কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-২৪

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-চব্বিশ
মাহবুবা বিথী

ডোর বেলটা বেজে উঠলো। সালেহা বেগম কিচেনে বসে সবজি কুটছিলেন। মনে মনে ভাবলেন,”এতো ভোরে কে এলো।” উনি কিচেন থেকে ড্রইংরুমে এসে দরজা খুলে দেখেন,মায়া দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার মুখটা বিদ্ধস্ত। চোখের নীচে রাতজাগার ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। সালেহা বেগম অবাক হয়ে বলেন,
—-তুই এতো সকালে,
—হুম,তোমাদের দেখতে মন চাইছিলো তাই ছুটি নিয়ে চলে আসলাম।
—-কালও তো ফোনে কথা হলো তুই তো কিছু বললি না।
—-তখনও সিদ্ধান্ত নেইনি আসবো কিনা?
মায়া ওর ব্যাগ নিয়ে ঘরে প্রবেশ করে সালেহা বেগমকে বলে,
—আব্বার শরীর কেমন আছে?
সালেহা বেগম দরজা লাগিয়ে বলেন,
—-ঐ আছে একরকম।
সালেহা বেগম নাস্তা রেডী করতে কিচেনে চলে যান।
এর মাঝে ইরাবতী, রুবেল আর নোবেল সবাই মায়ার সাড়া পেয়ে ড্রইং রুমে চলে আসে। ইরা মায়াকে দেখে বলে,
—তুমি আসবে আমাদের জানাওনি কেন?
মায়া শুকনো হাসি হেসে বলে,
—সারপ্রাইজ দিবো বলে,
নোবেল সাথে সাথে বলে,
—-আজ কতোদিন পর আমরা সব ভাইবোন একসাথে হলাম। আপু,একটা জমকালো নাস্তা করলে কেমন হয়?
রুবেলও বলে,
—নোবেল অবশ্য ভালো প্রস্তাব এনেছে। তুমি আর ইরা আপু যখন বাসায় ছিলে না তখন বাড়িটা খুব খালি খালি লাগতো। আজ তোমাদের দুজনের একসাথে বাড়ি ফেরাটা সেলিব্রেট করি,কি বলো?
মায়া ওর ভাই দুটির দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তোরা সারাজীবন এমনই থাকিস।
এরপর মায়া ইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আজ তোর ডিভোর্সের জন্য উকিলের কাছে যাবো।
ইরা মুখ শুকনো করে বলে,
—-হুম,আমিও আর ঐ শয়তানটাকে ঝুলিয়ে রাখতে চাইছি না।
এমনসময় কিচেন থেকে সালেহা বেগম ইরাকে ডাক দিলেন। মায়া তখন ইরাকে বলে,
—কিচেনে গিয়ে আম্মাকে রান্না করতে নিষেধ কর। আমি বাইরে খাবারের অর্ডার করছি। তুই বরং সবার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আয়। একসাথে সবাই চা আর মুড়িমাখা খাই।
ওদিকে মায়ার বাবা নোবেলকে ডেকে বলেন,
—এই নোবেল এদিকে আয়,মায়ার গলা শুনতে পারছি। ও কি এসেছে? কতদিন মেয়েটাকে দেখি না।
মায়া ওর বাবার ঘরে গিয়ে খাটের কোনায় বসে বলে,
—আমারও তোমাকে দেখার জন্য চোখ দুটো অস্থির হয়ে উঠেছিলো। তাই অফিস বাদ দিয়ে তোমার কাছে ছুটে চলে এসেছি।
ওর বাবা চোখ ছল ছল করে বলে,
—ওভাবে আমার পায়ের কাছে বসে আছিস কেন। আমার কাছে আয়।
মায়া একটা চেয়ার নিয়ে বাবার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে বলে,
—-তোমার শরীর এখন কেমন আছে?
—-শরীর থাকলে অসুখ তো হবে। এখন শরীরের কথা বাদ দে। তোকে আগে দুনয়ন জুড়ে দেখি। তোর মায়ের কাছে শুনলাম,তোর এবারের বসটা নাকি বেশ ভালো। ইরা যখন হাসপাতালে ছিলো তখন তোর মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো। খুব সম্মান করে কথা বলেছে।
—হুম,
মায়া মনে মনে বলে,আমারও আবীরের এই গুনটা ভালো লাগে। আচ্ছা,মানুষটা কি আমার চিঠি পড়েছে।

আবীরের বেশ সকালেই ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুলাল মিয়া টেবিলে নাস্তা বেড়ে দেয়। লাইলিও সকালে ওর বাড়ির উদ্দেশ্য বের হয়েছে। ওর বাড়ি সাভারে। পুরো বাড়িতে শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে। অর্ণব আর আবীর খাবার টেবিলে এসে বসে। মায়াকে দেখতে না পেয়ে দু’জনে অবাক হয়। আবীর দুলাল মিয়াকে জিজ্ঞাসা করে,
—-তোমার ম্যাম কোথায়?
দুলাল মাথা চুলকে বলে,
—-ম্যামতো অনেক সকালে সুটকেস নিয়ে বের হয়ে গিয়েছে।
কথাটা শোনা মাত্রই আবীরের রাগ চড়ে গেল। সেই রাগ ঝাড়লো দুলালের উপর। ওর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে আবীর বলে,
—তুমি আমার খাবার রুচিটাই নষ্ট করে দিয়েছো। খাবার বেড়ে দিয়ে কেউ আবার মাথায় চুলকায় নাকি। নাহ্ আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে না।
আবীর খাবার টেবিল থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমে আসে। মনে মনে মায়ার উপর অভিমান জন্মে। যাওয়ার সময় একটু বলে যাবার প্রয়োজন মনে করলো না। পুরো রুম পরিপাটি করে গোছানো। বিছানার চাদর চেইঞ্জ করে দিয়েছে। ওয়াশরুমের তোয়ালে চেইঞ্জ করেছে। ফার্ণিচারগুলোতে কোনো ধুলোবালি নেই। খুব সুন্দর করে রুমটা গোছানো। তারপরও আবীরের কাছে সব কিছু ম্রিয়মান লাগছে। হঠাৎ টেবিলের উপর একটা কাগজ ভাঁজ করা অবস্থায় দেখতে পেল। আবীর কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজের ভাঁজ খুলে পুরো চিঠিটা কয়েকবার পড়লো। মনে মনে মায়াকে বললো,
“এতোই যদি আমাকে ভালোবাসো তাহলে শোকাহত মানুষটাকে ফেলে তুমি কি করে চলে গেলে?তোমার একবারও মনে হলো বাবা মা চলে যাবার পর এই দাদী আমাকে বড় করে তুলেছে। সে চলে যাওয়াতে আমার বুকের ভিতরটা ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়েছে। কি বলতে কি বলেছি সেটাই তোমার কাছে বড় হয়ে ধরা দিলো। একবারও তো আমার হাতটা ধরে বললে না আমি আছি তোমার সাথে। তোমার এতো ইগোর কাছে আমার পাওনাগুলো সব ম্লান হয়ে গেল। মেয়েরা এতো কঠিন হতে পারে তোমাকে না দেখলে মনে হয় আমার জানা হতো না।”
আবীর বেলকনিতে এসে বসে। দাদী চলে যাওয়াতে ওর যতনা কষ্ট হচ্ছে তার থেকে বেশী কষ্ট হচ্ছে মায়া চলে যাবার পর। আবীর সত্যি আজ নিজের ভিতর থেকে প্রথম একজন আপন মানুষের অভাব বোধ করলো। আবীর ভিতরের একাকীত্বটা আজ প্রচন্ডভাবে মায়াকে চাইছে। মনে হচ্ছে একছুটে মায়ার কাছে চলে যেতে। ওর চুলের গন্ধ নিতে। ওর রক্তিম অধরে নিজের অধরখানি ছুঁয়ে দিতে। মনে মনে আবীর ভাবে ওর চাওয়াগুলো এতোদিন কোথায় লুকিয়ে ছিলো? আজ অবদি কোনোদিন কোনো নারী সঙ্গ ওকে আকর্ষণ করেনি। কতো নারী ওর জীবনে আসতে চেয়েছে। অর্থ বিত্ত দেখতেও সুদর্শন। আল্লাহপাক ওকে সব দিক থেকে ভরিয়ে দিয়েছেন। শুধু মায়ের অভাবটাই বাকি ছিলো। অথচ ঐ অপ্রাপ্তির কাছে ওর বাকী পাওয়াগুলো মুল্যহীন ছিলো। কিন্তু ওর জীবনে এমন কোনো মুহুর্ত আজ অবদি আসেনি যে ওর নারী সঙ্গ দরকার। নিজের চারপাশে চারিত্রিক শুদ্ধতার দেয়াল নিজ ইচ্ছাতেই গেঁথে রেখেছিলো। যাতে সেটা ভেদ করে কোনো নারী ওর কাছে আসতে না পারে।
অথচ এই জীবনে সর্বপ্রথম যে নারী ওর অন্তরে ভালোবাসার শতদল ফুটালো সে তার চর্তুদিকে সংযমের এমন এক দেয়াল তুলে রেখেছিলো যা ভেঙ্গে আবীর তার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেনি। অথচ চিঠিতে ও নিজে লিখে গিয়েছে, আবীরকে ও ভালোবেসেছে। তাহলে এ কেমন ভালোবাসা?
দরজা নক করার শব্দে আবীর ওর ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে। বেলকনি থেকে ঘরে এসে দরজা খুলে দেখে অর্ণব ওর ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবীর অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তুই এসময় কোথায় যাচ্ছিস?
—-ভাইয়া আমি চলে যাচ্ছি।
—তোর না একসপ্তাহ পর যাওয়ার কথা?
কাঁদতে কাঁদতে অর্ণব বলে,
—এখানে থাকলে দাদী হারানোর শোক সামলানো আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। সে কারণে টিকিটটা বদলে নিয়েছি।
—-তাহলে তো কিছু টাকা লোকসান গুনতে হলো।
—তা হয়েছে,কিন্তু আমি এখানে আর থাকতে পারছি না। আর একটা বলতে চাইছিলাম বলে অর্ণব হাতের নখ খুঁটতে লাগলো।
–এতো সঙ্কোচের দরকার নাই। যা বলবি বলে ফেল।
—-তুমি ভাবীকে ফিরিয়ে আনো। অনেক ভাগ্যবান তুমি। তাই ভাবীর মতো একজন নারীকে তোমার জীবন সঙ্গিনী হিসাবে পেয়েছো।
আবীরের জানতে ইচ্ছে হলো মায়া অর্ণবকে কখনও ভালোবাসার কথা বলেছে কিনা। সে কারণে অর্ণবের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-তুই কি মায়াকে ভালেবাসিস?
—মিথ্যা বলবো না। ভালেবাসি কিনা জানি না তবে ওকে দেখলে আমার ভিতর এক ধরনের কম্পন অনুভব হয়। কিন্তু এটাও তো জানো ভালোবাসা কখনও একতরফা হয় না। আমি জানি,কোনোদিন মায়াকে আমি পাবো না। শুধু মিথ্যা মরীচিকার পিছনে ছুটে লাভ নেই। বরং আমি ওর চোখে তোমার প্রতি ভালোবাসা দেখেছি। তুমি ওকে ভুল বুঝো না। আবারো বলি,ভাবিকে ফিরিয়ে আনো।
আবীরের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। এরপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলে,
—ড্রাইভার আসছে?
—-হুম,
—-ঠিক আছে ভালো ভাবে রওয়ানা দে। মোবারক মিয়াকে সাথে নিয়ে যা। পৌঁছে ফোন দিস।
অর্ণব আসলে দাদীকে নয় মায়ার উপস্থিতি ওকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দিচ্ছে। আবীরের সাথে মায়াকে দেখলে অর্ণবের ভিতরটায় বেদনার নদীটা উত্তাল হয়ে যায়। শরীরের সমস্ত শিরা উপশিরায় সেই ঢেউগুলো প্রবাহিত হয়। এর থেকে ওর চলে যাওয়া সবার জন্য মঙ্গল। বিশেষকরে মায়া আবীরকে ভালোবাসে সেটা যেমন অর্ণব অনুভব করেছে তেমনি আবীরের চোখে মায়ার প্রতি ভালোবাসা দেখেছে। ওর বাবা মা ভাই বোন সবাই আছে কিন্তু আবীরের তো মায়া ছাড়া কেউ নেই। সুতরাং ওর ভাইটা বরং মায়াকে নিয়ে সুখে থাকুক।
অর্ণব ভাবছে দাদীর মৃত্যুর খবর তো ওর বাবা মাকে দেওয়া হয়নি। তবে উনারা এখনও ইউকে তে পৌঁছাননি। পৌঁছানোর পর শোকের খবরটা জানালে ভালো হয়।
এয়ারপোর্টে প্রবেশের আগ মুহুর্তে অর্ণব মায়াকে একটা ম্যাসেজ পাঠায়। অর্ণবকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে মোবারক গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে আসে। তখন গেটের কাছে আবীরদের পারিবারিক লয়্যার মজিদমোল্লাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে উনাকে নিয়ে আবীরের কাছে যায়। মজিদমোল্লাকে ড্রইংরুমে বসিয়ে আবীরের রুমের দরজায় নক করে। আবীর দরজা খুলে জানতে চায়,
—কি ব্যাপার?
—-স্যার আপনাদের লয়্যার আসছে।
—-তুমি নীচে যাও আমি আসছি।

মাগরিবের মামাজ পড়ে মায়া শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে। আজ সারাদিন ওর অনেক পরিশ্রম হয়েছে। উকিলের কাছে গিয়ে ইরার ডিভোর্স পেপার রেডী করেছে। যদিও ইরার বিষন্ন মুখটা দেখে ওর কষ্ট হয়েছে কিন্তু এছাড়া তো আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই। না হলে বোনটাকে হারাতে হবে। বাইরে শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। মনে হয় ঝড়ো বাতাস বইছে। এখন তো মাঘের শেষ হতে চললো। এসময় অবশ্য ঝড় বৃষ্টি হওয়া ভালো। মায়া ফোনটা ওপেন করে। আজ তিনদিন হলো ও বাড়ি থেকে এসেছে। যদিও জানে ও বাড়ি থেকে ওকে কেউ ফোন দিবে না তারপরও মিথ্যা আশা কুহুকিনীর মতো মায়া বার বার ফোনের স্ক্রীনে তাকায়। আবীরের জন্য হৃদয় বীণায় ব্যথার রাগিনী বেজে উঠে। হৃদপিন্ডের রক্তাভ শোণিত ধারায় মায়ার ব্যথার রাগিনীগুলো বেজে উঠে। প্রচন্ড কষ্ট অনুভব হয়। এই কষ্ট কাউকে বুঝানো যাবে না। শুধু এই পথ দিয়ে যে একবার হেঁটে গিয়েছে সে শুধু অনুভব করতে পারবে। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। ক্লান্তিতে মায়ার দুচোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।
ঘন্টাখানিক ধরে বৃষ্টি ঝরে এখন মনে হয় একটু থামলো। ডোরবেলটা বাজলো। ইরা গিয়ে দরজা খুলে দেখে ওর আপুর বস দাঁড়িয়ে আছে। ইরা ভিতরে আসতে বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। আবীর ঘরে এসে ইরাকে জিজ্ঞাসা করে,
—মায়া কোথায়?
—আপু ওর রুমে শুয়ে আছে। আমি ডেকে আনছি।
—-না ওকে ডেকো না। আমি ওকে সারপ্রাইজ দিবো। তুমি বরং তোমার বাবা মাকে একটু ডাকো আমার কথা আছে।
ইরা ওর মাকে ডেকে দেয়। সাথে ও আর রুবেলও চলে আসে। মায়ার মাকে সালাম দিয়ে আবীর বলে,
—-আন্টি,মায়া আমার বিবাহিত স্ত্রী।
সালেহা বেগম, ইরা আর রুবেল মুখ চাওয়াচায়ি করে। অবাক হয়ে সালেহা বেগম বলে,
—-এ আপনি কি বলছেন? আমি আপনার কথা বিশ্বাস করবো না।
আবীর ওদের বিয়ের কাবিন নামা দেখায়। সালেহা বেগম প্রচন্ড কষ্ট পায়। আবীর সেটা বুঝতে বলে,
—-মা,এখানে মায়ার কোনো দোষ নাই। সব দোষ আমার।
মায়া বলেছিলো আপনাদের কাছে প্রস্তাব পাঠালে যদি আপনারা রাজী হন তাহলে ও আমাকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমার দাদীর শরীর বেশী খারাপ হওয়াতে উনি আমার বউ দেখতে চান। তখন আমি জোর করে ওকে বিয়ে করি। দাদীও দু’দিন আগে মারা গেলেন। আর মায়াও আমার কাছ থেকে রাগ করে চলে আসে।
আবীর কিছুক্ষণ চুপ করে সালেহা বেগমকে বলে,
—-মা,আজ আমি আপনার কাছে মায়াকে চাইতে এসেছি। একমাত্র আপনি ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেন।
আবীর ইচ্ছে করেই ওর আর মায়ার বিয়ের সত্যি কাহিনীটা গোপন করলো। ও চায়না এই পরিবারটা নিজেদের ছোটো মনে করুক।কেননা এখন থেকে এরাই ওর আপনজন। সাথে সাথে মায়ার সম্মান রক্ষা করা ওর দায়িত্ব। থাকুক না গোপন ওর আর মায়ার কিছু চুপকথা।
সালেহা বেগম আবীরের ব্যবহারে খুবই অভিভূত হলেন। মুগ্ধতার দৃষ্টিতে আবীরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তুমি আমার মেয়েটাকে কষ্ট দিও না বাবা। আমার মেয়ে বলে বলছি না আসলেই ওর মতো মেয়ে আজকাল দেখা যায় না। আমারতো চারটে সন্তান আছে। কিন্তু ও সবার থেকে আলাদা।
আবীর সালেহা বেগমকে বলে,
—আমি বাবার সাথে দেখা করতে চাই।
সালেহার বেগমের একটু অস্বস্তিবোধ হলো। নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের রোগীর ঘর। খুব একটা পরিচ্ছন্ন হবে না। যদিও সালেহা বেগম পরিস্কার রাখার চেষ্টা করেন। সালেহা বেগম আবীরের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-আমি ওর বাবার কাছে তোমাকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবো?
—-সেটা আপনি আমার উপর ছেড়ে দিন।
সালেহা বেগম ইতি উতি করছিলেন। আবীর উনার অস্বস্তি ভাব দেখে বলে,
—মা,আমাকে লজ্জা পাবার কিছু নেই। ধরে নেন আমি আপনার আরো একটা ছেলে।
আবীরের কথায় সালেহা বেগমের দুচোখ দিয়ে আনন্দের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার গড়িয়ে পড়লো। উনার মনে হলো মায়াবতী নামক এক রাজকন্যাকে নিতে আজ সত্যিই এক ডালিমকুমার উনার ঘরে এসেছে। ইরা অবাক হয়ে আবীর দেখছে আর মনে মনে ভাবছে কোথায় আবীর আর কোথায় জাওয়াদ। ওর বোনটা তার উপযুক্ত জীবনসঙ্গী পেয়েছে। মনে মনে আপুটার জন্য ইরা প্রান খুলে দোয়া করলো। এই প্রাপ্তি ওর বোনের প্রাপ্য ছিলো।
এরমাঝে রুবেল আবীরকে নিয়ে ওর বাবার ঘরে গেল। নোবেলও সাথে গেল। মায়ার বাবা কোনো কথাই বলতে পারলেন না। ফ্যাল ফ্যাল করে আবীরের দিকে তাকিয়ে থাকলো। আবীর মায়ার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
—আপনাদের কাছে আমি একটা মুল্যবান জিনিস চাইতে এসেছি। সেটা হচ্ছে আপনার মেয়েটাকে আমায় দিতে হবে। ও আমার বিবাহিত স্ত্রী।
মায়ার বাবা ভীষণ অবাক হলেন। উনার মতো এক হতভাগ্য পিতার কন্যাকে নিতে আজ তার গরীবখানায় এক রাজপুত্র এসেছে। এযেন রুপকথার গল্পের মতো লাগছে। আবীর মায়ার বাবার নিরবতায় বলে,
—কি বাবা দেবেন না আমায়? ও ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার কোনো আপনজন নেই।
মায়ার বাবা আবীরের হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,
—আমার রাজকন্যাটাকে কোনোদিন কষ্ট দিও না।
ইরা ওর বাবার মুখে এই কথাটা শুনে মনে মনে বলে,
—-আব্বা সময় আপুকে রাজকন্যা বলতো। সত্যিই আপু আজ রাজরানী হলো।
এরমাঝে মোবারক মিয়া এসে অনেক মিষ্টি ফল বাসায় দিয়ে গেল। আবীর সালেহা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,
—মা আজ আপনার হাতে একটু ডালভাত খেয়ে যাবো।
— আজ প্রথম এসেছো,তোমাকে ডাল ভাত কি করে খাওয়াই?
—না,মা আমি সত্যি আপনার হাতের ডাল ভাত খেতে চাই।
সালেহা বেগম কিচেনে গিয়ে একচুলায় ডাল আর একচুলায় ডিম সিদ্ধ বসিয়ে দিলেন। আসলে বাজার নেই ঘরে। ফ্রিজে কিছু ছোটো মাছ আছে। এছাড়া কিছু নেই।
সেকারনে উনি ডাল ডিম ভুনা আর আলুভর্তা করলেন। সাথে বেগুন ভাজি আর পটল ভাজি করে নিলেন।
এরমাঝে আবীর মায়াকে দেখার জন্য ছটফট করছে। এখন এটা কাউকে বলতে পারছে না। দ্রুত রান্না শেষ করে সালেহা বেগম মায়ার রুমে এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিলেন। হঠাৎ চোখে আলো পড়াতে মায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সাথে ইরাও এরুমে এসে মায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। মায়া রেগে গিয়ে বলে,
—-তোমরা মায়ে ঝিয়ে মিলে আমার ঘুমটা ভাঙ্গিয়ে এখন হাসা হচ্ছে?
সালেহা বেগম হাসিমুখে বলেন,
—-আর ঘুমাতে হবে না। ড্রইংরুমে গিয়ে দেখ কে এসেছে?
মায়া রেগে গিয়ে বলে,
—দেশের প্রধানমন্ত্রী আসলেও আমি যেতে পারবো না।
মায়া পাশ ফিরে মুখের উপর বালিশ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। সালেহা বেগম সাথে সাথে বললেন,
–আবীর তোকে নিতে এসেছে।
মায়ার ঘুম ছুটে গেল। শোয়া থেকে দ্রুত উঠে বসে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
—-ওকি তোমাকে সব বলেছে।
—-হা বলেছে,
—+ওর লজ্জা লাগলো না বলতে,
—-কেন লাগবে,ওতো অপরাধ করেনি। তোকে জোর করে বিয়ে করেছে। তাও ওর দাদীর জন্য করতে বাধ্য হয়েছে। এখানে আমি ওর কোনো দোষ দেখিনা।
এরপর ইরার দিকে তাকিয়ে বলেন,
–+তুই গিয়ে টেবিলে ভাত বেড়ে দে। আমি মায়াকে নিয়ে আসছি।
ইরার কষ্ট হবে বলে সালেহা বেগম ওকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলেন। ইরা আজ ডিভোর্স পেপারে সই করে কাগজ জাওয়াদের কাছে পাঠিয়েছে। এদিকে তার আর এক মেয়ে রাজার ঘরে রানী হয়ে চলে যাচ্ছে। ইরা তো ভাবতেই পারে ওর ভাগ্যটা মায়ার মতো হতে পারতো। কিন্তু এটাই বাস্তবতা। জগতের সবার ভাগ্য এক সুতো দিয়ে গাঁথা হয় না। মায়ার কাছে এসে ওর কপালে চুমু দিয়ে সালেহা বেগম বলেন,
—যে সন্তান তার বাবা মায়ের জন্য কষ্ট করে তার প্রতিটি কষ্টের মুল্য আল্লাহপাক বহুগুন বরকত দিয়ে ফিরিয়ে দেন। তুই তোর পুরুস্কার হিসাবে আল্লাহপাকের তরফ থেকে আবীরকে পেয়েছিস। কোনোদিন ওর অমর্যাদা করিস না। এরপর মায়ার হাত ধরে ড্রইংরুমে নিয়ে এসে আবীরের সামনে বসিয়ে দিয়ে চলে যান। আবীর অপলক মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর গাঢ়স্বরে বলে,
–কি মায়ার বাঁধনে বাঁধলে যে তোমার সামনে আমি চলে আসতে বাধ্য হলাম। এই তিনদিন আমার ঘুম হয়নি। খাওয়া হয়নি। তুমি এতো পাষাণ কি করে হলে? একটা ফোন দিয়ে খোঁজ নিলে না। ওদিকে আহসান চাচা একটু পার পর ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছে। একদিকে দাদী নাই আবার তুমি ও চলে গেলে।
মায়া শান্তভাবে বলে,
—তুমি আমাকে চলে আসতে বলেছো।
—মুখের কথাটাই বড় হলো। হৃদয়ের অন্তপুরের ভাষা বুঝলে না।
রুবেল এর মাঝে এসে আবীর আর মায়াকে ডেকে খাবার টেবিলে বসালো।
খাওয়া শেষ করে সবার কাছে বিদায় নিয়ে আবীর তার প্রিয়তমাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ড্রাইভার রফিক আর মোবারককে উবার নিয়ে চলে যেতে বললো। আবীর ড্রাইভিং সীটে বসে আর মায়া তার পাশের সীটটাতে বসে সীট বেল্ট লাগিয়ে নেয়। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার আগে আবীর মায়ার হাতটা শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। আহ্ কি মোলায়েন হাত! আবীরের উষ্ণ স্পর্শে মায়ার শরীরের শিরা উপশিরাগুলো যেন কেঁপে উঠলো। এমন উপলব্ধি ওর আগে কখনও হয়নি। আবীরের গরম শ্বাস মায়ার ঘাড়ে পড়ছে। ওর কেমন যেন লাগলো। থাকতে না পেরে মায়া আবীরকে বলে,
—সারারাত কি এখানে কাটিয়ে দিবে?
আবীর সম্বিত ফিরে পেয়ে বলে,
—-নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না। আমার ভালোবাসার উত্তাল স্রোত তোমার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
আবীর অবশেষে গাড়ী স্টার্ট দেয়। ক্যাসেট প্লেয়ারটা ছেড়ে দেয়। সেখানে বাজছে নিলুফার চৌধুরীর গাওয়া গান।
“এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে
দুটি মন কাছে আসলো,
এক সমুদ্র কল্পনা বেয়ে
দুটি মন ভালোবাসলো।”

চলবে