছেন।
“শুন, তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
শাহরিয়ার পাশে সরে মাকে ভিতরে প্রবেশের জায়গা করে দিলো।
ফারিয়া ভিতরে ঢুকে সোফায় বসলেন। শাহরিয়ারও মায়ের থেকে একটু দূরে আর্মচেয়ারে বসলো।
“কী হয়েছে?”
ফারিয়া একটু চুপ থেকে কথা গুছিয়ে নিয়ে বললেন,
“তোর ছোট খালামনি অরোরার জন্য মাহমুদের প্রস্তাব দিয়েছে।”
শাহরিয়ারের ভ্রু কুঁচকে গেলো। মাহমুদ ছোট খালার বড় ছেলে।
“আমি বলেছি তোর বাবা এখনও বাহিরে। আসলে কথা পেড়ে দেখবো। কিন্তু আমি চাইছি তার আগে তোর সাথে আলোচনা করে নিই।”
শাহরিয়ার বিরক্ত হয়ে বললো,
“আজব তো! অরোরা এখনও ছোট। এত তাড়াতাড়ি বিয়ের কথাবার্তা ধরেছো?”
ফারিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,
“২২ বছর চলে। ছোট কই? মাহিরারও তো একই এইজে বিয়ে হয়েছে।”
“তারপরও!”
“আরে এখনই তো দিচ্ছি না। আরো পাঁচ ছয়মাস সময় আছে হাতে। তোর আর জ্যোতির ঝামেলা শেষ হলে তখন দেখবো। জ্যোতি তো ডিভোর্স নিবে জানিয়েই দিয়েছে।”
শাহরিয়ারের মুখে আঁধার ঘনিয়ে এলো। কেনো যেন এই কথাটা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারলো না।
ফারিয়া ছেলের মুখের রঙ পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে? মুখটা এমন বাংলা পাঁচের মতো করলি কেনো?”
শাহরিয়ার ঝাড়ি মেরে বললো,
“কিছু না! তোমার উপর রাগ হচ্ছে! পাঁচ ছয় মাস সময় আছে তো পাঁচ ছয় মাস পরেই আলোচনা করতে! নদী না আসতেই পেরুবার চিন্তা!”
“ক্ষেপছিস কেনো? আমি তো শুধু তোর সাথে আলোচনা করছিলাম।”
শাহরিয়ার হতাশ হয়ে নিজের চুল আঁকড়ে ধরলো হাতের মুষ্টিতে। কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়ে বললো,
“মা, আ’ম স্যরি। আসলে মন মেজাজ ভালো না৷ এজন্য কোথাকার রাগ কোথায় দেখাচ্ছি। কিছু মনে করো না।”
ফারিয়া আন্দাজ করলেন ফ্যাক্টরিতে কাজের চাপে ছেলের এমন বেহাল দশা। মাতৃস্নেহে শাহরিয়ারের চুলে বিলি কেটে বললেন,
“তোর বাবাকে বলেছি আমি দ্রুত দেশে আসতে। ফ্যাক্টরির কাজ একা তোর উপর দিয়ে চলে গেছে। ম্যানেজারটাকে পর্যন্ত নিজের সাথে নিয়ে গেছে লোকটা!”
মায়ের স্নেহ সুলভ কন্ঠে শাহরিয়ারের ভিতরেের দহন যেন আরেকটু বাড়লো।
হঠাৎ করেই শাহরিয়ার উঠে এসে মায়ের কোলে মাথা রাখলো।
ফারিয়া হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। আলতো করে বিলি কেটে দিতে থাকে পুত্রের চুলে।
ছেলের মন কোনো কারণে অস্থির এটা বেশ বুঝতে পারছেন তিনি।
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ এভাবেই চুপ করে থেকে মৃদু কন্ঠে বললো,
“বাবাকে কিছু বলার দরকার নেই। এমনিতেও ওদিকে একটু ঝামেলায় আছে বাবা। এখন এদিকের কথা বলে শুধু শুধু টেনশন বাড়ানোর দরকার নেই। এমনিতেই প্রেসারের সমস্যা আছে বাবার। আমি সামলে নিতে পারবো এদিকের সবটা।”
_______________°_______________
ফারিয়া কিছুক্ষণ আগে শাহরিয়ারের রুম থেকে গিয়েছেন। শাহরিয়ার মুখ হাত ধুয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে লক্ষ্য করলো তার একটা চুল পাক ধরেছে।
তাজ্জব হয়ে চুলটার দিকে চেয়ে রইলো সে।
হঠাৎ করেই তার একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো।
একদিন জ্যোতি বলেছিলো শাহরিয়ারের একটা পাকা চুল সে দেখেছে যখন শাহরিয়ার ঘুমে ছিলো। পরে সে সেটা ছিঁড়ে নিয়েছে।
শাহরিয়ার একদমই বিশ্বাস করেনি।
জ্যোতি তারপরও তাকে টিটকারি করে বুড়ো খবিশ বলেছিলো।
শাহরিয়ার বাস্তবে ফিরে এলো। জ্যোতিকে একটা কল করা দরকার।
জ্যোতি বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলো সেসময়। শাহরিয়ারের কল দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করলো। এই লোকটা আবার কল করলো কেনো? ঘন্টা দুয়েক আগেই তো দেখা হয়েছে।
ফোন রিসিভ করে কাঠকাঠ গলায় বললো,
“হ্যালো!”
“সালাম আসে না মুখে না? এগুলো কী ধরনের অভদ্রতা?”
“শয়তানকে সালাম দিতে যাবো কোন দুঃখে?”
কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বলার সাহস পেলো না জ্যোতি। তাই চুপ করেই রইলো।
“নেক্সট অ্যাপয়েন্টমেন্ট কবে আমাকে জানিয়ে দিও। আমি সহ যাবো ডাক্তারের কাছে।”
“কোন সুখে? আম্মুই নিয়ে যেতে পারবে আমাকে।”
“বার্গেনিং না করলে হয় না তোমার? নিজেই তো বলেছিলে এই সময় মেয়েরা হাসবেন্ডের সাথে ডাক্তার দেখাতে যায়। এখন পল্টি খাচ্ছো কেনো?”
জ্যোতি চুপ করে রইলো।
শাহরিয়ারও কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো,
“তোমাদের বাড়িতে ওই ছেলেটা কে ছিলো?”
“কোন ছেলে?”
শাহরিয়ার চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“গেইটে তোমার হাত ধরেছিলো যে।”
জ্যোতি হকচকিয়ে গেলো। এটা কখন দেখলো শাহরিয়ার?
“কাজিন!”
শাহরিয়ার কিছুক্ষণ চুপ থেকে যেন বিষয়টা ধরতে পেরেছে এমন ভঙ্গিতে বললো,
“এক মিনিট! তুমি একবার বলেছিলে তোমার এক কাজিনের থেকেও সম্বন্ধ এসেছিলো তোমার জন্য। এটাই সে, তাই না? এজন্যই এতো উড়ছিলে ডিভোর্সের জন্য! এজন্যই তো বলি, হুট করে এতো জোর পাচ্ছো কোত্থেকে!”
জ্যোতি হতভম্ব হয়ে শাহরিয়ারের কথাগুলো শুনলো। হতভম্ব ভাব কাটতেই এক অপরিসীম রাগ তিরতির করে বাড়তে লাগলো জ্যোতির অভ্যন্তরে।
একদিন খুব সরল মনেই কথায় কথায় শাহরিয়ারকে বলেছিলো তার এক কাজিনের প্রস্তাব এসেছিলো তার জন্য। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। ওটা নওশাদ ছিলো না। কিন্তু শাহরিয়ার ঠিকই এই কথা ক্যাচ করে বসে আছে!
জ্যোতি উষ্মা নিয়ে বললো,
“সমস্যা কী আপনার? এতো সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হলে কবে থেকে ? কখনো ডাক্তার দেখাতে গেলে সন্দেহ করেন এবর্শন করাতে গিয়েছি, কখনো আমার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করেন! কী হয়েছে আপনার?”
শাহরিয়ারও রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করলো না। রেগেমেগে বললো,
“এসবের কারণ কি তুমি নও? এবর্শনের কথা কি আগ বাড়িয়ে তুমিই বলোনি? তুমি বলোনি, তোমার কাজিনের জন্য তোমার বিয়ের প্রপোজাল এসেছিলো?”
জ্যোতি রাগে কথার খেই হারিয়ে ফেললো। পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হওয়ার আগেই ফোন কেটে দিলো সে।
পর মূহুর্তেই আবার কল ব্যাক করলো শাহরিয়ারকে। শাহরিয়ারও একবার রিং হতেই রিসিভ করলো।
“Shahriar, go see a psychiatrist. You really need it!”
বলেই শাহরিয়ারকে কিছু বলতে না দিয়ে ঠাস করে ফোন কেটে দিলো জ্যোতি।
উফফ! ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তার!
“কীভাবে সহ্য করেছো এতদিন একে?”
জ্যোতি চমকে গিয়ে পই করে পিছনে ঘুরলো।
নওশাদ!
“আপনি এখানে? আড়ি পেতে আমার কথা শুনছিলেন?”
নওশাদ জবাব দিলো না জ্যোতির প্রশ্নে। পাল্টা বললো,
“তোমার ধৈর্য দেখে অবাক হচ্ছি! তোমার তো আরও আগে ডিভোর্স দেওয়া দরকার ছিল একে!”
জ্যোতিও নওশাদের কথার জবাব না দিয়ে আগের কথার খেই ধরে বললো,
“আপনি লুকিয়ে আমার কথা শুনছিলেন কেনো? খুবই বাজে হ্যাবিট এটা!”
নওশাদ হতাশ হয়ে বললো,
“আমি এমনিই এসেছিলাম এখানে। তোমাকে কথা বলতে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় শুনি আমার ব্যপারে কথা হচ্ছে!”
জ্যোতির চুল ছিড়তে ইচ্ছে করলো রাগে। ফোনের ভলিউম অনেক হাই ছিলো। তার উচিত ছিলো ভলিউমটা কমিয়ে রাখা।
“তাও ভালো সময় থাকতেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছো।”
জ্যোতি বিরক্ত হয়ে বললো,
“সেটা সময় এলেই দেখা যাবে কোনটা সঠিক কোনটা ভুল।”
নওশাদ বিষন্ন হয়ে বললো,
“দোষ তো সময়েরই! আম্মু যদি সময় থাকতেই সঠিক কাজটা করতো তাহলে এখনের চিত্রটা ভিন্ন হতো!”
জ্যোতি অপ্রস্তুত হলো। নিজেকে সামলে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“চিত্র যেহেতু ভিন্ন না তাই আপনারও উচিত না এখন এইসব কথা তোলা।”
“কিন্তু নিয়তি তো আরেকবার সুযোগ দিচ্ছে!”
জ্যোতি বিস্ময় নিয়ে তাকায় নওশাদের দিকে। অবাক সুরে বলে,
“আপনি এখন সুযোগের অপেক্ষায় আছেন?”
“ক্ষতি কী? মানুষ কি সেকেন্ড চান্স পায় না? কী কমতি আছে আমার?”
জ্যোতি চোখ মুখ উল্টে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“আপনি জানতে চান আপনার কীসের কমতি আছে? ম্যানার্সের!”
বলেই আর এক মূহুর্তের জন্যও দাঁড়ালো না সে। রেগেমেগে চলে গেলো সেখান থেকে।
#চলবে………..