কলঙ্কের সংসার পর্ব-০৩

0
16

#কলঙ্কের_সংসার
#ফৌজিয়া_কবির
#পর্ব_০৩

রহিসের হাতের ইশারায় জমিলা থেমে যায়। হাসিহাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়। রহিস তার মেয়েকে নিয়ে ভিতরে চলে যায়। একটা ছেলে রহিসের আনা সব জিনিসপত্র ঘরের ভিতরে দিয়ে যায়।
যেই রুমে রহিসের মেয়ে থাকে রহিস সেই রুমে যায়, লিনা ফ্যান ছেড়ে দেয়। রহিস লিনাকে জিজ্ঞেস করে

” কিরে লিমন, আহান আর আলী কই? ”

” আব্বা হেরা হাওরে গেছে বড় চাচার সাথে কাজ করতো। ”

” কেন? স্কুল নেই? ”

লিনা মাথা নুইয়ে নেয়। তারপর আস্তে আস্তে করে বলে

” আম্মা যাওনের পর আমরা আর ইস্কুলে যাইতে পারি নাই আব্বা, সবাই আমরারে লইয়া হাসিতামাশা করে। এর লাইগা বড় চাচা আমরা সবাইরে ইস্কুলে যাইতে মানা কইরা দিছে। ”

” কিন্তু আমি তো পড়াশোনার খরচের জন্য টাকা পাঠাইছি। ”

লিনা মাথা নুইয়ে রাখে আর কিছু বলে না। একটু পরে বলে

” তোমার লাইগা ঠান্ডা পানি লইয়া আই। ”

এই বলে লিনা ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
ঘর থেকে বেরুতেই লিনার সৎ মা তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে

” যদি বাপের কাছে কিছু লাগাইছোস,তাইলে তোর খবর আছে মা*গি, সবকয়টারে মাইরা পুইতা দিমু, নয়তো এমন কলঙ্ক লেইপা দিমু তোর গায়ে, তোর মায়েরে যেমনে সবাই ঘৃণা করে তোরেও করবো। ”

লিনা ব্যাথায় আহ্ করে উঠে,জমিলা খুব জোরে হাতটা চেপে ধরেছিলো তাই।

” ছোট আম্মা, আমারে ছাইড়া দেও, আমি আব্বারে কিছু কইতাম না। ”

জমিলা লিনাকে ছেড়ে দিয়ে রুমে ঢুকে। হাতের আঙুলে শাড়ী পেছাতে পেছাতে বলে

” আপনি আইবেন, আমারে কইলেন না, একটু সুন্দর কইরা সাইজ্জা গুইজ্জা থাকতাম। ”

রহিস মোবাইলে কিছু একটা দেখছিলো, জমিলার কথা শুনে মাথা তুলে তাকিয়ে বলে

” এতো সাজগোজের দরকার নেই, আমি কৃত্রিম কিছুই পছন্দ করি না। ”

জমিলা জবাবে আর কিছু বলে না। রহিসের গা ঘেঁষে গিয়ে পালঙ্কে বসে, তারপর আহ্লাদী কন্ঠ বলে

” আমার লাইগা কি আনছেন? ”

রহিস হাতের ইশারায় বড় একটা লাগেজ দেখিয়ে দিয়ে বলে

” এই ব্যাগটায় সবার জন্য সব কিছু আছে, যার যার জিনিসে যার যার নাম লিখা আছে। ”

” খুলে দেখি? ”

” না, সবাই আসোক একসাথে খুলে দেখবে। ”

এর মধ্যেই লিনা আসে পানি নিয়ে। রহিস পানি খায়। রহিসের ভাইয়ের বউ সাজেদা আসে লিনার থেকে জানতে পেরে যে রহিস এসেছে। রহিস আসাতে রহিমের বউ খুশি হয়, কারণ এতে রহিম আর জমিলার মেলামেশাটা একটু হলেও কমবে। সাজেদা রহিসের সঙ্গে কোশল বিনিময় করে।
রহিস সাজেদাকে জিজ্ঞেস করে

” রানু কই ভাবি? ”

” ও ইস্কুলে গেছে, এই বার ওয় মেট্রিক পরীক্ষা দিবো তো, ইস্কুল বাদ দেওন যায় না। ”

” ওহ্! লিনা.. ”

” হ্যাঁ আব্বা।”

” তোরা কি ইস্কুলে ভর্তি নাই? ”

লিনা মাথা নত করে বলে

” না আব্বা। ”

” কেন? ”

” তোমারে তো কইছি আমরা সরমে ইস্কুলে যাইতে পারি না, মাইনসে আমরারে ক্ষেপায় । ”

রহিস নিজের হাতের মুঠি শক্ত করে বিছানায় জোরে একটা কিল বসায়। তারপর চিৎকার করে বলে

” তাহলে তোমাদের চার জনের ভর্তি, বই কেনা, প্রাইভেট এবং যাতায়াত ভাড়ার জন্য যে আমি মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েছি ওইগুলো কি হয়েছে? ”

লিনা ভয়ে কেঁপে উঠে। জমিলা লিনার দিকে অগ্নি চক্ষু নিক্ষেপ করে। রহিস এইবার সাজেদাকে বলে রহিমকে কল দিয়ে বাড়িতে আসতে বলতে।
সাজেদা গিয়ে রহিমকে কল দেয়, রহিম হাওরে গাছের ছায়ার নিচে বসে বসে সিগারেট খাচ্ছিলো আর লিমন, আহান, আলী ক্ষেতে কাজ করছিলো। মাজেদার কল দেখে রহিম বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করে।

” আপনে তাড়াতাড়ি বাড়িত আইয়েন, রহিসের তিন পোলারেও লইয়া আইয়েন। ”

” কেন,? ”

” রহিস আইছে।”

” দিন দুপুরে কামের মধ্যে কল দিয়া মসকারা করো? ”

” আপনের সাথে আমি কোনদিন মসকারা করছি? রহিসে কইছে আপনেরে আমি আইতে কইতাম, এহন আপনি আইলে আইয়েন না আইলে নাই। ”

সাজেদা এই বলে কল কেটে দেয়।

রহিম ছেলেদের ডাক দিয়ে বলে হাতমুখ ধূয়ে নিতে, ওরা বাড়ি যাবে।

রহিম বাড়ি ফিরে হাসি মুখে ভাইকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। রহিস নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে

” আমার ছেলেরা কাম করতে যায় কেন ভাইজান? আমি কি তাদের ভরনপোষণের টাকা দেই নাই? তারা ইস্কুলে যায় না কেন? আমি তাদের ইস্কুলে যাইবার সব খরচ দিছি। ইস্কুলের পোলাপান আমার ছেলে মেয়ে দের উত্ত্যক্ত করে,আপনে কি পারেন নাই ইস্কুলে নালিশ করতে? ”

” নালিশ কইরা কয়জনের মুখ বন্ধ করমু? ভাবছিলাম কয়ডাদিন যাক, এইসব কাহিনী মানুষে ভূইলা যাক, পরে ভর্তি কইরা দিমু নে সবরে। তোরে কিছু জানাই নাই তুই কষ্ট পাবি এর লাইগা। ”

” তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার এই ছোট ছোট ছেলেমেয়ে কাম করবো কের লাইগা? ”

” ওরা নিজের ইচ্ছেতেই কামে যায়। বিশ্বাস না হইলে জিগা।”

” লিমন আর আলী চাচার কথায় সায় দেয়, কিন্তু আহান গম্ভীর মুখে বসে থাকে। ”

রহিস নিজের সাথে করে আনা বড় লাগেজটা খুলে একে একে সব জিনিস পত্র বের করে। লিনা, জমিলা, রানু আর সাজেদার জন্য এনেছে শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, লোশন, ঘড়ি। ভাইয়ের জন্য একটা ঘড়ি। ছেলেদের জন্য স্মার্ট ঘড়ি, খেলনা গাড়ী।
কম্বল, খেজুর চকলেট আরোও কিছু জিনিসপত্র।
এগুলো ভাগাভাগি শেষ হলে রহিস নিজের হাত বেগ থেকে একটা বক্স বের করে, বক্সটা খুললে দেখা যায় এতে আছে একটা সোনার হাড়, কানের দুল, আংটি, চুড়ি এবং টিকলি। জমিলা মনে করে এগুলো হয়তো তার জন্য এনেছে, কারন সে নতুন বউ। খুশিখুশি মুখ নিয়ে জমিলা এগিয়ে যায় বক্সটা হাতে নিতে। তখন বক্সটা রহিস লিনার হাতে তুলে দিয়ে বলে

” তোর বিয়ের সব গহনা নিয়া আইছি, দেখতো কেমন হইছে। ”

লিনা বক্সটা হাতে নিয়ে গহনা গুলোতে হাত বুলিয়ে বলে

” খুব সুন্দর আব্বা। ”

জমিলা মুখ ভোতা করে বলে

” মেয়েদের কি বাপের বাড়ি থাইকা সোনার গয়না দেওন লাগে? সোনা তো জামাই দিয়া নেয়, আপনে এই গয়নার সেট টা আমারে দিয়া দেন। ”

” বিলকিসের রাইখা যাওয়া গহনা তুমি পাইছো না? এইডি আমার মেয়ের, এইগুলাতে নজর দিবানা। ”

রহিম রহিসকে জিজ্ঞেস করে

” কয়দিনের ছুটি লইয়া আইছোস? ”

” ছুটি কাইটা আই নাই। ”

” তাইলে? ”

” ভিসা কাইটা আইছি। ”

এই কথা শুনে রহিম আর জমিলার মুখ কালো হয়ে যায়। রহিস যদি আর বিদেশ না যায় তাহলে তো সব থেকে বড় লস রহিমের।

—–
রহিস দেশে ফিরেছে, এই কথাটা বিলকিসের কানে আসে। বিলকিসের একটা মেয়ে হয়েছে যার তিন মাস। বিলকিস এখন উসমানের বাড়িতে। উসমানের বাবা মা বিলকিসকে মেনে নিয়েছে, উসমান তার বাবা মাকে শরিয়ত মোতাবেক জায়েজ না জায়েজ সব বুঝিয়েছে, ধর্মের জ্ঞান দিয়েছে। আর বিলকিসের মেয়ে মাশা-আল্লাহ্ অনেক মিষ্টি দেখতে, নাতিনের মুখ দেইখা উসমানের মা বাবা বিলকিসকে ঘরে তুলে নেয়।
রহিস এসেছে শুনে বিলকিসের শান্তি লাগে, আর যাই হোক তার বাচ্চারা এখন আর অনাথের মতো থাকবে না।
রহিসের কথা মনে পরলে বিলকিসের মনের কোণায় একটু কষ্ট অনুভব হয়, কারণ একটা সময় ওই মানুষটাকে বিলকিস ভালোবাসতো, খুব ভালোবাসতো, এতোটা ভালো উসমানকে বাসতে পারনি, উসমানের থেকে এতো আদর যত্ন পেয়েও। বিলকিস চায় রহিসকে মন থেকে মুছে দিতে কিন্তু পারেনা, পনেরো বছরের সংসার, সে ছিলো বিলকিসের সব, তাকে কীভাবে বছর খানিকের মধ্যেই ভূলে যাবে? এই নিয়ে বিলকিসের খুব অপরাধ বোধ কাজ করে, বিলকিসের মনে হয় সে উসমানের প্রতি অবিচার করছে। এসব চিন্তা ভাবনার মধ্যেই বিলকিসের মেয়ে কান্না করে উঠে। উসমানের মা নাতনির নাম রেখেছে মিহিরিমা। বিলকিস মিহিরিমাকে চায়নি, ভূলবসত প্রেগন্যান্ট হয়ে গিয়েছিলো, সে চেয়েছিলো বাচ্চাটাকে নষ্ট করে দিতে, কিন্তু ধার্মিক উসমান তা করতে দেয়নি। মিহিরিমা জন্মের পরও বিলকিস তার প্রতি যত্নশীল নয়, মিহিরিমার কান্না করলে তার বিরক্ত লাগে, সে তার আগের চার সন্তানের জন্য ব্যাথিত।
মিহিরিমা কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে যায়, উসমানের মা অন্যরুম থেকে চলে আসে, উনার আসার শব্দ শুনে বিলকিস ঘুমাবার ভান করে। উসমানের মা এসে নাতনিকে নিয়ে যায়।
আর বিলকিসকে ঘুমন্ত ভেবে কিছু বলে না।
মিহিরিমার সব খেয়াল তিনিই রাখেন, বিলকিস তো এই সংসারে উদাসীন ।

চলবে?