কমলা রঙের রোদ পর্ব-৩৯

0
2

#কমলা_রঙের_রোদ [৩৯]
#জেরিন_আক্তার_নিপা

একদিন বিকেলে মা ছেলে বাগানে পাতা চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে গল্প করছে। খুশবুই চা দিয়ে গেছে। ওকেও সাথে বসতে বলেছিল। কিন্তু তার নাকি কাজ আছে। চায়ের কাপ সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে মিসেস সুলতানা ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব। সত্যি করে উত্তর দিবি।

সান নড়েচড়ে বসল। আগ্রহ নিয়ে মার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,

-যদিও আমি মিথ্যা কথা খুব কম বলি। কিন্তু তোমার প্রশ্নের ধরনের উপর সত্য মিথ্যা উত্তর নির্ভর করবে।

-তুই মিথ্যা বললেও কিন্তু আমি ধরে ফেলব।

-তাহলে তো সত্যই বলতে হবে। আচ্ছা বলো কী জানতে চাও।

মিসেস সুলতানা ভাবছেন কথাগুলো কীভাবে বললে ভালো হবে। যদিও জানেন তার ছেলে কিছুই মনে করবে না।

-স্বামী স্ত্রীর ব্যক্তিগত অনেক বিষয় থাকে। আমি এটাও জানি কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানো উচিত না। কিন্তু আমাকে গলাতে হচ্ছে। কারণ আমি আমার বৌমাকে আর এভাবে দেখতে পারছি না।

সানও চায়ের কাপ রেখে দিল। এতক্ষণ দুষ্টুমি মনে থাকলেও এখন সিরিয়াস হলো।

-তোদের মাঝে কি কোন ঝামেলা হয়েছে? বৌমা বাড়িতে সবসময় মনমরা হয়ে থাকে। আবার তুই বাড়ি এলে তোর সামনে হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করে। আমি অবশ্য খুশবুকেও জিজ্ঞেস করেছি কী হয়েছে। কিন্তু মেয়েটা আমাকে কিছুই বলছে না। তুই আমার ছেলে। তুই অন্তত মিথ্যা বলিস না। কী হয়েছে তোদের মাঝে?

সান একটু হাসল। কিন্তু হাসিটা যে মন থেকে আসেনি জোর করে আনা তা যে কেউ বুঝে ফেলবে।

-তুমি একটু বেশিই চিন্তা করছো মা। আমাদের মাঝে কিছুই তো হয়নি।

সান এখনই মাকে কিছু জানাতে চায় না। কিন্তু মাকে মিথ্যা বলেও বোঝানো যাবে না। মিসেস সুলতানা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই ছেলে মিথ্যা বলতে পারে না। সান মিথ্যা বলছে জেনেও মিসেস সুলতানা আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।

-ঠিক আছে। মেনে নিলাম তুই সত্য বলছিস।

ওদের কথার মাঝেই খুশবু চলে এসেছে। খুশবুকে দেখে মিসেস সুলতানা আলোচনা ঘুরিয়ে নিলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

-আমাদের সাথে চায়ের আড্ডার থেকে আর কী জরুরি কাজ করে এসেছ শুনি?

খুশবু অন্য একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল,

-এখন বলে দিলে সারপ্রাইজ থাকবে না।

সানও উৎফুল্ল গলায় বলল,

-সারপ্রাইজ কি শুধু শাশুড়ির জন্যই? নাকি আমার জন্যও?

-দু’জনের জন্যই।

মিসেস সুলতানা জানতে চাইলেন,

-সারপ্রাইজটা কী তা কি বলা যাবে?

-না। কিন্তু রাতে খাবার টেবিলে বসলেই দেখতে পারবেন।

সান খুশবুর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

🌸

স্মরণ খুশির কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। খুশি আলতো হাতে ওর চুল টেনে দিচ্ছে। সারাদিনের সব ক্লান্তি এখানে এসেই মুছে যায়। ঘুমঘুম একটা ভাব চলে এসেছে।

-খুশবু কি আসে না?

-আসে। গতকালও এলো।

-হারামিটা আমার সাথে দেখাও করে না।

-কীভাবে করবে? তুমি তো অফিসে থাকো।

-কাল তো শুক্রবার। কাল ওদের আসতে বলি?

-বললে ভালোই হবে।

স্মরণ বকবক করছে। কিন্তু খুশি যেন কেমন চুপ মেরে গেছে। অনেকক্ষণ একা একা কথা বলে খুশির তেমন সাড়াশব্দ না পেয়ে স্মরণ ঘাড় সোজা করে খুশির দিকে তাকাল। মুখ চোখা করে বলল,

-কোন ধ্যান ধরেছিস?

-হু? না, কোন ধ্যানই ধরিনি।

-তাহলে বল এতক্ষণ আমি কী কী বলেছি।

খুশি বলতে পারল না। কারণ তার মনোযোগ অন্য দিকে ছিল। স্মরণ এবার উঠে বসল। ভালো করে খুশিকে দেখে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,

-কী ভাবছিস খুশি?

-খুশবুর যেন কী হয়েছে। ওকে এখন কেমন অন্যরকম লাগে।

-অন্যরকম কেমন?

-কেমন যেন। ওকে এখন আগের সেই খুশবু মনে হয় না।

-মনে না হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? বিয়ের পর ছেলের থেকেও বেশি মেয়েদের মাথায় সংসারের বোঝা চেপে যায়। আগের অবুঝ খুশবুর সাথে এখনকার সংসারী খুশবুর মিল কেন খুঁজছিস?

স্মরণ যতই বোঝাক খুশির মন কোন কিছুতেই মানতে চায় না। খুশবুটার বড়ো কোনকিছু হয়েছে। নইলে ওর মধ্যে এত পরিবর্তন আসত না।

🌸

খুশির যেদিন প্রসব বেদনা উঠেছে সেদিন খুশবু খুশির সাথেই ছিল। খুশিকে যন্ত্রণায় এতটা কাতরাতে দেখে খুশবু কী করবে বুঝতে উঠতে পারছিল না। সে গলা ফাটিয়ে মাকে ডাকল। মানছুরা রান্নাঘরে ছিল। খুশবুর ডাক শুনেই বুঝে গেল খুশির হয়তো কিছু হয়েছে। পরী বানুও ঘর থেকে ছুটে এলেন। দাদী কোন মহিলাকে নিয়ে আসতে বললেও খুশবু সবার আগে স্মরণকে কল করল। স্মরণ কল না তুললে সানকে কল করল। সানও শ্বশুরবাড়ি আসার পথেই ছিল। এই খবর পেয়ে সে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে সান চলে এসেছে। খুশবুকে প্রথম শান্ত হতে বলে বলল,

-কী করবে এখন?

-জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না।

যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সানই নিল। খুশিকে বাড়িতে রেখে রিস্ক নেওয়ার চেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালো মনে করল। খুশির প্রতিটা আর্তনাদে খুশবু হাত-পা অচল হয়ে পড়ছে। সান খুশিকে গাড়ি পর্যন্ত নিতে মা দাদী খুশবু সবার সাহায্য চাইল। কিন্তু খুশি দাঁড়াতেই পারছে না। তাই উপায় না পেয়ে সান খুশিকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়িতে এনে শুইয়ে দিল। খুশির মাথা কোলে তুলে নিয়ে খুশবুও পেছনে বসল। খুশি সমানে ঘামছে। খুশবু খুশির কপালের ঘাম মুছে দিয়ে সাহস দিয়ে বলল,

-একটু সহ্য করে নে খুশি। এক্ষুনি আমরা হাসপাতাল পৌঁছে যাব। আরেকটু ধৈর্য ধর বোন।

খুশি কোনভাবেই এই তীব্র ব্যথা সহ্য করতে পারছে না। সবচেয়ে কাছে যে হাসপাতালটা ছিল সান খুশিকে সেখানেই নিয়ে এসেছে। হাসপাতালে নিয়ে আসার সাথে সাথে নার্স ডাক্তাররা বাকি দায়িত্ব বুঝে নিল। খুশবু অস্থির হয়ে পায়চারি করছে। একজন নার্সকে ধরে জানতে পারল নরমাল ডেলিভারিই হবে। সান জিজ্ঞেস করল,

-স্মরণ কখন আসবে?

-স্মরণ ভাইকে এখনও জানানো হয়নি। কল দিয়েছিলাম কিন্তু তুলেনি।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে সান স্মরণকে কল করল। স্মরণকে ঘটনা জানিয়ে চিন্তিত না হতে বলে সোজা হাসপাতালে চলে আসতে বলল।

স্মরণ হাসপাতালে পৌঁছে খুশির কোলে ফুটফুটে এক নবজাতককে দেখতে পেলো। স্মরণকে দেখে খুশবু এগিয়ে গেল। বাধভাঙ্গা খুশিতে উপচে পড়ে বলল,

-ছেলের বাবা, খালি হাতে এসেছ তুমি! মিষ্টি নিয়ে আসোনি কেন?

স্মরণের কাছে এখনও সবকিছু স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। সে খুশির দিকে তাকাল। খুশির ঠোঁটেও হাসি। স্মরণ কাছে এগিয়ে গেল। প্রথমবারের মতো ছেলেকে দেখে তার সর্বশরীর কেমন অবশ হয়ে আসতে লাগল। পরী বানু বললেন,

-খালি দেখবিই? ছেলেরে কোলে নিবি না।

মানছুরা এগিয়ে এসে খুশির কোল থেকে বাবুকে নিয়ে স্মরণের হাতে তুলে দিল। স্মরণ ভয় পাচ্ছে। এই তুলোর মত নরম শরীরটাকে কি সে দু’হাতে রাখতে পারবে? সন্তানকে প্রথমবার স্পর্শ করে স্মরণ আবেগ ধরে রাখতে পারল না।

-আমার বাপ!

পৃথিবীর অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে এই দৃশ্যটা মনে হয় একটু বেশিই সুন্দর। সান মুগ্ধ চোখে ওদেরকে দেখছে। খুশবুর হঠাৎ সানের দিকে তাকিয়ে বুক পুড়তে লাগল। এই সুখ কি সে সানকে কোনদিনও দিতে পারবে? তার জন্য মানুষটা কোনদিনও বাবা ডাক শুনতে পারবে না কথাটা মনে পড়লেই খুশবুর বেঁচে থাকা বিস্বাদ হয়ে উঠে।

🌸

মা ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। পাড়ার প্রত্যেকে খুশির ছেলেকে দেখতে আসছে। ওরা শুধু খুশির ছেলে দেখেই চলে যাচ্ছে না। খুশবুকেও মনে করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, তুই কবে খুশির খবর শোনাবি? এই প্রশ্নেই খুশবুর খালা হওয়ার আনন্দ ফিকে পড়ে যায়। তাই এখন আর কেউ এলে খুশবু সামনে যায় না। তাকে দেখলেই সবার এক কথা। সান খুশবুকে বাইরে থেকে খুঁজে ঘরে এসে পেলো।

-ঘরে বসে আছো কেন? বাইরে তোমাকে খুঁজছে।

খুশবু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

-কেন খুঁজছে?

সান কতক্ষণ খুশবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ওর পাশে এসে বলল। হাত ধরে বলল,

-আমার বউয়ের কি মন খারাপ?

-না।

-কেউ কিছু বলেছে?

খুশবু জলে টলটলে চোখে সানের দিকে তাকিয়ে বলল,

-সবাই কেন আমাকে বারবার মনে করিয়ে দেয় আমি মা হতে পারব না।

চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না খুশবু। সান খুশবুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,

-তোমার মাথায় এই কথা কে ঢুকালো বলো তো? ডাক্তার তো বলেনি তুমি কোনদিন মা হতে পারবে না। সমস্যা আমাদের কারোরই নেই। আল্লাহ যখন চাইবেন তখনই আমরা বাবা মা হতে পারব।

খুশবু সব দোষ নিজের উপর নিচ্ছে। সান অনেক বুঝিয়েও ওর এই ধারণা পাল্টাতে পারেনি। খুশবুর মনে হয় তার মধ্যেই কোন সমস্যা আছে।

-আর কোনদিন যদি তোমাকে এই কথা বলতে শুনেছি তাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না। তুমি শুধু নিজেকে দোষ দিচ্ছ না। সাথে আমাকেও শাস্তি দিচ্ছ।

খুশবু তার চোখের পানি দিয়ে সানের শার্ট ভেজাচ্ছে। সান আলতো হাতে খুশবুর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছে। বিয়ের আগে খুশবুকে যতটা মারকুটে মনে হয়েছিল বিয়ের পর বুঝতে পারছে এই মেয়ের মন ততটাই কোমল। সামান্য বিষয়ও মনে লেগে যায়। কান্না করে ফেলে।

চলবে