কাঞ্চনবেলা পর্ব-০৫

0
2

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৫

মাঠ জুড়ে কখনো বিজয়ের উল্লাস তো কখনো আফসোসের সুর ভেসে আসছে। আবার কখনো কখনো সমস্বরে সবাই চিৎকার করে বলে উঠছে “ছক্কা”। অদূরে মাঠের এক কিনারায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি লালচে টলমলে আঁখি নিয়ে দেখছে প্রিয় ক্রিকেট খেলা। তবে আজ আর তার খেলার অধিকার নেই। অদ্ভুত শোনালো নিশ্চয়ই? সামান্য ক্রিকেট খেলায় আবার অধিকার লাগে? কালেভদ্রে অবশ্যই লাগে যখন পরিস্থিতি ঠিক উল্টোদিকে চলে। আজ সকালে স্কুল থেকে আসার পর, বুব্বো নিজের বাসার বিশালাকৃতির লিভিং রুমে ক্রিকেট খেলছিল। মামু একটা বিশাল বাড়ি কিনেছে তার জন্য। যেনো সে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াতে পারে। তার মামু বেস্ট মামু কিনা! কিন্তু বিপত্তিটা সেখানেই বাঁধলো যখন দেহের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ব্যাট করতে গিয়ে ব্যাটটাই হাত থেকে ছুটে যায়। কাঠের ব্যাট’টি দেয়ালে সজোরে আঘাত হানে এবং ভেঙে দুই ভাগ হয়ে যায়। বুব্বোর আকাশসম উঁচুতে ওঠার স্বপ্ন দেখার একমাত্র সিঁড়িটি হলো ঐ ব্যাটটি। ভাঙা দ্বিখণ্ডিত জড়বস্তুটি হাতে নিয়ে বুব্বো থমকে বসে পড়েছিল। বুকের এক পাশ ফাঁকা হয়ে পড়ে এই বুঝি তার জীবনের সকল আনন্দ ফিকে হয়ে পড়লো। একবুক হাহাকার নিয়ে বুব্বো মায়ের কাছে আর নানুর কাছে ছুটলো। অননুনয় করে বলে,
–“তার ব্যাটটা ঠিক করে দাও নয়তো নতুন একটা কিনে দাও।”

কিন্তু পরিস্থিতি সেখানে দূর্ভেদ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো। বুব্বোর আর ক্রিকেট খেলা হবে না। একবুক হাহাকার নিয়ে প্রত্যাহিক নিয়মানুযায়ী মাঠে খেলতে আসলো। বড়ো ভাইদের সাথে প্রতিদিন বড্ডো স্বাচ্ছন্দ্যেই খেলা করে বুব্বো। কিন্তু আজ আর বড়ো ভাইয়েরা তাকে খেলতে নিলো না। জানালো যার ব্যাট নেই সে খেলতে পারবে না। বুব্বো তখন আশ্চর্য হয়ে শুধায়,
–“তোমরা তো এতো দিন আমার ব্যাট দিয়ে খেলতে, আমি কখনো বাঁধা দিতাম না। তবে আজ আমায় তোমাদের ব্যাট দিয়ে খেলতে দিচ্ছো না কেনো?”

তখন এক বড়ো ভাই হেসে বলে,
–“আমাদের কি ব্যাট নেই? আছে। কিন্তু তোর ব্যাটটা অনেক ভালো ছিল বলে তোরটা দিয়ে খেলতাম। যা ভাগ এখন, ব্যাট নিয়ে আবার খেলতে আসিস।”

বুব্বো কিছু বলে না, শুধু টলমলে নয়নে তাকিয়ে থাকে।সদ্য মাঠে পা রাখা নোমান হাঁটতে হাঁটতে ভাবুক কণ্ঠে বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলে,
–“জানিস, ঐ এনজিওর মালিক মতি আছে না? ওকে কারা যেনো মাঝরাতে বেধরম পিটিয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি এখন। কাজটা কে করলো বলতো? আমার বাপ তো আমার উপর সন্দেহ করছে। অথচ আমি দূধের ধোঁয়া তুলসী পাতা।”

রিদওয়ান কাঁচুমাচু মুখে চাপা হাসলো। শাফাক আর নোমান কপাল কুঁচকে তাকায় তার পানে। একসাথে জিজ্ঞাসা করে,
–“তুই হাসছিস কেনো? তুই জানিস কারা করেছে তাই না?”
রিদওয়ান কাঁচুমাচু মুখে মাথা নেড়ে সায় জানালো। বলল,
–“আমি জানি।”

ওমনি খপ করে দু’টো বলিষ্ঠ হাত রিদওয়ানের গলা দুই পাশ থেকে প্যাঁচ দিয়ে চেপে ধরলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“কোনপ্রকার নাটক ছাড়া গড়গড় করে বলবি।”

রিদওয়ান মেজাজ নিয়ে তাকায় বন্ধুদের দিকে। বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলে,
–“এভাবে না ধরলেও আমি বলতাম। ছাড়!”

নোমান আর শাফাক কোনা চোখে তাকিয়ে ছেড়ে দিলো রিদওয়ানকে। রিদওয়ান গা ঝাড়া দিয়ে বলল,
–“একজনের সম্পর্কে না জেনে তাকে আঘাত দিয়ে কথা বলা উচিৎ না। তুই ঐ মহিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করে ঠিক করিসনি। সে অমন মহিলা নয়। সে একটা শিক্ষিত, মার্জিত এবং ভালো পরিবারের মেয়ে।”

নোমান সরু চোখে তাকায়। সে নিজেও বুঝতে পেরেছে , রাগের বশে মহিলার সাথে খারাপ ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। সে অগ্রাহ্য করে বলল,
–“আসল কাহিনী বল। এই মতির এই অবস্থার পেছনে ঐ মহিলার হাত আছে?”

–“না মহিলার ভাইয়ের।”

–“তার ভাই? তুই চিনিস, কে?”

রিদওয়ান থমথমে মুখে বলল,
–“স্বরূপ ভাই।”

নোমান কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“তোদের ঐ ব্যাংকারের বোন? মানে ক্যাপ্টেনের মা?”

সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়লো মাঠের আনাচেকানাচে। কাঙ্খিত ছেলেটিকে অদূরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। রিদওয়ান মাথা নেড়ে সায় জানায়। নোমান ধীরপায়ে এগিয়ে যায় বুব্বোর কাছে। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে শুধায়,
–“হেই ক্যাপ্টেন! কেমন আছো?”

বুব্বো ফোলা ফোলা মুখ উঁচু করে তাকায় নোমানের দিকে। কান্না আঁটকে জবাব দিলো,
–“ভালো আছি, বন্ধু।”

–“কিন্তু আমি তো দেখছি তুমি ভালো নেই। চোখের পাতায় একটু টোকা দিলেই পানি গড়িয়ে পড়বে।”, নোমান মৃদু হেসে বলল। এবং তার কথা যথার্থ! বুব্বোর নিরব আঁখি বেঁয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নোমানের হৃদয় ব্যথিত হলো। এই বাচ্চা ছেলেটিকে প্রথম দিন থেকে ম্যাচিউর, চঞ্চল, আত্মবিশ্বাসী, স্ট্রং দেখে এসেছে। এমন ক্রন্দনরত দেখতে ভালো লাগছে না তার। সে হাঁটু গেড়ে বসলো। কাঁধে হাত রেখে মৃদু হেসে নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“হেই ক্যাপ্টেন! আমি তো জানি আমার ক্যাপ্টেন অনেক স্ট্রং। তবে আজ কি এমন হলো যে সে কান্না করছে?”

বুব্বো অশ্রুসিক্ত নয়নে নোমানের দিকে তাকিয়ে ফ্যাসফেসে গলায় বলল,
–“আমার ব্যাট আজ ভেঙে গিয়েছে, বন্ধু! তাই ওরা আমায় খেলতে নিচ্ছে না।”

বলতে বলতেই বুব্বোর গলা আঁটকে আসলো কান্নায়। নোমান ম্লান হেসে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল,
–“তাতে কান্না করতে হবে? একটা ব্যাট গিয়েছে দশটা ব্যাট আসবে। তখন সবাই তোমার সাথে খেলবেও।”

বুব্বো জবাব দিলো না। নোমান ফের বলল,
–“এখন আর কেঁদো না। চলো, আমার সাথে। আমরা এখনি গিয়ে ব্যাট কিনে আনবো। তখন দেখবে তোমার সাথে একটু পরেই সবাই খেলবে? এসো।”

নোমান বুব্বোর হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে নিলে বুব্বো এক পা ও নড়লো না। নোমান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। বলল,
–“যাবে না? এখন তো আমরা বন্ধু হয়ে গিয়েছি। তুমি তো আমায় চেনো। তবে চলো।”

বুব্বো নোমানের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। থমথমে মুখে বলল,
–“ধন্যবাদ বন্ধু! কিন্তু আমার প্রয়োজন নেই ব্যাটের। আমার মামু আমায় ঠিক ব্যাট কিনে দেবে।”

নোমান নিরবে শুনলো মামুর প্রতি বাচ্চা ছেলেটির অগাধ বিশ্বাস। মৃদু হেসে বলল,
–“আমরা তো বন্ধু! তাইনা? তবে বন্ধুর থেকে কিছু নেয়া যাবে না? বন্ধুরা তো একে অপরের দুঃখে পাশে থাকে।”

বুব্বো ম্লান হেসে বলল,
–“এই তো তুমি আমার দুঃখে আমার পাশে রয়েছো। এতেই হবে।”

নোমান ডানে বামে মাথা নাড়লো বাচ্চা ছেলেটিকে দেখে। পরক্ষনেই বাচ্চা ছেলেটির মাঝে ঐ এক ঝলক দেখা আদলের মিল খুঁজতে লাগলো। ছেলে কতোটা ম্যাচিউর, বুদ্ধিমান এবং ধীরস্থির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন—অথচ মা? কেমন অবলা প্রাণীর ন্যায় সংকটময় মুহুর্তটিতে মিইয়ে যায়। রাগ হতে গিয়েও হলো না নোমান। কেননা পৃথিবীতে সব মানুষ একরকম ব্যক্তিত্ব নিয়ে জন্মায় না।
*****
সাময়িক সুখ দীর্ঘস্থায়ী দুঃখকে ভুলিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখলেও, দিনশেষে পুনরায় দরজায় কড়া নাড়া সেই দুঃখ গুলো বুঝিয়ে দেয়,” দুঃখদের ভোলা নিষেধ!” সাময়িক সুখ? অবচেতনেও কেনো এমন অসম্ভব শব্দ জেঁকে বসে মস্তিষ্কে? সুখ যে সবার জন্য নয়; হোক সেটা সাময়িক কিংবা দীর্ঘস্থায়ী!

দরজা খুলতেই শ্রান্ত দেহে মৃদু হাসি নিয়ে স্বরূপ বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দিলো মায়ের হাতে। জুতা খুলে ঘরে ঢুকতে যাবে তখনি কানে আসে বুব্বোর ক্রন্দনরত গলায় চিৎকার,
–“প্রতিদিন সবজি দিয়ে ভাত খেতে ভালো লাগে না। খাবো না আমি ভাত।”

স্বরূপ উদ্বিগ্ন বদনে লম্বা লম্বা পা ফেলে উৎসের দিকে এগোয়। বোনের ঘরের ঠিক দরজার সামনে দাঁড়াতেই ছুটে আসা বুব্বোর গতি রোধ হলো মামুকে দেখে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বুব্বোকে ছুটতে দেখে স্বরূপ হাঁটু গেড়ে বসে। বুব্বো বিলম্বহীন আঁছড়ে পড়লো তার বুকে। গলা জড়িয়ে ধরে হেঁচকি তুলে কাঁদছে সে। সাধনা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো ভাইকে দেখে। স্বরূপ বুব্বোর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হয়েছে বুব্বো? এভাবে কাঁদছো কেনো?”

বুব্বো জবাব দেয় না। সে একাধারে কেঁদেই যাচ্ছে। সাধনা হড়বড়িয়ে বলে,
–“ওর কান্নায় দুঃখি হওয়ার কিছু নেই, স্বরূপ। যা চায় তাই দিতে দিতে বেশি বাড় বেড়েছে ও। ইদানীং সবকিছুতে ওর জেদ। ভাত না খাওয়ার জন্য বাহানা করছে সেই থেকে। দে ওকে আমার কাছে দে। তুই অফিস থেকে এসেই এখানে এলি কেনো? ঘরে গিয়ে ফ্রশ হ।”

সাধনা বুব্বোকে নিতে আসলে স্বরূপ কড়া চোখে তাকালো বোনের দিকে। গম্ভীর মুখে বলল,
–“তোকে কতোবার বলেছি, ওর সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করবি না?”

পরপরই আদুরে কণ্ঠে ভাগ্নের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“বুব্বো! কি হয়েছে? মামুকে বলো। কান্না থামাও, দেখো স্ট্রং বাচ্চারা কখনো কান্না করে না বরং হাসিমুখে সবকিছুর সম্মুখীন হয়। কিন্তু তোমার তো মামু রয়েছে, মামু আর তুমি একসাথে মিলে সবকিছুর সম্মুখীন হবো। এখন বলোতো, এই পঁচা কান্নারা হঠাৎ কেনো আমার দুষ্টু বুব্বোর চোখে ভীড় জমালো?”

বুব্বোরা কান্নারা গতি হারালো। মামুর কাঁধের কাছের শার্টে মুখ ঘষতে ঘষতে জড়ানো কণ্ঠে বলল,
–“তুমি সবসময় সবজি কেনো কিনো? কখনো তো মাছ মাংস কিনতে পারো। সবসময় সবজি দিয়ে ভাত খেতে ভালো লাগে না।”

সাধনা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আটকাতে না পেরে। ছেলেটাকে কি করে বোঝাবে, তাদের দুই ধরণের সবজি কিনতেও কতো টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
স্বরূপের অন্তঃস্থল ফাঁকা হয়ে পড়লো ছোট্ট ছেলেটির কথায়‌। অসহায়ত্বরা আঁছড়ে পড়লো ক্ষিপ্র গতিতে। দেহের সকল উদ্বেগ মিলিয়ে যায়। অসহায়ত্বে কেমন ম্লান, বলহীন হয়ে পড়লো দেহ। ঋজু শিরদাঁড়া ভেঙে এলো! ফোঁস করে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো তার অন্তঃস্থল থেকে; শেষপর্যন্ত তার বুব্বোকে খাবারের জন্য ও কাঁদতে হলো?

স্বরূপ জোরপূর্বক মৃদু হেসে বলল,
–“শুধু এই ব্যপার? এতো ছোট্ট বিষয় নিয়ে কান্না করার কি আছে?”

বুব্বো কাঁধ থেকে মাথা তুলে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না আঁটকে বলল,
–“আমার ব্যাট ভেঙে গিয়েছে মামু। আমায় ব্যাট কিনে দাও।”
স্বরূপ ম্লান হেসে বলল,
–“কিনে দেবো। তার জন্য এতো কান্না করতে হবে কেনো?”

বুব্বো আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
–“আমার স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান হচ্ছে মামু। আমি সেখানে অংশগ্রহণ করবো। কিন্তু মাম্মা অনুষ্ঠানে নাম দিতে দেয়নি।”

স্বরূপ বোনের দিকে তাকায়। মিহি স্বরে শুধায়,
–“অংশগ্রহণ করতে দিস নি কেনো?”

সাধনা বলহীন দেহে দাঁড়িয়ে থাকে। বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। বুব্বো আবার নিজ থেকে বলে,
–“মাম্মা সবসময় শুধু বলে টাকা নেই।”

স্বরূপ মলিন কণ্ঠে বোনকে জিজ্ঞাসা করে,
–“কতো টাকা লাগবে?”

সাধনা উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জবাব দেয়,
–“আড়াইশো টাকা।”

–“আড়াইশো?”, স্বরূপ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো। মুহুর্তেই মস্তিষ্কে ছেপে গেলো মিছে বিভ্রমে ডুবে থাকা কিছু স্নিগ্ধ মুহুর্ত। মনে পড়ে, বিগত দিনগুলোতে রোজ বিকেলে অজানা এক মোহে পড়ে আপ ডাউন চল্লিশ টাকা রিকশা ভাড়ার কথা। পাঁচ দিনে দুইশো টাকা! মস্তিষ্কে হিসাব কষে নেয় ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে। অনুশোচনা অনুতপ্ততায় জর্জরিত অন্তঃস্থল কুঁকড়ে গেলো স্বরূপের। পথহারা পথিকের ন্যায় ভাগ্নের অশ্রুমাখা মুখটির দিকে তাকিয়ে অত্যান্ত ধিমি স্বরে অপরাধীদের ন্যায় বলল,
–“মামু, স্যরি বুব্বো!”

বুব্বো অবুঝ নয়নে তাকিয়ে শুধায়,
–“তুমি কেনো স্যরি বলছো?

স্বরূপ জবাব দিতে পারলো না। বলার সাহস হলো না, সে কিভাবে বিগত দিনগুলোতে অহেতুক কারোর পেছনে কতো গুলো টাকা খরচ করেছে। সেই টাকা গুলো যদি সে জমিয়ে রাখতো তবে আজ বুব্বো অন্তত ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারতো। বুক ভরা নিঃশ্বাস ফেললো স্বরূপ। চাপা ক্লেশ গুলো জোরপূর্বক হাসির আড়ালে লুকিয়ে নিয়ে, বুব্বোকে কোলে তুলে নেয়। চোখের পানি মুছে দিয়ে আশ্বাসভরা কণ্ঠে বলল,
–“নো মোর ক্রাই বুব্বো; মামু আছি তো! আর সবজি দিয়ে ভাত খেতে হবে না তোমায়। মামু তোমার জন্য মাছ মাংস আনবো, ব্যাট কিনে আনবো আর তুমি ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ও অংশগ্রহণ করবে। এটা তোমার মামুর ওয়াদা!”

সাধনা শুনলো সেই মন ভুলানো কথাগুলো আর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তবে আপাতদৃষ্টিতে সেগুলো মন ভুলানো কথা মনে হলেও কারোর জন্য এটা এখন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। হ্যাঁ, বুব্বোর মুখে হাসি ফোটানো স্বরূপের লক্ষ্য।

কোনরকম গোসল করে, না খেয়েই স্বরূপ পিসিতে বসে পড়লো কাজ খুঁজতে। এই মাসের মতো কম কাজ আর কোন মাসে পায়নি! প্রতিমাসে এই ফ্রিল্যান্সিং এর ভরসাতেই সে নিশ্চিন্ত থাকে। আঠারো বছর বয়স থেকে সে ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা উপার্জন করে। বাবা তখন জীবিত ছিল এবং খুব ভালো উপার্জন করতো। কিন্তু তবুও সে নিজে ইনকাম করে হাত খরচ চালাতো‌, এটা তার ভালো লাগতো! আয় করার সক্ষমতা, পুরুষ মানুষের শিরদাঁড়া সোজা করে এটা স্বরূপ মনেপ্রাণে মেনে চলতো! নিজের টাকায় বিনা কৈফিয়তে চলাফেরার আনন্দ অবর্ণনীয়।

রাত নয়টা বিশ তখন। কিন্তু স্বরূপ তখনো ব্যর্থ কাজ খুঁজতে। মাথায় তখন শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে আগামীকাল বুব্বোর পাতে যেনো এক টুকরো মাংস রাখতে পারে, ভাঙা ব্যাটটার জায়গায় যেনো একটা নতুন ব্যাট রাখতে পারে, ক্রীড়া প্রতিযোগিতার বুব্বো দৌড়াবে আর সে মাঠের পাশে বসে হাসিমুখে দেখবে। এতোটুকু স্বপ্ন ই এখন স্বরূপের চোখে। যখন সেটুকুও তার জন্য দুঃস্বপ্ন হতে যাচ্ছে তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখ, বলহীন উদাসীন দেহ চেয়ারে এলিয়ে দিলো। মাথাটা এলিয়ে দিলো কাঠের শক্ত পাতের উপর। বদ্ধ নেত্রে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অন্তঃস্থল অস্থির! কি করবে? ভাবতে ভাবতেই ঘেমে ওঠা বদন হঠাৎ থমকালো এলার্ম ঘড়িটি তীব্র শব্দাঘাতে নেচে উঠতেই। সরব ফ্যাকাশে নয়ন খুলে তাকায় ঘড়িটির পানে। ঠিক নয়টা ত্রিশ! এটি তো কোন মহালগ্ন নয়—তবে কেনো এতোটা গুরুত্ব সহকারে সময়টিকে আলাদা করা হয়েছে? জবাব বিহীন প্রশ্নটি সেভাবেই অবহেলিত পড়ে থাকে। ঠিক যেমনটা অবহেলায় চলে গেলো সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত সময়টাও।

দুই বছরের অভ্যাস! গুনে গুনে সাতশো ত্রিশ দিনে, মাত্র সাতদিন ছিল ব্যাতিক্রম। পুরো এক ঘন্টা সাফেদ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকা দেহটি অপেক্ষা নামক বিষাক্ত অনুভূতি অনুভব করতে করতে নির্জীব হয়ে গেলো। শেষ বারের মতো খালি বেঞ্চিটি একবার দেখে নিয়ে নৈরা উদাসীন দেহ এলিয়ে দিলো ম্যাট্রিসে। ঠোঁটের কোনে বিষাদে ভরা হাসি ফুটে ওঠে নৈরার। বিড়বিড় করে নিজেকে আশ্বস্ত করে,
–“গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত নিশ্চয়ই!”

পরপরই নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সিলিং এর দিকে। চোখের কার্নিশ বেয়ে অযথা এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। নৈরা ফের ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
–“আমার রাতটি দুঃসহনীয় দীর্ঘ করার বিনিময়ে আপনি কি এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন স্বরূপ?”

অর্থবিত্ত কখনো প্রকৃত সুখ হতে পারে না এই বাক্যটির জলজ্যান্ত প্রমাণ নৈরা নামক ওভার থিংকার মেয়েটি। ছোট ছোট ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী নৈরা নামক নারীটির নম্র সত্ত্বাকে ভেঙে চুরমার করে দেয়। সামান্য একটা বিষয় তাকে এতোটা ভাবায় যে সেটা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাকে ঘুমের ওষুধের সাহায্য নিতে হয়। মূলত এর জন্য ই নুহাশ মাহমুদ ঠিক মাটির পুতুলের ন্যায় মেয়ের সাথে আচরণ করে! যেনো এদিক সেদিক হলেই সে তার মূল্যবান কিছু খুইয়ে ফেলবে! নিরব, সর্বদা নিজের মাঝে গুটিয়ে থাকা মেয়েটি তখন দূর থেকে কাউকে দেখে সুখ অনুভব করতে লাগলো। সামান্য বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত প্যানিক হয়ে যাওয়া মেয়েটি অনায়াসে বিনা চিন্তায় ঘন্টা পার করে দিতো কারোর সাদামাটা বাচনভঙ্গি দেখতে দেখতে। ধীরস্থির প্রতিদিন ঐ এক ঘন্টার জন্য অপেক্ষা করা মেয়েটির ভালো থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই হুটহাট এমন অনুপস্থিতি মেয়েটিকে মানসিক পীড়া দেয়। উদাসীন দেহ টেনে নৈরা ম্যাট্রিস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। হেঁটে যায় বিছানার পাশের মিনি কাবার্ডের কাছে। ড্রয়ার ঘেঁটে ঘুমের ওষুধের পাতা থেকে একটা ওষুধ খেয়ে নিলো। এই ঘুমের ওষুধ তার নিত্যদিনের সঙ্গী নয় কিন্তু মাঝেমধ্যে যখন অতিরিক্ত মানসিক পীড়া অনুভব হয় তখন তার প্রিয় মিত্র হয়ে ওঠে এই সাফেদ ট্যাবলেট গুলো। বাবার ওষুধের বক্স থেকে লুকিয়ে নিয়ে আসে এগুলো ‌ বাবা কখনো টের পায় না! তার বক্সে যে রাজ্যের ওষুধ থাকে!

কাঁধে তখন নিশ্চল বুব্বোর গরম নিঃশ্বাস আঁছড়ে পড়ছে। ঘরময় অলস পায়ে হাঁটতে থাকা স্বরূপ উপায় খোঁজার চেষ্টায় বারংবার শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে তো কখনো গভীর চিন্তায় মগ্ন হচ্ছে। কিভাবে কটা টাকার ব্যবস্থা করবে! বুব্বোকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার জন্য বিছানার কাছে গেলে নিজের ল্যাপটপ টা চোখে বাঁধলো স্বরূপের। ল্যাপটপটা একহাতে তুলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। ওষ্ঠকোনা ঠিকরে স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে বাবার স্মৃতি মনে পড়তেই। এটা বাবা কিনে দিয়েছিল যখন সে প্রথম প্রথম বন্ধুদের ল্যাপটপ থেকে ফ্রিল্যান্সিং শিখতো! আজ এতো বছর পরেও অনেক ভালো সার্ভিস দেয়। সে যত্ন করে রাখে। কিন্তু এই যান্ত্রিক সঙ্গী এখনো তার সঙ্গ ত্যাগ না করলেও, বাবা নামক সঙ্গীটি বহু আগেই তার সঙ্গ ত্যাগ করে। আজ বোধহয় বাবার দেওয়া এই যান্ত্রিক সঙ্গীটির ও সঙ্গ ত্যাগ করার সময় এসে গিয়েছে। ম্লান হেসে স্বরূপ ল্যাপটপটির উপর একটা চুমু দিলো। ফিসফিসিয়ে বলে,
–“তোমার স্বরূপ তোমায় প্রচুর মিস করে আব্বু। আমি কখনো তোমার মেয়ে আর তোমার নাতির কোন কষ্ট হতে দেবো না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।”

ল্যাপটপটি টেবিলে রেখে দেয় স্বরূপ। সকল চিন্তারা মলিন, নির্জীব হয়ে পড়লো স্বরূপের এহেন কঠোর সীদ্ধান্তে। তাদের দূর করার জন্য ছেলেটা যে বাবার একমাত্র স্মৃতি ও ত্যাগ করতে রাজি। একটা শান্তির ঘুম দেওয়ার জন্য বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয় স্বরূপ। এক হাতে আগলে রাখা তখন বুব্বোর ছোট্ট দেহটি। তবে শান্তির ঘুম আদৌ ধরা দিল না চোখে!

চলবে…