#কমলা_রঙের_রোদ [২০]
#জেরিন_আক্তার_নিপা
অনেক ভেবেও কোন উপায় বের করতে না পেরে সান খুশবুর মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো। নিজের মাকে বলেও লাভ হয়নি। মা হয়তো ভাবছে, এখন বিয়ে ভেঙে দিলে মেয়ের পরিবারের উপর আঙুল উঠবে। মা’র ভাবনা ভুল না। কিন্তু শুধু এসব ভেবে সে তো বিয়েটাও করতে পারবে না। সান খুশবুকে ভালোবাসে তার বড় বোনকে না। দুই পরিবারই একটা ভুল বোঝাবুঝির স্বীকার হয়েছে। সময় থাকতে এই ভুল বোঝাবুঝি সমাধান না করলে দুইটা জীবনই নষ্ট হবে।
সান ঘরের ভেতর মানছুরা আর পরী বানুর সাথে কী কথা বলছে কেউ জানে না। সানকে প্রথমে তাদের বাড়িতে দেখে খুশবুর চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। এই লোক এখানে কী করতে এসেছে? যখন জানতে পারল সানই খুশির হবু বর তখন কোনরকম প্রতিক্রিয়া জানাতেই ভুলে গেল। তাকে পছন্দ করার কথা বলে বলে তার বোনকে বিয়ে করতে চায়! চরিত্রহীন লোক।
খুশি তার ঘরে বসে আছে। খুশবু বসে থাকতে পারছে না। পুরো ঘরজুড়ে পায়চারি করছে। টেনশন করে করে তার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণ ধরে কী কথা বলছে ওরা? সকালে খুশবু কলে ওই লোকটাকে শাসিয়েছে এই কথা বলে দেয়নি তো। খুশবুর অস্থিরতা দেখেও খুশি কিছু বলছে না। এই মেয়ের স্বভাবই এমন। খুশি জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে মা’র ঘরের দিকে দেখছে। এখনও বের হচ্ছে না কেন! নখ কামড়াতে কামড়াতে চিন্তিত কন্ঠে খুশবু বলল,
-এতক্ষণ সময় নিয়ে ওরা কী আলোচনা করছে? লোকটা কী কথা বলার জন্য এসেছে?
খুশির যেন কোনকিছু নিয়েই কোন চিন্তা নেই। সে অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। খুশবুকে এতটা উতলা হতে দেখে বলল,
-চুপ করে বোস না। তুই কেন এত মাথা ঘামাচ্ছিস?
খুশবু করুণ মুখে বোনের দিকে তাকাল। মাথা ঘামিয়ে বলেই তো এখন টেনশনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। মা তার কীর্তির কথা জানতে পারলে গা থেকে চামড়া টেনে ছিড়ে নিবে। লোকটা কি তার নামে বিচার দিতে এসেছে! একটু হলেও তো চেনাজানা আছে। তার সাথে এমনটা না করলেও পারত।
-খুশি।
খুশবুর ডাক খুশির কানে যায়নি। সে অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। খুশবু আবার ডাকল,
-খুশি!
খুশি এবার সাড়া দিল।
-হুম।
-আমার ভীষণ ভয় করছে।
-কেন?
খুশবু খুশির কাছে চলে এলো। গলা খাদে নামিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
-সকালে, এই ধর ঘন্টা খানিক আগে। ওই লোকটাকে কল করে অনেক কথা শুনিয়েছি। তোকে বিয়ে করতে এলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিব বলেও শাসিয়েছি৷ লোকটা মনে হয় আমার নামে বিচার দিতে এসেছে।
-তুই এসব কেন করতে গেছিস!
-করবো না? স্মরণ ভাইয়ের জন্য তোর দরদ থাকতে না পারে আমার অনেক দরদ আছে। দুইটা দিন ধরে বেচারা বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে…”
-খুশবু চুপ কর।
খুশবু ধমকে থামিয়ে দিল খুশি। খুশবু মুখ বাঁকিয়ে বলল,
-স্মরণ ভাইয়ের মরার কথা শুনতে পারিস না অথচ তুই-ই ওকে এই পথে ঠেলে দিচ্ছিস।
কথা বলতে বলতে মা’র ঘরের দিকে চোখ গেলে হঠাৎ থেমে গেল খুশবু। মুখে হাত চেপে ধরে খুশির পাশে ঘেঁষে বসল বসলো।
-আমার ভয় করছে। লোকটার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে মাকে সব বলে দিয়েছে।
ঘর থেকে বেরিয়ে সান এতক্ষণ চেপে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়ল। বুক এখনও ধুকধুক করছে। এত প্রশ্নের মুখোমুখি এ জীবনে হয়নি। তার উত্তরে খুশবুর মা দাদী কতটা সন্তুষ্ট হয়েছেন জানা নেই। তবে তার দিক থেকে কোন ত্রুটি রাখেনি এটাই স্বস্তি। সান আশেপাশে খুশবুকে খুঁজছে। তাকে এখানে দেখে যথেষ্টই অবাক হয়েছিল। খুশবু কি জানত না সে-ই বর। হয়তো জানত না। জানার পর বিশ্বাস করতে পারেনি। সান চলে যাবে নাকি অপেক্ষা করবে বুঝতে পারছে না। খুশবুর মা দাদী এখনও কিছু জানায়নি।
মানছুরা চুপ করে বসে আছেন। পরী বানু ছেলের বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-কী ভাবতাছো? পোলা তো নিজেই কইয়া গেছে খুশিরে হে বিয়া করবো না। তাইলে অহন তো স্মরণের লগে খুশির বিয়া দিতে কোন বাধা নাই।
মানছুরা এই বিষয়েই ভাবছেন। তবে খুশিকে নিয়ে না। ছেলেটা শুধু বিয়ে ভেঙে দিয়ে যায়নি। সে বিয়ে করবে কিন্তু খুশবুকে। যদিও মানছুরা খুশবুর ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব পরী বানুর উপরই দিয়ে রেখেছেন।
-আপনার অন্য নাতনির ব্যাপারে কী ভেবেছেন আম্মা?
-খুশবুর বিয়া আমি অহন দিতাম না।
-ছেলেটা আপনার নাতনিকে পছন্দ করে।
-পছন্দ করে করুক। খুশবু তো আর পছন্দ করে না।
-আপনার নাতনি পছন্দ করে কি-না সেটা তো ও-ই বলতে পারবে।
পরী বানু ভাবনায় পড়ে গেলেন। সত্যিই তো। খুশবুকে জিজ্ঞেস না করে তিনি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না।
সান ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে দেখেই খুশবু ওর সাথে কথা বলতে আসতে চেয়েছিল। খুশি ডেকে জিজ্ঞেস করল,
-কোথায় যাচ্ছিস?
-লোকটার সাথে কথা বলতে।
-নিজের কপালে দুঃখ টেনে আনিস না খুশি। চুপ করে বসে থাক।
-আমি দুঃখ টেনে আনি না। নিজে গিয়ে দুঃখের সাগরে ঝাপ দেই।
সান উঠানে নামলে খুশবু দৌড়ে ওর কাছে চলে এলো। সানকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টেনে গেটের বাইরে নিয়ে এলো।
-আপনি আমাদের বাড়িতে কেন এসেছেন?
সান খুশবুকে দেখছে। অশান্ত মনটা এবার কিছুটা শান্ত হয়েছে।
-সবাই মিলে যে একটা গণ্ডগোল পাকিয়ে রেখেছিলে সেটা সমাধান করতে।
-কী সমাধান করেছেন?
খুশবুর কৌতূহল দেখে সান ওকে একটু ক্ষেপাতে বলল,
-তোমায় কেন বলবো?
-আপনাকে আমি কী বলেছিলাম ভুলে গেছেন? খুশি আপনাকে পছন্দ করে না। ও স্মরণ ভাইকে ভালোবাসে।
-তাতে কী?
খুশবু চোখ ছোটছোট করে ফেলে বলল,
-তাতে কী মানে? এসব জেনেও আপনি বিয়েটা করতে চান?
-অনেকেই তো অনেককে ভালোবাসে। সবাই কি সবাইকে পায়? তোমার বোনের ভালোবাসা বাঁচিয়ে আমার লাভ কী? আমার ভালোবাসা তো কেউ দেখছে না।
খুশবুর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই লোক এতটা খারাপ!
-আর তোমার স্মরণ ভাই সে না, যে তোমাকে আমার পার্টি থেকে নিয়ে এসেছিল! তার উপরও আমার রাগ আছে।
খুশবু অবিশ্বাস্য গলায় বলল,
-স্মরণ ভাইয়ের উপর আপনার কিসের রাগ?
-তোমার এই ভাইয়ের জন্যই তো সেদিন আমার সব প্ল্যান বরবাদ হয়েছে। আমার ভালোবাসায় কুফা তোমার স্মরণ ভাই।
-তাই আপনি স্মরণ ভাইয়ের ভালোবাসায় ভিলেন হবেন!
সান কতক্ষণ হাসি চেপে রাখতে পারবে নিজেও জানে না। খুশবু তাহলে এখনও জানে না ওর মা দাদীকে কী বলে এসেছে সে।
-আপনি এমনটা করতে পারেন না।
-কেন পারবো না?
-কারণ আমি জানি আপ…”
কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল খুশবু। সান খুশবুকে পছন্দ করে এটা খুশবুও জানে। যাকে পছন্দ করে তার বড় বোনকে কেন বিয়ে করবে? সান আগ্রহ নিয়ে খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
-বলো বলো।
-কিছু না। কিন্তু আপনি এবিয়েটা করবেন না।
-আমি বিয়ে না করলে তোমার স্মরণ ভাই তোমার বোনকে বিয়ে করবে। কিন্তু আমার যে বিয়ে ভাঙবে আমাকে কে বিয়ে করবে?
-বিয়ে করার জন্য আপনি আরও অনেক মেয়ে পাবেন।
-অনেক মেয়ে চাই না। যে একটি মেয়েকে আমি চাই সে রাজি হলেই আমি বিয়ে ভেঙে দিবো।
লোকটা কি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এটা বোঝাল খুশবু উনাকে বিয়ে করতে রাজি হলে খুশিকে বিয়ে করবেন না উনি! খুশবুকে চুপ থাকতে দেখে সান ওর দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বলল,
-এমুহূর্তে এতবেশী ভাবার সময় নেই। বেশি সময় নিয়ে ফেললে আবার তোমার বোনের বিয়ে হয়ে যাবে। তখন আমারও কিছুই করার থাকবে না।
বিয়েতে তেমন কোন আয়োজন না থাকলেও পাড়াপ্রতিবেশি অনেকেই জানে আজ খুশির বিয়ে। যারা দেখতে আসছে তাদের অবাক হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে। বিয়ে বাড়ি অথচ এবাড়ির মানুষ গুলোর যেন কোন হেলদোল নেই। খুশিই বা এরকম সাদামাটা বসে আছে কেন? বরযাত্রী কখন আসবে? মানুষের মনে এসব প্রশ্ন উঁকি দিলেও কেউ জিজ্ঞেস করতে পারছে না। পরী বানু খুশবুকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে এলেন। মানছুরাও এখানে উপস্থিত আছে। পরী বানু রাখঢাক না রেখে সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করলে,
-খুশির যার লগে বিয়া ঠিক হইছিল তুই কি ওই পোলারে চিনোস?
খুশবুর কলিজায় পানি থাকল না। গলাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে খুশবু একবার মা’র দিকে তাকাল। সানকে সে চিনে এটা তো মিথ্যা না। তাই স্বীকার করে নিল।
-হুম।
-হুম কি? মুখে কথা নাই?
-চিনি।
-খালি কি চিনোস নাকি এর বেশিও কিছু আছে। অহন আর লুকাইয়া কাম নাই। সত্য কথা কইয়া দে।
দাদী ঠিক কী জানতে চাচ্ছে? সে ওই লোককে ভালোবাসে নাকি এটা জানতে চাচ্ছে?
-ওই পোলা খুশিরে না তোরে বিয়া করতে চায়৷ তুই কি চাস?
কী উত্তর দিবে খুশবু? সে যদি বিয়ে করতে রাজি না হয় তাহলে কি খুশির সাথেই বিয়ে হবে? সান তো এমনটাই বলে গেল।
-তোমরা যা বলবে আমি সেটাই করবো।
-আমাগো চাওয়া কথা না৷ কথা হইলো তুই কী চাস। তুই পোলারে তুমি পছন্দ করোস?
মা’র সামনে এমনিতেই ভয়ে তার অবস্থা বেহাল। এখন আবার এত বড় একটা মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে।
-করি।
পরী বানু খেঁকিয়ে উঠলেন,
-এই কথা তাইলে আগে কস নাই কেন? খুশির লগে তোর নাগরের বিয়া হইয়া গেলে পরে কইতি?
খুশবু কীভাবে বোঝাবে, ওই শালা তাকে মাইনকা চিপায় ফেলেছে। পছন্দ ওইদিক থেকে। তার দিক থেকে তেমন কিছুই নেই।
-সাফসাফ একটা কথা ক। তুই কি ওই পোলারে বিয়া করবি?
খুশবুর আর কি-ই বা করার আছে। স্মরণ ভাইয়ের কথা ভেবে নাহয় এটাও মেনে নিবে।
তবুও খুশির সাথে স্মরণ ভাইয়ের বিয়েটা হোক।
-হুম, করবো।
মানছুরা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। পরী বানু অবাক হয়ে খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মানছুরাও খুশবুর দিকে তাকিয়ে আছে। খুশির কথা ভেবেই কি ও এতদিন কাউকে কিছু জানায়নি? ছেলেটা এসে না জানালে খুশবুর মনের কথা কেউ জানতেই পারত না। কার জন্য এতবড় ত্যাগ স্বীকার করতে যাচ্ছিল ও?
চলবে