কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-১৪+১৫

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী

জিনাতুন্নেছাকে সাথে সাথে এভার কেয়ার হাসপাতালের অনকোলজিস্ট বিভাগে ভর্তি করা হয়। উনাকে আপাতত এইচডিইউ তে রাখা হয়েছে। ডাক্তার চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রেখেছে। বাইরে আবীর আর মায়া বসে আছে। দুজনেই খুব চিন্তাযুক্ত। দুজনের একটাই চাওয়া জিনাতুন্নেছা যেন আরো কিছুদিন বেঁচে থাকেন। হাসপাতালের একএকটা ঘন্টাকে মনে হচ্ছে বহুদীর্ঘ সময়।ঘন্টা দুই পরে ডাক্তার এসে জানালো উনার জ্ঞান ফিরেছে।প্রথমে আবীর পরে মায়া গিয়ে দেখা করে এসেছে। আজকের রাত দুজনেই হাসপাতালে থেকে গেল।

পরদিন রিপোর্ট চলে আসার পর জানা গেল উনার শরীরে ক্যান্সার আবার ছড়াতে শুরু করেছে। সে কারনে কেমো দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ছ’টা কেমো দেওয়া হবে। এবং দেড় মাসের মধ্যে এই কেমো কমপ্লিট করতে হবে। প্রথম কেমোটা এইচডিইউতে থাকা অবস্থায় দেওয়া হবে। আজ একটা টেস্ট আজ করা হবে। রিপোর্ট যদি ভালো আসে তাহলে আগামীকাল থেকে কেমো দেওয়া শুরু হবে। মায়ার উপর দায়িত্ব দিয়ে আবীর বাসায় চলে যায়। ওর আবার আজকে বিদেশের ব্যায়ারদের সাথে জুম মিটিং আছে। আবীর চলে যাবার পর মায়া ওর বাবার বাড়িতে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর করে। তখনই জানতে পারে ইরা ভালো নেই। ইরা যে ভালো নেই মায়া সেটা আন্দাজ করেছে। আজ অবদি জাওয়াদ একটা ফোন দিয়ে তো খোঁজ খবর করেই না বরং হুন্ডা কেনার জন্য মায়া যে লোন দিয়েছিলো তার একটা কিস্তিও মায়ার একাউন্টে জমা পড়েনি। মায়ারও ফোন দিতে লজ্জা লাগে। কেননা মায়া হয়তো ইরার খোঁজ নিতে ফোন দেয়। কিন্তু ইরা ভাবে মায়ার টাকার জন্য ফোন দিয়েছে। বেচারা ইরা তখন নানা বাহানা দিয়ে বলে,
—-আপু সংসারের ঝামেলায় তোমার কিস্তির টাকাটা জাওয়াদ এতোদিন দিতে পারে নাই। তবে আগামী দুদিনের
মধ্যে দিয়ে দিবে।
বাস্তবতা হলো ঐ দুদিন আর শেষ হয়না, জাওয়াদ ও ব্যংকে টাকা পাঠায় না। সে কারণে মায়ার ও ইরাকে ফোন দিতে অস্বস্তি হয়। মায়া হাসপাতালের ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। তারপর এককাপ কফি নিয়ে এসে কেবিনে বসে। আবীর সকালে যাওয়ার সময় কেবিনটা ঠিক করেছে। কেবিনটা বেশ সুন্দর। দুটো বেড একটা ছোটো বারান্দা, টিভি, ক্লসেট একটা টেবিল দুটো চেয়ার একটা ছোটো ফ্রিজ থেকে শুরু করে সব কিছুই আছে। টেবিলে রাখা ফুলদানিটায় টাটকা রজনীগন্ধা আর বেলী ফুল রাখা হয়েছে। আসলে টাকা থাকলে মানুষের রুচির অভাব হয় না। এটাই সহজাত বাস্তবতা। ওর বাবাকে কখনও ওরা কেবিনে ভর্তি করে নাই। আসলে ওদের সেই সামর্থ ছিলো না। ওয়ার্ডে সব সময় ওর বাবাকে ভর্তি করেছে। সে কারণে হাসপাতালের এমন কেবিন দেখার ওর সৌভাগ্য হয়নি। আজ দেখে সে কারণে একটু অবাক হলো। পৃথিবীর সব জায়গায় টাকা দিয়ে সুখ কেনা যায়। তাই বলেকি সবাই সুখী হয়। হয় না। এই যে আবীরের এতো টাকা অথচ মায়া বেশ বুঝতে পারে ওর মনের ভিতর রয়েছে কষ্টের বিশাল ব্লাকহোল। সেই কষ্টের তীব্রতা এতো বেশী যে ও কারো কাছে শেয়ার করে না। কথায় আছে অল্প শোকে কাতর আর অধিক শোকে পাথর। আবীর অনেকটা পাথরের মতোই শক্ত। মায়া ভেবেছিলো হয়তো আবীর ওর মায়ের কথা বাবার কথা ওকে বলবে। কিন্তু ও বলেনি। আবীর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছে পুরোটাই ওর দাদীর কাছে শুনেছে। আবীর যে ভিতরে ভিতরে প্রচন্ড দগ্ধ হয় মায়া সেই অনুভবটা স্বচক্ষে দেখেছে। এখন তো ও আবীর একই রুমে ঘুমায়। মাঝে মাঝে মাঝরাতে আবীরকে একা বারান্দায় বসে থাকতে দেখেছে। আবীর হয়তো ভেবেছে মায়া ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আবীর না ঘুমানো পর্যন্ত মায়া ঘুমায় না। একধরণের অস্বস্তিবোধ হয়। মায়া তখন ভাবে এতো অর্থবিত্ত থেকেও আবীর অসুখী। পাশাপাশি এটাও ভাবে আবীর হয়তো এখনও মায়ার উপর ভরসা করার সাহস পায়নি। মায়া জানে না এটা ওর দুর্বলতা নাকি আবীরের অক্ষমতা। অপরদিকে মায়াদের পরিবারে প্রাচুয্য নেই,বাবার অসুস্থতার পর অভাবের সাথে ওদের বাস। এই অভাবের সংসারে রোগ শোকের জ্বালাও আছে তার পাশাপাশি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার পরিবেশ আছে। তাদের ঘরে হয়তো প্রতিদিন ভালো খাবার রান্না হয় না। কিন্তু যেদিন রান্না হয় সেদিন ভাই বোন মা বাবা একসাথে বসে পেট পুরে খায়। এরপর ঢেকুর তুলে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে।
মায়ার মোবাইলটা বেজে উঠে। তাকিয়ে দেখে হাসপাতালের সিস্টার ফোন দিয়েছেন। মায়াকে এইচডিইউয়ের সামনে যেতে বলেছে। মায়া কেবিন থেকে বের হয়ে দ্রুত এইচডিইউ ইউনিট এর সামনে চলে যায়।ওখানকার ডাক্তার মায়াকে জানায় রিপোর্ট ভালো আসছে। উনারা আজকেই কেমো শুরু করতে চাচ্ছে। মায়া আবীরকে জানালে সেও কেমো শুরু করতে মত দেয়।
জিনাতুন্নেছার কেমো শুরু হলো। মায়া খুব টেনশনে আছে। ডাক্তার বলেছে অনেক ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। সারা শরীর চুলকাবে কিংবা পাতলা পায়খানা শুরু হবে। আবার বমিও হতে পারে। তবে ডাক্তার এটাও বলেছে এই কেমোটা দেওয়া হলে উনার রোগের কষ্টের কিছুটা উপশম হবে কিন্তু উনি আর কখনও পুরোপুরি সুস্থ হবেন না। আল্লাহপাক যে কদিন বাঁচিয়ে রাখবেন সেই কদিনই বেঁচে থাকবেন। কারণ বাস্তবতা হলো উনার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়।
মায়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ও অন্তর থেকে চেয়েছিলো এই মানুষটা আরো কিছুদিন বেঁচে থাকুক। অন্তত ওর নিজের জন্যই আল্লাহপাকের কাছে এই দোয়া করেছিলো। আল্লাহর রহমতে ও এখন অনেক ভালো আছে। ওর বাবা মা ভাইবোনদের খরচ চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে না। যদিও আবীরকে ওর ভালো লাগে, সারাজীবন এই মানুষটার সাথে জীবনটা কাটিয়ে দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু এই চাওয়াটা আবীরের দিক থেকে আসতে হবে। মায়া বুঝে আবীর ওকে ভীষণ পছন্দ করে। সাথে সাথে এটা ভেবেও মায়া সন্দিহান হয় ওকি আদৌ মায়াকে ভালোবাসে নাকি মায়া ওর অভ্যাস। আজ ছ,মাসের উপর হয় মায়া আবীরের দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। চব্বিশঘন্টা আবীর ওকে দেখছে। মায়া তো জানে ও অসুন্দর নয়। যে কোনো পুরুষ ওকে দেখলে মুগ্ধতা ছড়ায়। কিন্তু মায়াতো মুগ্ধতা কিংবা মোহতে নয়। একজন প্রেমিক পুরুষকে ওর জীবন সঙ্গী হিসাবে চায়। যার কাছে ছোটো ছোটো চাওয়াগুলোর মুল্য থাকবে।
এরমাঝে ডাক্তার এসে জানায় কেমো দেওয়া শুরু হয়েছে। ঘন্টাখানিক সময় পার হয়ে গেলো। কেমো শেষ হতে ছঘন্টার মতো সময় লাগবে। মায়া ইউনিটের সামনে বসে আছে। বেশ ভীড় এখানে। পাশেই আইসিইউ ইউনিট আছে। কেউ কেউ কাঁদছে। হয়তো তার আপনজনের অবস্থা বেশ খারাপ। এসব দেখলে মনটা ছোটো হয়ে আসে। মায়া ভাবে মানুষের আয়ু এতো কম অথচ তার জন্য মানুষ কত কিছুই না করে। চুরি দুর্নীতি খুন রাহাজানি মানিলন্ডারিং থেকে শুরু করে এমন কিছু নাই মানুষ করে না। অথচ এটা ভুলে যায় সব খারাপ কাজের জন্য তাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে।

ভালোভাবেই ছ’ঘন্টা সময় পার হয়ে গেল। আবীর অফিস শেষ করে এসেছে। জিনাতুন্নেছাকে একটু পরে কেবিনে নিয়ে আসা হবে। যদিও ডাক্তার চেয়েছিলো রুগী আজকের রাতটা এইচডওইউতে থাকলে ভালো হয়। কিন্তু জিনাতুন্নেছা রাজী হলেন না। উনার ওখানে থাকতে ভালো লাগছে না। পরিবারের লোকজনের সাথে উনি কেবিনে থাকবেন।
রাত দশটা বাজে। মায়া আর আবীর হাসপাতালের ক্যান্টিনে ডিনার করে নেয়। এরপর আবীর এইচডিইউয়ের সামনে চলে যায়। মায়া জিনাতুন্নেছাকে রিসিভ করার জন্য কেবিনে অপেক্ষা করে।
কিছুক্ষণ পরেই জিনাতুন্নেছা হুইল চেয়ারে করে কেবিনে চলে আসে। সিস্টাররা খুব যত্ন করে উনাকে বেডে শুইয়ে দেন। বেডে আসার ঘন্টাখানিক পর উনার কাশি উঠে। সাথে সাথে বমি করে কাপড় নষ্ট করে ফেলে। মায়া দৌড়ে গিয়ে টিস্যুপেপার দিয়ে মুখ মুছে দেয়। আবীর সিস্টারদের ডেকে আনার জন্য কেবিন থেকে বের হয়। এদিকে মায়া টিস্যু দিয়ে খুব যত্ন করে মুখ হাত মুছে দিতে থাকে। আবীর এসে মায়াকে নিজের হাতে করতে দেখে অবাক হয়ে বলে,
—,আমি সিস্টারকে খবর দিয়ে এসেছি। উনারা পোশাক নিয়ে এখনি আসছেন।
—–আসুক না সমস্যা কি? দাদীর অস্বস্তি লাগবে না সে কারণে মুছে দিলাম।
জিনাতুন্নেছা অসহায়ের মতো আবীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
–আমি ওকে নিষেধ করেছিলাম।
এরমাঝে সিস্টার চলে আসে। পর্দা টেনে দিয়ে উনার পোশাক থেকে শুরু করে বেডকভার বালিশের কভার সব বদলে দেয়। একটা ফ্রেস কম্বল দিয়ে যায়।
তবে মায়ার এই মানবিকতাটুকু আবীরের বেশ ভালো লাগে। ডাক্তার এসে বমির ট্যাবলেট দিয়ে দেয়। সেটা খাওয়ার পর আর বমি হয় না। পরদিন ওরা বাসায় চলে যায়।
এক সপ্তাহ পর আবার আরো একটা কেমো দিতে হবে। ডাক্তার বলেছে শরীরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য উনাকে অনেক পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে হবে। মায়াও আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে। সকালে কুসুম ছাড়া তিনটা ডিমের সাদা অংশ আর এক গ্লাস ফলের জুস রুটি আর সবজি নিজ হাতে তৈরী করে। এরপর এগারোটার দিকে একবাটি মুরগীর সুপ দেয়। অনেক যত্ন করে জিনাতুন্নেছাকে খাইয়ে দেয়। দুপুরে মাছ কিংবা মাংস সবজি ডাল আর ভাত বিকালে হালকা নাস্তা আর রাতে কখনও রুটি কখনও জাউ ভাত সাথে মাছ কিংবা মুরগীর ঝোল সবজি মাঝখানে আবার আপেল নাসপাতি পেয়ারা এসব ফল কেটে দেয়। মায়ার সেবা যত্নে জিনাতুন্নেছার দুর্বলতা আস্তে আস্তে কিছুটা কেটে যায়। আবীরও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর দাদীর জন্য মায়ার সেবাযত্ন লক্ষ করে অবাক হয়। মায়ার এসবে অভ্যাস আছে। বাড়িতে যতদিন ছিলো বাবার সেবাযত্ন নিয়ে ওকেই বেশী মাথা ঘামাতে হতো।

আর দুদিন পর জিনাতুন্নেছার দ্বিতীয় কেমো শুরু করতে হবে। আবার হাসপাতালে ছুটতে হবে। দুপুরে খেয়ে মায়া একটু বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে। এমন সময় মায়ার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে রুবেল ফোন দিয়েছে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রুবেল বলে,
–আপু তুমি কি বাসায় না অফিসে?
—কেন কি হয়েছে?
—ইরা আপু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
—ওর তো এখনও সময় হয়নি।
—-,আপু নাকি বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হয়েছে। চিকিৎসা করতে অনেক টাকা লাগবে। এই মুহুর্তে জাওয়াদ ভাইয়ের কাছে এতো টাকা নাই। তুমি কি কিছু টাকা পাঠাতে পারবে?
—তুই হাসপাতালের নাম বেড নাম্বার পাঠিয়ে দে। আমি এখুনি আসছি।
—মানিকগঞ্জ থেকে আসতে তোমার অনেক সময় লাগবে। এতে আপুর অনেক বড় ক্ষতি হতে পারে। তার থেকে তুমি জাওয়াদ ভাইয়ের একাউন্টে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়।
মায়া রেগে গিয়ে বলে,
—তোকে আমি যেটা করতে বলেছি সেটা কর।
আবীর সে সময় অফিস থেকে এসে রুমে প্রবেশ করে। মায়াকে জোরে কথা বলতে দেখে বলে,
—কি কোনো সমস্যা?
—আমার বোন হাডপাতালে ভর্তি হয়েছে। ও প্রেগনেন্ট ছিলো। ডেলিভারীর সময় এখন হয়নি। ওয়াশরুমে পড়ে গিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আমাকে এখুনি একটু বের হতে হবে।
মায়ার টেনশন দেখে আবীর বলে,
—আমিও তোমার সাথে যাবো।
মায়া বেশ অবাক হয়ে বলে,
—ওখানে কি আপনার যাওয়া ঠিক হবে? সবাই জানতে চাইবে আপনার সাথে আমার কি সম্পর্ক।
—বলবে বস আর কর্মচারী।
মায়া মনে হচ্ছে ওকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। এর থেকে আবীরের না যাওয়াই ভালো। কিন্তু আবীর নাছোরবান্দার মতো মায়ার পিছুপিছু হাসপাতালে রওয়ানা হয়।

চলবে

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

কল্যানপুরে স্পেশালাইজড হাসপাতালে ইরাকে ভর্তি করা হয়েছে। মায়া আর আবীরের বনানী থেকে পৌঁছাতে ঘন্টাখানিক সময় লেগে যায়। এসময় অফিস ছুটি হয় সে কারণে রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকে। হাসপাতালে পৌঁছাতে মায়ার সন্ধা সাতটা বেজে যায়। ওকে দেখেই ওর মা দৌড়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মায়া রুবেলের দিকে তাকিয়ে বলে,
–জাওয়াদ কোথায়? ওর সাথে কথা বলতে হবে। কিভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটলো জানতে হবে।
—-ভাইয়া তো এখানেই ছিলো। হয়তো ডাক্তারের সাথে কথা বলতে গিয়েছে।
মায়া ওর মায়ের সাথে আবীরের পরিচয় করিয়ে দেয়। আবীরও মায়ার মাকে সালাম দিয়ে বলে,
–আন্টি ভালো আছেন? আঙ্কেল কেমন আছে?
—মেয়ের এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর ভালো আর কিভাবে থাকি। তোমার আঙ্কেলের শরীর আছে মোটামুটি।
আবীর রুবেলকে নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলতে যায়। এই সুযোগে ওর মা বলে,
—-তোর বসটা কেমন?
—-ভালো,
—স্বভাব চরিত্র কেমন? লুইচ্ছা নয়তো?
মায়া অবাক হয়ে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–+পুলিশের মতো এতো জেরা করছো কেন? কোনো সমস্যা?
সালেহা বেগম ইতি উতি করতে লাগলেন। মায়া ওর মায়ের আচরণ দেখে বলে,
—আম্মা,একটু ঝেড়ে কাশো। কি বলতে চাও সরাসরি বলো।
—না,মানে কিছুদিন আগে তুই কক্সবাজার গিয়েছিলি না,
—হুম, আমার যাওয়ায় কার বাড়া ভাতে ছাই পড়লো।
—তুই রেগে যাচ্ছিস কেন?
—তা রেগে যাবো না? তোমার এক সন্তান মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। কোথায় তুমি দোয়া দরুদ পড়বে সেটা না করে কার বস লুইচ্ছা সে খবর নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছো।
—বলি কি আর সাধে? তোকে নিয়ে কানাঘুষা শুরু হয়েছে।
— আমি কি করেছি যে কানাঘুষা শুরু হবে?
—জাওয়াদ নাকি তোকে কক্সবাজারে কোনো একটা পুরুষ লোকের সাথে দেখেছে। পরে ও খোঁজ নিয়ে জেনেছে ঐ পুরুষলোকটা তোর বস হয়।
—-তা এতে সমস্যা কি হয়েছে? অফিসের কাজে আমি সারের সাথে যেতেই পারি।
—কিন্তু নানা জনে নানা কথা বলে। তোর ফুফুও সেদিন ফোন দিয়ে বলে,তোকে নাকি দুদিন রেস্টুরেন্টে একটা ছেলের সাথে দেখেছে।
—বুঝলাম আমাকে দুদিন দেখেছে। আর তার মেয়ে যে প্রতিদিন কোনো না কোনো ছেলের সাথে ডেটে যায় ফুফু কি সে খোঁজ রাখে?
—জবা কিসে করে যায়? ডেট আবার কেমন গাড়ি
মায়া বুঝেছে ওর মা কথাটা বুঝেনি। এখনকার যুগের এসব কথা ওর মায়ের না বুঝারই কথা। মায়া ঐ প্রসঙ্গে আর কথা না বলে আসল প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসে বলে,
—শোনো আম্মু, আসল কথা হচ্ছে আমরা এখন ভালো আছি বলে আত্মীয় স্বজনের চোখ টাটাচ্ছে। ওদের সহ্য হচ্ছে না।
দূর থেকে আবীর মায়াকে ওর মায়ের সাথে রেগে কথা বলতে দেখে কাছে এসে বলে,
—আমি এখন আসি। আপনার আজ ছুটি। এই দুঃসময়ে পরিবারের পাশে থাকাটা জরুরী। আমি ওদিকটা সামলে নিবো।
মায়া কিছু বলতে চাচ্ছিলো কিন্তু আবীর সুযোগ না দিয়ে চলে যায়। আসলেই মায়ার এখন এখানে থাকাটা জরুরী। বিশেষ করে জাওয়াদের সাথে ওর একটা বোঝাপড়া করতে হবে। মায়া ইতিমধ্যে কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু ফোন সুইচস্টপ বলছে।

চব্বিশ ঘন্টা পর ইরার জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু জাওয়াদের টিকিটা মায়া দেখতে পেলো না। মায়া আর ওর মাকে দেখে ইরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। মায়া ওকে কাঁদতে নিষেধ করে বলে,
—কাঁদাটা কোনো সমাধান না। তোর এই দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো?
—আপু, তোমাকে সব বলবো তবে জাওয়াদের সংসার আমি আর করবো না। ওকে ডিভোর্স দিবো।
সাথে সাথে সালেহা বেগম রেগে গিয়ে বলে,
—ডিভোর্সের আলোচনা এখন থাক। হুট করে কোনো সিদ্ধাম্ত নিবি না। অকাম করার সময় হুশ ছিলো না তাহলে তো ঐ বদমাশটাকে বিয়ে করতে হতো না। আর বিয়ে যখন করেছিস সংসার তোকে ওর সাথেই করতে হবে।
কথাগুলো বলার পর সালেহা বেগমও মনে মনে ভাবলেন,জাওয়াদ ওকে ভর্তি করে দিয়ে কোথায় পালালো?
মায়া ওর মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
—-যা হবার তাতো হয়ে গেছে। এখন এসব কথা বলে ওকে কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ? মায়া ওর মাকে রুবেলের সাথে চলে যেতে বলে। বাসায় ওর বাবা অসুস্থ অবস্থায় আছে। যদিও নোবেল এখন দেখভাল করতে পারে। তারপরও মায়া ওর মাকে নিয়ে আইসিইউ ইউনিট থেকে বের হয়। আর মনে মনে বলে ভাগ্যিস আজকে রুগীর চাপ কম ডাক্তারও একটু দূরে বসেছিলো। সে কারণে ওর মায়ের কথাগুলো কেউ শুনতে পায়নি। মাকে এখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো হবে।
রুবেলের সাথে মায়া ওর মাকে পাঠিয়ে দেয়। সালেহা বেগম রুবেলকে বলে,
—-জাওয়াদ কোথায়?
—-আমি কি করে বলবো?
জাওয়াদের আচরণ রুবেলের কাছে খুব বিরক্ত লাগছে। বউকে শ্বশুর বাড়ির কাঁধে ফেলে রেখে নিজে চম্পট দিয়েছে। এদিকে টাকা পয়সার ধাক্কাটা কে সামলাবে?
সালেহা আর রুবেল চলে যাবার পর মায়া ডাক্তারের সাথে কথা বলে। ইরাকে কখন কেবিনে দিবে? ডাক্তার বলে,
—-আজকের রাতটা দেখে কাল সকালে পেশেন্টকে কেবিনে দেওয়া হবে।
মায়া রাতটা হাসপাতালে কাটায়। বারোটার দিকে আবীরের ফোন আসে। মায়া ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আবীর বলে,
—ইরা কেমন আছে?
—-ভালো। ঘন্টাখানিক আগে ওর জ্ঞান ফিরেছে।
—খুব ভালো খবর। টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করো না। ওর চিকিৎসার পুরো খরচ আমি বহন করবো।
মায়ার একটু অস্বস্তি হলো। হাত পেতে এই জীবনে কখনও কারো দান ও গ্রহন করেনি। সে কারণে আবীরকে বলে,
—টাকা পয়সার সমস্যা নেই। যদি লাগে তখন বলবো।
আবীর কোমল স্বরে বলে,
—কেন আমাকে আপন ভাবতে পারো না অথচ যে ঘরে তুমি ঘুমাও সে ঘরের মানুষ খাট টেবিল চেয়ার জানালার পর্দা বেডকভার সবাই তোমাকে মিস করছে। প্রচন্ডভাবে মিস করছে। দাদী আজকে কিছুই খেতে পারেনি। আমিও পারিনি। আমাদের সবার অভ্যাস তুমি খারাপ করে দিয়েছো। দুদিন তোমাকে দেখিনা অথচ মনে হচ্ছে যুগযুগান্তর আমি তোমাকে দেখিনা। অপেক্ষার প্রতিটি প্রহর বড় কষ্টের। যা সহজে ফুরাতে চায় না।
মায়া ফোনটা নিয়ে হাসপাতালের করিডোরে হাঁটতে থাকে। রাত্রির গভীরতায় আস্তে আস্তে প্রান চঞ্চল পরিবেশটা নিরব হয়ে আসছে। দৃষ্টি বাইরে মুক্ত আকাশে মেলে ধরে। চাঁদের দেখা মিললো না। হয়তো অমাবশ্যা শুরু হয়েছে। রাস্তার নিয়ন বাতির আলোয় অমাবশ্যাতেও চারিদিক আলোকিত হয়ে আছে। আকাশের বুকে জ্বল জ্বল করছে অজস্র নক্ষত্ররাজী। আবীরের কথাগুলো মায়া মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। মায়ার নিরবতায় আবীর বলে,
–আমি একাই তো বকবক করছি। তুমি কিছু বলছো না যে?
—আমার শুনতে ভালো লাগছে।
আবীর আবার বলা শুরু করে,
—জানো মায়া, বৈবাহিক চুক্তি তো সব স্বামীস্ত্রীর মাঝে হয়ে থাকে। আমি বাহ্যিকভাবে সেই চুক্তিটাকে মেনে নিয়েছি কিন্তু মনে মনে চেয়েছি তোমার হৃদয়ের সাথে আমার হৃদয়ের চুক্তি হোক। আজ এটা ভেবে ভালো লাগছে কবে যে তোমার হৃদয়ের সাথে আমার হৃদয়ের ভালোবাসার চুক্তি হয়ে গেছে আমিই জানি না। আজ যখন তুমি এঘরটায় নেই তখন সেটা আমি আমার অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারছি। আজ একটা সত্যি কথা তোমায় বলবো। প্রথম যেদিন তোমায় দেখেছি সেদিনই তোমায় ভালোলেগেছিলো।
আবেগেমিশ্রিত কন্ঠে আবীর মায়াকে বলে,
—আমাকে তোমার ভালোলাগেনি মায়া?
আবীরের কথা শুনে মায়া যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। তারপরও নিজের অম্তরের দুর্বলতাকে অন্তরে রেখে বলে,
—আপনার মতো ব্যক্তিত্যবান পুরুষকে কোনো নারী ভালো না বেসে থাকতে পারে না।
—তবুও তুমি সরাসরি বললে না আমায় তোমার ভালো লাগে কিনা।
মায়াও আবেগে জর্জরিত হয়ে বলে,
—,পুরোটা জীবন তো পড়ে আছে। কিছু কথা না হয় সযতনে তুলে রাখলাম পরে বলবো বলে।
আবীর আজকে মায়ার বিরহে কাতর হয়ে আছে। সে কারণে ও মায়াকে আবারো বলে,
—,জানো আমরা একই রুমে থেকেছি। ধর্মীয় মতে সামাজিকভাবে আমাদের মেলামেশায় কোনো দোষ নেই। মিথ্যা বলবো না আমার মন তোমাকে কাছে পেতে চেয়েছে।পরক্ষণেই মনে হয়েছে শরীরকে ছুঁয়ে দিলে কি আর মনকে ছোয়া যায়? যায় না। শরীর তো টাকার বিনিময়ে কেনা যায়। কিন্তু মনকে টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তাকে পেতে হলে যুগ যুগ ধরে সাধনা করতে হয়। আমি জানি না তোমার মনটাকে ছুঁতে পেরেছি কিনা? আবেগের আতিশয্যে তোমাকে আজ অনেক কথা বলে ফেললাম। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। তুমি কি একা থাকবে নাকি রুবেল আসবে?
—-রুবেল আসবে। ঠিক আছে ফোন রাখলাম।
ফোনটা রেখে মায়া মনে মনে বলে,
“এমন একজন মানুষই তো ও জীবনভর চেয়েছে, যার চোখ ভালোবাসার স্বপ্নে ভরে থাকবে। সে শুধু দায়িত্বের কারণে নয়, অনুভূতি দিয়ে ওকে অনুভব করবে। জীবনের সুঃখে দুঃখে সব সময় ছায়া হয়ে পাশে রবে আর কায়া হয়ে জড়িয়ে থাকবে।

চলবে