#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ০৯
শুভ্র বরফখন্ডের ন্যায় মুখশ্রী কুঁচকে গেলো আঘাতপ্রাপ্ত জায়গাটিতে এন্টিসেপ্টিক দ্রবণের সংস্পর্শে আসতেই। তীব্র জ্বলন সহনশীল হতেই নৈরা চোখ খুললো। হাঁটু আঁকড়ে ধরে বসে থাকা শক্ত হাত দুটো শিথিল হয়। মেহের নৈরা’র পায়ের ফাঁটা ফোস্কার উপর থেকে তুলো উঠিয়ে নিলো। ননদের চুপসানো মুখটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে শুধায়,
–“সত্যি করে বলোতো নুরু, এতো হাঁটলে কোথায়?”
নৈরা কাঁচুমাচু করে দৃষ্টি লুকালো। মিনমিনে স্বরে জবাব দেয়,
–“খুব বেশি হাঁটি নি তো। নতুন জুতা ছিল, একটু হাঁটাহাঁটি করতেই ফোস্কা পড়ে গিয়েছে।”
মেহের চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“তুমি আজ যেই জুতাটা পড়েছিলে তা এক মাস আগের কেনা, ননদিনী। হঠাৎ কি এমন হলো যে মিথ্যা বলছো?”
নৈরা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টিতে তাকায় ভাবীর দিকে। বলে,
–“তুমি বারবার জেরা না করলে আমায় মিথ্যা হতো না।”
–“তবে কিছু তো আছে, তাই না? তাই তো বলি, আমাদের বোকা নুরু হঠাৎ এমন চঞ্চল হয়ে পড়লো কেনো?”
–“আবারো প্রেডিক্টেবল কথাবার্তা বলছো।”, নৈরা কপাল কুঁচকে বলল। মেহের হেসে ফেললো। নৈরা’র গাল টেনে দিয়ে বলল,
–“আমাদের নুরু বদলে গিয়েছে দেখছি। ভাবী খুব খুশি নুরু তোমায় চঞ্চল হতে দেখে। কারণটা জানলে আরো খুশি হতাম, তাই খোঁচাচ্ছিলাম। যাক গে তোমার ভাই তোমার জন্য চিন্তা করছে। আমাকে পাঠালো তোমার পায়ে কি সমস্যা হচ্ছে এটা দেখার জন্য। এখন ভাইকে গিয়ে বলো তোমার সমস্যা’র কথা। আমি বলতে গেলে একশো প্রশ্ন করবে পরে তুমিই ফেঁসে যাবে।”
নৈরা ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো ভাবীর কথায়। বলল,
–“আমি কোন অপরাধ করছি না যে তুমি ফেঁসে যাওয়ার কথা বলছো। কোথায় ভাইজান? তাকে পাঠাও আমার কাছে।”
মেহের হেসে বেরিয়ে আসে তার ঘর থেকে। মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে নিরাদ এসে হাজির হয় বোনের ঘরে। বোন অন্তর্মুখী স্বভাবের, একা একা থাকতে পছন্দ করে উপরন্তু বোন প্রাপ্তবয়স্ক। হুটহাট বড়ো ভাই হয়ে এখন অধিকার ফলাতে কেমন ইতস্ততা কাজ করে। কিন্তু অন্তঃস্থলের উচাটন তো আর থামবার নয়। তাই স্ত্রীকে পাঠিয়েছিল। নিরাদ ত্রস্ত পায়ে বোনের ঘরে ঢুকলো। খানিক উদ্বিগ্নতা নিয়ে শুধায়,
–“নুরু পা কি এখন ঠিক আছে? ফোস্কা পড়লো কি করে? তোমার তো হাঁটার প্রয়োজন পড়ে না কখনো?”
নৈরা মিহি স্বরে বলল,
–“গানের চর্চা শেষে বিরঙ্গনার কাছেপিঠে একটু হেঁটে ছিলাম ভাইজান। ভালো লাগছিল। কিন্তু জুতোটা নতুন ছিল, মাত্র বার দুয়েক পড়া। একটু হাঁটতেই ফোস্কা পড়ে গেলো। আমায় একটা ভালো দেখে স্লিপার কিনে দাও ভাইজান। যা পড়ে সারাদিন হাঁটলেও পায়ে ফোস্কা পড়বে না।”
নিরাদ বোনের কথা শুনে নিশ্চিন্ত হলো। নিরুদ্বেগ তাড়া দিয়ে বলল,
–“চলো এখনি জুতা কিনে দিচ্ছি। ভালো দেখে কিনে দেবো।”
নৈরা ঘড়ির দিকে তাকায়। বাজে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। সে বিছানা থেকে নেমে তৈরি হয়ে ভাইয়ের সাথে বের হয়। যাওয়ার আগে হেল্পিং হ্যান্ডদের পই পই করে বলে যায় তার ঘরের পর্দা বদলে ডিপ কালারের পর্দা লাগিয়ে দিতে।
নৈরা নয়টার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসলো। ভাইজান দেখে দেখে তিন জোড়া কম্ফোর্টেবল জুতা কিনে দিয়েছে। নৈরা খুশিতে আটখানা। এখন তার আর হাঁটতে অসুবিধা হবে না। মানুষটার সঙ্গ পেতে বাঁধা হতে দেবে না নিজের দূর্বল এই দেহটিকে ও। নৈরা মাঝেমধ্যে ই ভীষণ হতবাক হয় নিজের কর্মকাণ্ডে। কিভাবে কখন লোকটা তার হাসি খুশি বেঁচে থাকার কারণ হয়ে দাঁড়ালো, সে তো টের ই পেলো না।
আজ সাড়ে নয়টা বাজার আগেই চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চিটি পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো। কফি রঙের পর্দা ঘেঁষে লুকিয়ে বসে থাকা মেয়েটির ঠোঁট ছড়িয়ে যায় কাঙ্খিত মানুষটির দেখা পেতেই। আজ দিনটা ভালো গিয়েছে, রাতটাও লোকটার উদারতায় ভালো কাটবে। বিকালে জোর গলায় বলে এসেছে তার বয়েই গিয়েছে স্বরূপকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে। তার মাঝে দেখার মতো কিছু নেই। তাই তো স্বরূপ আজ এসেছে।
স্বরূপের বন্ধুরা আজ বেজায় বিরক্ত স্বরূপের উপর। তারা সমস্বরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে শুধায়,
–“তুই না বলেছিলি আর কখনো এখানে চা খেতে আসবি না? তবে আজ ঘাড় ধরে এখানে আনলি কেনো?”
স্বরূপ নিরবে চায়ের কাপ হাতে নিলো। বন্ধুদের কথার কোন ভ্রুক্ষেপ তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। আমান আবার শুধায়,
–“কি হলো, কি চিন্তা করছিস এতো?”
স্বরূপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বন্ধুদের পানে তাকায়। শান্ত স্বরে বলল,
–“নৈরা আমায় পছন্দ করে!”
উপস্থিত বন্ধুদের সকলের কপাল কুঁচকে গেলো। আমান, জয় অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“নৈরা? কোন নৈরা?”
পরপরই পাশে থেকে থমকানো একটি আওয়াজ ঠিকরে আসলো।
–“নুহাশ মাহমুদের মেয়ে, নৈরা?”, তপব্রত এর থমকানো কণ্ঠে উপস্থিত সকলে চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে তাকায় স্বরূপের দিকে। পরমুহূর্তটা স্বরূপের জন্য বেশ বিব্রতকর হলো। সে বিরক্তি নিয়ে তাকায় পায়ের কাছে জড়ো হওয়া সবকটা বন্ধুর দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“প্রত্যেকটা এখুনি নিজের জায়গায় যাবি।”
মুনিম, তৈমুর সহ সকলে ঘন ঘন মাথা নেড়ে নাকোচ কররো। বলল,
–“আমরা যাচ্ছি না। তুই আগে বল কেমন কি ভাই? নুহাশ মাহমুদ? শহরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির মেয়ে নাকি আমগো বন্ধুরে পছন্দ করে? তুই নিশ্চিত কোন হোজ্জা! আমায় একটু পানি পড়া দে না ভাই, তাহলে আমিও কারোর উপর ট্রাই করবো।”
তৈমুর বোকাসোকা কণ্ঠে স্বরূপ কটমট করে তাকায়। ধমকে উঠে বলে,
–“সর, এখান থেকে সর। ঠিক করে নিজ জায়গায় গিয়ে বস।”
তারা চুপসানো মুখ নিয়ে নিজেদের জায়গায় গিয়ে বসলো। স্বরূপ ধীরস্থির সব খুলে বলল। সব শুনে তাদের চোয়াল জুড়ে বড়োসড়ো এক হা। তারা অবাক পানে চেয়ে শুধায়,
–“তুই না করে দিয়েছিস? এই তুই পাগল? মেয়ে নিজে থেকে তোকে চায় আর তুই কিনা সামার্থ্যের দোহাই দিয়ে না করে দিয়েছিস? সে যখন তোকে ভালোবাসে তখন সব জেনেই ভালোবাসে।”
স্বরূপ মলিন হাসলো। পাশে লেজ গুটিয়ে বসা কুকুরটির দিকে একটা বিস্কিট এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“আমার সঙ্গ তার সৌন্দর্য চঞ্চলতা, উজ্জ্বল জীবনের গতিবিধি কেড়ে নেবে। সে যেমন জীবনযাপন করে তা দেয়ার সামার্থ্য আমার নেই। এটা জেনেও আমি তাকে নিজের সাথে কি করে জড়াই? সবসময় সবকিছু আমাদের হাতের নাগালে থেকেও থাকে না। আমি চাই না আবেগে পড়ে সে কখনো কোন আফসোস কিংবা আপোষ করুক।”
সকলে বেজায় ক্ষুব্ধ হয় স্বরূপের কথায়। মুনিম পাল্টা রাগ দেখিয়ে বলল,
–“এরকম সামার্থ্য নেই বলে বলে কতোদিন একা থাকবি? এভাবে জীবন চলে? তোর বয়সী সকলের বউ বাচ্চা হয়ে জীবনে অতোটা এগিয়ে গিয়েছে আর তুই এই লোনের চক্করে আগামী আরো তিনটা বছর নষ্ট করবি? ততোদিন কি এই মেয়ে থাকবে তোর অপেক্ষায়?”
স্বরূপ মিহি স্বরে জবাব দিলো,
–“ধরে রেখেছে কে?”
তৈমুর ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো। রেগে বলল,
–“ধরে রাখিস নি তো ঠিক আছে। এই সব ওঠ এখান থেকে। আর চা খেতেই আসবো না।”
বলেই সকলে উঠতে গেলো ওমনি স্বরূপ ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় বন্ধুদের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“একটাও এখান থেকে নড়লে খু/ন করে ফেলবো।”
–“কেনো নড়বো না কেনো? এখানে বসে তোর নাটক দেখবো? বিগত তিন বছর যাবৎ এখানে…
–“চুপ , সবকটা চুপ কর। আমার জীবন আমি বুঝে নেবো। তোদের বলাটাই ভুল হয়েছে।”, স্বরূপ ব্যগ্র কণ্ঠে বলে উঠলো। তার বন্ধুরা ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। তাদের ও ইচ্ছে হয় তাদের এই বন্ধুটাকে একটু নিজের জন্য বাঁচতে দেখতে।
স্বরূপ উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেলে এক পলক তাকায় গাঢ় পর্দায় ঢেকে যাওয়া কারোর লুকোচুরির ভালোবাসা। যেখানে নারীটির এক একটা চাহনি থেকে নড়চড়, কথাবার্তা সবকিছুতে তার প্রতি অগাধ ভালোবাসা প্রকাশ পায়, সেখানে এই পর্দা নিছকই এক সুবেদ্য, দূর্বল পর্দা।
সে মৃদু হেসে পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নেয়। এই যে অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা মনটা খুব করে চায় দায়িত্ব কর্তব্য, চিন্তা বাদ দিয়ে কারোর চোখে নিজের জন্য আবেগ দেখতে। নারীটির বোকামোতে প্রাণ খুলে হাসতে আর হুটহাট প্রচুর উচ্ছ্বসের সাথে তার বোকামো আর মিথ্যা গুলোকে পাকড়াও করতে। হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো স্রোতের সাথে গা ভাসাতে। ইচ্ছে টা কি অপরাধ স্বরূপ? তবে নাহয় একটু অপরাধী হলো! কিন্তু এই অপরাধের শাস্তি যদি মেয়েটিকে পেতে হয়? এহেন শঙ্কা যে অন্তঃস্থল কাঁপিয়ে তোলে।
তবুও একটু সঙ্গ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে কেনো অন্তঃস্থল? সে কি বোঝে না সবার জন্য ভালোবাসা নয়।
বোকা মেয়েটি বিকালে পই পই করে বলে দিয়েছে,
“তার বয়েই গিয়েছে লুঙ্গি টিশার্ট পড়া কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে। সে কাউকে দেখে না। সে যেনো চায়ের দোকানে চা খেতে আসে।”
ডাবল পর্দার আড়ালে গুটিয়ে বসে থাকা নৈরা ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে দেখে চলেছে নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী সুপুরুষটিকে। ইহজাগতিক চিন্তা বিদায় নিয়েছে সে বহুক্ষণ। কিন্তু তার সকল প্রেমময় ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়লো হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠতেই। সে অনাগ্রহে ফোনটা হাতে তুললে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। স্ক্রিনে ভাসছে স্বরূপের নামটি। লোকটি কি তাকে দেখে ফেলেছে? এখন নিশ্চয়ই আর আসবে না চায়ের দোকানে? সে তৎক্ষণাৎ ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললো। হড়বড়িয়ে প্রবল দৃঢ় কণ্ঠে এক বোকাসোকা মিথ্যা কথা বলে উঠলো,
–“দেখুন আপনি যা ভাবছেন ভুল ভাবছেন। আমি মোটেই আপনাকে দেখছি না। আপনার মাঝে দেখার মতো কিছু নেই। আর আমি তো জানিই না আপনি চায়ের দোকানে এসেছেন কি-না।”
কানে ফোন ঠেকিয়ে থাকা উদাসীন চোখমুখ ঠিকরে বেরোচ্ছে চাপা হাসির উজ্জ্বলতা। কারোর বোকামো এতো মোহনীয় কেনো? স্বরূপ নিজের হাসি আটকায়। মিটিমিটি হেসে শান্ত কণ্ঠে বলল,
–“আমি তো আপনাকে এমন কিছু জিজ্ঞেস করিনি নৈরা। আমি তো জানি আমার মাঝে দেখার মতো কিছু নেই।”
নৈরার সকল ভয়, উৎকণ্ঠা ফিকে পড়লো। সে কি আবার বোকা বনে গেলো? লোকটা তার সাথে আবার চতুরতা করলো কি? সে পর্দার আড়ালে একবার দেখে নেয় মাথা নুইয়ে কানে ফোন ঠেকিয়ে কথা বলা লোকটিকে। থমথমে মুখে শুধায়,
–“তবে কিসের জন্য ফোন দিয়েছেন?”
–“রাতের খাবার খেয়েছেন?”,
–“আপনি এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য ফোন দিয়েছেন?”
–“জি, আপনি হয়তো অন্য কিছু ভেবে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন?”, স্বরূপ মিটিমিটি হেসে শুধায়।
নৈরা হড়বড়িয়ে বলল,
–“না না ভয় কেনো পাবো। আপনি বাঘ না ভাল্লুক?”
–“আমি এক সাধারণ মানুষ, নৈরা। এরপরেও আমার কাছে অযথা এক ঝুড়ি মিথ্যা আর বোকামো নিয়ে হাজির হতে হবে কেনো?, স্বরূপ মিহি স্বরে বলল।
অপরপ্রান্ত থেকে থেকে ভেসে আসা ভীত এক কণ্ঠ।
মেয়েটি উদাসীন কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“সত্য বললে যদি দূরে সরে যান।”
–“আমাদের ভবিতব্যে কখনো নৈকট্য তো ছিলই না, নৈরা।”
নৈরার দৃষ্টি ছলছলে। থমথমে মুখে বলে,
–“আপনি সবসময় এতো কঠিন কথা বলবেন না, স্বরূপ। আমি বুঝি না এতো কঠিন কথা।”
–“আপনি বুঝতে চান না নৈরা।”
–“হ্যাঁ, আমি বুঝতে চাই না। তবুও কেনো বলেন।”
–“যেনো দিনশেষে আপনাকে কম কষ্ট পেতে হয়।”
–“আপনাকে আমায় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।”, মেয়েটির কঠোর গলায় অপরপ্রান্ত থেকে নিরবতা ভেসে আসলো। কেউ আর কোন কথা বললো না।
ধীরস্থির নৈরার বোকামো গুলো আস্কারা পেলো। নৈরার বোকামোগুলোকে যত্ন আর সম্মানের সাথে উপভোগ করা স্বরূপের অভ্যাসে পরিণত হতে লাগলো। আর দিনশেষে যার কাছে নিজের সব বোকামোগুলো বিরক্তির জায়গায় সম্মান আর যত্ন পায় তার জন্য মরিয়া হয়ে উঠতে লাগলো নৈরা।
******
স্যরি বা দুঃখিত শব্দটা সবার কাছে সমান মহত্ত্ব পূর্ণ হয় না। বেশিরভাগই নিতান্তই ঠুনকো এক শব্দ বলেই উড়িয়ে দেয়। নোমান ও নিজের সাথে বহু বোঝাপড়া করলো নিজের মনকে এটা মানাতে যে— স্যরি নট আ বিগ ডিল। একটা স্যরি না পেলে কি এমন হবে! কিন্তু তবুও দিনশেষে সে হেরে যায় অন্তঃস্থলে সুপ্ত অনুশোচনার টানাপোড়েনে। দিনশেষে সে যখন চোখ বন্ধ করে তখন ভেসে ওঠে অশ্রুসিক্ত দুটি চোখ। অলস মস্তিস্কে বিদঘুটে অনুভুতি সৃষ্টি করে কর্নকুহরে বাজতে থাকে একটি মাত্র কথা, “আমি চরিত্রহীন নই।” নোমান তখন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। তার জন্য দুঃখিত বলা এবং দুঃখিত গ্রহণ করানো যে ফরজে আইন হয়ে গিয়েছে। কেননা সে করেছে-ই এমন জায়গাটিতে আঘাত। অতঃপর নিজের সাথে বহু বোঝাপড়ায় হেরে গিয়ে নোমান দুঃখিত বলা এবং সেটি গ্রহণ করানোর সিদ্ধান্তে অটল রইলো। যতোই মুশকিল হোক না কেনো! কারোর একরত্তি সম্বলে আঘাত হানা তার কদাপী ঠিক হয়নি।
সপ্তাহ খানিক পরের ঘটনা। চাচা ভাতিজি দিনভর উপায় খুঁজতে খুঁজতে এক বক্স সিম হাতে বসে ছিল বারান্দায়। ভদ্রমহিলা তাদের কোন ফোন ই রিসিভ করে না। নিরুপায়ন্তর তারা অন্য উপায় খোঁজার চেষ্টায় পরদিন বিকালে সাউথসেন্টার রোডে হাজির হলো।
বুব্বোর জ্বর কমেছে। তার দূরন্তপনা আবার শুরু হয়েছে। চারটা বাজতেই ব্যাট বল নিয়ে হাজির মাঠে। মাঠের একপ্রান্তে তখন রাজমিস্ত্রী রা দূর্ভেদ্য দেয়াল গড়তে ব্যস্ত।
মাঠের এক কিনারায় আজ গোল মিটিং বসেছে। গোল মিটিং এর মুখ্য ব্যক্তি হলো বিভোর। তবে তার মুখখানি ঢাকা পড়েছে গাম্ভীর্যের আড়ালে। নিশু নোমান, শাফাক রিদওয়ান পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে বাচ্চাটির প্রতিক্রিয়া। সব শুনে বুব্বো নিরবতা ভেঙে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
–“তুমি আমার মাম্মাকে কষ্ট দিয়েছো কেনো?”
সহসা নোমান ভদ্র ছেলের মতো নিশুকে কোল থেকে নামিয়ে দু’হাতে কান ধরে বসল। ছোট ছোট অনাহারীর ন্যায় মুখ বানিয়ে বলল,
–“স্যরি ক্যাপ্টেন! না বুঝে কষ্ট দিয়েছি। আর কখনো এমন হবে না। তুমিই বলো স্যরি বলার পর আর কোন কথা থাকে? ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। আমি তো স্যরি বলছি।”
বুব্বো নরম হলো। গম্ভীর গলায় বলল,
–“আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোমার স্যরি গ্রহণ করছি। কিন্তু তোমায় মাম্মার কাছেও স্যরি বলতে হবে। আর তার মুখে হাসি ফোটাতে হবে।”
–“এ অসম্ভব! তোমার তেতোমুখি মা হাসতেই জানে না। জানে শুধু কাঁদতে আর রাগ দেখাতে।”, নোমান ফট করে বলে ফেললো। নিশু চোখ বড়বড় করে তাকায় চাচার দিকে। রিদওয়ান আর শাফাক ও ডানে বামে মাথা নাড়লো। নোমান তৎক্ষণাৎ জিভে কামড় দিয়ে একগাল হেসে বলল,
–“না মানে বলছিলাম যে তোমার মাম্মা তো খুব রাগী, তাই। তার মুখে হাসি ফোটনো তো কষ্টসাধ্য!”
বুব্বো সরু চোখে তাকিয়ে বলল,
–“না, মাম্মা রাগী নয়। মাম্মা সুইট। তাকে কাছে গুড বয় হয়ে থাকলেই সে আমাকে ভালোবাসে। তুমিও যদি গুড বয় থাকো তবে তোমায় ও ভালোবাসবে।
পরিপ্রেক্ষিতে নোমান আলাভোলা হাসলো। বলল,
–“আমার ভালোবাসা চাই না তো, ক্ষমা দিলেই হবে।”
বিভোর আবার মাথা নেড়ে বলল,
–“হ্যাঁ, গুড বয় হয়ে থাকলেই, মাম্মা তোমায় ক্ষমা করে দেবে।
নোমান তৎক্ষণাৎ ঘাড় নেড়ে সায় জানায়। বলল,
–“আমি তো গুড বয় ই।”
নিশু ততক্ষণে চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“এই যে ছোট ক্রিকেটার এখন তুমি একটু বলো তো, তোমার মাম্মা কি করলে আমার ছোট পাপার স্যরি একসেপ্ট করে নেবে?”
বিভোর কিছুক্ষণ ভাবলো। অতঃপর অবুঝ কণ্ঠে বলল,
–“আমি যখন কোন ভুল করি তখন মাম্মা যদি খুব রাগ করে আমার উপর, তখন আমি মাম্মাকে চুমু দেই। আর তাতেই মাম্মার রাগ গলে যায় আর আমার স্যরি একসেপ্ট করে নেয়।”
সহসা হাঁটু ভাঁজ করে বসা নোমান বড়ো বড়ো নেত্রে খুক খুক করে কেঁশে উঠলো। নিশু’র বুদ্ধি যেনো এতক্ষণে খুললো। সে চকিতে চাচার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এটার কথা। ছোট ক্রিকেটার ঠিক বলেছে ছোট পাপা! আদর করে দিলে সবার রাগ গলে যায়। তুমিও গিয়ে আন্টিকে চুমু দেবে তাহলেই দেখবে…”
নিশুর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নোমান লাফিয়ে পড়ে তার মুখ চেপে ধরলো। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
–“নিশুপিশু চুপ চুপ! একটা মাত্র চাচার চল্লিশা না খেতে চাইলে মুখ বন্ধ করো।”
রিদওয়ান আর শাফাক হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। নিশু বিরক্ত হয়ে চাচার হাত সরিয়ে ফেললো। একরাশ হতাশা নিয়ে তারা আবার খেলতে শুরু করলো। খেলতে খেলতেও বহু আলোচনা করলো তারা। কিন্তু কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না তারা। নোমান তখন ব্যাটিং করছে আর শাফাক বল। নোমান মেজাজ দেখিয়ে বলল,
–“আরে লাগবেই না আমার কোন স্যরি বলা। গোটা পৃথিবীতে একজন আমায় খারাপ বললেই তো আর আমি খারাপ হয়ে গেলাম না!”
কথাটি নিশু, বুব্বো, শাফাক, রিদওয়ান একজনের ও পছন্দ হলো না। তারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“না তুমি কাউকে বিনা দোষে কষ্ট দিতে পারো না।”
শাফাক রিদওয়ান ও বলে উঠলো,
–“না জেনে কাউকে চরিত্রহীন বলাটা একদমই ঠিক নয়, নোমান।”
–“আরে হয়েছে আমি পাপী, এখন শান্তি?
চরম বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলতে বলতেই নিজের সর্বোচ্চ শক্তি গিয়ে পড়লো ঐ একরত্তি বলের উপর। বাচ্চারা ছক্কা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। নোমান মেজাজ খারাপ করে ব্যাটটা ছুঁড়ে মারতেই কাঁচ ভাঙার আওয়াজে সে চমকে উঠলো। চমকে উঠলো বুব্বো ও। সে থমকানো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“আরে আমার ঘর!”
নোমান চমকে বুব্বোর দিকে তাকায়। ঘর? আবার কি করলো সে? সে চকিতে তাকায় বুব্বোর দৃষ্টি অনুসরণ করে। মাঠ সংলগ্ন ছয় তলা দালানটির তিনতলার একটি জানালার কাচ ভেঙে বলটি ঢুকে গিয়েছে। শাফাক রিদওয়ান নোমান শুকনো ঢোক গিলে সমস্বরে শুধায়,
–“ক্যাপ্টেন, ওটা তোমার ঘর?”
বিভোর বিবর্ণ মুখে চেয়ে মাথা নেড়ে সায় জানায়। বলে,
–“তুমি এটা কি করলে? আমার মামুর ঘরের জানালা ভেঙে দিলে? তুমি জানো ঐ বাড়িটা আমার মাম্মার জন্য কতো কাছের?”
নোমানের চেহারা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। সে মেকি কান্না জুড়ে নিশুর দিকে তাকায়। ক্যানক্যানে সুরে বলে ওঠে,
–“নিশুপিশু রে আমার স্যরির মায়ের বাপ হয়ে গিয়েছে!”
নিশু ডানে বামে মাথা নেড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে। ততক্ষণে ভাঙা জানালা ভেদ করে বিবর্ণ, রণমূর্তীর ন্যায় একটি মুখ ভেসে উঠলো। নোমান তৎক্ষণাৎ কাঁদো কাঁদো চেহারায় দু’হাতে কান ধরে দাঁড়িয়ে যায়।
জীবনের এই পর্যায়ে এসে মা ভাইয়ের সংসারের সকল সমস্যা, দারিদ্রতার মূল সাধনা নিজেকে ভাবে। ভাইয়ের কষ্টের উপার্জনের একটা কিছু কখনো বিফলে যেতে দেয় না সে। ছোট ছোট জিনিসগুলো ও সে যত্ন করে রাখে। তন্মধ্যে এই বাড়িটা সবচেয়ে মূল্যবান তার কাছে। এই বাড়িটার জন্য-ই তো তার ভাইটা দিনরাত এতো পরিশ্রম করছে। সে ছলছল নয়নে ভাঙা কাঁচটির দিকে তাকায়। পরপরই চোয়াল শক্ত করে তাকায় মাঠের দিকে। বাচ্চারা ইতিমধ্যেই ছুটে পালিয়েছে। মাঠে তখন শুধু নোমান, শাফাক, রিদওয়ান বিভোর আর নিশু দাঁড়িয়ে। নিশু জড়োসড়ো অবস্থায় চাচার পা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাধনা মিনিটের মাঝে নিচে নেমে আসে। সকল ক্লেশ, রাগে উৎখাত করে ক্ষিপ্ত স্বরে বলে ওঠে,
–“এটা আপনি করেছেন? আপনাদের কাছে কি কোন কিছুর মূল্য নেই হ্যাঁ? এতো বেয়াদব, উচ্ছন্নে যাওয়া পুরুষ মানুষ কি করে হতে পারে? মানুষের মন হোক কিংবা কারোর কষ্টের অর্জন হোক তাতে আঘাত হানতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা কাজ করে না আপনার তাই না?আপনাকে দেখতেই বিত্তশালী পরিবারের মনে হয়, তাই বলে কি এভাবে বেপরোয়া চলাফেরা করবেন? মানুষের মন নয় অন্তত তাদের কষ্টের অর্জনের তো একটু গুরুত্ব দিতে শিখুন। ঐ যে জানালাটুকু ভাঙলেন না ওটা শুধু আমাদের ঘর নয় আমাদের পুরো পৃথিবী। এটা ব্যতীত আমাদের আর ঠাই গোঁজার জায়গা নেই।”
তাকে দেখতেই নোমান ভেজা বিড়ালের ন্যায় কান ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়ে। সাধনা থামতেই সে বোকাসোকা হেসে বলল,
–“হয়েছে ম্যাডাম? এখন আমি একটু বলি? আপনি যতো খারাপ আমায় ভাবেন আমি অতো খারাপ নই শুধু পরিস্থিতি আমায় খারাপ বানাচ্ছে। আমি একদমই ইচ্ছে করে করিনি ওটা। জোরে ব্যাটিং করতে গিয়ে এমনটা হয়েছে। আমি দুঃখিত! আমি আপনার কাঁচ এখুনি ঠিক করিয়ে দিচ্ছি।”
সাধনা চোয়াল শক্ত করে শুনলো নোমানের কথা। অতঃপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“সন্ধ্যার আগে আমার ঘরের কাঁচ ঠিক করে দেবেন।”
নোমান যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। বলল,
–“সন্ধ্যা নয় আমি পনেরো মিনিটের মাঝে আপনার কাঁচ ঠিক করিয়ে দিচ্ছি। ধন্যবাদ ম্যাডাম। আপনি নিশ্চয়ই আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন? কান থেকে হাত নামাই?”
–“ক্ষমা আদোতে আপনার জন্য কোন গুরুত্ব বহন করে? আমার মতো থার্ড ক্লাস মহিলা আপনার মতো উঁচু বংশের লোককে ক্ষমা করার অধিকার রাখে না-কি? দয়াকরে এইসব নাটক করবেন না আমার সামনে। বুব্বো ঘরে এসো, আর কখনো যেনো তোমায় এখানে খেলতে না দেখি।”
সাধনা কঠোর গলায় বললো কথাগুলো। অতঃপর বুব্বোর হাত ধরে গটগট করে চলে যায়। নোমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে কাউকে ফোন লাগায়। রিসিভ হতেই সে বিগড়ে যাওয়া মেজাজে বলে ওঠে,
–“মোস্তাকিম চাচা, আভার আত্মার মাগফেরাত কামনা না করলে দশ মিনিটের মধ্যে সাউথ সেন্টার রোডে হাজির হও তোমার যন্ত্রপাতি নিয়ে।”
ভাগ্নের এমন কথায় লোকটা দশ মিনিটের মাথাতেই হাজির সাউথ সেন্টার রোডে। নির্দিষ্ট জানালাটিতে কাঁচ লাগানো শেষ হতেই, দরজায় দাঁড়ানো নোমান উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সাধনাকে খুঁজলো। মোস্তাকিম চাচা বেরিয়ে আসে সাধনাদের ঘর থেকে। তার পিছু পিছু সাধনাও আসতেই নোমান বিগলিত হেসে বলে,
–“শুধু শুধুই হাইপার হয়ে যান ম্যাডাম। দেখেছেন ত্রিশ মিনিটের মাঝে আপনার জানালা ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
সাধনা নিরুত্তর দরজা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে। থমথমে মুখে বলে,
–“আপনার প্রয়োজন শেষ। এখন সরুন, দরজা আটকাবো।”
নোমান মুখ বিকৃত করে তাকায় ভাতিজির দিকে। কি ঝাঁঝ মহিলার কণ্ঠে। তার যেনো বয়েই গিয়েছে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। নেহাৎ ই আজ সে পরিস্থিতির স্বীকার। সে নিজের রাগ লুকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুনিতা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে ওঠে,
–“এ কেমন আচরণ সাধনা? ছেলেটা ইচ্ছে করে তো আর করেনি। তবুও নিজে থেকে জানালা ঠিক করে দিয়েছে না? তুই এমন ব্যবহার করছিস কেনো?”
পরপরই নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
–“বাবা তুমি ভেতরে এসে বসো, এক গ্লাস শরবত খাও।”
নোমান একগাল হাসলো, বলল,
–“বাহ্, আন্টি আপনি কি সুইট। আপনার সুইটনেসের এক আনা একটু আপনার মেয়ের মধ্যে থাকলেও আজ আমায় তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়তে হতো না। শরবত দেয়া লাগবে না আন্টি এক গ্লাস পানি দিলেই হবে।”
–“আহারে, এই সাধনা ছেলেটাকে এক গ্লাস পানি দে। দিনদিন তুই বুদ্ধিহীন হয়ে পড়ছিস দেখছি।”
সাধনা দাঁতে দাঁত চেপে কড়া চোখে তাকালো নোমানের দিকে। ধুপধাপ পা ফেলে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসে। সেটি নোমানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
–“এটা পান করে বিদায় হন।”
নোমান পানিটা নিলো। তবে এটা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়। তার তৃষ্ণা পায় নি। সে আবার অনুশোচনা নিয়ে বলল,
–“সেদিনকার জন্য দুঃখিত। আমি ইচ্ছে করে বলিনি। রাগের মাথায় বলে ফেলেছি।”
সাধনা সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না দেখিয়ে শুধায়,
–“আপনার তৃষ্ণা পায়নি?”
নোমান ডানে বামে মাথা নাড়লো। সাধনা থমথমে মুখে তার থেকে গ্লাসটা ছিনিয়ে নিয়ে মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। নোমান রাগে গজগজ করতে করতে নিচে নেমে আসলো। দরজা আটকাতেই বুব্বোর ছোট মুখটি ভেসে উঠলো। সে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“বন্ধু খুব ভালো। তাকে তাড়িয়ে দিলে কেনো? সে সত্যিই তোমার কছে স্যরি বলতে এসেছিল।”
সাধনা গম্ভীর গলায় শুধায়,
–“তুমি ওনাকে চেনো কিভাবে?”
–“সে আমার বন্ধু হয়।”
–“এরপর থেকে তোমার যেনো আর তার সাথে না দেখি।”
বিভোর চুপটি করে শুনলো। অতঃপর বলল,
–“বন্ধু খারাপ নয়। সে খুব ভালো। আর তুমিই তো বলো স্যরি বললে ক্ষমা করে দেয়া উচিৎ। তবে তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছো না কেনো?”
–“কারণ তার কাছে এই ক্ষমার কোন মূল্য ই নেই। এটাও তার জন্য একটা ছেলেখেলা।”, বলেই সাধনা ঘরে চলে যায়।
*****
দিনগুলো সেভাবেই অতিবাহিত হয়। তবে সাধনার মনে নোমানের প্রতি জন্মানো বিতৃষ্ণা , বিরূপ মনোভাব নোমানের প্রচেষ্টারা ধীরস্থির কাটাতে সক্ষম হয়। গতকালকের বিব্রতকর এক ঘটনা সাধনাকে মানতে বাধ্য করায় যে, কারোর মধ্যে সত্যিই অনুশোচনা তীব্রতর।
এক গুচ্ছ সারা গোলাপের মাঝে ছোট্ট একটা চিরকুট।
যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
–“এই ফুলগুলোর শুভ্র স্নিগ্ধতার ন্যায় আপনার পবিত্রতায় প্রশ্ন তোলার জন্য প্রতিনিয়ত অনুশোচনা গ্রাস করে চলেছে। যেই ক্ষমা আপনার কাছে ছেলেখেলা সেটা আমার এই মুহুর্তে আমার সকল চাওয়ার উর্ধ্বে গিয়ে, একমাত্র চাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুঃখিত!”
শব্দকরে চিরকুটটি পড়ে নিজেই খানিক বিব্রত হলো স্বরূপ। কোনাচোখে বড়ো বোনের দিকে তাকালে আরেকটি বিব্রতকর চেহারা ভেসে উঠলো অক্ষিপটে। বিব্রতকর পরিস্থিতিটি এড়াতেই সে নিরুদ্বেগ ফুলের তোড়াটি বোনের হাতে দিয়ে দিলো। মিহি স্বরে বলল,
–“তোর মনে হয়।”
সাধনা অপ্রস্তুত আমতা আমতা কর বলল,
–“আমার…মানে তুই যেমনটা ভাবছিস…”
–“আমি কিছুই ভাবছি ন আপা। এটা একটা স্যরি নোট ছিল।”, বলেই স্বরূপ নিজের ঘরে চলে যায়। সাধনা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল ফুলের তোড়াটি হাতে। সে ভাবতে পারেনি ঐ অভদ্র লোকের জন্য একটা ক্ষমা এতোটা গুরুত্বপূর্ণ কিছু হবে। এমনটা করবে বুঝলে আগেই ক্ষমা করে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে দিতো।
সে দ্রুতপায়ে নিজের ঘরে গেলো। তোড়াটা রেখে ফোন হাতে বারান্দায় যেতেই, ল্যাম্পপোস্টের আবছা আলোয় কারোর সুগঠিত অবয়ব দেখতে পেলো। সাধনা কপাল কুঁচকে নেয় নোমানকে দেখে। হাতের ফোনটি বেজে উঠতেই বিলম্বহীন কনে ঠেকায়। তিরিক্ষি মেজাজে শুধায়,
–”আপনি এটা কি করলেন?”
–“কি করেছি? ক্ষমা চেয়েছি।”
–“আপনার কাছে একটা ক্ষমা এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি এভাবে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে আমার পেছনে পড়েছেন? নাকি অন্য কোন মতলব? আজ এভাবে ফুল পাঠিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কি মানে? আপনি জানেন আপনার কারণে আমার পরিবারের কছে আমায় কিভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে?”
নোমান আলাভোলা দৃষ্টি ফেললো। বারান্দার দরজার ওপাশ থেকে বের হয়ে থাকা ছোট্ট মাথাটির দিকে বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টিতে তাকায়। এই ফুল পাঠানোর বুদ্ধি তার নয় বিভোরের। তার মায়ের নাকি ফুল খুব পছন্দ। ফুল দিলেই তার রাগ গলে যাবে। নিশুপিশু সহ রিদওয়ান শাফাক ও সায় জানায় এই বুদ্ধিতে। তাই তো এই অকাজ করলো এখন কি হবে?
নোমান কথা টালার চেষ্টা করলো। বলল,
–“আপনার কেনো মনে হলো স্যরি আমার জন্য ছেলেখেলা? আপনারা থেকে ক্ষমা পাওয়া আমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ আমার দ্বারা কেউ কখনো কষ্ট পায়নি আপনি ব্যতীত। অন্যকিছু ভেবে ভুল করবেন না। আমার মতিভ্রষ্ট হয়েছে নাকি যে পড়াচোর, বেয়াদব আমি নিজের জীবনে যেচে শিক্ষিকা আনতে চাইবো? যে কি-না পদে পদে শুধু আদব কায়দা শেখায়? আমি এতোটাও বোকা নই, আমি শুনেছি মেয়েরা ফুল পাঠালে সব ভুলে যায়। এর জন্যই এই ফুল পাঠালাম।”
–“আগে মেয়ে আর মহিলার মধ্যে পার্থক্য শিখুন। আমি কোন নিব্বি নই যে ফুল দেখে গলে যাবো।”
নোমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অনুনয় করে বলল,
–“আচ্ছা ম্যডাম, আমার ভুল হয়েছে। আর কখনো ফুল পাঠাবো না। আমি আজো পাঠাতাম না যদি আপনি ক্ষমা করে দিতেন। দিন না ক্ষমা করে। ছোটরা ভুল করবে আর বড়োরা ক্ষমা করবে এটাই তো নিয়ম বলুন?”
সাধনা থমথমে মুখে তাকিয়ে রইল। কিয়ৎকাল বাদ বলল,
–“ক্ষমা করে দিয়েছি। এরপর থেকে যেনো আপনাকে আর আমায় বিরক্ত করতে না দেখি।”
নোমান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেলো। মাথার উপর থেকে বোঝা নেমে যেতেই, সে আনন্দে হৈ হৈ করে উঠে বলল,
–“আপনি অনেক সুইট, ম্যাডাম! ধন্যবাদ আমার স্যরি গ্রহণ করার জন্য। আর কখনো আপনাকে বিরক্ত করবো না আসি। ভালো থাকবেন।”
বলার সাথে সাথেই অপরপ্রান্তে থেকে ফোনটা টুট টুট শব্দ করে কেটে গেলো। নোমান কান থেকে ফোন নামিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলল,
–“সুইট না কচু! তেতোমুখী সিনিয়র!”
মা ঘরে ফিরতে দেখেই বিভোর এক ছুটে গিয়ে বিছানায় বসলো। ভদ্র বাচ্চার মতো বই পড়তে শুরু করলো। সাধনা ছেলেকে পড়তে দিয়ে তারপর জন্য খাবার আনতে গেলো। মা বের হতেই বিভোর আবার ছুটে যায় বারান্দায়। এক গাল হেসে নোমানের দিকে তাকায়। অতঃপর দু’জনে উড়ন্ত হাই ফাইভ দিলো তেতোমুখীর থেকে স্যরি একসেপ্ট করানোর উল্লাসে।
*****
প্রকৃতি যেনো বরাবরই প্রেমের বাহক! কপোক গাছের ঠুনকো ডালে এঁটে থাকা সাদা সাদা শিমুল তুলাগুলো সমীরণের শক্তিশালী ঝাপটায় উড়ে বেড়াচ্ছে দিগ্বিদিক। ব্যাংকের সিঁড়ি থেকে নামতেই স্বরূপের দৃষ্টি আঁটকে যায় রাস্তার ঠিক ওপারে কপোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা শাড়ি পরিহিতা নারীর দিকে। সে কি অপার স্নিগ্ধ দৃশ্য! যেনো তুষার রাজ্যের পড়ন্ত তুষারের মাঝে সেজে আছে এক শুভ্র পরী। শীতলতায় যার চোখেমুখে নীলচে শিরা উপশিরা জেগে বসে আছে। নিজের গায়ের সাদা শার্টটির দিকে এক পলক তাকিয়ে স্বরূপ মৃদু হাসলো। একটা মানুষ কতোটা আবেগী হলে কারোর দারিদ্রতাও সানন্দে আগলে নেয়? ভেবে পায় না স্বরূপ! তবে এতোটুকু জানে এ যাত্রায় চমৎকার ব্যক্তিত্বধারী মূল্যবান এক রত্নের সাথে তার দেখা হয়েছে। যার মূল্য দেয়ার সামার্থ্য তার নেই। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় স্টিলের বেঞ্চি পেরিয়ে রাস্তার ঠিক ওপারে নারীটির কাছে। নৈরা ডাগর ডাগর নেত্র মেলে চঞ্চল চোখে দেখছে লোকটিকে। প্রিয় মানুষটির থেকে সৌন্দর্যের প্রশংসা সকলের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থাকে। নৈরার ও আছে। স্বরূপ কখনো তার সৌন্দর্য নিয়ে কখনো কোন কিছু বলেনি। কিন্তু যেদিন সে প্রথমবার শাড়ি পড়ে সেদিন করেছিল। এরপর থেকে শাড়ি গা থেকে সরানোর ভাবনাও নৈরা কখনো আনেনি। বরং প্রতিদিন স্বরূপের সাথে মিলিয়ে মিলিয়ে ঐ সাদা আর স্কাই ব্লু রঙা শাড়ি দুটোই উল্টেপাল্টে পড়ে।
পাশে দাঁড়িয়ে শ্বাস ফেলা স্বরূপ তাকায় ভাবুক সেই চঞ্চল দৃষ্টির দিকে। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধায়,
–“আপনি কি দেখছেন নৈরা অদ্ভুত ভাবে আমাদের পোশাকের রঙ প্রতিদিন কিভাবে যেনো মিলে যায়?
নৈরা কপাল কুঁচকে নেয় স্বরূপের কথায়। লোকটা আবার তার সাথে কোন চতুরতা করছে? সে থমথমে মুখে বলল,
–“তাতে কি হয়েছে?”
স্বরূপ মাথা নেড়ে বলল,
–“নাহ্, কিছু হয়নি। এটা নিশ্চয়ই কাকতালীয়?”
নৈরা বিনা দ্বিরুক্তিতে বলল,
–“হু এটা কাকতালীয়, একদম কাকতালীয়।”
স্বরূপ মৃদু হেসে বলে,
–“ওহ্, আমি না একটা নতুন শার্ট কিনেছি। ভীষণ সুন্দর!”
নৈরার নেত্রদ্বয় বড়ো বড়ো হয়ে গেলো। উৎকণ্ঠা নিয়ে হড়বড়িয়ে শুধায়,
–“কবে? কি রঙের, কি রঙের?”
স্বরূপ মিটিমিটি হেসে বলল,
–“বলবো কেনো?”
নৈরা তেতে উঠলো।
–“বলবেন না মানে? নির্দয় লোক, বলুন।”
স্বরূপ হাসতে হাসতে পা বাড়ায়। বলে,
–“ তারপর সেটার রঙ ও কাকতালীয় ভাবে আপনার সাথে মিলে যাবে, তাই না?”
–“গেলে যাবে তাতে আপনার কি?”, নৈরা লোকটার পাছে চলতে চলতে বলল।
–“বলুন না।”, নৈরা পাছে ছুটতে ছুটতে বলল। স্বরূপ হাসি থামিয়ে মেয়েটির দিকে তাকায়। রাস্তা পার হতে হবে। সে রোজকার মতো কনুই এগিয়ে দিলো। তবে আজ আর নৈরা আঁকড়ে ধরলো না শার্টের আস্তিন। বরং জেদি কণ্ঠে শুধায়,
–“কোন রঙের কিনেছেন? বলুন।”
স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“কিনি নি, মজা করেছিলাম। পকেট শূণ্য, এই দেখুন।”
স্বরূপ পকেট ফাঁক করে দেখিয়ে বলল। নৈরা আশ্বস্ত হলো পর দুই আঙুলে আঁকড়ে ধরলো শার্টের আস্তিন। বড্ডো নির্ভীকতার সাথে প্রতিদিন এভাবেই সে দ্রুতগামী যানবাহনের মধ্য থেকেও নিরাপদে রাস্তা পারাপার করে। কারণ সে তো জানে সে এক শক্তিশালী বাহকের সাথে রয়েছে। যে পাশে থাকলে কোনকিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না।
~চলবে~