কাঞ্চনবেলা পর্ব-১১

0
10

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১১

ওয়ার্ম লাইটের টিমটিমে আলোয় ঘরময় মৃদু উজ্জ্বল। অফিস রুমের ডেস্কে দৃষ্টি রেখে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুহাশ মাহমুদ। ডেস্কের উপর ফর্মাল পোশাকে আবৃত এক শক্ত পেটানো দেহের দায়িত্বশীল ব্যাংকারের ছবি ভাসছে। পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার পুরো জীবনবৃত্তান্ত। তবে পড়াশুনা, দক্ষতা, দায়িত্ব সবকিছুতে দৃঢ়তার সাথে এগিয়ে যাওয়া গুণে গুণান্বিত এই জীবনবৃত্তান্ত খুব একটা প্রসন্ন করতে পারলো না এক দুঃস্থ, চিন্তিত বাবার মনকে। নিরবতাকে পরাজয় করে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে মিহি স্বর বেরিয়ে আসলো,
–“কতো লক্ষ্য টাকার লোন?”

ম্যানেজার বিনীত ভঙ্গিতে বলল,
–“মোট পঁচাত্তর লক্ষ্য টাকা ছিল স্যার। এককালীন বিশ লক্ষ্য টাকা পরিশোধ করেছে। এখন বাকি আছে তিপ্পান্ন লক্ষ্যের একটু বেশি টাকা।”

–“ওহ্! মাসিক বেতন কতো?”

–“মাসে আটচল্লিশ হাজার টাকা থাকে, স্যার।”

–“বেতন আটচল্লিশ হাজার টাকা হলে, প্রতিমাসে লোন গুনতে হয় কতো টাকা?”

–“স্যার দেড় লক্ষ্য টাকা।”

–“বাকি টাকাগুলো কিভাবে পরিশোধ করে?”

–“পার্টটাইম ফ্রিল্যান্সিং করে। এছাড়াও বন্ধুদের কাছ থেকে আর সমিতি থেকেও কিছু ধার দেনা রয়েছে। মানে টেনেহিঁচড়ে মাস চলে যায়।”

–“তবে খায় কি?”

ভদ্রলোক কিয়ৎকাল চুপ রইলেন নুহাশ মাহমুদের প্রশ্নে। ধারণা করে বললেন,
–“হয়তো কোনভাবে চলে যায়। বাবা নেই, স্বামী মরা বোন আর ভাগ্নে তাদের পেছনেও তো খরচ রয়েছে। আবার বৃদ্ধ মা। ঐ নুন আনতে পানতা ফুরায় এমন আরকি।”
এতক্ষণ যতোটুকু ধৈর্য্য আর মনোযোগ সহকারে শুনছিল সেটুকু ও আর রইলো না নুহাশ মাহমুদের। বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে শুধায়,
–“বিধবা বোন? শশুর বাড়ি নেই? সেখানে কেনো থাকে না?”

–“সে তো জালিম পরিবার! ছেলে মারা যাওয়ার পর ছেলের বউ আর নাতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সম্পত্তির এক আনা ভাগ তো দূরের কথা একবার খোঁজ নিয়েও দেখে না। তাই সব পাঠ চুকিয়ে এখন ভাইয়ের কাছেই তার একমাত্র ঠিকানা।”, ম্যানেজারের কণ্ঠে দিদৃক্ষা।

নুহাশ মাহমুদের এতক্ষণের শান্ত রূপটা আর স্থির রইলো না। সে জানতো তার বোকা মেয়েটাকে দুনিয়া সবসময় বোকাই বানিয়ে রাখবে। এর জন্যই কি সে সর্বদা একটা সুরক্ষিত বলয়ে মেয়েকে বড়ো করেছে, যেনো জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়েই সে বোকামো করে বসে? উদ্বিগ্ন পিতৃত্ব ভরা অন্তঃস্থল নিয়ে অশান্ত কণ্ঠে বলল,
–“জমশেদ কে ডাকো!”

মিনিট পাঁচেকের মাঝেই জমশেদ নামক ব্যক্তিটি ভীতসন্ত্রস্ত দেহাবয়বে হাজির হলো। ইনি আর কেউ নন বরং নৈরার ড্রাইভার। নুহাশ মাহমুদ ক্রুর দৃষ্টি তুলে তাকায় নত মস্তকটির দিকে। থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে শান্ত কণ্ঠে শুধায়,
–“জমশেদ তুমি আমায় কতোদিন ধরে চেনো?”

জমশেদ দাঁত খিচে দাঁড়িয়ে রইল। ধিমি কণ্ঠে জবাব দেয়,
–“আজ পনেরো বছর স্যার।”

–“এই পনেরো বছরে কখনো একবারো দেখেছো আমি নৈরাকে নিজের হাত ছাড়া অন্য কারোর হাতে ছেড়েছি? তাকে কখনো আমি আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে যেতে দিয়েছি?”

জমশেদ বিবর্ণ মুখে ডানে বামে মাথা নাড়লো। সহসা ভেসে আসলো হিংস্র চাপা এক হুঙ্কার।
–“তবে তুমি কোন সাহসে আমার বিশ্বাস নিয়ে খেললে? আমার আমানতকে তুমি কি করে এভাবে খোলামেলা ছেঁড়ে রেখেছো দিনের পর দিন? আমি কি এই কারণে তোমার উপর বিশ্বাস করেছিলাম? আমার মেয়ে দিনের পর দিন বোকামো করে গিয়েছে আর তুমি তা দেখেও আমায় অবগত করোনি?”

টেবিলে থাকা খবরের কাগজগুলো উগ্র চিত্তে উড়ছে দিগ্বিদিক। জমশেদ ঈষৎ কেঁপে উঠলো। ভীত দৃষ্টি তুলে তাকায় টেবিলে হাত দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে আসা হিংস্র মুখটির দিকে। কম্পিত স্বরে বলল,
–“আমি কখনো তাকে একা ছাড়তে চাইনি স্যার। সে আমায় এটা ওটা বলে দূরে সরিয়ে দিতো। প্রথম প্রথম মিথ্যা বলতো, পরবর্তীতে আমার ওপর রাগ ঝাড়তো, ভয় দেখানোর চেষ্টা করতো। আমি আপনাকে বলতে চাইলে ও বলতে দিতো না। আমি তার কথাতেই…”

জমশেদের কণ্ঠ থেমে গেলো ক্ষিপ্র ব্যগ্র কণ্ঠের উৎপীড়নে। নুহাশ মাহমুদ ফের চাপা স্বরে গর্জে উঠলো,
–“তার কথাতে? তোমাকে নৈরা রেখেছে নাকি আমি রেখেছি? তুমি ওর কথা শুনে আমার থেকে লুকিয়ে যাবে? এতো স্পর্ধা আসে কোত্থেকে তোমার জমশেদ? আমার মেয়ে যদি বুঝদার হতো তবে আমি তোমায় রাখতাম না। সন্তান রা ভুল করবে আমরা বাবা মা তা শুধরানোর জন্য সর্বদা ঢাল হয়ে থাকবো। এর জন্যই আমি আজ পর্যন্ত তাকে কোন ভুল কিছুতে জড়াতে দেইনি। কিন্তু তুমি? তাকে ভুল করার সুযোগ করে দিয়ে তুমি বড্ডো ভুল করেছো। তোমার কারণে আমার নৈরার চোখে এখন পানি আসবে। বের হও এখুনি। আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও”

নুহাশ মাহমুদ তিরস্কারের সাথে চেঁচিয়ে বললেন। জমশেদ বিবর্ণ মুখশ্রী নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। নুহাশ মাহমুদ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন। রক্ত তার টগবগ করছে। মনে হচ্ছে মেয়েকে বিরঙ্গনায় পাঠানোই তার একমাত্র ভুল ছিল। তার থেকেও বড়ো ভুল ছিল মেয়েকে ছাড়া গরুর মতো ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা। কপালে অনবরত আঙুল ঘষতে ঘষতে নুহাশ মাহমুদ বদ্ধ নেত্রে নিজেকে শান্ত করার প্রয়াস চালায়। বিড়বিড় করে বলে,
–“আম্মা, বাবা আপনাকে ভুল করার সুযোগ করে দিয়েছি , বাবাই আবার আপনাকে ভুল পথ থেকে ফিরিয়ে আনবো। বাবা খুব দুঃখিত, আম্মা। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার চিন্তা করার জন্য আপনার বাবা সবসময় আছে। আপনি ভুল করবেন বাবা তা শুধরে নেবো, এটাই তো নিয়ম। কিন্তু তবুও এই ভুলের কোন বিরূপ প্রভাব আপনার উপর বাবা পড়তে দেবো না। কখনো না।”

বলতে বলতেই উগ্র হাতে টেবিলে চাপড়ে নুহাশ মাহমুদ গটগট করে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
*****
অলসতা, উদাসীনতার সাথে দিন কাটানো মেয়েটি ইদানিং ঠিক একটা দুষ্টু খরগোশের ন্যায় আচরণ করছে। সবুজ ঘাসের মাঝে নিঃশব্দে গুটি গুটি চার পায়ে হাঁটতে থাকা খরগোশের মতো নিরবে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে নৈরা ছুটে গেলো রান্নাঘরে। মাথাতে তখন সাদা এক স্কার্ফ। ফজর নামাজ আদায় করেই সে এই মুখো হয়েছে। সে জানে তার বাড়িতে সকলের দিন শুরু হয় সকাল সাতটার পর। এর আগে কেউ ঘরের বাইরে বের হয় না। চোখেমুখে রাজ্যের উৎফুল্লতা আর উৎসুকতা নিয়ে মেয়েটি ফ্রিজ থেকে পাঁচটা ডিম, দুধ সহ প্রয়োজনীয় সবকিছু নামালো। অতঃপর দ্রুত হাত চালিয়ে অদক্ষ হাতে গতকালের ন্যায় ফের পুডিং বানাতে লাগলো। বানিয়ে ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখবে। তারপর বিকালে নিয়ে যাবে। লোকটা গতকাল আরো খেতে চেয়েছিল। তার উচিৎ ছিল বেশি করে বানানো।‌মানুষটা কতো তৃপ্তি সহকারে খেয়েছিল। ভাবতেই নৈরা’র মুখে হাসি ফুটে উঠলো। লাজমাখা চোখে ভেসে উঠলো লোকটার ঘাড় কাত করে বলা ছোট্ট কথাটি,
–“আরো খেতে ইচ্ছে করছে!”

তারমানে নিশ্চয়ই অনেক মজা হয়েছে! অজশ্র উদ্যমতা, উৎফুল্লতা নিয়ে নৈরা আবারো বানাতে লাগলো।

পরের দিনটি শুক্রবার হওয়ায় বেশ আলসেমি জুড়ে দিলো স্বরূপের শক্তপোক্ত পেটানো দেহটি‌। সারারাত পি.সি তে বসে ভোর বেলায় ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়েছে। কিন্তু সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হতে দিলো না বুব্বো নামক ছোট্ট চঞ্চল ছেলেটি। দশটা বাজার সাথে সাথে মামুকে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলেছে। উদ্দেশ্য তার সাথে খেলতে যাওয়া। এই একটাদিন কোনমতেই সে মামু’র সঙ্গ হাতছাড়া করতে নারাজ। নাস্তা করে স্বরূপ বেরিয়ে পড়লো ব্যাট বল নিয়ে ভাগ্নের সাথে। পাশের মাঠে জমিয়ে ক্রিকেট খেললো মামু ভাগ্নে। ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত বদনে ঘরে ফিরে মামু ভাগ্নে ঠান্ডা ঠান্ডা পানি দিয়ে গা ভিজিয়ে নিলো। অতঃপর দু’জনে কাপড় বদলে হেলতে দুলতে খাবার ঘর পর্যন্ত গেলো। বুব্বোকে কোলে করেই স্বরূপ একহাতে খাবার টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখা খাবারের ঢাকনা তুলে তুলে দেখতে লাগলো মা কি রান্না করেছে! ঢাকনা উল্টাতে উল্টাতে লাউয়ের ঝোল দেখেই তার চোখ মুখ বিকৃত হয়ে গেলো। সাধনা ব্যস্ত হাতে ঘর গোছাতে গোছাতে দেখলো সেই কপাল কুঁচকানো। জিজ্ঞাসা করে,
–“কিরে তুই লাউ দেখতেই অমন চোখমুখ কুঁচকে নিলি কেনো?”

স্বরূপ ঢাকনা বন্ধ করে বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে শুধায়,
–“লাউ পেয়েছিস কোথায়? আমি তো লাউ কিনি নি!”

সাধনা টি টেবিল মুছতে মুছতে বলল,
–“মা, ভ্যান থেকে কিনেছে। কিন্তু তুই এমন করছিস কেনো? লাউ তো তোর খুব পছন্দের সবজি। কতোদিন যাবৎ দেখছি ঘরে ও লাউ কিনছিস না।”

স্বরূপ তীব্র বিরোধিতা করে বলল,
–“লাউ আমার মোটেই পছন্দ না। পানসে পানসে বিরক্তিকর একটা সবজি। ওটাকে আমার চোখেই দেখতে ইচ্ছে করে না।”
সাধনা অবাক হলো ভাইয়ের এমন আচরণে। বলল,
–“কবে থেকে? কদিন আগেও তুই লাউ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেতি ভুলে গেলি?”

স্বরূপ জবাব দিতে পারলো না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েটির মাথা নেড়ে নেড়ে বলা কথাটি,
–“আপনাকে ঠিক লাউয়ের মতো দেখতে। হাতে পায়ে শুধু লম্বা কিন্তু খেতে পানসে হাদাভোদা।”

মেজাজ বিগড়ে গেলো ফের। সে পানসে? হাদাভোদা? বিরক্ত হয়ে বলল,
–“না আমি কখনোই পছন্দ করতাম না লাউ।”

সাধনা বিভ্রান্ত হয়ে গেলো ভাইয়ের আচরণে। বলল,
–“আচ্ছা, ঠিক আছে। পছন্দ করিস না যখন খাওয়ার দরকার নেই। কালো জিরা আর বেগুন ভর্তা বানিয়েছি অনেক ঝাল দিয়ে, তা খাবি।”

–“হুঁ।”, স্বরূপ ছোট্ট করে জবাব দিয়ে টিভির সামনে বসলো বুব্বোকে নিয়ে। বুব্বো তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো পুরো সপ্তাহে সে কি করে, কার সাথে খেলে। বলতে বলতেই সে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল,
–“জানো মামু, আমার একটা বিশাল বন্ধু আছে। তোমার মতো বিশাল। আমার সাথে রোজ বিকালে ক্রিকেট খেলে।”

স্বরূপ কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। শুধায়,
–“কে? যার তার সাথে আবার মিশে যাচ্ছো তুমি? তারপর এখানে ওখানে যেতে বলবে আর চলে যাবে?”

বুব্বো ঘন ঘন মাথা নাড়লো। বেশ বিজ্ঞদের মতো করে বলল,
–“বুব্বো এতো বোকা না-কি! বুব্বো ভালো খারাপ বোঝে। আর বন্ধু খারাপ নয়, খুব ভালো। মাম্মাও চেনে। মাম্মার সাথে ভাব ও হয়েছে, জিজ্ঞাসা করো।”

স্বরূপ সরু চোখে তাকায় বোনের দিকে। কর্মরত সাধনা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলো ভাইয়ের এমন দৃষ্টিতে। সে অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“কি ওভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? ওর কথা শুনিস? একটা বেয়ারা লোকের সাথে চলে সে। হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখিনি ওর ভাগ্য ভালো। আবার গুণ গাচ্ছে। যার জীবনে সিরিয়াসনেস বলতে কিছু নেই। পারে শুধু মানুষকে কষ্ট দিতে। আমার সাথেও ঝামেলা বেধে গিয়েছিল পরে ক্ষমা চাইলো। সেদিন দেখলি না?”

স্বরূপ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
–“ফুল দিয়ে দুঃখিত বলার মতো কি ঝামেলা হয়েছিলো?”

সাধনা ফের থতমত খেয়ে গেলো ছোট ভাইয়ের এমন প্রশ্নে। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
–“তেমন কিছু না লোকটার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। অথচ করার মতো কিছু আছে যে করবে! বড়ো লোকের ভবঘুরে ছেলে। কোনকিছুর চিন্তা নেই পারে শুধু না জেনেবুঝে মানুষকে কষ্ট দিতে।”

সাধনা তিরস্কারের সাথে বলল। স্বরূপ ফের শুধায়,
–“মানুষটা কে?”

–“নাম জানি না আমি।”, সাধনা ছোট্ট করে জবাব দিলো। শহরের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী নুহাশ মাহমুদের নাম শুনলেও এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তার কাছে কোনকালেই ছিল না আর না জানার আগ্রহ দেখা যায়। মূলত এই অজ্ঞতার কারণ এটাই। বুব্বো তন্মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“আমি জানি বন্ধুর নাম। বন্ধুর নাম হলো নোমান মাহমুদ।”

ভাগ্নের কথায় সহসা স্বরূপ খুক খুক করে কেঁশে উঠলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে শুধায়,
–“তার মতো ব্যক্তি তোমার বন্ধু?”

বুব্বো হেসে মাথা নাড়লো। স্বরূপ অপ্রস্তুত হলো বেশ। এই নোমানকে সে চেনে সেই ছোট থেকেই। তাদের বেড়ে ওঠা এই সাউথ সেন্টার রোড আর হাজী মহসিন রোডেই। সেই সুবাদেই সে চেনে। কিন্তু কখনো কোন সখ্যতা ছিল না তবে মুখ চেনা। সাধনা ও বেশ অবাক হলো নোমানের নাম শুনে। এটা তবে নুহাশ মাহমুদের বিগড়ে যাওয়া সু….না না কুপুত্র। নিজের ভুলটি শুধরে বিড়বিড় করলো সাধনা।
*****
দুপুরের খাবার টেবিলে তখন সবাই একমনে খেয়ে যাচ্ছে তবে একটি গলা থেকে একটা দানাও নামছে না।
নুহাশ মাহমুদ নিজের থমথমে আদল থেকে বের হয়ে গলা খাঁকারি দিলো। নত মস্তকে খেতে খেতে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
–“নৈরা, আম্মা আপনি খাচ্ছেন না কেনো? খাবার নিয়ে বসে থাকতে নেই।”

নৈরা টলটল দৃষ্টি তুলে তাকায়। সে জোরপূর্বক খাবার মুখে তুললো। নোমান মিনিট পাঁচ যাবৎ বোনকেই দেখছিল। দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণের রেশ। সে বোনের দিকে খানিক ঝুঁকে গিয়ে শুধায়,
–“নুরু, কি হয়েছে? মন খারাপ?”

নৈরা চোখ তুলে তাকায়। কিশলয়ের ন্যায় তিরতির করে কেঁপে ওঠা ঘন পল্লব ঝাপটে অবুঝ বোকা কণ্ঠে শুধায়,
–“আজ শুক্রবার কেনো?”

নোমান কিয়ৎকাল হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে রইল। তার ইদানিং মনে হয় নৈরা বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে তার কৌতুহল, বদলে যাচ্ছে তার সহজাত প্রবৃত্তি গুলো এবং অভ্যাস। যেটা খুব অল্পতেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। সে ভাবনা গভীর হতে না দিয়ে হেসে বলল,
–“পাগলা নুরু! শুক্রবার কবে থেকে অপছন্দ করতে শুরু করলো?”

নৈরা আবেগমাখা কণ্ঠে অনুযোগ এনে বলল,
–“আমায় পাগলা নুরু বলবে না ভাইজান। আমি পছন্দ করি না নাম বিকৃত করা।”

নোমান শুনলো বোনের কথা। মাথা নেড়ে বলল,
–“আচ্ছা, আমার পাগলা নুরু যখন তার নাম বিকৃত করে পাগলা নুরু ডাকতে বারণ করেছে, তখন আমি আর কখনো তাকে পাগলা নুরু বলে ডাকবো না। ঠিক আছে, আমার পাগলা নুরু?”

নৈরা রাগে ফোঁস করে উঠলো। এমনিতেই চোখদুটি অযুহাত করছিল নোনাজল মুক্ত করার। এখন যেনো প্রশ্রয় পেলো দূর্দান্ত রকমের। নৈরা ফ্যাচ করে কেঁদে উঠে দুম করে ভাইয়ের বাহুতে বারি দিলো। রেগে বলল,
–“বিরক্ত করবে না ভাইজান।”

নোমান খিক খিক করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে নৈরা আরো ব্যথিত হলো, সে খাবার ছেড়ে ছুটে চলে যায় নিজের ঘরে। সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেও নুহাশ মাহমুদের মাঝে কোন বিচলন দেখাগেলো না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের খাবারের দিকে। যেনো তার মস্তিষ্ক বিভোর গভীর ভাবনায়। যেখানে একমাত্র চিন্তা শুধু বোকা মেয়ের বোকামো শুধরানো।
মিতা আর নিরাদ রাগান্বিত স্বরে নোমানের উদ্দেশ্যে বলল,
–“কি অবস্থা নোমান? খাওয়ার সময় ও তোর এমন ফাজলামো করতে হবে?”

ভাইয়ের কথায় নোমান মৃদু হেসে সবাইকে আশ্বস্ত করে বলল,
–“চিন্তা করো না, আমি দেখছি নুরুকে।”

–“মেয়েটাকে খেতে পর্যন্ত দিলে না।”,
মায়ের কথায় নোমান নিজের প্লেটে আরো কিছু ভাত, সবজি মাংস নিয়ে বোনের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
চাপিয়ে রাখা দরজা খুলে ঢুকতেই বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকা বোনকে দেখে মৃদু হাসলো নোমান। ভাত মাখতে মাখতে বোনের পাশে বিছানায় পা গুটিয়ে বসলো। আদুরে গলায় বলল,
–“নুরু, ওঠ। এখন বল শুক্রবার হয়েছে তো কি হয়েছে? বাইরে যাবি? চল ভাইজান নিয়ে যাবো।”

নৈরা ঘাড় কাত করে বিষন্ন চোখে তাকায় ভাইয়ের দিকে। কিন্তু কিছু বলল না। নোমান ভাত মেখে বোনের মুখের সামনে তুলে ধরলো। নম্র স্বরে বলল,
–“খাবারের সাথে রাগ দেখাতে নেই। মোটকথা কোনোকিছুর সাথেই রাগ দেখাতে নেই। তাহলে লস আমাদের ই বুঝলি। রাগ না দেখিয়ে উপায় খুঁজতে হবে সমস্যা সমাধানের জন্য। এখন তোর সমস্যা বল, ভাইজান সমাধান খুঁজে দিচ্ছি। তবুও মন খারাপ করে থাকা যাবে না।”

নৈরা ইদানিং খুব সহজেই এমন উপদেশ গ্রহণ করে নেয়। তাই আজো ভদ্র মেয়ের মতো গ্রহণ করতে উদ্বত হলো। ভাইজান তো ঠিক ই বলেছে সমস্যার জন্য মন খারাপ না করে সমাধান খুঁজতে হবে। সে উঠে বসলো। ভদ্র মেয়ের মতো ভাইয়ের থেকে খাবার মুখে তুলে নিলো। নোমান মৃদু হেসে শুধায়,
–“বাইরে যাবি?”

নৈরা উপরনিচ মাথা নেড়ে সায় জানালো। নোমান ফের শুধায়,
–“কোথায় যাবি?”

–“বিরঙ্গনায়।”

–“আজ তো বিরঙ্গনা বন্ধ।”

–“এটাই তো সমস্যা!”, নৈরা নাকমুখ কুঁচকে বলল। তবে অন্তঃস্থলে চাপা সমস্যা যে অন্য কিছু। আজ কাল দুটো দিন ব্যাংক বন্ধ। এটাই নৈরার সকল সমস্যার মূল।
বোনের বিরক্তিতে একরাশ আশায় পরিপূর্ণ করে দিয়ে নোমান এবারেও চমৎকার হেসে বলল,
–“ভাইজানের কাছে এর ও উপায় আছে নুরু। তুই যাদের জন্য বিরঙ্গনায় যেতে চাইছিস তাদের ডেকে নিয়ে আয়! তবেই তো হয়ে গেলো। ঘোরাও হবে আড্ডা দেয়াও হবে মন খারাপ ও দূর হয়ে যাবে।”

নৈরার চোখমুখ চকচক করে উঠলো ভাইয়ের কথায়। কিন্তু পরক্ষণেই মনমরা হয়ে শুধায়,
–“কিন্তু সে তো আসবে না। কঠোর কি-না!”

নোমান থমকালো, চমকালো। অপ্রস্তুত সন্দিহান হয়ে শুধায়,
–“সে? মানে কে?”

নৈরা হতচকিত সোজা হয়ে বসলো। দৃষ্টি চুরি করে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“আছে বিরঙ্গনায় একজন সঙ্গী। আমার খুব কাছের মানুষ।”

–“ওহ্।”, নোমান সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছোট করে জবাব দিলো।

নৈরাকে ভাত খাইয়ে দিয়ে নোমান ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। ভাইজান যেতেই নৈরা দ্রুত ফোনটা হাতে নিলো। কাঙ্খিত নাম্বারটিতে কল দিলো নির্দ্বিধায়। পি.সির সামনে বসে কাজ করতে থাকা স্বরূপের ধ্যানচ্যূত হয় ফোনটি তীব্র শব্দ করে বেজে উঠতেই। স্ক্রিনে দৃষ্টি রাখলে অযথাই ঠোঁটের কোনা স্মিত বেঁকে যায়। বিগত তিন মাসে কেউ জোরপূর্বক তাকে হুটহাট ফোন করার অধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে। এমনি হুটহাট সময়ে অসময়ে ফোনটি বেজে ওঠে, কর্নকুহরে আন্দোলিত হয় বোকাসোকা রিনিঝিনি মিষ্টি কণ্ঠ। যেই কণ্ঠ থেকে শুরু করে মানুষটাকে সে চেয়েও উপেক্ষা করতে পারে না। ফোনটি কাঁধে চেপে স্বরূপ হাত কিবোর্ডে স্থির রাখলো। মিহি স্বরে ডেকে ওঠে,
–“নৈরা!”

ভেসে আসলো চঞ্চল কণ্ঠ,
–“আপনি কোথায়?”

-“পি.সি তে বসেছি।”

–“আজ সবজি কিনতে যাবেন না!?”

–“প্রয়োজন নেই, আগামীকাল কিনবো। আগামীকাল ছুটি আছে।”

নৈরা সবেগে বিরোধিতা করে উঠলো।
–“না, না আগামীকাল কেনো? আপনি আমায় ছাড়া সবজি কেনো কিনবেন? আপনি বরং এখন আসুন বিরঙ্গনায় আমরা একসাথে গিয়ে সবজি কিনবো।”,
–“সবজি কেনাটা এতোটা গুরুত্বপূর্ণ ও নয় নৈরা।”,স্বরূপের শান্ত কণ্ঠ। কিন্তু ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি। তার খুব ভালো লাগে মেয়েটির পেট থেকে সত্য কথা বের করতে‌। তার ভালো লাগাকে বাড়িয়ে দিয়ে নৈরা ছটফটে কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“কিন্তু আমার আপনার সাথে দেখা করাটা গুরুত্বপূর্ণ!”

স্বরূপ গা দুলিয়ে হাসলো। কাজ থামিয়ে কানে হাত ঠেকিয়ে ফোনটি ধরে শুধায়,
–“কেনো প্রয়োজন? লাউয়ের মতো পানসে, হাদাভোদা লোকের সাথে আপনার দেখা করাটা কেনো প্রয়োজন।”

নৈরার খুব বলতে ইচ্ছে করলো আপনাকে দেখাটা আমার জীবনের একমাত্র ইচ্ছে, অভ্যাস, লক্ষ্য। কিন্তু সাহস হলো না। নম্র স্বরে বলল,
–“আমি রান্না করেছি আপনার জন্য। না খেলে নষ্ট হয়ে যাবে। একটু আসুন না, আর বিরক্ত করবো না।”

“আর বিরক্ত করবো না” কথাটি বড্ডো তিতকুটে বিড়ম্বনা নিয়ে প্রতিধ্বনিত হলো কর্নজুড়ে। বুকজুড়ে সূক্ষ্ম চ্ছেদ গভীর ভাবে আঘাত হানলো যেনো! অথচ এটা মন মস্তিষ্ক স্বীকার করতে নারাজ। সে পি.সি’র দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে, মিহি স্বরে বলল,
–“আসছি।”

নৈরা’র মুখে বিশ্বজ্বয়ের হাসি। চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“আসুন, আসুন। গতকালকের শার্টটা পড়ে আসবেন কিন্তু।”

স্বরূপ মলিন হাসলো। নৈরা ফোন রেখে ছুটে বিছানা থেকে নামে। আলমারি খুলে স্বরূপের দেয়া শাড়িটি বের করে তাতে গাল লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শাড়িটিতে আদর করে বলল,
–” কি সুন্দর নরম তুলতুলে শাড়ি! তোমায় আজ পড়বো আর সুন্দর করে সাজবো। স্বরূপ দেখে মুগ্ধ হবে নিশ্চয়ই!”
মেয়েটি কাকে শুধালো জানা নেই। ঘরজুড়ে জড়বস্তু, দুটো হাঁসের ছানা আর খরগোশটি তার পায়ের কাছে গুটি গুটি পায়ে ঘুরঘুর করছে। তারাও মাঝেমধ্যে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করে হয়তো বলেই ফেলে মেয়েটি খুব বোকা!

ডার্ক মেরুন রঙা শাড়ির সাথে স্বর্নালী পাড়। লতানো দেহে জড়িয়ে গেলো আঁটসাঁটে হয়ে। কোমড় সমান চুল গুলোর নিম্নাংশ প্রাকৃতিক ভাবেই ঘাড় ত্যাড়া মানে কোঁকড়ানো থাকে। অথচ মুখের উপরের চুলগুলো একদম ভদ্র সভ্য। চোখে কাজল টানলো, ঠোঁটে গোলাপী রঞ্জক পদার্থ! ফ্যাকাশে শুভ্র রঙা বরন তাতেই খিলখিলিয়ে উঠেছে। হাতে কানে বাবার দেয়া গহনাগুলো এখন আর শোভা পায় না নৈরার। তার বোকা মনের হঠাৎ করেই মনে হলো, এই যে হিরের গহনাগুলো তার প্রিয় মানুষটিকে ছোট করছে। তাদের মধ্যে অদৃশ্য জড়তা সৃষ্টি করছে ঐ পাথরগুলো। তাই তো অলংকার বিহীন সিদেসাধা একটা শাড়িতেই নিজেকে সবসময় সাজায় নৈরা। আজো পরিপূর্ণ ভাবে তৈরি হয়ে নৈরা চমৎকার হাসলো নিজেকে দেখে।
তবে ঘর থেকে বের হতেই বাবা গতিরোধ করে দাঁড়ালো তার। অপ্রস্তুত নৈরা একগাল হাসলো বাবাকে দেখে। নুহাশ মাহমুদ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধায়,
–“কোথায় যাচ্ছেন আম্মা?”

–“বিরঙ্গনাতে বাবা।”, নৈরার ছোট্ট জবাবে নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে বলল,
–“আজ বিরঙ্গনা বন্ধ আম্মা।”

নৈরা যেনো জবাব তৈরি করেই রেখেছিল। চটপটে কণ্ঠে বলল,
–“বিরঙ্গনার কিছু প্রিয় মানুষ আজ দেখা করতে আসবে বাবা। তাদের সাথেই দেখা করতে যাচ্ছি।”

নুহাশ মাহমুদ এই প্রত্যুত্তরেও মৃদু হাসলো। মেয়ের আপাদমস্তক দেখে বলল,
–“আপনার গহনাগুলো কোথায়, আম্মা?”

নৈরা এবার ঝিমিয়ে পড়লো। বাবা অলংকার বিহীন তাকে দেখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না যে! সে মিনমিনে স্বরে বলল,
–“খুলে রেখেছি বাবা। পড়তে অস্বস্তি হয়।”

–“আপনাকে অলংকার ব্যতীত একটুও মানায় না আম্মা। মরা কোষের মতো নির্জীব, অনুজ্জ্বল প্রাণহীন দেখতে লাগে।”

নৈরা চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। অবুঝ কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“জ্বলজ্যান্ত মানুষের থেকে কৃত্রিম পাথরের ক্ষমতা কি বেশি বাবা? ঐ পাথরগুলো কেনো আমার উজ্জ্বলতা, সৌন্দর্য হবে? যেখানে আমার জ্বলজ্যান্ত প্রিয় মানুষগুলো আমার সৌন্দর্যের আসল কারণ। আমার সৌন্দর্য ঐ হিরের পাথরগুলো নয় বরং আমার প্রিয় মানুষটি।”

নুহাশ মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। গভীর কণ্ঠে শুধায়,
–“আপনার প্রিয় মানুষটি কে আম্মা?”

নৈরা অপ্রস্তুত হেসে বলল,
–“তোমরা, তোমরা সবাই আমার প্রিয় মানুষ। আমি আসছি বাবা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

নৈরা বলেই এক ছুটে বেরিয়ে গেলো। নুহাশ মাহমুদ তাকিয়ে রইলেন ছুটতে থাকা মেয়ের পথের পানে। উদাসীন কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“বাবা মায়ের কাছে সন্তান যখন মিথ্যা বলে তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়, আম্মা। যখন মা হবেন তখন বুঝবেন। বাবা তো আছি সবসময় আপনাকে সঠিক ভুলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য। এটাও দেখাবো সন্তান মিথ্যা বললে একজন বাবার কতোট কষ্ট হয়।”

~চলবে~