#কলঙ্কের_সংসার
#ফৌজিয়া_কবির
#পর্ব_০১
চার সন্তানের মা বিলকিস, নিজের সন্তানদের ছেড়ে, তারই ছেলের মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে এমন একজন হুজুর, তার হাত ধরে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছে। বিলকিসের স্বামী রহিস উদ্দিন সৌদি আরব প্রবাসী।
কি ভাবছেন? বিলকিস বাজে মহিলা? কীভাবে চারটা বাচ্চা রেখে চলে গেল?
আগে আসল কাহিনী তো শুনুন।
বিলকিসের প্রাক্তন স্বামী রহিস ১০ বছর যাবত বিদেশে। বিলকিসের বিয়ের বয়স ১৫, তার বড় মেয়ের বয়স ১৪। বিলকিসের ছোট ছেলে তার ৭ বছর বয়স। রহিসের ইচ্ছে তার এক ছেলেকে কোরআনের হাফেজ বানাবে। সেই অনুযায়ী ছেলেকে একটা ভালো মাদ্রাসায় ভর্তি করে। ছেলেকে দিয়ে দিতে হয় মাদ্রাসার বোডিং এ৷ ছেলের খোঁজখবর নেওয়ার সুবাদে বিলকিসের পরিচয় হয় মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করা উসমান এর সাথে। এতো ছোট ছেলের হাতে মোবাইল তো আর দেওয়া যায় না, তাই বিলকিস উসমানকে কল দিয়ে ছেলের খোঁজখবর নেয়, ছেলের সাথে কথা বলে। তাদের সম্পর্ক এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। উসমান যথেষ্ট সংযমের অধিকারী তিনি কোনোদিন বিলকিসের নাম্বারে অহেতুক কল দিয়ে খোশগল্প জমাতে চেষ্টা করেনি। বিলকিসও তাই, ছেলের শিক্ষক হিসাবে উসমানকে যথেষ্ট সম্মান করে।
কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন বিলকিসের ভাসুর জানতে পারে বিলকিস উসমান হুজুর কে কল দেয়। একদিন বিলকিসের ছেলে বাড়ি আসে, কথাকথায় বলে যে আমি আম্মুর সাথে উসমান হুজুরের মোবাইল দিয়ে কথা বলি।
বিলকিসের ভাসুর দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে বিলকিসের নামে রটিয়ে দেয় নোংরা কথা। বিলকিসের নাকি উসমান হুজুরের সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে।
বিলকিসের উপর তার ভাসুরের ক্ষোভ ছিল। সেই ক্ষোভের কারন হচ্ছে টাকা। বিলকিসের স্বামীর কষ্টার্জিত টাকা তার বড় ভাই ধুলোর মতো উরাতো, নিজে কোনো কাজ কাম করতো না। বিলকিস তার স্বামীকে সব খুলে বললে রহিস আলাদা হয়ে যায়। রহিসের পৈতৃক সম্পত্তি বলতে শুধু ভিটে টুকু আর অল্প একটু ফসলি জমি, যার সবটাই রহিস ভাইকে দিয়ে দেয়। কিন্তু তবুও
বিলকিসের ভাসুর রহিম তার বউ বাচ্চা নিয়ে পরে সংকটে। কোনো কাজ কাম না করে খাওয়া রহিম যে কিনা ভাই বিদেশ যাওয়া পরে পা ঘারে তুলে শুধু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিন কাটিয়েছে। এখন কোনো কাজও খুজে পাচ্ছিলো না বিধায় তার বউ বাচ্চাকে এক প্রকার না খেয়ে থাকতে হয়।
বিলকিসের বড় জা বিলকিসের থেকে চাল ডাল এটা ওটা চেয়ে নেয়। বিলকিস দরদী হয়ে তাদের সাহায্য করে। কিন্তু লোভী রহিম আবারও এটা ওটা চাইতে থাকে। হাজার, দু হাজার টাকা চেয়ে নিলে আর ফিরিয়ে দিতো না, বিলকিসও চাইতো না। কিন্তু এইভাবে একদিন ২০,০০০ টাকা চেয়ে নেয়, বিলকিস ও দিয়ে দেয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন, বিলকিস যখন টাকাটা ফেরত চায়। প্রায় বছর খানিক পরে বিলকিস ২০,০০০ টাকা চায়, যখন টাকাটা তার সত্যিই দরকার ছিল।।কিন্তু রহিম টাকা না দেওয়ার জন্য নানান বাহানা দেখায়।
বাধ্য হয়ে বিলকিস রহিসকে সবটা জানালে রহিস খুব রাগারাগি করে, এই পর্যায়ে রহিসের ঝগড়া হয় রহিমের সাথে। সেই থেকে দুই ভাইয়ের সম্পর্কে ফাটল ধরে।
বহুদিন ধরেই রহিম মনে ক্ষোভ পুষে রেখেছিলো, এখন তা উগরানোর সময়। রহিম দেরি না করে রহিসের কাছে কল দিয়ে বলে, শুধু এইটুকু না। বিলকিস নাকি উসমান কে বাড়ি নিয়ে আসে। উসমানের সাথে রাত কাটায়, রহিম নাকি কয়েকবার দেখেছে। ওদের প্যারালাইসড্ মা নাকি সব দেখে চোখের পানি ফেলেন। ( রহিম ও রহিসের মা প্যারালাইসড্, বাবা তো অনেক আগেই গত হয়েছে। প্যারালাইসড্ মায়ের যাবতীয় দায়িত্ব রহিস নিয়েছে। শ্বাশুড়ির সব দেখবাল বিলকিস করে, উনার মল-মুত্র নিজেই পরিষ্কার করে, নিজের মা মনে করে। কারন বিলকিস ছোট বেলায় তার মা হাড়িয়েছে।)
বড় ভাইয়ের কথা শুনে রহিস আর সত্যি মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করেই তৎক্ষনাৎ বিলকিসকে কল দিয়ে মৌখিক তালাক দেন।
এদিকে বিলকিস বোবার মতো হয়ে যায়, তার কথা বলার কোনো ভাষাই থাকে না। পনেরো বছরের সংসার জীবনে স্বামীর থেকে এতোটুকুও বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি? এই ভেবে বিলকিসের ভীষণ কষ্ট অনুভব হয়। আচ্ছা বিশ্বাস না করোক, বিষয়টা একটাবার যাচাই করে তো দেখবে? নিজের সন্তানদের কথাটা তো একবার ভাববে।
বিলকিস ভাবে রাগের মাথায় স্বামী তালাক দিয়েছে, সবটা শুনলে হয়তো বুঝতে পারবে, সবটার সমাধান হবে। বিলকিস নড়েচড়ে না তেমন একটা। রহিস বিলকিসের নাম্বারে ব্লক দিয়ে দেয়, বিলকিসের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখেনি আর। স্বামীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না থাকলেও বিলকিস তার সন্তান দের নিয়ে বেশ চলছিলো এই ভেবে যে সব ঠিক হয়ে যাবে, পরিশেষে সত্যের জয় হয়। কিন্তু না, বিলকিসের আশা মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে তার কিছুই হলো না। মৌখিক তালাকের ১২ দিনের মাথায় রহিম আসে, কোর্ট থেকে তালাকনামা নিয়ে। এই দেখে বিলকিস বলে
” তালাক দিলেই হলো? আমি আমার বাচ্চাদের ছেড়ে কোথাও যাবো না, উনার বউ হিসাবে না থাকি, আমি আমার বাচ্চাদের মা হিসাবে ওদরে পাশে থাকতে চাই। ”
এই বলে বিলকিস তার বাচ্চাদের জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে।
রহিম বিলকিসের ভাইয়েদের খবর দেয়। আট ভাইয়ের একমাত্র বোন বিলকিস, আদরের জিলাপি বলে ডাকতো সবাই। ভাইয়েদের জানের টুকরা।
বিলকিসের বড় দুই ভাই এলো। আলোচনা সভা বসলো। আশ্চর্য ভাবে সভায় বিলকিসের কথা কেউই বিশ্বাস করলো না। উসমানও এখানে উপস্থিত ছিলো।সবাই উসমান আর বিলকিস কে জড়িয়ে যা নয় তা বলছিলো। উসমান কিন্তু অবিবাহিত। উসমানের কথায়ও কেউ গুরুত্ব দিচ্ছিলো না৷
বিলকিস ভেবেছিলো আর যাই হোক তার ভাইয়েরা তাকে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। বিলকিস ও চলে যাবে। গিয়ে পরে থাকবে বাপের বাড়ি। তার সন্তানের বড় হলে একদিন ঠিকই মায়ের টানে তার কাছে যাবে।
কিন্তু বিলকিসের সব আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দেয় তার দুই ভাই। তারা জানায় তাদের জীবনে চরিত্রহীন বোনের কোনো জায়গা নেই। এখন থেকে তাদের কোনো বোন নেই। বিলকিস কি করলো, কোথায় গেলো, তা নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই, তাদের কিছু যায় আসে না। বিলকিস তার ভাইয়েদের জন্য মরে গেছে। এই কথাটা বিলকিসের বুকে ছুরির মতো বিধে। আজকে যদি বিলকিসের মা বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে কি তারাও এইসব বলতো? তারা কি বিলকিস কে একটু বিশ্বাস করতো না? ছোটবেলা থেকে যে বিলকিস তাদের চোখের সামনে বড় হয়েছে, তার চরিত্রে যদি সমস্যা থাকতো তারা কি টের পেতো না?
এই মুহুর্তে এসে বিলকিসের নিজেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে অসহায় মনে হয়। অথচ সবাই বলতো বিলকিস রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছে। বাবা মায়ের ভীষণ আদুরে ছিলে ছোটবেলায়।
এই মুহুর্তে বিলকিসের পাশে কেউ নেই। তার ভাইয়েরা তাকে ছেড়ে চলে যায়।
অসহায়ের মতো বিলকিস উঠোনে বসে পরে। তার ভাসুর আর তার জা বিলকিসের বাচ্চাদের ও তার কাছে আসতে দিচ্ছিলো না। বাড়ির গ্রিলে তালা লাগিয়ে দিয়ে দেয়। অনেক্ষন যাবত বিলকিস গ্রিল ধরে ধাক্কায়, কতো আকুতি মিনতি করে, কিন্তু তার ভাসুর তাকে পুলিশের হুমকি দেয়। এখান থেকে না গেলে বিলকিসকে পুলিশে ধরিয়ে দিবে বলে।
বিলকিসের এই করুন মুহুর্তে যখন আপন জনেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো তখন তার পাশে এসে দাড়ায় উসমান। বিলকিসকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিয়ে যায় তার বাড়িতে, কথা দেয় তাকে বিয়ে করবে। কিন্তু অবিবাহিত উসমানের পরিবার ছেলের থেকে বয়সে বড়, চার বাচ্চার মা বিলকিসকে তাদের ছেলের বউ হিসাবে কিছুতেই মানতে চায় না, উসমানের বাড়িতে বিলকিসের ঠাই মিলে না। ফলে উসমান বিলকিসকে নিয়ে চলে আসে বাড়ি ছেড়ে। উসমানের কথা হলো তার সাথে জড়িয়ে বিলকিসের এতো কলঙ্ক, এর দায় অবশ্যই তার আছে। হাদিসে তালাক প্রাপ্ত মহিলাদের বিয়ে করে তাঁদের দায়িত্ব নেওয়া জায়েজ। কিন্তু বিলকিসকে তিন মাস ইদ্দত পালন করতে হবে। উসমান তার এক সহকর্মীর বাসায় কথা বলে বিলকিসকে সেখানে রাখার ব্যবস্তা করে।
চলবে?