কলঙ্কের সংসার পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
15

#কলঙ্কের_সংসার
#ফৌজিয়া_কবির
#অন্তিম_পর্ব

রহিস রাগে দিশাহারা হয়ে রহিমকে গিয়ে একটানে জমিলার উপর থেকে তুলে, জমিলা রহিম দুজনেই উলঙ্গ। রহিমের লুঙ্গি পরবার সময়টা না দিয়েই রহিস তাকে একের পর এক কিল ঘুসি দিয়েই যায় আর অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতেই থাকে। জমিলা তাড়াতাড়ি করে কাপড় পরে নেয়, কি থেকে কি হয়ে গেল, সব প্ল্যানে পানি পরে গেল, কেন যে রহিমের কথা শুনে তার সাথে এখনি শুইতে গিয়েছিলো, দরজা টাও বন্ধ পর্যন্ত করেনি কেন।
হয়তো এটা আল্লাহরই কোনো ইশারা, আল্লাহই আজকে জমিলা আর রহিম ধরিয়ে দিতে চেয়েছেন বলেই ওরা ধরা পরেছে।

রহিসের শক্তির কাছে রহিম কিছুতেই পেরে উঠছে না, এমনিতেও রহিস রহিমের থেকে বলশালী, কিন্তু আজকে যেন রহিসের শরীরে আলৌকিক শক্তি ভর করেছে।
রহিস রহিম এমনভাবে মারছে যে মনে হচ্ছে আজ রহিমের মৃত্যু নিশ্চিত। জমিলা আর না পেরে ছুটে আসে রহিসকে আটকাতে । জমিলাকে রহিস এক ধাক্কায় ফেলে দেয়, পালঙ্কের কোণায় জমিলার কপাল লেগে খানিকটা কেটে যায়। জমিলা চিৎকার করে ডাকতে থাকে

” রানুর মা, ও রানুর মা, তাড়াতাড়ি এইয়ো, তোমার জামাইরে আজকে মাইরা ফালাইবো। ”

রহিমের বউ জমিলার গলার আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে এসে দেখে রহিস রহিমকে মারছে। রহিমের বউ গিয়ে সোজা রহিসের পা ধরে নেয়। রহিসের বাচ্চারাও সব ভিতরে চলে আসে, চিৎকার চেচামেচির আওয়াজে কয়েকজন প্রতিবেশীও চলে আসে।

রহিমের বউ রহিসের পা ধরে কান্না করতে করতে বলে

” ভাইরে ছাইড়া দে, ওয় মইরা যাইবো, আমার মাইয়া ডা এতিম ওইয়া যাইবো, আমার মা বাপ নাই, আমি কই যাইমু? কার কাছে যাইমু? ওই মানুষটা ছাড়া যে আমার কেউই নাই। ”

” এই পশুটারে বাচাইতে আইও না ভাবি তুমি ছাড়ো আজকে আমি ওরে মাইরাই ফালাইমু। ”

প্রতিবেশী দুইটা পুরুষ রহিমকে ছাড়িয়ে নিয়ে রহিসকে ধরে রাখে। রহিস বার বার বলছিলো

” আমারে ছাড়ো, হারামির বাচ্চারে আমি আজকে মাইরা ফালাইমু। ”

লিনা গিয়ে রহিসকে জড়িয়ে ধরে বলে

” তুমি শান্ত হও আব্বা, তুমি শান্ত হও, চাচারে মাইরা ফালাইলে তোমারে পুলিশে ধইরা লইয়া যাইবো, তখন আমরার কি হইবো আব্বা, তুমি শান্ত হও। তুমি শান্ত না হইলে আমরা মা বাপ জীবিত রাইখাই এতিম হইয়া যাইমু।  ”

লিনার বলা কথাটা যেন রহিসের উপর মন্ত্রের মতো কাজ করে। রহিস তখনই শান্ত হয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে, তিন ছেলেকে ইশারায় কাছে ডাকে। চার সন্তানকে বুকে নিয়ে রহিস অশ্রু বিসর্জন দেয়। কথায় আছে পুরুষ মানুষের হৃদয় পাথরের ন্যায়, তাদের কাঁদানো সহজ নয়। কিন্ত রহিস আজকে কাঁদছে, পাথরের হৃদয় ভেঙে অশ্রু ঝড়ছে তার কপোল বেয়ে।

রহিমের বউ এসে রহিসের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে কান্না করতে করতে বলে

” আমারে ক্ষমা কইরা দে ভাই, বিলকিসের সাথে করা অন্যায় দেইখাও আমি চুপ আছিলাম দেইখা আল্লাহ্ আমারে শাস্তি দিতাছে। ”

” তুমি বলতে চাইছো ভাবি। ”

রহিমের বউ আহাজারি করতে করতে বলে

” ওরে বিলকিসের চরিত্র ছিলো খাঁটি, পবিত্র। রহিম্মে হের উপর কলঙ্কের দাগ লাগাইছে, তোর সহায় সম্পত্তি ভোগ কইরা খাইবার লাইগা। আমিও তোর ভাইয়ের সঙ্গ দিছি এই ভাইবা যে আমি আর আমার মাইয়াও সুখে থাকমু,তোর সম্পত্তি আমরাই ভোগ করমু। কিন্তু আমার সব আশায় পানি ঢেলে তোর ভাই তোর জন্য বিয়া করাইয়া নতুন বউ আনে। কিন্তু আমি জানতাম না এই জমিলা কাল নাগিনীর লগে তোর ভাইয়ের অবৈধ সম্পর্ক আছে।
কয়েকদিন পরে আমি টের পাইলাম তোর ভাই আর জমিলার অবৈধ সম্পর্ক আছে, ওইদিন আমি এইসব নোংরা মেলামেশার প্রতিবাদ করলে তোর ভাই আমারে গরুর মতো পিঠায়। সেদিন আমারে বুঝাইয়া দেয় যে আমি ওর জীবনে সহ্যসঙ্গী ছাড়া কিছুই না, তার বাচ্চার মা হিসাবে আমার কোনো সম্মান, মূল্য নেই। ওয় আমারে হুমকি দিছে ওদের সম্পর্কে বাধা দিলে আমারে খুন করবো।
তোর ভাই আর তোর নতুন বউ, তোর ছেলে মেয়েরে আর আমারে চাকরের মতো খাটাইছে। তুই তো জানিসই আমার তিন কুলে কেউ নাই, আমারে মাইরা পুইতা দিলেও মামলা দেওয়ার মতো কেউ নাই, আমি মইরা গেলে আমার মাইয়াডা গাঙ্গে ভাসবো, এর লাইগা আমি মুখ বন্ধ কইরা রইছি।
লিনারে জিগা ওরেও ডর দেখাইয়া রাখছে। ”

রহিস লিনার দিকে তাকালে লিনাও কান্না করতে করতে বলে

” হ আব্বা চাচি ঠিক কইতাছে। ”

রহিসের ছেলেরাও কান্না করতে করতে সব বলে দেয়।

রহিমের বউ রহিসের পা চেপে ধরে কান্না করতে করতে বলে

” আমারে মাফ কইরা দে ভাই, আমি তোর ভাইয়ের অন্যায়ের সাথ দিছি, আমিও সমান পাপি। ”

রহিস দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে থাকে। তারপর কাঁদতে কাঁদতে বলে

” তোমরা আমার সোনার সংসার টারে ভাইঙ্গা দিলা? আমার বিলকিসের সাথে এতো অন্যায় করলা? আমরা ক্ষমা কইরা দিলেও তোমরারে আল্লাহ ক্ষমা করবো না। তোমরা এখন এই মুহুর্তে আমার ঘর থাইকা বাইর হইয়া যাও। ”

প্রতিবেশীরা এখন বিলকিসের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে, সবাই হায় হায় করছে। অথচ তারাই একটা সময় বিলকিসের মুখে থুথু চিটিয়েছে। কেউ ওকে একটু আশ্রয় দেয়নি।

রহিস জমিলাকে তালাক দিয়ে দেয়। জমিলা আর রহিমকে নিজের ঘর থেকে বের করে দিয়ে থানায় চলে যায়।
থানায় গিয়ে রহিমের নামে মামলা করে, তার বাচ্চাদের অত্যাচার করার আর তার সম্পত্তি আত্মসাৎ করার জন্য। রহিস কোন মাসে কতো টাকা রহিমকে পাঠিয়েছে তার সব ডকুমেন্টস দেয় এবং তার বাচ্চাদের দিয়ে সাক্ষী দেওয়ায়।
সব তথ্য যাছাই বাছাইয়ের পর কোর্ট রহিমের সব সম্পত্তির মালিকানা রহিসকে দিয়ে দেয় ( যদিও ওর তেমন কিছুই ছিলো না, টাকা পয়সা সব জুয়া খেলে আর মেয়ে বাজি করেই ফুরিয়ে দিয়েছে) । এবং রহিমকে এক বছরের কারাদণ্ড দেয়। রহিম অনেক আকুতি মিনতি করেছিলো ওকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য, কিন্তু রহিসের মন গলেনি একটুও মায়া হয়নি। কেন মায়া হবে, রহিম কি তার বাচ্চাদের মায়া দেখিয়েছিলো?
জমিলার উপরও শিশু নির্যাতনের মামলা দেওয়া হয়, কিন্তু জমিলা পালিয়ে কোথায় চলে যায়, কেউ ওর খোজ জানে না।

সব কাজ সেরে এখন রহিসের মনে হচ্ছে বিলকিসের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত, যেই ভাবা সেই কাজ। উসমানের ঠিকানা সংগ্রহ করে রহিস তার চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে বিলকিসের বাড়িতে। রহিসকে দেখে বিলকিসের শ্বাশুড়ি চিনতে পারে না প্রথমে, পরবর্তীতে রহিস তার পরিচয় দিলে বিলকিসের শ্বাশুড়ির মোটেও ভালো লাগেনা রহিসকে এখানে দেখে। বিলকিসের শ্বাশুড়ি রুষ্ট স্বরে জিজ্ঞেস করে

” কি চাই এখানে? ”

রহিস বিনয়ের সহিত উত্তর দেয়

” বিলকিসের সাথে দেখা করতে চাই। ”

” বিলকিস এখন পর্দা করে, পরপুরুষে সঙ্গে দেখা করা যাবে না। ”

” তো ওর বাচ্চাদের সাথে তো দেখা করতে পারে। ”

” হুম তা পারে। ”

এই বলে উনি বিলকিসের ছেলে মেয়েকে ভিতরে ডেকে নেয়। বাচ্চারা খুশিতে দৌড়ে ভিতরে যায়। কিন্তু বিলকিসের শ্বাশুড়ি রহিসকে ভিতরে আসবার কথা বলে না তাই রহিস বাইরেই দাড়িয়ে রয়।
বিলকিস রুমের ভিতরে মিহিরিমাকে ফিডিং করাচ্ছিল, তখনি আহান আর আলী গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা নিজের ছেলে মেয়েকে দেখে বিলকিসের তো খুশির শেষ নেই, মিহিরিমাকে নামিয়ে রেখে চার সন্তানকে জড়িয়ে ধরে, শুকিয়ে খাক হওয়া মাতৃ হৃদয় ভিজে যায় সুখের বন্যায়। বিলকিস তার মমতা উজার করে দেয় সন্তানদের।
লিনা মাকে সব খুলে বললে বিলকিস সস্তি পায়, তার কলঙ্ক গুছলো, এখন কেউ তাকে কলঙ্কিনী বলতে পারবে না, আর না কেউ তার সংসার কে কলঙ্কের সংসার বলতে পারবে।

বাহিরে কাঠফাটা রোদের মধ্যে দাড়িয়ে আছে রহিস, গরমে শরীল বেয়ে ঘাম টপটপ করে পরছে। এই মুহুর্তে বাড়ি এসেছে উসমান, রহিসকে বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে চিনে ফেলে সে, রহিসকে কয়েকবছর আগে উসমান দেখেছে। রহিসকে নিজের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে একটু অবাক হয় উসমান, তারপর ওর কাছে গিয়ে গলা ঝাড়ে। রহিস তার দিকে তাকায়,কিন্তু চিনতে পারে না। উসমান রহিসকে বলে

” আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ”

” আমার বাচ্চারা ভিতরে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। ”

” আপনি ভিতরে যাননি কেন? গরমের মধ্যে দাড়িয়ে আছেন। ”

” আমাকে ভিতরে ডাকেনি, তাই যাইনি। ”

” ওহ্, আচ্ছা তাহলে চলুন আমার সাথে। ”

রহিস উসমানের পিছন পিছন ঘরের ভিতরে আসে। তারপর জিজ্ঞেস করে

” কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না। কে আপনি? ”

” আমি উসমান বিলকিসের বর্তমান স্বামী। ”

রহিস উসমানকে ভালোভাবে পরখ করে, উসমান যথেষ্ট সুদর্শন। রহিসের থেকে অবশ্যই ভালো। রহিস মৃদু হেসে বলে

” ওহ্। আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন ভাই, ভূল বুঝে আপনাদের নামে কলঙ্ক লাগিয়েছি। ”

” আমার আল্লাহর উপর ভরসা ছিলো, আমি জানতাম আল্লাহ একদিন সব ঠিক করে দিবে। ”

” ভাই যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে বিলকিসের সাথে একটা বার কথা বলান, দয়া করে ভাই, ওর থেকে ক্ষমা না পেলে আমি মরেও শান্তি পাবো না। ”

” আচ্ছা দেখি। আপনি বসুন। ”

উসমান ভিতরে গিয়ে দেখে লিনার কোলে মিহিরিমা, লিনা ওকে আদর করছে। আর বিলকিসের তিন ছেলে ওকে জড়িয়ে ধরে আছে। উসমান গলা ঝাড়ে, লিনা একটু নড়েচড়ে বসে।

উসমান বলে

” আমি তোমার সাথে একটু আলাদা করে কথা বলতে চাই বিলকিস। ”

বিলকিস উঠে রুমের কোণায় আসে।

উসমান বলে

” তোমার প্রাক্তন স্বামী তার ভূল বুঝতে পেরেছে, এখন সে তোমার সাথে কথা বলতে চায়, তোমার থেকে ক্ষমা চায়। সে তোমার চার সন্তানের বাবা, তুমি চাইলে পর্দার সহিস তার সাথে কথা বলতে পারো। ”

বিলকিসের মনে কষ্টের ঢেউ খেলে যায়। বিলকিস নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে পর্দার সহিত রহিসের সামনে যায়। তারপর বলে

” বলুন কি বলবেন? ”

বিলকিসের আওয়াজে রহিস নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে

” কেমন আছো বিলকিস? ”

” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি? ”

” সব শুনেছো নিশ্চয়ই, তাও কেন জিজ্ঞেস করছো আমি কেমন আছি? ”

বিলকিস নিশ্চুপ।
রহিস আবারও বলে

” আমাকে ক্ষমা করে দাও বিলকিস। ”

” আপনাকে আমি সেই কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি৷ ”

” আমি না হয় বুঝিনি, রাগের মাথায় মুখে যা আসে তাই বলে দিয়েছি, তুমি একটু অপেক্ষা করতে পারতে, আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করতে। নতুন করে ঘর বাধার কি খুব বেশি জরুরি ছিলো?”

” কার জন্য অপেক্ষা করবো? যেই মানুষটা দীর্ঘ ১৫ বছর সংসার করার পরেও আমাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি, তার জন্য? যে নিজের ভাইয়ের কথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে আমাকে কিছু না জিজ্ঞেস করেই আমাকে তালাক দিয়ে দেয় তার জন্য অপেক্ষা করবো? লোকজন আমার দিকে থুথু ফেলছিলো, ছি ছি করছিলো তখন কেউ আমার পাশে দাড়ায়নি। তখন উসমান আমার পাশে দাড়িয়েছে, নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েছে আমার জন্য, তার হাত না ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করবো? ”

রহিস আর কিছু বলতে পারে না, বলার মতো মুখও নেই তার। বিলকিস ভিতরে চলে যায়। উসমান বাচ্চাদের আর রহিসকে নাস্তা খাইয়ে তারপর বিদেয় করে । আর বলে দেয় বাচ্চারা যখন খুশি তখন মায়ের সাথে দেখা করতে আসতে পারবে। ওরা চলে আসে।

বর্তমানে বিলকিস সুখে শান্তিতে সংসার করছে, মন চাইলে বাচ্চাদের দেখতে পারছে। রহিস আর বিয়ে করেনি। সে তার ছেলেদের নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছে । লিনাকে একটা বড় ঘরে বিয়ে দেওয়া হয়েছে । আর রহিমও ছাড়া পেয়েছে, এখন মানুষের বাড়িতে কামলা খেটে চলে। রহিস তার ভাতিজি আর ভাইয়ের বউকে মাঝে মাঝে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করে, কিন্তু রহিমের দিকে ফিরেও তাকায় না।
জমিলার কি হয়েছে কেউ জানে না, তবে লোকমুখে শোনা যায় ওর নাকি বড় একটা অসুখ হয়েছিলো , শরীল পছে মাংস কষে কষে পড়তো। এখন নাকি জমিলা আর বেঁচে নেই।

~সমাপ্ত~