#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১২
জৈষ্ঠ্যের এই দূর্দমণীয় দাবদাহে, দাপটে সূর্যের তেজকে হঠাৎ করেই সর্বশান্ত করে দিয়ে অসময়ের বৃষ্টি যেনো এক টুকরো প্রশান্তিময় শীতলতার ছোঁয়া নিয়ে আগমন ঘটে ছোট্ট শহুরে বুকে! হঠাৎ গগনের ঠিক কি কারণে বিরাগভাজন হলো যে আগাম বার্তা বিহীন এই বারিধারা’র বর্ষণ হয়ে চলেছে? আকাশে ধূসর মেঘের ঘনঘটা। আপতিত ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে গাছপালা সিক্ত হচ্ছে মন্থর গতিতে। ভিজে উঠেছে পিচের রাস্তাও। ছাতা হাতে একাকী অপেক্ষারত সুঠাম দেহটি গায়ের ভর ছেড়ে একাধারে তাকিয়ে আছে ব্যস্ত রাস্তার পানে। তার অপেক্ষারত দৃষ্টি থেকে উদাসীনতা কেড়ে নিয়ে দৃষ্টি সীমানায় প্রবেশ করে কালো একটি গাড়ি। কাঙ্খিত গাড়িটি! নয়নদ্বয় যে নিজ উদ্যোগে আপ্লুত হলো। গাড়িটি থামলো অনেকটা দূরে রাস্তার ঠিক ওপারে। কালো গাড়ির জানলাটি মন্থর গতিতে খুলতেই শান্ত আঁখিদ্বয়ে আঁছড়ে পড়লো একরাশ উৎসুকতা, আগ্রহ। জানালা ভেদ করে সাদা বকের ন্যায় লম্বাটে ঘাড় বের করে একটি মেদহীন স্নিগ্ধ মুখশ্রী ভেসে উঠলো। শক্ত হাতে ছাতা আঁকড়ে ধরে স্বরূপ একাধারে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ফোঁটায় ফোঁটায় সিক্ত হতে থাকা সেই শুভ্র বরফখন্ডের ন্যায় মুখটির দিকে।
নৈরা বৃষ্টির প্রকোপ আঁচ করতে পেরেই মুখটি ঢুকিয়ে নিলো গাড়ির ভেতর। নম্র কণ্ঠে জমশেদের উদ্দেশ্যে বলল,
–“বাইরে বেশি বৃষ্টি নেই, চাচা। আপনার অতোদূর আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, চলে যান। আমি এখান থেকেই চলে যাচ্ছি।”
জমশেদ শান্ত চোখে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। নৈরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো আজ আর ড্রাইভার চাচাকে কোন হুমকি ধমকি দিতে হয়নি বলে। সে ব্যাগ কপালে ঠেকিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বের হয়। বৃষ্টির ফোঁটা সামলে এদিক ওদিক এলোমেলো ফেললো সে। অদূরে ছাতা হাতে সুঠামদেহী লোকটিকে দেখতেই গন্তব্য সুনিশ্চিত করে নেয়। ওষ্ঠকোনে প্রগাঢ় হাসি নিয়ে নৈরা একহাতে শাড়ির কুচি চেপে এক ছুট লাগালো। অদূরে তখনো একটি উদাসীন দৃষ্টি মেয়েটির উপরেই নিবদ্ধ। ঐ যে ছয়শো টাকার সুতির শাড়িতে আবৃত নারীটিকে দেখতে ঠিক যেনো স্বরূপ ইব্রাহীমের একচ্ছত্র অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে হলো। এহেন অসংলগ্ন কথাবার্তা চিন্তায় আসলেও আজ আর দমালো না স্বরূপ! বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে ওঠা নারী বদন, দৃশ্যমান নগ্ন গোড়ালী, খালি হাত, কান, গলা নিগুঢ় দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই স্বরূপ বিড়বিড় করলো,
–“এক জোড়া নুপুর, একজোড়া চুড়ি, একজোড়া কানের দুল আর একটা লকেট সহ চেইন—এইতো কাঞ্চনবালা স্বয়ংসম্পূর্ণ!”
তবে সাদামাটা কাঞ্চনবালা’র মাঝে স্বরূপ এতোটাই ডুবে গেলো যে মস্তিষ্ক ভুলে বসলো, মেয়েটি রাস্তা পারাপারে অনভ্যস্ত। ছুটতে থাকা মেয়েটিকে দেখতে দেখতে আচমকাই স্বরূপের স্থিবরতা ভঙ্গ হলো ভয়ানক সাইরেনের আওয়াজে। এ যেনো কোন যানবাহনের সাইরেন নয় বরং আগমনী মৃত্যুর শিস ধ্বণী। স্বরূপের আড়ম্বরহীন দেহ দৃষ্টিতে যেনো বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো। সে চকিতে তাকায় বা দিক থেকে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে আসা বাসটির দিকে। অন্তঃস্থল ঈষৎ কেঁপে উঠলো ঈষৎ হারানোর ভয় জেঁকে বসতেই। ভয়ার্ত অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে,
–“নৈরা!”
মস্তিষ্ক অচল হয়ে পড়লো। অস্থির দৃষ্টি ফেলে পুরুষটির দেহ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছাতাটি ছেড়ে ছুটতে লাগলো। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। কিসের এতো তাড়া জানা নেই স্বরূপের। তবে না পেয়েও হারিয়ে ফেলার ভয় কেনো তার মনে? ছুটতে ছুটতে মাঝপথে আসতেই নৈরা’র দেহ অনড় হয়ে গেলো দ্রুতগামী বাসটি দেখে। রাস্তা পারাপারে অনভ্যস্ত মেয়েটির পা দুটো জমে গেলো ভয়ে। বাসটির নৈকট্য তখন বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেলো, কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটির ছিমছাম অবয়ব ও সেঁটে গেলো একটা সুরক্ষিত বলয়ের মাঝে। নৈরা ভয়ার্ত দৃষ্টি তুলে তাকায়। দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় লালচে, অশ্রু টলটলে দুটি ভয়ার্ত দৃষ্টি। স্বরূপ ঊর্ধ্বশ্বাস সামলে ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে,
–“সবকিছুর একটা সীমা থাকা প্রয়োজন নৈরা! এগুলো কি? এতো উদগ্রীবতা কেনো? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন আপনি রাস্তা পারাপার হতে পারেন না? কি হয়ে যেতো আজ? আপ…আপনি দেখলেন না…”
স্বরূপের কণ্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই নৈরার উপর রেগে কিছু ধমক ছুঁড়ে মারলো। এতো কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়ে হয় নাকি! আঁকড়ে ধরা শক্ত হাতটি থেকে পাওয়া ব্যথা সহ্য করে নিয়ে নৈরা মিনমিনে স্বরে বলল,
–“স্বরূপ, লাগছে।”
স্বরূপ মোটেই ছাড়লো না মেয়েটির কনুই। বরং আরো জোরালোভাবে আঁকড়ে ধরলো। দৃষ্টি তার চঞ্চল, শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ক্ষিপ্র। নৈরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল হঠাৎ অশান্ত অস্থির হয়ে পড়া মানুষটার দিকে। মৃত্যুর ভয় ও যেনো ফিকে পড়লো লোকটার মাঝে নিজেকে হারানোর ভয় দেখে। স্বরূপ ফের কঠোর চোখে তাকালো মেয়েটির দিকে। নৈরা স্মিত হাসলো সেই কঠোর দৃষ্টি দেখে। স্বরূপ কপাল কুঁচকে তাকায় তার পানে। আশ্চর্য হয়ে শুধায়,
–“মেয়ে আপনি হাসছেন?”
নৈরা’র ডাগর ডাগর নেত্র তখন টলমলে। ধিমি স্বরে বলে ওঠে,
–“আমার মৃত্যু শঙ্কার কারণে যদি আপনার চোখে, নিজেকে হারানোর ভয় দেখার সৌভাগ্য হয় তবে এমন মৃত্যুর পয়গাম আবারো জারি হোক। আপনি আমায় হারানোর ভয় পান, আর আমার বোকা মন তা দেখে স্বস্তি পাক!”
স্বরূপের হাতের বাঁধন শিথিল হয়ে আসে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। অন্তঃস্থলে প্রশ্ন করে উঠলো,
–“বোকা নারীটির বোকা প্রেমের শিকড় ঠিক কতোটা গভীর?”
–“আরে ঐ মুখপুরী? ধীরস্থির রাস্তা পার হইলে কি তোর পিরিত কমি যাবে?”
অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষিপ্ত কণ্ঠে নৈরা কপট কপাল কুঁচকে স্বরূপকে টপকে উঁকি দিয়ে তাকায় চা ওয়ালীর দিকে। কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে চা ওয়ালী। সে মুখ ঝামটা মেরে শুধায়,
–“কি হয়েছে তোমার?”
চা ওয়ালী চায়ের ছাঁকনি হাতে নেড়ে নেড়ে রাগান্বিত স্বরে বলে,
–“তুই করলি কি মাত্র? বেক্কল মাইয়া? এইভাবে কেউ রাস্তা পার হয়? কিছু যদি হইয়া যাইতো? আস্তেধীরে আসলে কি তোর পিরিত কমি যাবে?”
নৈরা চোখ মুখ কুঁচকে শাসিয়ে বলল,
–“ছিঃ, নোংরা কথা বলবে না বুড়ি। পিরিত কি?”
চা ওয়ালী ছাঁকনি হাতে তেড়ে আসলো তার দিকে। হাত নেড়ে নেড়ে বলে,
–“এই তুই আমায় কথা বলা শিখাবি? তুই আগে জন্মেছিস নাকি আমি?”
–“তাতে কি! তোমার ভাষার ঠিক নেই আমি তা বলবো না?”, নৈরা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হাঁচি দিতে দিতে বলল। চা ওয়ালী ফোঁস ফোঁস করে বলল,
–“আগে নিজে ঠিক করে চলা শেখ খচ্চর মাইয়া। তারপর আমায় কথা শিখাবি। এখনো শাড়ির আঁচলে মুখ মোছে সে আসছে আমায় কথা বলা শিখাতে।”
বলেই চা ওয়ালী নিজের দোকানে চলে গেলো। নৈরা তখনো নিরুদ্বেগ আঁচলে মুখ চেপে হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে। অন্যদিকে স্বরূপ অবাক পানে তাকিয়ে রইল চা ওয়ালী আর নৈরার দিকে। ছোলা ওয়ালা তার দৃষ্টি দেখে হেসে ফেললো। বলল,
–“স্যার, নারী জাতি মানেই সংঘর্ষ!”
স্বরূপ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। মাথাটা ধপ করে ভারী হয়ে উঠলো। বুক ধড়ফড় করছে। সে বুকে হাত চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। হাঁচি দিতে দিতে নৈরা পা বাড়াচ্ছিলো ছাউনির দিকে কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার হাতটা কেউ টেনে ধরলো। নৈরা চমকে তাকায় স্বরূপের ভয়ার্ত মুখের দিকে। হেসে উঠলো মেয়েটি। লোকটার হাতের উপর চাপড় দিয়ে আশ্বস্ত করলো। মিহি স্বরে বলল,
–“এতো ভয়ের কিছু নেই। আপনি ছুঁড়ে না ফেললে কখনো দূরে যাবো না।”
স্বরূপের আঁকড়ে ধরা হাতটি শিথিল হয়ে আসলো মেয়েটির কথার প্রেক্ষিতে। ছুঁড়ে ফেলবে? তার তো আঁকড়ে ধরার ই অধিকার আর যোগ্যতা নেই! নৈরা মলিন চোখে দেখলো ছেড়ে দেয়া হাতটি। মলিন কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“এখনি ছেঁড়ে দিলেন?”
স্বরূপ জবাব দিতে পারলো না। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে ছাউনির নিচে চলে যায়। নৈরাও নাকে আঁচল চেপে এগিয়ে যায়। ছাউনির নিচে যেতেই চা ওয়ালী তার দিকে একটা ওয়ান টাইম টিস্যুর প্যাকেট এগিয়ে দিলো। নৈরা গা দুলিয়ে হাসলো চা ওয়ালীর রাগান্বিত মুখে ভালোবাসা প্রকশের ধরণ দেখে। বলে ওঠে,
–“বুড়ির কি ঢং!”
চা ওয়ালী মুখ বাঁকালো মেয়েটির কথায়। টিস্যুর প্যাকেটটি আবার নেড়ে বাজখঁই গলায় বলে ওঠে,
–“এটা কি আমি আজীবন ধরে বসবো?”
ততক্ষণে আরো একটি হাত তার দিকে একটা টিস্যু বাড়িয়ে দিয়েছে। স্বরূপ খেয়াল করেনি চা ওয়ালীর হাতের টিস্যু। অপ্রস্তুত হলো সে। নৈরা হেসে খপ করে স্বরূপের রুমালটি নিয়ে বলে,
–“তোমার টিস্যু তোমার কাছে রাখো, চাচি।”
চা ওয়ালী টিস্যু রেখে খোঁচা মেরে বলল,
–“হ্যাঁ, আমার টিস্যু নিলে তো তোর পিরিত কমি যাবে।”
নৈরাও মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল,
–“ছিঃ আবার নোংরা কথা বলে। হ্যাঁ, কমে যাবে প্রেম।”
চা ওয়ালী চা বানাতে লাগলো নিজ মনে। ঠোঁটের কোনে তার মৃদু হাসি। প্রতি সপ্তাহে এই মেয়েটির বোকা প্রেম আর ঝগড়া দেখে তার একটা সুন্দর বিকাল কাটে। এখন তার অভ্যাস, এই মেয়েটির মুখ না দেখলে তার দিন ভালো যায় না। ভেবেছিল আজ শুক্রবার টা হয়তো বড্ডো বেরঙ হবে। কিন্তু না হয়নি! সে প্রসন্ন মনে চা বানাতে লাগলো। স্বরূপ নিজেকে শান্ত করে এগিয়ে এসে চা ওয়ালীকে নম্র স্বরে বলল,
–“চাচি একটা দুধ চা দেবেন। একটু মশলা দিয়ে বানাবেন, যেনো হাঁচি ভালো হয়ে যায়।”
চা ওয়ালী ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানালো। নৈরার চোখমুখ তখন উজ্জ্বল। লোকটি তার জন্য চিন্তা করেছে এটাই অনেক। সে চঞ্চল কণ্ঠে শুধায়,
–“আমার জন্য বলছেন? আমি চা খাবো না। দুধ চায়ের তো দরকার ই নেই।”
স্বরূপ থমথমে মুখে বলল,
–“বেশি কথা না বলে চুপচাপ বসুন। আপনার জ্বর এখনো ভালো হয়নি— অথচ আপনি বৃষ্টিতে ভিজছেন। আপনি বড্ড বেপরোয়া, নৈরা।”
নৈরা অস্থির হয়ে পড়লো। মাটির এক ভাঁড় দুধ চায়ের দাম যে বিশ টাকা। এতো টাকা কেনো খরচ করবে স্বরূপ? স্বরূপের কাছে বরাবরই যেনো মেয়েটি এক খোলা পান্না, সে শান্ত স্বরে মেয়েটির অস্থিরতাকে প্রশমিত করে বলল,
–“গতকাল থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত অনেকগুলো কাজ করেছি। একদিনেই ১২০ ডলার আয় করেছি। এতো চিন্তার কিছু নেই।”
নৈরা উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় লোকটির পানে। প্রবল আগ্রহের সাথে শুধায়,
–“সত্যি? একশো বিশ ডলার একদিনে? এ তো অনেক টাকা!”
স্বরূপ মৃদু হেসে ঘাড় নাড়লো। নৈরার অস্থিরতা কমলো, সে ছাউনির নিচে বসে ব্যাগ থেকে এয়ারটাইড কন্টেইনারটি বের করে চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“নিন নিন, ঠান্ডা ঠান্ডা খেয়ে নিন। খুব সুস্বাদু লাগবে।”
স্বরূপ প্রচন্ড আগ্রহের সাথে মেয়েটির হাত থেকে বাটিটি নিয়ে খেতে বসলো। চা ওয়ালী ততক্ষণে চা দিয়েছে নৈরার হাতে। সেই বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ শীতলতায় দশ মিনিট অনায়াসে কাটিয়ে উঠলো দুই মানব মানবী। সন্ধ্যা নেমে যাবে। সবজির বাজারে যেতে হবে। খাওয়া শেষে স্বরূপ চায়ের বিল দিতে গেলে চা ওয়ালী সরু চোখে তাকায় তার দিকে। গম্ভীর গলায় বলে,
–“ঐ খচ্চর মুখপুরী আমার থেকে চা খাবে আর আমি টাকা নেবো? আমার এতো টাকার অভাব পড়েনি।”
স্বরূপ কপাল কুঁচকে তাকায় চা ওয়ালীর দিকে। নৈরা ফোড়ন কেটে বলল,
–“হ্যাঁ, তুমি তো বড়ো লোকের বিটি। তোমার আবার অভাব পড়বে কেনো!”
স্বরূপ মেয়েটিকে চোখে শাসায়। চা ওয়ালীর দিকে জোরপূর্বক টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“গতকাল ও টাকা নেননি চাচি। আজ আমি আপনার কোন কথা শুনছি না। রাখুন এটা।”
চা ওয়ালী হেসে বলল,
–“লাগবে না স্যার। আমি অরে খুব ভালোবাসি। আপনি এটা রাখেন! আপনি শুধু একটু মুখপুরীর বোকামোগুলারে ধইরা রাইখেন এইতেই আমি খুশি।”
টাকা হাতে স্বরূপ এই পর্যায়ে নিরবে হাসলো। আর বরাবরের মতো বোকা মেয়েটির বিষয়ে নিরব হয়ে যাওয়া স্বরূপের নিরবতায় নৈরা ম্লান হাসলো। সে ব্যাকুলতার সাথে অপেক্ষা করছে সেইদিনের যেদিন স্বরূপ আর তাকে এড়িয়ে যাবে না, দূরে ঠেলে দেবে না। বরং ভালোবেসে আগলে নেবে।
নৈরা যাওয়ার বেলায় চমৎকার হাসি নিয়ে চা ওয়ালীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চা ওয়ালী মেয়েটিকে দেখতেই মুখ বাঁকালো। নৈরা হেসে উঠে হাত বাড়িয়ে চা ওয়ালীর গালে থাকা বিশাল আঁচিলের মতো তিলটা ছুঁয়ে দিয়ে বলে,
–“বুড়ি তুমি খুব ভালো। আমি তোমায় খুব ভালোবাসি।”
–“হয়েছে হয়েছে আধিক্ষেতা করতে হবে না।”, চা ওয়ালী থমথমে মুখে বলল। নৈরা ব্যাগে কন্টেইনার ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
–“কাল তোমার জন্য আমি পুডিং বানিয়ে নিয়ে আসবো বুঝলে। আজ তো তোমায় দিতে পারিনি।”
–“লাগবে না তোর পুডিং আমার।”
–“কেনো লাগবে না? খুব মজা হয় খেতে। দেখো না স্বরূপ কি মজা করে খায়? কাল তোমার জন্য ও আনবো। খাবে কিন্তু!”, নৈরা প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল। চা ওয়ালী মৃদু হেসে বলল,
–“আচ্ছা, আনিস।”
নৈরা হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
–“যাই হ্যাঁ?”
–“যাই বলতে নেই, বল আসি।”, চা ওয়ালী ফের বলল। নৈরা যেতে যেতে পা থামায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,
–“আসার হলে যাই বললেও আসবো, চাচি। আর যাওয়ার হলে আসি বললেও ফিরে আসা হবে না। এসব কুসংস্কার বুড়ি।”
চা ওয়ালী মলিন মুখে তাকায় মেয়েটির পানে। বলল,
–“এইসব কুসংস্কার আমগো মতো খুঁতখুঁতে মনরে শান্তি দেয় বেক্কল মাইয়া। বল, আসি।”
নৈরা ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল,
–“আচ্ছা, আসি।”
পকেটে আজ টান না থাকায়, স্বরূপের একটুও ইচ্ছে হলো না আর্থিক সমস্যা গুলোকে প্রকট হয়ে দাঁড়াতে দিতে। সে আজ খোলা হাতে খরচ করতে লাগলো, একটু সুন্দর স্মৃতি জোগানে। বৃষ্টির কারণে ইজি বাইকে করে সন্ধ্যা বাজারে পৌঁছালো নৈরা আর স্বরূপ। নৈরা’র এতে বেশ আপত্তি ছিল বিশ টাকার রিকশা রেখে চল্লিশ টাকা দিয়ে ইজি বাইকে করে যাওয়াতে।
বৃষ্টি ভেজা বিকালে সতেজ সবজির বাজারে ঢুকতেই নৈরা প্রাণোচ্ছল হাসলো। চঞ্চল পায়ে এদিকওদিক ছুটতে ছুটতেই তার দৃষ্টি কাড়লো এক ঝুঁড়ি ব্রকলি। পুরো বাজারে একটা লোকের কাছেই শুধু কিছু ব্রকলি আছে। সাধারণত এখন ব্রকলির সিজন না হওয়ায় পছন্দের সবজিটি পূর্ণ মনোযোগ কাড়লো নৈরার। নিশ্চয়ই সংরক্ষিত নয়তো অন্য কোন উপায়ে উৎপাদন করা। সে ছুটে যায় লোকটির কাছে। ব্রকলি ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে শুধায়,
–“চাচা ব্রকলি ভালো?”
সবজি ওয়ালা ঘাড় নেড়ে বলল,
–“খুব ভালো, খুব ভালো। এই সময়ে হঠাৎ কিছু পাইয়া গেছি। নিয়া আসছি আর এই কটা আছে বিক্রি করলেই শেষ।”
–“কিন্তু এখন তো ব্রকলির সিজন না চাচা?”
–“এইগুলা বিশেষ উপায়ে উৎপাদন করা হইছে মা। অনেক জায়গায় এখন এমন চাষ শুরু করছে। এরপর থেকে দেখবা সব সবজিই বারোমাস পাইবা।”
–“ওহ্।”, নৈরা একগাল হেসে বলল। পরপরই স্বরূপের দিকে তাকিয়ে আবদার করে বলল,
–“স্বরূপ, আজ একটা ব্রকলি নিন না!”
সাধারণত ব্রকলি বেশ নাজুক এবং রেয়ার এক সবজি। একদিনের বেশি রাখলে তা আর খাওয়ার উপযোগী থাকে না। হলুদ হয়ে যায়। তাই বিক্রেতারাও এটা বুঝেশুনে স্টকে রাখেন এবং দামেও বেশ চড়া থাকে। ঠিক এই কারণেই স্বরূপ এই সবজিটাকে একটু এড়িয়ে চলে। একশো টাকা দিয়ে একটা ব্রকলি কেনার থেকে এই দামে তার দুই ধরণের সবজি হয়ে যায়। তবে আজ একটু আগ্রহ দেখালো। সে মেয়েটির পাশে বসে একটি ব্রকলি ছুঁয়ে শুধায়,
–“দাম কতো চাচা?”
–“এই একটা নিবেন? একশো বিশ টাকা দেন। এই সময়ে এই সবজি তো পাওয়া যায় না। পুরো বাজার খুঁজলেও পাইবেন না আমার দোকান ছাড়া। আর দেখেন কতো সতেজ।”, দাম শুনেই স্বরূপের হয়ে গেলো। এটাও বুঝেগেলো লোকটা আজ একা এই সবজি বাজারে তুলে বাজিমাত করেই ছাড়বে। তাই সে অনাগ্রহ প্রকাশ করে নৈরাকে বলল,
–“উঠুন নৈরা। এগুলো নেয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা অন্য সবজি নেই চলুন।”
নৈরা আকুতিভরা চোখে চাইলো। বলল,
–“আজ একটা নিন না। খেতে খুব সুস্বাদু। আমি এটা দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে উঠি জানেন। চিংড়ি মাছ দিয়ে খেতে খুব মজা। একটা নিন প্লিজ স্বরূপ। চাচা দাম কমিয়ে রাখবে। এই চাচা কমিয়ে দাম রাখবেন না বলুন?”
নৈরা দোকানদারের উদ্দেশ্যে শুধায়। স্বরূপ ডানে বামে মাথা নেড়ে তাকে বলল,
–“ব্রকলির দাম একশো বিশ টাকা, সেটা নাহয় মেনে নিলাম,নৈরা। কিন্তু চিংড়ি? চিংড়ির কেজি কতো জানেন সাতশো টাকা! আর বড়ো চিংড়ি বারোশো টাকা। তাই এটা কেনার ইচ্ছা ছাড়ুন, উঠে আসুন।”
নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বলল,
–“চিংড়ি ছাড়াও খেতে ভালো লাগবে নিশ্চয়ই। আপনি একটা কিনে খেয়েই দেখুন না!”
–“আচ্ছা, আমি এটা বিশ টাকা দেবো, চাচা দিলে নিয়ে নিন!”, স্বরূপ গা ছাড়া ভাবে বলেই হেঁটে অন্যদিকে চলে যায়। নৈরা মুখ ছোট করে তাকায় লোকটির পানে। দোকানদার স্বরূপের বলা দাম শুনে উপহাসের সুরে বলে ওঠে,
–“বিশ টাকায় নষ্ট একটা ব্রকলি ও দেবে না কেউ!”
নৈরা কপাল কুঁচকে নিলো তার কথায়। বলল,
–“বিশ টাকা দিয়ে আপনার থেকে কেউ নষ্ট ব্রকলি কিনবে কেনো?”
লোকটি বিরক্ত হলো বেশ। বলল,
–“আরে আপনারা কেনবেন না সবজি তো এতো দামদড় করতাছেন কেনো! যান গিয়ে বিশ টাকার সবজি কিনেন।”
নৈরা উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ব্রকলি গুলো ছুঁলো। তার খুব ভালোলাগে স্বরূপকে ভালো ভালো সবজি কিনতে দেখতে, খেতে। লোকটার রিজিকে পৃথিবীর সব ভালো, সুস্বাদু খাবার গুলো জুটুক। সে দোকানদারের দিকে নম্র চোখে তাকায়। অনুনয় করে বলে,
–“এই একটা ব্রকলি বিশ টাকায় দিন না চাচা। আপনার তো অনেক বিক্রি হয় প্রতিদিন। একটা একটু লসে বিক্রি করলে কি খুব ক্ষতি হবে?”
–“আরে আপনি ঝামেলা কইরেন না তো! একশো বিশ টাকার সবজি বিশ টাকায় কোন পাগলে দেবে? যান তো! ব্রকলি না খাইলে কেউ কি মরে যাবে? স্যারের নিজের ও ইচ্ছে নাই ব্রকলি কেনার।”
নৈরা হাল ছাড়লো না বলল,
–“উনি দামের কারণে কিনতে চাইছে না। প্লিজ চাচা, দিন না। আমি আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করবো আপনার জন্য যেনো আপনার অনেক সবজি বিক্রি হয়। আর..
বলেই নৈরা গলির স্বর নিচু করলো। ডাগর ডাগর নেত্র মেলে লোকটাকে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“আপনি যদি এটা বিশ টাকায় ঐ লোকটাকে দিয়ে দেন তবে আমি আপনাকে এর বিনিময়ে পাঁচশো টাকা দেবো। প্লিজ চাচা দিয়ে দিন।”
লোকটি হাবাগোবা চোখে তাকিয়ে রইল অত্যাধিক পরিমাণে বোকা একটি মেয়ের দিকে। বিভ্রান্ত হয়ে শুধায়,
–“কি? আপনি একশো বিশ টাকার সবজি বিশ টাকায় নেয়ার জন্য আমারে পাঁচশো টাকা দেবেন? কিন্তু একশো বিশ টাকা দিয়ে এটা নিতে পারবেন না?”
নৈরা ডানে বামে মাথা নাড়ে। পারবে না। লোকটি বিরক্ত হয়ে উঠলো এবার। বলল,
–“যান তো, আপনি মজা কইরা আমার সময় নষ্ট করতাছেন।”
নৈরা সবেগে ঘাড় নেড়ে বলল,
–“না না, আমি মজা করছি না। আপনি যদি এটা বিশ টাকায় আমায় দেন তবে আমি সত্যিই আপনাকে পাঁচশো টাকা দেবো। এই নিন আপনি বরং আগেই নিন।”
নৈরা স্বরূপের অগোচরে ব্যাগ থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিলো। লোকটি হতভম্ব হয়ে গেলো। নৈরা আবার শুধায়,
–“দেবেন চাচা?”
লোকটি অপ্রস্তুত মাথা নেড়ে সায় জানায়। সহসা নৈরা আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো। অদূরে সবজি কিনতে থাকা স্বরূপকে ডেকে আনন্দের সাথে চেঁচিয়ে বলে,
–“স্বরূপ, স্বরূপ চাচা বিশ টাকায় ব্রকলি দিয়েছে। তাড়াতাড়ি আসুন, টাকা দিন।”
স্বরূপ কপাল কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে এগিয়ে আসে। দোকানদারের দিকে তাকিয়ে শুধায়,
–“কি হলো আপনি একশো বিশ টাকার ব্রকলি বিশ টাকায় দিয়ে দিলেন?”
লোকটা কে কথা বলতে হলো না নৈরা’ই বলে উঠলো,
–“দিয়েছে দিয়েছে, আমি দামদড় করেছি। আপনি বিশ টাকা দিন।”
নৈরা একটা ভালো দেখে ব্রকলি হাতে তুলে নিয়ে বলল। স্বরূপ ঘাড় নেড়ে পকেট থেকে টাকা বের করে দিলো। কিন্তু এবার দোকানদার লোকটির খারাপ লাগতে শুরু করলো। স্বরূপ অন্য সবজির দোকানে গেলে লোকটি নৈরার দিকে টাকাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“এই আপনার টাকা আপনি নেন। আমার লাগবে না পাঁচশো টাকা। আপনার ব্রকলি বাবদ যা দিতে ইচ্ছা হয় দিয়ে নিয়ে যান।”
নৈরা চমৎকার হেসে বলল,
–“ওটা আমি আপনাকে খুশি হয়ে দিয়েছি চাচা। রাখুন। এমনিতেও এগুলো আমার ব্যাগে পড়েই থাকে। খরচ করার জায়গা নেই। আপনি রাখুন ওটা।”
বলেই নৈরা চলে যায়। লোকটি চরম অস্বস্তি নিয়ে টাকাটা নিয়ে বসে রইল। টাকা নাকি কারোর ব্যাগে পড়ে থাকে? সবজি কিনে দু’জনে বের হতেই দেখলো বৃষ্টির বেগ কমে গিয়েছে। এখন সবাই স্বাচ্ছন্দ্যেই চলাফেরা করছে খোলা রাস্তায়। তারা কতোদূর হাঁটতে লাগলো। স্বরূপ হাঁটতে হাঁটতে মেয়েটির দিকে আড়চোখে তাকায়। আধভেজা আধশুকনো শাড়ি গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সে মিহি স্বরে বলল,
–“সবজি কেনা তো শেষ, এখন বাসায় যান নৈরা। নয়তো জ্বর আসবে এভাবে।”
মানুষটার সঙ্গ ফুরিয়ে আসার ক্ষণ সর্বদাই নৈরা’র জন্য সবচেয়ে ক্লেশদায়ক। সে পা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। বরাবরের মতো অনৈতিক অযাচিত আবদার করে বলে,
–“আরেকটু থাকি? আপনার তো আজ ছুটি কোন কাজ নেই।”
বরাবরের মতোই মেয়েটির অযাচিত আবদার গুলোকে প্রশ্রয় দেয়া স্বরূপ নিরবে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির পানে। মেয়েটি নিরবতাকে হ্যাঁ ধরে নিয়ে আবার দিগন্তে দৃষ্টি রেখে চলতে শুরু করলো।
*****
ভেজা মাঠের একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে বুব্বো। মলিন দৃষ্টিতে এঁটে আছে মাঠের চারিপাশে একের পর এক গড়ে ওঠা প্রাচীর। তার দম বন্ধ হয়ে আসে এই দেয়ালগুলো দেখলে। আজ বহুদিন বাদ নোমান কাজের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে আসে সাউথ সেন্টার রোডে। পরিচিত প্রিয় মুখটি দেখতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। নিশুর হাত ধরে ধীরপায়ে এগিয়ে যায় নোমান। ঠিক বুব্বোর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। একহাতে ছেলেটিকে নিজের সাথে আগলে নিতেই বুব্বো ঘাড় উঁচিয়ে তাকালো। নোমান হেসে শুধায়,
–“কেমন আছেন ক্যাপ্টেন?”
বুব্বো মলিন হেসে মাথা নাড়লো। বলল,
–”ভালো আছি।”
–“কিন্তু আমি তো দেখছি তোমার মন খারাপ!”
বুব্বো এবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় ঠিক নোমানের সম্মুখ বরাবর। নম্র কণ্ঠে বলে,
–“তোমরা এখানে দালান করছো কেনো? করাটা কি খুব জরুরী? করোনা প্লিজ। এখানে দালান করলে আমরা আর ক্রিকেট প্রাকটিস করতে পারবো না। আমার মামুর কাছে এখন তেমন টাকা নেই যে আমায় কোন ক্লাবেও ভর্তি করাবে। আমি যদি প্রাকটিস না করতে পারি তবে আমি বড়ো একজন ক্রিকেটার ও হতে পারবো না। আমার যে খুব ইচ্ছে একজন বড়ো ক্রিকেটার হওয়ার। মামু আর মা খুব কষ্ট করে জানো টাকা ইনকাম করার জন্য। আমি যদি বেশি বেশি প্রাকটিস করে ভালো খেলতে পারি তবে আমি খুব তাড়াতাড়ি টাকা ইনকাম করতে পারবো। আর মামু আর মায়ের চিন্তা দূর করে দিতে পারবো। তুমি তো এখানকার মালিক, তুমি তাদের বারন করো না, প্লিজ বন্ধু।”
নোমান মুগ্ধ হয়ে শুনলো বাচ্চা ছেলেটির নিখাদ, স্বচ্ছ, ভালোবাসায় পরিপূর্ণ পরিকল্পনা। নোমান তাকায় সদ্য গড়ে ওঠা প্রাচীর গুলোর দিকে। সম্পদের বিস্তৃতি ঘটানো বাবার নেশা। সে সবার থেকে এই কারণেই এগিয়ে কারণে এই শহরের বলতে গেলে সব জায়গাতেই তার কোন না কোন স্থাপত্য রয়েছে। যা তার একাধিক আয়ের উৎস। হঠাৎ মনে প্রশ্ন জাগলো এই ছোট্ট ছেলেটির আবদারটি রাখলে কি খুব লোকসান হবে তাদের? শহরের বুকে একটা খোলা জায়গা রাখলে কি তারা না খেয়ে মরে যাবে? না তো! সে মৃদু হেসে হাঁটু গেড়ে বসলো। বুব্বোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–“ক্যাপ্টেনের এতো সুন্দর ইচ্ছে আল্লাহ পূর্ণ করুক। মামা, মায়ের সকল চিন্তা দূর করো। আমি চেষ্টা করবো তোমাদের এই খেলার মাঠ অক্ষত রাখার কিন্তু কথা দিতে পারছি না বিভোর। কারণ এটা তোমার বন্ধুর নয় বন্ধুর বাবার জায়গা। আমি তার সাথে কথা বলবো ঠিক আছে?”
বুব্বো প্রগাঢ় হাসলো। নিশু ও চটপটে কণ্ঠে বলল,
–“এই ছোট ক্রিকেটার আমিও দাদুভাইকে বলবো যেনো তোমাদের খেলার জায়গা নষ্ট না করে। বুঝলে?”
বুব্বো ঘাড় দুলালো। নোমান নিশুর সাথে বিগত তিনমাসে বুব্বো একদম কাছের মানুষের সাথে মিলে গিয়েছে।
*****
ফুটপাত ঘেঁষে হাঁটতে থাকা দুই পথিকের হঠাৎ দৃষ্টি আকর্ষণ করলো একটি অতিসজ্জিত খোলা মাঠ। যেখানে অনেক রঙচটা আকর্ষণীয় কাপড় দিয়ে সাজানো গোছানো, আর অনেক মানুষের ভীড়। হয়তো ওখানে মেলা হচ্ছে কোন! ঐ তো নাগোরদোলা দেখা যাচ্ছে। স্বরূপ দাঁড়িয়ে যাওয়া মেয়েটির দৃষ্টি অনুসরণ করে শুধায়,
–“যাবেন, মেলায়?”
নৈরা চমৎকার হেসে ঘাড় দোলালো। স্বরূপ হাঁটা ধরলো সেদিকে। তারা মেলায় ঢুকলো। বাহারি রকমের খাবার, হাতের তৈরি অলংকার, কারুকার্য খচিত শৈল্পিক জিনিসে রমরমা এক পরিবেশ সেথায়। নৈরা প্রবল আগ্রহের সাথে প্রতিটা স্টল ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। স্বরূপ একটি মেয়ের স্টলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে হাতে তৈরি অলংকার সহ হাতে বোনা পোশাক আরো নানা সাজসজ্জার জিনিস রয়েছে। তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো কড়ি বসানো চুড়ি সহ কাঠের আর মুক্তো পাথরের অলংকার গুলো দেখতেই। সে সেখান থেকে বেছে বেছে একই ধরণের তিন জোড়া চুড়ি, তিন জোড়া কানের দুল, দু’টো গলার হার আলাদা করলো। দোকানের মেয়েটি আলাদা করা অত্যন্ত সুন্দর কারুকাজ খচিত অলংকার গুলো দেখে শুধায়,
–“এগুলো দেবো স্যার?”
স্বরূপ কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত চোখে তাকালো মেয়েটি আর হাতের অলংকার গুলোর দিকে। পরপরই তাকায় পাশের দোকানে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে থাকা মেয়েটির পানে। সে বাছাই করা মেরুন রঙা চুড়িগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলো। নিতান্তই ঠুনকো কিছু অলংকার, মেয়েটি পড়বে কি? এতো ঠুনকো জিনিস দেয়াও তো কেমন দেখায়! পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান এক রত্নের বদনে এমনকিছু শোভা তো পাবেই না বরং অপমান হবে। সে মেয়েটির দিকে তাকায়। মৃদু হেসে নাকোচ করতে যাবে, তখনি চোখের সামনে একটি নগ্ন হাতের কব্জি ভেসে উঠলো। স্বরূপ সোজা দৃষ্টি রাখে হাতের মালিকের মুখপানে। নৈরা স্মিত হেসে বলল,
–“আমায় একজোড়া চুড়ি কিনে দেবেন আমি আজ টাকা আনিনি। নয়তো চাইতাম না। আমি বরং কাল আপনাকে ফেরত দিয়ে দেবো। এগুলো খুব সুন্দর। দেখুননা আমার শাড়ির সাথে মিলে গিয়েছে।”
স্বরূপের নির্নিমেষ চাহনিতে অপার স্নিগ্ধতা। সে মৃদু হেসে চুড়িগুলো নিজ উদ্যোগে মেয়েটির হাতে পড়িয়ে দিলো। দুই হাতে চার জোড়া চুড়ি সেজে যেতেই হাত দুটো পরিপূর্ণ সৌন্দর্যে সেজে উঠলো। এবার আর দ্বিধাগ্রস্ত দেখাগেলো না স্বরূপকে। সে দোকান থেকে আরো কিছু অলংকার বাছতে লাগলো। একজোড়া ঝুমকা, একটা গলার হার একজোড়া সিলভার প্রলেপের নুপুর নিয়ে সে মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিলো। বলল,
–“চুড়ির মতো এগুলো পড়লেও আপনাকে সুন্দর লাগবে।”
নৈরা খপ করে নিয়ে নিলো সবগুলো অলংকার। সে ধীরস্থির সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সবগুলো অলংকার জড়ালো গায়ে। অতঃপর নিজেকে দেখিয়ে একগাল হেসে শুধায়,
–“কেমন লাগছে আমায়?”
প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপের ঠোঁটের কোনা ঠিকরে মোহনীয় হাসি ফুটে উঠলো। ধিমি স্বরে বলল,
–“নিখুঁত কাঞ্চনবালা।”
ঠিক চতুর্থ বারের মতো শোনা এই অদ্ভুত সম্বোধনে নৈরা কপাল কুঁচকে শুধায়,
–“কাঞ্চনবালা কি? আপনি আমায় কাঞ্চনবালা বলেন কেনো?”
স্বরূপ নিরুদ্বেগ শান্ত স্বরে বলল,
–“কাঞ্চনবালা মানে সোনালী যুবতী। এমন একজন মানুষ যে নিমিষেই কারোর ক্লান্তি, ক্লেশ শুষে নিতে পারে। নিজের আলোয় সামনের মানুষটাকে আলোকিত করার ক্ষমতা রাখে।”
নৈরা মুখ বিকৃত করে শুধায়,
–“সোনালী যুবতী? ক্লান্তি ক্লেশ? আমি আবার কার ক্লান্তি, ক্লেশ শুষে নিলাম?”
স্বরূপ হেসে বলল,
–“কারোর তো নিয়েছেন। আসুন এখান থেকে আরোকিছু অলংকার পছন্দ করে দিন আমায়।”
নৈরা চঞ্চল দৃষ্টি ফেলে শুধায়,
–“আপনার মা আর আপার জন্য তাই না? দিন দিন আমি পছন্দ করে দেই।”
নৈরা উৎসুক বদনে সাধনা আর শুনিতার জন্য অলংকার বাছাই করে দিলো। তারা সেখানে আরো কিছু সময় ঘুরলো, মেয়েটিকে তার পছন্দের ফুচকা, পানি পুড়ি খাওয়ালো। সন্ধ্যা ততক্ষণে নেমে গিয়েছে, বুব্বোর জন্য বেলুন আর কিছু খাবার কিনে মেলা থেকে বের হতে হতে। পথিমধ্যে মালাই আইসক্রিম দেখতেই নৈরার গতিরোধ হলো। সে কোনা চোখে তাকায় স্বরূপের দিকে। মিনমিনে স্বরে বলে,
–“একটা মালাই খাই?”
স্বরূপ গা দুলিয়ে হাসলো মেয়েটির মিনমিনে স্বরে। তার টাকা খরচ হবে এমন সব আবদার মেয়েটি বড্ডো বুঝেশুনে করে। সে নিরুত্তর মালাই আইসক্রিম কিনে আনলো। মেয়েটির হাতে এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“এতো ইতস্ততার কিছু নেই। যা খেতে ইচ্ছে করে মন খুলে বলতে পারেন। এই মাসের লোনের টাকা অনেক আগেই গোছানো হয়ে গিয়েছে। এখন যেটুকু বাড়তি ইনকাম হচ্ছে তা মনখুলে খরচ করার জন্য।”
নৈরা আপ্লুত হলো। উৎসুক কণ্ঠে শুধায়,
–“লোনটি শেষ হলেই আপনার সব চিন্তা শেষ হয়ে যাবে তাই না?”
স্বরূপ মাথা নেড়ে সায় জানায়। মেয়েটি তৎক্ষণাৎ একগাল হেসে বোকাসোকা মিনমিনে কণ্ঠে শুধায়,
–“তবে নৈকট্য নিশ্চয়ই দূরে নয়?”
স্বরূপ কপাল কুঁচকে নেয়। শুধায়,
–“কিসের কথা বলছেন?”
মেয়েটি তৎক্ষণাৎ চুপসে গেলো। জবাব না দিয়ে আইসক্রিম খেতে লাগলো। স্বরূপ হেসে উঠলো মেয়েটির মুখ লুকানো দেখে। ডানে বামে মাথা নেড়ে শুধায়,
–“আপনার বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে নেই, কাঞ্চনবালা?”
নৈরা হাঁটতে হাঁটতে উদাসীন কণ্ঠে বলে ওঠে,
–“আপনি রেখে দিলে আমি আজীবন থেকে যাই।”
অস্ফুট ভেসে আসা সেই কথাটি শুনলো স্বরূপ। এবং বরাবরের মতোই এড়িয়ে গেলো। আজ আর জমশেদের সাথে বাড়ি ফিরলো না নৈরা। সেই দিনটি একটা পরিপূর্ণ দিন হয়েই নৈরার জীবনে প্রকট হয়। একই রিকশার পাশাপাশি লম্বা একটা পথ পারি দিলো দু’জন।
বাসা থেকে কিছুটা দূরে নামলো নৈরা। পরিপূর্ণ সেই সুখী দিনটির স্মৃতি আঁকড়ে ধরে নৈরা আরেকটু লোভী হয়ে উঠলো। তার লোভী মন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন ছুঁড়ে শুধায়,
–“এমন দিন আবার আসবে তো?”
স্বরূপ নিটোল চোখে চেয়ে মলিন হাসলো। মিহি স্বরে বলল,
–“আল্লাহ্ চাইলে অবশ্যই আসবে।”
নৈরা ঘাড় দোলালো। বলল,
–“চাইবে, আল্লাহ অবশ্যই চাইবে।”
স্বরূপ মলিন হেসে বলল,
–“এখন বাসায় যান নৈরা।”
নৈরা কৃত্রিম হেসে পা বাড়ায়। যেতে যেতে ফিরে তাকায়। আবদার করে বলে,
–“চায়ের দোকানে আসবেন কিন্তু।”
স্বরূপ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে মেয়েটির গমনের পথে। বিড়বিড় করে বলে,
–“আপনি বড্ডো লোভী কাঞ্চনবালা সাথে আমাকেও লোভী করে তুলছেন। লোভ যে ভালো নয়।”
রাত বাড়লো। বোকা মেয়েটির জীবনে তথাকথিত গুরুত্বপূর্ণ লহমা হয়ে আজো ঘড়ির কাঁটায় সাড়ে নয়টা বাজলো। চায়ের দোকানের কাঠের বেঞ্চিটিতে শোভা পায় লুঙ্গি টিশার্ট পড়া সেই সাদামাটা মানুষটি। পাশে রোজকার মতো লেজ গুটিয়ে বসে আছে একটি কুকুর। তবে আজ আর পর্দার আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে নৈরা দেখলো না মানুষটাকে।
কানে ফোন ঠেকিয়ে নৈরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বরূপের দিকে। যে কি-না বিভ্রান্ত চিত্তে নিজের হাতের কন্টেইনারটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। নিজের ফোনটি বেজে উঠতেই স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে। হেঁটে যায় একটু কাছে। ঠিক মেয়েটির বারান্দা বরাবর দাঁড়িয়ে, ফোনটি কানে তুলে কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“এটা কি পাঠিয়েছেন নৈরা?”
নৈরা মৃদু হেসে বলল,
–“চিংড়ি মাছ। এগুলো দিয়ে ব্রকলি রান্না করবেন। খেয়ে আমায় জানাবেন কিন্তু কেমন খেতে!”
স্বরূপ বিতৃষ্ণা ভরা দৃষ্টিতে তাকায় মেয়েটির দিকে। অসন্তোষের সাথে বলে ওঠে,
–“আপনি উন্মাদ নৈরা।”
নৈরা ম্লান হেসে বলল,
–“আমার সকল উন্মাদনা আপনি জুড়ে হোক।”
দোতালার অন্ধকারাচ্ছন্ন পোর্চে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা নোমান স্মিত হাসলো নিজের বোকা বোন আর অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্রত্যাশিত এক মানুষের প্রেমময় দৃষ্টি আলাপন দেখে। দুই জোড়া দৃষ্টিতে একে অপরের জন্য রাজ্যের মায়া যে! রোজ সাড়ে নয়টা বাজলেই বোনের ঘর থেকে ভেসে আসা এলার্ম বাজার শব্দ, হুটহাট বোকাসোকা চঞ্চল লুকোচুরির আচরণ, কাক ডাকা ভোরে বোনকে রান্নাঘরে দেখা, শখ করে কারোর জন্য রান্না করা, অজশ্র মিথ্যা বলার কারণটি জানার জন্য উদগ্রীব ছিল তার অন্তঃস্থল। তার বোকা বোন কি জানে না, সে সকলের কাছে এক খোলা পান্না।
নোমান মৃদু হেসে ঘরে ঢুকে গেলো। তবে আজ আর বোনকে বোকা বলে আখ্যায়িত করতে ইচ্ছে হলো না বরং মনে হলো তার বোকা বোনটি মানুষ পরখে সুদক্ষ।
~চলবে~