কাঞ্চনবেলা পর্ব-০৬

0
3

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৬

আজকের দিনটি পরিপূর্ণ আনন্দের সহিত হাজির হয় ধরিত্রী বাসীর একপাশে অবস্থানরত আমোদপ্রমোদ প্রিয় বাঙালিদের নিকট। আজ একত্রে চৌদ্দ’ই ফেব্রুয়ারী এবং পহেলা ফাল্গুন। এই দিনগুলো সবার জন্য বিশেষ হয় না; তবে কারো কারোর জন্য এই পহেলা ফাল্গুন নামক দিনটি বড্ডো বিশাল কারণ হয় বিলাসী উদযাপন এবং হৈ হুল্লোড় এর জন্য। অর্থবিত্তের দিক থেকে যারা সমৃদ্ধ তাদের বিশাল এক কারণ মিলে যায় টাকা খরচ এবং বিলাসীতা করার জন্য। নুহাশ মাহমুদ এই কাতারের একজন মানুষ। আজ মাহমুদ বাড়িতে শাহী ভোজের আয়োজন চলছে সকল থেকেই। প্রতিবছর এই দিনটি তে আত্মীয় স্বজনদের মাঝে রমরমা এক মিলনায়তন মেলা দেখা যায়।

অথচ এহেন শাহী ভোজ, বিলাসী উদযাপনে বরাবরের মতো অনাগ্রহী মেয়েটি ঘুমের ওষুধের প্রভাবে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। মেয়ের ঘরের চাপিয়ে রাখা দরজাটি হালকা একটু খুলে উঁকি দেয় নুহাশ মাহমুদ। অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘরে সাদা পর্দা ভেদ করে সোনালী আলো ঠিকরে ঢুকছে। ঠিক বিছানা বরাবর দৃষ্টি রাখলে বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। মেয়ে প্রায়শই এমন দীর্ঘ নিদ্রায় সময় কাটায়। উদাসীন দৃষ্টি ফেললো বালিশে গাল দাবিয়ে বাচ্চাদের মতো শুয়ে থাকা মেয়ের দিকে। ফ্যাকাশে গায়ের বরন গোলাপী বর্ন ধারণ করেছে। লালচে ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে ঘুমাচ্ছে। মৃদু হাসলো নুহাশ মাহমুদ। মেয়ে তার কাছে বরাবরের জন্য বিশেষ একটি সত্ত্বা! মেয়ের আশায় আশায় দুইবার ছেলের বাবা হয়ে যায়। অতঃপর তৃতীয়বারের মতো সৃষ্টিকর্তা মুখ তুলে তাকালেন, আর ফ্যাকাশে রঙা লালচে ঠোঁট সমেত এক রাজকুমারীকে দিয়ে তার কোল ভরে দিলেন। ভাবতো মেয়ে তার ঐ টলটলে স্বচ্ছ চোখে এই রঙচঙে দুনিয়ার যতো মূল্যবান স্বপ্ন বুনবে আর সেই বোনা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করবে সে। নুহাশ মাহমুদের মেয়ের জীবনে কখনো কোন আক্ষেপ থাকতে দেবে না। কিন্তু কখনো ভাবতেও পারেনি মেয়ের ঐ ফ্যাকশে বরনের মতো মেয়ের স্বপ্নগুলো ও এমন ফ্যাকাশে বেরঙ হবে। মাঝেমধ্যে ই তার বড্ডো বিরক্ত লাগে, সে কেনো এতো অর্থবিত্ত অর্জন করেছে—যেনো তার সন্তানরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে পারে আর সে সেই আকাঙ্ক্ষা গুলো পূরণ করতে পারে! বিশেষ করে তার নৈরা! সে খুব করে চায় তার মেয়েটা আর পাঁচটা মেয়ের মতো চঞ্চল, আকাঙ্ক্ষা, চাহিদাভরা, আগ্রহের সাথে জীবনযাপন করুক। তবে দীর্ঘ এই ছাব্বিশ বছর যাবৎ তাকে শুধু দীর্ঘশ্বাস ই ফেলতে হয়েছে। সে ম্লান হেসে পুনরায় দরজা আঁটকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ভাইয়ের সাথে ব্যবসায়ীক আলোচনায় বসেছিল সকাল সকাল। এরপর নাস্তা খেয়ে উপরে আসলো। অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য সব খাবারের অর্ডার দিয়ে এসেছে গতকাল রাতেই। ঘরে কখনোই সে এসব রান্নাবান্নার ঝামেলা করে না।

নৈরার দীর্ঘ নিদ্রার রেশ কাটলো কাজিনদের আগমনী কোলাহলে। অলস দৃষ্টি মেলে তাকায় নিজের চার বোনের দিকে। নৈরাকে উঠতে দেখে হামলে পড়লো সবাই। প্রত্যেকের বয়স বিশ বছরের উর্ধ্বে। তারা নৈরার থেকে একদম ভিন্ন। বিলাসবহুল আধুনিক চলাফেরার ধরণ তাদের। এবং তারা যতক্ষণ নৈরার কাছে থাকবে তাদের কাজ হবে নৈরাকে বিরক্ত করা।
বিছানায় ঝিমিয়ে বসে থাকা নৈরা পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে বোনদের বিশাল পরিকল্পনা শুনছিল। ঘড়িতে তখন দশটা বিশ। তবে হঠাৎ তার ঝিমানো চিত্ত হতচকিত হয়। পহেলা ফাল্গুন? সে হতচকিত কণ্ঠে বোনকে শুধায়,
–“আজ কি পহেলা ফাল্গুন?”

একজন বিদ্রুপ করে বলল,
–“সেটা তুই এখন জিজ্ঞাসা করছিস? অর্ধেক দিন শেষ হওয়ার পরে?”

নৈরা গায়ে মাখে না। বোনদের পরিকল্পনা স্মরণ করে সে পুনশ্চঃ শুধায়,
–“এই দিনে বাইরে বের হলে কী শাড়ি পড়তেই হয়?”

নৈরার এক বোন চঞ্চল কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“হুঁ, আজকের বিশেষত্ব ই তো শাড়ি। তুই কি শুনিসনি শাড়িতে নারী? শাড়ি হলো নারীদের একান্ত ব্যক্তিগত ঐতিহ্য! শাড়ি আর ভালোবাসার মানুষের মধ্যে একটা চমৎকার কানেকশন আছে জানিস! নারী তার ভালোবাসার মানুষের জন্য শাড়ি পড়তে ভালোবাসে। আর অদ্ভুত ব্যপার হলো ভালোবাসার মানুষগুলো নারীকে এই শাড়িতে দেখতে পছন্দ করে।”
বলতে না বলতেই মেয়েটির পিঠে এক চাপড় পড়লো। তার আরেক বোন হেসে উঠে বলে,
–“তুই ওকে প্রেমের পাঠ পড়াচ্ছিস কেনো? সবাইকে কি নিজের মতো পেয়েছিস? নুরু আর ভালোবাসার মানুষ? হি হি..”, সকলে বিদ্রুপ করে হেসে উঠলো। নৈরা কপাল কুঁচকে বিরক্তি মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করে তাদের দিকে। কেনো তার ভালোবাসার মানুষ থাকতে পারে না? কে বলেছে নেই? সকলে বোকা! মনে মনে এহেন কিছু বাক্য উচ্চারণ করে মেয়েটি নিজের বিরক্তি নিজের মাঝেই চেপে রাখলো। বোনরা নিচে নামতেই নৈরা হাস্যোজ্জ্বল মুখে চঞ্চল পায়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। অক্ষিপটে রঙিন স্বপ্ন বুনছে আনমনে। তৃষ্ণার্ত অন্তঃস্থল জানে এই স্বপ্নের বাস্তবিক রূপ বড্ডো মনোমুগ্ধকর হবে। তবে ক্ষীণ সময়ের মাঝেই তার হাসি মিলিয়ে গেলো যখন কাবার্ডে একটা ও শাড়ি খুঁজে পেলো না। সে তড়িৎ গতিতে ঘড়ির দিকে তাকায় এগারোটা বাজে। বিলম্ব হীন বিছানা থেকে ফ্রকের ওড়নাটা নিয়ে নৈরা ছুটে বের হয় কামড়া থেকে। বের হতেই নৈরার মায়ের সাথে দেখা হলো। সে চিন্তিত কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হচ্ছে, এমন দৌড়াচ্ছো কেনো?”

নৈরা গতিরোধ করে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
–“মাম্মা, আমার আলমারিতে একটাও শাড়ি নেই কেনো?”

মিতা অবাক হলো মেয়ের এহেন প্রশ্নে। মেয়ে ঠিক কোন দুনিয়ায় থাকে এ নিয়ে আরেকবার প্রশ্ন জাগে মনে। সে অতিষ্ট ভঙ্গিতে ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল,
–“আপনি জীবনে শাড়ি পড়েন যে আপনার আলমারিতে শাড়ি থাকবে?”

নৈরা বিরক্তি নিয়ে তাকায় মায়ের দিকে। জবাবটি যে তার পছন্দ হয়নি। সে আবার ছুটতে লাগলো মিতা পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে,
–“মায়ের কাছে অনেক শাড়ি আছে নৈরা। পড়তে চাইলে সেখান থেকে পড়ো।”

–“না, আমার নিজের শাড়ি লাগবে মাম্মা।”, নৈরা চেঁচিয়ে বলল। বাবার কক্ষের চাপিয়ে রাখা দরজা খুলে ঢুকে গেলো নৈরা। বাবা সেখানে নেই। বারান্দা থেকে আওয়াজ আসছে। সে ছুটে বারান্দায় যায়। বারান্দার দরজা আকড়ে ধরে হাঁফাতে হাঁফাতে বলে,
–“বাবা আমার কাছে কোন শাড়ি নেই। আমায় শাড়ি কিনে দাও।”

নিজ আলোচনায় বিঘ্ন ঘটতেই নিরাদ আর নুহাশ মাহমুদ পিছু ফিরে তাকালো। মেয়ের আ’ত’ঙ্ক জর্জরিত মুখশ্রী দেখে নুহাশ মাহমুদ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হয়েছে আম্মা, এমন দেখাচ্ছে কেনো?”

নৈরা ফের অনাহুতর ন্যায় অসহায় কণ্ঠে বলল,
–“বাবা আমার আলমারিতে কোন শাড়ি নেই।”

নুহাশ মাহমুদের উদ্বিগ্নতা মিলিয়ে যায়। সে গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। এতোদিনে তার মেয়ের চোখে পড়েছে তার কোন শাড়ি নেই। নিরাদ ডানে বামে মাথা নাড়লো। এতো উদাসীনতা তার ভালো লাগে না। নুহাশ মাহমুদ হাত বাড়িয়ে দেয় মেয়ের দিকে। নৈরা বাড়িয়ে দেয়া হাতটি আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যায় বাবার কাছে। নুহাশ মাহমুদ নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনার হঠাৎ শাড়ির কথা কেনো মনে পড়লো আম্মা? শাড়ি পড়বেন?”

নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানায়। নুহাশ মাহমুদ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
–“কখন পড়বেন? বোনদের সাথে বাইরে বের হবেন?”

এহেন প্রশ্নে নৈরা জবাবহীনতায় ভুগলো। ঘেমে ওঠা হাত কচলাতে লাগলো সে। নুহাশ মাহমুদ দেখলো সেই হাত কচলানো। কিন্তু তবুও তার দৃষ্টি কৌতুহলী। কেননা মেয়ে যে আজ অব্দি কখনো কোন পহেলা ফাল্গুনে শাড়ি পড়েনি আর না বাইরে বের হয়েছে। নৈরা কিয়ৎকাল বাদ মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
–“বিরঙ্গনায় যাবো বাবা।”

–“বিরঙ্গনা আজো খোলা?”

বাবার প্রশ্নে নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে ডাহা মিথ্যা কথাটিকে সত্য প্রমাণ করলো। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হাসলেন। জিজ্ঞাসা করে,
–“আচ্ছা, তাহলে এখন বাবাকে কি করতে হবে?”

নৈরা মিনমিন করে বলল,
–“শাড়ি কিনে দিতে হবে, এখনি।”

বিনা দ্বিরুক্তিতে নুহাশ মাহমুদ সব কাজ অবহেলায় ফেলে রাখলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,
–“বাবা, এসে কথা বলছি নীরাদ। এখন আপনার বোনের শাড়ির ব্যবস্থা করে আসি।”

নিরাদ বাবাকে বলল,
–“তোমার যাওয়ার কি প্রয়োজন? আমি নুরুকে নিয়ে গিয়ে শাড়ি কিনে আনি।”

নুহাশ মাহমুদ নাকোচ করলেন, বললেন,
–“নাহ, বাবা যতোদিন আছি আমার আম্মার সব চাওয়া আমিই পূরণ করবো; হোক সেটা ছোট কিংবা বড়ো।”

নৈরা প্রগাঢ় হাসলো। মেয়েকে নিয়ে তৎক্ষণাৎ বের হয় নুহাশ মাহমুদ। আড়ং এর ছোট্ট সেই ব্রাঞ্চটিতে বাবা মেয়ে তখন ঘুরছিলো। ব্লক প্রিন্টের সেই কটনের শাড়িগুলো আজ যেনো নৈরার কাছে সবচেয়ে নান্দনিক সৌন্দর্যের পোশাক মনে হলো। আফসোস হলো কেনো শাড়ি নামক পোশাকটির এই সৌন্দর্য এতোদিন তার থেকে লুকিয়ে ছিল? তখনি অন্তঃস্থল বলে ওঠে, নারী সৌন্দর্যের মাঝে তখন ডুবে— যখন সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো কেউ একজন থাকে। ষষ্ঠ কাঞ্চনবেলার জন্য অপেক্ষারত নৈরা হাসলো নিজের মনের অবুঝ কথায়। শাড়ি গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতেই দু’টো শাড়ির দিকে চোখ আটকালো নৈরার। ওষ্ঠকোনা বেঁকে যায় ধবধবে সাদার মাঝে সুতোর কাজ করা একটি শাড়ি আর স্কাই ব্লু রঙা একটি ব্লক প্রিন্টেড শাড়ি দেখতেই। অক্ষিপটে ভেসে উঠলো সাদা আর স্কাই ব্লু রঙা শার্ট পড়া একটি ঘর্মাক্ত বদন। লোকটাকে পুরো সপ্তাহ এই দু’টো রঙের শার্ট ই পড়তে দেখা যায়। মনে হয় যেনো এই রঙদুটো ঐ ব্যক্তির জন্য ই তৈরি। সে হ্যাঙ্গার থেকে শাড়ি দু’টো বের করে নিয়ে এসে বাবার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে বলল,
–“এতো হালকা রঙের শাড়ি আম্মা? ফাল্গুনের দিনে কেউ এই রঙের শাড়ি পড়ে?”

নৈরা মৃদু হেসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে মিহি স্বরে বলল,
–“আমার ফাল্গুনের রঙগুলো তো এমনি, বাবা। তবে আমি ভিন্ন কিছু কিভাবে পড়তে পারি? আর এই রঙদুটো পৃথিবীর সব রঙের থেকে সুন্দর রঙ।”

নুহাশ মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুনলো মেয়ের বদলে যাওয়া রঙ। এতোদিন জানতো মেয়ের পছন্দের রঙ কালো!

সকাল থেকে বুব্বো আনন্দের দুনিয়ায় ভাসছে। তার এই প্রমোদের কারণ হলো মামু আজ পুরো বাজার তুলে এনেছে বুব্বোর জন্য। জাঙ্ক ফুড, মাছ মাংস, ফল আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই জিনিসটা—সেটা হলো ক্রিকেট ব্যাট এবং ক্রিকেট প্যাড। এখন বুব্বো আবার ক্রিকেট খেলবে কোনকিছুতে বাধাপ্রাপ্ত হবে না আর। স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ও সে অংশগ্রহণ করতে পারবে। ভাগ্নের ঐ উল্লাসে স্বরূপ ভুলতে চেষ্টা করলো সদ্য বাবার শেষ স্মৃতিটুকু খুইয়ে আসার বেদনা। সাধনা যখন ভাইয়ের মুখ থেকে সত্যটা জানতে ব্যর্থ হলো তখন সোজা ভাইয়ের ঘরে গেলো। খুঁজে দেখলো তার আর তার ছেলের জন্য তার ভাইটা পুনরায় নিজের কোন মূল্যবান জিনিস ত্যাগ করলো? বাবার শেষ স্মৃতিটুকু যখন আর খুঁজে পেলোনা ভাইয়ের ঘরে তখন সে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠলো। অশ্রুসিক্ত নয়নে বেদনাভরা কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
–“আব্বু, আমার জন্য আজ তোমার শেষ স্মৃতিটুকুও হারিয়ে ফেললো ও। আমি কি করে ওকে মুখ দেখাবো?”
*****
তৃষ্ণার্ত পীড়িত হৃদয় তাদের উৎকণ্ঠা সামলে নিতে শিখলো। তখন ঘড়িতে তিনটা বাজে। লোকটা একদিন স্কাই ব্লু রঙা শার্ট আরেকদিন সাদা শার্ট ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়ে। হিসেব মতো আজ লোকটার সাদা শার্ট পড়ার দিন।
ছিমছাম গড়নের দেহে সদ্যই সাদা শাড়িটি অপার সৌন্দর্য নিয়ে খাঁজে খাঁজে লেপ্টে গিয়েছে। বড্ডো সাধ জাগে টলটলে স্বচ্ছ টানা টানা চোখদুটিতে আজ কাজল টানার। অদক্ষ হাতে সেটাও টানলো। ফ্যাকাশে মুখশ্রীর গালদুটো সর্বদার ন্যায় অত্যাধিক ফর্সার কারণে গোলাপী আভায় ছেয়ে আছে। নৈরা আলগোছে একটি হাত খোঁপা করে নিলো। যেটি ঘাড় ছুঁয়ে আছে। অতঃপর আপাদমস্তক নিজেকে একবার দেখে নিলো। ঠিক খুঁটে খুঁটে। কোন অলংকারের ছোঁয়া নেই শুধুমাত্র বা হাতের মধ্যমা আঙ্গুলটি ব্যতীত। বাবার দেয়া হিরের ঐ আংটিটি আজ পর্যন্ত কখনো নিজের থেকে আলাদা করেনি নৈরা। তবুও মনে হলো সাজসজ্জা বেশি হয়ে গিয়েছে। তাকে অদ্ভুত দেখতে লাগছে কি? ততক্ষণে এলার্ম ঘড়িটি রোজকার মতো নির্দিষ্ট সময়ে বেজে উঠলো। নৈরা সেদিকে একবার তাকিয়ে ব্যস্ত হাতে নিজের ব্যাগটি কাঁধে তুলে নেয়। শেষবারের মতো নিজেকে আরেকবার দেখে নিয়ে নৈরা দ্রুত বের হয় ঘর থেকে।

প্রকৃতি আজ নতুন সাজে সজ্জিত। চারিদিকে মৃদুমন্দ শীতল সমীরনে ফুলের সুবাস। ফাল্গুনের স্বাগতমে গাছপালার ন্যায় ধরনীর এই প্রান্তের প্রতিটি মানুষ আজ রঙে আর ফুলে ফুলে সেজে উঠেছে। পথে প্রান্তরে শুধু শাড়ি আর পাঞ্জাবি পড়া যুগল। গতরে তাদের ফুলের ছোঁয়া।
পিচের রাস্তা ঢেকে যাওয়া শুকনো এবং আধশুকনো একাধিক ফুলের আস্তরণ পেরিয়ে গাড়ি থেকে নামে নৈরা। সোজা গিয়ে স্টিলের ঐ বেঞ্চিটির এক কিনারায় পা ঝুলিয়ে বসলো। চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে তাকায় বিরঙ্গনার পাশের সৌখিনতার ছোঁয়ায় সেজে থাকা সরু সিঁড়ির সামনে চেয়ার পেতে বসা দারোয়ানের দিকে। ওষ্ঠকোনে স্মিত হাসি ফুটে ওঠে। মনে হয় এই বুঝি তার অপেক্ষাদের সমাপ্ত ঘটিয়ে বেরিয়ে আসলো ঘর্মাক্ত শরীরের লোকটি।
ড্রাইভার চাচা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটির দিকে। শুধায়,
–“নৈরা আম্মা, তোমার গানের ক্লাব তো তালাবদ্ধ।”

নৈরা মৃদু হেসে বলল,
–“হুঁ চাচা, আজ তো পহেলা ফাল্গুন তাই বন্ধ।”

–“তবে তুমি এখানে আসলে কেনো?”

–“এমনিই চাচা। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসবো। আপনি ততক্ষণে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসুন। আমি ফোন করে আপনাকে ডেকে নেবো।

ড্রাইভার চাচা নম্র কণ্ঠে বলল,
–“আম্মা, তোমার বাবা তোমাকে একা ছাড়তে বারন করছে। তুমি বরং এখানে থাকো আমি এই পাশেই দাঁড়াই।”

নৈরা কপাল কুঁচকে নিলো। বলল,
–“নাহ, আপনার এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। আপনি ঘুরে আসুন কোথাও থেকে।”

–“তোমার বাবা রাগারাগী করবে, আম্মা।”, ড্রাইভারে অসহায় কণ্ঠ। নৈরা থমথমে মুখে জেদি কণ্ঠে বলল,
–“না গেলে আমি বাবাকে বলে দেবো আপনি রোজ দেরি করে আমায় নিতে আসেন।”

ড্রাইভার চাচা থতমত খেয়ে গেলো। বলল,
–“তা তো তোমার ভাইদের জন্য ই দেরি হয়।”

–“সেটা তো আমার দেখার বিষয় নয় চাচা। আপনার জন্য রোজ রোজ আমায় অপেক্ষা করতে হয়।”

–“আচ্ছা, ঠিক আছে তবে তুমি এখানেই থাকো। আর যাওয়ার সময় আমাকে ফোন দিও। আমি দ্রুত চলে আসবো।”, ড্রাইভার চাচা মিনমিনে কণ্ঠে বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে। ড্রাইভার চলে যেতেই নৈরা ফিক করে হেসে উঠলো। নিজেকে তার প্রচুর চতুর মনে হচ্ছে। কেমন চাটুকারিতার সাথে ড্রাইভার চাচাকে পাঠিয়ে দিল! নৈরা হাসিমুখে পা দোলাতে দোলাতে মৃদু স্বরে গুনগুন করতে লাগলো।

যার ধৈর্য্য যতোটুকু তার ধৈর্য্যের পরীক্ষা ঠিক তার থেকে দ্বিগুন। এই কথাটি যেনো একদম ফলপ্রসূ নৈরার জন্য। পুরো এক রাত সহ একটা দিন অপেক্ষা কি কম দুঃসহ যে আবার এই দুই ঘন্টার অপেক্ষা? কিন্তু সেই দুই ঘন্টার দুঃসহনীয় অপেক্ষাও নৈরা হাসিমুখে করে নিলো। কিন্তু…. পাঁচটা ত্রিশ বেজে গেলেও যখন ব্যাংকের সিঁড়ি থেকে কেউ নামলো না তখন অস্থির হয়ে পড়লো নৈরা। হাত কচলাতে কচলাতে বিবর্ণ মুখে বারবার তাকায় সিঁড়ির দিকে। দেখতে দেখতেই পাঁচটা চল্লিশ বেজে গেলো। নৈরা আর উদ্ভ্রান্ত অন্তঃস্থল নিয়ে বসে থাকতে পারলো না। সে ধীরপায়ে হেঁটে যায় ব্যাংকের নিচতলায় সিঁড়ির গোড়ায় থাকা মাঝবয়সী দারোয়ানের কাছে। গিয়ে বিনম্র কণ্ঠে বলল,
–“ভাইয়া, আসসালামুয়ালাইকুম।’

দারোয়ান লোকটি হেসে বলল,
–“ওয়ালাইকুমুস সালাম, কেমন আছেন আপা?”

নৈরা হেসে জবাব দিলো। কিয়ৎকাল‌ বাদ ইতস্তত কণ্ঠে শুধায়,
–“ভাইয়া, ছয়টা বেজে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাংকের লোকরা এখনো বের হচ্ছে না কেনো?”

লোকটি বিলম্বহীন হেসে জবাব দিল,
–“আজ তো শুক্রবার, আপা। ব্যাংক বন্ধ।”

সহসা নৈরার দুঃসহ অপেক্ষা, তৃষ্ণার্ত পীড়িত হৃদয় সহ সব সাজগোজ যেনো মুখ থুবড়ে পড়লো। অবাকপানে তাকিয়ে শুধায়,
–“আজ শুক্রবার?”

–“হ্যাঁ আপা। আপনি ভুলে গিয়েছেন বোধহয়। এমন হয় মাঝেমাঝে।”, দারোয়ান মৃদু হেসে বলল। নৈরা টলটলে স্বচ্ছ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরু সিঁড়িটির দিকে। মনে হলো এই বুঝি ঘর্মাক্ত শরীরে লোকটা ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসলো। নৈরা নিরুত্তর উদাসীন দেহ টেনে আবার বেঞ্চিতে এসে বসলো। তবে দেহে কোন উৎফুল্লতা নেই। আছে অবসাদ! এই অবসাদ দীর্ঘক্ষণ কারোর অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতে থাকতে যখন শুনলো তার অপেক্ষারা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ঠিক অনন্তকালের মতো দীর্ঘ অপেক্ষা মনে হলো নৈরা কাছে। পালাক্রমে কাঞ্চনবেলার সোনালী আলো মিলিয়ে গেলো। পশ্চিম আকাশের সূর্য তখন টকটকে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতি নির্দেশ করছে বিদায় বেলা এসে পড়েছে। অপেক্ষা নামক এক যন্ত্রণাদ্বায়ক অনুভূতি সামলে উঠতে না পারা মেয়েটি তখনো কোলের মাঝে দুই হাত জড়োসড়ো করে চুপটি করে নত মস্তকে বসে আছে। নত মস্তকে বসতে বসতেই একটাসময় দুইহাতের মাঝে টুপটাপ করে কিছু নোনাজল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

শেষ গলিটি লম্বা লম্বা পা ফেলে পাড় হতেই ঘর্মাক্ত দেহাবয়ব ম্লান হয়ে আসলো। চঞ্চল দৃষ্টি গিয়ে সোজা স্থির হয় বাগানবিলাস ফুলগুলোর নিচে স্টিলের বেঞ্চিতে নত মস্তকে বসে থাকা সাফেদ অবয়বের দিকে। মন ঠিক জানতো ঐ জায়গাটিতে বোকা নারীটি তার অপেক্ষার প্রহর গুনবে। গতরাতের মতো এই সময়টিকেও এড়িয়ে যেতে চাইছিল কিন্তু কোনভাবেই পেরে ওঠেনি। অস্থির অন্তঃস্থল নিয়ে ছুটে বের হয়। কিন্তু রিকশা খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই তো এতো পথ হেঁটে আসতে হয়েছে আর নারীটির চোখে জল এসেছে। সে উদাসীন কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলে,
–“বোকা কাঞ্চনবালা! অসুখের কাছে সুখ খুঁজে চলেছেন!”

বেঞ্চির ঠিক অপরপাশে দুই হাত দূরত্বে কেউ বসতেই নত মস্তকে বসা মেয়েটি বাচ্চাদের মতো হাতের উল্টো পিঠে চোখের পানি নাকের পানি মুছতে লাগলো। ফ্যাসফেসে গলায় শুধায়,
–“আজকের দিনে কি বাসায় সবজি খাওয়া হয় না?”

–“হয় তো!”, একটা রুমাল সহ ছোট্ট একটি জবাব ফিরে আসলো। মেয়েটি থমথমে মুখে রুমালটি নিয়ে নাক চোখ মুছতে লাগলো। ফের শুধায়,
–“তবে এতো দেরি করে এলেন কেনো?”

–“এমনিই।”, বড্ডো উদাসীন ঠেকলো সেই কণ্ঠ। মেয়েটি তৎক্ষণাৎ অশ্রুসিক্ত রাগান্বিত চোখে তাকালো ঠিক নিজের বা পাশে। সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া সুঠামদেহটি বেঞ্চিতে পিঠ এলিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকেই দেখে যাচ্ছে। নৈরা চোখ নামিয়ে নেয়। রাগে হাতে হাত চেপে কাঠ হয়ে বসে রইল। স্বরূপ কিয়ৎকাল বাদ মৃদু হেসে মিহি স্বরে ডেকে ওঠে,
–“নৈরা?”

–“হুঁ।”, নৈরার রাগান্বিত স্বর।

–“এখানে কি করছেন?”

–“বিরঙ্গনায় এসেছি।”, মেয়েটি রাগান্বিত স্বরে ডাহা মিথ্যা কথাটি বলল। স্বরূপ বিলম্বহীন মেয়েটির মিথ্যাকে পাকড়াও করে মিহি স্বরে বলে ওঠে,
–“আজ শুক্রবার নৈরা। বিরঙ্গনা বন্ধ।”

নত মস্তকে মেয়েটি অপরাধী সাব্যস্ত হলেও তারমধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখাগেলো না। সে তখনো ব্যস্ত গড়িয়ে পড়া অবাধ্য অশ্রু গুলো মুছতে। স্বরূপ ঘাড় কাত করে নিগুঢ় চোখে দেখে মেয়েটিকে। ফের ডেকে ওঠে,
–“নৈরা?”

–“হুঁ।”

–“কাঁদছেন?”

–“নাহ।”

–“আমি তো স্পষ্ট দেখছি আপনি কাঁদছেন!”

–“আপনি ভুল দেখছেন।”

–“ওহ্, তাই?”

–“হুঁ ।”

–“তবে তো মনে হয় আমি এটাও ভুল শুনেছি যে—আপনি দারোয়ানের কাছ থেকে আমার নাম্বার নিয়েছেন, তাই না?”

–“হুঁ।, ফের মেয়েটির রাগান্বিত স্বরে স্বরূপ গা দুলিয়ে হেসে উঠে পুনরায় শুধায়,
–“রোজ রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত পর্দার পেছনে লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে দেখা হয় এটাও নিশ্চয়ই আমি ভুল দেখেছি?”

মেয়েটি তখনো চোখের পানি মুছতে মুছতে জবাব দেয়,
–“হুঁ।”

রাস্তার ওপারে থাকা বকুলফুলের গাছটিকে দেখতে দেখতেই বিষাদেরা চোখজুড়ে নামলো। আবার ডেকে উঠলো মেয়েটিকে,
–“নৈরা?”

–“হুঁ।”

–“আপনি কি জানেন আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ, স্বচ্ছ এবং সরল একটি সত্ত্বা?”

–“হুঁ, ভাইজানরা বলে।”, নৈরার গম্ভীর কণ্ঠে স্বরূপ ম্মিত হাসলো। বকুল গাছটির দিকে স্থির দৃষ্টি রেখেই বিমর্ষ কণ্ঠে বলে উঠলো,
–” আপনার ভাইজনারা কখনো এটা বলেনি যে, আপনার সৌন্দর্য ই আপনার এই সহজ-সরল সত্ত্বা টি?”

মেয়েটি তৎক্ষণাৎ নত মস্তক তুলে তাকায় দূর পানে দৃষ্টি রাখা লোকটির দিকে। কিয়ৎকাল বাদ নিরবতা ভেঙে স্বরূপ বলতে লাগলো,
–“আমার বাবা নেই নৈরা। মা, বোন আর একটা পাঁচ বছরের ভাগ্নে নিয়ে আমার পরিবার। আপা বিধবা হয় বছর চার হলো। বিভোর—আমার ভাগ্নের বয়স তখন এক বছর। তারপর থেকেই আমার বোন আর ভাগ্নে আমার কাছে থাকে। আমার বোন আমার জন্য সবকিছু নৈরা। তাকে কখনো আমি কোনকিছুতে ছোট হতে দেখতে পারি না।
আমার প্রতিটা পদক্ষেপ হয় তার ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করে। আমার মাথার উপর বিশাল একটা লোনের বোঝা, নৈরা। চুয়ান্ন লক্ষ্য টাকা! প্রতিমাসে দেড় লক্ষ্য টাকা গুনতে হয় এই লোন বাবদ। সেখানে আমার মাসিক বেতন মাত্র আটচল্লিশ হাজার টাকা। বেতনের থেকে তিনগুণ বেশি এই লোন টানতে আমায় হিমশিম খেতে হয়। আমার বুব্বো খুব একটা ভালো খেতে পারে না এই কারণে। তার খুব আক্ষেপ মামু সবসময় কেনো সবজি কিনে? মাছ, মাংস কেনো কিনে না? আপনি জানেন সে খুব ভালো ক্রিকেট খেলে। স্বপ্ন বিশাল বড়ো ক্রিকেটার হবে। এই তো সেদিন রক্তাক্ত পা নিয়ে হাজির হয় আমি তাকে একটা ক্রিকেট প্যাড কিনে দিতে পারিনি। মাঝেমধ্যে প্রচুর অসহায় বোধ হয় জানেন!”

এতোটুকু বলে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো স্বরূপ পুনরায় বলতে শুরু করলো। নিজের ডান পাশের মেয়েটির দিকে তাকালে হতভম্ব দৃষ্টি দেখা মিলে। স্বরূপ চোখ রাখে সেই টলটলে আঁখি দ্বয়ের দিকে। বলল,
–“এমনতাবস্থায় কাউকে নিজের জড়ানো মানে তার সকল সৌন্দর্য কেড়ে নেয়া, নৈরা। আমার দ্বারা সব সহ্য হবে কিন্তু কারোর সুখ স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করা সহ্য হবে না। আপনি আমার দেখা সবচেয়ে অনন্য একটি সত্ত্বা, নৈরা। ইউ ডিজার্ভ বেটার দ্যান মি। অযথা নিজের অনুভূতি গুলোকে গভীর হতে দেবেন না। কারণ দিন শেষ কষ্টটা আপনার ই বেশি হবে। এটা আমার জন্য কখনো সুখকর হবে না…

–“কেনো হবে না?”,মেয়েটি অশ্রুভরা নয়নে তাকিয়ে শুধায়। স্বরূপ দৃষ্টি রাখে সেই অশ্রুভরা নয়নের দিকে। কিন্তু জবাব দিতে পারলো না। মেয়েটি পুনশ্চঃ শুধায়,
–“কেনো সুখকর হবে না?”

–“কাউকে দু্ঃখের মাঝে দেখা কারোর জন্য সুখকর হয় বুঝি?”, স্বরূপ মৃদু হেসে শুধায়। মেয়েটি নাকোচ করে বলল,
–“যখন কেউ কাউকে ভালোবাসে তখন ই তার কষ্ট দেখতে পারে না।”

–“আমি তো আপনাকে চিনিই না, তবে ভালোবাসা কোত্থেকে আসলো?, স্বরূপ ভ্রু নাচিয়ে শুধায়। মেয়েটি তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
–“তবে আপনি কি করে বুঝলেন আমি রোজ আপনাকে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি? আপনিও নিশ্চয়ই দেখেন? আজ শুক্রবার হওয়া সত্ত্বেও আপনি কেনো এখানে আসলেন? আর আপনি আমার নাম ও জানতেন আগে থেকে।আপনার মনে চোর আছে।”

বুকে হাত গুঁজে থাকা লোকটি মৃদু হাসলো মেয়েটির কথায়। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
–“মাটি খুঁড়ে কেঁচো বের করতে পারবেন না বোকা কাঞ্চনবালা। ব্যর্থ চেষ্টা করা ছেঁড়ে দিন।”

মেয়েটি ছলছলে নয়নে তাকায়। রাগান্বিত স্বরে বলে,
–“আই ডোন্ট ডিজার্ভ বেটার বিকজ আই ডোন্ট নিড বেটার। আপনাকে আমায় নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে না।”

স্বরূপ তখনো হাসলো মেয়েটির রাগান্বিত স্বরে। মেয়েটি যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজের মিছে ভাবনাকে সত্য প্রমাণ করতে। তখন সন্ধ্যা নেমে গিয়েছে। বেঞ্চির দুই ধারে বসা দুই মানব মানবীর অন্তঃস্থলে বিদায়ের সুর বাজলো। এলোমেলো অনুভূতি মিশ্রিত নির্নিমেষ চাহনিতে একবার দেখে নেয় সাফেদ শাড়িতে আবৃত নারীটিকে। পাঞ্জাবি ঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় স্বরূপ। অদূরে ভ্যানে ফুল বিক্রি করতে থাকা লোকটির কাছে হেঁটে যায়। ফিরে আসে দুটো লাল গোলাপ সমেত। নত মস্তকে বসে থাকা মেয়েটির চোখের সামনে অস্তপ্রায় সূর্যের ন্যায় রক্তিম ফুল দু’টো ভেসে উঠতেই সে চোখ তুলে তাকায়। স্বরূপ সেই দৃষ্টির মানে অনুসরণ করে বলল,
–“আপনি সৃষ্টিকর্তার এক নিখুঁত সৃষ্টি, নৈরা। সামান্য একটা ফুল আপনার বাহ্যিক সৌন্দর্যে খুঁত সৃষ্টি করবে এটা বড্ডো বেমানান লাগছিলো। এটা আপানর জন্য! কানের পিঠে গুঁজে নিলে সুন্দর লাগবে। অন্যকিছু ভেবে নিজের কষ্টকে দ্বিগুণ করবেন না। আসছি, নিজের যত্ন নিবেন।”

লোকটি চলে যায় মেয়েটিকে সেই বেঞ্চিতে একা ফেলে। আর মেয়েটি সেদিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হলো যেনো নীড়ছাড়া কোন দুঃখী পাখি সে!

চলবে..