#কলঙ্কের_সংসার
#ফৌজিয়া_কবির
#পর্ব_০৪
নিজের শয়ন কক্ষে রহিস শুয়ে শুয়ে বিলকিসের সাথে কাটানো রঙিন মুহুর্ত গুলো মনে করছিলো, কতো সুন্দর সাজানো গুছানো জীবন ছিলো তাদের, বিলকিস এমন চরিত্রহীন বেরুবে তা রহিসের ভাবনাতেও আসেনি, কিন্তু তার ভাই এমন ভাবে বলেছে তা বিশ্বাস না করে উপায় নেই।
আজকে জমিলাকে সকাল সকাল উঠে রান্না চাপাতে হয়েছে, রহিস বলেছে রান্না করার কথা।জমিলার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। রাতে জমিলা খুব সুন্দর করে সাজগোছ করে রহিসের কাছে গেলে রহিস তাকে একটু স্পর্শও করলো না। জমিলা ছোট বেলা থেকে শুনে আসছে আগুন আর মোম পাশাপাশি থাকলে মোম গলবে নিশ্চিত, পুরষ মোম হলে নারীরা আগুনের ন্যায়। কিন্তু এতো সুন্দর কামনাময়ী নারীর দিকে রহিস ফিরেও তাকালো না? রহিসের পৌরষত্ব নিয়ে সন্দেহ জাগে জমিলার মনে। কারন জমিলার মতো মেয়েরা জানে না কামনার চেয়েও বড় কিছু হচ্ছে ভালোবাসা, প্রকৃত পুরুষ ভালোবাসার টানে নারীর শরীল স্পর্শ করে।
জমিলা রান্না ঘরের ঘটিবাটি জোরে জোরে মেঝেতে ফেলছে যাতে কেউই ঘুমাতে না পারে। লিনা তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে আসলে দেখতে পায় জমিলা চুলোয় ভাত চাপিয়ে সবজি কাটছে। লিনা দৌড়ে গিয়ে জমিলার থেকে বটি নিয়ে বলে
” আমি সবজি কাইটা লইতাছি ছোট মা, তুমি গিয়া ঘুৃমোও। ”
” আর নাটক করন লাগবো না, বটিটা আমার হাতে দে। ”
তখনি রহিস আসে রান্নাঘরে। লিনার উদ্দেশ্যে বলে
” আজকে তোমাদের সবাইকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে আসবো, আর কেউ যেন তোমাদের উত্ত্যক্ত করতে না পারে সেই ব্যাপার টাও দেখবো। এখন যাও গিয়ে তৈরি হয়ে নাও, তোমার মা রান্না শেষ করলে আমার খেয়ে বেরুবো। ভাইদেরও গিয়ে ডেকে তুলো। ” ( বলে রাখি, রহিস দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার কারনে তার ভাষার পরিবর্তন হয়েছে, সে মাঝে মাঝে গ্রামের ভাষায় কথা বলে আর মাঝে মাঝে শুদ্ধ ভাষায়)
লিনা মাথা নুইয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। রহিস জমিলার উদ্দেশ্যে বলে
” রুই মাছ দিয়ে চাল কুমড়ার ঝোল আর লইট্টা সুটকির ভূনা রান্না করবে।
এগুলো রান্না করতে পারো তো? ”
” জি পারি।
তয় আপনে কি আমারে শুধু কাম কাজ করানোর জন্য বিয়া করছেন? ”
” কেউই কাম কাজ করানোর জন্য বিয়ে করে না। তবে নিজের সংসারের কাজ প্রত্যেক স্ত্রী নিজেই করে। ”
এবার জমিলা গলার আওয়াজে খানিকটা খাদ লাগিয়ে বলে
” তয় কাল রাইতে আপনি আমার স্ত্রীর হক আদায় করলেন না কেন? আমি আপনার লাইগা সাজগোছ করছিলাম। ”
রহিস হেসে বলে
” এটার জন্য তুমার মন ভারী?
কাল আমি ক্লান্ত ছিলাম বেশ, তবে বিয়ে যখন করেছি, তোমার সব হকই আদায় করবো, চিন্তা করো না। ”
এই বলে রহিস এখান থেকে চলে যায়।
অনেক দিন হলো জমিলার রান্না ঘরে ঢুকা হয় না, তাই এখন রান্না করতে কষ্ট লাগছে, খুবই বিরক্ত লাগছে। তবে জমিলা মনে মনে অন্য ফন্দি আটছে, তাকে আগে রহিসের বাচ্চার মা হতে হবে। রহিসের বা রহিমের দুজন থেকে এক জনের বাচ্চা হলেই হবে, তবে রহিস যেন টের না পায় তারও খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে পায়ের নিচের মাটিটা একটু শক্ত হবে, তখন রহিসের চার বাচ্চা থেকে মুক্তি পাওয়াটা সহজ হবে। ওরা চলে গেলে রহিসের সহায় সম্পত্তির মালিক হবে শুধু মাত্র জমিলা, যদিও রহিমও এর ভাগ চায়, তবে জমিলা রাঘব বোয়াল একাই সব গ্রাস করার চিন্তাভাবনা করছে, রহিমকে শুধু সে নিজ সার্থে ব্যবহার করছে।
রহিস নিজের চার সন্তানকে নিয়ে খেতে বসেছে। তরকারি দিয়ে মাখিয়ে এক লোকমা ভাত মুখে নিতেই রহিসের মুখ তেঁতো হয়ে যায় লবনে। রহিস থুথু দিয়ে ফেলে দেয় মুখে নেওয়া খাবার। বিরক্ত নিয়ে বলে
” এসব কি অখাদ্য রান্না করেছো? ”
” কি হইছে? আমি তো সব ঠিকঠাকই… ”
” হ্যা সব ঠিকঠাক দিয়ে লবনের তরকারি করেছো, মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। ”
বিলকিস তো কি সুন্দর সব ঠিকঠাক দিয়ে রান্না করতো। কাল রাতের রান্নাটাও মোটামুটি ভালো ছিলো, যা লিনার রান্না ছিলো। লিনা রান্নাবান্না বিলকিসের থেকেই শিখেছে।
রহিস ভাতের থালায় পানি ঢেলে দিয়ে বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বলে
” আর খেতে হবে না, উঠে পর, বাহিরে খেয়ে নিবো আমরা। ”
ওরা উঠে যেতে নিলে জমিলা পিছন থেকে বলে উঠে
” আমি কি খাবো? ”
” নিজে যা রান্না করেছো তাই খাও। আর দুপুরে এসে যেন খাওয়ার যোগ্য কোনো খাবার পাই। ”
এই বলে রহিস গটগট পায়ে চলে যায়, সাথে সাথে বাচ্চারাও। রহিস যেতেই রাগে জমিলা নিজের হাতে থাকা কাচের বাটিটা জোরে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তারপর রাগে ফুঁসত থাকে।
রহিসকে বের হয়ে যেতে দেখেই রহিম চুপিচুপি জমিলার কাছে চলে আসে। এসে দেখে জমিলা রাগে ফুঁসছে আর বাসনকোসন ধুয়ে রাখছে। রহিম এসে জমিলাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।
জমিলা ছিটকে রহিমের থেকে দূরে সরে গিয়ে জোরে চেচিয়ে বলে ওঠে
” কি অসভ্যতা হচ্ছে? ”
রহিম ব্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে
” এর মধ্যে অসভ্যতার কি আছে? ”
” একজন পরস্ত্রী কে স্পর্শ করা অসভ্যতামো নয়তো কি? ”
রহিম জমিলার কোমড়ে ধরে কাছে টেনে নিয়ে হাত দিয়ে গালে স্লাইড করতে করতে বলে
” বুঝা যাচ্ছে আজ তোমায় প্রথম স্পর্শ করছি সুন্দরী ”
জমিলা আবার দূরে সরে গিয়ে বলে
” তখন আর এখনের মধ্যে ব্যাবধান আছে, এখন আমার স্বামী দেশে। ”
” তো কি হয়েছে? এখন তো আর ও বাড়ি নেই। ”
” না থাকলে কি হইছে? আমার তো অনেক কাজ আছে। ”
” কাজ গুলা রানুর মায় কইরা দিবো নে। ”
” না তার দরকার নাই। ”
” তাইলে লও আমিও তোমারে সাহায্য করি, দুই জনে মিল্লা কাজ শেষ কইরা তার পরে যা করার করুমনে। রহিসের আইতে মেলা দেরি। ”
জমিলা বুঝতে পারে ও যতো যাই করুক রহিম এখান থেকে যাবে না, তাই ওকে আর তাড়ানোর চেষ্টা করলো না।
—-
রহিস বাচ্চাদের নিয়ে একটা ভালো রেস্টুরেন্টে সকালের খাবার খেয়ে চলে যায় স্কুলে । তাদের এলাকায় নামকরা একটা ভালো স্কুলে তার বড় তিন ছেলেমেয়েকে ভর্তি করিয়ে নেয়। লিমনকে যেহেতু টিসি দেওয়া হয়েছে, ওর চরিত্র একটু কালো দাগ পরেছে তাই ওকে ভর্তি করাতে মোটা অঙ্কের টাকা ঢালতে হয়, যদিও অন্য স্কুলে ভর্তি করা যেতো। কিন্তু রহিস তিন ভাইবোনকে একই স্কুলে ভর্তি করতে চায়। লিনা ক্লাস টেন এ, লিমন এইটে আর আহান সিক্স এ ভর্তি হয়।
এবার ভর্তি করার পালা ছোট ছেলে আলীকে। রহিস ঠিক করে আলীকে আগের মাদ্রাসাতেই ভর্তি করা হবে।
সবাই মিলে ওটোতে করে মাদ্রাসায় চলে আসে। মাদ্রাসার অফিস কক্ষে রহিস বসে আছে, তখনি তার পাশ কাটিয়ে চলে যায় বিলকিস,ও একটা দরকারে উসমানের কাছে এসেছিলো। বোরকা পরা অবস্থায় রহিস বিলকিসকে দেখলেও চিনতে পারেনি, তবে বিলকিস ঠিকই চিনেছে। একটু আড়ালে গিয়ে বিলকিস তার চার সন্তানকে প্রাণ ভরে দেখে নেয়,ওদের হাসিখুশি দেখে বিলকিসের আত্মা জুড়িয়ে যায়। ওর খুব ইচ্ছে করছিলো সন্তানদের জড়িয়ে ধরে আদর করতে। বহুদিনের জমানো মায়া মমতা উজাড় করে দিতে সন্তানদের। কিন্তু তা এখন সম্ভব না, বিলকিস এখন রহিসের সামনে আর পরতে চায় না। সময় হলে সব ফিরে পাবে, সন্তানদের কাছে পাবে, কিন্তু রহিসকে আর পাবে না।
ছেলেকে ভর্তি করিয়ে রহিস তাদের নিয়ে চলে যায় মার্কেটে। তাদের দামী দামী কাপড়চোপড় কিনে দেয়, জুতা কিনে দেয়।
বহুদিন পর রহিসের ছেলে মেয়ে এতো খুশি হয়। আহান মুখ ফুটে বলেই দেয়
” আম্মা যাওনের পরে এই প্রথম আমরা পেট ভইরা ভাত খাইছি আব্বা, এই প্রথম আমরা মন খুইল্যা হাসতাছি। ”
আহানের কথায় রহিস ওর দিকে তাকিয়ে বলে
” তোমাদের ভরনপোষণের জন্য তো যথেষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়েছি। তাহলে তোমাদের খাওয়ার সংকট হবে কেন? ”
আহান আর কিছু বলার আগেই লিনা মাঝখান থেকে বলে উঠে
” আম্মার কথা মনে পরতো খুব, তাই খাওন দাওনের মন চাইতো না, এখন তুমি আইয়া পরছো তাই আম্মার কথা কম মনে পরে। ”
লিনা আহানের হাতে আস্তে করে একটা চিমটি কেটে কানে কানে বলে
” বেশি বকরবকর করিস না, বিপদে পরবি। ”
বোনের এমন সবকিছু লুকিয়ে চলা আহানের একদমই পছন্দ হয় না। সে কি জন্য এমন করছে? আব্বাকে বলে দিলেই তো হয়, ছোট মা আর বড় চাচা শাস্তি পায়।
তবে রহিস এতোদিনে বুঝতে পারে বাচ্চাদের জন্য টাকা পয়সাই সব না, মা বাবার ভালোবাসারও দরকার আছে।
কেনাকাটা শেষে রহিস বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি চলে আসে।বাড়ি এসে রহিস সোজা তার রুমে ঢুকে যায়। জমিলার জন্যও কিছু কেনাকাটা করেছে তা ওকে দিতে। রুমে ঢুকে রহিস যা দেখে তার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গ অবস্থায় তার বিয়ে করা বউ জমিলা। আহানও বাবার পিছু পিছু আসলে রহিস তার চোখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ওকে বের করে দেয়।
চলবে?