কাঞ্চনবেলা পর্ব-০৩

0
2

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ৩

দমকা হাওয়ার ন্যায় বয়ে চলা জীবনে স্বামী ব্যতীত পথচলাটুকু কতোটা কঠিন হয়? যতোটা কঠিন সাধনার কল্পনাতীত।
সাধনাকে তার বাবা কখনো পৃথিবীর কুৎসিত দিকগুলোর সাথে পরিচিত হতে দেয়নি, বিয়ের পর স্বামীও আগলে রেখেছে, স্বামীর ছায়া সরে গেলে ভাই আগলে রেখেছে। তার জীবনটা এই নিরাপদ বলয়ের মাঝেই ঘেরা। সে অনভ্যস্ত এই কুৎসিত দিকগুলোর সাথে লড়াই করতে।

ডিসপ্লে কেবিনেটের সাথে লেপ্টে আছে থরথরিয়ে কম্পনরত মেয়েটির দেহ। এলোমেলো চুল, ঘেমে উঠেছে লালচে গাল গলা। অশ্রুসিক্ত ভয়ার্ত কোনা চোখ অতিনিকটে ঘৃণ্য কুৎসিত এক বয়স্ক লোকের দিকে। দু’হাতে পুরো গায়ে আঁচল জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে আছে সাধনা। ফের কাঁধ থেকে কনুই পর্যন্ত অশালীন ভাবে ছুঁয়ে যায় বয়স্ক লোকটির অভিশপ্ত হাত। লোকটি চাপা স্বরে বলে উঠলো,
–“সাধনা, এতো ভয় পাচ্ছো কেনো? কোন ভয় নেই। আমি তো সবসময়ই তোমায় কতো স্নেহ করে আসছি। তাই নয় কি? তবে? এখন নাহয় তোমায় একটু বেশি ভালোবাসবো। শোন আগামীকাল থেকে শুধু তুমি আমায় দুই ঘন্টা করে একান্তে সময় দিবে। আমরা নিজেদের মতো করে সময় কাটাবো। আমি জানি তোমারো ইচ্ছে করে কারোর ভালোবাসা পেতে। আজ কতো বছর যাবৎ বিধবা। তার উপর আবার আর্থিক সংকট। এই কটা টাকা ইনকামে তোমার কিছু হয় না আমি বুঝি। তুমি আমার কথা শুনে চললে মাস শেষে তোমায় টাকার চিন্তা করতে হবে না। যতো টাকা প্রয়োজন আমি দেবো, শুধু তুমি একটু আমায় খুশি করবে।”

কর্নকুহরে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি করে ঘৃণ্য কথাগুলো প্রবেশ করলো সাধনার। ঘৃণ্য ঐ পরিবেশে ক্রমশই ভারসাম্য হারাতে বসে সাধনা। জীবনে একা পথচলা এতো কঠিন কেনো। কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচল সরতে নিলেই সাধনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অনুনয় করে বলে,
–“আমায় যেতে দিন।”

বয়স্ক লোকটি বিশ্রী হেসে বলে,
–“যাবে তো। আমি কি তোমায় আঁটকে রাখবো সারাজীবন! আমি তো শুধু দিনশেষে তোমার কাছে একটু সুখ খুঁজি সাধনা। আর তাতে তোমারো লাভ হলো। এই চাকরিটা তোমার কতো প্রয়োজন তা তো আমি জানি।”

–“বাহ্ বাহ্! মতি, তুই আমার বাপের টাকা নিয়ে নিজের সুখ খুঁজছিস? তোর এলেম আছে বলতে হবে।”

মতিউর রহমান চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নিজের কক্ষের দরজার পানে। আধখোলা দরজার কপাটের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে নোমান মাহমুদ। মতিউর তড়িৎ গতিতে ছেড়ে দেয় সাধনাকে। সাধনা আরো দৃঢ়ভাবে শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নিলো। চোখের সামনে ক্রমশই সব ধোঁয়াশা হয়ে আসছে। দোদুল্যমান দেহ নিয়ে সাধনা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যাচ্ছে। তাকে এখান থেকে বের হতে হবে। মতিউর সৌজন্য হেসে বলল,
–“আরে নোমান, তুমি? তোমার বাবা পাঠিয়েছে? এসো। ও হলো সাধনা আমার খুব কাছের একজন মানুষ। বুঝতেই পারছো। এই এনজিওতেই কাজ করে। বিধবা, তাই নিজের দূরাবস্থা বলছিল আমায়।”
শেষের কথাগুলো মতিউর মিটিমিটি হেসে বললো। নোমান চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিল। মতিউরের কথায় তার মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় দপদপ করতে লাগলো রাগে। এক পলক দেখে বিধ্বস্ত ক্রন্দনরত নারীটির দিকে তাকিয়ে তেড়ে গেলো মতিউরের দিকে। বিলম্বহীন এক তীব্র মুষ্টিঘাতে মতিউর মুখ থুবড়ে পড়লো ডেস্কে। নোমান রাগে হিসহিসিয়ে বলল,
–“জা/নো/য়া/র একটা! বিধবা বলে ফয়দা নিচ্ছিলি? তোকে তো মে/রে ফেলবো আমি।”

বলেই নোমান একটা লাথি মারলো মতিউরকে। সাধনা আ’ত’ঙ্ক জর্জরিত চোখে তাকায় রক্তাক্ত মতিউরের দিকে। মস্তিষ্ক থেকে নিজের বিধ্বস্ত অবস্থা মিলিয়ে গেলো। শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আজকের এই সিনক্রিয়েটের পর যদি তার চাকরিটা না থাকে তবে স্বরূপের জন্য পথচলা আরো কঠিন হয়ে যাবে। অন্তত এর কারণে ছেলেটার মাথা থেকে একটু বোঝার ভাড় কমে। এনজিওতে চাকরি করে মাসে যে তিন হাজার টাকা পায় এতে তাদের খাওয়া-দাওয়া কোনরকম চলে যায়। এতো টুকু যদি না থাকে তবে…একসাথে‌ লোন বাসার খরচ ছেলেটা কিভাবে করবে? সে দ্রুত আগুন্তক লোকটিকে গিয়ে থামায়।

–“থামুন, থামুন। মারবেন না ওনাকে। ওনার কোন দোষ নেই। উনি কিছু করেনি।”

নোমান হতবাক হয়ে গেল নারীটির কথায়। যে কি-না চোখের সামনে মিথ্যা বলছে। সে এসেছে আরো দশ মিনিট আগে। পুরোটাই দেখেছে এবং শুনেছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“আপনি ভয় পাচ্ছেন কেনো? কোন ভয় নেই এটাকে আমি দেখে নেবো।”

সাধনা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। শুকনো ঢোক গিলে বলল,
–“আমি কোন ভয় পাচ্ছি না। আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সে আমার সাথে কিছু করেনি। ছাড়ুন তাকে।”

নোমানের রাগ এবার ঠিকরে পড়লো সাধনার উপর। সে গর্জে উঠে বলল,
–“ওহ্, তার কোন দোষ নেই? তারমানে আমি ভুল তাই না? আপনার ও প্রফিট রয়েছে এর মধ্যে। টিপিক্যাল থার্ড ক্লাস টাইপ মহিলা! বিধবা বলে এভাবে পেট চালাতে হবে? কেনো বিধবারা সৎ পথে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে না?”

সাধনা নিথর দেহে শুনে নিলো সেই ঘৃণ্য তকমা গুলো ও। একদম নিরবে, নির্বিকার। বারংবার শুধু অবচেতনেও উচ্চারণ করে যাচ্ছে তাকে এই চাকরিটা টিকিয়ে রাখতে হবে যতোদিন না অন্য কোন উপায় হয়। নয়তো তার ভাইটার উপর বোঝা বাড়তেই থাকবে। নোমান রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে মতিউর কে আরেকটা লাথি দিয়ে বলল,
–“এই বা/স্টা/র্ড! আগামী সপ্তাহের মাঝে বাবা’র সব টাকা ক্লিয়ার করবি। নয়তো তোর এই এনজিও আমি ভেঙেচুরে চুরমার করে ফেলবো। মনে থাকে যেনো! এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং।”

সাধনার দিকে এক পলক অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নোমান গটগট করে বেরিয়ে যায়।
*****
তৃতীয় কাঞ্চনবেলায় প্রকৃতিতে খানিক বাউন্ডুলে সমীরনের আধিপত্য। সেই বাউন্ডুলে সমীরনের সাথে পেরে উঠছে না বাগানবিলাস ফুলগুলোর দূর্বল বোঁটা। তারা নিজেদের সৌন্দর্য খুইয়ে টুপটাপ ঝরে পড়ছে। ঝরা ফুলগুলো, সাদামাটা বেশভূষায় বসে থাকা মেয়েটির কালো কুচকুচে এলোমেলো চুলগুলোর উপর বিস্তীর্ণ হয়ে পড়ে আছে, একদম অযত্নে। কেননা চুলগুলোর মালিকের যে আজ মন খারাপ। সাদা গোল ফ্রক সাথে সাদা পায়জামা,সাদা ওড়নায় থাকা এক উদাসীন নারী দেহ বেঞ্চির এক কিনারায় ঝিমিয়ে বসে আছে। বকুল ফুলের সুগন্ধ ও আজ বড্ডো বিতৃষ্ণাময় ঠেকছে নৈরার কাছে। আধাআধুরা গানের চর্চা রেখে কারণ ব্যতীত স্টিলের এই বেঞ্চিতে এসে বসে আছে। কারণ ব্যতীত মুখে বললেও অন্তঃস্থলে অপেক্ষাদের দূধ্বর্ষ রাজত্ব চলছে। পাঁচটা বিশ—থেকে পাঁচটা পঁচিশ কিন্তু তখনো বেঞ্চির অপরপাশ খালি ই পড়ে রইলো। অথচ পাঁচ মিনিটের এই বিলম্বে নৈরার মনে হচ্ছে আজ তাকে মুখ দর্শন বিহীন বাড়ি ফিরতে হবে। উদাসীনতায় দৃষ্টি টলটল করে উঠলো। ঝাঁপসা দৃষ্টি পথধারে দাঁড়িয়ে থাকা ছোলা ওয়ালার দিকে। পা দোলাতে উদাসীন কণ্ঠে গেয়ে উঠলো,
“ভেসে এসেছি ঢেউয়ের তালে,
স্বপ্নেরা চোখে কথা বলে
তোমায় ছুঁতে চায় এ মন!
অজানা দেশের ক্যানভাসে
একা আমি বসে আছি তীরে
সন্ধ্যা নামে দিগন্তে
অপেক্ষাতে থাকবো কতো?
অবশেষে এসো ফিরে!……………”(কালেক্টেড)

–“আপনি অনেক সুন্দর গান করেন।”

শ্রান্ত কণ্ঠে ভেসে আসা বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই কণ্ঠে নৈরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। টলমলে আঁখি রাখে বেঞ্চিতে গা এলিয়ে বসা ঘর্মাক্ত পোশাকে থাকা ক্লান্ত মুখটির দিকে। বলে,
–“ধন্যবাদ!”

স্বরূপ পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে শুধায়,
–“আপনার গাড়ি আসেনি এখনো?”

–“নাহ।”, নৈরা ছোট্ট করে জবাব দেয়। স্বরূপ আর কথা বাড়ায় না চুপচাপ ফোনে দৃষ্টি রাখলো। কাঁটা কাঁটা চুলগুলো বেয়ে গড়িয়ে পড়া শ্বেদ জ্বল দেখতে দেখতে নৈরা মিহি স্বরে শুধায়,
–“গতকাল চায়ের দোকানে আসেননি কেনো?”

ফোনে চলতে থাকা হাতটি থামলো। দুই হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে নুইয়ে থাকা স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিমর্ষ চিত্তে বসে থাকা নারীটির দিকে। অযাচিত কৌতুহলের ইতস্ততার ছিটেফোঁটাও নেই চোখেমুখে। যেনো এই প্রশ্নের জবাব পাওয়া নারীটির অধিকার। নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী অন্তঃস্থল ও নারীটির অযাচিত কৌতুহলকে উপেক্ষা করতে পারে না। মিহি স্বরে জবাব দেয়,
–“কাজ ছিল।”

–“গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই? গুরুত্বপূর্ণ না হলে তো আসার কথা, তাই না?”, কণ্ঠে শিশুসুলভ আদল স্পষ্ট। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“জি, গুরুত্বপূর্ণ।”

–“ওহ্, কি কাজ ছিল?”, ফের অযাচিত কৌতুহল! স্বরূপ মৃদু হেসে চোখ রাখে জবাবের আশায় গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকা মুখটির দিকে। ঘোলাটে চোখের দিকে চেয়ে বলল,
–“কি কাজ! বলার মতো কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।”

–“তবে মিথ্যা বললেন কেনো? কেনো আসেননি?”, নৈরার কণ্ঠে ক্ষোভ! স্বরূপ উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসে। বলল,
–“প্রতিদিন চায়ের দোকানে যেই কারণে যাওয়া হয়, তা বিকালেই সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই যাওয়ার তাগিদ অনুভব করিনি।”

–“কিসের জন্য যাওয়া হয়?”

স্বরূপ ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে ধিমি কণ্ঠে বলল,
–“বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।”

–“কিন্তু গতকাল বিকালে তো আমি আপনার সঙ্গে ছিলাম। বন্ধুদের সাথে কখন দেখা করলেন?”

–“আপনি যাওয়ার পর। বাড়ি ফেরার পথে।”

একের পর এক অযাচিত প্রশ্নগুলোর জবাব যথাযথভাবে পেয়ে নৈরা শান্ত হলো। বলল,
–“ওহ্।”

স্বরূপ আবার নিজ খেয়ালে ডুবে যায়। অনুভব করে বিরঙ্গনা থেকে ভেসে আসা সমস্বরে সুরেলা কণ্ঠগুলোকে। নৈরা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাত কচলাতে লাগলো। কিয়ৎকাল বাদ সতর্ক কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“আজ সবজি কিনতে যাবেন না?”

বদ্ধ নেত্রে সুরে নিমগ্ন স্বরপ অনাগ্রহে বলে,
–“হুঁ।”

নৈরা আশাভরা চাহনিতে তাকিয়ে থাকে বদ্ধ নেত্রে ঘামে জ্বলজ্বল করা স্নিগ্ধ মুখটির দিকে। অযত্নের ছোঁয়ায় খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ফাটা পিচ রঙা ঠোঁট খানিকটা বেঁকে আছে।একা একা হাসছে কেনো? কিয়ৎকাল বাদ আবারো সতর্ক কণ্ঠে শুধায়,
–“আমায় নিবেন না?”

বদ্ধ নেত্রে স্বরূপ নিঃশব্দে গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। যেনো এতক্ষণ ধরে এই প্রশ্নটির ই অপেক্ষায় ছিল। সে নিশ্চল থেকে বললো,
–“আমি যদি এখন আপনার একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে, নির্জন জায়গায় নিয়ে মেরে ফেলি তখন কি হবে?”

নৈরা পা দোলাতে দোলাতে মিহি স্বরে বলে,
–“যে পথের নোংরা কুকুরটাকে সাথে বসিয়ে, মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তাকে বিস্কুট খাওয়ায়, তার দ্বারা এহেন অবান্তর আচরণ করা হাস্যকর। ঐ পথের নোংরা কুকুরটা যদি এতো ভালোবাসা পায় তবে আমি তো তার থেকে একটু উঁচু শ্রেণীর প্রাণী। আমি আরেকটু বেশি ভালোবাসা পাবো।”

সহসা বদ্ধ নেত্র খুলে যায়। দৃষ্টি রাস্তার ঠিক ওপারে থাকা বকুল ফুলের গাছটির দিকে। শ্রান্ত উদাসীন কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“আপনি দেখি একদিন দুদিনেই আমার আদ্যোপান্ত চিনে গিয়েছেন।”

–“একদিন দুদিন নয়, পুরো দুই বছর!”, মেয়েটি বড়ো বড়ো নেত্রে চঞ্চল কণ্ঠে বলে উঠলো। কিন্তু বলার পরে নিজেই থমকালো। নৈরার ইচ্ছে করলো দেয়ালে মাথা ঠুকতে। ভাইজানরা ঠিক বলে, সে একটা বোকা! স্বরূপ এবার ঘাড় কাত করে তাকায় থমকানো মুখটির দিকে। কিয়ৎকাল দেখে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলা মেয়েটিকে। অতঃপর ম্লান হাসলো। নৈরা চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
–“যাবেন না? সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।”

–“কিন্তু আমি তো আপনাকে নেবো না।”, স্বরূপ মৃদু হেসে বলল।

নৈরা অসহায় চোখে তাকালো। তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধায়,
–“কেনো? আমি তো আপনাকে বিরক্ত করি না।”

–“গতকালকের কথা ভুলে গিয়েছেন?”

নৈরা মিইয়ে গিয়ে বলল,
–“আচ্ছা, আর করবো না।”

স্বরূপ ফের হাসলো। তবে হাসিতে মলিনতা। পকেট খাঁ খাঁ করছে। এর মাঝে নৈরাকে বাজারে নিতে হলে তাকে রিকশা নিতে হবে। আপডাউনের রিকশা ভাড়াটাই তার বাড়তি খরচ হবে। এরপর বাড়িতে যেতে আবার তাকে রিকশা নিতে হবে। সে তো পায়ে হেঁটে যেতো সন্ধ্যা বাজার পর্যন্ত। বেঁচে যাওয়া টাকাটা দিয়ে অন্তত বুব্বোর জন্য একটা কিছু খাবার নিতে পারতো। তবুও চাপা নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“চলুন।”

নৈরার মুখের হাসি প্রগাঢ় হয়। ফের রিকশার পাশাপাশি আসনে দুজনের নৈকট্য বাড়লো। দুই ধারে দুই মুখ তখন পূর্বের ন্যায় দিগন্ত দেখতে ব্যস্ত। আর মেয়েটির দুই আঙুলের চিমটির মাঝে ভারসাম্য রক্ষার্থে স্বরূপের শার্টের আস্তিনের এক কোনা আঁটকে আছে।
সন্ধ্যা বাজারে ঢুকতেই বড়ো বড়ো মিষ্টি কুমড়া দেখতেই নৈরা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে স্বরূপকে বলল,
–“স্বরূপ, কুমড়া দেখুন। কি তাজা! নিন নিন কুমড়া নিন।”

–“কুমড়া প্রয়োজন নেই নৈরা।”, স্বরূপ কচি লাউ দেখতে দেখতে বলল। নৈরা বলল,
–“ওহ্।”

পরমুহূর্তেই পুঁই শাক দেখে সে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“স্বরূপ পুঁই শাক। দেখুন পাতাগুলো কতো বড়ো বড়ো। ওগুলো নিন।”

স্বরূপ সেটাও নিলো না। নৈরা ছুটছে আর সবজি দেখছে। বড়ো বড়ো সুগন্ধযুক্ত লেবু দেখতেই, সে সেগুলো ধরে দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে,
–“এই যে লেবু ওয়ালা ভাইয়া! এগুলো কতো?”

–“চল্লিশ টাকা হালি আপা।”

নৈরা বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠে,
–“মাত্র চল্লিশ টাকা?”

পরমুহূর্তেই সে হাঁক ছেড়ে স্বরূপকে ডাকে। স্বরূপ ধীরপায়ে এগিয়ে যায় তার দুই ধরনের সবজি কেনা শেষ ততক্ষণে। নৈরা লেবুগুলো দেখিয়ে বলল,
–“লেবু নিন স্বরূপ। অনেক বড়ো আর খুব লোভনীয় সুগন্ধ।”

স্বরূপ শান্ত স্বরে বলল,
–“লেবুর প্রয়োজন নেই নৈরা।”

–“তবে একটা ব্রকোলি নিন। ব্রকোলি আমার খুব পছন্দের।”, নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–” আপনি আমাদের বাড়িতে থাকলে নিতাম, নৈরা। কিন্তু এখন প্রয়োজন নেই। চলুন, সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।”

নৈরা মন খারাপ করে বলে,
–“তবে নিয়ে চলুন আমায় আপনার বাড়িতে।”

স্বরূপ হাসলো। বলল,
–“কখনো সামার্থ্য হলে নেবো, নৈরা।”

নৈরা বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
–“আপনি এমন কেনো? অনেক কঠোর!”

স্বরূপ বরাবরের ন্যায় শান্ত স্বরে বলল,
–“কারণ আপনার কাছে পৃথিবীটা একটু বেশিই সহজ, নৈরা।”

বলেই স্বরূপ বাজার থেকে বের হওয়ার পথ ধরলো। নৈরাও বিরাগভাজন নিয়ে তাকে অনুসরণ করে।
*****
বুব্বো বিস্তীর্ণ খেলার মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একের পর এক গুড শটের চিৎকার ভেসে আসছে। বোলারের দূর্বল বোলিং এর কারণে হঠাৎ বুব্বোর গতিবিধি ও দূর্বল হয়ে গেলো। ছোট্ট ছেলেটি রেগে গেলো। চেঁচিয়ে বলল,
–“আরে ঠিক করে বল করতে পারো না? বাড়িতে তোমায় ভাত দেয় না? জোরে বল করো।”

বুব্বোর কথায় ছেলেটি জোরে বল তো করলো কিন্তু সেটা বুব্বোকে ছাড়িয়ে আদূরে গিয়ে পড়লো। বুব্বোর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। সঙ্গীসাথীদের ও মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা নোমান, রিদওয়ান, শাফাক মৃদু হাসলো বুব্বোর মেজাজ খারাপ করে ব্যাট ছুঁড়ে মারা দেখে। ছোট্ট ছেলেটির মাঝে অদম্য চেষ্টা, সফলতার তৃষ্ণা স্পষ্ট। নোমানের পেছনেই দশ বারোজন দিনমজুর একে একে মাথায় করে ইট এনে স্তুপ বানাচ্ছে। তাদের ইটের ভাটা থেকে আনা হয়েছে এই ইটগুলো। বাবা এখানে একটা দালান করবে। তার ই জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ‌ আর সে দেখাশোনা করছে। বুব্বো মাঠ ছাড়তে গিয়ে টুকরো কয়েকটা ইটে বেঁধে পড়ে গেলো। হাফ প্যান্ট পড়া বুব্বোর নরম চামড়া কেটে রক্তের প্রবাহ সৃষ্টি হলো ক্ষীণ সময়ের মধ্যে। নোমান আর তার বন্ধুরা এগিয়ে যায়। নোমান হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে শুধায়,
–“হেই ক্যাপ্টেন! এতো মেজাজ খারাপ করছো কেনো? দেখেছো রেগে গেলে তো হেরে গেলে। কতো রক্ত বের হচ্ছে। আবার খেলবে কি করে?”

বুব্বো হাত দিয়ে অনাদরে রক্ত মুছতে মুছতে বলল,
–“এই সামান্য ব্যথা বুব্বোকে আটকাতে পারবে না আঙ্কেল। এগুলো সেরে যাবে। মামু আসলেই এগুলো সারিয়ে ফেলবে।”

–“কেনো তোমার মামু কি ম্যাজিশিয়ান?”, নোমান পকেট থেকে রুমাল বের করে আঘাতের জা গায় চেপে ধরে শুধায়। বুব্বো হেসে মাথা উপরনিচ করে। বলল,
–“মামুর কাছে বিশাল একটা বুক রয়েছে। আর তাতে বুক ভরতি ভালোবাসা রয়েছে। মামুর ভালোবাসা পেলেই বুব্বোর সব ব্যথা গায়েব হয়ে যায়।”

নোমান হাসে বাচ্চা ছেলেটির বুঝদারের ন্যায় কথায়
পরপরই চিন্তিত গলায় বলে,
–“রক্ত থামছে না ক্যাপ্টেন। চলো ফার্মিসিতে যাবে। এভাবে রাখলে ইনফেকশন হয়ে যাবে।”

বুব্বো নাকোচ করে বলল,
–“না আঙ্কেল! অপরিচিত কারোর সাথে যাওয়া মানা। মাম্মা কষ্ট পাবে।”

নোমান কি করবে ভেবে না পেয়ে রিদওয়ানকে বলল,
–“এই গিয়ে একটা স্যাভলন, অয়েনমেন্ট আর ব্যন্ড এইড নিয়ে আয়।”

রিদওয়ান এক ছুটে গিয়ে নিয়ে আসলো। নোমান বুব্বোর পা পরিষ্কার করে অয়েনমেন্ট লাগিয়ে ব্যন্ড এই লাগিয়ে দিল। অতঃপর বলল,
–“ক্রিকেট খেলবে?”

বুব্বো অনাগ্রহ প্রকাশ করে বলল,
–“না আঙ্কেল! দেখছো না চুনোপুঁটি গুলো ঠিকমতো বোলিং ই করতে পারে না। এদের সাথে খেলে এনার্জি নষ্ট করার কোন মানেই হয় না।”

নোমান আর তার দুই বন্ধু হেসে উঠলো। বলল,
–“চলো, আমরা তোমার সাথে খেলবো। দেখবো তুমি আমাদের বোলিং সহ্য করতে পারো কি-না।”

বুব্বো খুশি হয়ে গেলো। বড়োদের সাথে খেলার আনন্দ ই আলাদা। সে বলল,
–“ঠিক আছে চলো।”

প্রথম বলগুলো নোমান করতে লাগলো। তবে যতোই বল করছে ততোই তারা অবাক হয়
ছোট্ট ঐ ছেলেটি দ্রুতগামী প্রত্যেকটা বল ব্যাট ছোঁয়াতে সক্ষম হচ্ছে দেখে। নোমান যতো দ্রুত বল ই করুক না কেনো! সেটা বুব্বোর ব্যাট ছুঁয়ে যাচ্ছে। নোমান হতবাক হয়ে শুধায়,
–“ক্যাপ্টেন, এতো সুন্দর খেলা শিখলে কোত্থেকে?”

–“মামুর থেকে আঙ্কেল। মামু খুব সুন্দর খেলে।”

–“ওহ্, তোমার মামু কোথায়?”

–“মামু ব্যাংকে, আঙ্কেল। চাকরি করে।”

নোমান ঘাড় ঘুরিয়ে রিদওয়ানের দিকে তাকায়। জিজ্ঞাসা করে,
–“চিনিস ওর মামুকে?”

রিদওয়ান মাথা নেড়ে সায় জানায় বলে,
–“চিনি তো, স্বরূপ ভাই।”

–“ওহ্, তোদের সেই ইমিডিয়েট সিনিয়র স্বরূপ ভাই?”

–“হুঁ।”

–“আঙ্কেল, আমি এখন বাসায় যাই। মাম্মা বকা দেবে নাহলে।”, বুব্বোর কথায় নোমান হেসে বলল,
–“ক্যাপ্টেন, আঙ্কেল বলে আমায় বুড়ো বানিয়ে দিও না। এখন পর্যন্ত অবিবাহিত!”

বুব্বো ব্যাট হাতে এগিয়ে আসে। শুধায়,
–“তবে কি বলবো?”

নোমান কিয়ৎকাল ভেবে বলল,
–“ফ্রেন্ড? ফ্রেন্ড বলো।”

–“বন্ধু?”

–“হ্যাঁ।”

বুব্বো হেসে বলল,
–“আচ্ছা, বন্ধু! আল্লাহ হাফেজ।”

নোমান তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
–“আল্লাহ হাফেজ, ক্যাপ্টেন।”

বুব্বো ছুটে বাড়িতে চলে যায়। ঠিক সাড়ে ছয়টা নাগাদ স্বরূপ বাড়িতে আসে। কলিং বেল বাজাতেই স্বরূপের মা সুনিতা দরজা খুলে দেয়। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“আম্মা, আসসালামুয়ালাইকুম। বাজার নাও।”
মায়ের হাতে বাজার দিয়ে দিল স্বরূপ। সুনিতা সালামের জবাব দিয়ে বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই বুব্বোর মুখটি ভেসে উঠলো। স্বরূপ জুতা খুলতে খুলতে মৃদু হাসলো ভাগ্নেকে দেখে। বুব্বো অলস দেহে দুই পা এগিয়ে মামুর দিকে দুহাত মেলে দাঁড়িয়ে যায়। অলস কণ্ঠে বলে,
–“মামু, আসসালামুয়ালাইকুম। কোলে।”

স্বরূপ হেসে বলল,–“ওয়ালাইকুমুস সালাম, বুব্বো। কিন্তু মামু এখন ঘেমে আছি। কোলে নেয়া যাবে না।”

বুব্বো চোখ মুখ কুঁচকে বলল,
–“সারাদিন পরে এসে এমন কিপ্টামো করো না মামু। কোলে নাও। ঘাম আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ আমি জীবাণু প্রতিরোধকারী চুলকানি পাউডার।”

স্বরূপ গা দুলিয়ে হেসে উঠলো ভাগ্নের কথায়। ঝট করে কোলে তুলে নিয়ে বলে,
–“এতো দুষ্টুমি আপনি শিখেন কোত্থেকে মামু?”

বুব্বো হেসে পুনরায় গর্বের সাথে বলে,
–“আমি কারোর থেকে শিখি না, আমার থেকে সবাই শেখে মামু।”

–“ওহ্, আচ্ছা?”, বলেই স্বরূপ বুব্বোর পেটে সুরসুরি দিতে লাগলো। তখনি তার চোখ যায় বুব্বোর পায়ের ব্যন্ড এইডের দিকে। মুখশ্রী আ’ত’ঙ্ক জর্জরিত হয়ে পড়লো। স্বরূপ উদ্বিগ্ন চিত্তে তাকে দাঁড় করিয়ে পা দেখতে লাগলো। জিজ্ঞাসা করে,
–“এতো পা কেটেছে কি করে?”

বুব্বো মিনমিনে স্বরে বলল,
–“খেলতে গিয়ে। আমার তো ক্রিকেট প্যাড নেই। থাকলে পড়ে গেলেও ব্যথা পেতাম না।”

স্বরূপ মলিন দৃষ্টিতে তাকায় ভাগ্নের দিকে। মলিন হেসে তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে আদর করে দিয়ে বলল,
–“মামু, ক্রিকেট প্যাড কিনে দেবো।”

বুব্বো খুশি হয়ে যায়। ক্রিকেট জড়িত সবকিছু থাকা তার স্বপ্ন। বুব্বোকে রেখে মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে সে গোসল করে বের হয় স্বরূপ। তবে এসেছে থেকে বোনকে না দেখে সে ডাকতে লাগলো সাধনাকে,
–“আপা? আপা, কোথায় তুই?”

–“সাধনা ঘুমাচ্ছে, স্বরূপ।”, মায়ের কথায় স্বরূপের কপাল কুঁচকে গেলো। সে বোনের ঘরে গিয়ে দেখে বোন কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।
–“আপা? এই সন্ধ্যার সময় অসময়ে ঘুমাচ্ছিস কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?”

বলতে বলতেই স্বরূপ বোনের মুখের উপর থেকে কাঁথা সরায়। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সাধনা। সে কপালে হাত দিয়ে দেখে বেশ গরম। উদ্বিগ্ন বদন নিয়ে বেরিয়ে আসে সে।
মাকে বলে,
–“আপার তো জ্বর এসেছে। কখন থেকে শুয়ে আছে? ওষুধ খাইয়েছিলে?”

–“খাইয়েছি। দুপুরে এসেছে থেকে এমন শুয়ে আছে।”, সুনিতা চিন্তিত কণ্ঠে বলল। স্বরূপ মৃদু স্বরে বলল,
–“ওহ্। চিন্তা করো না ঠিক হয়ে যাবে।”

সুনিতা ছেলেকে ভাত দেয়। স্বরূপ ভাগ্নেকেও টেনে কোলে বসায়। সাথে করে একটু খাইয়ে দিল। ঘরে আজেবাজে কোন খাবার ই তেমন থাকে না বাধায় বেশিরভাগ সময় সে জোরপূর্বক বুব্বোকে ভাত খাওয়ায়। খিদে পেটে থাকলে যে বাড়ন্ত এই বয়সটা এখানে ই আঁটকে থাকবে।
*****
ধরনীতে আঁধার নেমেছে। অমানিশার সাথে সাথে যেনো নৈরার সুপ্ত অনুরাগগুলো ডানা মেলে। সন্ধ্যা থেকে রাতটুকু নৈরার কাটে ঘড়ির মুখ চেয়ে চেয়ে। তবে বরাবরই ঘড়ি তার সাথে ছেলেখেলা করে ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিয়ে। নুহাশ মাহমুদ আটটা নাগাদ বাড়িতে ফিরে হাঁক ছেড়ে মেয়েকে ডাকলেন। বাবার ডাকে নৈরা
চঞ্চল পায়ে উপর থেকে নেমে আসে। নুহাশ মাহমুদ ম্যানেজারের কাছ থেকে খাঁচা দু’টো হাতে নিয়ে নৈরার দিকে বাড়িয়ে দেয়। নৈরা গাল ভরে হাসলো হাঁসের ছানা আর সাদা ধবধবে একটা খরগোশ দেখে। বাবার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“ধন্যবাদ বাবা।”

নুহাশ মাহমুদ হেসে মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। স্নেহের কণ্ঠে বলে,
–“বাবাকে আবার ধন্যবাদ! রাতের খাবার খেয়েছেন আম্মা?”

–“নাহ, বাবা।”

–“আচ্ছা, তবে বাবা হাত মুখ ধুয়ে আসছি; একসাথে খাবো।”

নৈরা মাথা নেড়ে সায় জানায়। প্রফুল্ল হেসে হাসের ছানা আর খরগোশ গুলোকে নিয়ে উপড়ে চলে যায়।

বাথটাবে তখন চারটা হলুদ হাসের ছানা ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। নৈরার পায়ে কাছে খরগোশটি ঘোরাফেরা করছে। ঠিক তখনি তীব্র শব্দ উৎপাতের দ্বারা এলার্ম ঘড়িটি ঝনঝনিয়ে উঠলো। নৈরা হতচকিত হয়। খরগোশটিকে দ্রুত কোলে তুলে এক ছুটে বেরিয়ে আসে বাথরুম থেকে। চঞ্চল দৃষ্টি ঘড়ির দিকে নিক্ষেপ করলে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সাড়ে নয়টা বাজে। সে এলার্ম বন্ধ করে বারান্দা থাই সংলগ্ন ফ্লোরিং বিছানার উপরে গিয়ে আসন পেতে বসলো। বই হাতে সাদা পর্দা একটু ফাঁক করে দেখলো চায়ের দোকানের মৃদু উজ্জ্বল আলোয় দুইটা ফাঁকা বেঞ্চি। আশাহত হতে গিয়েও হলো না কেউ ছুটে এসে বেঞ্চিতে আয়েশ করে বসতেই। ওটা স্বরূপের বন্ধুদের একজন। তারমানে অন্য বন্ধুরাও আসবে এবং আসবে আকাঙ্ক্ষিত মানুষটিও। তার ধারণা ঠিক প্রমাণ করে কিয়ৎকাল বাদ আরো সাত আটজন ঢুলতে ঢুলতে এসে বেঞ্চিতে বসলো। নৈরার মুখে হাসি ফুটে উঠলো লুঙ্গি আর টিশার্ট পড়া সুবিশাল দেহটিকে দেখে। ফর্মাল বেশভূষা হোক কিংবা এই সাদামাটা লুঙ্গি আর টিশার্ট লোকটি অপূর্ব! দুই বছর আগে এমনি এক অলস, প্রাঞ্জলহীন রাতে বই পড়তে পড়তে হঠাৎ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে লুঙ্গি টিশার্ট পড়া একটি লোকের প্রতিনিয়ত বন্ধুদের অফার করা সিগারেটকে না বলতে দেখা। যেখানে সব বন্ধুরা সিগারেট খায় সেখানে লোকটা এক কাপ চা দিয়ে এক ঘন্টা সময় পার করে দেয়। মাঝেমধ্যে তার সঙ্গী হয় পথের নোংরা কুকুরগুলো। একদম গা ঘেঁষে বসে আর মানুষটা অলস হাতে সেই কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং আড্ডা দেয়। সর্বদা মৃদু হেসে কথা বলা, হাসলে পুরুষালী চোখ কুঁচকে যাওয়া এবং প্রত্যাহিক পুরুষালী বদ অভ্যাসের প্রতীক সিগারেটকে না করা এই দৃশ্য দেখা নৈরার নিত্যদিনের অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু কখনো বুঝতে পারতো না লোকটাকে নিত্যদিন দেখা তার অযথা উদাসীন দৃষ্টির কারণ নয় বরং ওটা তার অভ্যাস ছিল। যেই অভ্যাসে ব্যতিক্রম ঘটলে নৈরা অস্থির হয়ে পড়ে। অযাচিত কৌতুহল জেঁকে বসে লোকটা আজ কেনো আসলো না? সেই অস্থিরতায় নৈরার ঘুম আসতো না। অপেক্ষা করতো পরের রাতের জন্য। এমনি একবার ব্যতিক্রম হয় যখন টানা ছয়দিন স্বরূপ চায়ের দোকানে আসেনি। একটারাত ঘুমাতে পারতো না নৈরা। বারবার বারান্দায় আসতো হয়তো একটু পরে আসবে, এই করে করে রাত পার হয়ে যেতো! কিন্তু মানুষটা আসতো না। তার ছয়দিনের অস্থিরতার অবসন ঘটিয়ে সাত দিনের দিন ঐ চায়ের দোকানে ঠিক সাড়ে নয়টায় কাঙ্খিত মানুষটির মুখ দেখতে পেয়ে নৈরার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সকল চিন্তা, অস্থিরতা মিলিয়ে যায়। মেয়েটি অনুভব করে কাউকে দূর থেকে অবলোকন করতে করতে তার ব্যাক্তিত্ব আর বাচনভঙ্গির প্রেমে পড়ে সে। ওটাকে সে আদোতে ভালোবাসা নাম দিতো না যতোদিন পর্যন্ত না সামনাসামনি দেখা হয়। সেদিন যখন হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সামনাসামনি দেখা হলো নৈরা কিয়ৎকাল হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল। সে জানতো না মানুষটা কোথায়, কি করে? এটাও জানতো না নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী ঐ মানুষটি দূর থেকে যতো সুন্দর কাছে থেকে ঠিক ততোটাই মোহনীয়। যার সাথে অযথা অজস্র মুহুর্ত কাটিয়ে দেয় যায়। যে কি-না তার অযাচিত কৌতুহল গুলোকে সম্মানের সাথে মিটিয়েছে। কখনো বিরক্ত হয়নি। ভালোবাসা নৈরা বোঝে না তবে সে স্বস্তি, নিরাপদ, প্রশান্তিদ্বায়ক আশ্রয়স্থল হিসেবে ঐ একটি মানুষকেই বোঝে। যে কি-না হাসছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। নৈরা স্মিত হাসি নিয়ে একটু ফাঁক করা পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বরূপ আড়চোখে তাকায় কাঁচ ভেদ করে সাদা পর্দার আড়ালে গুটিয়ে বসে থাকা নারী অবয়বের দিকে। ওষ্ঠকোনা অলসগতিতে বেঁকে যায়। বোকা নারীটি কি জানে! সাদা আলো, সাদা পর্দা আর গ্লাসে মেয়েটির স্পষ্ট কালো অবয়ব তৈরি হয়? সে স্মিত হেসে বিরবির করে,
–“বোকা কাঞ্চনবালা!”

চলবে…