কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-১১

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

মায়াকে রুমে রেখে আবীর বেরিয়ে পড়ে। ওর কি যেন কাজ আছে। মায়া হোটেলে না থেকে লাগোয়া বীচটাতে ঘুরতে যায়। বিমোহিত হয়ে সাগরের দৃশ্য দুচোখ ভরে দেখতে থাকে।নীলচে সাদা সাদা ফেনা ছড়িয়ে ঢেউগুলো তীরের পানে ছুটে আসছে। মাথার উপর বিশাল নীল আকাশটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সাগরপাড়ের বালুকাবেলায় দাঁড়িয়ে মায়ার দূর অজানায় হারিয়ে যেতে মন চায়। শহরের ব্যস্ত কোলাহল ছেড়ে এসে সাগরের এই নির্জনতা ওর মনের মাঝে একরাশ প্রশান্তি এনে দেয়। ঢেউয়ের প্রতিটি শব্দ ওর হৃদয়ের অন্তপুরে আছড়ে পড়ছে। আল্লাহপাকের সৃষ্টির এই সৌন্দর্য মায়া উপভোগ করে আর মনে মনে শোকরিয়া জ্ঞাপন করে। সাগরের এতো কাছাকাছি এসে মায়া উপলব্ধি করে কেন মানুষ বার বার সাগর পাড়ে ছুটে আসে। যদিও ওর জীবনে এবারই প্রথম আসা। আর আসবেই বা কি করে? যাদের জীবনে নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের কি সাগর নিয়ে বিলাসিতা শোভা পায়? সৈকতে পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে মায়া একমনে সাগরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ আবীরের ডাকে চমকে উঠে।
—-বারোটা বাজতে চললো,লাঞ্চ করবেন না?
আবীরের মুখে খাওয়ার কথা শোনার সাথে সাথে পেটটা চোঁ করে উঠলো।
মাথা নাড়িয়ে মায়া বললো,
–+চলুন যাই।
মায়া ওর সাথে ডাইনিং এ গিয়ে খাওয়া শেষ করে রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। মায়ার খুব ঘুম ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু যখনই মনে হচ্ছে আবীরের পাশে ঘুমাতে হবে তখনই ওর চোখ থেকে ঘুম পরীরা হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। রুমের দরজা খুলে মায়া অবাক। পাশে একটা ডিভান রাখা আছে। ডিভানটা বেশ বড়। এটাকে ডিভানও বলা যায় আবার খাট হিসাবে ব্যবহার করা যায়। ডিভানটা দেখে খুশী হয়ে মায়া বলে,
—এটা কখন আসলো?
—রুম সার্ভিস এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ওদের বলেছিলাম একটা ডিভান হলে ভালো হয়। অফিসের কাজ করতে সুবিধা হবে।
আবীর এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-,আপনি নিশ্চিন্তে বিছানায় ঘুমাতে পারেন। আমি এখানে ঘুমাবো।
মায়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আসলেই ওর খুব টায়ার্ড লাগছে। হোটেলের নরম বিছানায় শরীরটা ছেড়ে দিতেই ঘুমের অতলে তলিয়ে গেল। আবীর ডিভানে বসে অফিসের কাজগুলো করা শুরু করে। একসময় মায়ার দিকে চোখ যায়। মেয়েটা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। মনে হয় শীত লাগছে। রুমের এসিটা বেশ বাড়ানো রয়েছে। আবীর পায়ের কাছে রাখা কম্বলটা দিয়ে মায়ার শরীরটা ঢেকে দেয়। এমন সময় মায়ার মুখের দিকে আবীরের দৃষ্টি যায়। কি সুন্দর নিশ্পাপ মুখশ্রী! কম্বলটা পেয়ে মায়া নিজেকে ভালো করে ঢেকে নেয়। আবীর তাড়াতাড়ি মায়ার সামনে থেকে সরে আসে। যদি ঘুম ভেঙ্গে দেখে আবীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভুল বুঝতে পারে। আবীর বারান্দায় পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর মনে মনে ভাবে, মানুষের জীবনে সঙ্গীর বড়ই প্রয়োজন। পুরুষ কিংবা নারী একটা বয়সে তাদের শারীরিক চাহিদা থাকে সেটা একটা নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত। কিম্তু একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর প্রয়োজন হয় মৃত্যু পর্যন্ত। সেই বন্ধুটি স্বামী বা স্ত্রী হতে পারে। সবার জীবনে তাদের অর্ধাঙ্গীনিরা কি বন্ধু হয়? কিংবা তাকে বিশ্বাস করা যায়? কিন্তু ওর বাবা তো ওর মাকে বিশ্বাস করতে পারলো না।
মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। নিজের গায়ে কম্বল দেখে অবাক হয়। যতটুকু মনে পড়ে ওতো গায়ে কম্বল না জড়িয়ে ঘুমিয়েছে। রুমের লাইট অফ করা। রুমের চর্তুদিকে চোখ বুলিয়ে আবীরকে খুঁজতে থাকে। মোবাইল অন করে দেখে সাড়ে পাঁচটা বাজে। তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে এসে আসরের নামাজ আদায় করে নেয়।
এরপর বারান্দার দরজাটা খুলে দেখে আবীর চেয়ারে বসে দূরের সমুদ্র দেখছে। মায়ার পায়ের আওয়াজ পেয়ে আবীর পিছনদিকে তাকায়। মায়াকে দেখে বলে,
—-ঘুম ভাঙ্গলো আপনার?
—-না ভাঙ্গলে আপনার সামনে কিভাবে আসলাম।
আবীর মুচকি হেসে বলে,
—আপনার চেহারা ধারণ করে পেত্নীও তো আসতে পারে তাই না? এসব হোটেলে নাকি অশরীরি আত্মারা ঘুরে বেড়ায়।
মায়া একটু ভয় পায়। তারপর বাইরে কোনো পরোয়া করি না এমন একটা ভাব দেখিয়ে বলে,
—-আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে লাভ নেই।
এরপর মায়া সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আবেগ মিশ্রিত গলায় বলে,
—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
—-হঠাৎ,
—-এই যে আপনার সাথে সমুদ্র দেখতে আসলাম।
—আল্লাহপাক আপনার রিজিকে লিখে রেখেছেন বলে আসতে পেরেছেন। আমার এখানে ধন্যবাদ পাওয়ার কিছু নেই। আপনাকে আরো সুন্দর জিনিস দেখাবো।
মায়া সমুদ্র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবীরের দিকে মেলে ধরে বলে,
–+কি জিনিস,
—যতসম্ভব আজ পূর্ণিমা। রাতে সাদা সাদা ঢেউ গুলোতে চাঁদের আলোয় চিকমিক করে। আর পূর্নিমা থাকার কারণে ঢেউগুলো বেশ বড় হয়। চাঁদের আলো আর সাগরের গর্জনের মিশেলে অপরুপ সৌন্দর্যের পসরা বসে বালুকাবেলায়। যাবেন নাকি?
আবীরের অপূর্ব বর্ণনায় মায়া রাজী হয়ে যায়। কথা অনুযায়ী রাতের ডিনার সেরে মায়া আর আবীর বীচের দিকে হাঁটতে থাকে। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ উঠেছে। তার আলোকছটা সমুদ্রের বুকে প্রতিফলিত হয়ে এক অদ্ভুত নৈসর্গিক সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে। মায়া “ছুবহানআল্লাহ” বলে। মায়ার ধর্মীয়বোধটা আবীরকে বেশ আকর্ষণ করে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। মায়া আবীরকে বলে,
—-মাথার উপর পূর্ণিমার চাঁদ পায়ের নীচে সমুদ্রে ঢেউ সাথে আপনার মতো একজন বিশস্ত মানুষের সাথে সাগরের বালুকাবেলায় হাঁটবো কোনোদিন কল্পনাতে আসেনি।
আবীরও আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—-আপনার ভাগ্যে আল্লাহপাক রেখেছেন।
আবীরও মনে মনে একই কথা ভাবতে লাগলো। ওর মা ওকে ওভাবে ফেলে চলে যাওয়াতে আজ অবদি কোনো নারীকে ও ভালোবাসেনি কিংবা ওর জীবনের পটভূমিতে আসতে দেয়নি। কিন্তু আজ এই চাঁদনী প্রহর রাতে সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে মায়ার মতো একজনকে কাছে পেতে মনটা বড় চাইছে। মায়ার নরম কোমল হাতটা ধরে হাঁটতে বড় ইচ্ছে করছে। পরমুহুর্তেই শামুকের মতো নিজের আবেগগুলোকে খোলসের ভিতর ঢুকিয়ে রাখে। নিজের ভালোবাসাগুলোকে বুকের ভিতর পুষে রাখে।

মায়ার আজ নিজেকে রানীর মতো সুখী মানুষ মনে হয়। আবীরের সাথে বিয়ে হওয়ার আগের দিনও নিজেকে অসহায় দুঃখী মানুষ মনে হয়েছিলো। অথচ একসপ্তাহের মধ্যে ওর জীবনের চিত্রটা বদলে গেল। আজ ওর বাবার কথা খুব মনে পড়ছে। বাবা ওকে সবসময় বলতো,
—-দেখিস তোর জীবনে একদিন রানীর মতো সুখ আসবে। যে সন্তান বাবা মায়ের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেয় তার জীবনে সুখ আসে আল্লাহর তরফ থেকে। তার প্রতিটি সৎ কাজের ফল আল্লাহপাক বহুগুন বরকত দেন। মায়ার চোখটা ভিজে উঠলো। দিনের বেলা হলে আবীর দেখতে পেতো। রাত বলেই অশ্রুটাকে মায়া আড়াল করে নিলো। মায়া হাঁটতে হাঁটতে পানিতে গিয়ে নামলো। এমন সময় একটা বড় ঢেউ এসে মায়াকে ভাসিয়ে নিতে চায়। মায়া ভয় পেয়ে পেছাতে গেলে হোঁচট খাওয়ার উপক্রম হয়। আবীর দ্রুত মায়ার হাতটা ধরে ফেলে। মায়া পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
—-সরি,
আবীরের হাতটা ধরার খুব ইচ্ছে ছিলো। যেভাবেই হোক মায়ার নরম কোমল হাতটা ধরতে পেরে ওর ভীষণ ভালো লাগছে। সে কারণে মায়াকে বলে,
—-এতো সরি বলতে হবে না। এখন রুমে ফেরা যাক।
মায়ার হোটেলে ফিরতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু উপায় নেই ফিরে যেতে হবে। রুমে এসে ক্লান্ত থাকার কারণে ওরা দুজন ঘুমিয়ে পড়ে। খুব সকালে মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বিছানায় বসে আবীরের দিকে চোখ যায়। হাতে একটা গল্পের বই। বইটা বুকের উপর রাখা। কম্বলটা পায়ের কাছে পড়ে আছে।
Walter scott এর লেখা”lvanhoe” বইটা মায়া সরিয়ে রেখে কম্বলটা টেনে দেয়। আবীর চোখ খুলে বলে,
—-ঋণ শোধ করছেন?
মায়া প্রথম বুঝতে পারেনি। পরে মনে পরে আবীরও ওর গায়ে কম্বল টেনে দিয়েছিলো। হেসে দিয়ে মায়া বলে,
–পৃথিবীর সব ঋণ শোধ করতে হয় না। এতে শুধু বিড়ম্বনা বাড়ে। আপনার ঠান্ডা লাগছে বলে কম্বলটা টেনে দিলাম। আপনি রাতে ঘুমাননি?
—-ঘুমিয়েছি। তবে চারটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভাবলাম গল্পের বই পড়লে হয়তো ঘুম আসতে পারে। এসেছিলো কিন্তু আপনার টানাটানিতে ভেঙ্গে গেল।
—কি বলছেন এসব?
—-একটু মজা করলাম। আমরা আর কিছু না হই বন্ধু হতে তো বাঁধা নেই।
—আমার নামাজের দেরী হয়ে যাচ্ছে।
মায়ার মনে হলো ও ক্রমে আবীরের উপর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। নিজের দুর্বলতা ঢাকতে আবীরের সামনে থেকে সরে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। আবীরও বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসে। এরপর দুজনে বারান্দায় বসে কিছু সময় কাটায়। সকালের নাস্তাটা নীচের বাগানে খোলা জায়গায় দেওয়া হবে। আবীর আর মায়া রেডী হয়ে সেদিকে যায়। নাস্তা শেষ করে আবীর মায়াকে বলে,
—দুপুরের লাঞ্চ আমি বাইরে করবো। আপনারটা কি রুমে দিয়ে যেতে বলবো?
মায়াও ভাবে একা একা বাইরে খেতে ভালো লাগবে না। সে কারণে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

আবীর পাঁচটার দিকে রুমে ফিরে আসে। বাইরে তখন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঘরে এসে দেখে মায়া রুমে নাই। বারান্দায় গিয়ে দেখে সেখানেও নেই। এরপর ওয়াশরুমে দেখে মায়া নেই। ফোন করে দেখে মায়ার মোবাইল বন্ধ। আবীর দৌড়ে লিফট দিয়ে নীচে নামে। রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে,মায়াকে ওরা কেউ দেখেছে কিনা। আবীরের পুরো শরীর ঘামতে থাকে। বাইরে তখন মেঘের গর্জন আর ঝড়োবৃষ্টি বয়ে চলেছে।

চলবে