#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী
বারান্দায় বসে মায়া সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে ঢেউয়ের খেলা দেখে। এদিকে বিকালের নরম রোদ সৈকতের বালির উপর পড়তেই বালুগুলো চিকমিক করছে। মায়ার মনে হলো এক অদৃশ্য সুতোর টান ওকে সাগরের দিকে টানছে। মায়া আর থাকতে পারলো না। রুমে এসে জিন্স ফতুয়া আর একটা হেজাব মাথায় জড়িয়ে নেয়। গলায় একটা ওড়না ঝুলিয়ে কেটস পরে ও রুম থেকে বের হয়। লিফট দিয়ে নেমে বীচের দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর যেতেই সোনালী রোদ মিলিয়ে যেতে থাকে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কিন্তু মায়া সমুদ্রের মোহে এতোটাই বিভোর সে তীর ধরে একটানা হাঁটতে থাকে। অনেকদূর হেঁটে যায়। কতদূর চলে আসে ও বুঝতে পারে না। ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করে। বীচটাও খালি হতে শুরু করেছে। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ওদের হোটেলটা বহুদূর পিছনে ফেলে এসেছে। মায়া আর সামনের দিকে এগোয় না। যে পথ ধরে হেঁটে এসেছে সেই পথ ধরে আবার ফিরে যেতে থাকে।
পুরো বীচ এরিয়া আস্তে আস্তে নির্জনতার চাদরে ঢেকে যায়। ভয়ে টেনশনে মায়ার পায়ের গতি মনে হয় শ্লথ হয়ে বসে। মায়া দৌড়ানো শুরু করে। মায়ার গতির সাথে তাল দিয়ে বৃষ্টির গতিও বেড়ে যায়। হঠাৎ সামনে তিনজন লোক এসে ওর পথ রোধ করে। মায়া ওদেরকে জিজ্ঞাসা করে,
—আপনারা আমার পথ আটকিয়েছেন কেন?
—-আপনার দুই হাতে সোনার বালাগুলো দিয়ে যান তাহলে আপনাকে ছেড়ে দিবো।
মায়ার তখন স্বপ্নের কথা মনে হয়। পাশাপাশি মনে মনে ভাবে কতবড় ভুল ও করে ফেলেছে। এই জিনিস তো ওদের হাতে কিছুতেই দেওয়া যাবে না। এটা ওদের পারিবারিক ঐতিহ্য। মায়ার কাছে এটা অনেক বড় আমানত। নাহ্ কিছুতেই এই জিনিস ওদের হাতে তুলে দিবে না। মায়া ওদের কথা শুনে হেসে দিয়ে বলে,
—ইমিটিশনের এই বালার দাম ক’টাকাই বা হবে। এটা নিয়ে আপনাদের তেমন কোনো লাভ হবে না।
—আপু আমরা যে পেশায় আছি সোনা চিনতে আমাদের বেগ পেতে হয় না। আপনি বালাগুলো খুলে আমাদের হাতে তুলে দেন। আসল না নকল তা আমরা বুঝে নিবো।
কথার মাঝে ব্যস্ত রেখে মায়া সুযোগ বুঝে আবারও দৌড়াতে থাকে। ওরাও মায়ার পিছু পিছু দৌড়ায়।
ওদিকে আবীর হোটেল থেকে একটা জীপ কালেক্ট করে বীচের দিকে চালাতে থাকে। আবীরের মনে হয় মায়াকে এভাবে রুমে একা রেখে ওর বের হওয়া উচিত হয়নি। যদি মেয়েটার কিছু হয়ে যায় তখন এই চিন্তাটা ওকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। টেনশনে আবীরের মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। আবীরের মনে দ্বন্দ শুরু হয়। সন্ধার আলো আঁধারীতে ঝড়ো বৃষ্টির রাতে মেয়েটা হোটেলে কিভাবে ফিরে আসবে?
এদিক মুষলধারে বৃষ্টি হওয়াতে গাড়ির সামনের কাঁচ ঘোলাটে হয়ে আসছে। ওয়াইপার দিয়ে পরিস্কার করেও কুলানো যাচ্ছে না। বৃষ্টির মাঝে ভেজা বালির উপর গাড়ি চালাতে আবীরের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। হেটেলের একটা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। ওর নাম নাদিম। তবে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলটাও নিয়ে এসেছে। হঠাৎ গাড়ির হেড লাইটের আলোতে সামনে কাউকে দেখা যাচ্ছে। নাদিম সেদিকে তাকিয়ে আবীরকে বলে,
—-স্যার গাড়িটা আস্তে চালান। সামনে মনে হয় কাউকে দেখা যাচ্ছে।
গাড়ির কাছাকাছি চলে আসাতে নাদিম চিৎকার দিয়ে বলে,
—মনে হচ্ছে ম্যাম আসছেন।
আবীর অবাক হয়ে বলে,
—-তুমি কি করে চিনলে?
—বিকালে ম্যাম যখন হাঁটতে বের হন তখন আমার সাথে দেখা হয়েছে।
তবে আবীর দেখতে পাচ্ছে মায়ার পিছনে দু’তিনজন লোক ছুটে আসছে। এই দৃশ্য দেখে আবীরের বুকের ভিতরটা ধ্বক করে উঠলো। হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠে। আবীর গাড়ি থেকে নেমে ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। গুলির আওয়াজ পেয়ে মায়ার পিছনের লোকগুলো সামনে এগুনোর সাহস পায় না। মায়া দৌড়ে এসে ভয়ে আবীরকে জড়িয়ে ধরতে চায়৷ কিন্তু শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলে নেয়। আবীর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তুমি ঠিক আছো?
মায়া মাথা নাড়িয়ে বলে,
—ওরা ছিনতাই কারী ছিলো।
আবীর এসময় নাদিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আপনাদের বীচটাতো নিরাপদ নয়।
নাদিম তখন আবীরকে বলে,
—,ম্যাম আমাদের বীচের সীমানা পার হয়ে গিয়েছেন।
আবীর বুঝতে পারে মায়া যেহেতু এখানে প্রথম এসেছে সেকারণে হয়তো বুঝতে পারেনি। বৃষ্টিও থেমে গেছে ঝড়টাও আর নেই। মায়াকে পেয়ে আবীরের বুক থেকে একটা দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে আসলো। আবীর আর কথা না বাড়িয়ে মায়াকে নিয়ে রুমে ফিরে আসে। আবীরের মুখে তুমি ডাক শুনতে মায়ার বেশ ভালো লাগে। লাগলে কি হবে? ও শুধু লোক সম্মুখে মায়াকে তুমি বলে। কিন্তু অন্তরালে আপনি বলে দুরত্বের দেয়াল তুলে ধরে।
গাড়িতে পুরোটা পথ মায়া নিরব ছিলো। রুমে এসে আবীরকে বলে,
—আপনাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য দুঃখিত।
আবীর মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে পুরো শরীর ভিজে চুপচুপ। নাহ্ আবীরের মায়ার উপর রাগ হয়নি বরং ওকে যখন খুঁজে পাচ্ছিলো না তখন ওর বুকের ভিতরটা শুন্য হয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো খুব দামী একটা রত্ন হারিয়ে ফেলেছে। আবীর মায়ার দিকে তাকিয়ে আবেগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—-আমি খুব একটা নামাজ পড়ি না কিংবা ধার্মিক মানুষ নই। কিন্তু আজ যখন আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন প্রাণ ভরে আল্লাহকে ডাকলাম। আল্লাহপাক আমাকে ফিরিয়ে দেননি। যাক আপনাকে খুঁজে পেয়েছি আল্লাহপাকের কাছে অনেক শোকরিয়া। সুতরাং আপনার সরি হবার কিছু নেই। আপনি বরং ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক বদলে ফেলুন ঠান্ডা লেগে যাবে।
ওর জন্য আবীরের এই হাহাকার মায়ার অনুভূতিতে নাড়া দেয়। বাহ্যিকদিক থেকে আবীরকে ওর খুব কঠিন মানুষই মনে হতো। কিন্তু ভিতরের মানুষটা খুবই আবেগপ্রবন। দাদীমা ঠিকই বলেছিলেন।
মায়া ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক বদলে নেয়। হালকা মেহেদী রঙের থ্রিপীচ গায়ে জড়িয়ে নেয়। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আবীরকেও ওর পোশাক বদলে নিতে বলে। আবীর একটা ট্রাউজার সাথে টিশার্ট পড়ে নেয়। আবীরের মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে। ভার হয়ে আছে। ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে ফোনে দুকাপ কফির অর্ডার করে। কিছুক্ষণের মধ্যে কফি চলে আসে। আবীর নিজের মগটা নিয়ে চুমুক দেয়। কফি শেষ হবার পরও শরীরের ম্যাজ ম্যাজ ভাবটা কমছে না। বরং চোখটা লাল হয়ে আসছে। জ্বর জ্বর ভাব হচ্ছে। শরীরটা উষ্ণ হয়ে আসছে। ও ডিভানে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। মায়া কফির মগে চুমুক দেয় আর ফেসবুক ক্রল করতে থাকে। আবীরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমের দিকে তাকাতেই কম্বল মুড়িয়ে ওকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে। শোয়ার ধরণটা স্বাভাবিক লাগছে না। কফিটা শেষ করে ও আবীরের কাছে আসে। কেমন যেন একটা গোঙ্গানীর মতো শব্দ হতে থাকে। কপালে আলতো করে হাত দিতেই আবীর বলে,
—-ও কিছু না,শরীরটা শুধু একটু গরম হয়েছে।
মায়া অস্থির হয়ে বলে,
—জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে আর আপনি বলছেন একটু গরম হয়েছে।
মায়া চটজলদি ওর ওষুধের বক্স খুলে একটা নাপা ট্যাবলেট বের করে আবীরকে খাইয়ে দেয়।আবীর ওষুধ আর পানি খেয়ে বলে,
—ওষুধ কোথায় পেলেন?
মায়া হেসে বলে,
—-এ আমার বহুদিনের অভ্যাস। একটা ছোটো ফাস্ট এইড বক্স আমি সবসময় সাথে রাখি।
মায়ার এই সচেতনতা আবীরের ভিতর ভালো লাগা ছড়িয়ে দেয়। ওষুধ খেয়ে ওর ভালো লাগছে। আসলে জীবনে কারো আপন হতে গেলে খুব বড় কিছু করতে হয় না। এই ছোটো ছোটো অনুভূতিগুলো মানুষকে পরস্পরের কাছে টেনে আনে।
কোনো রকমে রাতের ডিনার সেরে আবীর আর মায়া শুয়ে পড়ে। সারাদিনের টেনশন আর ধকলে শোয়ার সাথে সাথে মায়া ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আবীরের চোখে ঘুম আসে না। ওর মাথাটা ব্যথা করছে। প্রথমে ব্যথাটা অল্প ছিলো। ক্রমে তা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। ওর একবার মনে হলো মায়াকে ডেকে আরো একটা ওষুধ দিতে বলবে। পরক্ষণেই ওর কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হলো না। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সয়ে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু পেরে উঠে না। মুখ দিয়ে উহ্ আহ্ শব্দ বের হয়। একসময় মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কানে শব্দ ভেসে আসে। হঠাৎ আবীরের জ্বরের কথা মনে পড়ে। ডিভানের দিকে তাকিয়ে দেখে আবীর ছটফট করছে। বিছানা থেকে নেমে মায়া আবীরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর ছটফটানি দেখে জিজ্ঞাসা করে,
—আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?
—,হুম, মনে হচ্ছে জ্বরটা আবার আসতে চলেছে আর মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। আমাকে আরো একটা নাপা ট্যাবলেট দিলে ভালো হয়।
—-আমাকে ডাকেননি কেন?
—-আপনার ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে হয়নি।
মায়া চটজলদি আরো একটা নাপা ট্যাবলেট আবীরকে খাইয়ে দেয়। কিন্তু মাথার যন্ত্রণায় ওর ঘুম আসছিলো না। আবীরের কষ্টটা মায়াকে পীড়া দিতে থাকে। একসময় ও আবীরের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে। আলতো করে আবীরের কপালে হাত রাখে। আবীর চোখ খুলে একবার মায়াকে দেখে কিন্তু নিষেধ করে না। বরং ওর মনে হয় মা চলে যাবার পর এই প্রথম কেউ একজন পরম মমতায় ওর কপালে হাত রাখলো। আবীরের দুচোখের কোন বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। টিস্যু দিয়ে মায়া সেই অশ্রু মুছে দেয়। নাহ্ আবীরের কাছে মায়া কিছুই জানতে চায়নি। কারণ দাদী জিনাতুন্নেছার কাছে মায়া ওর সম্পর্কে সব জেনেছে।
মায়া আবীরের মাথাটা আস্তে আস্তে ম্যাসেজ করে দেয়। জীবনে একজন খুব আপন মানুষের অভাব এই প্রথম আবীর উপলব্ধি করে। মনে হয় কেউ একজন ওকে শাসন করার কিংবা ভালোবাসার থাকুক। ও ব্যথা পেলে যার হৃদয়ের কষ্টের অনুভব হবে। যার হাসিতে ওর পৃথিবীটা হেসে উঠবে। যে মানুষটা কাছে থাকলে পুরোটা সময় ভালোবাসার মায়া ছড়িয়ে দিবে। আজ আবীরের মন খুব ইচ্ছে হয় মায়া ওর শিয়রে বসে থাক। মায়ার কোলে মাথাটা রেখে ওর ঘুমাতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা কি করে হয়? এই মেয়েটার সাথে ওর আদৌ কি সেই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? কিন্তু ধর্মীয় মতে সামাজিকভাবে ওরা তো স্বামী স্ত্রী। চাইলেই তো ওরা দাম্পত্য জীবন শুরু করে পুরো জীবন পার করে যেতে পারে। এসব নানা ভাবনায় আর মায়ার হাতের কোমল স্পর্শে আবীরের দুচোখে ঘুম নেমে আসে।
একসময় আবীরের নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ঘন হয়ে আসে। মায়া জেগে থাকে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরটা আর নেই। শরীরটা ঘেমে গিয়েছে। মায়া আবীরের শরীর থেকে কম্বলটা সরিয়ে দিতেই লোমশ বুকটার দিকে ওর নজর পড়ে। খুব ইচ্ছে করে ঐ বুকটায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে মনে মনে মায়া বলে, “এ আমি কি ভাবছি। মরীচিকার এই সংসারের মায়ায় আটকে পড়া যাবে না। তাহলে সারাজীবন ওকে কষ্ট পেতে হবে।”
বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে বসে। ওর মনটা ভালো নয়। আজকের ঘটনাটার কথা মনে হয়। মনে মনে ভাবে কেন ওকে বারবার এভাবে বিপদে পড়তে হয়। আর এই মানুষটাই বা কেন ঐ সময় ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। ও জানে না আল্লাহপাকের এ কেমন ইশারা!
চলবে
#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
আধোঘুম আধোজাগরণে মায়ার রাতটা কেটে যায়। সকালে আবীরের বেশ ভালো লাগছে। তবে একটু দুর্বল। মায়াকে ডেকে আজকের ব্রেকফাস্ট রুম সার্ভিস দিতে বলে। মায়া রিসিপশনে ফোন দিয়ে ব্রেকফাস্টের কথা বলে। সাথে আবীরের জন্য চিকেন আর ভেজিটেবলের মিক্সড সুপ দিতে বলে। উনারাও রুটি সবজির সাথে দুগ্লাস অরেঞ্জ জুস, সুপ আর ডেজার্ট হিসাবে পুডিং দিয়ে যায়। নাস্তার পাঠ শেষ করার পর চা কফি দিয়ে যায়। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মায়া আবীরকে বলে,
—-ওয়াশরুমে গিয়ে গরম পানি দিয়ে শরীরটা ধুয়ে নিন। ভালো লাগবে।
আবীর সাথে সাথে বলে,
—-আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেই আমার মাথাটা ঘুরে। ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু জ্বরের ঘোরে স্ট্রোক করেছিলো। যদিও ব্যাটা বেঁচে আছে। ও ব্যাটার তো বউ আছে। সেবা যত্ন করার পর সুস্থ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার সেবা যত্ন কে করবে?
আবীরের কথা শুনে মায়া আপন মনে গুন গুন করে গলায় গানের সুর ভাজে।
“হাতের কাছে ভরা কলস তৃষ্ণা মেটে না,কেউ কোনদিন আমারে তো কথা দিলো না।” বলে একা একা হাসলো। সেদিকে তাকিয়ে আবীর বলে,
—-আপনার কি মাথায় সমস্যা, একা একা হাসছেন।
—-কেন আপনার সামনে কি এখন হাসতে মানা?
“রামগরুদের ছানা, হাসতে তাদের মানা,হাসির কথা শুনলে বলে হাসবো না না।”
“ভালোই তো আবৃত্তি করেন।” আবীর বলে,
“আচ্ছা গানের সুরটা খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আপনি একটু ধরিয়ে দিলেই আমি বলতে পারবো।” আবীর বলে,
মায়া আবীরকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। গিজার চালু করে পানি গরম করে নেয়। তাতে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে আসে। আবীরকে ওর শরীরটা মুছতে বলে। আবীর বুক হাত মুছতে পারলেও পিটের দিকটা মুছতে পারছিলো না। মায়া তোয়ালেটা আর একবার ভিজিয়ে নিংড়ে এনে পিটের দিকটা মুছে দেয়। এবার ঠান্ডা পানি দিয়ে তোয়ালেটা ধুয়ে মাথা মুছে দেয়। মায়ার হাতের স্পর্শে আবীরের চোখ দুটো আবেশে বুঝে আসে। মনে মনে এরকম একজন আপনজনের প্রয়োজন খুব তীব্রভাবে অনুভব করে। এরপর মায়া সুটকেস থেকে একটা ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে আবীরের হাতে দেয়। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। ওয়াশরুমে গিয়ে পোশাক বদলে আবীর বারান্দায় এসে বসে। মায়াও ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়। পোশাকটা বদলে হালকা নীল রঙের একটা লখনৌস্টিচের সুতী থ্রিপীচ গায়ে জড়ায়। রুমে আসতেই ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে ইরা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ইরা সালাম দিয়ে বলে,
—আপু কেমন আছো?
কিন্তু ইরার গলাটা মায়ার কাছে কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে ও কাঁদছে। সে কারণে চিন্তিত হয়ে বলে,
—আলহামদুলিল্লাহ,আমি তো ভালো আছি। তোর গলাটা এমন লাগছে কেন।
—-একটু ঠান্ডা লেগেছে। সেজন্য এরকম শোনাচ্ছে।
ইরা একটু অস্বস্তি নিয়ে মায়াকে বলে,
—আপু জাওয়াদকে একটা হুন্ডা কেনার জন্য তুমি লোন দিতে চেয়েছিলে। সেটা কি দিতে পারবে?
—এই কথাটা বলতে তুই এতো সঙ্কোচ কেন করছিস? অবশ্যই পারবো। ম্যাসেঞ্জারে জাওয়াদের একাউন্ট নাম্বারটা পাঠিয়ে দে।
—-আপু তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আসলে জাওয়াদের ইনকাম না থাকাতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। বুঝোই তো ওদের টানাটানির সংসার। আমি এখুনি একাউন্ট নাম্বারটা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফোনটা রাখার সাথে সাথে টুং করে শব্দ হলো। ইরা একাউন্ট নাম্বার পাঠিয়েছে। মায়া সাথে সাথে অনলাইনে টাকা পাঠিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর ইরা আবারো ধন্যবাদ জানিয়ে ম্যাসেজ পাঠায়।
আবীর অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে থেকে রুমে ফিরে এসে মায়াকে বলে,
—- সমুদ্রের বাতাসে দ্রুত খিদে লেগে যায়। চলুন লাঞ্চ করে আসি।
মায়া রুমে দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে বারোটা বাজে। লাঞ্চ টাইম হয়ে আসছে। রাতে ঘুম না হওয়াতে মায়ার খুব ঘুম পাচ্ছে। ও দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে একটু ঘুমাবে। তা,না হলে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হবে।
ওরা দু’জন ডাইনিং এ গিয়ে দ্রুত লাঞ্চ করে রুমে ফিরে আসে। মায়া সাথে সাথে শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যে মায়া ঘুমিয়ে পড়ে। আবীর দূর থেকে মায়ার মুখটার দিকে বার বার তাকায় আর ভাবে সবার ঘুমন্ত মুখটা কি এরকম নিশ্পাপ দেখায়? ওতো ওর নিজেরটা দেখতে পায় না। মায়ার পাশে গিয়ে শুয়ে ওর সুন্দর মুখশ্রীটা দেখতে আবীরের খুব ইচ্ছে করে। তবে মায়ার প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। নিজের পরিবারের জন্য মেয়েটা কি না করছে। চাইলেই নিজের মতো করে জীবনটা গড়ে নিতে পারতো। দেখতে সুন্দরী শিক্ষিত ওকে বিয়ে করতে পুরুষের অভাব হবে না। কিন্তু মেয়েটার কাছে তার নিজের সুখের থেকে পরিবারের দায়িত্ব অনেক বেশী। মায়ার আরো একটা গুন আবীরকে আকৃষ্ট করে। তা হচ্ছে ও নির্লোভ একজন মানুষ। আবীর বিয়েতে ওকে অনেক গয়না দিয়েছে। বিয়ের পাট চুকে গেলে গয়নাগুলো ফেরত দিতে চেয়েছে। বর্তমানে ওর হাতে পাঁচ লাখ টাকা দামের দুটো বালা আছে। লোভী হলে কাল একটা বালা লুকিয়ে রেখে বলতেই পারতো ছিনতাই কারী নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু নিজেকে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েও এই আমানত ও রক্ষা করেছে। আবীরের ভালো লাগলেও মায়া ওর চারপাশে দ্বিধার দেওয়াল তুলে দিয়েছে। সেটাকে আবীর এখন পর্যন্ত ভাঙ্গতে পারেনি।
মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখে ও বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। একবার মনে হলো সন্ধে হয়ে যাচ্ছে ওকে ডেকে দেওয়া উচিত। পরমুহুর্তে আবীরের মনে হলো, কাল সারা রাত মেয়েটা ওর জন্য ঘুমায়নি। মায়া ঘুমের মধ্যে খুব হাত পা ছুঁড়ে। কম্বলটা একসময় খাট থেকে ফেলে দেয়। আবীর ডিভান থেকে উঠে গিয়ে কম্বলটা ওর গায়ে তুলে দেয়। ডিনারের আগে আবীর মায়াকে ডেকে দেয়। মায়া ঢুলু ঢুলু চোখে ডিনার করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে নাস্তা করেই ওরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সব আনুষ্টানিকতা শেষ করে আটটার সময় বাংলাদেশ বিমানে উঠে। ন,টা দশ মিনিটে বিমান ঢাকা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে। মোবারক আর ড্রাইভার রফিক আগে ঘেকেই এয়ারপোর্টে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আবীর আর মায়া গাড়িতে উঠে বসে। মোবারক আর রফিক মিয়া আবীর আর মায়াকে সালাম দেয়। মোবারকের কাছে আবীর ওর দাদী শরীরের কথা জানতে চায়। মোবারক বলে,
—দাদী ভালো আছেন।
সাড়ে এগারোটার মধ্যে ওরা বাসায় পৌঁছায়।
বাসায় পৌঁছে আবীর দেখে দাদীর রুম থেকে ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার ফয়সল আঙ্কেল বের হলেন। আবীর খুব চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
—আঙ্কেল দাদীর শরীর ঠিক আছে?
—-তেমন কিছু না। একটু জ্বর এসেছে।
ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে আবীর দাদীর রুমে এসে বলে,
—তোমার জ্বর এসেছে আমাকে জানাওনি কেন?
—-তোরাতো আজকেই আসবি সেই কারণে বলিনি। শুধু টেনশন বাড়িয়ে কি লাভ? এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে জিনাতুন্নেছা বলেন,
—-হানিমুনটা কেমন হলো?
—-ভালো,
—-শুধুই ভালো?
মায়া আবীরের দিকে তাকায়। আবীর দাদীর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-অসুস্থ অবস্থায় তোমার এতো রস আসে কোত্থেকে?
—+এই রসবোধ আছে বলে এই মারণ রোগ আমাকে কাবু করতে পারে না। যা তোরা রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে নে।
আবীর আর মায়া নিজেদের রুমে চলে আসে। ক’দিন অফিসে যাওয়া হয় না। আবীর ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে অফিসের দিকে রওয়ানা হয়। মায়া এই ফাঁকে ওর মাকে ফোন দিয়ে ওর বাবার খোঁজ নেয়। নোবেল আর রুবেলের ব্যাপারে খোঁজ খবর করে। ওদের পড়াশোনা কেমন চলছে তাও জানতে চায়। তবে সালেহা বেগম ইরার বিষয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে মায়াকে বলে,
—ইরাটা মনে হয় ভালো নেই।
মায়াও চিন্তিত হয়ে জানতে চায়,
—-তোমার এমন মনে হওয়ার কারণ কি?
—রুবেলকে ঐ বাসায় পাঠিয়েছিলাম। ইরার মুখটা বড্ড পাংশুটে হয়ে আছে। তাছাড়া রবেলের সাথেও ওদের ব্যবহারটা আন্তরিক ছিলো না। চা বিস্কুট খাইয়ে বিদায় দিয়েছে।
—- এটার ভিত্তি করে কারো সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করা ঠিক নয়। তুমি ওকে নিয়ে এতো ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
কথা শেষ করে মায়া ফোনটা রেখে দিয়ে মনে মনে ভাবে,জাওয়াদকে ওর কাছে খুব একটা সুবিধার মানুষ মনে হয় না। মায়া ইরার কনসিভ করার বিষয়টা জেনে গিয়েছে বলেই হয়তো ও ইরাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। যাক মায়া আর খারাপ কিছু ভাবতে চায় না। তবে এটাতো সত্যি যার কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হয়।
জান্নাত মহলে মায়ার জীবনের ছ’মাস সময় পার হয়ে যায়। আবীরের সাথে ওর সম্পর্কটা এখন বেশ স্বাভাবিক। আবীর এখন ওর রুমে ঘুমায়। ওদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্কটা চালু না হলেও দুজন দুজনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্ধুত্বের কোমল মসৃন ধারাজলে দুজন দুজনকে সিক্ত করেছে। মাসে দু,বার মায়া ওর বাবার বাড়িতে যায়। নভেম্বর মাস। ঢাকায় একটু একটু করে শীত পড়া শুরু হয়েছে। মায়ার বাবার সংসারে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ অনেকটা ফিরে এসেছে। দুমাস পর নোবেলের এসএসসি পরীক্ষা। মায়া টিচার দিতে কোনো কার্পন্য করেনি। ও মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করেছে। ভাইদুটো নিজের পায়ে দাঁড়ালে মায়ার বুকের উপর থেকে একটা বিশাল ভার নেমে যাবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে চারিদিকে গোধুলীর আবীর ছড়িয়ে পড়েছে। আবীর আজ এক সপ্তাহ পরে দেশে ফিরছে। ব্যবসার কাজে থাইল্যান্ড গিয়েছিলো। মোবারক আর রফিক আবীরকে আনতে এয়ারপোর্টে গিয়েছে। আবীরকে দেখার জন্য ওর চোখ দুটো অস্থির হয়ে আছে। এই কয়দিন মায়া আবীরকে প্রচন্ড মিস করেছে। বন্ধু হিসাবে আবীর অতুলনীয়। এ কথা মায়ার অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ইদানিং আবীরকে নিজের করে পেতে মন চায়। তারপর আবার ভয় হয়। তবে জীবনসঙ্গী হিসাবে আবীর কেমন হবে ওর জানা নেই।
থাই ল্যান্ডের সুবর্নভুমি এয়ারপোর্টে আবীর ডিউটি শপে ঘুরতে থাকে। ওখানে একটা ডায়মন্ডের শপ চোখে পড়ে। মায়ার জন্য কিছু একটা কিনতে ইচ্ছে করছে। আজ অবদি মেয়েটাকে ওর তেমন কিছু দেওয়া হয়নি। পুরো দোকান ঘুরে এক জোড়া কানের দুল ওর পছন্দ হয়। মায়ার জন্য কিনে সেটা কোর্টের পকেটে রেখে দেয়। যথা সময়ে প্লেনে উঠলো। এখন এখানে তিনটা বাজে। বাংলাদেশে পৌঁছাতে বিকাল চারটা বেজে যাবে।
ডোরবেলটা বেজে উঠে। মনে হয় আবীর এসেছে। লাইলি দরজা খুলে দেয়। আবীর অফিস থেকে এসে আগে ওর দাদীর ঘরে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে এ ঘরে চলে আসে। এখন আবীর আর মায়া এক ঘরে ঘুমায়। তবে একদিন মায়া খাটে ঘুমায় আর আবীর ডিভানে থাকে। আবার পরদিন আবীর খাটে ঘুমায় মায়া ডিভানে শুয়ে পড়ে। এভাবেই ওদের অদ্ভুত দাম্পত্য সময় অতিবাহিত হতে থাকে। মায়া সিঁড়িতে আবীরের পায়ের আওয়াজ শুনতে পায়। দরজার কাছে এসে নক করে আবীর রুমে প্রবেশ করে। এরপর মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
—কেমন আছো?
—ভালো,তবে তোমাকে অনেক মিস করেছি।
আবীর বলে,
—-আমিও তোমাকে মিস করেছি।
এরপর পকেট থেকে একটা মখমলের বাক্স মায়ার হাতে তুলে দেয়। মায়া অবাক হয়ে বলে,
—-এটা কি?
—-খুলেই দেখো,
এরপর মায়ার কানের কাছের ফিসফিস করে বলে,
—দেখো তোমার পছন্দ হয় কিনা।
আবীরের উষ্ণশ্বাস মায়া মুখমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। ওর বুকের ভিতর এক অচেনা কাঁপন শুরু হয়। মায়ার ফর্সা গাল দুটো রক্তিম হয়ে উঠে। এক সপ্তাহের বিরহে আবীরের মনে হয় সহস্র বছর ও যেন মায়াকে দেখে না। মায়াকে জড়িয়ে ধরা তীব্র আকুলতা মনের মাঝে জেগে উঠে। মায়ার খুব কাছে গিয়ে উষ্ণ নিঃশ্বাসে ভাসিয়ে দেওয়ার তৃষ্ণা জেগে উঠে। এমন,অনুভব ওর আগে কখনও হয়নি। এমন সময় নীচ থেকে চিৎকার ভেসে আসে। লাইলি চিৎকার করে বলে,
—কে কোথায় আছো চলে আসো। দাদীমা মাটিতে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
লাইলির চিৎকারে আবীর আর মায়া রুম থেকে বের হয়ে আসে।
চলবপ