কমলা রঙের রোদ পর্ব-০৪

0
7

#কমলা_রঙের_রোদ [৪]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

এক সপ্তাহের জ্বরে খুশবু এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছে যে নিজে থেকে উঠে বসতে পারছে না। খুশি দাঁড়িয়ে দেখছে খুশবুর একা বসতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। শেষে খুশবুই বলল,

-দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমাকে একটু ধরে বসা।

ইচ্ছে না থাকলেও খুশি খুশবুকে বসতে সাহায্য করলো। এর পরে খুশবু আরও কোন সাহায্য আশা করার আগেই খুশি বলে দিল।

-এর বেশি আমার থেকে আর কিছু আশা করিস না। নিজে খেতে পারলে খা। নয়তো বাদ দে।

খুশবু শুষ্ক মুখে বোনের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

-তাহলে নিজের খাবার আমাকে দিলি কেন?

-তুই বলে দিয়েছি এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। অসুস্থ যেকেউ হলে দিতাম।

-আমি আর যেকেউ এক হলাম?

-অন্তত আমার জন্য তো একই।

কথাটা শুনে খুশবুর চোখ জলে টলমল করে উঠল। খুশিও কি তাকে ভালোবাসে না? সে এমন কী পাপ করেছে যেজন্য মা খুশি কেউ তাকে ভালোবাসে না। সে কি জেনে-বুঝে কিছু করেছে? তাহলে এর শাস্তি তাকে কেন দেওয়া হচ্ছে? মনের মধ্যে এক আকাশ কষ্ট নিয়ে খুশবু বলল,

-ঠিক আছে। তাহলে তোর এনে দেওয়া খাবার খাবো না আমি।

-না খা। তাতে আমার কী?

এটা সত্যি তার জন্য কারো কিছু আসে যায় না। সে থাকা বা না থাকা নিয়ে কারো জীবনে পরিবর্তন আসবে না। এরকম ভালোবাসাহীন কপাল নিয়ে সে কেন দুনিয়াতে এসেছে? বাবা তো সব জানতো। সব জানার পরেও বাবা কেন এই মানুষ গুলোর কাছে তাকে একা রেখে গেছে। এই পরিবারটা তার হলেও কেউ তাকে ভালোবাসে না। কেউ তাকে চায় না। খুশবু সত্যি সত্যিই না খেয়ে ওপাশ ফিরে শুয়ে নিরবে চোখের পানি ফেলতে লাগল। মাঝে মাঝে মনে হয় সে মরে গেলেই হয়তো সবাই খুশি হবে। পৃথিবীর বুকে সে একটা বোঝা। খুশবু না খেয়ে থাকলেও খুশি কিছুই বলল না। যার খিদে পাবে সে খাবে। খিদে না পেলে না খেয়ে থাকবে। এমন তো না সে খাবার দেয়নি।

মা দাদী বাড়ি ফিরলে খুশি জানতে পারলো পল্টুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটা মোটরবাইক ধাক্কা দিয়ে চলে গেছে। অবস্থা অনেক খারাপ। কাছের হাসপাতালে নিলে রাখেনি। তাই শহরে নিয়ে যাচ্ছে। পল্টু এই পাড়ার একটা বিচ্ছু শয়তান। এর মতো দুষ্টুমি পাড়ার আর কোন ছেলে করে না। যেমন দুষ্টুমি করে কাকীর হাতে তেমন মারও খায়। মার খেয়ে বেশিরভাগ সময়ই খুশবুর কাছে চলে আসে। খুশবুর সাথে ওর অনেক খাতির। কিন্তু তার সাথে তেমন ভাব নেই। তারপরেও খবরটা শুনে পুরোটা বিকেল খুশির মন খারাপ হয়ে রইল। আজকাল মানুষের জীবনের খুব একটা দাম নেই। যেখানে সেখানে মেরে ফেলে রেখে যাচ্ছে। বাইক ওয়ালা গুলো যেন একটু বেশিই বেপরোয়া। রাস্তায় বেরোলে এদের হুঁশ থাকে না। এজন্যই খুশি স্মরণকে বাইক চালাতে নিষেধ করে।

🌼

খুশিকে দেওয়া কথা রাখতে স্মরণ সত্যিই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসেছে। বাড়িতে পা রেখেও ভয়ে ভয়ে হাঁটছে। ভাবছে মাস্টার মশাই বাড়ি নেই তো? না থাকলেই তার জন্য মঙ্গল। সারাদিন পল্টুকে নিয়েই ছুটাছুটি করেছে। এবারের মতো পল্টু টিকে গেছে। স্মরণ নিজেও যা ভয় পেয়েছিল! বারান্দা দিয়ে পা টিপে হেঁটে যাওয়ার সময় খুব সাবধানতা অবলম্বন করল। বাবার ঘরের দরজা দেওয়া থাকলেও ওটুকু জায়গা পেরিয়ে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। কারো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে কেউ নেই নাকি? খুশির ঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কৌতূহল বশে ভেতরে উঁকি মারল। দরজা খোলা ভেতরে আলোও জ্বলছে। এ সময় খুশির পড়ার টেবিলে বসে থাকার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু স্মরণ আজ অন্য কিছুই দেখলো। খুশবু মাটিতে পড়ে আছে। এটা দেখে স্মরণ এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। ছুটে গিয়ে খুশবুর পাশে বসলো। চিন্তিত কন্ঠে ডাকতে লাগল,

-খুশবু! অ্যাই, কী হয়েছে তোর? মাটিতে শুয়ে আছিস কেন?

খুশবুর কপালে হাত দিয়ে স্মরণ বুঝতে পারলো এর তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। মাটিতে শুয়ে আছে না বরং বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। খুশবুর জ্বর এটা শুনেছিল। কিন্তু জ্বর কি এখনও ভালো হয়নি? অসুস্থ মেয়েটাকে একা রেখে বাকিরা কোথায় গিয়ে রাজনীতি করছে কে জানে। স্মরণ খুশবুর মাথা কোলে তুলে নিলো। কপালে হাত রেখে অনুমান করলো কম হলেও ১০৩/৪ ডিগ্রি জ্বর তো হবেই। একে হাসপাতালে নেওয়া উচিত। কিন্তু তার আগে মাথায় পানি ঢেলে হুঁশ ফেরানো দরকার। স্মরণ খুশবুকে পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিল। খুশবুকে একা বাড়িতে রেখে সবাই কোথায় গেছে এটা ভাবার সময় নেই। সে নিজেই কলপাড়ে গিয়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে এলো। খুশবুর মাথা খাটের কিনারায় রেখে চুল গুলো আলগা করে দিলো। লম্বা কালো রেশমি সুতার মতো চুলগুলো মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। স্মরণ বিরক্ত হয়ে বলল,

-সাপের মতো পাঁচ হাত লম্বা চুল রাখতে কে বলেছে তোকে পঁচা গন্ধের বাচ্চা? লম্বা চুল রেখে ঢঙ না করে কেটে ফেললেই তো হয়। খায়রুল সুন্দরীর কেশ কাকে দেখাবি শুনি?

রোগীর মাথায় পানি টানি ঢেলে হুঁশ ফিরিয়ে আনলো। স্মরণ এত সেবাযত্ন করলো এটা কিছু না। খুশবু চোখ খুলেই বলে উঠল,

-স্মরণ ভাই কানে পানি দিচ্ছ কেন?

স্মরণ চোখ পাকিয়ে খুশবুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-নিমকহারাম! কতটা সেবা করেছি এটা দেখছিস না। কানে একটু পানি গেল কি না গেল এটা নিয়ে চেঁচাচ্ছিস!

-একটু গেছে? আমার তো মনে হচ্ছে পুরো বালতির পানিই তুমি আমার কানে ঢেলেছ।

-তুই একটা আস্ত হারামি। বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতি ওটাই ভালো হতো।

-পড়ে থাকতে দিতে। ধরেছো কেন?

-আমার মন তো তোর মতো পাষণ্ডী না।

-আহারে আমার নরম মনের মানুষ!

-তাহলে! আমার মন তুলার চেয়েও নরম। জানিস না তুই?

তর্কে না পেরে খুশবু মুখ ভেঙাল। স্মরণ না দেখার ভান করে জিজ্ঞেস করল,

-সবাই কোথায় গেছে রে?

-কোন সবাই?

স্মরণ খুশবুর মাথায় মেরে বলল,

-তোর মা দাদী আর বোন।

এটা শুনে খুশবু অবাক হয়ে বলল,

-কেউ বাড়িতে নেই!

কাকে কী জিজ্ঞেস করে সে! এই ছাগল তো দুনিয়ার কোন খোঁজ খবরই রাখে না। টেবিলের উপর খাবার ঢেকে রাখা দেখে প্লেট উল্টিয়ে দেখল, এখনও আগের মতোই পড়ে আছে। কেউ হয়তো রেখে গেছে। খুশবু মনে হয় দেখেনি।

-কে খাবার রেখে গেছে? খাসনি কেন?

দুপুরের কথা মনে পড়তে খুশবুর মুখটা ছোট হয়ে গেল। এবাড়িতে তার চিন্তা কারো নেই। সে যাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে সেই বোনেরও না। তার মনে হয় এই পৃথিবীতে সে নিতান্তই অবহেলিত একটা মানুষ। সে থাকলেও যা না থাকলেও তা।

-ভাত পড়ে আছে। ঔষধও নিশ্চয় খাসনি। এজন্যই তো ফিট হয়ে পড়েছিলি। খাসনি কেন ছাগল?

-এমনি।

স্মরণ জানে এই পাগল কতটা অভিমানী। যাদের কাছে এর অভিমানের কোন মূল্যই নেই তাদের উপর অভিমান করে কী লাভ?

-এক লাথি খাবি। এমনি আবার কেমন কথা। এক্ষুনি ভাত খেয়ে ঔষধ খা। ঔষধ আছে ঘরে?

-জানি না।

-চড় মেরে চাপা ত্যাড়া করে ফেলব। আমার সামনে খেতে বোস এক্ষুনি। আমার রাগ উঠলে কী করবো জানিস তো? তাই ভালো হবে আমার রাগ তুলিস না। চুপচাপ খেয়ে ওঠ।

খুশবুর প্রতি স্মরণের আলাদা একটা দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্ব কেউ তার উপর চাপিয়ে দেয়নি। স্মরণ নিজেই এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। খুশবু এমন একটা মেয়ে যে কোনদিন মুখ ফুটে কিছু বলে না। ওর অনুভূতি গুলো বুঝে নিতে হয়। খুশবু কখনও বলবে না আমার এটা লাগবে। সে না বলাতেও জিনিসটা পেলে এত বেশি খুশি হবে, ওর চেহারায় এই খুশিটা দেখার জন্যই স্মরণ নিজে থেকে এতসব করে। এই ছাগলকে খুশি করতে অবশ্য তার বেশিকিছু করতে হয় না। মাঝে মাঝে ছোটখাটো সাজগোজের জিনিস। আর হাত খরচের জন্য পঞ্চাশ ষাট টাকা। এসবের থেকেও এক জিনিসে খুশবু সবথেকে বেশি খুশি হয়। স্মরণের বাইকে চড়ে কলেজ যাওয়া। তবে খুশবু এই সুযোগটা খুব কমই পায়।স্মরণ তাকে বাইকে চড়াতেই চায় না।

🌼

মা দাদীরা ফিরে এসেছে। খুশবু বাইরে ওদের শব্দ পাচ্ছে। পরী বানু বাড়ি এসেই আগে খুশবুকে দেখতে এলেন। দাদীকে দেখে খুশবু জিজ্ঞেস করল,

-তোমরা সবাই কোথায় গিয়েছিলে দাদী?

-পল্টুগো বাড়ি।

-কাকী আবার পল্টুকে মেরেছে? কই পল্টু তো আমার কাছে এলো না।

-সালমা মারে নাই। হোন্ডার ওয়ালা ধাক্কা দিছে।

কথাটা শুনে খুশবু শোয়া থেকে বসে পড়ে বলল,

-পল্টুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে!

-হ।

-এখন কেমন আছে? তোমরা দেখতে গিয়েছিলে আমাকে ডাকোনি কেন? আমিও যেতাম।

-হ যাইবি! ওইঠা খাড়াইতে পারোস না। দেহি জ্বর ছাড়ছে নি।

পরী বানু এগিয়ে এসে খুশবুর কপালে হাত রেখে জ্বর দেখলেন।

-জ্বর দেহি ছাইড়া দিছে। ঔষধ খাইছিলি?

ঔষধ খায়নি। ঘরে ঔষধ নেইও। খুশবু দাদীকে এটা জানালো না সে জ্বরে বেহুশ হয়ে পড়েছিল। স্মরণ ভাই মাথায় পানি ঢেলে জ্বর নামিয়েছে। সে আপাতত পল্টুর কথাটা শুনে চিন্তিত।

চলবে