কমলা রঙের রোদ পর্ব-৩১+৩২

0
4

#কমলা_রঙের_রোদ [৩১]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

খুশির আজ ঘুম আসছে না। সে জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ মনে হয় পূর্ণিমা। আকাশের চাঁদটা কী ভীষন রকম ঝলমল করছে। আজকে তার খুশির দিন। তারপরও কোথাও যেন একটা বিষাদ অনুভব করছে। যে মানুষটাকে সে ভালোবাসে, আজকের পর তাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পেয়ে যাবে। তারপরও কেন খুশি হতে পারছে না?

খুশবু ঘরে এসে খুশিকে এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

-এখনও ঘুমাসনি কেন? কাল সকালে উঠার ইচ্ছে নেই নাকি? বিয়ের দিনই দেরি করে উঠবি!

খুশবু কাঁথা বালিশ সহ সানকে স্মরণের ঘরে দিয়ে এসেছে। আজকের রাতে শেষ বারের মতো সে খুশির সাথে থাকতে চায়। এর পরে তো আর চাইলেও দুই বোন একসাথে থাকতে পারবে না। খুশবু দ্রুত হাতে বিছানা গুছিয়ে দিল। খুশির দিকে তাকিয়ে বলল,

-চলে আয়।

খুশি খুশবুর কথা শুনছে নাকি কে জানে। এখনও সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। খুশবু বিরক্ত হয়ে তাকাল। এতবার ডাকছে তবুও কোন সাড়াশব্দ দিচ্ছে না। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে খুশির পেছনে দাঁড়িয়ে খুশবু বলল,

-গাধার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমচ্ছিস কেন?

খুশি এবার খুশবুর দিকে ফিরে তাকাল। শান্ত গলায় বলল,

-গাধা না, ঘোড়া দাঁড়িয়ে ঘুমায়।

-ওই একটা হলেই হলো। এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ঘুমাবি না?

-ঘুমবো। তুই কি আজ এঘরে থাকবি?

-হ্যাঁ। তোর জীবনের শেষ দিন না মানে বিবাহিত জীবনের শেষ দিন ভাবলাম শেষ বারের মতো দুই বোন একসাথে থাকি। পরে তো আর স্মরণ ভাইকে ছেড়ে আমার সাথে থাকতে আসবি না।

-তোর বর কোথায় থাকবে?

-ওকে স্মরণ ভাইয়ের সাথে দিয়ে এসেছি। দু’জনের ভালো খাতির হয়েছে দেখলাম।

-ওহ।

খুশির মনে কিছু চলছে এটা খুশবুও বুঝতে পারল। এত চুপচাপ খুশি কোনদিন থাকেনি। হ্যাঁ, খুশি তার মতো বাচাল না। কিন্তু এমন গোমড়ামুখোও না। খুশি কি ভয় পাচ্ছে? দূর। ভয় কেন পাবে? অচেনা অজানা কারো সাথে তো বিয়ে হচ্ছে না। স্মরণ ভাইয়ের সাথে বিয়ে হচ্ছে। দু’জন দু’জনকে কত্ত ভালোবাসে। কবে থেকেই তো বিয়ে করতে চায়। তাহলে এখন সমস্যা কী।

-খুশি, কী ভাবছিস তুই?

খুশি দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। বিছানার দিকে এগোতে এগোতে বলল,

-কিছু না।

খুশবুও খুশির পেছনে এলো। কপালে সন্দেহের ভাঁজ ফেলে বলল,

-কিছু না কী? মিথ্যা কার সাথে বলছিস।
কিছু যদি না-ই হতো তাহলে আজকের মতো এত খুশির একটা রাতে তোকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুঃখী মনে হচ্ছে কেন? আজকের রাত তুই ছটফট করতে করতে কাটাবি। কখন সকাল হবে। কখন তুই কবুল বলে স্মরণ ভাইয়ের বউ হবি।

-খুশবু।

-হু বল।

-আমি মন থেকে অনেক বেশি খুশি। তারপরও কেন এমন অস্থিরতা কাজ করছে?

খুশবু একটু ভাবল। তারপর বলল,

-অস্থির লাগছে তোর?

-হুম।

খুশবু যেন ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিল।

-আরে দূর! অস্থির কেন লাগবে? নতুন জীবনের শুরু করতে যাচ্ছিস। তুই এক্সাইটেড ফিল করছি। এটাকেই ভুলে অস্থিরতা ভেবে নিচ্ছিস।

খুশবু যথাসম্ভব চেষ্টা করছে খুশির মাথা থেকে যেন আলতো ফালতু চিন্তাভাবনা বের করে দিতে পারে। খুশির হাত ধরে নরম গলায় বলল,

-কিছু হবে না। এতকিছু ভাবিস না তো। আমার মতো অকর্মা মেয়ে পরের বাড়িতে গিয়ে সংসার করতে পারছি। তুই তো নিজের বাড়িতেই থাকবি। তার উপর কাজে কর্মে তুই আবার আমার থেকে সবদিক দিয়ে এগিয়ে। তুই কেন ফালতু টেনশন করছিস।

খুশি খুশবুর দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটাকে সে সজ্ঞানে কোনদিন বোন বলে পরিচয় দেয়নি। দুই জনের শরীরে এক রক্ত বইলেও সবসময় খুশবুকে মনে করিয়ে দিয়েছে খুশবু তাদের কেউ না। খুশবুর জন্য তাদের জীবনে দুঃখ এসেছে। এত তিক্ততা, এত কটু কথা, এত অবহেলা অযত্ন সহ্য করেও মেয়েটা কোনদিন তাদের ঘৃণা করেনি। মুখ ফোটে কোনদিনও অভিযোগ করেনি। বরং তাদের সকলের চিন্তায় চিন্তিত হয়েছে। তাদের দুঃখ কষ্টকে নিজের দুঃখ কষ্ট ভেবে নিয়েছে। এখনও কেমন তার জন্য অস্থির হচ্ছে। খুশির চোখ দিয়ে পানি পড়তে দেখে খুশবু থতমত খেয়ে গেল। কাঁদছে কেন খুশি! কী হয়েছে ওর?

-খুশি, কী হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন?

খুশি এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। খুশবু আরও ভড়কে গেল৷ তার কোন কথাতে কি কষ্ট পেয়েছে? কিন্তু সে তো কষ্ট দেওয়ার মতো কোন কথা বলেই নি।

-আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছিস? তুই তো জানিস, আমি কোন কথা ভেবে বলি না। পাগলের মতো মুখে যা আসে বলে ফেলি।

খুশি আচমকা খুশবুকে জড়িয়ে ধরল। খুশবু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এরকম কিছু ঘটবে কল্পনা করেনি সে। খুশি কখনও তাকে জড়িয়ে ধরতে এটা স্বপ্নের মতোই অবিশ্বাস্য।
খুশি সবসময় তাদের মাঝে দূরত্ব রেখেছে। বোঝ হওয়ার পর থেকে দু’জন এক ঘরে থাকলেও খুশি কখনও তার সাথে এক বিছানায় ঘুমায়নি। খুশবু যদি ঘুমের মধ্যে বাজে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে খুশির ঘাটে শুতে গেছে তাহলেও খুশি অনেক কথা শুনিয়েছে।
খুশবু কোনদিনও ভয়ে খুশির কোন জিনিস ধরেনি।
খুশি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলছে। খুশবু ধীরে ধীরে খুশির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জিজ্ঞেস করল,

-কী হয়েছে তোর? কেউ তোকে কিছু বলেছে? কিন্তু তোকে কে কী বলবে? কার আচরণে বা কথায় কষ্ট পেয়েছিস?

খুশি কেঁদেই যাচ্ছে। কোন জবাব দিচ্ছে না। খুশবু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।

-বল না খুশি। কী হয়েছে তোর? কেন এমন করছিস?

-আমি আমার নিজের করা কাজে কষ্ট পাচ্ছি খুশবু। আমি জীবনে অনেক বেশি ভুল করে ফেলেছি। নিজের ভুল গুলো বুঝতে পরলেও এখন আমি আর কিছুই করতে পারব না।

-কী ভুল করেছিস তুই? আর কে বলেছে তুই ভুল করেছিস? তুই কোন ভুল করতেই পারিস না।

-তুই ঠিকই বলেছিস। আমি ভুল করতে পারি না। আমি যা করেছি তা অন্যায়। মানুষ অজান্তে ভুল করে। জেনে-বুঝে করলে সেটাকে ভুল না বলে অন্যায় বলে।

-কী উলটাপালটা কথা বলছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

-তুই এত ভালো কেন খুশবু? তোর মন এত সরল কেন? কেন তুই আমাকে ঘৃণা করিস না? তোর ঘৃণা পাওয়ার মতো সব কাজই তো আমি করেছি। তোকে ছোট করার, কষ্ট দেওয়ার কোন কাজই বাদ রাখিনি।
তারপরও তুই কেন আমাকে নিয়ে ভাবিস? কেন আমার চিন্তায় অস্থির হোস?

খুশবু কতক্ষণ বোকার মতো খুশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর হেসে ফেলে বলল,

-দূর পাগল! এসব কেমন ধরনের কথা বলছিস। বোন হয়ে আমি বোনের কথা ভাবব এটাই তো নিয়ম। পৃথিবীর সব বোনই তাদের বোনকে নিয়ে ভাবে। আমি একা ভাবি নাকি!

খুশির কান্নার বেগ বেড়ে গেল।

-আমি তো কোনদিন তোকে বোনের ভালোবাসা দিই নি। সারাজীবন তোকে ঘৃণা করেই এসেছি।

-কে বলেছে তুই আমাকে ভালোবাসা দিস নি? হ্যাঁ, তুই কখনও প্রকাশ হতে দিস নি তুই আমাকে কতটা ভালোবাসিস। তারপরেও আমি বুঝে নিয়েছি।

-কীভাবে বুঝেছিস? আমি সজ্ঞানে কখনও তোর সাথে ভালো ব্যবহার করেছি?

-করিসনি। কিন্তু আমার জ্বর হলে রাত জেগে কেন মাথায় জলপট্টি দিতি? আমার যে জিনিস খেতে পছন্দ তা নিজে কম খেয়ে আমার জন্য বেশি কেন রেখে দিতি? আমার জন্য ওই রঙের কাপড়টাই কেন আনতি যে রঙ আমার পছন্দ? কলেজে গেলে মাঝে মাঝে যে আমি ব্যাগের ভেতর টাকা পেতাম ওই টাকা আমার ব্যাগে কে রাখত? তুই তো কখনও সাজিস না। তারপরও কেন মেকআপ কসমেটিকস কিনিস? আমার জন্য মা’র কাছে কেন মিথ্যা বলিস?

খুশি কোন কথা বলতে পারল না। খুশবুকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলে গেল। খুশবু নিজেও কাঁদছে। খুশিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

-তুই যে আমাকে ভালোবাসিস এটা তুই মুখে স্বীকার না করলেও আমি জানি। তুই আর মা একরকমই। তোদের মুখে বিষ কিন্তু অন্তরে মধু।

খুশবুর কথা শুনে খুশি কান্নার মাঝেও হেসে ফেলল। এরকম একটা মুহূর্তেও একমাত্র খুশবুই এমন কথা বলতে পারে। খুশবু খুশিকে সোজা করে বসিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

-কান্না করলে তোকে বিশ্রী লাগে। এত বিশ্রী লাগে যে বমি এসে যায়। তুই আর জীবনেও কাঁদিস না।

-তুই যে কথায় কথায় ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদিস! তোকে বিশ্রী লাগে না?

খুশবু কানের পেছনে চুল গুঁজে দিয়ে নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,

-না। আমি জানি, কাঁদলে আমাকে মায়াবী লাগে। কান্না করতে করতে কয়েকবার আয়নার দেখেছিলাম।

খুশি এবার শব্দ করে হাসতে লাগল। খুশবু মনে মনে স্বস্তি পেলো। খুশি বলল,

-শুয়ে পড়। অনেক রাত হয়ে গেছে।

সাথে সাথে খুশবু অনেক আশা নিয়ে বলল,

-আজ তোর সাথে শুই? এক বিছানায়?

খুশি চোখ পাকিয়ে তাকাল। সাফ সাফ মানা করে দিয়ে বলল,

-একদম না। নিজের বিছানায় যা।

খুশবু মুখ বাঁকাল। একটু আগে কেঁদেকেটে কেমন ভালো মানুষি দেখাচ্ছিল! এটা আসলেই একটা শয়তান।

🌸

সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়লেও স্মরণের ঘরের দরজা এখনও খুলেনি। খুশবু দরজা ধাক্কিয়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছে। মরে টরে গেল নাকি এরা? এত ডাকার পর কোন সুস্থ সাধারণ মানুষ ঘুমিয়ে থাকতে পারবে?

-স্মরণ ভাই! আর কত ঘুমাবে। আল্লাহ রে আল্লাহ! আজ তো তোমার বিয়ের দিন।

খুশবু উপায় না পেয়ে জানালায় গেল। অনেক ধাক্কা টাক্কা দিয়ে জানালা একটু ফাঁক করতে পেরেছে। এক চোখ বুঁজে অন্য চোখে ঘরের ভেতরে দেখার চেষ্টা করছে। খুশবু এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল দু’জন কী সুন্দর করে একজন আরেকজনের উপর পা তুলে ঘুমচ্ছে!

-স্মরণ ভাই। উঠবে তোমরা?

খুশবুর ডাকাডাকিতে সানের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে ঘরটা অচেনা লাগল। ঘরটা ভালো করে দেখার পর মনে পারল, রাতে সে স্মরণের ঘরে শুয়েছিল। স্মরণের উপর নিজের একটা পা দিয়ে রেখেছে দেখে সান তাড়াতাড়ি পা নামিয়ে নিল। দরজায় তখনও খুশবু ডাকছে। সান দরজা খুলে দিলে খুশবু চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করল,

-কোন কিছু খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন নাকি? এরকম মরার মতো ঘুমচ্ছিলেন কেন? ডাকতে ডাকতে আমার গলা ভেঙে গেছে।

সানের মনে করতে পারল না রাতে তারা কয়টায় ফিরেছিল। অনেক রাতই হয়ে গিয়েছিল হয়তো। তাই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে।

-কী হলো? জবাব দিচ্ছেন না কেন?

-কী খেয়ে ঘুমাবো?

-নেশা পানি কিছু?

-আস্তাগফিরুল্লাহ! তোমার বরকে তুমি নেশাখোর ভাবো?

-আপনিই তো ভাবতে বাধ্য করেছেন। সাধারণ মানুষ এত ঘুমায় কীভাবে?

-রাতে ফিরতে মনে হয় দেরি হয়েছিল।

খুশবু কপাল কুঁচকিয়ে ভাবল। তারপর বলল,

-ফিরতে দেরি হয়েছিল মানে কী? কোথায় গিয়েছিলেন?

-বেরিয়েছিলাম একটু।

-আপনি একা?

-না। তোমার ভাইও গিয়েছিল।

খুশবু বিস্মিত না হয়ে পারল না। তার বিস্ময় প্রকাশ করে বলল,

-আপনাদের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব কখন হলো? যাকগে। এখন তাহলে আপনার বন্ধুকে ডেকে তুলুন। আমার আরও অনেক কাজ আছে।

খুশবু চলে যাওয়া ধরলে সান ডেকে বলল,

-আমি কিন্তু তোমার উপর রেগে আছি।

খুশবু পেছন ফিরে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

-কেন?

-এখানে আসার পর একমাত্র জামাইকে তুমি এভাবে অবহেলা করছো! প্রথম দিন বিছানা আলাদা করেছ। কাল ঘর থেকেও বের করে দিয়েছ। রাগ করবো না?

-আপনার বন্ধুর সাথেও তো ভালোই সময় কেটেছে। রাতে ঘোরাঘুরি করেছেন। আমার জন্য না ঘুমিয়ে বসে ছিলেন এমন তো না।

চলবে

#কমলা_রঙের_রোদ [৩২]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

সকালে থেকেই সান খুশবুর পেছনে ঘুরঘুর করছে। খুশবু যেখানে যাচ্ছে পেছন পেছন সে-ও গিয়ে হাজির হচ্ছে। এদের এমন কাণ্ড দেখে বাড়ির মানুষ হাসাহাসি করছে। কেউ কেউ তো টিপনি কেটে বলেও উঠছে,

-কী খাইয়ে জামাইকে এমন বশ করেছিস রে খুশবু। আমাদেরও একটু বল।

-জামাই তো তোর পিছুই ছাড়ছে না। আড়ালে গিয়ে দেখ না বেচারা কী চায়?

কথাগুলো বলে সবাই একসাথে হেসে উঠল। খুশবুর সব রাগ সানের উপর গিয়ে পড়ছে। সানের জন্য মানুষজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। তারপরও এই লোক আঁচল ছাড়ছে না। খুশবু ওখান থেকে চলে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-আপনার সমস্যা কী? এমন কেন করছেন?

সান মিছেমিছি গোমড়া মুখ বানিয়ে ছোটদের মতো বলল,

-আমি তোমার উপর রেগে আছি।

-এটা কেমন রাগ ভাই! মানুষ রেগে থাকলে কথা বলা, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়।

-জানি। কিন্তু আমি না খেলে, কথা না বললেও তো তুমি আমার রাগ ভাঙাতে আসবে না।

-যদি জানতাম আমার কোন ভুলের কারণে আপনি রাগ করেছেন তাহলে নিশ্চয় রাগ ভাঙাতে যেতাম। কিন্তু আপনি তো হুদাই রাগ করে বসে আছেন। আপনার রাগের কারণটাও আমি জানি না।

সান ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উদাস ভঙ্গিতে বলল,

-আজ পর্যন্ত তুমি আমার ভালোবাসাই বুঝলে না৷ আমার রাগ কী বুঝবে?

কথাটা শুনে খুশবু কতক্ষণ পলকহীন চোখে সানের দিকে তাকিয়ে রইল। সানও খুশবুর চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই দাদীর ডাক শোনা গেল। খুশবু কিছু না বলেই ‘আসছি’ বলে চলে গেল। সানের মনটা একটু খারাপ হলো। এতদিনেও খুশবুকে তার ভালোবাসা বোঝাতে ব্যর্থ সে। তবে মন খারাপটাকে সান দীর্ঘ স্থায়ী হতে দিল না। আবার কাজে লেগে পড়ল। বউয়ের মুখ থেকে যতক্ষণ ভালোবাসি কথাটা না শুনবে ততক্ষণ হার মানা যাবে না।

🌸

স্মরণকে এখনও বাইরে ঘুরাঘুরি করতে দেখে পরী বানু এক ধমক লাগালেন।

-ওই নাদান, এহনও ঘুরাঘুরি করতাছোস কেন?

-তাহলে কী করব বুড়ি?

-তৈয়ার হইবি।

-আমি তো আর তোমার নাতনির মতো বউ সাজব না। বর সাজতে পাঁচ মিনিটও বেশি হবে যাবে।

এই ছেলের সাথে কথা বললে মেজাজ খারাপ হবে। তাই পরী বানু অন্য কাজে চলে গেলেন। স্মরণ সুযোগ খুজছে কীভাবে খুশির সাথে দেখা করা যায়৷ কবুল বলার আগেই এত অবহেলা করছে৷ কবুল বলে ফেললে তার তো কোন দামই থাকবে না মনে হচ্ছে।
স্মরণ আশেপাশে খুশবুকে খুঁজতে লাগল। খুশবুকে ধরলে খুশির সাথে দেখা করা সহজ হয়ে যাবে।

-বউ! ও বউ!

খুশবু রাগী চোখে সানের দিকে তাকাল। এ আবার কোন নাটক? সকাল থেকে পেছন পেছন ঘুরছিল। এখন বউ বউ করছে। এই লোকের পাগলামির একটা সমাধান করতেই হবে।

-আপনার সমস্যা কী?

-তুমি আমার সমস্যা।

খুশবু চোখ মুখ কুঁচকিয়ে তাকিয়ে রইল।

-আমি সমস্যা মানে কী?

-তুমি আমার ফিলিংস বুঝো না এটাই সমস্যা।

-আজকে আমার বোনের বিয়ে। আজ অন্তত বিরক্ত করবেন না।

সান মন খারাপ করে বলল,

-আমার ভালোবাসা তোমার কাছে বিরক্তির কারণ?

-আল্লাহ রে! আপনি কিন্তু প্রচুর বিরক্ত করছেন। এমনিতেই আমার মাথা গরম হয়ে আছে। এখনও পার্লারের মহিলা আসেনি৷ কখন খুশিকে সাজানো শেষ হবে। দুপুরে কাজি চলে আসবে। বোনের বিয়েতে আমি নিজেও তৈরি হতে পারছি না। ফকিন্নির মতো ছুটাছুটি করছি।

-আমার কাছে আমার বউই পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী। তোমার আর বাড়তি সাজসজ্জার দরকার নেই। যেমন আছ তেমনই থাকো।

-সামনে থেকে সরুন তো। জ্বালাবেন না একদম।

খুশবু সানকে ঝাড়ি দিয়ে চলে গেল। সামনেই স্মরণ পড়ল। স্মরণ খুশবুকে কিছু বলার আগেই খুশবু ওকেও কথা শুনিয়ে চলে গেল।

-তুমিও বিরক্ত কোরো না তো স্মরণ ভাই। সামনে থেকে সরো।

স্মরণ বোকার মতো চেয়ে রইল। সে কী করেছে? তাকে কেন ঝেড়ে চলে গেল মেয়েটা!

-আল্লাহ দুইটা বোন বানিয়েছে! এদের মেজাজ বাঁধাই করে রাখার মতো।

পার্লার থেকে দু’জন মেয়ে এসেছে। খুশবু ওদেরকে খুশির ঘরে নিয়ে গেল।

-আপনারা এমনিতেই দেরি করে এসেছেন। দুইটার সময় কাজী চলে আসার কথা। এত কম সময়ে সাজাতে পারবেন? দেখবেন তাড়াহুড়ো করে আবার সাজ নষ্ট করে ফেলবেন না। বিয়ের ছবি ভালো না এলে তার দায় আপনাদের।

খুশি চোখে ইশারায় খুশবুকে শাসন করল। মানুষের সাথে এভাবে কথা বলে কেউ? কিন্তু খুশবু সেসবের ধারের কাছেও গেল না।

-বলেছিলেন দশটায় আসবে। এখন বাজে বারোটা। কাজীকে বসিয়ে রেখে কি বউকে সাজাবেন?

-আপু আমরা দশটার সময়ই চলে আসতাম। রাস্তায় দু’জন ড্রাইভার মারামারি লেগে লেগে গিয়েছিল। ওখানেই আটকে লেট হয়ে গেল।

-সেটা তো কল করেও বলতে পারতেন। আমি অন্য ব্যবস্থা করতাম।

খুশি এবার খুশবুকে ধমক দিয়ে চুপ করাল।

-তুই কি এখন সময় নষ্ট করছিস না? তোর জন্য তো আরও দেরি হচ্ছে।

খুশবু মুখ বাঁকিয়ে তাকাল। কথায় আছে না, যার জন্য করলাম চুরি সে-ই বলে চোর! শুধু পার্লারের মহিলা না। খুশবু আজ চোখের সামনে যাকে পাচ্ছে তারই ক্লাস নিচ্ছে।
ভেতরের ঝামেলা শেষ করে এবার বাবুর্চিদের কাছে এলো। পোলাও, মুরগির রোস্ট আর গরুর মাংস হয়ে গেছে। এখন শুধু পায়েস রান্না বাকি। বাঁধছে তাদের পাড়ারই এক কাকা।

-কাকা রান্না শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে?

-এইতো মা। শেষই ধর।

-ধরাধরি করা যাবে না কাকা। মেহমান কিন্তু আসতে শুরু করেছে।

-আসতে থাকুক। আমার রান্নাও শেষ। তুই একটু খেয়ে দেখবি গরুর মাংস কেমন হয়েছে?

-এখন সময় কোথায়? আমার অনেক কাজ।

খুশবুকে এতটা দায়িত্ব নিতে দেখে কাকা হাসলেন। খুশবুটাও বড় হয়ে গেছে। গেটের ভেতর পা রেখেই মার সামনে পড়ল খুশবু। এতক্ষণ সে সবাইকে ধমকা ধমকি করলেও এবার মানছুরার কাছে তাকে ধমক খেতে হলো। খুশবুর পরনের কাপড়ের দিকে তাকিয়ে মানছুরা বলল,

-কেউ বলবে তুই বউয়ের বোন? নিজের কী অবস্থা বানিয়ে রেখেছিস! জামাই মনে মনে কী ভাববে। এক্ষুনি নিয়ে এসব কাপড় পাল্টে ভালো কিছু পর।

-ভালো কাপড় পরে সেজেগুজে কি কাজ করা যায়?

-তোকে কাজ করতে কে বলেছে?

-আমি কাজ না করলে কে করবে? স্মরণ ভাই কি নিজের বিয়ের তদারকি করতে পারবে?

-কাউকে কিছু করতে হবে না। এখন তুই গিয়ে তৈরি হবি। আমি যেন তোকে এই অবস্থায় আর না দেখি।

দূর! কাজ করেও বকা খেতে হয়। মায়ের বকার পেছনের ভালোবাসা খুশবু আজও বুঝতে ব্যর্থ হলো।
গোসল করে ঘরে এসে শুকনো একটা গামছা দিয়ে আগে চুল পেঁচাল। চুলের পানি পড়ে ঘর ভিজে যাচ্ছে। তার কাপড়চোপড় সব লাগেজে। কিছুই নামানো হয়নি। খুশবু লাগেজ খুলে এক এক করে খুঁজতে লাগল আজ কী পরা যায়। প্রথমে ভেবেছিল শাড়ি পরবে। কিন্তু এখন মত পাল্টে ফেলেছে। এই গরমে শাড়ি পরা কোন আজাবের থেকে কম না। তাই খুশবু সিম্পলের মধ্যে একসেট থ্রিপিস বের করে রাখল। সানও তো রেডি হয়নি। খুশবু সানের কাপড়ও নামিয়ে রাখার জন্য ওর লাগেজ বের করল। লাগেজ খুলেই সবার উপরে একটা শপিং ব্যাগ দেখতে পেল। খুশবুর সামান্য কৌতূহল হলো। কী আছে এটার ভেতর। বরের জিনিস সে দেখতে পারবে। এতে অন্যায় কিছু নেই। ব্যাগটা খুলে খুশবু হতভম্ব হয়ে গেল। ভীষণ সুন্দর একটা শাড়ি। কালারটাও তার ফেভারিট।

-এটা কি উনি আমার জন্য এনেছেন! তাহলে আমাকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন কেন?

খুশবু কিছু একটা ভাবল। তারপর শাড়িটা রেখে থ্রিপিস তুলে রাখল। আজ সে এটাই পরবে।
খুশবুর শাড়ি পরা তখনও শেষ হয়নি। কোনভাবেই কুঁচি ঠিক করতে পারছে না। জর্জেট শাড়ির এটাই এক সমস্যা। এমন সময় দরজা খুলে গেলে ঝট করে সামনে তাকাল। সানও ভাবেনি ভেতরে খুশবু আছে। দু’জনই অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। সান ভেতরে আসবে নাকি আবার ফেরত যাবে বুঝতে পারছে না।

-আপনি নক করে আসতে পারেন না!

-তুমি ভেতরে আছো জানতাম না।

-জানতেন না সেজন্যই তো নক করে আসা উচিত ছিল।

সান এবার খুশবুর দিকে সরাসরি তাকাল। খুশবু তার আনা শাড়িটা পরেছে দেখে মৃদু হাসল। শাড়িটা সে খুশবুকে দিতে পারেনি। দেওয়ার সুযোগই হয়নি। তারপরও খুশবু শাড়িটা পরছে দেখে বুকের ভেতর অজানা এক ভালোলাগার শিহরণ খেলে গেল। ধীর পায়ে খুশবুর দিকে এগোতে এগোতে বলল,

-তোমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে আমার নক করে না আসায় অপরাধ হতো৷ কিন্তু এখন তুমি আছো। সুতরাং আমি কোন অপরাধ করিনি।

লোকটার সাথে কথায় পেরে উঠা যায় না। সান খুশবুর অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। তা দেখে খুশবু বলল,

-আপনি এখন একটু বাইরে যান। আমার শাড়ি পরা প্রায় শেষ।

-তুমি শাড়ি পরো। আমি কি বাধা দিয়েছি?

-আপনি এখানেই থাকবেন!

-কেন? আমি থাকলে কোন সমস্যা?

-জি। আপনি এখানে থাকতে পারবেন না। আমি কি আপনার সামনে শাড়ি পরবো?

-পরতেই পারো। আমি তোমার দিকে তাকাব না। আর যদি তাকাইও এতেও কোন অন্যায় নেই। সর্বাবস্থায় তোমার দিকে তাকানোর লাইসেন্স আমার আছে।

সানের কথা শুনে খুশবু বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। এই লোকের আজ কী হলো? এমন উদ্ভট উদ্ভট কথা কেন বলছে! কঠিন কথায় কাজ হবে না ভেবে খুশবু এবার অনুরোধের সুরে বলল,

-আপনি একটু বাইরে যান না। কেন তর্ক করে আমার সময় নষ্ট করছেন।

সান বাইরে যাওয়ার বদলে বিছানায় এসে বসল। ঠোঁট মৃদু হাসি নিয়ে বলল,

-তর্ক করে সত্যিই সময় নষ্ট করছো। এতক্ষণে তোমার শাড়ি পরা শেষ হয়ে যেত।

রাগে খুশবুর এই লোকের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কত বড় শয়তান লোক ভাবা যায়। বাইরে যাওয়ার বদলি গেঁড়ে বসেছে। অন্য ঘর ফাঁকা হলে খুশবু সেখানেই চলে যেত৷ কিন্তু আফসোস এসময় এই ঘর ছাড়া কোন ঘরই ফাঁকা নেই। কী আর করার, বদ লোকটা যেহেতু যাবেই না তাকে সানের সামনেই শাড়ি পড়তে হবে। সান এখানে বসে পড়লেও একবারও খুশবুর দিকে তাকায়নি। অন্য দিকে তাকিয়ে থেকেই বলল,

-শাড়ি পরায় হেল্প লাগলে আমাকে বলতে পারো। আমরা আমরাই তো। লজ্জা পেয়ো না। সাধ্য মতো তোমাকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।

খুশবু আগুন চোখে তাকিয়ে দৃষ্টি দিয়েই সানকে ভস্ম করে দিতে চাইল। ইতর লোক!

চলবে