কাঞ্চনবেলা পর্ব-০২

0
1

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০২

পৃথিবীতে সবার জীবনে বসন্ত রঙ নিয়ে আসে না। কারোর কারোর জন্য বসন্ত তো বহু আগেই বেরঙ ধারণ করেছে। দরজা সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা একটি নারী অবয়ব ম্লান হয়, রঙিন সুতোয় বোনা ছোট্ট ছেলেটির রঙিন স্বপ্নের গল্পে। সন্তানের বোনা স্বপ্নগুলোকে যেই মা বাস্তবে রূপদান করার ক্ষমতা রাখে, নিঃসন্দেহে সে এক ভাগ্যবতী মা। কিন্তু সাধনা সেই ভাগ্যবতী মা নয়। তার সন্তানের স্বপ্নগুলো যেনো ধূসর ই থেকে গেলো তার দূর্ভাগা কপালের কাছে। এখানেই যে তার ভাগ্য থেমে তা নয়! সে কিন্তু একজন ভাগ্যবতী স্ত্রী ও নয়; এমনকি ভাগ্যবতী বোনটাও হতে পারেনি। যদি ভাগ্যবতী স্ত্রী হতো তবে অকালে বিধবা হতে হতো না। যদি ভাগ্যবতী বোন হতো তবে তার ছোট ভাইটাকে নির্ঘুম রাত্রি কাটাতে হতো না, কঠোর পরিশ্রম করতে হতো না কিংবা পরিশ্রমের টানাপোড়েনে বয়স এবং জীবন হেরে যেতে পারতো না। তেত্রিশ বছরের এক পরিপূর্ণ ব্যক্তি হয়েও স্বরূপ জীবনে আগাতে পারছে না। তার জীবনটা থমকে আছে বিধবা বোন, ভাগ্নে আর বাবা মরা মায়ের সম্মানের সহিত ভরণপোষণের টানাপোড়েনেই। প্রকম্পিত হৃদয় নিয়ে সাধনা ধীরপায়ে এগিয়ে যায় স্বরূপের কাছে।
–“এখনো ঘুমাসনি?”

চুলের মাঝে কেউ হাত গলিয়ে দিতেই স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বড়ো বোনকে দেখে মৃদু হেসে বলল,
–“কাজ করছি। এই মাসে তো তেমন কাজ পাইনি। মাস শেষের পর্যায়ে। আজ এই কাজটা পেলাম। খুব সীমিত সময় পেয়েছি কাজটার জন্য। আগামীকাল সকালে জমা দিতে হবে। আজ আর ঘুম হবে না।”

সাধনা’র মলিন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
–“কতো টাকা জোগাড় হয়েছে?”

স্বরূপ ম্লান হেসে বলল,
–“চলতি মাসের বেতন নিয়ে বিরাশি হাজার টাকা।”

সাধনার মলিন মুখটি আরো মলিন হতে লাগলো। বলল,
–“এখনো তো অনেক টাকা, স্বরূপ! এতো টাকা এর মধ্যে গোছাবি কি করে? মাস শেষ হতে আর নয়দিন বাকি আছে।”

স্বরূপ বোনের হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে হাসিমুখে বলল,
–“এতো চিন্তা কেনো করো? এতোদিন পর্যন্ত গুছিয়ে আসছি না? দেখবে এবারেও গুছিয়ে ফেলবো।”

–“কিভাবে করবি?”

–“বললাম না করে নেবো? চিন্তা করো না।”

সাধনা ছলছল নয়নে তাকায়। মিহি স্বরে শুধায়,
–“আমি তোকে অনেক জ্বালাই তাই না?”

স্বরূপের চলন্ত হাত দুটো থেমে গেলো। শক্ত চোয়াল অথচ কণ্ঠ বড্ডো শান্ত অভিমানী শোনালো,
–“জ্বালাস! খুব জ্বালাস। এই যে, যেখানে আমায় সাহস জানানোর কথা; সেখানে তুই আমায় টেনেহিঁচড়ে পেছনে নিয়ে যাচ্ছিস এমন কথা বলে। আমি আগাতে গেলে তোর এই কথাগুলো আমায় ভেঙে দেয়। তুই আমার উজ্জ্বল দিনের স্বপ্ন দেখার শক্তি—অথচ নিজেকে ভাবিস আমার সব সমস্যার কারণ। কেনো সবসময় এমন কথা বলিস? তোর, বুব্বোর আর মায়ের হাসিমুখ আমায় হাসিমুখে বাঁচতে সহায্য করে। শত বাঁধা অতিক্রম করতে সাহায্য কর, সেখানে মাথার উপর এই ক’টা টাকার লোন কিছুই না।”

–“ক’টা টাকা? চুয়ান্ন লক্ষ্য টাকা তোর কাছে কটা টাকা লাগে? আমার চিন্তা হয় তোর জন্য স্বরূপ! কি দরকার ছিল এসবের?”

–“দরকার ছিল। আমি বেঁচে থাকতে আমার বোনকে কারোর অপমানের সইতে হবে কেনো? তবে আমি কেমন ভাই হলাম? আমি থাকতে আমার বোন মা মাথা উঁচু করে বাঁচবে। তাদের শির আমি কখনো কারোর সামনে নত হতে দেবো না।”, স্বরূপের শক্ত চোয়াল এবং দৃঢ় কণ্ঠ। চোখ টলমলে। আজো তার চোখে ভাসে কারোর তীক্ত কথায় বোনকে অঝোরে কাঁদতে দেখার সেই দৃশ্য। সাধনা ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে ভাইয়ের শক্ত মুখটির দিকে। ঝরতে চাওয়া অশ্রুগুলোকে দ্রুতহাতে মুছে নিয়ে প্রসঙ্গ এড়াতে চায়। বলে,
–“রাত জাগবি, খিদে পাবে। আমি ভাত নিয়ে আসছি।”

–“এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। ঘন্টা দুই আগেই না খেলাম।”, স্বরূপের গম্ভীর রাগান্বিত স্বরে সাধনা হাসলো। হেসে ভাইয়ের মাথায় চাটি দিয়ে বলল,
–“তুই বড়ো না আমি বড়ো? যে আমি তোর কথা শুনবো? ভাত আনছি চুপচাপ খেয়ে নিবি।”

মিনিট পাঁচেক পরেই সাধনা প্লেট হাতে এগিয়ে আসে। ভাত মেগে ভাইয়ের মুখের সামনে তুলে ধরতেই, স্বরূপ থমথমে মুখে সেটি মুখে তুলে নিলো। সাধনা মৃদু হাসলো তাদের মাঝে অভিমান ঠাই পায় না দীর্ঘক্ষণ। ভাইকে খাইয়ে দিয়ে সাধনা ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। স্বরূপকে দ্রুত কাজ শেষ করার স্পেস দিলো—যেনো এক ঘন্টা অন্তত ঘুমাতে পারে। সকাল হলেই তো আবার সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে।

পঁয়ত্রিশ বছর থেকে সদ্য ছত্রিশে পা দেওয়া সাধনা স্বরূপের বড়ো বোন। একদা তারা মধ্যবিত্ত এবং একটি সুখী পরিবারের অংশ ছিল। কিন্তু তখনি হঠাৎ দমকা হাওয়ার ন্যায় নশ্বর জীবনের তলব আসলো। বোনের বিয়ের এক বছরের মাথায় বাবা পরপারে পাড়ি জমান।
মধ্যবিত্ত সেই পরিবারটিতে তখন দারিদ্র্যের ছোঁয়া লাগলো একটু একটু করে। দারিদ্র্যের সেই ছোঁয়া থেকে মা কে রক্ষা করতে মেধাবী স্বরূপ চাকরি নিলো ব্যাংকে। সৃষ্টিকর্তা বুঝি মুখ তুলে তাকালেন! বেশ ভালোই দিন কাটতে লাগলো তাদের। কিন্তু? কিন্তু যেনো আমাদের জীবন থেকে পিছু ছাড়ে না। বিভোর জন্মানোর এক বছরের মাথায় দুলাভাই মারা গেলো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। একদম আকস্মিক! মাথার ওপর থেকে স্বামীর ছায়া সরে যেতেই পুরো পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকা যেনো সাধনার জন্য পেরেক গাঁথা এক বিছানায় শুয়ে থাকার মতো যন্ত্রনাদ্বায়ক। ভাসুরের কু নজর, লাগাতার দেওয়া মিথ্যা অপবাদ, শশুর বাড়ির লোকেদের নিত্যদিনের দুর্ব্যবহার—সম্মান আর সম্ভ্রম নিয়ে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ে সাধনার জন্য। এমনকি ছোট্ট বিভোরকে তার পিতৃ সম্পদ ভোগ করতে দিতেও নারাজ তারা। স্বরূপের কানে যেদিন এই কথা যায়, সেদিন বোনের শ্বশুরবাড়ির সাথে সম্পর্কের সকল পাঠ চুকিয়ে স্ব-সস্মানে বোন আর ভাগ্নেকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। নিজের ওপর তার অঢেল বিশ্বাস! সে থাকতে তার বোনকে কারো দরজায় মাথা ঠুকতে হবে না।

সংগ্রাম গুলো সেখানেই থেমে থাকে না। ভাড়া বাড়িতে থাকতে হলে বাড়ি ওয়ালার কতোশত নিষেধাজ্ঞা মানতে হয়। এটা করা যাবে না, সেটা করা যাবে না। প্রাপ্তবয়স্করা সানন্দে এই নিষেধাজ্ঞা গুলো মেনে চললেও একটা বাচ্চা যে অবুঝ। বিভোর নামক পুরো বাচ্চাটি চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকতো। সময় কাটানোর জন্য সে সাফেদ দেয়ালগুলোকেই বেছে নেয়। বাড়ির দেয়ালের বিশ্রী অবস্থা দেখে বাড়ি ওয়ালা রীতিমতো রাগে ফেটে পড়লো। সাধনা আর তার মাকে যা না তাই বলে গালি গালাজ করলো। মরা বাবা এবং স্বামী তুলে কথা বলতেও দুইবার ভাবেনি। দুই সপ্তাহের মাঝে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দেন তিনি। সে-ই ঘৃণ্য কথাগুলো সাধনা আর তার মা নিতে পারলো না ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো ছেলের সামনে। মা বোনের অশ্রু স্বরূপের জন্য শাস্তিস্বরূপ। সেই পরিস্থিতি যেনো দ্বিতীয়বার তৈরি না হয়—এই স্পৃহা নিয়েই সামার্থ্যের উর্ধ্বে গিয়ে এক সিদ্ধান্ত নেয় স্বরূপ। দুই সপ্তাহের মাঝে দালালদের সাহায্যে খুলনা শহরের মধ্যে সাউথ সেন্টার রোডে একটা ফ্লাট কিনলো। যেই ফ্লাটের দাম পঁচাত্তর লক্ষ্য টাকা পড়ে যায়। বাবার রেখে যাওয়া কিছু সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ বিশ লক্ষ্য টাকা দিতে পারে এবং বাদবাকি ব্যাংক থেকে‌ লোন নিয়ে। অল্প কয়মাস হলো লোন টানছে।
এরপর থেকে শুরু হয় আরেক সংগ্রাম! ইনকামের থেকে তিনগুণ বেশি লোন প্রতিমাসে বহন করতে হিমশিম খেয়ে যায় স্বরূপ। বেতন বাদে তাকে বাকি টাকাগুলো ফ্রিল্যান্সিং করে উপার্জন করতে হয়। প্রতি নিয়ত চিন্তায় কাটাতে হয় মাস শেষে মা বোনকে যেনো ব্যাংকের লোকদের কটু কথার সম্মুখীন হতে না হয়।
*****
পাখির ডাকের বদলে শহুরে জীবনে ঘুম ভাঙার সঙ্গী হয় এলার্ম ঘড়ি। নৈরার ক্ষেত্রেও ভিন্ন নয় এটি। ঘড়িটি তীব্র শব্দ উৎপাতের দ্বারা ঝনঝনিয়ে উঠতেই নৈরা এক লাফে ঘুম থেকে উঠলো। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বোঝার চেষ্টা করলো, সে কোথায়? মস্তিষ্ক থেকে অলসতা বিদায় নিতেই নৈরার মস্তিষ্ক সচল হলো। সে চকিতে ঘড়ির দিকে তাকায় আটটা আটচল্লিশ বাজে! আ’ত’ঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো তার চোখেমুখে, আটটা আটচল্লিশ? বাবা নিশ্চয়ই বেরিয়ে গিয়েছে? ঢিলেঢালা সাদা ফ্রকের সাথে সাদা একটি ওড়না নিয়ে বিছানা থেকে হন্তদন্ত হয়ে নামলো নৈরা। দরজার পানে ছুটতে গিয়েও আবার ফিরে আসে ঘরে। ব্যাগ থেকে হাত খরচের সব টাকাগুলো বের করে নিয়ে ছুটে বের হয়। করিডর পেরুতে পেরুতে চেঁচিয়ে ডাকে,
–“বাবা? বাবা? তুমি কি বাসায় আছো?”

মেয়েটির ডাকে ভেসে আসলো ভারী একটি কণ্ঠ।
–“নৈরা, আম্মা! বাবা নিচে।”

নৈরা যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। করিডরের রেলিং আঁকড়ে ধরে নিচে উঁকি দিতেই, নিচের বসার ঘরে বাবাকে বসা দেখতে পেলো। নুহাশ মাহমুদ চোখ তুলে তাকায় মেয়ের দিকে। ব্যবসায়ি হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার বাসায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের আনাগোনা থাকে। সম্মুখে এখনো দু’জন বসা রয়েছে। নৈরা হন্তদন্ত হয়ে কিছু বলতে গেলেই নুহাশ মাহমুদ তাকে আঁটকে দেয়। বলল,
–“আম্মা, ঘরে যাও। বাবা উপরে আসছি দশ মিনিট পর।”

নৈরা নিজের চঞ্চলতা সামলে নিলো অপরিচিত মানুষ দেখে। সে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ঘরে চলে যায়। নুহাশ মাহমুদ ঠিক দশ মিনিটের মাথায় মেয়ের ঘরের দরজায় টোকা দিলেন।
–“আম্মা?”

–“বাবা, এসো।”, তোয়ালে হাতে নৈরা বলল। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে এগিয়ে যায় মেয়ের কাছে। এলোমেলো চুল ঢিলেঢালা পোশাকে উদাসীনতার ছড়াছড়ি। সে মেয়েকে এমনি দেখতে অভ্যস্ত। মেয়ের মাথায় হাত রেখে হেসে শুধায়,
–“কি হলো, আজ আমার আম্মা পুরো বাড়ি মাথায় তুলছে কেনো?”

নৈরা জবাব দেয় না। সে বিছানায় রাখা টাকাগুলো দু হাতের আজলায় নিয়ে বাবার দুহাতের মধ্যে রাখলো। নুহাশ মাহমুদের ভ্রু কুঁচকে গেলো হাত ভরতি টাকা দেখে। এগুলো যে মেয়ের হাত খরচের টাকা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। সে কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“এগুলো আমায় দিচ্ছো কেনো আম্মা?”

নৈরা আঙুল কচলাতে কচলাতে বলল,
–“এগুলো আমার লাগবে না। আমায় খুচরা টাকা দাও, বাবা।”

–“খুচরা টাকা? তা দিয়ে কি করবে তুমি?”

–“বাবা প্রয়োজন হয় পথেঘাটে। নয়তো লজ্জায় পড়তে হয়।”, নৈরার মিনমিনে কণ্ঠে নুহাশ মাহমুদের কপাল কুঁচকে গেলো। জিজ্ঞাসা করে,
–“তুমি আবার কবে থেকে পথেঘাটে চলতে লাগলে? বাড়ি থেকে তো বের’ই হও না। হলেও গাড়িতে। তবে?”

নৈরা কি বলবে ভেবে পেলোনা। সে আসলেই কাজ ব্যতীত বাড়ি থেকে কখনো বের হয় না। একটা ছোট্ট কোনকিছু প্রয়োজন হলেও বাবা ভাইয়েরা এনে হাজির করে। সে নরম স্বরে বলল,
–“বিরঙ্গনার ওখানে অনেক খাবার ওঠে। খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এতো বড়ো নোট দেখলে কেউ খাবার দিতে চায় না।”
বড্ডো দুঃস্থ শোনালো নৈরার কণ্ঠ। নুহাশ মাহমুদের বেশ খারাপ লাগলো। সে কক্ষ থেকে বেরিয়ে হাঁক ছেড়ে ম্যানেজারকে ডাকলো। হাতের টাকাগুলো তার কাছে দিয়ে বলল, সবগুলো খুচরা করে আনতে। আধা ঘন্টার মাঝে নুহাশ মাহমুদ তিন বান্ডিল খুচরা টাকা নিয়ে হাজির হয় মেয়ের কাছে। যেখানে দশ, বিশ পঞ্চাশ টাকার নোট। সেগুলো মেয়েকে দিয়ে বলল,
–“এই নাও আম্মা, বাবার কাছে খুচরা টাকা থাকে না। খুচরো করাতে হয়েছে।”

–“ধন্যবাদ, বাবা।”, নৈরা হাসিমুখে বলল। নুহাশ মাহমুদ স্নেহের হাসি নিয়ে মেয়ের এলোমেলো চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বলল,
–” গানের চর্চা কেমন চলছে? বাবাকে একটু গান গেয়ে শোনালে না!”

নৈরা বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত বলল,
–“চর্চা অনেক ভালো হচ্ছে বাবা। আমার গলা এখন অনেক ছেড়েছে। আমি নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গাইতে পারি।”

–“এতোকিছু শিখলে অথচ বাবাকে একটু বললেও না।”, নুহাশ মাহমুদ গম্ভীর গলায় বললেন। নৈরা মৃদু হেসে বলল,
–“শুক্রবার যখন তুমি বাড়িতে থাকবে তখন শোনাবো।”

–“আচ্ছা, তোমার ভাবি আর বোনরা আজ কি যেনো করছে—ঐ যে মেয়েরা নখে কি যেনো করে না ওগুলো। আমি বলেছি তোমার কাছেও পার্লারের মেয়েদের পাঠিয়ে দিতে। যা করতে চায় করতে দিও, হ্যাঁ?”, নুহাশ মাহমুদ কণ্ঠে নম্রতা অনুরোধ এনে বললেন। মেয়ের আদ্যোপান্ত যে তার মুখস্থ! তার ধারণাকে বরাবরের মতোই সত্য প্রমাণ করে নৈরা তীব্র বেগে নাকোচ করে বলল,
–“আমার এগুলো দরকার নেই বাবা। আমার হাত পায়ের নখ একদম কেটেকুটে পরিষ্কার। তারা করুক আমি করবো না।”

নুহাশ মাহমুদ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
–“সবসময় সবকিছুতে এতো উদাসীনতা কেনো আম্মা? তারা কতো আনন্দ আর আগ্রহের সাথে এগুলো সবসময় করে অথচ তুমি?”

নৈরা অস্থিরভাবে নিঃশ্বাস ফেললো। কপাল কুঁচকে অসন্তোষের সাথে বলল,
–“আমি এগুলোতে আগ্রহ পাই না বাবা। তোমরা কেনো রোজ রোজ এগুলো নিয়ে পড়ে থাকো? আমার ভালো লাগে না এসব। সবাই এক হবে এমন তো কোন কথা নেই।”

মেয়ে ক্রমশই সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে দেখে নুহাশ মাহমুদ আর কথা বাড়ালো না। কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–“বাবা একটু পরে বেরিয়ে যাবো। আসতে রাত হবে। তোমার কিছু লাগবে? লাগলে বলো আমি এনে দিয়ে তারপর যাবো।”

বাবার কথা শেষ হতেই নৈরা এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে কিছু খুঁজতে লাগলো। নুহাশ মাহমুদ জিজ্ঞাসা করে,
–“কি খুঁজছো?”

–“আমার আলু বুখারার কৌটাটা বাবা। কোথায় রাখলাম?”, নৈরা খুঁজতে খুঁজতে বলল। নুহাশ মাহমুদ নিরবে বারান্দায় চলে গেলো। সৌন্দর্যবর্ধনকারী সবুজ গাছের আড়ালে কাঁচের কৌটাটার এক অংশ দৃশ্যমান। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেটি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। নৈরা সেটি দেখে বলল,
–“ওটা বারান্দায় ছিল?”

–“কৌটার মালিক যে সারাদিন বারান্দাতেই থাকে!”, নুহাশ মাহমুদ হেসে বলল। নৈরা কৌটাটা হাতে নিয়ে দেখলো কৌটার শেষ প্রান্তে কয়টা আলু বুখারা রয়েছে। সে সেটি দেখিয়ে বাবাকে বলল,
–“শেষ! নিয়ে এসো।”

নুহাশ মাহমুদ হাসলেন। মেয়ের অবসরের পছন্দের সঙ্গী এই আলু বুখারা, বিড়াল আর বই। সে বলল,
–“আচ্ছা, বাবা পাঠিয়ে দেবো। এখন নাস্তা খেতে আসো। বাবার সাথে একসাথে খেয়ে নেবে।”

নুহাশ মাহমুদ পা বাড়ায় দরজার দিকে। কিন্তু নৈরা তখনো নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। সে পা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। জিজ্ঞাসা করে,
–“কি হলো আম্মা, যাবে না?”

নৈরা হাত কচলাতে কচলাতে ইতস্ততা নিয়ে বলল,
–“বাবা?”

নুহাশ মাহমুদ আবার পা বাড়ায় মেয়ের দিকে। বলে,
–“কিছু বলবে আম্মা?”

নৈরা ইতস্ততা নিয়ে কাবার্ডের কাছে এগিয়ে গেলো। কাবার্ডের পাল্লা খুলে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“এখান থেকে আমায় কোনটা পড়লে সুন্দর লাগে?”

নুহাশ মাহমুদ হেসে ফেললো অপ্রত্যাশিত কথায়। মেয়ের মাঝে সুন্দর নিয়ে স্পৃহা আছে তবে। সে মেয়ের ইতস্ততাকে আর গাঢ় হতে দিলো না। বলল,
–“তোমায় সবকিছু পড়লেই সুন্দর লাগে আম্মা। তবুও আমি দেখছি।”

সব সুতির কুর্তি আর থ্রি পিস। নুহাশ মাহমুদ বেছে বেছে বেগুনী রঙের একটা থ্রিপিস বের করলো। বলল,
–“এটা সুন্দর লাগবে তোমার উপর।”

নৈরা প্রগাঢ় হেসে মাথা নাড়লো। বাবার থেকে জামাটা নিয়ে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“আচ্ছা।”

–“আজ কোন বিশেষ কিছু আছে আম্মা?”

নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
–“না বাবা এমনিই।”

নুহাশ মাহমুদ হেসে মেয়ের হাত ধরে নিচে নামলেন। মেয়ে তার অন্তর্মুখী কেমন ঘরকুনো স্বভাবের। জাগতিক কোনকিছুতে যে কোন আগ্রহ খুঁজে পায় না, একাকীত্ব, সাদামাটা জীবনযাপন আর বই পড়া ব্যতীত। কিন্তু অনার্স শেষ করার পর মেয়ে দিনকে দিন কেমন মাত্রারিক্ত ঘরকুনো এবং মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। সেই ভয় থেকেই দুই সপ্তাহ হলো তাকে বিরঙ্গনায় পাঠাচ্ছে। হয়তো এর মাধ্যমে একটু চঞ্চল হবে। নাস্তার টেবিলে সবাই তখন জড়ো হয়। নৈরা সদ্যই ফলের বাটিটা নিজের দিকে টেনে নিচ্ছিলো ওমনি তার হাত থেকে ছো মেরে কেউ বাটিটা নিয়ে নিলো। নৈরা শান্ত চোখে তাকায় মেজো ভাইয়ের দিকে।
নোমান ফলের বাটিটা নিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো। বড়ো বড়ো হা করে ইতিমধ্যেই সে কয়েকটা ফল খেয়ে ফেলেছে। নুহাশ মাহমুদ বিরক্তি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ছেলের দিকে। গম্ভীর গলায় বলল,
–“নৈরার ফলের বাটি ওকে দিয়ে দাও, নোমান।”

নোমান নিরুদ্বেগ শুনলো বাবার কথা। ফলের বাটিটাও দিলো কিন্তু অর্ধেকটা খেয়ে। নৈরার মা রাগান্বিত চোখে ছেলের দিকে তাকায়। তবে নৈরার মাঝে কোন উদ্বেগ দেখাগেলো না সে নিরবে সেই অর্ধেকটাই খেতে লাগলো। নোমান হতাশ হয় ছোট বোনের নির্লিপ্ততায়। নুহাশ মাহমুদ হাঁক ছেড়ে বললেন,
–“নৈরার জন্য আরেক বাটি ফল নিয়ে আসো, মিতা।”

–“আনছি।”, নৈরার মা মিতা বলল। নৈরা এবং নোমানের বড়ো ভাই নিরাদ ততক্ষণে টেবিলে এসে বসে
ছয় বছরের মেয়েকে নিয়ে। বসেই বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“নুরু, ভাইজান টোকিওতে যাচ্ছি এক সপ্তাহের জন্য। কি কি লাগবে আমায় একটা লিস্ট করে দেবে।”

নৈরা চোখ তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে। হেসে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“চারটা হাসের ছানা আর একটা খরগোশ এনো। হাসের ছানা বাথটাবে ছেড়ে দিলে অনেক সুন্দর লাগে।”

নিরাদের খাওয়া থেমে গেলো। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো বোনের দিকে। চোখেমুখে অসন্তোষের রেশ। তন্মধ্যেই নুহাশ মাহমুদ আর নোমান মাহমুদের উচ্চস্বরে হাসি ভেসে আসলো। নিরাদের স্ত্রী ও মৃদু হাসলো ননদের কথায়। তার ননদ এমনি! একটু অদ্ভুত, একটু মিষ্টি! নিরাদ ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল,
–“জাপান থেকে আমি তোমার জন্য হাসের ছানা আর খরগোশ আনবো?”

নৈরা চুপসে গেলো। আর কথা বাড়ায় না। নুহাশ মাহমুদ ছেলেকে থামিয়ে বলল,
–“তোমার কিছুই আনতে হবে না। আমার আম্মার যদি কিছু প্রয়োজন হয় তবে আমি যেকোনো মূল্যে তা হাজির করবো। হোক সেটা টোকিও কিংবা হাসের খামার। তুমি তোমার কাজে যাও।”

পরপরই বলল,
–“আম্মা, আপনার হাসের ছানা চাই?”

নৈরা চকচকে দৃষ্টি ফেলে বলল,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা! হলুদ রঙের! খুব আদুরে লাগে তাদের। আর একটা খরগোশ ও, সাদা রঙের।”

–“বাবা এনে দেবো , আম্মা।”

বাবার কথায় নৈরা গাল ভরে হাসলো। নিরাদ, নোমান নিরবে দেখলো সেই হাসিটুকু। বোনের কর্মকান্ডে তারা প্রায়শই বিরক্ত আবার প্রায়শই মুগ্ধ হয়।
*****
ঠিক আরেকটি কাঞ্চনবেলায় প্রকৃতির মাঝে বিভোর চিত্ত, অপেক্ষারত! উচ্চস্বরে গান, গাড়ির সাইরেন, মানুষের কোলাহল, কর্মব্যস্ততায় মুখরিত বিরঙ্গনার সম্মুখ পথধার। টারজো দিয়ে নান্দনিকতার সাথে গড়া ফুটপাত ঢেকে গিয়েছে ঝরাফুলের আস্তরণে। কখনো গোলাপী , কখনো হলুদ, কখনো সাদা ফুলের সমারোহ। প্রকৃতি নিজ উপায়ে আল্পনা এঁকে চলেছে। যেই আল্পনা নিজস্ব সুবাসে সুবাসিত। সপ্তাহের শুরুর দিকে পাঁচটা থেকে পাঁচটা বিশের মধ্যে ব্যাংকের কাজ শেষ হলেও সপ্তাহের শেষ দিনগুলো ছয়টা পেরিয়ে যায়।

ঠিক পাঁচটা বিশে ব্যাংক কর্মকর্তারা একে একে সিঁড়ি বেয়ে নামলো। গতরে তাদের অলসতা। কানে ফোন ঠেকিয়ে স্বরূপ ব্যস্ত কণ্ঠে কলিগদের বিদায় সম্ভাষণ জানায়। বুট জুতোয় ঝরা ফুলগুলো পিষতে পিষতে বড়ো বড়ো কদম ফেলে স্ট্যান্ডের কাছে যায়।
–“আম্মা! এখন বলো এতক্ষণ শোনা যাচ্ছিলো না।”

বলতে বলতেই স্বরূপ বেঞ্চিতে গা এলিয়ে দেয়। অপরপ্রান্ত থেকে কিছু বলছে আর স্বরূপ হ্যাঁ হুঁ করছে।
সেই ব্যস্ত মুখশ্রীটি দেখতেই যেনো এতক্ষণের অপেক্ষারা শেষ হলো। নৈরা প্রাণোচ্ছ্বল হাসি নিয়ে সদ্য আনা দুটি ধোঁয়া ওঠা মাটির চায়ের ভাঁড়ের দিকে তাকালো। সেখান থেকে একটি চায়ের ভাঁড় দুই হাত দূরে বসা লোকটির কাছে ঠেলে দিয়ে আবার চুপটি করে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। নিজ কর্মে ব্যস্ত মানুষটার বদ অভ্যাস এখানটাতে দশ মিনিট কাটানো। ঐ যে কর্নকুহরে শ্রুতিমধুর শব্দতুলে প্রবেশ করছে কতো সুরেলা কণ্ঠের গান। দায়িত্বে পরিপূর্ণ ব্যস্ত এই জীবনে এই দশ মিনিট ই স্বরূপের নিজস্ব হয়। কানে ফোন ঠেকিয়ে ঘামে ভিজে ওঠা শার্ট ঝাড়তে ঝাড়তেই নিজের বা পাশে তাকালে অপ্রস্তুত হয় উৎসুক দুটি ক্ষণপরিচিত দৃষ্টি দেখে। পরপরই তার উদাসীন দৃষ্টি আকর্ষণ করে মাটির চায়ের ভাঁড় দেখে। সে আর এক পলক তাকায় এক গাল আলাভোলা হেসে তাকিয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। দুই মিনিট বাদ ফোন রাখতেই নৈরা চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“ভালো আছেন?”

স্বরূপ সৌজন্য হেসে বলল,
–“জি, কিন্তু এই চা কিসের জন্য?”

–“আপনি আমার থেকে ত্রিশ টাকা পান। কিন্তু ত্রিশ টাকা ফেরত দিলে খারাপ দেখায়। আবার না দিতে পারলে আমার ভালো লাগবে না। তাই এই চা, আশাকরি আপনি নাকোচ করবেন না।”, ঠিক যেনো মুখস্থ বিদ্যা উগড়ে দেয়ার মতো করে বলল নৈরা। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“আপনি এখনো ত্রিশ টাকায় আঁটকে আছেন? যাক, চায়ের জন্য ধন্যবাদ!”

বলেই স্বরূপ চায়ের ভাঁড়টা তুলে নেয়। অদূরে পথে দৃষ্টি রেখে এক সিপ মুখে তুললে, ক্লান্ত বদন একটু স্বস্তি পায়। পুরুষ মানুষের অদ্ভুত এক স্বভাব—তীব্র গরম, কর্মব্যস্ততার মাঝেও এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম গরম চা তাদের মনে প্রশান্তি আনতে সক্ষম! স্বরূপ চা পান করতে করতে আরেক পলক তাকায় পা ঝুলাতে থাকা মেয়েটির দিকে। তার পাশে রাখা চা টি তখনো কাপেই রয়েছে। তা দেখে সে শুধায়,
–“আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। পান করছেন না কেনো?”

নৈরা হকচকায় স্বরূপের কথায়। সৌজন্য হেসে চায়ের ভাঁড় টা হাতে নেয়। মিনমিনে স্বরে বলল,
–“আসলে চা অনেক তেঁতো। আমি খেতে পারছি না। আমি চা খাওয়ার মধ্যে একটু দুধ চা’ই খাই। ”

–“তবে কিনলেন কেনো?”, স্বরূপ চায়ে সিপ দিতে দিতে শুধায়।

–“আপনার জন্য। আপনি তো মনে হয় পুরুষদের চা খেতে পছন্দ করেন তাই আমি এটাই নিয়েছি। আপনি রঙ চা আমি দুধ চা বিষয়টা ভালো দেখাতো না।”, মেয়েটির মনে যা মুখে তা—এই সোজাসাপ্টা স্বভাবটা স্বরূপের ভালো লাগলো। সে কৌতুহলী নয়নে তাকিয়ে শুধায়,
–“পুরুষদের আবার চা হয়?”

নৈরা বড়ো বড়ো নেত্র নিয়ে মাথা নেড়ে বলল,
–“হয়, বাবা বলে পুরুষ মানুষ টং এর দোকানের সারাদিনের জ্বাল করা কড়া লিকারের চা পছন্দ করে। তাদের খুশি করার জন্য এমন এক কাপ চা ই যথেষ্ট!”

স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“আপনার বাবা ঠিক বলে।”

নৈরা প্রাণোচ্ছ্বল হাসলো। স্বরূপ চায়ের ভাঁড় টা রেখে বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে যায় টং এর দোকানের সামনে বসা ছোলা ওয়ালার দিকে। নৈরা ভ্রু কুঁচকে পিটপিট করে দেখতে লাগলো তাকে। স্বরূপ মিনিট তিন বাদ ফিরে আসলো ঠোঙায় করে ছোলা মাখা নিয়ে। নৈরার দিকে ঠোঙাটা এগিয়ে দিতেই নৈরা বিদীর্ণ দৃষ্টিতে‌ তাকায় ঘর্মাক্ত মুখপানে। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“আপনি বরং এটা খান।”

বলতে বলতেই স্বরূপ নৈরার চায়ের ভাঁড়টা নিজের হাতে নিয়ে বলল,
–“আর আমি চা দুই কাপ। এটা ফিরিয়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই, আমি খুশি হয়ে দিয়েছি।”

নৈরা মৃদু হাসলো স্বরূপের শেষের কথাটিতে। অতঃপর বেঞ্চির দুই ধারে দু’জন নিজেদের পছন্দের খাবার উপভোগ করতে লাগলো। আরো দুইজন বেঞ্চিতে এসে বসতে চাইলে স্বরূপ তাদের বসার জায়গা দিলো। ফলস্বরূপ তাদের মধ্যকার দূরত্ব কমলো এক হাত। নৈকট্য বাড়তেই নৈরার কৌতুহলী মনটি উদ্বত হলো তার কৌতুহল মেটাতে। অন্যদিকে তাকিয়ে চা খেতে থাক লোকটির বুকে ঝুলতে থাকা কার্ডটির দিকে উঁকি দিয়ে তাকায় নৈরা। ছোট ছোট অক্ষর বোঝা দ্বায় হয়ে উঠতেই সে আরেকটু নুইয়ে এলো। স্বরূপের ভ্রু কুঁচকে গেলো অতি নিকটে উঁকি দেয়া মুখটি দেখে। সে নিরবে দেখতে লাগলো মেয়েটির কাজ। দেখতে দেখতেই নৈরার দৃষ্টি মিলে গেলো স্বরূপের সাথে। নৈরা হতচকিত সোজা হয়ে বসল। হড়বড়িয়ে বলল,
–“আসলে..ঐ না মানে….”
তার কথা অসম্পূর্ণ ই থেকে গেলো। স্বরূপ থমথমে মুখে বুক থেকে কার্ডটা নৈরার দিকে তুলে ধরে বলল,
–“স্বরূপ…স্বরূপ ইব্রাহীম।”

ধরা পড়ে যেতেই নৈরা কৃত্রিম হাসলো। আবার জড়োসড়ো হয়ে বসে রইল। স্বরূপ মৃদু হেসে শুধায়,
–“আপনার গাড়ি এখনো আসেনি?”

–“উঁহু!” , নৈরা ছোট্ট করে জবাব দেয়। পরপরই লোকটির দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,
–“আপনি কি আজো সব্জি কিনতে যাবেন?”

আজো? ছোট্ট ঐ শব্দটি স্বরূপকে আকর্ষণ করলেও এড়িয়ে গিয়ে বলল,
–“হুঁ।”

–“রোজ সব্জি কিনতে যান?”

–“হুঁ।”

–“কেনো?”

–“সতেজ সব্জি খেতে অনেক স্বাদ তাই।”

–“আপনি কি বাজার থেকে সব্জি কিনেন? ঐ যে যারা বাজারে ঝুড়িতে ঝুড়িতে সব্জি বিক্রি করে অনেকে মানুষ একসাথে—ওখান থেকে?”, মেয়েটির প্রবল উৎসুক কণ্ঠে স্বরূপ মাথা নেড়ে বলল,
–“হুঁ, সন্ধ্যা বাজার থেকে।”

–“সন্ধ্যা বাজার? আমি শুনেছি সন্ধ্যা বাজার অনেক বড়ো।”

–“হুঁ, মোটামুটি।”, এতোটুকু বলে কিয়ৎকাল নিরবতায় আচ্ছন্ন হলো দুই মানব মানবী। নৈরা হাত কচলাতে কচলাতে আড়চোখে তাকায় পা দোলাতে দোলাতে চা খেতে থাকা লোকটির দিকে। মিনমিনে সতর্ক কণ্ঠে শুধায়,
–“আমায় নিবেন?”

স্বরূপের ললাটে অনুমতিবিহীন ভাঁজের সৃষ্টি হলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টি রাখে কাঁচুমাচু করতে থাকা মেয়েটির দিকে। জিজ্ঞাসা করে,
–“কোথায়?”

–“সব্জির বাজারে।”, নৈরা মিহি স্বরে জবাব দেয়।

–“সব্জির বাজার কোন যাওয়ার মতো জায়গা হলো?”

নৈরা যেনো একটু হলেও ভয় কাটাতে সক্ষম হলো, স্বরূপের নম্র কণ্ঠে। সে বলল,
–“আমার কাঁচা বাজারে যেতে খুব ভালোলাগে। ছোটবেলায় একবার গিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর আর কখনো যাইনি। কেউ নিয়েও যায় না আর না যাওয়ার অনুমতি আছে। তাই আরকি!”

স্বরূপ শুনলো তার কথা। কিয়ৎকাল বাদ গম্ভীর গলায় বলল,
–“একা একটা মেয়ে অচেনা একটা ছেলের সাথে সব্জির বাজারে যেতে চাইতে ভয় করছে না আপনার? আমি যদি আপনাকে নিয়ে মে/রে ফেলি?”

স্বরূপের গম্ভীর মুখ দেখে নৈরা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কোলের মাঝে রাখা দুই হাত মুঠো করে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“আপনি অচেনা নন। আমি আপনাকে চিনি। রোজ রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা গলির মোড়ে আপনি বন্ধুদের সাথে চা খান। আমি জানি আপনি আমায় মে/রে ফেলবেন না।”

এসেছে থেকে যেনো স্বরূপ আশ্চর্য ই হচ্ছে মেয়েটির কথায়। স্বরূপ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটির মুখপানে। স্বরূপের কুঁচকানো দৃষ্টি দেখে নৈরা চঞ্চল কণ্ঠে সাফাই দিয়ে বলল,
–“আসলে আপনি যেই চায়ের দোকানে বসেন সেটা একদম আমার ঘরের বারান্দা বরাবর। সব স্পষ্ট দেখা যায়।”

মনে প্রশ্ন জাগলো অহেতুক। তবুও বরাবরের মতো সেই প্রশ্ন এবং আশ্চর্য ভাব লুকিয়ে নিয়ে স্বরূপ বলল,
–দূর থেকে কাউকে দেখলেই চেনা পরিচিত হয়ে যায়? আমি যে ভালো তার নিশ্চয়তা কি?”

–“অনেকের দৃষ্টি গভীর হয়। দূর থেকে এক জনের কর্মকাণ্ড দেখলেও বোঝা যায় সে ভালো না-কি খারাপ। আর আপনি খারাপ নন। কারণ আপনার বন্ধুরা আপনাকে রোজ সিগারেট খেতে বলে কিন্তু আপনি রোজ তাদের না করেন। কখনো সিগারেট ছুঁয়েও দেখেন না। আর যে ছোট্ট একটা খারাপ কাজকে না করার ক্ষমতা রাখে সে বড়ো খারাপ কাজ গুলোকেও খুব সহজেই না করতে পারে। তাই আমি বুঝেছি আপনি ভালো।”, বেশ বিজ্ঞদের মতো শোনালো মেয়েটির কণ্ঠ। ঠান্ডা চা হাতে স্বরূপ তখনো সূচালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে মেয়েটির দিকে। কিয়ৎকাল বাদ ধিমি কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
–“তা গভীর দৃষ্টি কি সবার জন্যই নাকি কোন একজনের জন্য? দশ বারো জন ছেলেদের মধ্যে আপনার গভীর দৃষ্টি আমাকে ই বা পর্যবেক্ষণ কেনো করলো?”

নৈরা মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে জবাব দেয়,
–“সবার জন্যই।”

–“ওহ্!”, স্বরূপ মৃদু হেসে বলল। ততক্ষণে খালি চায়ের ভাঁড় দু’টো নিজেদের জায়গা করে নিয়ে বেঞ্চির উপর। স্বরূপ চায়ের ভাঁড় দু’টো দিয়ে আসে। গলার কার্ড খুলে পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে অদূরে এক রিকশা চালককে ডাক দিলো হাত নেড়ে। নৈরা তখনো বেঞ্চিতে বসে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে। চলে যাচ্ছে? তাকে নেবে না? সে আবারো মিনমিনে স্বরে শুধায়,
–“নিবেন না?”

এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বলে,
–“রিকশা ছাড়া যাবেন কি করে? হেঁটে যেতে পারবেন?”

মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“না, রিকশা ডাকুন।”

স্বরূপ আবারো শুধায়,
–“আপনার বাড়ির লোক চিন্তা করবে না?”

নৈরা হেসে বলল,
–“তারা জানবেই না।”

স্বরূপ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
–“এটা ঠিক নয়।”

–“আমরা জাগতিক যা যা করি তা কোনকিছুই ঠিক নয়। তবে ক্ষুদ্র এই বেঠিক খুব বেশি ক্ষতিসাধন করবে না। আপনি চিন্তা করবেন না।”, নৈরা স্মিত হেসে বলল।

রিকশায় দুই ধারে দুটি মুখ দিনের অন্ত দেখতে ব্যস্ত। মেয়েটির দুই আঙুলের ছোট্ট একটা চিমটির মাঝে আঁটকে আছে শার্টের ক্ষুদ্র একটি অংশ। শার্টের মালিক সেই চিমটির অস্তিত্বটুকুও অনুভব করতে পরবে না স্পর্শটি এমন। এই ছোট্ট একটি সাপোর্ট জীবনে প্রথমবার‌ রিকশায় ওঠার ভয় জনিত কারণে। রিকশা তার গন্তব্যে পৌঁছাতেই নৈরার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বিশাল একটা সব্জির বাজার দেখতেই চারিদিকে তাজা তাজা সব্জি। স্বরূপ নিরবে দেখলো মেয়েটির উচ্ছ্বাস। এগিয়ে যায় সন্ধা বাজারের ভেতর। নৈরা তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতেই পুদিনা ওয়ালা ডেকে বলে,
–“আপা পুদিনা পাতা নেন।”

নৈরা চকচকে দৃষ্টিতে স্বরূপের দিকে তাকায়। ডেকে বলে,
—“স্বরূপ, পুদিনা পাতা নিন।”

মেটে আলু দেখতে দেখতে স্বরূপ জবাব দেয়,
–“পুদিনা পাতা লাগবে না, নৈরা।”

নৈরা চকিতে তাকায় সব্জি দেখতে ব্যস্ত স্বরূপের দিকে। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধায়,
–“আপনি আমার নাম জানেন? কই আমি তো একবারো আপনাকে আমার নাম বলিনি।”

স্বরূপের হাত থামে। উষ্ণ এক নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে অতি শান্ত স্বরে বলল,
–“আমি না, পুরো শহর আপনার নাম জানে।”

–“এটা অসম্ভব। পুরো শহর কেনো আমার জানবে? আপনি সত্যি করে বলুন আমার নাম কি করে জানলেন? আপনি আমায় আগে থেকে চিনতেন?”, মেয়েটি কণ্ঠে জোর দিয়ে বলল। স্বরূপ শান্ত দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে বলল,
–“আপনার বাবা শহরের নাম করা ধনী ব্যক্তি। খুব অস্বাভাবিক নয় আপনার নাম জানা।”

–“আমার বাবা ধনী। আমি তো নই। আপনি কি সত্যি বলছেন? আপনি আমায় আগে থেকে চিনতেন না?”

স্বরূপ মৃদু হেসে শান্ত স্বরে বলল,
–“উহু! আমি আপনাকে আগে থেকে চিনতাম না।”

–“ওহ্!”, নৈরা মিহি স্বরে বলে। স্বরূপ মায়ের বলা সব্জি কিনলো। কেনা শেষ হলে, বের হতে নিলে নৈরা চারিকে তাকিয়ে বলল,
–“আপনি তো কিছুই কিনলেন না?”

স্বরূপ পিছু ফিরে তাকায়। ব্যাগ দেখিয়ে বলে,
–“এগুলো কি তবে?”

নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“এগুলো ও সব্জি। কিন্তু আপনি গাজর, ক্যাপসিকাম, ব্রকোলি, বিট কপি কতো সব্জি আছে ওগুলো তো কিনলেন না।”

–“ওগুলো আমার প্রয়োজন নেই, নৈরা।”

–“কিন্তু আমার তো অনেক কিছু কিনতে ইচ্ছা করছে।”

–“তবে কিনুন।”, স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল। নৈরার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে নিজের পছন্দসই রাজ্যের সব্জি কিনলো। নৈরার মন ভরতেই তারা সেগুলো নিয়ে বাইরে বের হয়। নৈরা হঠাৎ তার গতি থামিয়ে বলল,
–“এতো সব্জি দিয়ে আমি এখন কি করবো? এগুলো বাড়িতে নিলে সবাই আমায় বকা দিবে।”

স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“সেটা কেনার আগে বিবেচনা করা উচিৎ ছিল।”

–“এখন? এগুলো বরং আপনি নিয়ে যান। তাহলেই তো সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে”, নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। স্বরূপ শান্ত তবে দৃঢ় কণ্ঠে নাকোচ করে বলল,
–“এগুলো দিয়ে কি করবেন সেটা আপনার চিন্তা, নৈরা। আমি কোনরূপ সাহায্য করতে পারছি না আর না এগুলো আমি নিচ্ছি। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, ফার্স্ট!”

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বাসার সবাই হুলুস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে দেবে। নৈরা তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,
–“আপনি অনেক কঠোর, স্বরূপ!”

স্বরূপ স্মিত হেসে বলল,
–“আপনি অনেক সহজ, নৈরা।”

নৈরা রাগ দেখাতে দেখাতে ফুটপাতের উপর বসে থাকা ভিক্ষুকের কাছে হেঁটে গেলো। সব সব্জিগুলো তাকে দিয়ে আসলো।

চলবে…