#কলঙ্কের_সংসার
#ফৌজিয়া_কবির
#পর্ব_০২
তিন মাস ইদ্দত পালনের পর উসমান আর বিলকিসের বিয়ে হয়। মাদ্রাসার পাশে ছোট একটা ঘর ভাড়া নিয়ে শুরু হয় উসমান আর বিলকিসের সংসার। নতুন সংসারে স্বামীর সুখ পেলেও বিলকিস তার চার সন্তান হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারে না। বিলকিসের ছোট ছেলে আলীর সাথে তার দেখা হতো সে আলীর থেকে বাকিদের খবরাখবর নিতো কিন্তু রহিম বিষয়টা জানতে পারার পর বিলকিসের ছেলেকে আর এই মাদ্রাসায় পাঠায় না।
উসমানের সাথে বিলকিসের বিয়ে হওয়ার পর লোকজন রহিমের কথা সত্যি বলে মেনে নেয়। লোকজন বলে যে কোনো লটরপটর না থাকলে কি আবিয়াইত্যা ( অবিবাহিত) বেটা মানুষ চার বাচ্চার মায়েরে বিয়া করবো? লোকজন কথা বলার সময় মুখ ভরে বলতে পারে কিন্তু বিপদের সময় কেউ এসে পাশে দাড়াতে পারে না।
বিলকিসের ছেলে মেয়ে বাড়ি থেকে বেরুতে পারে না, লোকজন তাদের খোঁচা দিয়ে কথা বলে। বড় মেয়ে লিনা, স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। চাচি তাকে দিয়ে বাড়ির যাবতীয় কাজ কাম করিয়ে নেয়, অথচ তার থেকে বড় চাচাতো বোন সে একটা জিনিস এদিক থেকে ওদিক করে না, উনিশ থেকে বিশ হলে চাচিও লিনাকে কথা শুনাতে ছাড়ে না।এতটুকু লিনার চরিত্র নিয়ে খুব বাজে বাজে কথা বলে। লিনা রাত হলে বালিশে মুখ চেপে কান্না করে, মাকে অভিশাপ দেয়, তাদের এই অবস্থার জন্য মা’ই দায়ী।
বিলকিসের বড় ছেলে লিমন, যে তাদের এলাকায় একটা হাইস্কুলে সেভেনে পড়ে, বয়স আর কয়টা, একদিন এক সহ পাঠী তাকে তার মাকে নিয়ে বাজে কথা বলে। লিমনের বাপ নাকি বিদেশ থেকে টাকা পয়সা দেয় না, লিমনের মা বে*শ্যা গিরি করে টাকা কামিয়ে বাড়িঘর করেছে, তাদের ভরনপোষণ জুগিয়েছে।
এই কথা গুলো শুনে লিমন ক্ষেপে গিয়ে ওই ছেলের সাথে ঝগড়া করে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। স্কুলের প্রিন্সিপাল অভিভাবক ডাকে। লিমনের অভিভাবক হিসাবে রহিম স্কুলে যায়। প্রিন্সিপাল লিমনের হাতে টিসি ধরিয়ে দেয়, রহিমকে অনেক কথা শুনিয়ে তারপর বিদায় করে। বাড়ি ফিরে রহিম লিমনকে পেন্টের বেল্ট দিয়ে ইচ্ছে মতো মারে, জায়গায় জায়গায় কালো জখম হয়ে গিয়েছিলো।মারার পর রহিম ভয় দেখায় যে যদি তাদের কেউ এসব কথা রহিসের কাছে লাগায় তাহলে তাদের মেরে পুতে দিয়ে বলবে তারা মায়ের কাছে চলে গেছে। ছোট বাচ্চারা এতো কিছু কি বুঝে? এই বয়সে যাদের বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় বড় হবার কথা তারা জীবিত মা বাবা রেখেও অনাথের মতো জীবনযাপন করছে। ওদিকে প্রবাসী বাবা ঘুনাক্ষরেও টের পাচ্ছেনা কিছু।
রাতে চার ভাইবোন একসাথে এক রুমে বসে জড়াজড়ি করে কান্না করছে। লিনা লিমনের শরীলে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান হচ্ছে আহান। যার বয়স সবে দশ বছর।
সে মনে মনে ফন্দি আটে কোনোভাবে বাবাকে সবকিছু বলে দিবে। একমাত্র আহান তার মাকে বিশ্বাস করে। বিলকিস সবথেকে বেশি আদর আহান কেই করতো। কিন্তু বড় মেয়ে চৌদ্দ বছরের হয়েও এতো ঘোরপেঁচ বুঝতে পারলো না। চারজনের মধ্যে কেউই আর রাতের খাবার খেলো না। ওদের কেউ ডাকতেও আসেননি, অবশ্য কোনোদিন ডাকেও না।
রহিসের সহ্যসায়ী মা, তাকে যত্ন করার মতো আর কেউ নেই। এই কয়দিনে যত্নহীন অবস্থায় তিনি প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে। নিজের মলমূত্রে রাতদিন একই অবস্থায় পরে থাকে, বাচ্চা মেয়ে লিনা মাঝে মাঝে এসে পরিষ্কার করিয়ে দিয়ে যায়। লিমনকে রহিম উনার সামনেই মেরেছে, লিমনের মাইর খাওয়া দেখে উনার চোখ বেয়ে টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পরতে থাকে। এতো কষ্ট তিনি সহ্য করতে না পেরে রাতেই দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করেন।, প্রতিদিন লিনাই দাদির খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে যথাসাধ্য সব খোঁজ খবর রাখতো, কিন্তু আজকে লিনার মন ভালো নেই বিধায় আর দাদির কাছে আসেনি।
সকালে লিনাই দাদিকে দেখতে এসে দেখে দাদির আর শ্বাস চলছে না, চিৎকার দিয়ে কান্না করে লিনা চাচিকে ডাক দেয়। লিনার চাচি ঘুমঘুম চোখে আসে। শ্বাশুড়িকে মৃত অবস্থায় দেখে যেনো উনার এক ফোটাও মন খারাপ হয়নি। উল্টো তিনি বলে ভালো হয়েছে, উনি মরছে, জায়গাটা খালি করে দিয়ে গেছে। লিনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে চাচির দিকে। একটা পালিত কুকুর মরলেও মানুষের কষ্ট হয়, আর এটা তো জলজ্যান্ত একটা মানুষ, চাচির একটুও কষ্ট হচ্ছে না?
লিনার দাদির দাফন সম্পন্ন হয়। বিলকিস প্রাক্তন শ্বাশুড়ির মৃত্যুর সংবাদ শুনে তাকে দেখতে আসতে চান, কিন্তু উসমান বাধা দেয়। ও জানে যে রহিম তাকে বাড়িতে ঢুকতে দিবে না।
বেশ কদিন কেটে যায়। বিলকিসের তিন ছেলেই এখন মাঠে কাজ করে, আর মেয়ে ঘরে, বাবার সাথে তাদের কথা হয় নিয়মিত, রোজ কথা বললেও তারা সাহস করে তাদের কষ্টের কথা বলতে পারে না, তাদের একটাই প্রশ্ন, আব্বা তুমি আইবা কবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে রহিস নিশ্চুপ থাকে। মাঝে মাঝে জবাবে বলে, সময় হলে আসবো।
কিন্তু রহিস জানে না, তার ঔরসজাত সন্তানদের তাকে দরকার, খুব করে দরকার।
কয়েকদিন পরে রহিম পাগল হয়ে যায় রহিসকে বিয়ে করানোর জন্য । সে পাত্রীও ঠিক করে রেখেছে। ভাইয়ের কথায় রাজি হয়ে রহিসও সিদ্ধান্ত নেয় বিয়ে করে নিবে।রহিসের বিয়ে সম্পন্ন হয় মোবাইলের মাধ্যমে। রহিসের চার ছেলেমেয়ে ভাবে এবার হয়তো তাদের একটা মা হবে, তাদের কষ্ট দূর হবে, কিন্তু বোকা বাচ্চারা এটা জানে না,তাদের জন্য আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে।
বাচ্চাদের নতুন মা আসে, লিনা সারাক্ষণ মায়ের পিছনে পরে থাকে, কিন্তু রহিসের নতুন বউ জমিলা, সে এসছে থেকেই ভয়ংকর। নিজের সংসারের চাবি নিজের আঁচলে বেধে নিয়ছে, রহিমের বউকে এখন কোনঠাসা করে দিয়েছে। লিনা, লিমন, আহানে আর আলীর মতো, বড় চাচীর জীবনেও নেমে আসে দুঃখ ।
গোপনে রহিমের সাথে চলতে থাকে জমিলার প্রেমলিলা। জমিলা মূলত আগে থেকেই রহিমের প্রেমিকা। তাকে কাছে নিয়ে আসার জন্যই রহিম নিজের ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে দেয়।
রহিমের বউ সব জেনেও চুপ থাকে, কারন তারও এই দুনিয়ায় স্বামী ছাড়া আর কেউ নেই। রহিম তাকে ভয় দেখায়, মুখ খুললে তালাক দিয়ে দিবে, ফলে তার মেয়ের জীবনও হবে অনিশ্চিত।
—-
বিলকিসের জীবনে এখন সুখের শেষ নেই,উসমান তাকে খুব ভালোবাসে যত্ন করে। বিলকিস এখন তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। কিন্তু বিলকিস তার বাচ্চাদের একনজর দেখার জন্য ছাতক পাখির মতো ছটফট করে। তাদের বাড়ির পাশে প্রতিবেশীদের থেকে খবর নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা বিলকিসের সাথে কথা বলতে চায় না। বিলকিসের মতো চরিত্রহীনা মহিলার সাথে কথা বললে নাকি তাদেরও চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে। বিলকিসের মনে হয় সে সুখে শান্তিতে সংসার করলেও এটা কলঙ্কের সংসার।
বিলকিস এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, আল্লাহর কাছে বিচার চায়, তার সন্তানদের সুখ কামনা করে।
—–
দিন যায় মাস যায়, বিলকিসের বাচ্চাদের আর ভাগ্য পরিবর্তন হয় না।
আহান একদিন তার চাচা আর নিজের সত মা’কে এল বিছানায় অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখে ফেলে। এতোকিছু না বুঝলেও আহান এতটুকু বুঝতে পারে যে তারা একসঙ্গে কোনো ভালোকাজ করছে না। আহান বড়বোনকে সবটা বলে। এইসব শুনে লিনা আহানের মুখ চেপে ধরে বলে
” চুপ, একদম কাউকে কিছু বলবি না। বললে চাচা আমাদের মারবে। ”
আহান চুপ হয়ে যায়।
তবে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে কাউকে না জানিয়ে দেশে আসে রহিস। খুশি মনে সে বাড়িতে প্রবেশ করে। বাড়িতে ডুকেই সে লিনাকে ঘর মুছতে দেখে। রহিসের জানামতে লিনা নিয়মিত স্কুলে যায়,প্রাইভেটে যায়, তো আজকে স্কুল কামাই করে বাড়িতে কাজ করছে কেন?
রহিস লিনা ডাক দেয়।
লিনা রহিসকে দেখে দৌড়ে এসে রহিসের বুকে ঝাপিয়ে পরে।
বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিজের চোখে জমিয়ে রাখা অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। রহিস মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয়। রহিসের বউ জমিলা এসে দেখে রহিস এসেছে৷ মনে মনে জমিলা খুশি হতে পারেনা , কিন্তু রহিসকে দেখে মিথ্যা হাসি দিয়ে এসে রহিসকে জড়িয়ে ধরতে যায়। রহিস দূর থেকে হাতের ইশারায় জমিলাকে থামিয়ে দেয়।
চলবে?