কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-০৯

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

আবীরের নানা আর দাদা ছোটোবেলার বন্ধু ছিলো। আবীরের দাদা গ্রামের সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকা শহরে ব্যবসা শুরু করে। পুরাণ ঢাকায় ওর দাদা একটা চাররুমের বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে প্রথমে বারোটা মেশিন কিনে বিভিন্ন গার্মেন্টস থেকে অর্ডার নিয়ে লোক দিয়ে সেলাই করে জমা দেওয়া শুরু করে। কাজের মান ভালো হওয়াতে অর্ডারও বাড়তে লাগলো। বছর দুয়েক পর জমানো টাকা আর ব্যাংক লোন নিয়ে আমরা নিজেরা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু করি। আমার যেহেতু সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা আছে সে কারণে আমি সুপারভাইজারের দায়িত্ব নেই। সাথে সাথে সেলাই, কাটিং এর উপর আরো ট্রেনিং নিয়ে পুরোদমে কাজে নেমে যাই। আর ওর দাদা অন্যান্য সাইড দেখা শোনা করতে লাগলো। আস্তে আস্তে আমাদের ব্যবসা বড় হতে লাগলো। এদিকে আবীরের বাবাও বড় হতে থাকে। স্কুল কলেজ শেষে ঢাকা ভার্সিটিতে বিবিএ তে গ্রাজুয়েশন শেষ করে বছর দুয়েকের মধ্যে এমবিএ কমপ্লিট করে। এদিকে ছেলে আমার বিয়ের উপযুক্ত হয়। ঢাকা শহরের অনেক নামি দামী পরিবার থেকে আমার ছেলের জন্য প্রস্তাব আসে। কিন্তু ওর দাদার ইচ্ছে বন্ধুর মেয়েকে বউ করে আনবেন। আবীরের নানা রংপুর শহরে জেলা স্কুলে চাকরি করতেন। আবীরের মা রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে সোসিওলজিতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। ওর মা আনজুমানও বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। দুই বন্ধু মিলে বিয়ে ঠিক করে। বেশ ঘটা করে বিয়ে হয়। বউ নিয়ে আমাদের তখন আনন্দের সীমা নেই। কিন্তু আমি খেয়াল করে দেখলাম আনজুমানের মুখে সুখের কোনো চিহ্ন নেই। নতুন বিয়ে হয়েছে কতো উচ্ছাসে থাকার কথা। অথচ মুখ ভার করে ঘুরে বেড়ায়। আমার ছেলেও তেমন খুশী থাকে না। আমাকে আবীরের বাবা দু একবার আনজুমানের ব্যাপারে বলেছিলো। ওর মত নিয়ে এ বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে কিনা? আমি আসলামের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলেছিলাম,
—-বাচ্চা হয়ে গেলে দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু আমার ধারণাটা ভুল ছিলো। আবীরের জন্ম হলো। কিন্তু আনজুমানের মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসলো না। সংসারের প্রতি প্রচন্ড নিরাসক্ততা দিনদিন বেড়েই চললো। কিন্তু আবীর যত বড় হতে লাগলো ততই মায়ের ন্যাওটা হতে শুরু করলো। এর কারণ অবশ্য ছিলো। আসলাম আর ওর বাবা এবং আমি ব্যবসা নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতাম। সে কারণে হয়তো মায়ের প্রতি ও বেশী দুর্বল। যদিও আবীরকে দেখা শোনার জন্য আলাদা খালা রাখা হয়েছিলো। তারপরও আবীর সারাক্ষণ মায়ের পিছু পিছু ঘুরতো। মা বাথরুমে গেলে আবীর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। ও যখন রাতে ঘুমাতো তখন মায়ের আঁচল নিয়ে আঙ্গুলে গিট দিয়ে রাখতো। যাতে মা উঠে গেলে ওর ঘুম ভেঙ্গে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিনাতুন্নেছা বললেন,
—-আসলে ছোটো আবীর বুঝতে পেরেছিলো হয়তো একদিন ও ওর মাকে হারিয়ে ফেলবে। জানো সত্যি হারিয়ে ফেললো। ওর বয়স যখন চার তখন আনজুমান এই সংসার ছেড়ে ওর প্রেমিকের হাত ধরে অস্টেলিয়া পাড়ি জমায়। পরে শুনেছিলাম ইউনিভার্সিটি পড়া অবস্থায় ওদের প্রেম হয়েছিলো। ছেলে গ্রাজুয়েশন শেষ করে পিএইচডি করতে অস্টেলিয়া চলে যায়। কথা ছিলো পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে আনজুমানকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে। কিন্তু ওর বাবা ঐ ছেলেকে মানতে চাননি। উনি বন্ধুর ছেলের সাথেই মেয়ের বিয়ে দিবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু মেয়ে তো তার মনের ঘরে প্রেমিককে আগেই বাসস্থান ঠিক করে দিয়েছে। যার সেখানে আমার ছেলের আর জায়গা হয়নি। এমনকি আনজুমান নিজের ছেলেকেও তার প্রেমিকের থেকে বেশী ভালোবাসতে পারেনি।
সেদিন সকাল থেকে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিলো। আসলাম ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলো। আমি আর আবীরের দাদা অফিসে ছিলাম। বিদেশ থেকে বায়্যাররা এসেছিলো। সেদিন বাসায় আবীর আনজুমান আর বাড়ির অ্যাসিসট্যান্টরা ছিলো। এমন সময় আনজুমানের প্রেমিক ওর খোঁজে এ বাড়িতে আসে। আনজুমান নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। বাড়ির কাজের হেলপারদের সামনে উনাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। আবীর তখন ঘুমিয়ে ছিলো। সেই ঝড় বৃষ্টির দিনে আনজুমান ওর প্রেমিকের সাথে বেরিয়ে যায়।
আমি বাড়ী ফিরে দেখি আবীর ঘুম থেকে উঠে ওর মাকে দেখতে না পেয়ে কাঁদতে থাকে। এরপর বিছানা থেকে নেমে প্রতিটি ঘর বারান্দা বাথরুম স্টোর রুম সব জায়গায় মাকে খুঁজে আর কাঁদে। কিন্তু মাতো কোথাও নেই। মাকে না পেয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আসলাম একদিন পরেই ওর ট্যুর কমপ্লিট করে ফিরে আসে। বাবাকে পেয়ে আবীর কিছুটা ঠান্ডা হয়। কিন্তু আমার ছেলে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এই অপমান নিতে না পেরে মাস দুয়েক পর হার্ট অ্যাটাক করে মারা যায়। এদিকে আবীরের দাদা ছেলে হারানোর শোক সইতে মা পেরে স্ট্রোক করে বসে। আনজুমানের বাবা মা পরবর্তীতে আমাদের কাছে ক্ষমা চায়। আসলে ওদের তো কোনো দোষ নেই। যদি বলি কারোর কোনো দোষ নেই। হয়তো আমার নসীবে এটাই লেখা ছিলো। তবে এখান থেকে একটা শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়েদের জোর করে কখনও বিয়ে দিতে হয় না।
সেই থেকে অফিস সংসার আবীরের দাদা ও আবীরের দেখভাল সব আমার কাঁধে এসে পড়লো। আমার আবীরের জন্য খুব কষ্ট হতো। মা ন্যাওটা ছেলে প্রথম প্রথম মায়ের কথা মনে হলে চিৎকার করে কাঁদতো। অনেক কষ্টে আমি ওকে থামাতাম। কিছুদিন যাওয়ার পর ক্লসেট থেকে মায়ের শাড়ি জামা বের করে জড়িয়ে ধরে একা একা আস্তে আস্তে কাঁদতো। বছর দুয়েক পর আবীরের দাদা মারা যায়। তখন আমি অনেকটা ভেঙ্গে পড়ি। আত্মীয় স্বজন তেমন কাউকে কাছে পাইনি। আবীরের দাদা ওর বাবার একমাত্র সন্তান ছিলেন। উনার চাচাতো ভাইবোন ছিলেন। কিন্তু আমাদের ব্যবসার উন্নতি দেখে উনাদের মাঝে হিংসার বীজ রোপিত হয়। সে কারণে আমিও ওদের থেকে দূরে থাকতাম। তবে আমার একটা ভাই ছিলো। ভাবী আবীরকে অনেক ভালোবাসতো। আবীরও ভাবীকে খুব পছন্দ করতো। আমার ভাই ইউকে তে সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার হিসাবে চাকরি করতো। আবীর যখন ও লেভেল পাশ করলো তখন আমি ওকে ইউকেতে আমার ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেই। কেননা ওকে দেখলেই আত্মীয় স্বজন থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী এমন আমার বাসার কাজের হেলপার সবাই ওর মায়ের নামে খারাপ কথা বলতো। এতে আবীর ধীরে ধীরে ওর মায়ের উপর বীতশ্রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আবীর তখন ক্লাস টেন এ পড়ে। আমি অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি বাইরে লনে বসে ও ওর মায়ের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, ওর মায়ের ছবি থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবহার্য জিনিস পত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওর মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা ওকে ইউকে তে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়ে দিলাম। সবই ঠিক ছিলো। ও ইউকে তে এম বিএ করে ওখানেই চাকরি নিয়ে নেয়। এরমাঝে আমার শরীরে এই মারণ রোগ ধরা পড়ে। আবীর দেশে ফিরে আসে কিন্তু বিয়ে, ঘর সংসার করবে না বলে ঠিক করে। পরে আমি যখন বলি সমস্ত সম্পদ আমি ট্রাস্ট করে দিবো তখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মায়া সবটা শুনে বললো,
–আপনার চাপে পড়ে ও হয়তো আমাকে বিয়ে করেছে কিন্তু মন থেকে মেনে নিয়েছে কিনা জানি না।
—সে কথাই তোমাকে বলবো। ওকে বাইরে থেকে দেখতে যতটা কঠিন মনে ভিতরে ও ততটাই নরম। তুমি যদি একবার তোমার ভালোবাসা দিয়ে ওর বাইরের কঠিন আবরণটা ভেঙ্গে দাও। ও তখন তোমাকে ওর সবটা দিয়ে ভালোবাসবে। আমার মনে হয় তুমি পারবে।
মায়া জিনাতুন্নেছার কথা শুনে মনে মনে বললো,
“আপনি একটু বেশী আশা করে ফেললেন।” মায়াকে নিরব দেখে জিনাতুন্নেছা আবারও বললেন,
–বলো,তুমি তোমার পুরোটা দিয়ে আমার নাতীটাকে ভালোবাসবে। কোনোদিন ওকে ছেড়ে যাবে না।
মায়া এই বয়স্ক মহিলাটির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলো বড় আশা নিয়ে উনি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। না মায়া সেই চাহনিকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। সে কারণে উনাকে সান্তনা দিয়ে মায়া বললো,
–আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো।
এমন সময় আবীর এসে দরজা নক করলো। জিনাতুন্নেছা ওকে ঘরে আসতে বললেন। খাটের কোনায় বসে আবীর ওর দাদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
—আমার এক ঘুম হয়ে গেল তবুও তোমাদের গল্প ফুরোলো না।
জিনাতুন্নেছা নাতীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তুই কি বুঝবি গল্প করার মজা? মুখটাতো সবসময় পাতিলের তলার মতো করে রাখিস।

চলবে