#বড় গল্প
#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী
আবীর ওর অফিসরুমের কাঁচের দেওয়াল দিয়ে বৃষ্টিস্নাত বিকেলটা দেখছিলো। দেয়ালের ওপাশে থরে থরে কৃষ্ণচূড়া ফুটে আছে। দুটো শালিক কৃষ্ণচূড়ার ডালটায় বসে নিজেদের চঞ্চু দিয়ে সোহাগ বিনিময় করছে। মায়া আবারও অফিসে ফিরে আসলো। একটু ইতস্তত করে কাঁচের দরজা ঠেলে ভিতরে রিনরিনে কন্ঠে বললো,
—-আসতে পারি
আবীর পিছন ফিরে মায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
—আসুন।
মায়া ভিতরে আসার সাথে সাথে মোবারক মিয়া চলে আসলেন। আবীর না তাকিয়ে মোবারক মিয়াকে বলে,
—-মোবারক ডিলের কাগজপত্র নিয়ে আসো।
এরপর আবীর চৌধুরী নিজের আসনে বসে মায়াকে তার মুখোমুখি চেয়ারটায় বসতে বলে। ততক্ষণে মোবারক মিয়া চুক্তিপত্র এনে মায়ার সামনে এগিয়ে দেয়। মায়ার চাওয়া মতো ওখানে কন্ট্রাক ম্যারেজ কথাটা ওরা রাখেনি। বিয়ের নরমাল কাবিননামা। বিষয়টা মায়ার খুব ভালো লাগলো। তবে উসুল দশ লাখ টাকা লেখা আছে। মায়া ইতিউতি করতে লাগলো। সেদিকে লক্ষ্য করে আবীর বললো,
—-সমস্যা কি? আপনার শর্ত তো মেনে নিয়েছি। পরশু শুক্রবার। গাড়ি পাঠাবো দুপুর দুটোর সময়। আপনি একদম রেডী হয়ে থাকবেন। কাজীকে বলা আছে। আমি ঠিক তিনটায় কাজী অফিসে যাবো। সেখানে বিয়ের কাজ শেষ করে চারটার মধ্যে বাসায় চলে আসবো। সাড়ে চারটায় দেশের বাইরে অনলাইনে আমাকে একটা মিটিং এ অংশ নিতে হবে। আমি ঘড়ি ধরে চলতে পছন্দ করি। একটা কথা জানার ছিলো।
—-বলুন,
—-আপনার এই সিদ্ধান্তের কথা বাসায় আপনার বাবা মা জানেন?
—নাহ্ আমি কাউকে জানাতে চাইছি না।
—-তাহলে আপনি বিয়ের পর আমার বাসায় কিভাবে থাকবেন?
—-সে ভাবনা ভেবেছি। বাসায় সবাইকে বলবো ঢাকার বাইরে আমার চাকরি হয়েছে। এটা ছাড়া আর কিছু বলার নাই। কেননা এভাবে বিয়ে হওয়াটা আমার মা বাবা কেউ মেনে নিবেন না।
তারপরও মায়া সই করছিলো না দেখে আবীর বললো,
—- এখন কি সমস্যা?
মায়া মনে মনে ভাবলো পেটে খিদে মুখে লাজ রেখে লাভ নেই। তাই বেশ স্পষ্ট করে বললো,
—-আমি উসুলের দশ লাখ টাকা এখনও বুঝে পাইনি।
আবীর বেশ তাচ্ছিল্য ভরে বললো,
—-টাকা নিতে সমস্যা নাই শুধু চুক্তির বিয়েতে সমস্যা। বিজ্ঞাপনে দুটো বিষয় উল্লেখ ছিলো। যদি চুক্তির বিয়েতে রাজী হোন তাহলে আপনাকে দশ লাখ টাকা দেওয়া হবে। অথচ আপনি সেই শর্তে রাজী হলেন না কিন্তু বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত টাকাটা নিতে সমস্যা নাই।
আবীরের কথাগুলো মায়ার শরীরে কাঁটার মতো ফুটলো। তবুও হজম করে নিয়ে মায়া বললো,
—-টাকার প্রয়োজন ছিলো বলেই এসেছি। যেমন আপনার আমাকে প্রয়োজন। প্রত্যাখান করে চলেই তো যাচ্ছিলাম। আপনি ডেকে আনলেন বলেই তো আসলাম।
অন্যসময় হলে আবীর এই মেয়ের মুখে ঝামা ঘসে দিতো। কিন্তু এখন সেটা সম্ভব নয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে তাকে কিল খেয়ে কিল হজম করতে হচ্ছে। এরপর নিজের ড্রয়ার থেকে দশ লাখ টাকা বের করে মায়ার হাতে ধরিয়ে দিলো। টাকা গুনে নিয়ে মায়া স্ট্যাম্পে সই দিয়ে বললো,
—তাহলে ঐ কথাই রইলো। আমি ঠিক তিনটার দিকে পরশু বাসা থেকে বের হয়ে আনসার ক্যাম্পের মেইন রোডে পৌঁছে যাবো।
মেয়েটাকে আবীরের কেন যেন খুব চেনা মনে হচ্ছে। মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছে এই মুখ সে কোথায় দেখেছে। মনের কথাটা চেপে না রেখে একসময় উগরে দিয়ে বললো,
—-আপনাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি।
মায়ার মনে পড়েছে। কাল এই লোক ওকে লিফট দিয়েছে। ওর কেন যেন মনে হলো কালকের কথা লোকটাকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। পরে যদি আবার কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়। সে কারণে মায়া ঠোঁটের কোনায় হাসির আভাস এনে বললো,
—-আপনার স্মরণ শক্তি বেশ প্রখর। ঠিক ধরেছেন। কাল আপনি আমাকে ঝড় বৃষ্টির সময় লিফট দিয়েছিলেন।
আবীরের খুব জানতে ইচ্ছা হলো, মায়া কেন এঔ ঝড় বৃষ্টির রাতে ঐ রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছিলো। কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলো,
—যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা জানতে চাইছিলাম।
—–বলুন,
—-কাল ঐ সময় আপনি ওখানে কেন গিয়েছিলেন?
—-বলতে সমস্যা নেই। অন্য আর একদিন বলবো। এখন আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে। আকাশটা আজও মেঘাচ্ছন্ন।
—-এতোগুলো টাকা নিয়ে সিএনজি করে যাওয়া ঠিক হবে না। মোবারক আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
—-না,আমি একাই যেতে পারবো।
আবীর একটু ধমক দিয়ে বলে,
—বললাম তো মোবারক আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবে। এক কথা বার বার বলা আমি পছন্দ করি না।
মায়া প্রচন্ড অবাক হলো। এখনও তো বিয়েই হয়নি তাতেই খবরদারী করতে শুরু করেছে। তবে এখন আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা করলো না। টাকা যখন নিয়েছে কিছুটা হলেও আবীর চৌধুরীর কাছে দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছে। যাক আবীর চৌধুরী মোবারক মিয়াকে ডেকে মায়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে বললো। মায়া মোবারকের পিছু পিছু চলে গেল। অফিসের বাইরে এসে মোবারক বিএমডব্লিউ গাড়ির দরজা খুলে মায়াকে মাঝের সীটটাতে বসতে বললো। ড্রাইভারের পাশের সীটে মোবারক মিয়া বসার সাথে গাড়িতে স্টার্ট দিলো রফিক মিয়া। মায়া গাড়িতে উঠেই কনফার্ম হলো কাল রাতে এই গাড়িতে করে ও বাসায় ফিরেছে। এরপর রফিক মিয়া মোবারকের দিয়ে তাকিয়ে বললো,
—-কোথায় যাবো।
মোবারক মায়ার কাছে পুরো ঠিকানা জানতে চাইলো।
মায়া পুরো ঠিকানাটা বললো। কিন্তু ওদের গলিতে এতো বড় গাড়িটা ঢুকলে আর কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। সে কারনে মায়া মোবারক মিয়াকে বললো,
—-মিরপুর এক নাম্বারে আনসার ক্যাম্পের সামনে আমি নেমে পড়বো। বাসা পর্যন্ত গাড়িটাকে নেওয়া যাবে না।
—-ঠিক আছে,আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দিবো। সন্ধা হয়ে গেছে। একা যাওয়া ঠিক হবে না।
মায়াও কোনো উচ্চবাচ্চ্য করলো না। আসলে এতোগুলো টাকা সাথে আছে। সুতরাং মোবারক মিয়া গেলে মন্দ হয় না। গাড়ি থেকে নামার সময় রুবেল মায়াকে দেখে ফেললো। একটু অবাক হলো। ওর বোন এতো বড় চাকরি তো করে না যে বিএমডব্লিউ গাড়িতে করে বাড়ি ফিরবে। ও দূর থেকে মায়াকে ফলো করতে লাগলো। আরো অবাক হয়ে দেখলো ষন্ডা মার্কা একটা লোক ওকে মেডাম মেডাম করে মুখে ফেনা তুলছে। মায়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে মোবারক মিয়া চলে গেল। মায়া ঘরে ঢুকতেই ওর মা একটু বিরক্ত হয়ে বলে,
—-কিরে তোর ফোন বন্ধ ছিলো কেন?
মায়ার মনে পড়লো আবীরের অফিসে ঢুকার সময় মোবাইলটা অফ করে রেখেছিলো। কিন্তু তারপর আর চালু করা হয়নি। একটা বিশেষ কাজে ব্যস্ত ছিলাম। সেই কারণে মোবাইলটা অফ ছিলো।
—-কি কাজ?
—-আমার ইন্টারভিউ ছিলো। আম্মু আমার চাকরি হয়েছে। এখন আপাতত ঢাকার বাইরে পোস্টিং হবে। বছরখানিক কাজ করার পর ঢাকায় চলে আসতে পারবো।
সেসময় রুবেল বাসায় ঢুকে বললো,
—ওটা কি তোমার বসের গাড়ি?
—নাহ্ আমাদের অফিসের গাড়ি। তবে বসই ব্যবহার করে।,রাত হয়েছে বলে বাসায় পৌঁছে দিলো।
—-বেতন কতো আপু?
মায়া মুচকি হেসে বললো,
—-,বেতন জানতে হবে না। তোর কি কি লাগবে জানালেই সব পেয়ে যাবি।
এমন সময় নোবেল এসে বলে,
—-আপু আমার স্কুলের তিনমাসের বেতন বাকি আছে।
—-,কাল সব পেয়ে যাবি।
এরপর মায়া ওর মায়ের হাতে একলক্ষ টাকার বান্ডিল দিয়ে বললো,
—-টাকাটা হাতে রাখো। আমাকে শুক্রবার মানিকগঞ্জ যেতে হবে। একসপ্তাহের আগে তো মনে হয় না আসতে পারবো। সংসারের খরচগুলো এটা দিয়ে আপাতত চালিয়ে নিও।আম্মা ইরা কোথায়?
—-ওর জ্বর এসেছে। সাথে বমিও হচ্ছে। মাথা তুলে বসতে পারছে না।
তবে টাকার বান্ডিলটা হাতে নিয়ে ভাবছেন, মেয়েটা কোনো খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়ছে নাতো। মায়ের মন বলে কথা।অজানা আশঙ্কায় ছটফট করে।মায়া মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—কি ভাবছো আম্মু,
—-না,মানে
—-বুঝতে পারছি, হয়তো ভাবছো মেয়ে কোনো খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়লো কিনা?
—+ইনশাআল্লাহ, তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আমি এমন কোনো কাজ করবো না যা আমার ধর্মের সাথে সাংঘর্ষিক। আর তোমাদের ও সম্মানহানি করবো না। এই টাকাটা শতভাগ হালাল।
এরপর মায়া ওর মায়ের সামনে থেকে সরে পড়ে। যদি মুখ ফসকে কিছু কথা বেরিয়ে যায় তখন তা সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে। মায়া নিজের রুমে এসে দেখে আসলেই ইরার শরীর খুব খারাপ। ওরা দুবোন একরুমেই থাকে। ইরাকে এভাবে নির্জীব হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখে মায়া খুব চিন্তায় পড়ে যায়। ও মনে মনে ঠিক করলো আগামী কালই ইরাকে ডাক্তার দেখাবে। এ ছাড়া ওর আর সময় হবে না। ইরার দিকে তাকিয়ে মায়া বললো,
—-কি খাবি বল?
—-আপু আমি কোনো খাবারের গন্ধ নাকে নিতে পারছি না। গা গুলিয়ে উঠছে।
—-ঠিক আছে কালই তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
—-আমারও মনে হচ্ছে ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
পরদিন খুব ভোরে উঠে মায়া ইরাকে নিয়ে বের হয়। ইরাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ও ব্যাংকের ভিতরে প্রবেশ করে। ওর কাবিনের বাকি আট লাখ টাকা জমা দেয়। মাকে এক লাখ দিয়েছে। আর আজকে একলাখ নিয়ে বের হয়েছে। ইরাকে নিয়ে টেনশনে আছে। কি কাহিনী যে ঘটিয়েছে কে জানে? ব্যাংকের কাজ গুছিয়ে ইরাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যায়। ওখানে পরীক্ষা নীরিক্ষার পর ডাক্তার মায়াকে জানায়,ইরা মা হতে চলেছে। একথা শুনে মায়া বজ্রাহতের মতো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের মনকে প্রবোধ দেয় সে হয়তো ভুল শুনেছে। তারপর আবারো সাহস সঞ্চয় করে ডাক্তারকে বলে,
—-ম্যাম আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। ওর তো বিয়েই হয়নি। মা হবে কি করে?
—-ভুল আমার নয় আপনার হচ্ছে। মা হলো কি করে তা আপনার বোনকে জিজ্ঞাসা করুন।
ইরা মায়ার সামনে মাথা নীচু করে বসে থাকে। মায়ার পুরো পৃথিবী দুলে উঠছে। ওর চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। কানের ভিতর মনে হচ্ছে কোনো ডাস মাছি ভনভন শব্দ করছে। ও ইরাকে নিয়ে টলতে টলতে চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। এরপর ইরার দিকে তাকিয়ে কঠিনভাবে জিজ্ঞাসা করে,
—-তোর এই সর্বনাশ কে করলো?
ইরা এরপরও চুপ করে থাকাতে মায়া কষে ওর গালে থাপ্পড় মারে। এতে হাসপাতালের লোকজন এসে মায়াকে বলে,
—-এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করবেন না। যা করার বাইরে গিয়ে করুন।
মায়া ওকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আসে। এরপর ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
—-এখন চুপ করে থাকার সময় নয়। তুই কি কার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিস?
ইরার ঠোঁট কাঁপছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রুগড়িয়ে পড়ছে। মাথার শিরাগুলো দপদপ করছে। নিজেকে সামলে মাথা নাড়িয়ে বলে,
—-হুম,
—-তার পরিচয় কি?
—-জাওয়াদ ওর নাম। আমাদের কলেজে মার্কেটিং এ অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে।
—-এই কাহিনী কিভাবে ঘটলো।
—–ওর সাথে একদিন রুমডেট করেছিলাম। আমরা নিজেদের কন্ট্রোল করতে পারিনি।
—-রুমডেট করতে গিয়েছিলি কেন? এখন তার ফল হাড়ে হাড়ে ভোগ কর। তুই এই পাপ কাজ কিভাবে করলি? এখন তো পাপের ফল ভোগ করতে হবে। এ বাচ্চা রাখা যাবে না। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে এবরশন করানোর ব্যবস্থা করি। ইরা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
—-আপু আমি এবরশন করাতে চাচ্ছি না।
—-ভালো কথা, তাহলে জাওয়াদকে বল,তোকে বিয়ে করতে।
চলবে