কমলা রঙের রোদ পর্ব-০৫

0
6

#কমলা_রঙের_রোদ [৫]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

স্বামী মারা যাবার আগে থেকেই মানছুরা শাশুড়ির সাথে ঘুমাতেন। হাবিবের সাথে সেদিন থেকেই কথা বলা বন্ধ করেছেন যেদিন হাবিব খুশবুকে নিয়ে বাড়ি এসেছিল। স্বামীর দেওয়া ধোঁকা মানছুরা সহ্য করতে পারেননি। তাই এক বাড়িতে থাকার পরেও মানছুরা হাবিবের সাথে অচেনা মানুষের মতোই আচরণ করেছে। মানছুরার প্রতি তার অন্যায় অবিচার, নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাবিব ক্ষমা চাইলেও মানছুরা ক্ষমা করেনি। যেখানে মানছুরা স্বামীকেই ক্ষমা করেনি, স্বামীর মেয়েকে মেনে নেওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না। খুশবু মানছুরাকে মা ডাকলেও মানছুরা কোনদিন খুশবুকে মেয়ে বলে মনে করেনি। বকুলের মৃত্যুর পর থেকেই এই বাড়ির সবকিছু পাল্টে গেছে। হাসান জীবন সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে তার মানসিক অবস্থারও কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে। মাঝে মাঝে সে স্বাভাবিক থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই যেন নিজের কল্পনায় অন্য কোন জগতে বসবাস করেন। মানছুরা সহ আরও অনেকেই লক্ষ্য করেছে হাসান একা থাকলে কারো সাথে কথা বলে। খুব স্বাভাবিক কথাবার্তা। না দেখে আড়াল থেকে শুধু শুনলে মনে হবে দু’জন মানুষ হয়তো একে অপরের সাথে কথা বলছে। ছেলের উপর থেকেও তার সব ধ্যান উঠে গেছে। মা’কে ছাড়া যে স্মরণের শৈশব ভালো কেটেছে এমনটাও বলা যায় না। মানছুরা স্মরণকে হৃদয়ের সবটা ঢেলে ভালোবাসা দিলেও সেই শাসনটুকু কোনদিন করতে পারেনি যা করার প্রয়োজন ছিল। এই বাড়িটা একটা শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই দ্বিতীয় ঘটনাটা ঘটে। বকুলের মৃত্যুর তিন বছরের মাথায় হাবিব রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। তারপর থেকেই এই পরিবার একপ্রকার ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। মানছুরা শুতে এলে পরী বানু বললেন,

-মাইয়াডার জ্বর একটু কমছে। কিন্তু রাইতে আবার আইবার পারে। ডাক্তার দেখানির দরকার আছিল না বউ?

মানছুরা পাশ ফিরে শুতে শুতে বললেন,

-দরকার থাকলে দেখাবেন।

পরী বানু জানেন, মানছুরা কোনদিনও খুশবুর কোন ব্যাপারে কথা বলে না। এই যে মেয়েটা একটা সপ্তাহ ধরে জ্বরে ভুগছে মানছুরা একবার ওই ঘরে উঁকি দিয়েও দেখেনি। এমনকি এটাও জানতে চায়নি মেয়েটা এখন কেমন আছে। পরী বানু মনে মনে ভাবলেন,

-মাইয়া মানুষের দিল এত শক্ত হইবার পারে! ওই বয়সী নিজেরও তো একটা মাইয়া আছে। খুশবুডা মা মা কইরা জান দেয়। কিন্তু বউয়ের বুকের ভিত্রে তো দিলই নাই।

দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে খুশির ঘুম ভেঙে গেল। ওর ঘুম বরাবরই পাতলা। সামান্য আওয়াজে জেগে যায়। সেদিক দিয়ে খুশবুকে কুম্ভকর্ণের সাথে তুলনা দেওয়া যায়। কিন্তু আজ মনে হয় অসুস্থ থাকায় জেগেই ছিল। তারপরও নিজে না উঠে খুশিকে বলল,

-দরজাটা খোল না।

খুশি রাগ হয়ে বলল,

-তুই খুলতে পারিস না?

খুশবু কাঁথা টেনে নাকমুখ ঢেকে দিয়ে বলল,

-তাহলে থাক। যে এসেছে এমনিই ফিরে যাবে।

খুশি রেগেমেগে কতক্ষণ খুশবুর দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খোলার জন্য উঠে গেল। দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে স্মরণ বলল,

-গন্ডারের কান তোদের? এক ঘন্টা ধরে ডাকছি কারো কানে যাচ্ছে না?

-কেন ডাকছো? এত রাতে কী দরকার পড়েছে?

-এত রাত? তোদের মতো পাবলিকের জন্য আমার মতো কিছু মানুষের জীবনের শান্তি কমে যাচ্ছে। রাত দশটাকে বারোটা বানিয়ে ফেলিস। আর সকাল সাতটাকে এগারোটা।

খুশি হতাশ গলায় বলল,

-তুমি কি এসব কথা বলার জন্য আমার ঘুম ভাঙিয়েছ?

ঘরের ভেতর অন্ধকার থাকায় স্মরণ খুশির মাথার উপর দিয়ে উঁকি দিয়েও কিছুই দেখতে পেলো না।

-পঁচা গন্ধের বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়েছে?

-জেগে আছে। কিছু বলবে?

স্মরণ পকেট থেকে ঔষধের প্যাকেটটা বের করে খুশির দিকে দিয়ে বলল,

-রোগীর বাচ্চা সন্ধ্যায় বেহুশ হয়ে পড়েছিল। এটাতে ঔষধ আছে। খাইয়ে দিস।

খুশবু অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল? কখন? খুশি যতই দেখাক খুশবুর জন্য তার কোন টান নেই। কিন্তু মনে মনে ঠিকই খুশবুর জন্য ভাবে। দুপুরে সে ভালো করে বললেই খুশবু ভাত খেতো। সে বলেনি বলেই খায়নি। অজ্ঞান তো হবেই। খুশি স্মরণের হাত থেকে ঔষধের প্যাকেট নেওয়ার সময় স্মরণ বলল,

-জীবনে বিল্ডিং গিরি দেখানোর সাথে সাথে বোনেরও একটু খেয়াল রাখিস। একটাই তো বোন।

-তোমরাও একটাই তো বোন। তুমি নিজে কেন খেয়াল রাখো না?

-খেয়াল রাখি না? খেয়াল না রাখলে ঔষধ… এই দাঁড়া। কী বললি তুই? একটাই বোন মানে? তার মানে তুই নিজেকে আমার বোন মানিস না, তাই তো!

খুশি দড়াম করে স্মরণের মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিল। এর বেশি আর কিছু শুনতে চায় না সে। বাইরে স্মরণ আনন্দিত গলায় আরও অনেককিছু বলে যাচ্ছে। ভেতরে খুশি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খুশবু কাঁথার নিচ থেকে কচ্ছপের মতো মাথা বের করে বিড়বিড় করে বলল,

-এদের ট্রেন এই স্টেশন থেকে কবে ছাড়বে? আর কত বছর এক স্টেশনে আটকে থাকবে? কেউ তো নিজের দিক থেকে এক পা বাড়াও। আমার যদি জীবনে কোন ছেলেকে পছন্দ হয়। তাহলে আমি এদের মতো নাটক করবো না। শাহরুখের স্টাইলে হাঁটু গেড়ে বসে ফুল দিয়ে সোজা মনের কথা বলে ফেলবো। ছেলে আমাকে রিজেক্ট করলেও এটা তো সান্ত্বনা দিতে পারব, বাড়ে বাড়ে শেহেরমে
এইসি ছোটি ছোটি বাতে হোতে রেহেতেহে।
কিন্তু রিজেক্ট হওয়ার ভয়ে এদের মতো সামনেই আগাবো না এমন গাধা আমি না।

🌼

খুশবু এখনও পুরোপুরি সুস্থ না হলেও জ্বর অনেকটাই সেরেছে। কাল রাত থেকে আজ জ্বর আসেনিই বলা যায়। কিন্তু শরীর যথেষ্ট দূর্বল হয়ে পড়েছে। সাথে মাথা ঘুরানো তো আছেই। তাই ইচ্ছে থাকলেও আজ কলেজে যাওয়ার মতো উপায় তার ছিল না। আর কয়টা দিন এভাবেই ঘরে শুয়ে পচতে হবে।
খুশি কলেজে এসেছে। বয়সে খুশবু ওর এক বছরের ছোট। তাই পড়াশোনাতেও এক ক্লাস নিচে। ক্লাসে যাওয়ার সময় কোত্থেকে খুশবুর বন্ধুরা এসে ঝেঁকে ধরল। মাহিয়া মেয়েটাকে খুশি চেনে। খুশি অল্পস্বল্প খুশবুর সব বন্ধুদেরকেই চিনে। খুশবুই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। মাহিয়া বলল,

-আপু ভালো আছেন?

খুশি ছোট্ট করে হুম বলে কাটিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু এরা তাকে এত সহজে ছাড়লে তো।

-আজও খুশবু আসেনি! ও বাড়িতে কী করে আপু?

-খুশবু অসুস্থ। তাই কিছুদিন আসবে না।

মাহিয়া চিন্তিত মুখে বলল,

-কী হয়েছে ওর?

-জ্বর।

-জ্বর কি অনেক বেশি? এজন্য এতদিন আসছে না? আমরা তো জানতামই না। ও এখন কেমন আছে আপু?

-মাহিয়া আমার একটা ক্লাস আছে। লেট হয়ে যাচ্ছে। পরে তোমাদের সাথে কথা বলি।

-হ্যাঁ, হ্যাঁ আপু আপনি যান।

খুশি চলে গেলে মাহিয়া মুখ বাঁকাল। ভেঙিয়ে বলল,

-ভাব দেখলে মরে যেতে ইচ্ছে করে। এত কিসের ভাব? কথাই বলতে চায় না।

তবে তার কাজ হয়ে গেছে। যতটুকু জানার ছিল জেনে নিয়েছে। মাহিয়া একজনের খুঁজে পুরো ক্যাম্পাস চষে বেড়াল। তবুও সেই মানুষটার পাত্তা নেই।
শেষে ক্লান্ত হয়ে ক্যান্টিনে চলে এলো।

-যার মাথা ব্যথা সে-ই আসবে। আমি এত খুঁজতে পারবো না।

মাহিয়া তার অর্ডারকৃত কোল্ড কফিতে চুমুক দেওয়ার আগেই সান কোথাথেকে উদয় হয়ে সেটা ছিনিয়ে নিলো। সামনের চেয়ারে বসে পড়ে নিজে কফিটা খেতে খেতে প্রশ্ন করল,

-তোর বান্ধবী কলেজে আসছে না কেন?

কফি নিয়ে খেয়ে ফেলায় মাহিয়া কতক্ষণ রেগে তাকিয়ে রইল। কিন্তু তার রাগের পরোয়া কি খালার ছেলে করে? মাহিয়া উত্তর দিতে দেরি করছে দেখে সান বলল,

-কী হলো? একটা সহজ কাজ দিয়েছিলাম। সেটাও পারিসনি?

-কে বলেছে পারিনি?

-তাহলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছিস কেন? কুইকলি আন্সার দে।

-তোমার নায়িকা জ্বরে ভুগছে। সেজন্যই কয়েকদিন ধরে দেখা মিলছে না।

সান কফি রেখে পিঠ সোজা করে বসে গম্ভীর মুখ করে বলল,

-জ্বরের কত সাহস দেখেছিস!

ভাইয়ের এরকম আচরণে মাহিয়া হেসে ফেলল। সান তার থেকে অনেক বড়। নামি-দামি একটা প্রতিষ্ঠানে এমবিএ করছে। তাদের কলেজে সানের কোন কাজ নেই। তবুও নিয়মিত একবার হলেও আসতে হয়। এর পেছনের কারণ অবশ্য একটা আছে। মাস কয়েক আগে সান তাকে কলেজ থেকে নিতে এসেছিল। সেদিনই প্রথমবার খুশবুকে দেখে বেচারা এমন পিছলানো পিছলেছে কোমর নিয়ে এখনও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। বান্ধবীর ভাই হিসেবে সানের সাথে এক দু’বার খুশবুর কথা হয়েছে। সেটাও আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, কেমন আছেন টাইপ। খুশবু গাধীটা কি তার ভাইয়ের চোখের দিকে তাকায় না? এই চোখে ওর জন্য কত মুগ্ধতা লুকিয়ে আছে তা কেন দেখতে পায় না? সান ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-তোর বান্ধবীর বাড়ি কোথায় জানিস?

-জানবো না কেন?

-তাহলে এড্রেস হোয়াটসঅ্যাপ করে দিস।

মাহিয়া বিস্মিত কন্ঠে বলল,

-তুমি কি খুশবুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবছো!

সান পেছন না তাকিয়ে যেতে যেতে জবাব দিল,

-তোদের নিয়ে বিয়ের কথা পাকা করার দিনই ওই বাড়িতে যাবো। টেনশন করিস না।

-তখন যেও। কিন্তু ভুলেও এখন ও পাড়ায় যেও না। ওর গুণ্ডা ভাই বোনদের ত্রিসীমানায় কোন ছেলের ছায়াটাও পড়তে দেয় না। তুমিও তো কম ঘাড়ত্যাড়া না। শুধু শুধু ঝামেলা হবে।

সান মাহিয়ার কথাগুলো শুনেছে কি-না বলা গেল না। তবে মাহিয়া চায় না কোন কিছুর চক্করে তাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হোক। খুশবু তো এখনও এটাই জানে না তার ভাই যে ওকে পছন্দ করে।

চলবে