কমলা রঙের রোদ পর্ব-১৮+১৯

0
5

#কমলা_রঙের_রোদ [১৮]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশিকে একটু আগেই তুলে নিয়ে গেছে। মা চায়নি বলে খুশবু বিয়ের পুরোটা সময় ঘরে বন্দী হয়ে ছিল। বাইরে বেরোয়নি। বাইরে হৈচৈ পড়ে গেলে জানালার ফাঁক গলিয়ে দেখতে পেলো খুশি বরের গাড়িতে উঠে পড়েছে। বর পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে বলে খুশবু শত চেষ্টা করেও বরের মুখটা দেখতে পেলো না। গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে খুশবু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। মেয়েকে বিদায় দিতে মানছুরার চোখ অশ্রুসিক্ত। তাই হয়তো খুশবুকে চোখের সামনে দেখেও কিছু বলেনি। বাকিরা খুশবুকে দেখে নানান প্রশ্ন করছে। এতক্ষণ কোথায় ছিল? বোনের বিয়েতে সামনে আসেনি কেন? খুশবু কাউকে বুঝতে না দিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,

-আমি তোমাদের সামনেই ছিলাম। তোমরা লক্ষ্য করোনি এটা কি আমার দোষ?

এক এক করে সবাই চলে গেলে বাড়িটা পুরো ফাঁকা হয়ে গেল। একটু আগেই কত হাসি আনন্দ শোরগোল ছিল। দাদী উঠানে বসে কাঁদতে থাকলে খুশবু এসে দাদীর পাশে বসলো। দাদীর কাঁধে মাথা রেখে বলল,

-কেন কাঁদছো বুড়ি? নাতনির বিয়ে দেওয়ার জন্য তো পাগল হয়ে গিয়েছিলে। এখন তাহলে কেন চোখের পানি ফেলছো?

-খুশি চইলা গেছে বাড়িডা খালি খালি লাগতাছে।

পুরোটা বিকেল মানছুরা ঘরে বসে থাকল। জানালা দিয়ে বিকেলের মরে আসা আলোর দিকে তাকিয়ে নিজের বিয়ের দিনের কথা মনে পড়তে লাগল। সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই চাওয়া, তার মেয়ের কপাল যেন তার মতো না হয়। বাপের ভালোবাসা কপালে লেখা ছিল না। অন্তত স্বামীর ভালোবাসা যেন পায়। সন্ধ্যার আগে আগে ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে হাত লাগালো। বিয়ে বাড়ির কাজের শেষ নেই। খাবার যা বেচেছে রাতে সকলের খাওয়া হয়ে যাবে। বড়ো বড়ো হাঁড়ি পাতিল গুলো কলপাড়ে এনে জমা করে রাখছে। কিছু নিজেদের কিছু প্রতিবেশীদের থেকে এনেছিল। ওগুলো মেজে রাতেই ফেরত দিয়ে আসতে হবে। এমনিতে খুশবুও বাড়ির কাজ করে। কিন্তু আজ অলস ভঙ্গিতে বসে রইল। তার কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। রাতে খুশবুকে খেতে ডাকলে খুশবু খেতেও গেল না। অন্ধকারে অনেকটা সময় বসে থাকার পর ঘরে চলে এলো। এই ঘরটায় তারা থাকতো। দুই জানালা বরাবর দুটো খাট পাতা। আজ এই ঘরটা পুরোটা তার। এখন থেকে সে একাই থাকবে। খুশবু নিজের খাটে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কতক্ষণ ওপাশ ফিরে শুয়ে থেকে হঠাৎ এপাশ ঘুরে খুশির ফাঁকা খাটের দিকে নজর পড়লে খুশবুর কী হলো সে নিজেও জানে না। জলোচ্ছ্বাসের মতো বুকের ভেতর থেকে বাঁধ ভাঙা কান্না বেরিয়ে এলো। খুশবু হু হু শব্দে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কান্নার শব্দ বাইরে যাবে ভেবে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজল। চুল ছড়ানো পিঠটা শুধু ফোলে ফোলে উঠছে। খুশবু যতই চেষ্টা করুক তার কান্না কারো কানে না পৌঁছাক। পাশের রুমে বসে কিন্তু মানছুরা, পরী বানু ঠিকই শুনতে পারছে। মানছুরার মাঝে অবশ্য কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। পরী বানু আর ঘরে থাকতে পারলেন না। খুশবুর কাছে এসে ওকে শান্ত করার চেষ্টায় পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে চলল,

-খুশবু বইনরে, কেন কানতাছোস?

কান্নার তোড়ে খুশবু কথা বলতে পারছে না। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। দাদীর দিকে না তাকিয়েই ফোঁপাতে ফোপাঁতে খুশবু বলার চেষ্টা করল,

-আমি কাঁদতে চাই না দাদী। তবুও কেন কান্না থামাতে পারছি না! কেন এত কষ্ট হচ্ছে দাদী? কেন খুশির কথা মনে পড়ছে?

-মনে তো পড়বোই রে নাতি। ছোট থেইকা এক লগে থাকছস। দুই শালিকের জোড়া আছিলি। একজন চইলা গেলে খারাপ লাগবো না?

-আমার স্মরণ ভাইয়ের জন্যও কষ্ট হচ্ছে। স্মরণ ভাই এখন কোথায়?

-খুশবু! এই খুশবু! কী হয়েছে তোর? এই খুশবু উঠ।

খুশবু ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলে খুশি ওকে গা ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগল। খারাপ কোন স্বপ্ন দেখে এমনভাবে কাঁদছে!

-খুশবু চোখ খোল। স্বপ্ন দেখছিস তুই। ভয় পাস না।

খুশির ধাক্কায় খুশবুর ঘুম ভেঙে গেল। খুশবু চোখের সামনে খুশিকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে ওকে জড়িয়ে ধরল। খুশি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল।

-তুই চলে যাসনি? তোর বিয়ে হয়নি?

কান্নার কারণে একটা কথাও বোঝা গেল না। খুশি খুশবুকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

-কী বলছিস বুঝতে পারছি না। কান্নাটা একটু থাকা। তারপর বল কী হয়েছে?

খুশবু খুশিকে ছেড়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমি দেখেছি তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই বরের সাথে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছিস।

এটা বলে খুশবু খুশিকে আবার জড়িয়ে ধরল। খুশি হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। তার বিয়ের স্বপ্ন দেখে এই মেয়ে এমনভাবে কাঁদছে! কাল সত্যি সত্যিই তার বিয়ে হয়ে গেলে কী করবে তাহলে?

-আমার বিয়ের স্বপ্ন দেখে তুই এভাবে কাঁদছিলি?

-কাঁদব না? তুই স্মরণ ভাইকে কষ্ট দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমি জীবনেও তোর সাথে কথা বলবো না। তোর মুখও দেখবো না।

-তুই আমার জন্য কাঁদছিলি না! তোর স্মরণ ভাইয়ের কষ্টের কথা ভেবে কাঁদছিলি! ছাড় আমাকে।

-তুই একটা পাষণ্ডী। তোর জন্য কেন কাঁদব আমি?

-তুই কি সত্যিই আমার বোন!

-তুই আমাকে বোন মানিস?

খুশি কিছু বলল না। ‘ তুই আমার বোন না’ মুখে সে খুশবু এই কথা বহুবার বলেছে। কিন্তু মনে মনে সে কী অনুভব করে এটা কি খুশবু জানে?

-এই বিয়েটা তুই করিস না খুশি।

-রাত পোহালে কাল বিয়ে এখন এসব বলে লাভ নেই।

-তুই কি মানুষ? আমার তো তোকে মানুষই মনে হয় না। তোর কষ্ট হয় না?

-ঘুমা খুশবু।

খুশবু রেগেমেগে বলল,

-তুই ঘুমা। এমন ঘুম ঘুমা কাল আর উঠিসই না।

খুশবু খুশির উপর রাগ করে ওপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। খুশির চোখ বেয়ে টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। স্মরণ দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। কোথায় আছে, কী করছে খুশি জানে না।

🌸

কাল রাতে সানের বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। মিসেস সুলতানা তখনও ছেলের জন্য অপেক্ষায় বসে ছিলেন। সান কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করলেও কোন জবাব দিলো না। মায়ের প্রশ্ন উপেক্ষা করে রুমে চলে এলো। খুশবুকে একনজর দেখার জন্য যাচ্ছিল সে। পথেই খবরটা পেলো। যদিও তার জন্মদাতা পিতা অনেক আগেই তাদের ত্যাগ করেছে। কিন্তু মানুষটা পৃথিবীতে আর নেই শুনে সান নিজেকে আটকে রাখতে পারল না। আজ তার হলুদ এই কথা ভুলে ছুটে গেল। শেষ সময় মানুষটা অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। সান আর্থিক ভাবে সাহায্য করতে চাইলেও উনি নিতে মানা করেন। হয়তো নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারছিলেন না। তারপরও সান পরিচয় গোপন রেখেই সহযোগিতা করেছে। মানুষটা আর নেই। তার জীবনের সবথেকে খুশির সংবাদটাও শুনে যেতে পারল না।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি। সকালেও সানের মুড অফ দেখে মিসেস সুলতানা চিন্তিত হচ্ছেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। তার পরে কী এমন হলো যে সান নিজের বিয়ের দিনও আনন্দ না করে মনমরা হয়ে ঘুরছে।

-কী হয়েছে তোর? নিজের বিয়ের দিনও কোন জিনিসটা তোকে ডিস্টার্ব করছে?

-কিছু হয়নি মা। তুমি আমাকে নিয়ে ভেবো না।

🌸

খুশবু রাতেই ভেবে ফেলেছিল খুশি স্মরণ ভাই চুপ থাকলেও তাকেই কিছু করতে হবে। এরা সেচ্ছায় আগুনে ঝাপ দিতে চাচ্ছে। খুশবুকেই এখন যে করে হোক এদের থামাতে হবে। তাকে কী কী করতে হবে রাতেই প্ল্যান বানিয়ে ফেলেছে। অন্য কাউকে বলে কোন লাভ হবে না। তীর সঠিক নিশানায় ফেলতে পারলে যদি কাজ হয়। খুশির বরকে সে এখনও দেখেনি। তবে ব্যাটার ফোন নাম্বার জোগাড় করে ফেলেছে। এখন শুধু একটা মোবাইল প্রয়োজন। পল্টুকে বলে এই কাজও সহজ হয়ে গেল। পল্টু তার মা’র মোবাইল ফোন এনে দিয়েছে।

-খুশবু আপু, এই নাও। তুমি কথা বলো। আমি পাহারা দিচ্ছি।

খুশবু ফোন হাতে নিয়ে চোখ বাঁকিয়ে বলল,

-জীবনের প্রথম তোর মুখ দিয়ে আপু ডাক বেরুলো। কার মোবাইল চুরি করে এনেছিস?

-আমার মা’র। নিজের বাড়িতে চুরি হয় না।

খুশবু সময় নষ্ট না করে দ্রুত হাতে কাগজে লেখা নাম্বারটা তুলে ফেলল। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। কী কারণে হাত পা-ও যেন কাঁপছে। কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও কেউ কল রিসিভ করছে না। খুশবু অধৈর্য হয়ে বলল,

-রিসিভ করছে না তো।

-তুমি চেষ্টা চালিয়ে যাও।

পাঁচ বারের মাথায় সান কল তুললো। ওপাশ থেকে হ্যালো শব্দটা শোনার আগেই খুশবু বলে উঠল,

-আমি আজেবাজে কোন কাজে কল করে আপনার সময় নষ্ট করছি না। যদিও আমি আপনাকে আমার পরিচয় দিতে পারব না। কিন্তু এটা দু’জন মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন। এমনকি আপনার জীবনের সুখ দুঃখ এই একটা সিদ্ধান্তের উপরই অনেকটা নির্ভর করছে।

কে কথা বলছে? কী কথা বলছে? সান কিছুই বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেস করল,

-আপনি কে বলছেন বলুন তো?

-বলেছি তো আপনাকে আমি আমার পরিচয় দিতে পারব না। পরিচয় না জেনেও আপনি প্লিজ আমার এই অনুরোধটা রাখুন। এই বিয়েটা আপনি করবেন না। জেনেশুনে দু’জন মানুষের জীবন নষ্ট করবেন না।

কেউ তাকে বিয়েটা না করতে বলছে! কিন্তু কেন?

-দেখুন আপনি যদি আমাকে এমনভাবে ধোয়াশার মধ্যে রাখেন তাহলে আমি আপনার কথা কেন শুনবো? আপনাকে বিশ্বাস করার আমার কোন কারণ আছে কি?

-জানি আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস না করলে ক্ষতি আপনারই বেশি হবে।

-যেমন?

-আপনি যদি জানতে পারেন যাকে আপনি বিয়ে করছেন সে আপনাকে না অন্য একজনকে ভালোবাসে তখনও কি আপনি তাকে বিয়ে করতে চাইবেন?

-আমি যাকে বিয়ে করতে চাচ্ছি সে আমাকে ভালো না বাসলেও অন্য কাউকেও যে বাসে এটা জেনেই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছি।

লোকটার উপর খুশবুর রাগের শেষ রইল না। কী পরিমাণের বিটকেল একটা লোক!

-আপনি ভুল জেনেছেন। খুশি স্মরণ ভাইকে ভালোবাসে এটা আমাদের পাড়ার কুকুর বিড়ালও জানে।

খুশি! স্মরণ! এরা কারা? কেউ কি তার সাথে মজা করছে? সান কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,

-আচ্ছা আমি বিয়েটা করবো না। তবে আপনি যদি আমাকে আপনার নাম বলেন।

খুশবু বড়ো বড়ো করে কয়েকবার দম নিয়ে মেজাজ ঠান্ডা করল। এই রিস্কটুকু নিতেই হবে। নাহলে খুশির বিয়ে আটকাতে পারবে না।

-আগে আপনি কথা দিন আমার কথা কাউকে বলবেন না।

-ঠিক আছে বলবো না।

খুশবু পল্টুর দিকে তাকাল। পল্টু হাত ইশারা করে ফিসফিস করে বলছে,

-নাম বলে দাও।

খুশবু ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলে ফেলল,

-আমার নাম খুশবু। আপনি যাকে বিয়ে করবেন সে আমার বড় বোন।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [১৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

যাকে ভালোবাসে, যাকে নিজের করে পাওয়া নিয়ে হাজারো স্বপ্ন বুনে ফেলেছে আজ কি না বিয়ের দিন সকালে তার মুখ থেকেই শুনছে ‘আপনি আমার বোনকে বিয়ে করবেন না।’
বোনকে বিয়ে কে করতে চায়। সান বিস্ময়ের চোটে বলতেও পারল না,

-বিয়ে তো আমি তোমাকে করতে চাই। মাঝখানে তোমার বোন কোত্থেকে আসলো?

লোকটা কি বোবা হয়ে গেছে? উত্তরে কিছু তো বলবে। ওপাশে লোকটা কী বলছে জানার জন্য পল্টু অস্থির হয়ে উঠেছে।

-ও খুশবু, কী বলছে বেটা?

-আরে কিছুই তো বলছে না। হ্যালো, আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো!

তার এই সাতাশ /আটাশ বছরের দীর্ঘ জীবনে এত বড় ধাক্কা সান কোনদিনও খায়নি। তার সাথে হচ্ছে কী এসব? মা কার সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে? সে তো মাকে খুশবুর কথা বলেছে। সান কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

-তুমি কি সত্যিই খুশবু বলছো?

আপনি থেকে সোজা তুমি! লোকটা তো ভীষণ অসভ্য। খুশবু মনে মনে বলল, ত্যাঁদড় লোক।

-আমি সত্যি খুশবু নাকি মিথ্যা খুশবু তা দিয়ে তো আপনার কাজ নেই। আপনাকে শেষ বার একটা কথা বলে রাখছি, আপনি আমার বোনকে বিয়ে করতে আসবেন না।

খুশবু এখনও জানে না সে কার সাথে কথা বলছে। সান খুশবুকে বলে দিতে গিয়েও বলল না।

-তুমি কেন চাও না আমি তোমার বোনকে বিয়ে করি?

-কারণ আমার বোন অন্য একজনকে ভালোবাসে।

-আর তুমি? তুমি কাউকে ভালোবাসো না?

-আপনি তো আচ্ছা ত্যাঁদড় লোক। আমাকে এসব প্রশ্ন করার সাহস কী করে হয় আপনার? এতক্ষণ তো অনুরোধ করছিলাম। এবার ধরে নিন হুমকি দিচ্ছি। আপনি শুধু আজ বিয়ে করতে আসুন। আমাদের পাড়ায় আপনার পা পড়ার আগে হাঁটুর নিচ থেকে আপনার পা ভেঙে ফেলব।

খুশবু রেগেমেগে কল কেটে দিল। পল্টু অসহায় মুখে ঠোঁট কামড়ে বলল,

-এটা কি আমাদের গরম হবার সময়? এখন আমাদের নরম হয়ে বিষয়টা সামলাতে হবে। নাহলেই খুশি আপুর বিয়ে হয়ে যাবে।

খুশবু রাগী চোখে পল্টুর দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করতে করতে বলল,

-এত জ্ঞান দিস না তো। শালা একটা ত্যাঁদড়। খুশির রুচিই খারাপ।

সান ফোন হাতে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে মা’র ঘরের দিকে ছুটলো। একটু পর বিয়ে করতে যাবে এখন শুনছে বউ খুশবু না। মিসেস সুলতানা ছেলের উপর কিছুটা রেগে ছিলেন। কারণ কাল সান কোথায় গিয়েছিল এটা বলেনি। সান দরজার সামনে থেকেই বলল,

-মা কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ তুমি?

এরকম একটা প্রশ্ন মিসেস সুলতানা আশা করেননি। তিনি সাথে সাথে কোন উত্তর দিতে পারল না।

-আমি তোমাকে কার কথা বলেছি আর তুমি কার সাথে বিয়ে ঠিক করে চলে এসেছ!

-পাগলের মতো এসব কোন ধরনের কথা বলছিস।

-আমি কিন্তু সত্যিই পাগল হয়ে যাব মা।

ছেলের পাগলামি কথাবার্তা মিসেস সুলতানা কিছুই বুঝতে পারছেন না। তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন,

-কিছু খেয়ে এসেছিস নাকি? মাথা ঠিক আছে তোর?

-আমি তোমাকে খুশবুর কথা বলেছি। তুমি খুশবুর বড়ো বোন খুশির সাথে বিয়ে ঠিক করেছ। এই বিয়ে আমি করতে পারব না মা। আমি খুশবুকে ভালোবাসি। ওর বোনকে না।

মিসেস সুলতানার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই ছেলে বলে কী এসব! বিয়ের দিন সকালে বিয়ে ভেঙে দিলে সমাজে মেয়েটার কত বদনাম হবে! তিনি নিজেও কোনদিন কথার বরখেলাপ করেননি।

-বিয়ের দিন সকালে এসে তুই বলছিস বিয়েটা আমি ভেঙে দেব!

-হ্যাঁ দেবে। কারণ ভুল তোমার হয়েছে।

-সঠিক ভুল বিচার করার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। একটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার তোর আমার কারো নেই।

-তুমি শুধু ওই মেয়েটার কথাই ভাবছো! নিজের ছেলের কথা একবারও ভাববে না?
যাকে আমি ভালোবাসি না তাকে বিয়ে কেন করবো?

মিসেস সুলতানা চোখের সামনে অন্ধকার দেখছেন। সান মাকে এটাই বুঝিয়ে উঠতে পারছে না, শুধু সমাজ কী বলবে এটা ভেবে বিয়ে করে নিলেও কি সে ওই মেয়েটাকে ভালো রাখতে পারবে?

-পাগলামি করিস না সান। মেয়েটার পরিবারের কথা একবার ভেবে দেখ।

-আমি আগে আমার জীবন নিয়ে ভাববো মা। আমি নিজে ভালো না থাকলে অন্যকে নিয়ে ভেবে আমার লাভ কী? আর তাছাড়া ওই মেয়েকে নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে না। আমি বিয়ে না করলেও তার বিয়ে হয়ে যাবে।

🌸

খুশবু ভেবেছিল পাত্রের সাথে কথা বললে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। বেডার হবু বউ অন্য একজনকে ভালোবাসে শুনে হয়তো বিয়েটা ভেঙে দিবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। পাত্র উল্টো কী আবোলতাবোল বলল খুশবুর মাথায় কিছুই ঢুকলো। শালা একটা মহা আবাল। খুশবু হতাশ হয়ে ফিরে এলো। শেষবার একটা চেষ্টা করতে এসেছে। পাত্রকে বুঝিয়ে লাভ হয়নি। খুশিকে যদি বোঝানো যায়। সেই আশায় খুশির কাছে এসেছে।

-তুই কেন বিয়েটা করছিস খুশি?

-কারণ মা এটাই চায়।

-মানছি তুই মা’র বাধ্য মেয়ে। কিন্তু স্মরণ ভাইয়ের কথা একবার ভাববি না?

-খুশবু প্লিজ এব্যাপারে আমাকে আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিস না।

-কেন করবো না? তোকে ভালোবেসে কি স্মরণ ভাই অপরাধ করেছে?

-তোর স্মরণ ভাই কি একাই ভালোবেসেছে? আমি বাসিনি?

খুশবু অধৈর্য হয়ে উঠে বলল,

-বেসেছিস তাহলে অন্য একজনকে বিয়ে কেন করছিস?

খুশি হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে বলল,

-তুই বুঝবি না খুশবু। আমার ভেতরের অবস্থা তুই কেন কেউই বুঝবে না। আমার মা-ই আমাকে বুঝেনি। অন্য কেউ কী বুঝবে? মা মনে করে স্মরণকে বিয়ে করলে আমি ভালো থাকবো না। আমাকে স্মরণের থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে মা আমার ভালো চায়। এই ভালো চাওয়া শেষ অব্দি কতটা আমায় ভালো রাখবে আমি নিজেও জানি না।

-স্মরণ ভাই-ই তোকে সবথেকে বেশি ভালো রাখতে পারবে।

খুশি কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলতে শুরু করেছে। খুশবু নিজেও ভেজা চোখে বোনকে জড়িয়ে ধরল। মানছুরা দরজার সামনে থেকে সরে এলো। তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে যেন। নিজের ঘর পর্যন্ত কোনরকমে যেতে পারল। মেয়ের সুখ চাইতে গিয়ে কি ওকে দুঃখের সাগরে ফেলে দিচ্ছে? মানছুরার ভয় হয়। তার সাথে যা হয়েছে কিছুতেই তা যেন তার মেয়ের সাথে না হয়। মানছুরাকে খুঁজতে খুঁজতে পরী বানু এঘরে চলে এলেন। পরী বানু চাননি এবিয়ে হোক। তারপরেও হচ্ছে। এজন্যই তার রাগ বেশি।

-কামকাজ ফালাইয়া ঘরে আইয়া বইয়া রইছো কেন? এতদিক কেডা সামলাইবো? আমি কিছু দেখতে পারমু না মা। তোমার মাইয়ার বিয়া তুমিই দেখো সব।

পরী বানু গজগজ করে এসেছেন। কথাগুলো বলে আবার চলে যাওয়া ধরলেন। মানছুরা অলস গলায় বললেন,

-আমি কি কোন ভুল করতে যাচ্ছি আম্মা?

মানছুরার কন্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল পরী বানু মুহূর্তে ঠান্ডা হয়ে গেল। মানছুরার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-সত্য কথা হুনবার চাও?

মানছুরা আগের মতোই শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পরী বানু কিছুটা নরম হলেন।

-তুমি ভুলই করতাছো। তুমি খালি পয়সার এক পিঠ দেখতাছো। আরেক পিঠটাও তো দেখা উচিত। হাবিব আমার ছেলে হইলে হাসানও তো আমার ছেলে। হাবিব যা করছে তুমি খালি এইটাই মনে রাখছো। হাসানরে কেন দেখো না? বড় বউ মরছে কম দিন হইছে? হাসান অহনও তারে ভুলতে পারে নাই। ভুলতে পারে নাই দেইখাই আমার পোলা আজ আধা পাগল। একলা একলা বড়ো বউয়ের লগে কথা কয়। স্মরণ ওর বাপের মতো না হইয়া চাচার মতো হইবো এই কথা কেন ভাবো? আমার শিক্ষা খারাপ আছিল। হের লাইগা আমার এক সন্তান ভুল রাস্তায় গেছে। তুমি কেন হাসান, বড়ো বউ, তোমার শিক্ষায় সন্দেহ করতাছো? স্মরণরে তো তুমি নিজের হাতে মানুষ করছো। ওর উপ্রে এইটুকুন ভরসা করতে পারলা না? যারে ছেলের মতো ভালোবাইসা লালন-পালন করছো তারেই এতবড় দুঃখ কেমনে দিবার পারবা বউ?

পরী বানু চলে গেলেও মানছুরা থম মেরে বসে রইল। বাহিরের হৈচৈ এখন আর তার কাছে আসছে না। একটু পরেই বরযাত্রী চলে আসবে। মায়ের কথা রাখতে খুশি হয়তো কবুলটাও বলে ফেলবে। কিন্তু যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে-ও যে তার মেয়েকে ভালো রাখতে এই গ্যারান্টিও কেউ দিতে পারবে না। স্মরণ তার চোখের সামনে মানুষ হয়েছে। স্মরণকে সে যতটা চেনে ওই ছেলেকে তো তা-ও চিনে না। ছেলেটাকে তো মানছুরা সামনাসামনি দেখেনি। কথাও বলেনি। মাকে দেখে কি ছেলের চরিত্র বিচার করা যায়? মানছুরা ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজতে লাগল। বিছানার চাদর, বালিশ টালিশ এলোমেলো করে ফেলেও মোবাইল ফোনটা কোথাও পেলো না। এখনও দেরী হয়নি। ছেলের মা’র সাথে কথা বলতে হবে। এই বিয়েটা কিছুতেই হতে পারে না। মানছুরা মোবাইল খুঁজছে এমন সময় খুশবু এসে জানাল,

-মা বর এসেছে।

মানছুরা থমকে খুশবুর দিকে তাকাল। শেষ চেষ্টাটাও কি তাহলে করতে পারল না! খুশবু ঢোঁক গিলে বলল,

-বরযাত্রী আসেনি। ছেলে একা এসেছে। তোমার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে চায়।

চলবে