#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৮
বেলা গড়ালো। সূর্যের আলো দিগন্তে মিলিয়ে গিয়ে আধার নামলো। পালাক্রমে জীবন থেকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ লহমা নিঃসঙ্গবিধুর বেদনায় কেটে গেলো। বিগত দুই বছরে, রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত নৈরার কাছে বড্ডো গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। আজ সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানটিতে বেদনারা জায়গা করে নেয়ার দুর্ধর্ষ প্রয়াস চালাচ্ছে। বারান্দার সাফেদ পর্দা ঘেঁষে হাঁটু আঁকড়ে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকা মেয়েটির লালচে আঁখি বেয়ে টপটপ করে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। মানুষটা আজো আসেনি। তাকে শাস্তি দিচ্ছে —না বলা ভালোবাসার শাস্তি।
সদর দরজা থেকে ত্রস্ত পায়ে নুহাশ মাহমুদ আর নোমান ঢুকলো। নোমান বাবার চিন্তিত মুখটি দেখে শুধায়,
–“বাবা, কিছু হয়েছে?”
নুহাশ মাহমুদ হাঁটতে হাঁটতে মিহি স্বরে জবাব দিলেন,
–“তোমার বোন ভালো নেই, সেই দিকে তো কোন খেয়াল নেই তোমার।”
নোমান অবাক হয়ে গেলো। অবাকের সুরে শুধায়,
–“নুরু? নুরুর আবার কি হয়েছে?”
নুহাশ মাহমুদ ক্রুব্ধ হলেন ছেলের এহেন আচরণে। গম্ভীর গলায় বললেন,
–“ভবঘুরে এই জীবন ছাড়ো। দায়িত্বের পরোয়া করতে শিখ, নয়তো জীবন থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সুন্দর সময়গুলো আজীবনের জন্য পিছু ছুটে যাবে।”
বলেই সে গটগট করে উপরে চলে যায়। উপরে যেতেই স্ত্রীর সাথে দেখা হলে সে চিন্তিত কণ্ঠে শুধায়,
–“নৈরা কিছু খেয়েছে?”
মিতা কাঁচুমাচু করে না বোধক মাথা নাড়লো। সে জানে মেয়ের প্রতি তার স্বামী কতোটা সংবেদনশীল! একটু এদিক থেকে সেদিক হলেই পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। নুহাশ মাহমুদ চিবিয়ে চিবিয়ে রুষ্ট কণ্ঠে বলল,
–“সারাজীবন নিজেকে নিয়েই এভাবে ব্যস্ত থাকবে মিতা। কোনদিন তোমার এই ব্যস্ততার কারণেই না এই সংসার নামক ব্যস্ততা তোমার পিছু ছুটে যায়।”
মিতা আশ্চর্য হলো না একটুও বরং সে অভ্যস্ত এহেন আক্রমণাত্মক কথায়। কেননা সুপ্ত এক তীক্ত সত্য হলো নুহাশ মাহমুদ একজন শ্রেষ্ঠ বাবা হলেও স্বামী হিসেবে নিকৃষ্ট। এটা তার ব্যক্তিগত এবং চরম সত্য এক মতামত। সে থমথমে মুখে বলল,
–“আমি অনেকবার নৈরাকে জোর করেছিলাম খাওয়ার জন্য। কিন্তু ও কিছুতেই খেতে চায়নি আর না বিছানা থেকে উঠেছে। পুরোটা দিন শুয়েই ছিল।”
–“মা জোর খাটাবে আর সফল হবে না, এটা আমায় বিশ্বাস করতে বলো? দিনশেষে তোমার মাতৃত্বে প্রশ্ন থেকেই যায় মিতা। যেটা আমার সবথেকে অপছন্দ।”
বলেই নুহাশ মাহমুদ গটগট করে মেয়ের ঘরের দিকে চলে যায়। মিতা শাড়ির আঁচল আঁকড়ে ধরে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শক্ত দৃষ্টিতে নোনাজল স্পষ্ট। মাঝেমধ্যেই নিজের কঠিন এই জীবনের পাতা ঘাঁটলে তার দম বন্ধ হয়ে আসে।
মেয়ের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নুহাশ মাহমুদ জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে চাপিয়ে রাখা দরজায় দু’টো টোকা দিল। নম্র কণ্ঠে ডেকে উঠে বলে,
–” নৈরা? আম্মা? বাবা এসেছি, ভেতরে আসবো?
–“বাবা এসো।”, জড়ানো কণ্ঠটি কর্নকুহরে প্রবেশ করতেই নুহাশ মাহমুদ ঘরে ঢুকলেন। ঘরের চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে এলোমেলো চুলে বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়ের পানে তাকায়। ল্যাম্পের মৃদু আলোয় শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে নৈরা। বাবা’র আগমনেও তার মাঝে কোন বিচলন দেখা গেলো না। নুহাশ মাহমুদ দেখলেন মেয়ের দেবে যাওয়া কালচে চোখের নিচ, দেখলেন ফ্যাকাশে মুখশ্রীর ক্লেশ জর্জরিত মুখটি। সে নিরবে পাশে গিয়ে বসলো। নৈরা বই থেকে চোখ তুলে এক পলক তাকায় বাবার পানে। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে মেয়ের এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে শুধায়,
–“আম্মা, শরীর খারাপ?”
নৈরা ডানে বামে মাথা নাড়লো। মিহি স্বরে জবাব দেয়,
–“মন খারাপ বাবা।”
–“আমার আম্মার মন খারাপের কারণটা কি বাবাকে বলা যাবে?”
নৈরা ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল,
–“বাবা, আমি এতো বোকা কেনো?”
নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে শুধায়,
–“কে বলল আপনি বোকা?”
–“আমি বোকা নাহলে কেউ আমার মনের কথা কিভাবে পড়ে ফেলে?”
নুহাশ মাহমুদ বরাবরের মতো ছোট্ট একটা কারণ ধরে নিলেন মেয়ের এই অবস্থার কারণ হিসেবে। কেননা সে জানে মেয়ে এমনি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে। সে বরাবরের মতো মেয়ের দুশ্চিন্তা গুলোকে উড়িয়ে দিতে বলল,
–“যারা আপনার মনের কথা বুঝে ফেলে তারা মুখ দেখে মন পড়তে পারার মতো বিশেষ ক্ষমতাধর কিছু মানুষ আম্মা। আপনি তাদের বোকা বানিয়ে দিবেন তাদের বলা কথাগুলো কে একদম মিথ্যা বলে দিয়ে। তাহলেই তো হলো, তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে যে তারা হয়তো ভুল ভাবছে।”
নৈরা ঝিমিয়ে পড়া বদন বিচলিত হয়। সে বই রেখে উঠে বসে। চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“সত্যিই বাবা?”
নুহাশ মাহমুদ গুরুতর মুখ বানিয়ে বলল,
–“একদম সত্যি, আম্মা। আপনি তাদের মুখের ওপর বলে দেবেন যে তারা যেটা বলছে মিথ্যা বলছে। তাহলেই তারা বুঝতে পারবে না আপনার মনের কথা।”
নিমিষেই অনুভূতি নিঃশেষের ভয়ে অতল গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া আঁখিদ্বয় আবার রঙিন স্বপ্ন বুনতে শুরু করলো। নুহাশ মাহমুদ এবার আহ্লাদ ছেড়ে খানিক গম্ভীর গলায় বলল,
–“কিন্তু আম্মা, এতো ছোট বিষয় নিয়ে এভাবে নিজেকে কষ্ট দিলে হবে? আপনি খাওয়া দাওয়া করছেন না ঠিকমতো। অনিয়ম করছেন সবকিছুতে, আবার প্রতিদিন এভাবে না খেয়েই বিরাঙ্গনায় চলে যাচ্ছেন। এমনটা কেনো করছেন আম্মা? নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? কেমন লাগছে আপনাকে!”
নৈরা মলিন হেসে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। বড্ডো ছোট কারণ? তবে এই ছোট কারণটি তার উপর এতো প্রভাব ফেলছে কেনো? কেনো লোকটার উপেক্ষা সহ্য করতে পারছে না? কেনো মনে হচ্ছে আর একদিন যদি লোকটার থেকে দূরত্ব বাড়ে তবে তার দম বন্ধ হয়ে আসবে। এটা কি নিতান্তই বহু দিনের অভ্যাসের জোরে—নাকি ইতিমধ্যেই এ জীবনে তার সকল সুখের কারণ লোকটি হয়ে গিয়েছে?
–“চলুন আম্মা, বাবার সাথে খাবেন। আপনার পছন্দের ক্যাশুনাট সালাদ আর চাইনিজ আনিয়েছি। খাবেন চলুন।”
নৈরা অনাগ্রহের সাথে তাকায় বাবার দিকে। দৃষ্টি টলটল করছে। লোকটার থেকে দূরত্ব এতোটা পীড়াদায়ক যে খাবার তার গলা দিয়ে নামে না। মনে হয় এই দূরত্ব বুঝি আর কোনদিন মিটবে না। দুশ্চিন্তায় পুরো দেহ ছেড়ে দেয় নৈরার। নুহাশ মাহমুদ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। নৈরা ছোট বেলা থেকেই এমনি, ছোট ছোট দুশ্চিন্তায় গ্রাস খুব সহজেই বিলীন হয়ে যাওয়া এক দূর্বল সত্ত্বা। এর জন্যই তো তার পুরো পৃথিবীটাকে চিন্তামুক্ত রাখে সে। সে বলল,
–“আম্মা, না খেয়ে থাকলে চিন্তা কমবে না আরো বাড়বে। আমি আপনার একটুও কথা শুনছি না। আসুন বাবার সাথে।”
সে মেয়েকে জোরপূর্বক নিচে নিয়ে নামলো। নোমান পোশাক পরিবর্তন করে নিচে নামছে তার পিছু পিছু নিশুও নামছে। নোমান সোজা বোনের কাছে গেলো। গিয়েই বোনকে একহাতে নিজের সাথে আগলে নেয়। নৈরা মৃদু হেসে ঘাড় তুলে তাকায়। নোমান আজ আর বিরক্ত করে না নৈরাকে। বরং নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“নুরু কি হয়েছে?”
নৈরা ম্লান কণ্ঠে বলল,
–“কিছু না মেজো ভাইজান।”
নোমান বুঝলো বোন অনাদরে তাকে মিথ্যা বলেছে। তবুও সেই মিথ্যাকেই প্রশ্রয় দিয়ে রসিকতার সাথে বলে উঠলো,
–“ওহ্, কিছু হয়নি? তবে একটু নাক মলে দেই নুরু?”
বলেই নোমান দুই আঙুলের নাকল’সের মাঝে নৈরার নাক চেপে ধরল। সহসা মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠলো ভাইজান বলে। বিলম্ব হীন নাকটা লাল হয়ে গেলো নৈরার। সে টলটল করা চোখে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকালো ভাইয়ের দিকে। নোমান গা দুলিয়ে হাসলো। বোনকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলে,
–“নুরু কখনো কোন সমস্যা হলে ভাইজানকে সাথে সাথে বলবি, দেখবি ভাইজান তোর সব সমস্যার সমাধান করে দিবো চুটকিতে। শুধু শুধু একা একা মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘুরবি না।”
নৈরা প্লেট তুলে নিতে নিতে মিহি স্বরে জবাব দেয় ,
–“আমি কোন চিন্তা করছি না, ভাইজান।”
–“কিন্তু আমি তো স্পষ্ট দেখছি তুই মিথ্যা বলছিস।”
নৈরা বিরক্তি নিয়ে তাকায় ভাইয়ের দিকে। খানিক রাগান্বিত স্বরে বলে,
–“তোমরা আমার মন পড়বে না, অসহ্য!”
নোমান গা দুলিয়ে হাসছে। মিতা আর নিরাদের ভাইয়ের স্ত্রী ততক্ষণে খাবার হাতে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়ায়। মিতা মেয়ের কাছে এসে দাঁড়ায়, কাঁধে হাত রেখে শুধায়,
–“আম্মা, শরীর ভালো লাগছে?”
নৈরা মৃদু হেসে বলল,
–“আমি অসুস্থ নই, মাম্মা।”
–“কিন্তু তোমায় সবসময় অসুস্থ লাগে।”
ভাবীর কথায় নৈরা খেতে খেতে হাসলো। বলল,
–“সৃষ্টিকর্তা আমায় এক খোলা চিঠির মতো তৈরি করেছে। যে কেউ বিনা অনুমতিতে পড়ে নেয়—একটুও প্রাইভেসি নেই।”
মেয়ের কথায় সদ্য হাত মুখ ধুয়ে আসা নুহাশ মাহমুদ হেসে বললেন,
–“ভাগ্যিস! নয়তো আমায় বেশ বিপাকে পড়তে আমার অন্তর্মুখী মেয়ের স্বস্তি নিশ্চিত করতে।”
নিরাদ ও ততক্ষণে চলে আসে। নোমান ভাতিজিকে কোলে নিয়ে খাওয়াচ্ছে। বাসায় যতক্ষন থাকবে নিশু তার কাছেই থাকে। নিরাদের স্ত্রী মেহের তিন মাসের গর্ভবতী। নিরাদ ব্যস্ত থাকে, এর জন্যই ভাতিজির খেয়াল যতোটুকু সম্ভব নোমান ই করে। সকলে খেতে বসল। নুহাশ মাহমুদ খেতে খেতে নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
–“তুমি কি কিছু ভাবলে?”
নোমান কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“কি নিয়ে?”
–“আর কতোদিন এমন একা দিন কাটাবে? বয়স হচ্ছে, দায়িত্ব কাঁধে নাও। নয়তো এরপর বয়স পেরিয়ে গেলে আর জীবনসঙ্গী পাওয়া খুঁজে পাবে না।”
নোমান বিরক্ত হলো বহু বছরের ঘ্যানঘ্যানে কথা আবারো শুনে। বরাবরের মতো নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“খারাপ সময়ে যে পাশে থাকে সেই প্রকৃত সঙ্গী। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যেই মানুষটা আমায় বিয়ে করতে রাজি হবে—সেই আমার প্রকৃত সঙ্গী। তাই আমি এতো সহজে বিয়ে করছি না। এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
নুহাশ মাহমুদ অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। মিতাও বেশ অসন্তোষের সাথে বলল,
–“এটা কেমন কথা নোমান? অনেক হয়েছে তোমার এই ভবঘুরে জীবনযাপন। এবার জীবনের একটা গতি করতে হবে। ছোট ভাবির বান্ধবীর একটা মেয়ে আছে। উচ্চশিক্ষিত সুন্দরী, চলাফেরার দিকে থেকে আমাদের বংশের জন্য একদম উপযুক্ত।”, এতোটুকু বলে মিতা থামলো। পরপরই স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি কি বলো? নোমান তো কখনো এই বিষয়ে আগ্রহ দেখাবে না। আমরা-ই দেখেশুনে একটা ভালো মেয়ে নিয়ে আসি।”
নুহাশ মাহমুদ নত মস্তকে খেতে খেতে মাথা নেড়ে সায় জানায়। বলে,
–“দেখো, মেয়ে দেখা শুরু করো।”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখো। দেখেশুনে একটা ভালো মেয়ে বের করো তারপর তোমরাই বিয়ে করে ঘরে তুলো। আমার ঘাড়ে এসব উঠাবে না।”, নোমান বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলল। নৈরা, নিরাদ, নুহাশ মাহমুদ বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার পানে। নোমান রাগে ফোঁস ফোঁস করে খাচ্ছে। এভাবে বিয়ে করা যায় একজন অচেনা মানুষকে? লাইফে কোন আনন্দ থাকবে?
–“তো কি করবে টা কি তুমি? এ জীবনে বিয়ে করবে না।”
–“এ জীবনে এখনো পছন্দ সই মেয়ে পাইনি। পেলে তোমাদের কাছে জিজ্ঞাসা ও করবো না, সোজা গিয়ে তুলে আনবো।”, বলেই নোমান খাবার ছেড়ে উঠে গেলো।
–“বেয়াদব!” , নুহাশ মাহমুদ বিড়বিড় করে বলে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নৈরা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,
–“ভাইজান এমন করে কেনো? একা জীবন যাপন করা যায়? জীবনসঙ্গী ছাড়া একটা সময় একাকীত্বের যন্ত্রনায় ভুগতে হবে।”
নুহাশ মাহমুদ ছেলের কথা ছেড়ে মেয়ের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“তার কথা ছেড়ে দিন আম্মা। দেখতে দেখতে আপনিও কারোর ঘরনী হওয়ার যোগ্য হয়ে গিয়েছেন। আপনি বলুন আপনার জীবনসঙ্গীর ঠিক কেমন হতে হবে?”
বাবার প্রশ্নে মেয়েটিকে একটুও ভাবতে হলো না জবাবটি দিতে। নত মস্তকে খেতে খেতে মিহি স্বরে বলে,
–“একজন নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী সুপুরুষ যে সবসময় আমায় সম্মান করবে, ভালোবাসবে। উল্টেপাল্টে পড়ার জন্য দু’টো শাড়ি, তিনবেলা খাবার জোগাড় করার সামার্থ্য থাকবে, আর সর্বাবস্থায় আমার ঢাল হয়ে থাকবে—এতোটুকু হলেই চলবে।”
নুহাশ মাহমুদ সহ সকলে খাওয়া ছেড়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল নৈরার দিকে। নুহাশ মাহমুদ হালকা কেশে মৃদু হেসে শুধায়,
–“আম্মা, কি আজ কোন উপন্যাস পড়েছেন? মনে হচ্ছে বের হতে পারেননি চরিত্র থেকে এখনো।”
নৈরা খাওয়া থামিয়ে চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। ম্লান হেসে বলে,
–“বিগত দুই বছর যাবৎ এক সাদামাটা উপন্যাসের পাতায় নিজেকে হারাতে চাইছি বাবা। কিন্তু তা ছোঁয়ার অনুমতি আমার নেই। তবে দূর থেকে দেখে উপন্যাসের মাঝে যতোটুকু হারিয়েছে তাতে এ জীবনে হয়তো উপন্যাসের ঐ সাদামাটা চরিত্র থেকে আমার রেহাই নেই।”
নুহাশ মাহমুদ অবুঝপানে তাকায় মেয়ের দিকে ইদানীং মেয়েকে কেমন অন্যরকম লাগছে।
–“সবকিছুর একটা সীমা থাকা দরকার নুরু, এভাবে জীবনযাপন করা হয় না। এতো উদাসীনতা না একদিন তোমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। জীবন, শরীর স্বাস্থ্য, নিজের চাহিদা, চালচলন নিয়ে একটু যত্নবান হও।”, নিরাদ বিতৃষ্ণাভরা কণ্ঠে বলল। বড়ো ভাইজান সর্বদা নৈরার উপর খানিক বিরক্ত থাকে তার জীবনব্যবস্থার কারণে। নৈরা অভ্যস্ত! সে মৃদু হেসে বলল,
–“সামার্থ্য থাকলেই যে চাহিদা দেখাতে হবে কিংবা শো অফ করতে হবে, এটা কি ম্যান্ডাটরি ভাইজান? কতো মানুষ আছে সামার্থ্যের অভাবে একটা ভালো জীবনযাপন কেনো একবেলা মাংস ও খেতে পারে না।”
–“আমার আম্মা আদর্শ গুনে শ্রেষ্ঠ নিরাদ। তাকে নিয়ে এমন অসন্তোষ প্রকাশ করবে না। আমার আম্মার জীবনে কাল আসার আগে তার বাবা’র সম্মুখীন হতে হবে। আম্মা আপনি কোন চিন্তা করবেন না। ভাইজান আপনাকে নিয়ে চিন্তা করে তাই বলে এগুলো।”
নৈরা ম্লান হাসলো। সে জানে তার ভাইজান তাকে কতোটা ভালবাসে। সে সর্বদা চায় তাকে প্রাণবন্ত চঞ্চল আভিজাত্যে মোড়ানো দেখতে। কিন্তু এগুলো যে নৈরার ভালোলাগে না। খাওয়া শেষে নৈরা নিজের ঘরে চলে আসে।
*****
বেশ কয়দিন যাবৎ স্বরূপ অনেক কাজ পাচ্ছে। জবের সময়টুকু বাদে বাদবাকি পুরো সময়টা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে স্বরূপ এটার পেছনছি লেগে আছে। নিশুতি রাত তখন। ঘুমন্ত বুব্বোকে কোলে করে স্বরূপের ঘর থেকে নিজের ঘরে ঢুকলো সাধনা। অতি সাবধানে ছেলেকে শুইয়ে দিয়ে কিয়ৎকাল তাকিয়ে রইল নিষ্পাপ আদলের দিকে। ছেলেটা কতো দূরন্ত। স্বরূপ আর মা না থাকলে কিভাবে সে এই দুষ্টুকে একা হাতে লালন পালন করতো আল্লাহ জানে। সাধনা ধীরস্থির মুখ নামিয়ে ছেলের কপালে চুমু খায়। এমনি সময় ছুঁতে দেয় না। বলে সে বড়ো হয়ে গিয়েছে চুমু খেলে তার লজ্জা লাগে। ছোট্ট ছোট ফর্সা মুখ একদম তার অবিকল হলেও স্বভাব চরিত্র আচরণ একদম বাবার মতো। মানুষটা আজ কেমন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝেমধ্যে তার বুকটা ব্যথায় আঁটকে আসে এ জীবনে সে আর তার ছেলেটা আর কখনো ঐ মানুষটার একটু সান্নিধ্য পাবে না। সৃষ্টিকর্তার কি কঠোর নিয়ম।
ভাবনার মাঝেই নিজের নোকিয়া বাটন ফোনটি তীব্র শব্দ করে বেজে উঠতেই সাধনা দ্রুত ফোন হাতে নিলো। ফোন রিসিভ করতেই চঞ্চল একটি কণ্ঠ ভেসে আসলো।
–“হ্যালো মিস সিনিয়র ম্যাডাম?”
সাধনা কপাল কুঁচকে নিলো অপরিচিত কণ্ঠে। পরপরই অদ্ভুত সম্মোধন তাকে মনে করে দেয়, জীবনের এই যাত্রাকালে একজন অভদ্র মানুষের সাথে তার দেখা হয়েছিল। সে থমথমে মুখে বলল,
–“মিস নয় মিসেস।”
–“ওপস্ স্যরি মিসেস সিনিয়র! আপনি দেখি আমায় চিনে ফেলেছেন? আমি সত্যিই অনেক খুশি হলাম।”, নোমান চঞ্চল কণ্ঠে বলল।
সাধনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“খুশি হওয়ার-ই কথা কেননা আপনার মতো অভদ্র, বেয়াদব লোক আমার জীবনে আর দুটো নেই। তাই আপনাকে না চেনার কোন প্রশ্ন ই আসে না।”
সহসা নোমানের উচ্ছ্বসিত মুখটি নিভে গেলো। সে ফোন কান থেকে দূরে সরিয়ে মুখ বিকৃত করে নিশুর দিকে তাকায়। রেগে বলে,
–“দেখলে দেখলে কি বলল? কথায় কথায় কটুক্তি করে, তেতোমুখি। এর থেকে স্যরি একসেপ্ট করানো এভারেস্ট জয় করার মতো কষ্টসাধ্যের কাজ। আমি নাকি বেয়াদব…
–“কি বললেন?”
পুনশ্চঃ সাধনার কণ্ঠে নোমান হুড়মুড়িয়ে ফোন কানে চাপলো। বিগলিত হেসে বোকাসোকা কণ্ঠে বলল,
–“না মানে বলেছি আপনি একটু বেশি আদব কায়দা ওয়ালী তো তাই সবাইকে বেয়াদব মনে হচ্ছে। কোন ব্যপার না, এমন হয়।”
সাধনার তার কথার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সোজাসাপ্টা শুধায়,
–“আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়? আর এতো রাতে আমায় ফোন কেনো করেছেন?”
নোমান নির্ভিক চিত্তে তৎক্ষণাৎ চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“আপনি আপনার বাড়ির সামনের ফ্লেক্সিলোড এর দোকান থেকে ফোনে টাকা ভরেন। আপনি জানেন আপনার নাম্বার জোগাড় করার জন্য আমায় পাঁচশো টাকা গুনতে হয়েছে। শা”লা ঘুষখোর! একটা স্যরির দাম পাঁচশো টাকা?”
সাধনা দাঁত কিড়মিড় করে উঠলো রাগে। চিবিয়ে চিবিয়ে শুধায়,
–“আপনি আমায় স্টক করছেন? আগে ভাবতাম আপনি বেয়াদব এখন তো দেখছি ভদ্রতার বেশ ধরে থাকা এক ঘুণপোকা।”
নোমান কপাল কুঁচকে তাকায় নিশুর দিকে। অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“ঘুণপোকা কি মিসেস সিনিয়র?”
সাধনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পুনরায় শুধায়,
–“আপনি কেনো ফোন করেছেন?”
–“স্যরি বলতে মিসেস।”, নোমান প্রগাঢ় হেসে বলল।
–“স্যরি নয় বলুন আমার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে। যেটা আপনাদের মতো কিছু পুরুষ বেশ ভালো করে দিতে জানে। আঘাত দেয়া আর সেই আঘাতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করায় আপনারা পটু। এরপর থেকে আমায় ফোন করার আর দুঃসাহস দেখাবেন না।”
বলেই সাধনা খট করে ফোন কেটে দিলো। ফোন হাতে নোমান হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে নিশুর দিকে তাকায়। বলে,
–“দেখলে পরিণাম? এই ভদ্রমহিলা আমার স্যরি তো একসেপ্ট করবেই না বরং প্রত্যেকবার কথায় কথায় বুঝাবে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট পুরুষ!”
নিশু গম্ভীর গলায় বলল,
–“তুমি এতোটুকুতেই হার মেনে নিচ্ছো? নিশু যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ম্যাথ না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত টেবিল থেকে ওঠে না। তুমিও যতক্ষণ পর্যন্ত না নিকৃষ্ট পুরুষ থেকে উত্তম পুরুষ হয়ে উঠছো ততোদিন পর্যন্ত তার পিছু ছাড়বে না। লাগাও আবার ফোন!”
নিশু আদেশের সুরে বলল। নোমান মুখ ভ্যাটকায়ে বলল,
–” আবার ফোন দিয়ে কি বলবো? ভদ্রমহিলা তো কিছু বলার আগেই হয় ক্ষেপে যাবে নয় কেঁদে দেবে। এবং দুটোই বিরক্তিকর। তুমিই বলো আমি কি এমন পাপ করেছি?”
–“কোন পাপ করোনি। সেটা প্রমাণ করতেই তো তোমার আবার ফোন দিতে হবে। দাও ফোন দাও। বলো তুমি খুব স্যরি আর কখনো এমন কাজ করবে না।”
নোমান ফোন দিলো কিন্তু মনে হলো কোন গড়বড় আছে। সে হতবাক হয়ে ফোনের দিকে। অতঃপর বৃহৎ নয়নে তাকালো নিশুর দিকে। বিস্ময় নিয়ে বলল,
–“দেখলে আমায় কিভাবে ব্লক করে দিলো।”
নিশু দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে রাখা আরো দু’টো ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“উফ্ ছোট পাপা! এই নাও। এটা দিয়ে ফোন করো। তবুও হাল ছেড়ো না।”
–“দরকার নেই আমার স্যরির।”, নোমান তেজ দেখিয়ে বলল। নিশু গম্ভীর মুখে বলল,
–“ব্যাড ছোট পাপা! দাদুভাই কি বলে শোননি? কাউকে কখনো কষ্ট দিতে হয় না তাহলে সেই কষ্ট আবার তোমার উপরেই এসে পড়বে। সো, গো এন্ড সে স্যরি।”
–“ওহ্, নিশুপিশু! তুমি বড্ডো জ্বালাচ্ছো।”
নোমান বিরক্ত হয়ে বলল। আবার ফোন লাগায় অন্য নাম্বার দিয়ে। রিসিভ হলো দুই বারের বার। রিসিভ হতেই নোমান হড়বড়িয়ে বলল,
–“দেখুন মিসেস সিনিয়র! আমি না জেনেশুনে রাগের মাথায় অমন কথা বলে ফেলেছিলাম। আমি তো স্যরি বলেছি।”
সাধনা মনে করতে চায় না সেই বিদঘুটে দিনটি। স্বামীর হারা হওয়ার পর কতো নোংরা হাত ধেয়ে আসে তার দিকে। কিন্তু স্বরূপ কখনো একটা স্পর্শ ও লাগতে দেয়নি। কিন্তু সেদিন! বুব্বোর বাবাকে কি জবাব দেবে? সে পরপুরুষের নোংরা ছোঁয়া থেকে নিজেকে হেফাজত করতে পারেনি? টলটলে আঁখি অশ্রু ছেড়ে দিলো। অসহায় চোখে তাকায় বারান্দা ভেদ করে আকাশের পানে। লোকটা দেখছে কি? সে উদাসীন কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“না জেনে কখনো কারোর একরত্তি সম্বলে আঘাত হানা উচিৎ নয়। আমি চরিত্রহীন নই!”
ফোনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। নোমান দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নিশুও তার বুকের উপর শুয়ে পড়ল। বুকে হাত চাপড়ে বলল,
–“হার মানতে নেই। তুমি পারবে।”
নোমান হাসলো। কর্নকুহরে কেমন তিক্ততা সৃষ্টি করলো উদাসীন কণ্ঠটি,
–“আমি চরিত্রহীন নই…..কণ্ঠটি বড্ডো ক্লেশদায়ক শোনালো। নোমানের মনে হলো একটা বিধ্বস্ত মনকে সে হয়তো আরেকটু বিধ্বস্ত করে তুলেছে। অনুশোচনা ক্রমেই বাড়তে লাগলো নোমানের। মনে হলো ধরনীতে কোন একজনের চোখে চোখ রাখতে তার কষ্ট হবে। এটা মানা যায় না। জীবনে যেখানে তার দ্বারা সবাই হেসেছে সেখানে কারোর চোখে তার জন্য ঘৃণা কি করে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেবে?
*****
আর্থিক স্বচ্ছলতা আর সামাজিক অবস্থানের কাছে হেরে গেল কয়েকটা সোনালী কাঞ্চনবেলা। দুটি সাদামাটা বাচনভঙ্গির মানুষকে আর দেখা যায় না স্টিলের বেঞ্চিটির দুই ধারে। দেখা যায় না সাদামাটা পুরুষটির দিকে মেয়েটিকে বারবার আড়চোখে তাকাতে। প্রকৃতিও মনে হয়তো হুটহাট আঁছড়ে পড়া এই বিরহ মেনে নিতে পারলো না। সমীরণে এখন আর বকুল ফুলের সুবাস ভেসে বেড়ায় না। ভেসে বেড়ায় পেট্রোল ডিজিলের পোড়া গন্ধ। সমীরণ ধোঁয়াটে। ঝরে পড়া বাগানবিলাস ফুলগুলোর আর শোভা পায় না এলোমেলো চুলগুলোতে। বিকাল পাঁচটা পনেরো। ব্যাংকের সিঁড়ি বেয়ে দোতালা থেকে নিচে নামছে সারাদিনের কর্মব্যস্ততা কাটিয়ে ওঠা কিছু ক্লান্ত বদন। সহকর্মীদের সাথে কথা বলতে বলতে নামলো স্বরূপ। সহকর্মীদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে অভ্যাস অনুযায়ী আড়চোখে তাকায় স্ট্যান্ডের দিকে। ঠোঁটের কোনা অলস গতিতে বেঁকে গেলো খালি বেঞ্চিটি দেখে। পরপরই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বিরঙ্গনার দিকে। সমস্বরে গান গাইছে ললনারা। বুকভরা নিঃশ্বাস ফেলে স্বরূপ পা বাড়ালো। কেমন অনুভূতি হয় যখন কারোর সকল চঞ্চলতা আর বোকামোর কারণ নিজেকে মনে হয়। কখন সে কারোর কাছে এতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো?
–“স্বরূপ, তোমার তো এখানে দশ মিনিট বসার অভ্যাস। তবে চলে যাচ্ছো যে?
এক সহকর্মীর প্রশ্নে স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। ম্লান হেসে বলল,
–“অভ্যাসে চ্ছেদ ঘটেছে অপূর্ব।”
সহকর্মী তার পদচারণা অনুসরণ করে হাঁটতে হাঁটতে শুধায়,
–“কেনো অভ্যাসে চ্ছেদ ঘটলো কেনো? আজো তো গান হচ্ছে। গান শুনবে না?”
স্বরূপ হাঁটতে হাঁটতে একই রকম শান্ত স্বরে হেসে জবাব দেয়,
–“গায়িকা না থাকলে গান শুনবো কি করে?”
অপূর্ব চকিতে তাকায় স্বরূপের দিকে। কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“তুমি তো চমৎকার ভাবে আমার সব আগ্রহ কেড়ে নিলে, স্বরূপ। তবে গায়িকা রয়েছে এখানে? কাউকে পছন্দ?”
পছন্দ? না পছন্দ তো নয়। এমনিই বলে ফেললো কি-না অসম্ভব এক বাক্য! সে শুধরে বলল,
–“তেমন কিছু না অপূর্ব। আজ সুর ভেতরে প্রশান্তি সৃষ্টি করতে পারছে না। তাই আগ্রহ পাচ্ছি না শোনার।”
অপূর্ব আহত সুরে বলল,
–“আহ্, আমি আরো ভাবলাম ভাবীর হয়তো দেখা পাবো। প্রচুর আশাহত করলে স্বরূপ। কিন্তু তোমার পরিকল্পনা কি? বয়স তো কম হলো না। চেহারায় ভারী ভাব চলে আসছে। বিয়ে করবে কবে?”
স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“এই চ্যাপ্টার মনে হয় আমার লাইফে মিসিং ই থেকে যাবে।”
অপূর্ব ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সিরিয়াস কণ্ঠে শুধায়,
–“এ কেমন কথা! বিয়ে করবে না কোনদিন?”
স্বরূপ হাঁটতে হাঁটতে তখন স্টিলের বেঞ্চিটি পার হচ্ছিল। মানবশূন্য বেঞ্চিটি দেখতে দেখতেই ম্লান হেসে ঠোঁট উল্টে বলল,
–“কাউকে নিখুঁতভাবে জেনে যাওয়ার শাস্তি হিসেবে, আজীবন একাকীত্বে আমার জন্য কখন মঞ্জুর হয়ে গেলো বুঝতেই পারলাম না।”
–“তুমি অনেক ভারী ভারী কথা বলছো স্বরূপ।”
–“বুকটা আসলেই ভারী হয়ে আছে। আমার কথা বাদ দাও, তুমি এই পথে কোথায় যাচ্ছো?”
–“সামনেই কেবলের দোকানে। এডাপ্টর কিনবো একটা। বাবু তার ইঁদুরের মতো দাঁত দিয়ে চার্জারের কেবল ছিঁড়ে ফেলেছে।”
–“ওহ্ আচ্ছা। ছোট সাহেব এতো বড়ো হয়ে গিয়েছে?”
–“হুম, দেড় বছর। তোমার থেকে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে আমি।”, বলেই অপূর্ব হেসে ফেললো। স্বরূপ ও হাসলো। তারা একই বয়সী! তারা কথা বলতে বলতে হাঁটতে লাগলো। স্বরূপ সন্ধ্যা বাজারে যাবে। তবে পিছু ফেরার রেশ যেনো থেকেই যায়। কানে ফোন ঠেকিয়ে ফের আরো একবার পিছু ফিরে তাকালো। নাহ অযাচিত আবদার করার জন্য আজ আর কেউ ছুটতে ছুটতে বিরঙ্গনা থেকে বের হচ্ছে না। অপূর্ব পথ বদলে নিলো। সে একা একা হাঁটতে হাঁটতে মাকে ফোন দিলো। মা রিসিভ করতেই সে শুধায়,
–“আম্মা, কি কি সবজি লাগবে?”
মা জবাবে যা বলছে তা শুনতে শুনতেই হঠাৎ ক্ষিপ্র গতিতে শার্টের আস্তিনে টান পড়লো। স্বরূপের গতিরোধ হলো কেউ পিছু টেনে ধরতেই। সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নিজের বা পাশে। শার্টের আস্তিন আঁকড়ে ধরে হাঁটু আঁকড়ে স্কাই ব্লু রঙা শাড়ি পরিহিতা এক নারী অবয়ব হাঁফাচ্ছে। তার সকল উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে মেয়েটি স্বচ্ছ টলটলে চোখ তুলে তাকায়। অন্তঃস্থল থমকালো। মাঝবরাবর সিঁথি কাঁটা এলোমেলো হাত খোঁপার সাথে হালকা রঙের ঐ শাড়িটি ফ্যাকাসে দেহে মিলেমিশে একাকার। ঠিকযেনো সাদা পবনের মাঝে ফুটে ওঠা এক বিস্তর নীল মেঘ। মুখ সহ গলদেশে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে নীল নীল শিরা উপশিরা গুলো। সে কি অপার সৌন্দর্য! অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে,
–“একটুকরো বরফখন্ড!”
স্বরূপের ধ্যান ভাঙলো উর্দ্ধশ্বাসের আওয়াজে। নারীটি জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে। চোখেমুখে উপচে পড়া রাগ। স্বরূপের দৃষ্টি কৌতুহলী হয়ে পড়লো অনতিবিলম্বে। নৈরা শার্টের আস্তিন ছেড়ে একপ্রকার তেতে উঠলো তার উপর।
–“নিজেকে আপনার কি মনে হয়? বিশ্বের সেরা সুদর্শন পুরুষ? নারীরা আপনাকে দেখলেই পাগল হয়ে যাবে? ভালোবেসে ফেলবে? ভালোবাসা এতো সহজ? আপনি যদি এমনটা ভেবে থাকেন—তবে আপনি ভুল মিঃ স্বরূপ ইব্রাহীম! আমি কি আপনাকে কখনো বলেছি আমি আপনাকে ভালোবাসি? তবে আপনি কি করে বলে দিলেন আমি আপনাকে ভালোবাসি? আমার আপনার প্রতি অনুভূতি রয়েছে? এই নৈরার এতো খারাপ দিন আসেনি যে সে আপনার প্রেমে পড়তে যাবে। বুঝেছেন? আপনি দেখতে মোটেও সুদর্শন না। আপনি দেখতে ঠিক একটা লাউয়ের মতো।”
সহসা স্বরূপের ভ্রু টানটান হয়ে গেলো। সূচালো চোখে তাকায় নারীটির পানে। থমথমে মুখে শুধায়,
–”আমি লাউয়ের মতো দেখতে?”
নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
–“হ্যা, লাউয়ের মতো। শুধু হাতে পায়ে লম্বা কিন্তু খেতে একদম পানসে পানসে, হাদাভোদা। যেমনটা আপনি শুধু দেখতেই সুন্দর কিন্তু ব্যবহার একদম পানসে পানসে। আমি আপনাকে একটুও পছন্দ করি না। আপনি যখন রোজ রাতে ঐ একটা সাদা কালো লুঙ্গি আর কালো টিশার্ট পড়ে রোজ আসেন তখন আমার প্রচুর বিরক্ত লাগে। আর আমি মোটেই আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি না। আপনার বন্ধুদের কার্যকলাপ দেখি। সেদিন শুক্রবার বিরঙ্গনাতেও আমি আসি নিজের জন্য আপনার জন্য নয়। আমি সবজির বাজারে যেতে ভালোবাসি কিন্তু আমার অনুমতি নেই এইসব জায়গায় যাওয়ার, তাই। আর আমি দারোয়ান কাকুর থেকে আপনার নাম্বার নিয়েছি কারণ আমি আপনার সাথে রোজ সবজির বাজারে যাই। যদি হুটহাট কখনো প্রয়োজন পড়ে তাই। এটা নিয়ে অতিরিক্ত ভাবার কিছু নেই। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।”
স্বরূপ চোয়াল শক্ত করে নেয়। শেষের কথাগুলো গায়ে না লাগলেও লাউ নামক তুলনা যে তার বেশ গায়ে লেগেছে। শেষে কি-না একটা লাউয়ের সাথে নিজের তুলনা? সে থমথমে মুখে পুনরায় শুধায়,
–“মাত্র ই বললেন আমি সুন্দর না আবার এখন বলছেন শুধু দেখতেই সুন্দর?”
নৈরা থতমত খেলো। তবুও দমে না গিয়ে বলল,
–“ঐ তো লাউয়ের মতো একটু সতেজ, স্নিগ্ধ দেখতে। এর বেশিকিছু না।”
স্বরূপ ভ্রু উঁচিয়ে নেয় আবার সেই লাউ প্রসঙ্গ টানায়। আবার শুধায়,
–“আপনি মোটেও আমায় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেন না?”
নৈরা সবেগে মাথা নেড়ে নাকোচ করে বলল,
–“নাহ।”
–”তবে কি করে জানলেন আমি রোজ একটি লুঙ্গি আর একটি টিশার্ট ই পড়ি? কোন কালার পড়ি তাও দেখছি মুখস্থ।”
নৈরা এহেন প্রশ্নে গোলগোল নয়নে তাকিয়ে রইল। কি জবাব দেবে এখন? ভাবতে ভাবতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ বেশ দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
–“সার্প ব্রেইন! আমি অনেক সার্প মাইন্ডেড পার্সন। যা একবার দেখি তা আজীবন মনে থাকে।”
স্বরূপ মৃদু হেসে মাথা নেড়ে বলল,
–“ওহ্।”
নৈরা প্রগাঢ় হাসলো নিজের উপস্থিতি বুদ্ধিতে। নিজেকে মনে মনে বাহ্বা দিলো। সে কি সুন্দর চাটুকারিতার সাথে স্বরূপকে বোকা বানালো! সে প্রফুল্ল চিত্তে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“আপনার ভুল ধারণা ভেঙেছে না? তবে চলুন সবজি কিনতে যাই।”
বলেই নৈরা হাঁটতে লাগলো সম্মুখ পথ ধরে। স্বরূপ মেয়েটির গমনের দিকে চেয়ে ফোন পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বিড়বিড় করলো,
–“চতুর কাঞ্চনবালা।”
–“কি হলো আসছেন না কেনো?”, ফের নৈরার কণ্ঠে স্বরূপ পা চালায়। মেয়েটির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মিহি স্বরে শুধায়,
–“আমায় লাউয়ের মতো দেখায়—অথচ পানসে হাদাভোদা লাউয়ের সাথে বাজারে যেতে আপনার কোন সমস্যা নেই?”
নৈরা চকচকে দৃষ্টি ফেলে হাসলো। প্রগলভ কণ্ঠে বলল,
–“লাউ চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করলে একটু খেতে স্বাদ লাগে।”
স্বরূপ ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
–”তো এই চিংড়ি মাছ কোথায়?”
নৈরা প্রফুল্ল হেসে উঠলো নিজেকে দেখিয়ে বলল,
–“এই যে আমি চিংড়ি মাছ। লাউ আর চিংড়িমাছ মিলেমিশে মজাদার খাবার তৈরি হবে।”
স্বরূপ হেসে ফেললো গা দুলিয়ে। চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
–“লাউ আর চিংড়ি মাছ মিলেমিশে একাকার হবে?”
নৈরা অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেয়,
–“হবে আলবত হবে।”
–“কিভাবে?”, কণ্ঠে উপহাসের আভাস পেতেই নৈরা চোখ ছোট ছোট করে তাকালো স্বরূপের দিকে। প্রশ্নের মানে বুঝে উঠতে না পেরে শুধায়,
–“কিভাবে মানে? যেভাবে লাউ আর চিংড়ি একে অপরের সাথে মিলেমিশে…”
বলতে বলতেই মেয়েটি থমকালো। সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সম্মুখে দৃষ্টি রেখে চোখে হাসা চতুর লোকটির দিকে। চোখেমুখে উপচেপড়া হাসি রোধের উজ্জ্বলতা। নৈরার কানদুটো গরম হয়ে উঠলো লাজে। হাত পা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। সে আঁচল আঁকড়ে ধরে ফুটপাত ঘেঁষে চুপটি করে হাঁটতে লাগলো।
হাঁটতে হাঁটতেই স্বরূপ তাকায় শাড়ি পরিহিতা নৈরার দিকে। পরপরই নিজের দিকে তাকায় একদম একই রঙের পোশাক দু’জনের গায়ে। যে কেউ দেখলে নিজ দায়িত্বে বুঝে নেবে তারা যুগল! সে মিহি স্বরে বলল,
–“আপনি এতো দূর হেটে যেতে পারবেন না নৈরা। ফিরে যান।”
নৈরা ফিরে তাকায়, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
–“কে বলেছে পারবো না! একশোবার পারবো। আপনি চিন্তা করবেন না আমার অভ্যাস আছে। ছোটবেলায় আমি দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। খুব ভালো দৌড়াতে পারি আমি সেখানে হাঁটা তো কোন ব্যাপার ই না।”
স্বরূপ পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শুধায়,
–“বিজয়ী হয়েছিলেন? পুরস্কার পেয়েছিলেন?”
সহসা নৈরার মুখটি ছোট হয়ে গেলো। বলল,
–“সবাই আমায় ধাক্কা দিয়ে সামনে দৌড় দিতো। আমি পেরে উঠতাম না তাদের ধাক্কার সাথে।”
স্বরূপ হাসলো সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে। বলল,
–“শাড়ি পড়ে হাঁটা দুস্কর।”
–“আমি পারবো।”, নৈরার দৃঢ় কণ্ঠে স্বরূপ ঘাড় কত করে তাকায়। চোখে তার মায়া! ঠিক আরো একবার মেয়েটির অযাচিত অধিকার গুলোকে অগ্রাধিকার দিলো স্বরূপ। মিহি স্বরে বলল,
–“জোরে হাঁটার কারণে পেছন থেকে শাড়ি উঠে গিয়েছে, পেটিকোট দেখা যাচ্ছে।”
নৈরা ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের পেছনে তাকায়। ঠিক করার জন্য নত হতে গেলে বাধাপ্রাপ্ত হলো। স্বরূপ হাঁটু গেড়ে বসে শাড়িটা টেনেটুনে পেটিকোট ঢেকে দেয়ার ক্ষুদ্র প্রয়াস করলো। নৈরার মুখে ফাসি ফুটে উঠলো। এ যাত্রায় যে বোকা মেয়েটি নিজের চতুরতায় জিতে গিয়েছে। আর হারানোর ভয় নেই। তারা পুনরায় চলতে শুরু করল। দু’জনের দৃষ্টি মিলিয়ে গেলো দিগন্তে। হাঁটতে হাঁটতে বেলা গড়ায়। প্রায় বিশ মিনিট হাঁটার পরে সন্ধ্যা বাজারের দেখা মিললো। রাস্তার ওপারে। এতক্ষণ ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটলেও রাস্তা পার হওয়ায় অনভ্যস্ত নৈরা। স্বরূপ তো একমনে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতেই নিজের পাশ শূন্য মনে হলো। সে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। অদূরে রাস্তার ওপারে নৈরা আঁচল আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে যায়। শুধায়,
–“হাঁটতে পারছেন না? এসে গিয়েছি তো।”
নৈরা মিনমিন করে বলল,
–“আমি একা একা রাস্তা পার হতে পারি না।”
স্বরূপ কিয়ৎকাল দেখলো নত মুখটি। এমনভাবে মুখ ছোট করে আছে যেনো এটা মেয়েটির কোন অপরাধ। সে বিনা শব্দ ব্যয়ে নিজের বা হাতের কনুই এগিয়ে দিলো মেয়েটির দিকে। নৈরা অবুঝ নয়নে তাকায়। স্বরূপ বললো,
–“ধরুন, আমায় অনুসরন করে চললেই পার হতে পারবেন।”
নৈরা হাসিমুখে খপ করে অভ্যাস অনুযায়ী দুই আঙুলে শার্টটি আঁকড়ে ধরতেই স্বরূপ আর্তনাদ করে উঠলো,
–“আহ্..!”
পরপরই চোখমুখ কুঁচকে বলে,
–“মেয়ে, শার্টের আস্তিন ধরতে বলেছি, চিমটি কাটতে বলিনি।”
–“ওহ্ দুঃখিত! দুঃখিত!”, নৈরা হড়বড়িয়ে বলল। তারপর ঠিক করে শার্টের আস্তিনের এক কোনা আঁকড়ে ধরলো। অতঃপর নির্ভয়ে রাস্তা পার হয়ে মেয়েটি সন্ধ্যা বাজারে ঢুকলো। তবে আজ আর কোন সবজি কেনার আবদার জুড়লো না নৈরা্ স্বরূপ যা যা কিনছে তাই চুপটি করে দেখছে মেয়েটি। কিনতে কিনতেই লম্বা দেখতে একটা লাউ হাতে নিয়ে স্বরূপ কপাল কুঁচকে শানিত দৃষ্টিতে তাকালো লাউটির দিকে। মা পই পই করে কচি লাউ নিতে বলেছে। তার মুখ বিকৃত হয়ে গেলো কিয়ৎকাল লাউটির বেশভূষা দেখতেই। সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
–“ডিজগাস্টিং”
বলেই লাউ আবার ঝুড়িতে রেখে দিলো। মনে মনে পন করলো এ জীবনে তার মুখে আর লাউ রুচবে না। নৈরা এতক্ষণ অবুঝ নয়নে দেখছিল লোকটির কর্মকাণ্ড। কারণ বুঝতে পেরে সে ফিক করে হেসে উঠলো। স্বরূপ ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল,
–”উদাহরণ দেয়ার জন্য আমার পছন্দের সবজি টিই আপনি পেয়েছিলেন?”
নৈরা গা দুলিয়ে হেসে উঠলো। স্বরূপ আবার সবজি কিনতে লাগলো। শুরু হয় আর এক অনিশ্চিত যাত্রা যার গন্তব্য আদোতে কোথায় গিয়ে থামবে তা জানে না সুকুমারপ্রবন দুই নর নারী…।
~চলবে~