কাঞ্চনবেলা পর্ব-০৪

0
4

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৪

সুকুমার প্রবন অন্তঃস্থলের জন্য বিরঙ্গনার সান্নিধ্যে দশ মিনিট কাটানো, এবং দুশ্চিন্তার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া হাসি ফিরিয়ে আনতে বন্ধুদের সাথে কাটানো এই এক ঘন্টা সময়— স্বরূপের একান্ত ব্যক্তিগত সময় হয়। এই সময়গুলো তার নিত্যদিনের সঙ্গী নয় বরং তার অভ্যাস! থেমে থেমে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বরূপ নিরবতা ভেঙে নিজের এক বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“শুব্রত, আমায় এই মাসের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবি?”

সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে শুব্রত নামক ব্যক্তিটি বন্ধুর পানে দৃষ্টি রাখলো। তাদের এই বন্ধুমহলের প্রত্যেকে নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত; সেটা কর্মক্ষেত্র হোক কিংবা ব্যক্তিগত জীবন প্রতিটা ক্ষেত্রেই। তারা প্রত্যেকেই বিবাহিত, স্বরূপ ব্যতীত। তারা সকলেই অবগত, জীবনের টানাপোড়েনে ছেলেটার জীবন কিভাবে থমকে আছে। সে মিহি স্বরে শুধায়,
–“হঠাৎ টাকার কেনো প্রয়োজন? এই মাসের সব টাকা জোগাড় হয়নি?”

স্বরূপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে না বোধক মাথা নাড়লো। আবার জিজ্ঞাসা করে,
–“পারবি? আগামী মাসের মধ্যে আমি শোধ করবো।”

–“পারবো না কেনো? আমার সমিতির মালিকের কাজ টাকা কাজে খাটানো। তারা খাটাবে, চিন্তা করিস না। আমি ব্যবস্থা করে দেবো।”, শুব্রত দৃঢ় কণ্ঠে বলল। সে একজন হাসপাতালের রিসেপশনিস্ট! এছাড়াও একটা সমিতিতে যুক্ত আছে সে। স্বরূপ নিশ্চিন্তের এক নিঃশ্বাস ফেললো। অন্তত মাস শেষে মা, বোনকে কারোর কথা শুনতে হবে না। তাদের আলাপকালেই নৈরাদের বাড়ি— কুঞ্জ ভবনের গেট থেকে থেকে রিদওয়ান বের হয়। বের হতেই চায়ের দোকানে বসা স্বরূপকে দেখে রিদওয়ানের গতিশ্লথ হলো। সে বিলম্ব হীন এগিয়ে যায় চায়ের দোকানের দিকে। গিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বলল,
–“স্বরূপ ভাই, ভালো আছেন?”

স্বরূপ সহ তার বন্ধুরা তাকায় রিদওয়ানের দিকে। তাদের জুনিয়র। এর থেকেও আরেকটা পরিচিত পরিচয় হলো নোমান মাহমুদের খুব কাছের বন্ধু! স্বরূপ হেসে বলল,
–“রিদওয়ান যে! আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, ছোট ভাই?”

রিদওয়ান মৃদু হেসে জবাব দিয়ে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“ভাই, আপনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?”

–“হ্যাঁ, বলো। তা আবার এভাবে জিজ্ঞাসা করছো কেনো? এসো, এখানে বসো।”, স্বরূপ একটু এগিয়ে বসে জায়গা করে দিয়ে বলল। রিদওয়ান নাকোচ করে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“না মানে ভাই, একটু আলাদাভাবে যদি শুনতেন।”

স্বরূপ ইতস্ততা নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকায়। স্বরূপের বন্ধুরা বুঝলো, অতঃপর হেসে স্বরূপকে আলাদা যাওয়ার জন্য বলল। চায়ের দোকান থেকে কয় হাত দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ায় রিদওয়ান আর স্বরূপ। স্বরূপ কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“গুরুতর কিছু রিদওয়ান?”

রিদওয়ান কৃত্রিম হেসে বলল,
–“তেমন কিছু না ভাই, কিন্তু একটা কথা ছিল। আপনার বোন তো শুনেছি আপনার সাথে থাকে। সে কি কোন এনজিওতে চাকরি করে ভাই?”

স্বরূপের কপাল কুঁচকে গেলো বোনের প্রসঙ্গ উঠতেই। তার বোনের প্রসঙ্গ বাইরে উঠবে এমন কোন পরিস্থিতি আজ পর্যন্ত সে তৈরি হতে দেয়নি। সে মিহি স্বরে বলল,
–“হ্যাঁ, আপা শান্তি নিকেতন এনজিওতে চাকরি করে। কিন্তু কেনো বলোতো?”
স্বরূপের কণ্ঠে শঙ্কা! রিদওয়ান মিনমিনে কণ্ঠে বলতে শুরু করলো,
–“ভাই, আমি আজ ঐ এনাজিওতে গিয়েছিলাম। নোমানকে তো চিনেন, ওর সাথেই গিয়েছিলাম একটা কাজে। আসলে…আমি আপনাকে ব্যাক্তিগত ভাবে চিনি, তাই আমার মনে হয়েছে আপনাকে বিষয়টা জানানো উচিৎ।”

রিদওয়ান ইনিয়ে বিনিয়ে বলল। স্বরূপ বিবর্ণ মুখটি নিয়ে, অধৈর্য হয়ে শুধায়,
–“যা বলার সোজাসাপ্টা বলো, রিদওয়ান।”

রিদওয়ান সব খুলে বলল। স্বরূপ বাঁকহারা হয়ে গেলো।
শূণ্য মস্তিষ্ক খাঁ খাঁ করছে বিদঘুটে কিছু শব্দ! অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“এসব কি বলছো রিদওয়ান?”

রিদওয়ান কাঁচুমাচু করে বলল,
–“ভাই আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে চিনি। আমি জানি, আপনার বোন কখনো এমন কাজ করতে পারে না। ঐ এনজিওর মালিকের ই দোষ! ওটাকে আমার ভালো মনে হয়নি।”

স্বরূপ কিয়ৎকাল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তঃস্থলে প্রশ্ন জাগে, সে কেমন ভাই? মস্তিষ্কে তীব্র প্রদাহ সৃষ্টি হলো। চোখদুটো রাগে টলটল করে উঠলো। চাপা স্বরে শুধায়,
–“এটা কখন হয়?”

–“সকালে ভাই।”

–“ওহ্।”, স্বরূপ ছোট্ট করে জবাব দেয়। মনে পরে একটু আগে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় যখন বোনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কোন সমস্যা হয়েছে কি-না? তখন বোন নির্বিকার হাসিমুখে না বলে। মুষ্টিবদ্ধ হাতের শিরা উপশিরা দপদপ করতে লাগলো। চোয়াল শক্ত হয়ে যায় স্বরূপের। দিনশেষে এই প্রতিদানের জন্যই কি সে এতো কষ্ট করে?

নিগুঢ় চোখে সাদামাটা ব্যক্তিত্বধারী মানুষটাকে খুঁটে খুঁটে দেখতে নিমগ্ন নৈরা সরব উদগ্রীব ব্যকুল হয়ে পড়লো, স্বরূপকে ক্ষিপ্র গতিতে স্থানত্যাগ করতে দেখে।
অবুঝ মেয়েটি কৌতুহলী নয়নে দেখলো স্বরূপ সহ তার বন্ধুদের গমন। হঠাৎ কি হলো? এখনো তো এক ঘন্টা হয়নি! বিদীর্ণ মোহ’রা ছুটে পালায় নমনীর অন্তঃস্থল থেকে। একরাশ অসন্তুষ্টি নিয়ে নৈরা বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু পরক্ষণেই তার ম্লান অন্তঃস্থল প্রসন্ন হয়ে উঠলো, আগামী দিনের এক উজ্জল আকাঙ্ক্ষাভরা মুহুর্ত কল্পনা করতেই।

নিস্তব্ধ রজনীর নিশি পোকার ডাক নির্দেশ করছে ধরিত্রীর একপ্রান্ত তখন নিদ্রাচ্ছন্ন। তখন পুরোদস্তুর সকলে ক্লান্ত দেহটিকে আরাম দিচ্ছে। ঠিক তখনি মতিউরের আরামে বিঘ্ন ঘটলো শ্রুতিকটু ফোনের রিংটোন। আধো আধো চোখ খুলে একটু কাত ফিরতেই ব্যাথায় দেহ চিড়বিড়িয়ে উঠলো। অকথ্য ভাষায় সে কয়েকটা গালি ছুড়লো নোমানের উদ্দেশ্যে। বিরক্তি নিয়ে ফোনটা কানে তুললো। রুক্ষ বেজার কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“হ্যালো! কে?”

অপরপ্রান্ত থেকে বিনম্র এক কণ্ঠ ভেসে আসলো।
–“স্যার আমি লজিস্টিকস কোম্পানি থেকে বলছি, মালয়েশিয়া থেকে আপনার জন্য একটা পার্সেল আছে। দয়াকরে এটা রিসিভ করুন।”

মতিউরের ঘুম জড়ানো নিশ্চল মস্তিষ্কে আদোতে কোন পার্সেলের ডেটা এন্ট্রি নিতে পারছে না। সে মেজাজ নিয়ে বলল,
–“কোথাকার পার্সেল?”

–“স্যার মালয়েশিয়া!”

–“এমন কোন পার্সেল আমার আসার কথা নয়।”

–“কিন্তু স্যার পার্সেলটা আপনার নাম আর এড্রেসেই।”

–“আরে এই মাঝরাতে কিসের পার্সেল দিতে এসেছেন আপনি?”

–“স্যার আমরা ইন্টারন্যাশনাল শিপমেন্টের কাজ করি। আমাদের শিপ যখন পৌঁছায় তখনি আমাদের ডেলিভারি দিতে হয়। এটা নিয়ম স্যার! আপনি পার্সেলটা তাড়াতাড়ি রিসিভ করলে আমিও অন্য পার্সেল গুলো তাড়াতাড়ি ডেলিভারি করতে পারবো।”

–“ধুর!”, মতিউর মেজাজ খারাপ করে ব্যথাতুর শরীর নিয়ে বিছানা ছাড়লো। নাকে ছোট্ট একটা ব্যন্ডেজ করা। সে ঢুলতে ঢুলতে নিচে নামলো। গেট খুলে বের হলে স্ট্রিট লাইটের আলোয় মানবশূন্য এক নিস্তব্ধ পথ ছাড়া আর কিছু দেখাগেলো না। সে আবার ডেলিভারি বয়কে ফোন দিতে যাবে তার আগেই গেট সংলগ্ন গাছের আড়াল থেকে একটা ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হয়। বিনম্র কণ্ঠে বলে,
–“স্যার, আমি এখানে।”

মতিউর সরু চোখে দেখে খালি হাতে মাস্ক পরা এক যুবককে। বিক্ষিপ্ত মেজাজে জিজ্ঞাসা করে,
–“কোথায় পার্সেল?”

–“পার্সেল তো তুই নিজে মতি কিন্তু সিটি হাসপাতালের।”, শুব্রত ফিচলে হেসে বলল। মতিউর চমকে নিজের পেছনে তাকায়। আওয়াজটি সেখান থেকেই আসছে। তাকাতেই সে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেলো সাত আটজন মাস্ক পরা যুবককে দেখে। ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“এসব কি হচ্ছে? তোমরা কারা? তোমরা আমার সাথে মজা করেছো? কি চাও?”

বলতে বলতেই মতিউর সতর্ক কদম ফেলে গেটের দিকে আগায় কিন্তু তার পিঠ ঠেকে গেলো কারোর সাথে। মাস্ক পরা সেই যুবকটি দাঁড়িয়ে। মতিউর ঘেমে উঠলো ভয়ে। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে,
–“কে তুমি?”

স্বরূপ একহাতে নিজের মাস্কটা খুললো। চোয়াল শক্ত করে বলে,
–“সাধনার ভাই।”

কথাটি শেষ হতেই এক প্রকাণ্ড মুষ্ঠিঘাতে মতিউরের চোয়াল নড়ে উঠলো। সে ছিটকে পড়লো আদূরে। উঠে দাঁড়ানোর আর সুযোগ পেলো না, আর না পেলো আওয়াজ করার সুযোগ। মুখে কেউ টিস্যু গুঁজে দিলো ক্ষিপ্র গতিতে। স্বরূপের বন্ধুরা সহ রিদওয়ান ইচ্ছেমত পেটাতে লাগলো মতিউরকে। দশ মিনিটের মধ্যেই মতিউর অচেতন প্রায়! স্বরূপ মতিউরের ডান হাতটা উল্টোদিকে মুচড়ে দিতেই মতিউর ছটফট করে উঠলো। সাদামাটা সর্বদা হাসিমাখা সেই নির্মল মুখটিতে আজ ভরপুর হিংস্রতা, ক্রোধ। তার মতো একটা ভাই থাকতে তার বোনকে কেনো অবাঞ্ছিত স্পর্শের স্বীকার হতে হবে? রাগ তরতরিয়ে বাড়তে লাগলো স্বরূপের। মুচড়ে ধরা হাতটা আরেকটু ক্ষিপ্ত হাতে মুচড়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“আমার বোনের দিকে হাত বাড়ানোর দুঃসাহস দেখানোর ফল এটা। দ্বিতীয়বার এমন কিছু যদি ঘটে—তবে আমার বোন আর অন্যের বোন দেখবো না আমি; সোজা তোকে কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে আসবো।”

বলহীন হাতটা ঝাড়া মেরে ফেলে দেয় স্বরূপ। মতিউর সেভাবেই অচেতন র”ক্তা”ক্ত হয়ে পড়ে রইলো রাস্তায়।
*****
সূর্যের তেজি ময়ূখ দ্যুতির আড়ালে মুখ লুকিয়েছে অমানিশা‌। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছে হিংস্রতা। স্বভাবসুলভ সেই নিরাগ ,শান্ত থমথমে চেহারা নিয়ে শার্টের আস্তিনের বোতাম লাগাতে লাগাতে নিজের ঘর থেকে বের হয় স্বরূপ। সুনিতা ব্যস্ত হাতে আলু ভর্তা মাখছে। পেটভরে গরম ভাত খেয়ে অফিসে যাওয়ার অভ্যাস স্বরূপের। স্বরূপ বসার ঘর পর্যন্ত যেতেই স্কুল ড্রেস পরা বুব্বো ঢুলতে ঢুলতে বের হলো মায়ের ঘর থেকে। সাধনা নিজের ঘর থেকে বের হতে হতে ব্যস্ত কণ্ঠে ছেলেকে বলল,
–“বুব্বো, পানির বোতলে ফিল্টার থেকে পানি ভরে নাও জলদি।”

বুব্বো অলস কণ্ঠে বলল,
–“যাচ্ছি, মাম্মা।”

–“যাচ্ছি না যাও। তাড়াতাড়ি করো বুব্বো, সময় নেই।”

বলতে বলতেই সাধনা সোফার কাছে এসে দাঁড়ায়। এতক্ষণে স্বরূপ চোখ তুলে তাকায় বোনের দিকে‌। একদিনের জ্বরেই কেমন মুখটি পাণ্ডুর, শুকনো হয়ে গিয়েছে। শুধুই কি জ্বর? সে গমগমে স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–“কোথায় যাচ্ছিস?”

সাধনা ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বরাবরের ন্যায় স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
–“বুব্বোকে স্কুলে দিয়ে আমি এনজিওতে যাবো।”

–“বুব্বোকে আমি স্কুলে দিয়ে আসবো। তোর বাইরে বের হতে হবে না।”

সাধনা অবাক হলো বেশ। খানিক আশ্চর্যের রেশ ধরেই শুধায়,
–“বাইরে বের হবো না মানে? বাইরে না গেলে এনজিওতে যাবো কিভাবে?”

স্বরূপের দমানো রাগগুলো আস্কারা পেলো। উল্কার বেগে ঠিকরে বেরিয়ে আসে ক্রোধ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“এনজিওতে আর যাবি না।”

সাধনার টনক নড়লো ভাইয়ের কথায়। ভয় জেঁকে বসলো স্বরূপ কি কিছু জেনে গিয়েছে? সে ফাঁকা ঢোক গিলে শান্ত স্বরে বলল,
–“যাবো না মানে কি? মাসের শেষ এখন বন্ধ দিলে বেতনটা কাটা যাবে।”

স্বরূপ আর দমাতে পারলো না নিজেকে। ক্রোধে ফেটে পড়ে সোফার পাশে সাজিয়ে রাখা একটি শো পিস ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“আমি বলেছি যাবি না মানে যাবি না। কোন বেতনের প্রয়োজন নেই। আমি যা ইনকাম করি তা দিয়ে যেটুকু জুটবে সেটুকু খাবি। তাতে যদি মরিচ ও জোটে ঐটুকুই মুখ বন্ধ করে খাবি। কিন্তু আর এক পা ও ঘরের বাইরে রাখবি না।”

ভাইয়ের চিৎকারে, সাধনা পাল্টা রাগান্বিত স্বরে বলে উঠলো,
–“কি হচ্ছে কি স্বরূপ? সকাল সকাল এমন আচরণ করছিস কেনো?”

স্বরূপ অবাক চোখে তাকায় বোনের দিকে। অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বুকভরা আক্ষেপ নিয়ে বলে,
–“এই তোর কি আমাকে মানুষ মনে হয় না, হ্যাঁ? আমি তোর কাছে এতোটাই মূল্যহীন? আমি যে এই সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাই শুধুমাত্র তোর, বুব্বোর আর মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য, এটা কি তুই বুঝিস? কাপুরুষ মনে হয় আমাকে? হ্যাঁ, কাপুরুষ ই তো আমি। আমার মতো একটা ভাই থাকতে আমার বোনকে মলিস্টেশনের স্বীকার হতে হয়; আমি কাপুরুষ না তো কি? তবে সবথেকে কষ্ট টা কখন হয় জানিস? যখন আমি তোর থেকে অচেনা মানুষের মতো আচরণ পাই। যখন তুই হাসিমুখে সবটা আমার থেকে লুকিয়ে যাস না? তখন আমার কষ্ট হয়। আমার সারাদিনের ক্লান্তিরা ফিকে পড়ে তোর আচরণে। আমি এতোটাই অপদার্থ ভাই যে আমার বোন আমার কাছে মুখ ফুটে তার কষ্টের কথা বলতে পারে না।”

সাধনার নেত্রদ্বয় বাঁধ ভাঙা হয় ভাইয়ের আক্ষেপজড়িত কণ্ঠে। সে কি ভাইটার কষ্ট কমাতে গিয়ে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে? সে এগিয়ে যায়। আদুরে হাতে ভাইকে ছুঁতে গেলে স্বরূপ দূরে সরে যায়। সাধনা ক্রন্দনরত গলায় ডেকে ওঠে,
–“স্বরূপ! ভাই?”

–“ভাই ডাকবি না আমায়! একদম ভাই ডাকবি না। আমায় কাপুরুষ ডাকবি। ওটা শুনতে ভালো শোনায়।”

সাধনা ধমকে উঠলো,
–“চুপ, একদম চুপ! যা মনে আসছে তাই বলে যাচ্ছিস, বেয়াদব!”

স্বরূপ শোনেনা। বোনের থেকে দূরে সরে গিয়ে, রাগান্বিত স্বরে বলল,
–“আজ থেকে তোকে যদি ঘরের বাইরে বের হতে দেখি— তবে তুই আমার লা”শ দেখবি আপা। এটা আমার শেষ কথা।”

সাধনা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে নালিশ দিয়ে বলল,
–“দেখেছো কি বলছে ও? কিভাবে কথা বলছে আমার সাথে? বড়ো হয়ে গিয়েছে অনেক! আমার তো খারাপ লাগে তোমাদের সংসারে বোঝা হয়ে থাকতে। তোমাদের কষ্টের কারণ তো আমিই। শূণ্য হাতে তোমাদের ঘাড়ে বসে খাচ্ছি। আমার তো ইচ্ছে করে ওর কষ্টটা একটু কমাতে। অন্তত মাস শেষে চালের চিন্তাটুকু তো করতে হয় না!”

স্বরূপ ফের গর্জে উঠলো,
–“চালের চিন্তা তোকে করতে হবে না। চাল না খেতে পারলে আটা খাবি তবুও ঘর থেকে বের হতে পারবি ন। আমি যা আনবো তাই খেয়ে চুপচাপ বসে থাকবি।”

বলেই স্বরূপ সোফায় লাথি মেরে চলে যায় নিজের ঘরে। সাধনা কাঁদতে কাঁদতে সোফায় বসে পড়লো। এঁটো হাতে সুনিতা টলমলে দৃষ্টিতে ছেলে মেয়েদের দেখে নেয়। বুকটা খামচে ধরলো আজ তাদের পরিণতির জন্য কিনা তার অতি নমনীয় মেয়েটাকে এমনকিছুর স্বীকার হতে হলো? আর কতো? তবুও অন্তঃস্থলে বলে ওঠে এই কান্না সাময়িক! সব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। সে বিড়বিড় করে বলল,
–“হে খোদা! ওদের সব দুঃখ তুমি দূর করে দাও না!”

অদূরে বসার ঘরের কিনারায় তখন জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মামুকে সে কখনো এমন রাগতে দেখেনি। মিনিট পাঁচেক পর স্বরূপ আবার বেরিয়ে আসে চোখেমুখে পনি দিয়ে। বুব্বোর স্কুল ব্যাগ হাতে নিয়ে, গমগমে স্বরে বুব্বোকে বলল,
–“বুব্বো এসো।”

কিন্তু বুব্বো গেলো না বরং ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই। স্বরূপ চোখ তুলে তাকায় ভাগ্নের দিকে। থমথমে মুখে শুধায়,
–“কি হলো আসছো না কেনো?”

বুব্বো মিনমিনে স্বরে বলে উঠে,
–“তুমি আমার মামু নও। আমি যাবো না তোমার সাথে।”

–“মানে?”, ফের স্বরূপের গম্ভীর কণ্ঠে বুব্বো বলল,
–“আমার মামু শুধু ভালোবাসে, কখনো রাগ দেখায় না।”

স্বরূপ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ভাগ্নের দিকে। পরপরই কোনা চোখে তাকায় মুখ ফুলিয়ে বসে থাকা বোনের দিকে। এই যে এই দু’জনের চঞ্চলতা আর হাসিমুখ ছাড়া সে শান্তিতে এক মুঠো ভাত গলাধঃকরণ করতে পারে না। সে থমথমে তবে শান্ত কণ্ঠে বলল,
–“কাছে না আসলে আদর করবো কিভাবে?”

সহসা বুব্বোর মুখশ্রী থেকে ভয় সরে গেলো। হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। এক ছুটে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো মামুর কোলে। স্বরূপ ম্লান হেসে ঝাঁপিয়ে পড়া দেহটিকে কোলে তুলে নেয়। কপালে চুমু দিয়ে বলে,
–“মামু তোমাদের সাথে রাগ করে তো থাকতে পারি না!”

বুব্বো হেসে মামুর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে শুয়ে রইলো।
*****
তবে জীবনে যতো উত্থান পতন ঘটুক না কেনো! দিনশেষে সঙ্গিত আর সঙ্গীর সংস্পর্শে একটা চমৎকার কাঞ্চনবেলা পুরো দিনের সকল রুক্ষতা, ক্লেশ শুষে নেয়। পর্যায়ক্রমে চতুর্থ কাঞ্চনবেলায় প্রকৃতি বেশ চঞ্চলতায় নিমগ্ন। এই চঞ্চলতা আগমনী ফাল্গুনের।কাল বাদে পোরশু যে রঙে রঙে রঙিন সেই মোহনীয় ফল্গুন শত সুগন্ধি মিশ্রিত সমীরন নিয়ে হাজির হবে। শূণ্য উপত্যকার ন্যায় নির্জীব, নিস্তব্ধ প্রেমতরঙ্গবিহীন মন গুলোতে প্রেমের দোল দিতে আসবে। মৃদুমন্দ সমীরনে প্রেমের সুবাস, শহুরে কোলাহল, কোচিং শেষে বাড়ি ফেরা কিশোর কিশোরীর খিলখিল হাসি ভেদ করে কর্নকুহরে শ্রুতিমধুর শব্দতুলে প্রবেশ করছে মোহনীয় কিছু কণ্ঠ। তবে আজ সঙ্গীত অন্তঃস্থলে প্রেমের ছোঁয়া দিচ্ছে কেনো? কেনো সুখ খুঁজতে যেতে চায়, ঐ সাদামাটা বোকাসোকা চাহনির নারী অবয়বের মাঝে?

তুমি সুখ যদি নাহি পাও
যাও সুখেরও সন্ধানে যাও
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে
আর কিছু নাহি চাই গো
আমারো পরানো যাহা চায়…
আমি তোমারো বিরহে রহিবো বিলীন
তোমাতে করিবো বাস..

মাটির ভাঁড়ে থাকা চায়ে চুমুক দিতে দিতে সুরে দুলছে দুই পা আপনমনে। স্নিগ্ধ সেই নারী কণ্ঠগুলোর সুরে বিষাদেরা খনিক মুখ লুকালো। ঠোঁটের কোনা ঠিকরে স্মিত হাসি বেরিয়ে আসলো। ঘর্মাক্ত সেই একই স্কাই ব্লু রঙা টিশার্টটি তখন লেপ্টে আছে সুগঠিত বদনে। আজ আগেই কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে তাদের। বরাবরের ন্যায় স্টিলের বেঞ্চির এক কিনারয় গা এলিয়ে দিলে এক কাপ চায়ের তৃষ্ণা গ্রাস করে। এই তৃষ্ণা সেদিনকার চায়ের স্বাদ নেয়ার পর থেকেই। ঘড়ির কাঁটা তার দশ মিনিট সময়ের অন্তিম রেখা টানলে স্বরূপ বেঞ্চি ছাড়ার তাগিদ অনুভব করলো। তবে চায়ের ভাঁড়ে তখনো বেশ খানিকটা চা। চায়ের কাপে ঠোঁট লাগাতেই হাওয়ার বেগে একটা সুতির ওড়না ছুঁয়ে গেলো মুখশ্রী। কেউ ছুটতে ছুটতে এসে ধপ করে স্বরূপের পাশে বসে পড়লো। ক্ষণপরিচিত সেই হেলিয়ট্রোপ ফুলের সুগন্ধ ফুরফুরিয়ে নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করে জানান দিচ্ছে ব্যতিক্রমী এই সুগন্ধির মালিকের পরিচয়। তবুও নিরুদ্বেগ চায়ের কাপে ঠোঁট বসাতে ব্যস্ত তথাকথিত কঠোর ব্যক্তিত্বধারী মানুষটি।
নৈরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বারবার তাকাচ্ছে দুই হাত দূরত্বে অবস্থানরত মানুষটার দিকে। দেখেনি বোধহয়! সে বারংবার তাকাতে লাগলো। লোকটা কথা বলবে না? তারা কি অপরিচিত? তবে কথা বলছে না কেনো? আবার একা একা চা খাচ্ছে! সে গলা খাঁকারি দিয়ে এক গাল হেসে বসলো। কিন্তু তবুও দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হলো। আবার গলা খাঁকারি দিলো তবুও ব্যক্তিটির উদাসীন দৃষ্টি অদূরে কংক্রিটের পথেই। সে এবার খুক খুক কাঁশতে লাগলো। কিন্তু তবুও ফিরলো না স্বরূপ। নিরুপায় নৈরা অস্থিরতা নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে জোরে জোরে খুক খুক কাঁশতে শুরু করলো। ঠিক তখনি এক জোড়া সংকুচিত দৃষ্টি তার মুখপানে পড়লো। স্বরূপ কপাল কুঁচকে তাকায় নিজের দিকে নুইয়ে আসা মুখটি দেখে। বেশ বিব্রত বোধ হলো নৈরার। সরে যেতে নিলে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটলো। এতক্ষণের অপেক্ষারত নুইয়ে পড়া ছোলা মাখা গুলো থমথমে মুখে এগিয়ে দিতেই নৈরা আশ্চর্য হলো। পরমুহূর্তেই হাসি ফুটে উঠলো, একা একা খাচ্ছে না তার জন্য ও রেখেছে কিছু। সে ছো মেরে ছোলা মাখা গুলো নিয়ে খেতে লাগলো। স্বরূপ কোনাচোখে দেখলো পা দোলাতে দোলাতে নিজ মনে খেতে থাকা মেয়েটিকে। চায়ের অর্ডার দিতে গিয়ে হঠাৎ অযাচিত এক চিন্তা আঁকড়ে ধরে মস্তিষ্ক! মনে হলো তার এই একা একা চা খাওয়াতে বেঞ্চির অপরপাশের মানুষটা প্রচুর দুঃখী, একাকী বোধ করবে! তাই তো উদার মনের পরিচয় নিয়ে খা খা করা পকেটকে তুচ্ছ করে বিশ টাকার ছোলা মাখা কিনে রেখেছিল।

–“যাবেন না?”

স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে শুধায়,
–“রোজ রোজ সবজির বাজারে গেলে কি ভিন্ন ভিন্ন আনন্দ পাওয়া যায়? সেই তো একই আনন্দ।”

নৈরা খেতে খেতে জবাব দেয়,
–“হয়তোবা আপনার কাছে একই অনুভূতি কিন্তু আমার কাছে তো প্রতিনিয়ত আমার অনুভূতিরা ভিন্ন মাত্রা পায়।”

স্বরূপ নিরুত্তর মৃদু হাসলো। মিনিট পাঁচেক পর একটা রিকশা এসে থামলো। জিজ্ঞাসা করলো,
–“স্যার, ম্যাডাম আইজকা সন্ধ্যা বাজারে যাইবেন না?”

নৈরা চঞ্চল কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“যাবো চাচা , যাবো।”

আজ আর অনুমতি নিতে হলো না নৈরার। স্বরূপ চায়ের ভাঁড় টা রেখে নিরুদ্বেগ রিকশায় উঠে বসে। পাশের সিটটিতে বিনা অনুমতিতে অযাচিত অধিকার খাটিয়ে বসে পড়লো চঞ্চল মেয়েটি। রোজকার মতো কনুইয়ের কাছে শার্টের আস্তিনের ছোট্ট একটি অংশ কারোর দুই আঙুলের চিমটির মাঝে এঁটে যেতেই, পুরুষালী ওষ্ঠকোনা অলসগতিতে বেঁকে যায়। এই এক চিমটি শার্টের কোনা না-কি মেয়েটির ভরসা!

এভাবেই পর্যায়ক্রমে পাঁচটি কাঞ্চনবেলা সাদামাটা দুই নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী মানব মানবীর জীবনের খাতায় লিপিবদ্ধ হলো। বড্ডো সুখময় হয় সেই দুই ধরণের সবজি কেনার সময়টুকু। মেয়েটি তখন ষষ্ঠ কাঞ্চনবেলার মুখ চেয়ে…তবে জানা নেই সেই ষষ্ঠ কাঞ্চনবেলা আদৌ মেয়েটির অনুকূলে হবে কি না!

চলবে…