কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর প্রেম পর্ব-১০

0
1

#কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ অতঃপর লাভ
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

ডিনার শেষ করে ঘরে এসে মায়া বড় দ্বিধায় পড়ে গেল। রাত পোহালেই ঐ লোকের সাথে তাকে কক্সবাজার যেতে হবে। এদিকে ও ওর মাকে বলেছিলো শুক্রবার ছুটির দিনে ও বাসায় যাবে। মা ভাইবোনের সাথে সময় কাটাবে কিন্তু কি এক ফ্যাসাদ সামনে এসে দাঁড়ালো। কে জানতো এই বিয়েতেও আবার হানিমুনে যেতে হবে? মায়ার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। ওখানে একা পেয়ে ঐ লোক আবার কি করবে কে জানে? যদিও এখন পর্যন্ত মানুষটা ওর সাথে কোনো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেনি। দরজাটা কে যেন নক করলো। মায়া রুমের দরজা খুলে দেখে আবীর দাঁড়িয়ে আছে। মায়াকে দেখে হাস্যেজ্জল মুখে বললো,
—-রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রাখুন। আটটায় ফ্লাইট। আমরা সাড়ে পাঁচটায় বাসা থেকে বের হবো। গুড নাইট।
আবীরের হাসি মুখ দেখে মায়ার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। মনে মনে ভাবলো ব্যাটা কি ফন্দি আঁটছে কে জানে। এদিকে আম্মাকে ফোন করে জানাতে হবে কাল ও যেতে পারবে না। কারণ হিসাবে আপাতত ঠিক করলো অফিসের কাজে কক্সবাজার যেতে হচ্ছে। মাকে জানিয়ে দিয়ে ফোন করে ব্যগটা গুছিয়ে মায়া শুয়ে পড়লো।

মায়া সমুদ্রের তীর ধরে হাঁটতে লাগলো। ভীষণ ভালো লাগছে। আসলে ওর জীবনের এ যাবতকালে ওর সমুদ্র দেখতে আসা হয়নি। ঢেউগুলো এসে পায়ের তালুতে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। শীতল বাতাসে মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বিকেলের রক্তিম আভা মুছে গিয়ে রাত্রির অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করেছে। ক্রমশঃ রাত্রির গভীরতা বাড়তে লাগলো। লোকারণ্য বীচটা আস্তে আস্তে খালি হতে শুরু করেছে। আকাশে হঠাৎ মেঘের ঘনঘটা। বজ্রের ধ্বনি আর বাতাসের শব্দে চারিদিকে অশান্ত বাতাবরনের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। মায়াবতীর প্রচন্ড ভয় হতে লাগলো। ও উর্দ্ধশ্বাসে হোটেলের দিকে দৌড়াতে লাগলো। হঠাৎ ওর পিছনে পায়ের আওয়াজের শব্দ কানে আসলো। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো। আকাশ চিরে বিদ্যুতের আলোয় কিছু ভয়ঙ্কর মানুষের চেহারা দেখতে পেলো। মায়া আশে পাশে আবীরকে দেখতে পেলো না। দৌঁড়াতে গিয়ে একসময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। তখন একটা ষন্ডা মার্কা লোক ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ঘটনার আকস্মিকতায় মায়া হতবিহ্বল হয়ে চোখ বন্ধ করে পরম করুণাময় আল্লাহপাককে অবিরাম ডাকতে লাগলো। এমনসময় একটা গুলির শব্দ শুনতে পেলো। তাকিয়ে দেখে আবীর ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আর ঐ লোকটা মাটিতে পড়ে আছে। চারিদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে। জল কাদায় মাখামাখি ভেজা শরীরে মাটি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ও আবীরকে জড়িয়ে ধরলো। আর সেই মুহুর্তে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। পুরো শরীর ঘামে ভিজে আছে। শোয়ার সময় এসি চালাতে ভুলে গিয়েছিলো। কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগলো। দেওয়ালে টাঙ্গানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত চারটা বাজে। নাহ্ বাকি রাতে ওর দুচোখে আর ঘুম নামেনি।
বারান্দায় বসে মায়া চাঁদের অস্তরাগের দৃশ্য দেখতে লাগলো আর মনে মনে ভাবলো,ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে?
এখন স্বপ্নের সেই ভয়ঙ্কর অনুভূতি ওর শরীর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কি অদ্ভুত জীবন ওর! নিজেকে অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা এক চাবি দেওয়া পুতুল মনে হলো। সংসারের প্রয়োজনে নিজেকে প্রতিনিয়ত চালিত করছে। মাঝে মাঝে নিজের জীবন থেকে নিজেকেই হারাতে মন চায়। যেখানে ওকে আর কেউ খুঁজে পাবে না। রাত্রির নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে দরজা নক করার শব্দ ওর কানে ভেসে আসে। ওড়নাটা দিয়ে নিজেকে ভালোমতো ঢেকে দরজাটা খুলে দেয়। আবীর ঘরে ঢুকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
—রাত্রে ঘুমাননি? টেনশন হচ্ছে?
মায়া আবীরের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝার চেষ্টা করলো। সেখানে কোনো লম্পটের ছাপ আপাত দৃষ্টিতে দেখতে পেলো না। এরপর বিছানার চাদরটা ঠিক ঠাক করে দিয়ে বলে,
—-একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছি। আপনি শুয়ে পড়ুন। আমি নামাজ পড়ে নেই।
—এখন আর বিছানায় গড়াবো না। আমার ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নেই। আসলে ওখানে আমার কিছু ব্যায়ার আসবে। আমাকে হয়তো মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। আপনাকে একাই ঘুরতে হবে।
একথা শুনে মায়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আবীর আবারও বলা শুরু করলো।
—দাদীর কারণে আপনাকে এই অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হলো। অসুস্থ মানুষ। আর কটা দিনই বা বাঁচবেন। দাদীর এই অত্যাচারগুলো একটু সয়ে নিন।
আবীর ওর ব্যাগ গোছাতে লাগলো। মায়া ওজু করে ফজরের নামাজ আদায় করে নেয়। আবীর ব্যাগ গুছিয়ে পোশাক পাল্টে রেডী হয়ে নীচে নামে। মায়া হাতের কাজ করা একটা কচুপাতা রঙের কামিজ পড়ে নেয়। জামাটাতে হলুূদ আর পেস্ট কালারের সুতো দিয়ে কাজ করা হয়েছে। কচুপাতা রঙের সালোয়ার সাথে হলুদ রঙের সুতীর বড় ওড়না গায়ে জড়ায়। ওড়নার জমিনে কচুপাতা আর পেস্ট কালারের সুতো দিয়ে কাজ করা হয়েছে। মাথায় কচুপাতা রঙের হেজাব পরে নেয়। মুখে হালকা ফেস পাউডার চোখে কাজলের প্রলেপ দেয়। ঠোঁটটা লিপ লাইনার দিয়ে এঁকে নেয়। আয়নাতে মায়া নিজেকে একবার দেখে নিয়ে আপনমনে ভাবে বিয়ের আগে ওতো কখনও নিজেকে এভাবে সাজাতো না। তবে আজ কেন সাজায়? এ সাজ কি আবীরকে দেখানোর জন্য। কি লাভ এতে? এতো মরিচীকার মতো। ছুঁতে গেলে হারিয়ে যাবে। দরজায় নক করার শব্দ। মায়া দরজা খুলে দেখে লাইলি দাঁড়িয়ে আছে। মায়াকে দেখে বললো,
–স্যার আপনাকে ডাকছে।
মায়া সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকে। আবীর খাওয়ার টেবিল থেকে মায়ার দিকে তাকায়। আবীরের কাছে মায়াকে সেই মুহুর্তে হলুদ পরীর মতো লাগলো। মনে মনে বলে সৃষ্টিকর্তা মেয়েটাকে রুপ দিয়েছে বটে। মায়া নীচে নামতেই জিনাতুন্নেছা বলেন,
—প্লেন তো মিস হয়ে যাবে। তোমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ো। মায়া দ্রুত একটা স্যান্ডউইচ মুখে পুরে নেয়। এরপর চা,টা চটজলদি খেয়ে নেয়। আবীর খাওয়া শেষ করে দাদীর কাছে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসে। মায়াও জিনাতুন্নেছার বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। বনানী থেকে খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যায়। ঘড়ির দিকে আবীর তাকিয়ে দেখে সাড়ে ছ’টা বাজে। খুব তাড়াতাড়ি এয়াটপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাউঞ্জে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করে। এদিকে মায়ার ভয় হতে থাকে। এই প্রথম প্লেনে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেনে উঠে নিজেদের নির্ধারিত সীটে আবীর আর মায়া বসে পড়ে। আবীর মায়াকে জানালার কাছে বসতে দেয়। মায়া সীট বেল্ট লাগাতে পারছিলো না। আবীর যত্ন করে বেল্টটা লাগিয়ে দিয়ে বলে,
—আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?
—-,হুম,এই প্রথম প্লেনে উঠেছি।
—সমস্যা নেই আমি তো আপনার পাশে আছি।
প্লেন যখন রানওয়ের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো টেকঅফের জন্য মায়ার তখন ভীষণ ভয় করছিলো। আবীর সে সময় মায়ার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো। নাহ্ মায়া এসময়টাতে বাঁধা দেয়নি। বরং আবীরের এই কেয়ারিং টুকু ওকে ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয়।
প্লেন একসময় আকাশে উড়ে। আবীর মায়ার হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে,
—জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখুন ভালো লাগে। পেজা তুলোর মতো মেঘগুলো আকাশের বুকে ভেসে বেড়াতে লাগলো। মায়া জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে ঢাকা শহর দেখতে লাগলো। মায়ার হঠাৎ মনে হলো আবীর আর একটু হাতটা ধরে রাখলেই পারতো।
প্লেন একসময় কক্সবাজারে পৌঁছে গেল। প্লেন থেকে মুগ্ধ চোখে মায়া সমুদ্র দেখছে। সেদিকে তাকিয়ে আবীর বললো,
—-একটু পরে কাছ থেকে দেখতে পাবেন। তখন মুগ্ধতা আরো বাড়বে। এয়ারপোর্টে নামতেই আবীরের মোবাইলে হোটেল থেকে ফোন আসলো। রিসিভ করতে ওপাশ থেকে বললো,
—স্যার আমরা গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছি।
—ওকে লাগেজগুলো কালেক্ট করেই আসছি।
ব্যাগগুলো বেল্ট এ আসা মাত্রই কালেক্ট করে মায়াকে নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হলো।দূর থেকেই আবীর বেওয়াচের গাড়িটা দেখতে পেলো। ওরা দুটো ফুলের তোড়া আবীর আর মায়ার হাতে তুলে দিলো। ওদের উষ্ণ অভ্যর্থনা মায়ার ভীষণ ভালো লাগে। গাড়ি মেরিন ড্রাইভ দিয়ে ছুটে চলছে। একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে সমুদ্র। মায়া অবাক হয়ে এই সৌন্দর্য অবলোকন করে। আবীর মায়ার মুগ্ধতা দেখে এই সৌন্দর্যটা এমন কখনও পুরোনো হয় না। যতবার আসবেন ততবারই মুগ্ধতা ছড়িয়ে সৌন্দর্য দেখবেন।
ওরা হোটেলে পৌঁছে গেলো। ওয়েটিং রুমে বসতেই ডাবের পানি দেওয়া হলো। আবীর হোটেলের ফর্মালিটিসগুলো মিটিয়ে মায়াকে সাথে কারে লিফটের সামনে দাঁড়ায়। হোটেলের বয় আগেই ওদের লাগেজ নিয়ে রুমে পৌঁছে দিয়েছে। রুমে ঢুকেই মায়ার চক্ষুচড়ক গাছ। বিছানার মাঝখানে হার্ট সেইপ করে গোলাপের পাপড়ি বিছানো আছে। তাতে গাজরা দিয়ে হানিমুন শব্দটা লেখা হয়েছে। পুরো রুমটাতো ছোটো ছোটো পাত্রে মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মায়া আবীরের দিকে তাকিয়ে বললো,
—এসবের মানে কি?
—-এখনি ছবি তুলে দাদী মোবাইলে পাঠিয়ে দিয়ে সব সরিয়ে ফেলবো। মায়া একটু নিশ্চিন্ত হলো। পুরো রুমটা ঘুরে দেখলাে। বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। বারান্দায় রাখা চেয়ারটায় বসে,আল্লাহপাকের কাছে শোকরিয়া আদায় করে নেয়। এতো সুন্দর দৃশ্য দেখা আল্লাহপাক ওর ভাগ্যে রেখেছেন। যেই কথা সেই কাজ। আবীর ছবি তুলে নেয়। মায়াকে ডেকে দুজন মাঝখানে হানিমুন শব্দটা রেখে ছবি তুলে। এরপর আবীর রিসিপশনে ফোন দিয়ে রুমটা পরিস্কার করে দিতে বলে। মায়া খেয়াল করে রুমে খাট একটা। তাহলে কি ওকে আজকে আবীরের পাশে ঘুমাতে হবে। ইস কি বিব্রতকর!

চলবে