কমলা রঙের রোদ পর্ব-২১+২২

0
3

#কমলা_রঙের_রোদ [২১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশি তীক্ষ্ণ চোখে খুশবুর দিকে তাকিয়ে আছে। তার অনুসন্ধানী চোখের দৃষ্টি খুশবুর ভেতরটা পড়ে ফেলতে চাচ্ছে যেন। খুশবু আড়চোখে কয়েকবার খুশিকে দেখল। খুশির দিক থেকে ফিরে বসলে খুশি বলল,

-চোরের মতো মুখ লুকচ্ছিস কেন? পারলে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল। তুই কি আমার জন্য এই কুরবানী দিতে যাচ্ছিস?

-তোর জন্য কিছুই করছি না।

-তাহলে কি স্মরণের জন্য করছিস?

-না।

-তাহলে আমার জায়গায় তুই কেন বিয়ে করছিস?

-তোর জায়গায় করছি না। ওই জায়গা সবসময় আমারই ছিল। উনি আমাকে পছন্দ করেন। বিয়ের প্রস্তাবও আমার জন্যই পাঠিয়েছিল। মাঝখানে একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে তোর সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার সব ঠিক হয়ে গেছে।

খুশি খুশবুকে একটু হলেও চিনে। তাদের মধ্যে হয়তো এতটা ভালোবাসা নেই৷ কিন্তু খুশবু যে এসব তার জন্য করছে এটা না বোঝার মতো অবুঝ সে না।

-তুই কি ছেলেটাকে পছন্দ করিস?

খুশবু নিজেও ভাবছে, সে কি মানুষটাকে পছন্দ করে? পছন্দ না করলেও অপছন্দ করে না এটা সত্যি। খুশবু উত্তর না দিয়ে কিছু ভাবছে দেখে খুশি বলল,

-এখনও সময় আছে। ভেবে দেখ। তুই যদি ওই লোককে পছন্দ না করিস তাহলে বিয়েও করিস না। বিয়ে কোন পুতুল খেলা না। সারাজীবনের জন্য একটা মানুষের সাথে বাঁধা পড়ে যাওয়া।

-তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস। নিজে তো স্মরণ ভাইকে ভালোবেসেও এই লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলি।

খুশবু নিজের কথা ভাবছে না। ছোটবেলা থেকেই সে যেমন ভেবেছে তার সাথে তেমন কিছুই হয়নি। সবসময় উল্টোটাই হয়েছে। তাই জীবন নিয়ে ভাবাভাবি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। আরও অনেক বছর আগে খুশি তাকে একটা কথা বলেছিল। খুশি কেন তাকে দেখতে পারে না, কেন তার সাথে খারাপ ব্যাপার করে এর কারণ জানতে চাইলে খুশি বলেছিল,

-তোর জন্য আমি সেই মানুষটার ভালোবাসা, মমতা থেকে বঞ্চিত হয়েছি যাকে আমার জীবনে সবথেকে বেশি দরকার ছিল। তুই আমার শৈশব নষ্ট করেছিস। আমার ভালোবাসায় ভাগ বসিয়েছিস।

খুশবু খুশির এই কথাগুলো মনে রেখেছে। তার ভুল কি ছিল সে জানে না। তবে সবাই যেহেতু তাকেই দায়ী করে তাহলে হয়তো দোষ তারই ছিল। তার জন্য খুশি বাবার ভালোবাসা পায়নি। তাই খুশবু যেভাবেই হোক খুশিকে ওর ভালোবাসা পাইয়ে দিবে।
খুশবু মনে মনে বলল,

-আমার ভাগ্যে যা লেখা আছে তা-ই হবে। সুখ জিনিসটা এমনিতেও আমার জন্য না। কিন্তু তোকে স্মরণ ভাইয়ের সাথে সুখী হতে দেখে আমি ভালো থাকার কারণ খুঁজে পাবো।

সকাল পর্যন্ত সবাই জেনে এসেছে খুশির বিয়ে হবে। এখন শুনছে খুশির জায়গায় নাকি খুশবুর বিয়ে হবে। মানুষ এনিয়ে আড়ালে যেমন সমালোচনা করছে তেমন সামনেও ফুসুরফাসুর করছে। তবে মানছুরা এমন একজন মানুষ যে সমাজের মানুষের কথার পরোয়া করেননা। মানুষ কখনোই কারো দুঃখে পাশে দাঁড়ায় না। কিন্তু সুখে হিংসা ঠিকই করেন।

🌸

মাকে মানাতে সানের যথেষ্ট কষ্ট করতে হয়েছে। মা কিছুতেই মানাবে না। তিনি খুশিকেই ছেলের বউ হিসেবে চান। সান মাকে এটা বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত সে খুশবুকে ভালোবাসে তাহলে কীভাবে খুশিকে বিয়ে করবে!

-আমি কিছু জানি না। ওই মেয়েকে তুই বিয়ে করবি না।

-এটাই তোমার শেষ কথা তো?

-হ্যাঁ।

-তাহলে আমার শেষ কথাও শুনে রাখো। খুশবুকে না পেলে আমি আর অন্য কাউকেও চাই না। সারাজীবন একা থেকে যাব। আমি তোমারই ছেলে। তুমি জেদি হলে আমি আরও বড় জেদি।

ছেলের জেদ সম্পর্কে আর কেউ না জানলেও মা তো জানবেই। এসএসসি পরীক্ষার সময় সান একবার মা’র সাথে রাগ করে বলেছিল সে পরীক্ষা দিবে না। মিসেস সুলতানা ভেবেছিলেন রাগের মাথায় বলছে। কিন্তু সান সেবার সত্যি সত্যিই পরীক্ষা দেয়নি। তারপর থেকে মিসেস সুলতানা ছেলের রাগ,জেদকে ভয় পায়। মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও ছেলের জেদের কাছে হার মেনে মিসেস সুলতানা অনুমতি দিয়ে দিলেন। সান খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল।

-আমি জানতাম তুমি রাজি হবে। আমার সুখ, খুশির থেকে বেশি তোমার কাছে আর কিছু নেই।

🌸

বিয়ে হবার কথা ছিল দুপুরে। পাত্রী বদল হলে সন্ধ্যায় খুশবুকে সাজাতেই বসানো হলো। বরযাত্রী রাতে আসবে। দুপুরে পার্লারের মহিলারা খুশিকে সাজাতে এসেছিল। কিন্তু তখনও ঠিক হয়নি বিয়েটা হবে কি-না। তাই উনারা চলে গেছেন। এখন খুশবু পল্টুর মা সাজিয়ে দিচ্ছে। খুশিকে বলেছিল সাজিয়ে দিতে। কিন্তু খুশি খুশবুর উপর রাগ করে এঘরে উঁকিও দিচ্ছে না। সে ভাবছে খুশবু নিজের জীবন তার জন্য নষ্ট করতে যাচ্ছে। সাজানোর মাঝে খুশবু একবার কাকীকে জিজ্ঞেস করেছিল,

-পল্টু কোথায় কাকী?

-আমার ছেলের মনে দুঃখ দিয়ে এখন আবার জিজ্ঞেস করছিস কোথায় আমার ছেলে?

খুশবুর মন ভালো না থাকলেও সে হেসে ফেলল। পল্টু তাকে পছন্দ করে এটা পড়ার সবাই জানে।

-তোমার ছেলে মাত্র ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকলে আমি তো বুড়ী হয়ে যাব।

-বুড়ী বউকেই আমি মেনে নিবো।

-তাহলে কি বিয়েটা ভেঙে দিবো?

কাকী চোখ পাকিয়ে তাকালেন।

-শুভ কাজের আগে এসব অলক্ষুণে কথা মুখে আনিস না। বিয়েশাদি জীবনে একবারই হয়। আমি মন থেকে চাই তুই ভালো থাক। তোকে ভালো থাকতে দেখলে আমার থেকে বেশি খুশি মনে হয় কেউ হবে না।

বরযাত্রী আসতে আসতে রাত আটটা বেজে গেছে। বরযাত্রী খুব বেশি মানুষ আসেনি। সানের কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। স্মরণ ভাইকে ছাড়া সে কবুল বলবে না। কিন্তু স্মরণের কোন খোঁজ নেই। পল্টু মাজুর দোকান সহ পুরো বাজার খুঁজেছে। স্মরণ ভাই কোথাও নেই। পরী বানু একটু পরপর এসে খুশবুকে দেখে যাচ্ছেন। নাতনি বিদায় করার আগে এখনই তিনি কাতর হয়ে পড়েছেন। মেয়েটা একটা দিন সুখে কাটালে তিনদিন কেঁদে কাটিয়েছে। এই নাতনির সুখ দেখে যেতে না পারলে মরেও তিনি শান্তি পাবেন না।

ছেলে পক্ষের খাওয়াদাওয়া সেরে বিয়ে পড়াতে পড়াতে রাত দশটার বেশি হয়ে গেল। স্মরণের অপেক্ষায় খুশবু কবুল বলতে অনেক সময় নিল। কিন্তু সান কাজীর বলার সাথে সাথেই কবুল বলে ফেলেছে। খুশবুকে নিয়ে চলে যাবে। শেষ পর্যন্ত খুশি কঠিন হয়ে থাকতে পারল না। জীবনে যা কখনও করেনি আজ তা করল। খুশবুকে কতক্ষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থাকল। খুশবু কান্না আটকাতে পারল না। যা কখনও চেয়েও পায়নি আজ না চাইতেই তা পেয়ে গিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। পরী বানুও দুই নাতনিকে ধরে কাঁদছেন। মানছুরার চোখেও কি পানি এসেছিল? বোঝা গেল না। কারণ মানছুরা এঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে। সবাই খুশবুকে তুলে দিতে গাড়ি পর্যন্ত এসেছে। সবার মাঝেও ব্যাকুল নয়নে খুশবু একজনকে খুঁজছে। স্মরণ ভাইকে না দেখে সে কীভাবে চলে যাবে? খুশবু গাড়িতে উঠছে দেখে পরী বানু বললেন,

-যাওনের সময় হইয়া গেছে। আর রাইত করিস না।

দাদীর দিকে তাকিয়ে খুশবু কাতর গলায় বলল,

-স্মরণ ভাই কোথায় দাদী? আমাকে বিদায় দিতে আসবে না?

-জানি না পোলাডা দুইটা দিন ধইরা কই পইড়া রইছে। ও তো জানে না আজ যে তোর বিয়া। জানলে কি না আইসা থাকত?

খুশবু আরও অপেক্ষা করত। কিন্তু মানছুরা গাড়িতে উঠে বসার কথা বললে খুশবুকে তা-ই করতে হলো। খুশবুর পাশে সান উঠে বসল। গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে তবুও খুশবু জানালা দিয়ে মাথা বের করে সবাইকে দেখছে। গাড়ি নিয়ে ছোট গলি দিয়ে বেরোতে অসুবিধা হয়। গলির প্রায় শেষে চলে এসেছে এমন সময় পেছন থেকে কেউ খুশবুর নাম ধরে ডেকে উঠল। কন্ঠটা চিনতে পেরে খুশবু সাথে সাথে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলল। গাড়ি থামলে এক মুহূর্তও দেরি না করে দরজা খুলে খুশবু নেমে পড়ল। কী হলো এটা? সান হতবুদ্ধি হয়ে কতক্ষণ বসে থেকে সে-ও বেরিয়ে পড়ল। তার বউ কি পালিয়ে গেছে? দৌড়ে এসে স্মরণ হাঁপাচ্ছে। স্মরণকে দেখে খুশবুর খুশির শেষ রইল না। সে ছুটে এসে স্মরণের সামনে দাঁড়াল। খুশবু বউয়ের সাজে দেখে স্মরণ জলে টলমলে চোখ নিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসল। ভাঙা গলায় বলল,

-কবে তুই এত বড় হয়ে গেছিস রে? আজ তোর বিয়ে!

খুশবু কিছু না বলে স্মরণকে মারতে লাগল। স্মরণ এমনটা আশা করেনি।

-আরে এ কী! মারছিস কেন আমাকে?

-তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে? তুমি জানো তোমার জন্য আমার কতটা চিন্তা হয়েছে? আমার বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু তুমি কাছে ছিলে না। আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যেতাম তবুও তুমি জানতে পারতে না। এতদিন তুমি আমাকে মিথ্যা বলে এসেছ। তুমি আমাকে একটুও ভালোবাসো না। তুমি একটা মিথ্যাবাদী মিথ্যাবাদী। তোমার সাথে আমি কোনদিন কথা বলবো না।

কথাগুলো বলতে বলতেও খুশবু কাঁদছে। সান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার বউ পালায়নি। ভাই বোনের ভালোবাসা দেখে সানের একটু একটু হিংসা হচ্ছে। তার বউ তাকে ছাড়া বাকি সবাইকে ভালোবাসে। ভাইয়ের প্রতি কত ভালোবাসা! এমন ভালোবাসা তার প্রতি কবে জন্ম নিবে।

-আজ তোর বিয়ে আমি তো জানতাম না।

-তোমার জানা উচিত ছিল।

-কীভাবে জানবো রে পাগলি? তুই আমাকে ভালোবাসিস এটা জানি। কিন্তু এতটা বেশি ভালোবাসিস এটা ধারণা ছিল না। আমাকে ভালোবেসে খুশির জায়গায় নিজে পাত্রী হয়েছিস!

সান দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। স্মরণ ওর দিকে তাকালে এগিয়ে গেল। স্মরণ খুশবুর চোখ মুছে দিয়ে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-তুমি আমার পাগলি বোনকে কতটা ভালোবাসো জানি না। কিন্তু ওর চোখে একফোঁটা পানি এলে সেদিন তোমাকে আমার সামনা করতে হবে। কোনদিন ওকে কষ্ট দেওয়ার কথা কল্পনাও কোরো না৷ আমার বোনটার অনেকবেশি খেয়াল রেখো।

সান হাসল। তাকে এসব না বললেও সে খুশবুর খেয়াল রাখবে। তবুও শালা বাবুর হুমকি সে ভালোবেসেই গ্রহণ করল।

গাড়িতে বসেও যখন খুশবু কাঁদছে সান ওর দিকে তাকিয়ে বলল,

-আজকেই কিন্তু শেষ বারের মতো কাঁদছো। কেননা আজকের পর কোনদিন তোমার চোখে পানি আসবে না। তোমার ভাই আমাকে কী হুমকি দিয়েছে শুনেছ তো? সুতরাং পৃথিবীর সব সুখ ভোগ করার জন্য নিজেকে তৈরি রাখো।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [২২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেও মা এসে বরণ করে তাদের ঘরে তুলছে না। সান কতক্ষণ মাকে ডাকাডাকি করল। কিন্তু এতেও কোন কাজ না হলে নিজেই খুশবুকে কোলে তুলে ভেতরে নিয়ে এলো। সান এমনকিছু করবে খুশবু কল্পনা করতে পারেনি। বেচারি ভয় পেয়ে সানের পাঞ্জাবি শক্ত করে মুঠো করে ধরল। খুশবুর দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে সান বলল,

-শাশুড়ির ছেলের মন চুরি করে নিয়েছ। আশা করি শাশুড়ির মন জয় করতে তোমার খুব বেশি সময় লাগবে না। এই কাজে তোমার বর তোমাকে ফুল সাপোর্ট দিবে।

খুশবুকে কোলে নিয়ে মা’র ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। কয়েকবার ডেকে আর না ডাকলে মিসেস সুলতানা কান খাড়া করে বাইরে কী হচ্ছে শোনার চেষ্টা করছিলেন।

-নতুন বউ বরণ করতে আসোনি। এখন কি আমাদের আশীর্বাদও করবে না? তোমার দোয়া না নিয়ে নতুন জীবন শুরু করবো না এটা তুমিও খুব ভালো করেই জানো।

মিসেস সুলতানা মনে মনে অভিমানের পাহাড় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। বিয়ে করেই ছেলে বুঝি পর হয়ে গেল। সান খুশবুকে মাকে সালাম করতে বললে খুশবু বিড়বিড় করে বলল,

-আগে তো আমাকে নামান।

-কেন? পা ধরে তো সালাম করবে না। মুখে সালাম করার জন্য কি এখন তোমাকে আমার কোল থেকে নামতে হবে?

এদের মা ছেলের কী সিন চলছে খুশবু জানে না। কিন্তু সানের জন্য তাকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে। মিসেস সুলতানা ছেলের এমন নির্লজ্জ কথাবার্তায় হতবাক হয়ে রইলেন। বিয়ে করে এনেই এই অবস্থা? কয়েকটা দিন গেলে আরও কী কী দেখতে হবে তাকে?

-আমাদের দোয়া করো মা। সামনের বছরই যেন তোমাকে দাদী বানাতে পারি।

এবার খুশবু লজ্জা না পেয়ে চুপিচুপি একটা কাজ করলো। সানের ঘাড়ে জোরে চিমটি কাটল। যার জন্য সান প্রায় লাফিয়ে উঠে তাকে নামিয়ে দিয়ে ঘাড় ডলতে লাগল। অদ্ভুত চোখে সান তার দিকে তাকিয়ে আছে। অবাক হচ্ছে? হোক। তাকে বউ বানিয়ে ফেলেছে দেখে কি সাপের পাঁচপা দেখে ফেলেছে? ব্ল্যাকমেইলিং করে যে বিয়েতে রাজি করিয়েছে এই হিসাবও তো এখনও বাকি। চাদু এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে বিয়ে যে কত মজা।
সান মনে মনে ভাবল,

‘না, এ মেয়ের মধ্যে বিন্দু পরিমাণও পরিবর্তন আসেনি। বরং আগের থেকেও আরও সাঙ্ঘাতিক হয়েছে।’

নিজের রুমের দরজা খুলে সান নিজেও অবাক হয়ে রইল। তার বন্ধুরা এই কাজ কখন করলো? একঝাঁক ফুলের গন্ধ নাকে এসে লাগলে খুশবু নাক চেপে ধরল। খুশি বা বিস্মিত হবার বদলে বলল,

-পৃথিবীর সব ফুল তুলে এনেছেন নাকি? কী কড়া ঘ্রাণ! মাথা ঘোরাচ্ছে।

বন্ধুরা এত সুন্দর করে বাসরঘর সাজিয়েছে সান মনে মনে যতটা খুশি হয়েছিল বউয়ের কথা শুনে ততটাই হতাশ হলো। এই মেয়ে তো দেখা যাচ্ছে তার জীবন থেকে রোমান্সই দূর করে দিবে।

-এগুলো কি সরিয়ে ফেলতে বলবো?

-দয়া করে বলুন। নয়তো এঘরে থাকলে মনে হবে একটা ফুল বাগানের মাঝখানে বসে আছি।

-তুমি কি ফুল পছন্দ করো না?

তার বউ ফুল পছন্দ করে না এই বিস্ময় কোনভাবেই চেপে রাখতে পারল না। খুশবু সানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

-ফুল পছন্দ করলেও এমুহূর্তে করছি না। ব্যাটা বদ, ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছিস। তুই কি মনে করেছিস তোর বাসর করার শখ আমি পূরণ হতে দিবো? অন্তত এই জন্মে তো না।

কী আর করার, বউয়ের ফুল পছন্দ না। সান কাজের লোককে ডেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘরের সমস্ত ফুল সরিয়ে ফেলতে বললো।

🌸

সন্ধ্যা হয়ে গেলেও পরী বানু উঠানে বসে আছেন। কারেন্ট নেই। ঘরে আলো দেওয়া হলেও উঠানটা অন্ধকার। খুশি এসে নিঃশব্দে দাদীর পাশে বসলো। কোন কথা না বলে চুপ করে বসে থাকল।

-খুশবুর লাইগা মন কেমন করতাছে?

-উঁহু।

-তোর বিয়া হইলে খুশবু অনেক কানতো।

-হয়তো।

খুশি ভাবছে সে কেন খুশবুর মতো অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। খুশবু কষ্ট পেলে যেমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে পারে তেমনি খুশি হলে হো হো করে হাসতেও পারে। খুশি তার হাসি কান্না কোনকিছুই প্রকাশ করতে পারে না।

-খুশবুরে ছাড়া বাড়িডা একেবারে খালি খালি লাগতাছে।

-দাদী তুমি খুশবুকে সবথেকে বেশি ভালোবাসো, না?

অন্ধকারে পরী বানু নাতনির দিকে তাকালেও খুশির মুখ দেখতে পেলেন না। খুশির ছেলেমানুষী প্রশ্ন শুনে পরী বানু হাসলেন।

-কেডা কইছে আমি খুশবুরে বেশি ভালোবাসি? আমার তিন নাতি/নাতনিরেই আমি সমান ভালোবাসি।

-কিন্তু খুশবুর জন্য তোমার ভালোবাসা সবথেকে বেশি প্রকাশ পায়।

-প্রকাশ পায় কারণ তোর বইন একটা নাছোড়বান্দা। দেখস না সব জিনিস কেমুন জোর কইরা আদায় কইরা নেয়।

খুশি গোপনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। খুশবু বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছে খুশবুকে ছাড়া এবাড়ি কতটা ফাঁকা। খুশবু একাই বাড়িটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। খুশি আজ নিজের ঘরে যেতে পারছে না। খুশবুর অনুপস্থিতি তাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে। বারবার খুশবুর সাথে করা তার বাজে আচরণ গুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। খুশবুর কাছে কি সে কোনদিন ক্ষমা চাইতে পারবে?

আজ বাড়ি ফেরার সময় সিঙ্গাড়ার দোকানের সামনে অনেকটা সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিল স্মরণ। খুশবু তার কাছে আর কিছু আবদার করতো বা না করতো, সিঙ্গাড়া খাওয়ার আবদার জোরই করত। আজকের পর থেকে তার কাছে কেউ আবদার করবে না। কেউ বলবে না, স্মরণ ভাই পঞ্চাশটা টাকা দাও তো। তোমার এত টাকাপয়সা কে খাবে? দোকানে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে কর্মচারী ছেলের দোকান থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-স্মরণ ভাই, সিঙ্গাড়া মাত্রই তোলা হইছে। এক প্যাকেট দিমু?

ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে স্মরণ বলল,

-সিঙ্গাড়া খাওয়ার মানুষ চলে গেছে। কার জন্য নিবো?

হাঁটতে হাঁটতে স্মরণ বাড়ি ফিরে এলো। দাদী খুশিকে উঠানে বসে থাকতে দেখে ওদের কাছে এলো। স্মরণকে দেখে দাদী জিজ্ঞেস করলেন,

-কই আছিলি এতক্ষণ?

-তোমরা এখানে বসে আছো কেন?

পরী বানু জবাব দিলেন,

-ঘরে মন টিকতাছে না।

-কটকটির মা’র সাথে কথা হয়েছে? ঠিকঠাক মতো পৌঁছেছে?

-কথা তো হয় নাই।

-খুশবুকে ছাড়া বাড়িতে ভালো লাগে না তাই না দাদী?

-হ রে ভাই। আমগোরে ছাইড়া খুশবুরও কি মন টিকতাছে? জীবনে তো এক রাইতেও লাইগাও বাড়ি ছাইড়া কোথাও থাকে নাই। কী জানি মাইয়াডা কী করতাছে।

🌸

খুশি, স্মরণ ভাই, মা, দাদী সবার কথা ভীষণ মনে পড়ছে। বাড়ি থেকে দূরে কখনও থাকা হয়নি। নতুন এই পরিবেশে খুশবুর একটুও ভালো লাগছে না। প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে খুশির সাথে যে গল্প গুলো করতো সেসব গল্প এখন কার সাথে করবে? খুশবুর মন খারাপ এটা সানও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু খুশবুর মন ভালো করার জন্য কী করতে পারবে সে?

-বাড়ির কথা মনে পড়ছে খুশবু?

-হুম।

-অল্প নাকি বেশি?

-অনেক বেশি।

-আচ্ছা। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠেই তোমাকে বাড়ি নিয়ে যাবো।

সানের এই সান্ত্বনা মূলক কথা খুশবুকে খুশি করতে পারল না। সান ভেবেছিল এতে হয়তো কাজ হবে। বাড়ি নিয়ে যাবে শুনেও খুশি হয়নি!

-দুনিয়াতে এত মেয়ে থাকতে আপনার আমাকেই কেন বিয়ে করার ইচ্ছা জাগলো? আপনি আমাকে বিয়ে না করলে আমি এখন বাড়িতে থাকতাম। সবার থেকে দূরে না এলে আমার এতবেশী মন খারাপও থাকতো না।

খুশবুর কথা শুনে সানের দুঃখ লাগলেও হাসল সে। এই মেয়ে পরিবার ছাড়া আর কিছুই বুঝে না। তার ভালোবাসা কি এখনও উপলব্ধি করতে পারছে না?

-আমি তোমাকে বিয়ে না করলেও অন্য কেউ করতো। তার থেকে ভালো হলো না আমি করেছি? আমাকে তুমি চেনো। দেখা যেত ওই লোককে চিনতেই না। অচেনা একটা লোকের থেকে আমি ভালো না?

খুশবু উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকল। সান বলল,

-আচ্ছা, আমি কী করলে তোমার মন ভালো হবে আমাকে বলো। তুমি যা বলবে আমি তা-ই করবো।

খুশবু মানুষটার দিকে তাকিয়ে মন খারাপের মাঝেও ভাবছে, সত্যিই কি কেউ তাকে এত ভালোবাসতে পারে? তার মন ভালো করার জন্য সব করতে পারে? তার মাঝে তো তেমন বিশেষ কিছু নেই। দাদী, স্মরণ ভাই ছাড়া কেউ তার মন খারাপের খবর রাখতে চায়নি।

-বলো।

-আপনার কিছু করতে হবে না। আমার মন ভালো হয়ে গেছে।

🌸

সকালে খুশবুর ঘুম ভাঙলে চোখ খুলে সানকে সামনে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। চিৎকার করে উঠার আগে মনে পড়ল গতকালই তো তার বিয়ে হয়েছে। নিজের বাড়িতে নেই সে। সান গালে হাত দিয়ে পলকহীন চোখে খুশবুকে দেখে যাচ্ছে। তার কাছে সব কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে। খুশবু সত্যিই তার বউ এটা বিশ্বাসই হতে চায় না। খুশবু উঠতে গেলে সান বলল,

-এখনই ওঠো না প্লিজ। তোমাকে আরেকটু দেখি।

খুশবু কপাল কুঁচকে লোকটাকে দেখছে।

-আমাকে আগে আর দেখেননি?

-দেখেছি। কিন্তু আজ আবার নতুন করে দেখছি।

বিয়ে করে এই লোক পাগল হয়ে গেল নাকি? সানের কথা না শুনেই খুশবু উঠে পড়েছে। সান ব্যথিত হলো। সানও উঠে দাঁড়িয়েছে তখনই ওর ফোন বাজল। ফোন রিসিভ করে সান মধুর কন্ঠে সালাম দিয়ে বলল,

-আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন আম্মা?

খুশবু চোখ বাঁকিয়ে দেখছে সান কার সাথে কথা বলে। মানছুরা রাতেই একবার খোঁজ নিতে চেয়েছিল। সকাল হতে হতে আর থাকতে না পেরে কল করে ফেলল।

-ভালো আছি বাবা। তোমরা কেমন আছো?

-আমিও ভালো আছি। কিন্তু আপনার মেয়ে মনে হয় এতটা ভালো নেই। আপনাদের ভীষণ মিস করছে।

সান তার মা’র সাথে কথা বলছে! খুশবুর কেনই যেন হিংসে হলো। তার মাকে কত সুন্দর করে আম্মা ডাকছে!

-আপনার মেয়ে? আমার সামনেই আছে। এক্ষুনি দিচ্ছি।

মা তার সাথে কথা বলতে চাইবে এটা আশা করেনি খুশবু। সান তার দিকে ফোন এগিয়ে দিলে খুশবু ফোনটা হাতে নিয়েও বিশ্বাস করতে পারছে না মা তার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। খুশি লুকিয়ে কাঁপা গলায় খুশবু বলল,

-হ্যালো মা।

চলবে