কাঞ্চনবেলা পর্ব-১৪

0
17

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৪

কথা ছিল পথটা দীর্ঘ হবে, রোজ একটা কাঞ্চনবেলা বোকা কাঞ্চনবালার নামে থাকবে, স্টিলের বেঞ্চিটি তার সৌন্দর্য ধরে রাখবে, চা ওয়ালীকে নিজের হাতের রান্না খাওয়াবে…. কিন্তু সেই বৃষ্টিভেজা বিকালের পর স্বরূপ আর নৈরার দেখা হয়নি। স্টিলের বেঞ্চিতে অস্থির উদ্বিগ্নতা নিয়ে মেয়েটিকে ক্লান্ত মানুষটার জন্য অপেক্ষা করতে দেখে চক্ষু শীতল করার সুযোগ হয়নি চা ওয়ালীর।
নিজের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত উদাসীনতায় নৈরার জ্বর মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। পুরোটা দিন চোখ খুলতে পারেনি নৈরা। যখন চোখ খুললো তখন রাত আটটা। চারিপাশে পরিবারের লোকজন সহ একজন ডাক্তারের উপস্থিতি মেয়েটির ঘর জুড়ে। কিন্তু জ্বরগ্রস্থ মেয়েটির নিশ্চল মাথায় তখনো শুধু একটা নাম এবং সেই নাম জড়িত সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। সে চকিতে উঠে বসলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে দূর্বল কণ্ঠে মায়ের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“মাম্মা, বাজে কয়টা? আমি কতক্ষন ঘুমিয়েছি? আমায় বিরঙ্গনায় যেতে হবে। দেরি হয়ে গিয়েছে কি?”

মিতা মলিন মুখে তাকায় মেয়ের দিকে। গালে হাত বুলিয়ে বলে,
–“এখন রাত আটটা বাজে আম্মা। বিরঙ্গনায় যাওয়ার সময় চলে গিয়েছে।”

নৈরা বিস্ফোরিত চোখে তাকায়। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“রাত আটটা?”

মুহুর্তেই নৈরার চোখ নোনাজল ছেঁড়ে দেয়। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে অস্ফুট স্বরে বলতে লাগলো,
–“আটটা…আমি বিরঙ্গনায় যেতে পারিনি। আজ আমার বিরঙ্গনায় যাওয়ার কথা ছিল…সবজি কিনতে পারিনি। ”

নৈরা অচেতনের ন্যায় কাঁদছে আর উল্টাপাল্টা বকে যাচ্ছে।
কক্ষের বা পাশের কাউচে বদ্ধ নেত্রে বসা নুহাশ মাহমুদের বদ্ধ নেত্রদ্বয় সবেগে খুলে গেলো। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেয়ের ভঙ্গুর, ফ্যাকাসে কান্নারত মুখটির দিকে। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে মেয়ের মুখপানে
রাগে, ক্ষোভে বিষিয়ে তুললো মন। মেয়ে যে নিজের মাঝেই নেই। এই অসুস্থ শরীরেও সে কারোর মাঝে ডুবে আছে। নিজের শরীরের পরোয়া না করেই সে এতোদিন পাগলের মতো বিরঙ্গনায় ছুটতো! কি আছে ঐ সাদামাটা এক ব্যাংকারের মাঝে? কেনো নৈরা এতো পাগল তার জন্য? নিরাদ কি তবে ঠিক বলে? নৈরার ব্রেইন ওয়াশ করে ফেলেছে ঐ ব্যাংকার! এতো দিন শান্তভাবে বিষয়টাকে সামাল দিতে চাইলেও আর নিতে পারলো না নুহাশ মাহমুদ। সে থমথমে মুখে কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। কক্ষ থেকে বের হতে হতে গমগমে স্বরে আদেশের সুরে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলে যায়,
–“ওকে খাবার খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দেবে মিতা। আর রাতে এখানেই থাকবে। ঘুমের ওষুধ দিতে ভুলবে না।”

নৈরা চমকে বাবার দিকে তাকায়। বিস্ময় নিয়ে শুধায়,
–“ঘুমের ওষুধ? তোমরা আমায় ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিলে সকালে? এর জন্যই আমি এতো ঘুমিয়েছি তাই না? তোমরা আমায় ঘুমের ওষুধ কেনো দিয়েছো?”

পাশে দাঁড়ানো ডাক্তার ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
–“তুমি নিজের শরীরের উপর চাপ সৃষ্টি করছো মামনি। জ্বর, ঠান্ডা তোমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। শরীরের প্রতি এতো অযত্ন অবহেলা করলে তো শরীর ভেঙে পড়বে। তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন প্রচুর। তাই আমার সাজেস্টেই তোমায় ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়েছিলো।”

নৈরা শোনেনা সে রাগে চিৎকার জুড়ে দেয় তাকে ঘুমের ওষুধ কেনো দেয়া হয়েছে সেই কথার জের ধরেই। মিতা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় স্বামীর দিকে। অবাক হয় স্বামীর চোখে মেয়ের প্রতি রাগের আভাস দেখে। নুহাশ মাহমুদ ক্ষোভে ভরা দৃষ্টিতে দেখে চলেছে মেয়ের কান্না। একজন পরপুরুষ তার মেয়েটার জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো! শরীর, বাবা মা, পরিবার কোনকিছুর তোয়াক্কা করছে না। সে ইশারায় ডাক্তারের দিকে তাকালো। ডাক্তার চোখে আশ্বস্ত করে তাকে। নৈরা সেই রাতে ঘুমের ওষুধের ভয়ে কোন ওষুধ ই মুখে তুললো না। কিন্তু সে জানেই না তাকে ইনজেকশনের নাম করে ঘুমের ওষুধ অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছে।
নিস্তেজ জ্বরগ্রস্থ দেহ নিয়ে নৈরা পড়ে রইলো বিছানায়। ঘর তখন শূন্য। কয়েকদফা যুদ্ধ করে মিতা আর মেহেক খাবার খাইয়েছে। নিভু নিভু আঁখি নিয়ে নৈরা ফোন হাতরে বের করলো। কাঙ্খিত নাম্বারটিতে ফোন দিতেই সাথে সাথে রিসিভ হলো। বদ্ধ নেত্রে নৈরা প্রফুল্ল হাসলো সাথে সাথে ফোন রিসিভ হতেই। সে ঘুম জড়ানো দূর্বল কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
–“স্বরূপ!”

কর্নকুহর চিরে মেয়েটির কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হতেই স্বরূপ দেহের ভর ছেড়ে পা গুটিয়ে বসলো বিছানায়। গতকাল রাতের পর আর মেয়েটির খোঁজ না পেয়ে বিচলিত ছিলো তার অন্তঃপুর! সে ম্লান হেসে শুধায়,
–“জ্বর বেড়েছে তাই না?”

নৈরা বদ্ধ নেত্রে মলিন হাসলো। মিহি স্বরে বলল
–“আই হেইট ফিভার! এটা কেনো হয়? সকালে ঘুমিয়েছি আর রাত আটটায় উঠেছি।”

–“বলেছিলাম নিজের প্রতি এতো উদাসীনতা করবেন না। শোনেন নি। দেখলেন তো পরিণাম?”

–“আর কখনো উদাসীনতা করবো না প্রমিজ। এবারের মতো জ্বরকে চলে যেতে বলুন না।”

স্বরূপ নিঃশব্দে গা দুলিয়ে হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল,
–“আপনার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে নৈরা। ঘুমিয়ে পড়ুন।”

নৈরার চোখের কার্নিশ নোনাজলে সিক্ত। বলল,
–“বাবা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ছিল আমি জানতাম না। তাই বিরঙ্গনায় আসতে পারিনি। আপনি কি সবজি কিনেছিলেন?”

–“সবজি কেনার সঙ্গী ছাড়া সবজি কিনবো কি করে?”, স্বরূপের কথায় নৈরার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। যাক আজ তবে একটা নাম পেয়েছে তাদের নামহীন সম্পর্ক। সবজি কেনার সঙ্গী —ভেবেই হাসলো নৈরা। শুধায়,
–“কেনেন নি কেনো? কাল খাবেন কি?”

স্বরূপ উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো। জ্বরের ঘোরে মেয়েটি হয়তো ভুলে গিয়েছে আজ মাসের শেষ দিন। লোন পরিশোধের দিন। হাতের সব টাকা একদম গুছিয়ে দিয়ে দিতে হয়েছে। এখন অল্পকিছু টাকা আছে! সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
–“একটা সুখবর শুনবেন?”

–“বললে শুনবো।”

–“আমার বেতন স্কেল বেড়েছে।”

–“সত্যি?”, নৈরা ঝট করে চোখ খুলে শুধায়। স্বরূপ মৃদু হেসে বলল,
–“হু, এটা একটা সমস্যার কারণে আঁটকে ছিলো দুই বছর যাবৎ। আমি যেই পোস্টে রয়েছি এই পোস্টে সাধারণত এতো কম বেতন থাকে না। কিন্তু ঐ সমস্যাটির কারণে আমার বেতন স্কেল কম ছিল। এই সপ্তাহে সমস্যাটা সমাধান হয়েছে। এখন বেতন বেড়েছে। আল্লাহ চাইলে আর কিছুদিনের মাঝে হয়তো প্রমোশন হয়ে ম্যানেজার ও হয়ে যাবো। তখন আর পিছু ফিরে তাকাতে হবে না।”

ঘুমে জড়িয়ে আসা আঁখি নিয়ে নৈরা শুনলো সেই সুখের বার্তাটি। লোকটির জন্য এটা শুধু বেতন স্কেল আর তার জন্য তার গোটা জীবনের সুখের কারণ। স্বরূপ তো এই কারণেই তার অনুভূতি স্বীকার করতে নারাজ। সে প্রার্থণা করলো পৃথিবীর সকল সফলতা লোকটার ঝুলিতে থাকুক। সে ভেজা ঘুম জড়ানো আঁখি নিয়ে দূর্বল কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“পৃথিবীর সকল সফলতা আপনার হোক আর আপনি আমার।”

স্বরূপ স্পষ্ট শুনলো সেই দূর্বল জড়ানো কণ্ঠ। ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। দৃষ্টিদ্বয় টলটল করে উঠলো। সেও ফিসফিসিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“আমিন।”

তবে মেয়েটি শুনলো না সেই অস্ফুট শব্দটুকু্। কানে ফোন ঠেকিয়ে সে ইতিমধ্যেই ঘুমের সাথে দ্বন্দ্বে হেরে গিয়েছে। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে স্বরূপ দুই বার ডাকলো কিন্তু সাড়াশব্দ পেলো না। একটাসময় ফোনটি আপাআপনিই অপরপ্রান্ত থেকে কেটে গেলো। স্বরূপ বুঝে নিলো মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়েছে।

নুহাশ মাহমুদ ফোনটা মেয়ের কানের উপর থেকে উঠিয়ে বেডসাইড মিনি কাবার্ডের উপর রেখে দিলো। বুক ভরা নিঃশ্বাস ফেলে মেয়ের পাশে বসলো। আলতো হাতে মেয়ের ভেজা চোখ মুছে দিতে লাগলো। চোখেমুখে এখন আর ক্ষোভ নেই। মেয়ের মাথা আদুরে হাতে ছুঁয়ে দিতে দিতেই সে বিড়বিড় করে বলল,
–“আপনার সাথে যুদ্ধ করতে আমার বড্ডো কষ্ট হবে আম্মা। আপনি কেনো এতো আবেগি? কোনটা নিজের জন্য ভালো তা আজো বুঝলেন না। ছোটবেলা থেকে শুধু নিজের জন্য যেটা ক্ষতি সেটাই বেছে নেন। বাবার কথা কখনো মান্য করেন না। পরে বাবাকে বেগ পেতে হয় তা সামাল দিতে।”

নুহাশ মাহমুদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে কিছু দূর্বিসহ স্মৃতি। যেখানে ছোট্ট নৈরা রক্তাক্ত অবস্থায় জঙ্গলের মধ্যে বসে কাঁদছে আর তার সামনে নিথর দেহে পড়ে রয়েছে একটি নারী অবয়ব। তার প্রিয় নারী! তাকে আজো পীড়া দেয় সেই দৃশ্য, সেই হারিয়ে ফেলার তীক্ত দৃশ্য। সে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ফের অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে ওঠে,
–“আপনি সবসময় শুধু আমার কষ্টের কারণ কেনো হন আম্মা? এবার আর হতে দেবো না আপনাকে আমার কষ্টের কারণ। বাবা বুকে পাথর চেপে আজো বেঁচে আছি শুধু আপনার জন্য অথচ আপনি একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। নিজেকে কষ্ট দিয়ে আপনি বাবার যন্ত্রনা আরো দ্বিগুণ করছেন।”

দরজা খুলে মিতা নিঃশব্দে ঘরে ঢুকতেই নুহাশ মাহমুদ চোখ মুছে নিলেন। মেয়ের পাশে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গমগমে স্বরে আদেশের সুরে বললেন,
–“মরার মতো ঘুমাবে না, আম্মার মাথা ব্যথা করছে নিশ্চয়ই মাথা টিপে দেবে। রাতে জাগলে কিছু খাইয়ে তারপর ঘুমাতে দেবে।”

আঁচলে হাত মুছতে থাকা মিতা হাত মোছা থামিয়ে ব্যথিত নয়নে তাকালো স্বামীর পানে। মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করলো, সারাদিন এই ভরা সংসারটার দেখভাল করার পর তার ও একটু বিশ্রামের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাহস হলো না। থমথমে মুখে মাথা নেড়ে সায় জানায়। নুহাশ মাহমুদ মেয়েকে এক পলক দেখে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।
*****
উইকডেজ এর প্রথম দিন। ব্যাংক সর্বদাই একটি ব্যস্ততা মুখর পরিবেশ—তবে রবিবার যেনো এটা একটু বেশিই ব্যস্ততায় মুখরিত থাকে। শুক্রবার, শনিবার ব্যবসায়ীরা দাঁতে দাঁত চেপে অপেক্ষা করলেও রবিবার তারা সকল সকাল তেড়েফুঁড়ে হাজির হয় ব্যাংকের দুয়ারে। আজো তেমনি এক ব্যস্ততা মুখর এক রবিবারে ব্যাংক কর্মকর্তারা কর্মব্যস্ততায় আচ্ছন্ন। ব্যবসায়ি সহ আরো অনেক পেশাদারিত্বের মানুষগুলো ভীড় জমিয়েছে। চায়ের কাপে পল অনুপল বাদ চুমুক দিতে দিতে স্বরূপ কম্পিউটারে কাজ করে চলেছে। তন্মধ্যে একজন সহকর্মী এসে প্রয়োজনীয় কিছু ফাইল দিয়ে গেলো। স্বরূপ কম্পিউটারের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখেই ধন্যবাদ জানালো। তবে সহকর্মীর সাথে আসা আরেকজন মানুষকে খেয়াল করেনি সে। সহকর্মী বেরিয়ে গেলেও মানুষটা বের হলো না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে কর্মব্যস্ত স্বরূপের দৃষ্টি আকর্ষণ করার প্রয়াস করলো। কারোর গলা খাঁকারির শব্দে স্বরূপ ধ্যানচ্যূত হলো। কৌতুহলী দৃষ্টি তুলে তাকালে দৃষ্টি মৃদু হকচকালো। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবী পরিহিতা নুহাশ মাহমুদ পেছনে হাত বেঁধে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। স্বরূপ অপ্রস্তুত হলেও বিচলিত হলো না। পেশাগত সৌজন্যতা ধরে রেখে দাঁড়িয়ে গেলো । বিনম্র কণ্ঠে বলল,
–“আসসালামুয়ালাইকুম, দাঁড়িয়ে আছেন কেনো! বসুন।”
নুহাশ মাহমুদ মৃদু স্বরে সালামের জবাব দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। স্বরূপ ও চেয়ারে বসে। পেশাগত দক্ষতায় একজন বাকপটু ব্যাংক কর্মকর্তা হলেও এই মুহূর্তে সে বাক্যহীনতায় ভুগতে লাগলো। কারণ অবচেতনেও মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছে সামনের লোকটির সাথে সে ব্যক্তিগতভাবে ও জড়িয়ে আছে। নিজের চিন্তায় অবাক হয় স্বরূপ। তাদের নামহীন এক সম্পর্কের কতোটা জোড়! সে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। নুহাশ মাহমুদ ঠিক কোন বিষয়ে তার স্মরণাপন্ন হয়েছে তা তার অজানা। কথোপকথন কি দিয়ে শুরু করবে, কোন বিষয়ে শুরু করবে ভেবে পেলোনা। দ্বিধাগ্রস্ত অন্তঃস্থল নিয়েই সে পেশাগত কণ্ঠে শুধায়,
–“কি সাহায্য করতে পারি আপনাকে?”

নুহাশ মাহমুদ নিগুঢ় চাহনিতে অত্যাধিক পরিমাণে সাদামাটা গোছানো, শিষ্টাচারে সমৃদ্ধ পুরুষটিকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। স্বরূপের প্রশ্নে সে থুতনি থেকে হাত সরায়। ঋজু শিরদাঁড়া আরেকটু টানটান করে সোজাসাপ্টা বলল,
–“আমি নৈরার বিষয়ে আপনার সাথে কথা বলতে এসেছি।”

স্বরূপ কিয়ৎকাল তাকিয়ে রইল অত্যাধিক পরিমাণে শান্ত ভারী মুখটির দিকে। নৈরা! মেয়েটিকে নিয়ে তার সাথে বলার মতো ঠিক কি কথা রয়েছে ভাবছে তার অন্তঃস্থল। সে যা না চাইতো, তাই কি হয়ে গিয়েছে তার দ্বারা? মেয়েটি কি তার অজান্তেই তার সাথে জড়িয়ে গিয়েছে? কেনো? সামান্য সবজি কেনার সঙ্গী বলে না-কি ঐ স্টিলের বেঞ্চিতে তার পাশে বসার সঙ্গী বলে না-কি অদৃশ্য অনুভূতি বিদ্যমান তাদের মাঝে তার কারণে! সে কতো শত কথা’রা জমে স্বরূপের মনে। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে নামহীন এই সম্পর্ককে স্বরূপ কোনভাবেই অস্বীকার করতে পারলো না। অস্বীকার করতে পারলো না, নৈরা নামক মেয়েটির বিষয়ে তার সাথে বলার মতো কোন কিছুই নেই। বরং মনে হলো নৈরা জুড়ে অনেক অনেক কথা রয়েছে শুধু মাত্র স্বরূপ জুড়ে। নৈরা স্বরূপ একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশের ন্যায়। সে মাথা নেড়ে বলল,
–“জি বলুন।”

আজ এতো বছরে নুহাশ মাহমুদের পিতৃত্বভরা অন্তঃস্থল ঈষৎ ঈর্ষা অনুভব করতে পারলো। তার মনে হলো তার নৈরা বাবা, ভাই ব্যতীত কোন পুরুষ মানুষের সাথে বেশ অধিকারবোধ নিয়ে জুড়ে আছে। সামনের পুরুষটি কেমন দাম্ভিকতা নিয়ে তার’ই মেয়ের বিষয়ে কথা বলছে। যেনো নৈরা তার অধিকার ভুক্ত। সে মৃদু হেসে নিজের ঈর্ষা লুকিয়ে নিলো। তবুও তার শব্দগুলো ঈর্ষা লুকাতে ব্যর্থ হলো।
–“আপনি দেখছি নৈরার বিষয়ে বেশ শঙ্কোচহীন! আপনাদের মাঝে একটা ভালো বোঝাপড়া আছে নিশ্চয়ই?”

স্বরূপ নিজেও অজ্ঞাত সে নৈরার বিষয়ে কতোটা শঙ্কোচহীন, কতোটা প্রশ্রয় প্রিয়। তাই সে বাক্য স্বল্পতায় ভুগলো। নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়া স্মরণ করে বলল,
–“শঙ্কোচ করার মতো কোন গভীর সম্পর্ক নেই তার সাথে, তাই হয়তো শঙ্কোচহীন মনে হচ্ছে।”

কথাটির যথার্থ অর্থ বোঝার জন্য নুহাশ মাহমুদকে আগ্রহী দেখাগেলো বেশ। সে কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“আপনি কি বলতে চাইছেন?”

স্বরূপ ডেস্কের উপর রাখা দুই হাত একে অপরের সাথে জড়িয়ে নিয়ে মিহি স্বরে বলল,
–“শঙ্কোচ, ভয়, আলোচনা করার মতো সম্পর্ক আমাদের মাঝে আদৌও নেই। সেটাই বললাম।”

–“কিন্তু আপনার কথার মাঝে ভরপুর অধিকারবোধ কাজ করে নৈরাকে নিয়ে।”

–“সেটা আপনার মনে হচ্ছে কারণ আপনি আমাদের বিষয়ে এই ধারণা নিয়েই এখানে এসেছেন।”, স্বরূপ মৃদু হেসে বলল। নুহাশ মাহমুদ ও প্রেক্ষিতে হাসলো। শুধায়,
–“আমি কি ভুল ধারণা নিয়ে এসেছি?”

স্বরূপকে এযাত্রায় নিরব দেখাগেলো। নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে বললেন,
–“আমি ভুল ধারণা নিয়ে আসিনি। হয়তো আপনি নিজেই এখনো অজানা নয় আমায় ভুল প্রমাণ করতে চাইছেন।”

–“আপনি কি বলতে চাইছেন?”, স্বরূপে গম্ভীর প্রশ্নে নুহাশ মাহমুদ বললেন,
–“নৈরাকে নিয়ে আপনি কতোটুকু সিরিয়াস?”

–“যতোটুকু তার জন্য উত্তম।”, স্বরূপের বিলম্বহীন স্পষ্ট কণ্ঠে নুহাশ মাহমুদ মিহি স্বরে বললেন,
–“তার জন্য উত্তম আপনার থেকে দূরত্ব।”

নৈকট্য কোথায়— যে দূরত্বের খোঁজে মানুষ! প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেলোনা স্বরূপ। সে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।
–“মানে?”

নুহাশ মাহমুদ চেয়ারের হেলান ছাড়লেন। সোজা হয়ে বসে পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রিনটা স্বরূপের মুখের সামনে তুলে ধরলো। ভেসে উঠলো ক্যানোলা লাগানো ঘুমন্ত ভঙ্গুর একটি ফ্যাকাসে মুখ। স্বরূপের মুখশ্রী বিবর্ণ হয়ে গেলো অতল গহ্বরে ঢুকে যাওয়া চোখ, রোগা অসুস্থ মুখটি দেখে। নুহাশ মাহমুদ ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলতে শুরু করলেন,
–“তার সারাদিনের ব্যস্ততা থাকে বিকাল চারটায় ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য। আলমারি ভরতি কাপড় ছেড়ে মাত্র দুটি শাড়ি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পড়া, অনিয়মের সাথে দুইবেলা ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে তাও মেনুতে থাকে দুই ধরণের সবজি। মাছ ইচ্ছে হলে ছুঁয়ে দেখে কিন্তু মাংস কখনো প্লেটে তোলে না। তার ভাষ্যমতে কেউ মাসেও মাংস খেতে পারে না সেখানে সে প্রতিদিন মাংস কেনো খাবে? নৈরা নাজুক, আর পাঁচটা মেয়ের মতো চঞ্চল, স্বাস্থ্য সামার্থ্যবান নয়, মাটির পুতুলের মতো জীবনযাপন। নিজের শরীরের প্রতি একটু অবিচার অবহেলা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সেখানে তার পুরো দিনের ধ্যানজ্ঞান, ব্যস্ততা সবকিছু—সবকিছুর মালিক শুধু একজন! আমায় বলে বোঝাতে হবে না সেই একজনটা কে।”

নির্বাক স্বরূপ স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে শুনছে বোকা মেয়েটির বোকামির মিষ্টি গল্প। নুহাশ মাহমুদ ফের বলতে শুরু করলেন,
–“দীর্ঘ অপেক্ষার পর আমার বুক জুড়ে একটা কন্যাসন্তান আসে। আমার ধ্যানজ্ঞান সে জুড়ে। আপনি একবার ভাবুন তো ঠিক কতোটা যত্ন কষ্টের বিনিময়ে একজন বাবা তার সন্তানকে বড়ো করে? দুনিয়ার সকল খারাপ কিছু থেকে আগলে রেখে কিসের জন্য তাদের বড়ো করে? যেনো তাদের ভবিষ্যৎ এ সুখী, সুন্দর, নিরাপদে একটা সহজ জীবন যাপন করতে দেখতে পারে, তার জন্য ই তো তাই না? কিন্তু এতো কষ্ট আর যত্নে গড়া সন্তানটিকে কি কোন‌ বাবা জেনেশুনে কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিতে পারবে? যেখানে তার মেয়েটাকে তিন বেলা খাবার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হবে?”

নুহাশ মাহমুদ একটু দম নিলো। আবার বলতে লাগলো,
–“আমি আপনার মাঝে কোন খুঁত পাইনি। নিঃসন্দেহে আপনি একজন দায়িত্বশীল সুপুরুষ। কিন্তু আমার নৈরার জন্য আপনি আপনার গড়া জীবন যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপ দেয়ার মতো। ও যেই জীবনে অভ্যস্ত না সেই জীবনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখুননা ওর কি অবস্থা? আমি এতো কষ্টকরে কি আমার সন্তানটাকে এই পরিণতির জন্য বড়ো করেছি? নৈরা অবুঝ। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে ও কিছু জানে না। ও জানে না একটা টাকা ইনকাম করতে ঠিক কতোটা ঘাম ঝড়াতে হয়। জীবন কতোটা কঠিন। বাবার ছায়ায় থেকে সে বোঝে না সমস্যা কি? সে আবেগ দিয়ে ভাবে সব সম্ভব। সে হয়তো কল্পনাও করতে পারে না, মধ্যবিত্ত এক পুরুষের জন্য, বাবা হীনা বিধবা বোন, ভাগ্নে, বয়স্ক মা মাথার উপর বিশাল লোনের বোঝা ঠিক কতোটা ভারী আর দুঃসহ। কিন্তু আমি আপনি তো বুঝি, চিনি দুনিয়া। আমায় সাহায্য করুন।
আমার মেয়েটার আবেগ সামলাতে সাহায্য করুন। আপনি একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি! আমি জানি আপনি কখনো কারোর ক্ষতি হোক এটা চাইবেন না। আমায় ফিরিয়ে দেবেন না, দয়াকরে আজকের পর থেকে নৈরাকে কোনরূপ প্রশ্রয় দেবেন না।”

ভর ছেড়ে একাধারে তাকিয়ে থাকা স্বরূপ ম্লান হাসলো বরাবরের মতো তাকে দায়িত্বের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়ায়। তার বড্ডো ইচ্ছে করে অভিযোগ করতে, কেনো সবাই সবসময় তাকে দায়িত্বের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়? তার ও তো ইচ্ছে করে বাঁচতে, নিজের জন্য। মাঝেমধ্যে খুব ইচ্ছে হয় স্বার্থপরতা করতে। কিন্তু বরাবরের মতোই কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠলো না আর না করা হলো স্বার্থপরতা। সর্বদা শুনে এসেছে দায়িত্বের কাঠগড়ায় থাকা মানুষদের স্বার্থপরতা করতে মানা। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিলো স্বরূপ। নুহাশ মাহমুদের দিকে তাকিয়ে কৃত্রিম হেসে মাথা নেড়ে কলের পুতুলের মতো বলল,
–“আজকের পর থেকে কোন প্রশ্রয় পাবে না।”

নুহাশ মাহমুদের মুখশ্রী উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আপ্লুত নয়নে স্বরূপের সাথে শেইক হ্যান্ড করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল,
–“আপনার সহানুভূতির জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। আপনি শুধু ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখবেন বাকিটা আমি সামলে নেবো।”

স্বরূপ ম্লান হেসে ভারী হয়ে আসা কণ্ঠে মিহি স্বরে বলল,
–“নৈকট্য কখনো ছিলোই না।”

নুহাশ মাহমুদ প্রসন্ন মনে প্রস্থান করেন। সে যেতেই স্বরূপের ফোনটি তীব্র শব্দ উৎপাতের দ্বারা বেজে উঠলো। স্বরূপ ঘাড় কাত করে তাকায় ফাটা স্ক্রিনের দিকে। কাঞ্চনবালা নামটি ভাসছে সেথায়। ভারী হয়ে আসা অন্তঃস্থল নিয়ে স্বরূপ নাম্বারটি ব্লক করে দিলো। বুকভরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বার কয়েক উচ্চারণ করলো,
–“দায়িত্বের কাঠগড়ায় থাকা মানুষদের স্বার্থপরতা করতে মানা। আটমোস্ট রেসপেক্ট ফর দোজ পিপল!”

~চলবে~