কাঞ্চনবেলা পর্ব-১০

0
3

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১০

এক পশলা বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় সুখময় সময়গুলো ক্ষীণ সময়ের মাঝে এক বুক অনুভূতি উপহার দিয়ে গেলো দুটি ভালোবাসা প্রবন অন্তঃস্থলে। দুঃখ আজীবনের সঙ্গী হলেও ক্ষণিকের সুখ যেনো হয় পরাক্রমশালী! আজীবন দুঃখ নিয়ে যেমন কাটিয়ে দেয় যায় তেমনি ক্ষীণ সুখ নিয়েও নিমিষেই কাটিয়ে দেয়া যায় গোটা এক জন্ম!

বোকা কাঞ্চনবালা’র সুখ বলতে দিনশেষে প্রতিটা কাঞ্চনবেলায় সুকুমার প্রবন ঐ নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী সুপুরুষটিকে একটু দেখা, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঐ দু’টো সাদা আর স্কাই ব্লু রঙা শাড়ি পড়ে নিজের অনুভূতি জাহির করা, রাস্তার ফুটপাত ঘেঁষে মানুষটার পাশাপাশি একবুক সুখ নিয়ে নিরবে হাঁটা, হাতে হাতে দু’টো সবজি কেনা…ব্যস এতোটুকুই।

ঘরময় মেয়ের উচ্চস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ক্ষিপ্রতার সাথে। সদ্য বাড়িতে প্রবেশ করা নুহাশ মাহমুদের ললাটে বলিরেখার সৃষ্টি হলো মেয়ের চিৎকার চেঁচামেচি তে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায় আওয়াজের উৎসের দিকে।

–“আপনাদের কতোবার বলেছি যতো কাজ থাকুক না কেনো, আমার শাড়ি দুটো সবার আগে ধুয়ে রাখবেন? এখন আমি পড়ব কিভাবে এই আধোয়া শাড়ি?”

বিবর্ণ, রাগান্বিত মুখে নৈরা মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বকছে হেল্পিং হ্যান্ডদের কে। বেলা দুইটা তেতাল্লিশ মিনিট তখন। নুহাশ মাহমুদ নৈরার কাছাকাছি গিয়ে শুধায়,
–“আম্মা! কি হয়েছে, এতো রেগে আছেন কেনো?”

নৈরা’র রাগ দমে গেলো বাবাকে দেখেই। সে রাগ দমন করে নেয় অনতিবিলম্বে। বাবা তো কখনো এই সময় বাড়িতে থাকে না! সে মিনমিনে স্বরে মৃদু রাগের সম্মেলনে বলল,
–“বাবা, আমি বিরাঙ্গনা’য় যাবো। কিন্তু ওনারা আমি শাড়ি ধুয়ে রাখেনি। এখন আমায় আধোয়া নোংরা শাড়ি পড়ে যেতে হবে।”

নুহাশ মাহমুদ সরু চোখে তাকায়। বলল,
–“তারা কাজটা একদম ঠিক করেনি, আম্মা। কিন্তু আপনাকে নোংরা শাড়ি পড়তে কেনো হবে, আম্মা? আপনার জামা কাপড়ের অভাব আছে? কাবার্ড থেকে অন্যকিছু বের করে আজ পড়ুন।”

নৈরা প্রায় আঁতকে উঠলো বাবার কথায়। নিজের তৈরি করা এই প্রেমময় পন্থা যে তার বড্ডো প্রিয়। প্রিয় মানুষটির সাথে মিলিয়ে পোশাক পড়া, তার সামার্থ্য অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তোলার মাঝেও যে অঢেল সুখ। সে চোখ মুখ কুঁচকে নাকোচ করে বলল,
–“না, আজ আমায় সাদা শাড়ি ই পড়তে হবে।”

–“কেনো?”, নুহাশ মাহমুদের শঙ্কিত কণ্ঠ। বাবার হঠাৎ তীক্ষ্ণ নজরে অপ্রস্তুত হলো নৈরা। বলল,
–“ওখানে সবাই শাড়ি পড়েই আসে। যারা নাচে তারাও, আর যারা গান গায় তারাও..তাই। আর আজ সাদা শাড়ি পড়ার দিন।”

নুহাশ মাহমুদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় অপ্রস্তুত দৃষ্টি চুরি করতে থাকা মেয়ের পানে। শান্ত কণ্ঠে বলল,
–“তবে চলুন বাবা আপনাকে আরো সাদা শাড়ি কিনে দিচ্ছি।”

নৈরা নাকোচ করলো সাথে সাথে। বলল,
–“প্রয়োজন নেই। আজকে এটাই পড়বো।”

–“দু’টো শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কেনো পড়তে হবে নৈরা?”, পুনশ্চঃ বাবার শঙ্কিত কণ্ঠে নৈরা নত দৃষ্টিতে মিহি স্বরে বলল,
–“দুটো’ই পর্যাপ্ত আমার জন্য। বেশি থাকলে তা আলমারিতে পড়ে থাকবে শুধু শুধু। অপচয় হবে।”

প্রেক্ষিতে নুহাশ মাহমুদ শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। খুব জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হলো যে,
–“আপনার অজশ্র জামা আলমারিতে পড়ে আছে তা অপচয় হচ্ছে না? কেনো এই দুটি শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়েই অপচয় রোধ করতে হবে?”

তবে জিজ্ঞাসা করা আর হলো না। বরাবরই মেয়েকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো তার অপছন্দ। সে মেয়ের রোগা, অসুস্থ মুখটির দিকে তাকায়। এক পা এগিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল,
–“আজ বিরঙ্গনায় যাওয়া জরুরী? আপনার জ্বর এখনো কমেনি, আম্মা। মনে হচ্ছে একটু পর আবারো জ্বর আসবে।”

নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে নিজেকে সতেজ দেখানোর প্রয়াস করলো। কৃত্রিম হেসে বলল,
–“মাম্মা ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, বাবা। আর জ্বর আসবে না। তুমি চিন্তা করো না। বাইরে বের হলে শরীর আরো ভালো লাগবে।”

নুহাশ মাহমুদ কোন জবাব দিলেন না শুধু শুনলেন। নৈরা ডাগর ডাগর নেত্র মেলে কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“তুমি আজ এই অসময়ে বাড়িতে কেনো বাবা? তুমি তো কখনো এই সময়ে বাড়িতে থাকো না!”

নুহাশ মাহমুদ মৃদু হাসলেন মেয়ের কথায়। মিহি স্বরে বলল,
–“আপনার সাথে একসাথে খাবার খাবো বলে এসেছিলাম আম্মা।”

–“কিন্তু আমি তো খাবার খেয়ে নিয়েছি।”, নৈরা মৃদু স্বরে বলল। নুহাশ মাহমুদ মাথা নেড়ে বললেন,
–“বাবা হয়তো একটু দেরি করে ফেলেছি, তাই না আম্মা?”

নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানালো। বাবা দেরি করে ফেলেছে। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে নিরুত্তর মেয়েকে যাওয়ার জন্য পথ করে দিলেন। বাবা ছেড়ে দিতেই নৈরা দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। তবে নুহাশ মাহমুদ তখনো স্থির সেখানেই দাঁড়িয়ে। বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
–“বাবা হয়তো একটু বেশিই দেরি করে ফেলেছি, আম্মা।”

নিজের ঘরে ঢুকেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ইদানীং কতো মিথ্যা বলতে হয় তাকে! অচিরেই চোখ দুটো টলটল করে উঠলো নৈরার। কঠোর লোকটার যদি তার উপর একটু দয়া হতো তবে আর কাউকে এভাবে মিথ্যা বলতে হতো না। সবার সামনে দৃঢ় কণ্ঠে বলতো, এই মানুষটাকে সে ভালোবাসে। তার সব সুখ এই মানুষটা জুড়ে।
চাপিয়ে রাখা দরজায় আবার টোকা পড়তেই নৈরা দ্রুত দরজা খুললো। একজন হেল্পিং হ্যান্ড বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
–“আপা, বিশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। আপনার রান্না বোধহয় হয়ে গিয়েছে।”
নৈরা তড়িঘড়ি করে ঘর ছেড়ে বের হলো। এক ছুটে গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। আজ যে তার প্রিয় মানুষটির বিশেষ দিন। বিশেষ দিনটিকে আরো বিশেষ করার জন্য সে কোন দামী উপহার বেছে নেয়নি বরং নিজের যোগ্যতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মনে হয়েছে, দামী গিফটের থেকে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন স্ত্রী স্বরূপের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার হবে। স্ত্রী এবং শব্দটির গভীরতা ভাবতেই লাজ ভর করলো নৈরার ফ্যাকাসে মুখজুড়ে। সে লাজুক হেসে প্যান থেকে নিজের হাতে বানানো খাবারটি নামিয়ে দেখলো হয়েছে কি-না। ইউটিউব দেখে দেখে জীবনের প্রথমবার সে ক্যারামেল পুডিং বানিয়েছে। স্বরূপের খুব ভালো লাগবে নিশ্চয়ই!

ফাল্গুন মুখ লুকিয়েছে পালাক্রমে ধরিত্রী দাপিয়ে বেড়ানো মৌসুমের আগমনে‌। সমীরণে এখন আর কপোক গাছের তুলো গুলো খেলা করে না। বাতাসে বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়ায় না। এখন আর সোনালী কাঞ্চনবেলা খুব একটা চোখে পড়ে না। বিরঙ্গনা সংলগ্ন পরিবেশটিতে ফুলের আবির্ভাব কমেছে। ছোট্ট স্ট্যান্ডটির উপর এক ঝাঁক বাগানবিলাস ফুল এখন আর নত শির ঝুঁকে বসে না অপার সৌন্দর্যের সাথে। তবুও বাগানবিলাসের অনুপস্থিতি যেনো এতোটুকু খামতি সৃষ্টি করতে পারছে না ঐ স্টিলের বেঞ্চিটির। কেননা বিগত মাসগুলোতে অচিরেই ঐ স্টিলের বেঞ্চিটির অনন্য এক সৌন্দর্য হয়ে উঠেছে হাসিমুখে পা দোলাতে দোলাতে অপেক্ষারত বোকাসোকা এক কাঞ্চনবালা।
স্ট্যান্ড সংলগ্ন চায়ের দোকানের আটপৌরে বৃদ্ধা মহিলা জানে ঐ বেঞ্চিটির সৌন্দর্য ঐ দুটি মানুষ। ছোলা ওয়ালাও জানে অপরাহ্নের শেষ স্টিলের বেঞ্চিটির সৌন্দর্য ঐ দুই নির্মলপ্রাণ ব্যাক্তিত্বধারী সাদামাটা মানব মানবী। কর্মব্যস্ততার মাঝেও চা ওয়ালী আটপৌরে বৃদ্ধা আর ছোলা ওয়ালা অগোচরে মুচকি হাসে বোকা কাঞ্চনবালা’র বোকামো দেখে, ঠিক যেমনটা হাসে সাদামাটা পুরুষটি। এতে কেউ বিন্দুমাত্র বিরক্ত হয় না তারা। বরং মনে হয় এই দূষণে ভরা ধরিত্রীর দূষিত মনগুলোর মাঝে একটুকরো পবিত্র, স্নিগ্ধ, নির্ভেজাল পরশ পাথর প্রতিদিন শোভা পায় ঐ স্টিলের বেঞ্চি জুড়ে।

চা ওয়ালী আটপৌরে বৃদ্ধা মহিলা চায়ের ভাঁড়ে চামচ নাড়তে নাড়তে মুচকি হাসলেন। কোনাচোখে দেখতে ভুললেন না সদ্য স্টিলের বেঞ্চিটিতে বসা সাদা শাড়ি পরিহিতা মেয়েটিকে। সাথে সাথেই যেনো ধাতব পাতটি নির্মল ঐ নারী সত্ত্বার ছোঁয়ায় মহত্ত্ব পূর্ণ হয়ে উঠেছে। পড়ন্ত ঐ বিকেলে একরত্তি শীতলতার ছোঁয়া নেই বাতাবরণে। প্রকৃতি এতো রুষ্ট কেনো? এহেন প্রশ্ন জেঁকে বসলো মেয়েটির মনে। অস্বস্তিভরা দেহে শাড়ির আঁচল দিয়ে গলার ঘাম মুছলো নৈরা। এটা কি প্রকৃতির রুষ্টতা নাকি তার দৈহিক? শরীর বোধহয় আবার খারাপ করবে। তার সাইনুসাইটিস রয়েছে। মারাত্মক বিরক্তিকর এক ব্যাধি! বিগত কয়দিন ধরেই তার জ্বর ঠান্ডা লেগে আছে। প্রাসঙ্গিক অসুবিধার কথা নাই বা বলি। থেমে থেমে জ্বর উঠছে।

–“আম্মা, আইজকা গান গাইতে গেলি না?”

চা ওয়ালী বৃদ্ধার প্রশ্নে নৈরা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ঠোঁটের ডগায় ঘাম মুছতে মুছতে দূর্বল গলায় বলল,
–“না চাচি, আজ গায়ে আর শক্তি নেই। অসুস্থ!”

বৃদ্ধাকে চিন্তিত দেখা গেলো। কান খাঁড়া করে শোনা ছোলা ওয়ালার ও কর্নদ্বয় সচকিত হয়। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“কেনো কি হইছে?”

নৈরা মলিন হেসে বলল,
–“জ্বর হয়েছে চাচা।”

চা ওয়ালী ব্যগ্র কণ্ঠে শুধায়,
–“তবে এতো তাড়াতাড়ি আসলি কেনো? ব্যাংক তো আরো দেরিতে ছুটি হবে।”

নৈরা স্মিত হাসলো দুই বৃদ্ধাকে দেখে। তারাও জানে সে এখানে কেনো আসে অথচ লোকটা বুঝেও বুঝতে চায় না। সে হাসিমুখে চাপা স্বরে বলল,
–“গোপন কথা শুনবে চাচা, চাচি?”

ছোলা ওয়ালা আর চা ওয়ালী ঘন ঘন মাথা নেড়ে মুখ এগিয়ে আনলো একটু সন্নিকটে। নৈরা মৃদু হেসে প্রফুল্ল চিত্তে বলল,
–“আজ তার জন্মদিন। আমি নিজে হাতে তার জন্য রান্না করে এনেছি।”

দুই বৃদ্ধাকে বেশ আনন্দিত, আশ্চর্য হতে দেখাগেলো। যেনো বোকা মেয়েটির বোকা প্রেম তাদের কাছেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। চা ওয়ালী ক্ষেপে গিয়ে শুধায়,
–“আরে এই বেক্কল মুখপুরী আগে বলবি না?”

নৈরা সরব মুখ কালো করে নিলো, কপাল কুঁচকে নিয়ে মুখ ঝামটা মেরে শুধায়,
–“কেনো আগে বললে কি হবে?”

ছোলা ওয়ালা ছোলা মাখতে মাখতে বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে বলল,
–“স্যার আইজকা জন্মাইছে কতো খুশির দিন না? আমরা বুজুর্গ মানুষ, খুশি হইয়া কিছু দেয়া উচিৎ না?”

নৈরা তেতে উঠলো সাথে সাথে। মুখ ঝামটা মেরে বলল,
–“খবরদার তোমরা আগেভাগে তাকে কিছু বলবে না। আমি বিগত এক সপ্তাহ যাবৎ কষ্ট করেছি আজকের দিনটার জন্য? জানো আমার হাত পুড়ে গিয়েছে, বাবা জানলে সব মেইডদের ঘর থেকে বের করে দেবে। বাসার কেউ জানে না আমি রান্নাঘরে ঢুকেছিলাম। এতো বিপদ নিয়ে কি আমি এগুলো করেছি তোমরা আমার পরিকল্পনা ভেস্তে দেবে বলে? খবরদার বলছি বুড়ো বুড়ি!”

নৈরা শাসিয়ে বলল। চা ওয়ালী মুখ বাঁকালো সবেগে। নৈরাকে তীব্র কটুক্তি দ্বারা উপেক্ষা করে বলল,
–“বেক্কল মাইয়া! পিরিতে মাথা খাইয়ে নিছে! আমরা আগেভাগে কিছু কইলি তোর পিরিত কমি যাবে?”

নৈরা চোখমুখ কুঁচকে নিয়ে বলে,
–“ছিঃ মুখের কি ভাষা! হ্যাঁ, কমে যাবে প্রেম। তোমাদের বারন করেছি তোমরা বলবে না।”

নৈরা মুখ ঝামটা মেরে বলল। চা ওয়ালী মুখ বাঁকিয়ে খদ্দরের হাতে চায়ের ভাঁড় তুলে দিলো। ছোলা ওয়ালাও মৃদু হেসে ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে ছোলা মাখা তুলে দিলো। নৈরা পা দোলাতে দোলাতে অপেক্ষা করতে লাগলো। তবে ক্ষণে ক্ষণে তীব্র ঝাঁঝের সাথে হানা দেয়া হাঁচির প্রকোপ তাকে শান্তি দিলো না। চা ওয়ালী আড়চোখে দেখতে দেখতে গম্ভীর গলায় শুধায়,
–“এক কাপ গরম গরম মশলা ওয়ালা চা দেই। ঠান্ডা ভালো হয়ে যাবে।”

নৈরা আঁচলে নাক মুখ মুছতে মুছতে থমথমে মুখে জবাব দিলো,
–“লাগবে না তোমার চা।”

ভদ্রমহিলা হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলো,
–“আরে এই খচ্চর মাইয়া! তুই অতো সুন্দর শাড়ি দিয়া নাক মুছতাছিস কেনো?”

নৈরা বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। মুখ ঝামটা মেরে শুধায়,
–“আমার কাছে মোছার মতো কিছু থাকলে কি আমি শাড়ি দিয়ে মুছতাম?”

ভদ্রমহিলা কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
–“এই তুই একবারো আমাকে বলেছিস?”

–“এখন শুনেছো না?”

চা ওয়ালী নিজের দোকান থেকে একটা ওয়ানটাইম টিস্যু প্যাকেট এনে ছুঁড়ে মারলো নৈরার কোলে। বলল,
–“শুনেছি বলেই এটা দিচ্ছি। এই নে আন্ধা!”

নৈরা পিটপিট করে তাকালো টিস্যুর প্যাকেটটির দিকে। আসলেই তার মাথা কোথায় থাকে! চা ওয়ালীর দোকানে প্রাসঙ্গিক অনেককিছুই থাকে। সে তো কিনতেই পারতো। নিজের ওপর নিজে বিরক্ত হয়ে গেলো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে নম্র চোখে তাকায় পুনরায় চা ওয়ালীর দিকে। ততক্ষণে চা ওয়ালী একটা চায়ের ভাঁড় হাতে ফিরে আসে। তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
–“গরম গরম খেয়ে নে, ঠান্ডা ভালো হয়ে যাবে।”

নৈরা ডাগর ডাগর নেত্র মেলে শুধায়,
–“এই গরমে চা খাওয়াচ্ছো?”

–“গরমে গরম কাটে রে বোকা মেয়ে।”

–“তুমি কার চা আমায় দিলে? এটা নিয়ে যাও। স্বরূপ চা খেতে ভালোবাসে। সে আসলে একসাথে নাহয় খাবো।”, নৈরা চায়ের ভাঁড় টা এগিয়ে দিয়ে বলল। চা ওয়ালী বিরক্ত সত্ত্বেও হেসে ফেললো। ঘেঁষাঘেঁষি রঙ তামাশার এই প্রেমের যুগে মেয়েটির স্বচ্ছ, বোকা এই প্রেম তাকে প্রশান্তি দেয়। চোখ জুড়ায়! মেয়েটির ভালোবাসার মাঝেও সে স্নিগ্ধতা খুঁজে পায়। সে স্নেহের চোখে চেয়ে নম্র কণ্ঠে বলল,
–“তোর ব্যাংকার তো রঙ চা খায়। এটা তো দুধ দিয়ে ঘন করে বানানো। সে রঙ চা তুই দুধ চা খেলে ভালো দেখায়? এটা এখন খা তখন নাহয় রঙ চা খাবি তার সাথে।”

নৈরা’র চিন্তা ছুটে পালালো। সে হেসে বলল,
–“আচ্ছা।”

চা ওয়ালী তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নৈরা স্মিত হেসে বলল,
–“রাগ দেখানোর পরেও এতো ভালোবাসছো কেনো? আহ্লাদ করছো যেনো— স্বরূপ আসার সাথে সাথে আমার আগে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে পারো?”

ভদ্রমহিলা আবার ক্ষেপে গেলেন। তেতে উঠে বললেন,
–“হ্যাঁ, তোর মতো তো ব্যাক্কল আমি। ওনার প্রেমিককে আমি গিয়ে আগে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো! শরীরে অতো আলগা রস আমার নেই। তোর ঢং তুই কর।”

নৈরা হেসে কুটিকুটি। সে পা দোলাতে দোলাতে চা পান করতে লাগলো। সূর্য ঢলে পড়লো কিঞ্চিৎ। লালচে আভায় দিগন্ত ছেয়ে গিয়েছে। ব্যাংকের সিঁড়ি বেয়ে একে একে পরিপাটি রুচিসম্পন্ন পোশাকে আবৃত কর্মক্লান্তিতে আড়ষ্ট দেহ বেড়িয়ে আসছে। বেড়িয়ে আসে কাঙ্খিত মানুষটিও। বেঞ্চিটি তার পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ফিরে পায়, আটপৌরে বৃদ্ধা চা ওয়ালীর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সেই হাসি সংক্রামিত হয় ছোলা ওয়ালার ঠোঁটেও। অদূরে রিকশার প্যাডেলে পা দিয়ে বসে থাকা রিকশাওয়ালাও মৃদু হাসলো। স্যার ম্যাডামকে প্রতিদিন এভাবেই ঐ বেঞ্চিটিতে বসে দুই হাত দূরত্বে বসে ভাব বিনিময় করতে দেখা যায়। তাদের লজ্জা লাগে না বরং খুব ভালো লাগে রোজকার ঐ সাদামাটা দৃশ্যটুকু দেখতে।
ঠোঁটের কোনে সুপ্ত হাসির রেখা নিয়ে বেঞ্চির অপরপাশে গা এলিয়ে দিতেই নারীটির অপেক্ষারত দুলতে থাকা পা দু’টো গতিরোধ হলো। জ্বরের প্রকোপে লালচে আভাযুক্ত ফোলা ফোলা মুখটিতে একগাল হাসি নিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কিন্তু তার হাসি মিলিয়ে যায় পাশে বসে থাকা এক অন্য সৌন্দর্যের অধিকারী মানুষটিকে দেখে। কালো প্যান্ট ডার্ক মেরুন রঙা ফুল হাতার শার্টটি সে কি অপার সৌন্দর্য নিয়ে পুরুষটির গায়ে এঁটে আছে! কিন্তু বোকা মেয়েটি খুশি হতে পারলো না। কারণ কি খুলে বলা লাগবে? আপনারা তো জানেন বোকা মেয়েটি কতো বোকা বোকা নিয়ম তৈরি করে রেখেছে নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করার জন্য।
অভিমানে স্বচ্ছ টলটলে নয়নদ্বয় অন্যদিকে ঘুরে গেলো। কাঠ হয়ে বসে রয় নিরবে। থমথমে মুখে পাশে থাকা ব্যাগটি থেকে এয়ারটাইড কন্টেইনারটি বের করে
নিজের ঠিক ডান পাশে দুই হাত দূরত্বে বসে থাকা লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে আবার কোলের মাঝে হাত গুটিয়ে বসে রইল। অভিমান মিশ্রিত নম্র কণ্ঠে বলল,
–“শুভ জন্মদিন!”

স্বরূপ এতক্ষণে চোখ ঘুরিয়ে তাকায় অভিমানী মুখটির দিকে। পরপরই তাকায় এগিয়ে দেয়া কন্টেইনারের দিকে। মৃদু হেসে কন্টেইনারটি নিজের কোলে তুলে রেখে, পাশে থাকা ব্যাংকের ব্যাগটি থেকে একটি শপিং ব্যাগ বের করে হাতে তুলে নেয়। মৃদু হাসি নিয়েই সেও একই রকম নিরবে শপিং ব্যাগটি দুই হাত দূরত্বে বসা অভিমানী মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে মিহি স্বরে বলল,
–“শুভ জন্মদিন!”

সহসা একজোড়া চোখে বিস্ফোরণ ঘটলো অভিমানে জর্জরিত মেয়েটির মাঝে। সে চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। মানুষটা একমনে কন্টেইনার খুলে তা থেকে পুডিং খাচ্ছে। বড্ডো মনোযোগ, আগ্রহ আর তৃপ্তির সাথে। যেনো এটা পৃথিবীর সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার। তার ঝিমিয়ে পড়া বদন খানিক আড়ম্বরপূর্ণ হয়ে উঠলো। নৈরার মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দিন আজকের দিনটি। তার জন্ম স্বার্থক! এই মানুষটার সাথে তার দেখা হওয়া স্বার্থক! তার জন্ম ই যেনো এই মানুষটার সাথে তার ভবিতব্য জুড়বে বলে! তার কাছে জন্মদিন কখনোই কোন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। তবে স্বরূপের জন্মদিন তার জন্য অনেক মহত্ত্ব পূর্ণ ছিল। কিন্তু আজকের পর থেকে হয়তো তার জন্মদিনটাও মহত্ত্ব পূর্ণ হয়ে উঠবে। সে চোখ মুছে মৃদু হাসি নিয়ে শপিং ব্যাগটি হাতে তুলে নেয়। ব্যাগটি খুলতেই একটি মেরুন রঙা কটন শাড়ি বেরিয়ে আসলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা সুখের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কঠোর মানুষটা তার বোকামো মিশ্রিত এই প্রেমকে গ্রহন করুক বা না করুক, অন্তত সম্মান তো করে!

সে ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলে,
–“ধন্যবাদ!”

স্বরূপ নিরবে খেতে খেতে মৃদু হাসলো। জন্মদিন উপলক্ষে আপা এই শার্টটা তাকে উপহার দিয়েছে। আপা আর মা ঘরে বসে কিছু হাতের কাজ করে। তা থেকেই এই উপহার সে জানে। আপার অনুরোধেই আজ এটা পড়েছে, নয়তো পড়তো না। কারণ সে তো জানে কেউ তার পোশাক আর পোশাকের রঙের মাঝেও প্রেম খুঁজে বেড়ায়। যদি এই প্রেমে অমিল খুঁজে পায় তবে বড্ডো কষ্ট‌ পাবে। বিগত মাসগুলোতে সে ফ্রিল্যান্সিং এর অনেক কাজ ও পাচ্ছে। পকেট খুব একটা শুকনো নয়। তাই আসার পথে মিলিয়ে একটা শাড়ি কিনে আনে। কাকতালীয় ভাবে সে এটাও জানতো আজ মেয়েটির জন্মদিন। মোটকথা একটা শুভ লগ্ন আজ! সে পুরো কন্টেইনরাটা শেষ করেই চামচ ছাড়লো। কন্টেইনার আঁটকে রেখে কিয়ৎকাল বাদ শুধায়,
–“পছন্দ হয়েছে?”

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলে,
–“খুব, খুব।”

স্বরূপ চোখে হেসে শুধায়,
–“খুব খুব?”

নৈরা ফের মাথা নাড়লো। স্বরূপ পুনশ্চঃ শুধায়,
–“এই খাবার কে বানালো?”

–“আমি আমি, কেনো ভালো হয়নি?”, নৈরার চঞ্চল কণ্ঠে স্বরূপ বুকে হাত গুঁজে ঘাড় কাত করে শীতল দৃষ্টিতে তাকায়। মিহি স্বরে বলল,
–“আরো খেতে ইচ্ছে করছে।”

নৈরার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। তার আরো আনা উচিত ছিল! সে ছোট মুখে বলল,
–“কম হয়ে গিয়েছে? আমি বরং আবার কল বানিয়ে আনবো।”

স্বরূপ মৃদু হাসলো মেয়েটির ছোট মুখটি দেখে। শুধায়,
–“আপনি রান্না করতে পারেন?”

নৈরা মিথ্যা বলতে পারলো না। সে জীবনে প্রথমবার আজ ই রান্না করেছে। সে না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
–“না, কিন্তু রান্না অনেক সহজ। আমি আজ বুঝেছি। খুব শিঘ্রই শিখে নেবো সব রান্না।”

–“হাত পুড়েছে কয় জায়গায়?”

নৈরা তার ধবধবে সাদা চিকন লম্বা বুড়ো আঙুলের লালচে নাকল’স দেখিয়ে বললো,
–“এখানটাতে একটু। এটুকুও পোড়ার কথা নয় আমি হিটপ্রুফ কাপড় ছাড়া ধরতে গিয়েছিলাম প্যান। তাই পুড়ে গিয়েছে।”

বড্ডো সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে স্বরূপ নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। জিজ্ঞাসা করে,
–“রান্না করতে হবে কেনো?”

নৈরা অনাহুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“তাহলে আপনাকে উপহার কি দিতাম? আজ না আপনার জন্মদিন?”

–“বুড়ো লোকের আবার জন্মদিন হয় নাকি?”

নৈরা কপাল কুঁচকে তাকায়, কথাখানা যে তার খুব একটা পছন্দ হয়নি তা স্পষ্ট চোখেমুখে। সে চুপ করে রইলো। কিয়ৎকাল বাদ আবারো ভেসে আসলো স্বরূপের কণ্ঠ,
–“অন্যকিছু ও তো দেয়া যেতো?”

নৈরা ঘাড় কাত করে তাকায়। উদাসীন কণ্ঠে বলল,
–“সেটা আমার হাতে তৈরি হতো না। আর আমার একটুও ভালো লাগতো না সেটা।”

স্বরূপ অদূরে পিচের রাস্তায় দৃষ্টি রেখে মৃদু হাসলো। ততক্ষণে তাদের দু’জনের মাঝে চমৎকার ভালোবাসা নিয়ে দুই কাপ চা আর এক ঠোঙা ছোলা মাখা এসে জায়গা করে নিলো। স্বরূপ ছোলা ওয়ালা আর চা ওয়ালীর দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো। তারা একত্রে হেসে বলল,
–“দু’জনকে শুভ জন্মদিন। দেখছো আল্লাহ কি সুন্দর দিনে দু’জনকে বানাইছে? দু’জন একই রকম! কতো মিল।”

স্বরূপ মৃদু হাসলো তাদের কথায়। মাথা নেড়ে বলল,
–“ধন্যবাদ চাচি-চাচা।”

–“বড়ো হও অনেক বড়ো হও, অবশ্যই দু’জন একসাথে।”, তারা দোয়া করে দিলো। নৈরা চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে শুধায়,
–“দেখেছেন আমাদের মাঝে কতো মিল?”

স্বরূপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল,
–“আট বছরের পার্থক্যে আপনি মিল কোথায় খুঁজে পেলেন, কাঞ্চনবালা?”

নৈরা কপাল কুঁচকে বলল,
–“তাতে কি? আমরা একই দিনে জন্মেছি একই দিনে মরবো।”

স্বরূপ সহসা কপাল কুঁচকে নিলো মরার কথা শুনতেই। গম্ভীর গলায় বলল,
–“এটা কেমন কথা, নৈরা?”

নৈরা হেসে উঠলো খিলখিলিয়ে। বলল,
–“আপনি ভয় পেয়ে গিয়েছেন তাই না? আমার মরার কথা শুনে? আমি জানতাম আপনি ভয় পাবেন।”

স্বরূপ কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“কিভাবে জানতেন?”

–“যেভাবে জানি, আজ আপনি আমার জন্য উপহার আনবেন।”

স্বরূপ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় চতুরতার বহিঃপ্রকাশ করা মেয়েটির দিকে। বোকা মেয়েটির এতো চতুরতা যে তার হজম হচ্ছে না। ভেতরটা আই টাই করে উঠলো মেয়েটির চতুরতাকে মূর্ছনা করার জন্য। ভ্রু নাচিয়ে শুধায়,
–“কিভাবে জানতেন?”

–“এই যে আপনি আমায় আগে থেকে চেনেন, আমার নাম জানেন, আমার জন্মদিনের তারিখ ও জানেন, আমার জন্য চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন, আমার জন্য বিরাঙ্গনার সামনে বসে গান শোনেন….মানে আমায় ভালোবাসেন।”, নৈরা চপলতার সাথে এক গাল হেসে বলল। স্বরূপ হো হো করে হেসে উঠলো মেয়েটির বাচ্চাদের মতো ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে বলা অবান্তর কথায়। হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে মেয়েটির টোট ব্যাগটি মুখের ওপর তুলে ধরে বলল,
–“আমার বোকা কঞ্চনবেলা! সারাদিন মাটি খুঁড়ে কেঁচো খোঁজার তালে না থেকে একটু মাথা খাটান। এই যে আপনার ব্যাগের কিনারায় কেউ সযত্নে গোটা গোটা স্পষ্ট অক্ষরে লিখে রেখেছে, বারো’ই জৈষ্ঠ্য এক হাজার চারশ ছয় বঙ্গাব্দ।”

বরাবরের মতো লোকটির থেকে বোকা প্রমাণিত হয়ে নৈরা বিরক্তি রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকায় ব্যাগের কিনারায়। আসলেই ওখানে তার জন্মদিনের তারিখ লেখা। বাবা কোত্থেকে যেনো এটা তার জন্য বানিয়ে এনেছিল। রাগে দুঃখে তার কান্না এসে গেলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় স্বরূপের দিকে। যে একমনে হেসে যাচ্ছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে। স্বরূপ ডানে বামে মাথা নাড়লো রাগান্বিত মেয়েটির দিকে। তখনি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নারীটির মূর্ছনা ভাব। আজ সতেজতা একটু কম। অসুস্থ দেখাচ্ছে। সে হাসি থামিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনাকে অন্যরকম লাগছে নৈরা। আপনি কি ঠিক আছেন? চোখ মুখ এমন ফোলা ফোলা লালচে কেনো হয়ে আছে?”

নৈরা গমগমে স্বরে বলল,
–“জ্বর হয়েছে একটু। আপনি সবজি কিনতে যাবেন না? সন্ধ্যা হয়ে এসেছে!”

স্বরূপকে ব্যতিব্যস্ত হতে দেখাগেলো। নৈরা সেই উদ্বিগ্নতা টুকু চোখ মুদে নিলো। স্বরূপ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল,
–“আজ এভাবে এতো পথ হেঁটে সবজি কিনতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি বাসায় চলে যান নৈরা।”

নৈরা থমথমে মুখে জেদ নিয়ে বলল,
–“আমি এতোটাও অসুস্থ নই যে সবজি কিনতে যেতে পারবো না। চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

–“রোজ রোজ সবজি কিনতে যাওয়ার মাঝে কোন বিশেষত্ব নেই নৈরা।”, স্বরূপের খানিক কঠোর গলায় নৈরা উদাসীন কণ্ঠে বলল,
–” বিশ মিনিটের পথ পায়ে হেঁটে আপনার সাথে পাড়ি দিয়ে দুই ধরণের সবজি কেনা, আমার কাছে বিশেষত্ব বলতে এতোটুকুই।”

স্বরূপ গায়ের ভর ছেড়ে অধৈর্য্য গলায় বলল,
–“আপনি প্রচুর জেদি নৈরা।”

নৈরা ছলছল নয়নে বলল,
–“অথচ আপনি জেদ বুঝলেন কিন্তু জেদের কারণ না।”

–“বোঝার সামর্থ্য আমার নেই নৈরা।”, স্বরূপের উদাসীন বলহীন কণ্ঠ। নৈরা মুখ ঘুরিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। থমথমে মুখে বলে,
–“মিথ্যুক!”

একা একাই হাঁটতে লাগলো নৈরা সন্ধ্যা বাজারের পথ ধরে। পাশে একটি চলন্ত রিকশা দাঁড়াতেই সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় রিকশার প্যাসেঞ্জার সিটে বসা স্বরূপের দিকে। স্বরূপ হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“উঠে আসুন।”

নৈরা নাকোচ করে বলল,
–“নাহ, রিকশার প্রয়োজন নেই। আমি হাঁটতে পারবো।”

স্বরূপ কঠোর গলায় বলল,
–“জেদ করবেন না নৈরা। উঠে আসুন।”

–“তবে রিকশা ভাড়া আমি দেবো।”

স্বরূপ বিরক্ত হয়ে প্রথমবারের মতো স্ব উদ্যোগে মেয়েটির হাত ধরে জোরপূর্বক রিকশায় তুললো। শান্ত স্বরে বলল,
–” আমি ইদানিং অনেক কাজ পাচ্ছি নৈরা। এতো চিন্তার কিছু নেই। আগামী এক সপ্তাহ আপনি নির্দিধায় রিকশায় চড়ে সন্ধ্যা বাজারে যেতে পারবেন।”

নৈরার দৃষ্টি চকচক করে উঠলো স্বরূপের কথায়। লোকটার ইনকাম ভালো হচ্ছে? লোকটির সকল সফলতায় সে সুখ অনুভব করে। মনে হয় এই তো তাদের নৈকট্য বেশি দূরে নয়। সে ভাড় হয়ে আসা মাথাটা রিকশার হুডে এলিয়ে দিলো। উত্তপ্ততায় গা অসাড় হয়ে আসছে। দূর্বল দেহে রিকশার সাথে মাথা ঠেকিয়ে ঝাঁকুনি খেতে লাগলো। স্বরূপ সম্মুখ বরাবর দৃষ্টি রেখে খানিক ইতস্ততা নিয়ে বলল,
–“অসুবিধা না হলে কাঁধে মাথা রাখতে পারেন। ওভাবে মাথায় ব্যথা পাবেন।”

কথাটি বলার মিনিটের মাঝেই একটি নরম আদলের ছোট্ট মাথা তার কাঁধে নিজের ভর ছেড়ে দিলো। আলগা হাত খোঁপা টি ছড়িয়ে পড়লো স্বরূপের পিঠজুড়ে। কৃত্রিম সেই কেশের সুগন্ধ সমীরণে মিশে যায় ক্ষিপ্র গতিতে। অথচ পুরুষালী নাসারন্ধ্রে সেটি ছদ্মবেশী প্রেমের সুবাস হয়ে ফুরফুরিয়ে ঢুকছে। নারী জড়িত সবকিছু অদ্ভুত ছদ্মবেশী হয় কেনো? ভেবেই মৃদু হাসলো স্বরূপ। জীবনে এমন এক সুখের লহমা যে আসবে তা যে অকল্পনীয় ছিল তার জন্য। স্বরূপ শুকরিয়া আদায় করতে ভুললো না ঐ উপরওয়ালার! নিশ্চয়ই তিনি উত্তম পরিকল্পনা কারী।

কালো গাড়িটির কাঁচ ভেদ করে দৃশ্যমান বয়স্ক মুখটিতে ভরপুর গাম্ভীর্যের সাথে ক্লেশ ফুটে উঠলো। মুখে বা হাত ঠেকিয়ে বসে থাকা নুহাশ মাহমুদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দূরন্ত গতিতে ছুটতে থাকা রিকশাটির দিকে। চোখের সামনে বিদঘুটে বেদনা সৃষ্টি করছে মেয়ের মাথা কারোর কাঁধে দেখে। একজন বাবার জন্য এটা কখনো দৃষ্টি নন্দণীয় নয়‌। কখনো না! সে ক্লেশ জর্জরিত কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল,
–“বাবার কাছে মিথ্যা বলতে নেই আম্মা! আমার বোকাসোকা নৈরা আম্মা আমার খুব প্রিয়। আমার আম্মা কখনো আমার কাছে মিথ্যা বলে না। বাবা যে প্রতি জন্মদিনে আপনার সাথে একসাথে বসে খাবার খাই এটাও মনে ছিল না আপনার! এই আপনি টা বড্ডো অপ্রিয়!”

~চলবে~