কাঞ্চনবেলা পর্ব-১৫

0
11

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৫

খোলা জানালা, নিস্তব্ধ রজনী, নরম গদি, কৃত্রিম শীতলতা—ভরপুর প্রশান্তি, আভিজাত্যের ছোঁয়ায় শুয়ে থাকা ভারী দেহটির মাঝে এক রত্তি প্রশান্তির দেখা নেই। কথায় আছে, টাকার গাছ থাকলেও সুখের ছায়া মেলে না। এই কথাটি বেশ যুৎসই নুহাশ মাহমুদের জন্য। তার সুখ যে বহু বর্ষ আগেই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। জানালা ভেদ করে দূর আকাশে সেজে থাকা চন্দ্রের দিকে উদাসীন দৃষ্টি তার। অক্ষিপটে ভেসে ওঠা নারী অবয়ব আজো তার অন্তঃস্থল’কে ক্লেশে জর্জরিত করে। মাঝেমধ্যেই তার মনে হয় তার জীবনে টাকা বাদে সবকিছু থাকলেই বোধহয় ভালো হতো! নিরাদ, নোমান, নৈরা আর তার দোলা। দোলা—হ্যা তার দোলা!
এতোটুকু থাকলেই তো সে সুখী হতো! কিন্তু নেই, এতোটুকু তার কাছে নেই। বুক চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো। কেনো নিজের জীবনে অর্থবিত্তকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে ছোট বেলা থেকে?

সৃষ্টিকর্তার আরাধনা’র নেশা ব্যতীত কোন নেশাই হয়তো সুফল বয়ে আনে না। পৃথিবীতে অন্যতম এক অনিষ্টকর নেশা হলো টাকা’র নেশা। এই নেশা যদি মনুষ্যত্ব বোধ খুইয়ে কাউকে গ্রাস করে, তবে ঐ ব্যক্তির পশুতে পরিণত হতে খুব বেশি সময় লাগে না। পৃথিবীতে এমন অনেক পশু বিদ্যমান। তেমনি মাহমুদ পরিবারেও অর্থবিত্তের সাথে সাথে এমন অনেক পশু গর্জে ওঠে।
নুহাশ মাহমুদ বাল্যকাল থেকে শান্ত, স্থির, বিচক্ষণ ধারার এক চতুর মানুষ। বিশ বছর বয়স থেকে বাবার ব্যবসায় সে হাত বাটায়। পঁচিশ বছরের মধ্যে সে বাবার ব্যবসা পুরোপুরি বুদ্ধিমত্তার সাথে নিজের দখলে নিয়ে নেয়। বাবার সেই চলনসই ব্যবসা একে একে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতেও তার সময় লাগে না। তখন তার দুই চাচাও তাদের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল। দ্বন্দ্ব টা সেখান থেকেই শুরু হয়। পুরো ব্যবসাটা সহ বিশাল পরিমাণের একটা সম্পত্তি ধীরস্থির নুহাশ মাহমুদের আয়ত্তে চলে যা তার দক্ষতা আর বুদ্ধিমত্তার জোরে। তার চাচারা সহ চাচাতো ভাইয়েরা কেউই তার মতো ব্যবসার হাল ধরতে পারছিল না। তাই তারা ভাগবাটোয়ারার সিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে তুমুল দ্বন্দ্বে লিপ্ত নুহাশ মাহমুদের চাচারা সহ চাচাতো ভাইয়েরা। নুহাশ মাহমুদের তিলে তিলে গড়া বিশাল সাম্রাজ্যে তখন বসে বসে খাওয়া চাচা, চাচাতো ভাইয়েরা হকের থেকে বেশি সম্পত্তির ভাগ চায়। যেই জায়গা জমি সহ শপিং কমপ্লেক্স গুলো নুহাশ মাহমুদ নিজের ইনকামে গড়ে তোলে সেই জায়গাগুলোতেও তারা ভাগ বসাতে চায়। তাদের বক্তব্য এই সম্পত্তি নুহাশ মাহমুদ তাদের টাকা দিয়ে গড়েছে। এই নিয়ে দ্বন্দ্ব জারি থাকে বহুদিন। কিন্তু তন্মধ্যে নুহাশ মাহমুদের নিজের পরিবার মুখোশধারী শত্রুতে পরিণত হয়ে যায় তা টের পায় না নুহাশ মাহমুদ। ততোদিনে সে নিজের পছন্দের নারীকে বিয়ে করে তিন সন্তানের জনক হয়ে গিয়েছে। সম্পত্তি, বুদ্ধিমত্তা, ক্ষমতায় নুহাশ মাহমুদ সবদিক থেকে এগিয়ে থাকায় তারা পেরে ওঠে না নুহাশ মাহমুদের সাথে। তাই তো আঘাতটা ঠিক নুহাশ মাহমুদের ঋজু শিরদাঁড়া বরাবর করলো।

একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ি হওয়ার যাত্রাপথে নুহাশ মাহমুদ একজন চমৎকার প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। বাবার ব্যবসা সামলে রোজ এক ঘন্টা একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ের পেছনে ঘোরা ছিল নুহাশ মাহমুদের এক অন্য সত্ত্বার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। ক্লান্ত বদন নিয়ে মেয়েটির কাছে রোজ একটা আবদার নিয়ে হাজির হতো,
–“তার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।”

দোলা নামক মেয়েটি রোজ ঐ আবদার এড়িয়ে যেতো। নুহাশ মাহমুদ ও নাছোড়বান্দা। সে কখনো প্রয়াস করা থামাতো না। এমনি একদিন নুহাশ মাহমুদ হাজির হয় মেয়েটির কাছে। সাথে থাকে রোজকার সেই আবদার। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সেদিন দোলা এড়িয়ে গেলো না। বরং হেঁটে নুহাশ মাহমুদের কাছে এসে দাঁড়ায়। তীক্ষ্ণ নজরে ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে রাগান্বিত স্বরে বলে
–“রোজ রোজ এমন আবদার না করে বাবা মাকে নিয়ে আমার বাড়িও তো আসতে পারেন। বিবাহ ব্যতীত কোন ছেলের ক্লান্তি দূর করার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে আমি নই। তাই এরপর থেকে এমন আবদার নিয়ে আর আসবেন না।”

বলেই দোলা গটগট করে চলে যায়। নুহাশ মাহমুদ সেদিন হতভম্ব সয়ে গিয়েছিলো। আকস্মিক সে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ে আনন্দে। সেই রাতেই বাবা মা আর কাজী নিয়ে হাজির হয় দোলাদের বাসায়। সেই রাতেই একদম বিয়ে করে ঘরে তোলে দোলাকে। নুহাশ মাহমুদের বাবা হতভম্ব হয়ে পড়ে শান্ত ছেলেটার অশান্ত সেই রূপে। দীর্ঘ দুই বছরের অপেক্ষার পর প্রেয়সীকে নিজের করে পেয়ে কর্মজীবন ব্যক্তিজীবন—সবদিক থেকে সমৃদ্ধ নুহাশ মাহমুদ দূর্বার গতিতে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়। কিন্তু সুখ যে ক্ষণস্থায়ী।

নৈরার বয়স তখন চার বছর। তারা রূপসা নদীর ওপারে শহর থেকে কিছুটা দূরে শিঙ্গার চর নামের জায়গাটিতে পৈতৃক নিবাসে থাকতো নুহাশ মাহমুদ আর তার পরিবার। দুই ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দোলা মেয়েকে নিয়ে ঘরে সময় কাটাচ্ছিলো। দোলাকে ঠিক রানীর ন্যায় সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছিলেন নুহাশ মাহমুদ। সন্তান আর স্বামী এদের ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে রাখাই ছিল দোলার একমাত্র কাজ। ছোট ছোট হাত পায়ের দ্বারা সাবলম্বী নৈরা তখন বেজায় চঞ্চল, দুষ্টু ছিল। হুটহাট মায়ের চোখের আড়াল হলেই সে এক ছুটে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। নুহাশ মাহমুদ প্রত্যেক দিন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মেয়েকে সময় নিয়ে আদর করে বলে যায় কেউ ডাকলেই তার সাথে যেনো চলে না যায়, মায়ের সাথে সাথে থাকে যেনো! কিন্তু বরাবরই নৈরা বাবার অবাধ্য! ছোট্ট বাচ্চাটি বাবার কথা এক কান দিয়ে শুনতো অন্য কান দিয়ে বের করে দেয়াই ছিল তার কাজ। এমনি একদিন নুহাশ মাহমুদের ছোট চাচার মেজো ছেলে নৈরাকে ডাকলো। বোকা নৈরা হাসতে হাসতে চলে গেলো তার সাথে। দোলা রান্নাঘর থেকে দেখলো মেয়েকে যেতে। নুহাশ বারবার বলে যায় তাকে সাবধানে থাকতে। সে মেয়েকে দেবরের সাথে একা ছাড়তে সাহস পায়নি। সেও ছুটে বের হয় মেয়ের পিছু পিছু। তবে সেই বের হওয়াই একেবারে বের হওয়া ছিল দোলার জন্য। সেদিন ঠিক বিকাল চারটায় হন্য হয়ে স্ত্রী সন্তানকে খুঁজতে থাকা নুহাশ মাহমুদ আধম”রা নৈরাকে পেয়েছিল গ্রামের জঙ্গলের মাঝে। তার ঠিক সামনে পড়ে ছিল ছু”ড়িঘাতে ক্ষতবিক্ষত প্রিয় স্ত্রীর লা”শ।
দুই চাচা’রা আর চাচাতো ভাইয়েরা মিলে নিজের ক্ষোভ মিটিয়েছে নুহাশ মাহমুদের সুখ কেড়ে নিয়ে। তারা এ জীবনে আর সূর্যের আলো দেখতে পারবে না সেই ব্যবস্থা করেই নুহাশ মাহমুদ স্ত্রীকে দাফন দেয়। আর হাসপাতালের দ্বারপ্রান্তে উন্মাদের মতো ছোটাছুটি করে অর্ধমৃত প্রায় মেয়েকে নিয়ে। গলায় ফাঁস দিয়ে ছোট্ট মেয়েটিকে মা”র”তে চেয়েছিল। কিন্তু কোন এক মিরাকেলের মতো বাচ্চাটি সে যাত্রায় বেঁচে যায়। সেই ঘটনার পরেই নৈরা এমন চুপচাপ উদাসীন হয়ে যায়। বাচ্চা মেয়েটি ঐ হিংস্রতা সহ্য করতে পারেনি। অতোটুকু মেয়ে একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যায়। যার দ্বারা সে নিজের চঞ্চলতা খুইয়ে ফেলে।

তখন ছোট ছোট তিন সন্তান নিয়ে তখন সর্বহারা নুহাশ মাহমুদ অনাহুত’র ন্যায় বসেছিল। কি করবে, কিভাবে করবে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে সে ভাবতে ভাবতেই হিংস্রতা ভর করে। পরদিন ঠিক সকালে মেজো চাচার একমাত্র মেয়েটাকে কলেজ থেকে তুলে আনে। এবং সেটাই ছিল মিতা। বাবা ভাইদের করা পাপের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতে হয় ছোট ছোট মা হারা বাচ্চাদের দেখাশোনা করার। সে বিনা অভিযোগে মাথা পেতে নেয় সেই শাস্তি। ধীরে ধীরে সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের মা হয়ে উঠলো, একটাসময় নুহাশ মাহমুদের স্ত্রীর ও তকমা পায়। তবে প্রায়শ্চিত্তের বিনিময়ে পাওয়া এই বিলাসবহুল জীবনে মিতা একরত্তি মানসিক সুখ কখনো পায়নি। অবশ্য এটাই তো হওয়ার কথা ছিল। সে তো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছে সেখানে সুখের সংসার কিভাবে পাবে সে। মিতার জীবন থেকে বিয়োগের খাতায় লিপিবদ্ধ হয় স্বামীর ভালবাসা আর মাতৃত্ব। নুহাশ মাহমুদের থেকে একটু ভালো আচরণ আজ পর্যন্ত মিতা পায়নি। আর না এই জীবনে সে কখনো নিজের গর্ভের সন্তানের মা হতে পারবে। এমনি কঠোর নিয়ম মেনে আজ পর্যন্ত তাকে একটা দূর্বিসহ জীবন বয়ে চলতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে কষ্ট হয় খুব কিন্তু দিনশেষে বাবা ভাইদের করা পাপের কাছে সেই কষ্টটাও ফিকে পড়ে। সে হাসিমুখে মেনে নেয় সবটা।

মিতা অশ্রুসিক্ত বদ্ধ নেত্র খুলে তাকায় পাশে শুয়ে থাকা নৈরার দিকে। মৃদু হেসে মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। বড্ডো আদরের সাথে হাতের উল্টোপিঠে চুমু খায়। এই দূর্বিসহ জীবনে এই তিন ছেলেমেয়ে তার স্বস্তি, প্রশান্তি। নিরাদ, নোমান, নৈরা তাকে কখনো নিরাশা করেনি। আজ পর্যন্ত তাকে কখনো কষ্ট দেয়নি, অসম্মান করেনি। ছোটবেলা থেকে মাম্মা মাম্মা করে তার মাতৃত্বের অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে। গর্ভে ধারণ করেনি তো কি হয়েছে কোলেপিঠে মানুষ তো করেছে! সে মা—এই তিনজনের মা। নৈরা আজো জানে না সে তার আসল মা নয়। ছোটবেলার সেই স্মৃতি আজ নৈরার কাছে অস্পষ্ট।
*****
যেই টাকার জন্য আজ নুহাশ মাহমুদ সর্বহারা সেই টাকা’কেই এখন নিজের জেদ বানিয়ে নিয়েছে। এই জেদের কাছে প্রায়শই বিবেক অবহেলিত থেকে যায়। আজ টাকার জোরে নুহাশ মাহমুদকে শহরের সবাই এক নামে চেনে। নিরাদ ও ঠিক বাবার প্রতিরূপ। কিন্তু নোমান আর নৈরা ঠিক এর উল্টো। তারা টাকার গুরুত্ব খুব কম বোঝে। টাকা তাদের কাছে অবহেলিত।

–“তোমার মতিভ্রষ্ট হয়েছে? ঐখানে আমি ইতিমধ্যেই কতো টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছি তোমার ধারণা আছে?এখন আমি কাজ বন্ধ করে দেবো? তুমি আমার সাথে মজা করছো?”, নুহাশ মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে শুধায়।
বাবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখেই নোমান দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
–“নাহ্! মতিভ্রষ্ট হয়নি বরং আমার মস্তিষ্ক সঠিক জায়গায় আছে। কিন্তু তোমার মস্তিষ্ক টাকার নেশায় তার বিবেক খুইয়ে বসেছে‌। জায়গা কেনো, সেটা ভালো কথা কিন্তু সব জায়গাগুলোতে দালান ওঠানো কি খুব প্রয়োজন? একটা খালি জায়গা থাকলে তোমার কোন লস তো হবে না বরং চারিপাশের মানুষ একটু খোলামেলা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে, বাচ্চাকাচ্চারা খেলাধুলা করতে পারবে। পুরো শহরে একটা খালি জায়গা খুঁজে পাওয়া দুস্কর।”

–“আর আমার সেই টাকা দিয়েই তোমরা বিলাসীতা করে বেড়াও। একটু হাত পা গজিয়েছি কি ওমনি বাবার কাজের উপর আঙুল তুলছো? এই যে আজ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি এটা কি করে আছি সেটা শুধু আমি জানি। তাই নিজের এই সমাজসেবার চিন্তাভাবনা আমার সামনে দেখাবে না। পুরো দুনিয়ার মানুষ দালান করে বেড়াচ্ছে আর আমি একা গিয়ে মানুষের প্রতি সহমর্মিতা দেখাবো?”, নুহাশ মাহমুদ তাচ্ছিল্য হেসে বললেন।

নোমান চোয়াল শক্ত করে নেয় এতো বলার পরেও বাবার মাঝে বিবেকের সঞ্চার করতে না পেরে। সে দাঁতে দাঁত চেপে শুধায়,
-“তুমি সাউথ সেন্টার রোডের কাজ বন্ধ করবে না?”

–“কখনো না। অলরেডি কতো টাকা আমি খরচ করে ফেলেছি ম্যাটারিয়ালসের পেছনে। এই টাকাগুলো কে দেবে? তুমি দেবে?”

নোমান কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকে বাবার পানে। অতঃপর গটগট করে বেরিয়ে যায় বাবার অফিস রুম থেকে। ঠিক পাঁচ মিনিট বাদ ফিরে আসে হাতে একটা ফাইল নিয়ে। নুহাশ মাহমুদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছে। সাউথ সেন্টার রোডে দালান তৈরি বাবদ এই পর্যন্ত যতো খরচ হয়েছে এটা সেই ফাইল। নোমান ফাইল খুলে বাবার সামনে মেলে ধরলো। নুহাশ মাহমুদ ফাইলে চোখ বুলালো এ যাবৎ বিরাশি লক্ষ্য টাকা খরচ হয়েছে। নোমান চেক বইতে নির্দিষ্ট এমাউন্ট লিখে বাবার সামনে বাড়িয়ে দিলো। গমগমে স্বরে বলল,
–“তোমার এই পর্যন্ত যতো খরচ সবটা এখানে রয়েছে। এখন কাজ বন্ধ করো।”

নুহাশ মাহমুদ ভ্রু উঁচিয়ে চেকটার দিকে তাকিয়ে রইল। তৎক্ষণাৎ তার থমথমে মুখশ্রী ভেদ করে উচ্চস্বরে হাসি বেরিয়ে আসে। নুহাশ মাহমুদ হাসতে হাসতে বললেন,
–“ওহ্, নোমান আব্বু! আপনি বড়ো হলেন না। ছোট বেলার মতো জেদি, একরোখা বাচ্চামো এখনো রয়ে গিয়েছে। আমার টাকা আমাকেই দিচ্ছেন?”

শেষের কথাটা নুহাশ মাহমুদ হাসি থামিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন। নোমান টেবিল চাপড়ে নুইয়ে আসে বাবার দিকে। শক্ত কণ্ঠে বলে,
–“এই টাকাগুলো তুমি এমনি এমনি আমায় দাওনি। আমি এফোর্ড দিয়েছি তার পরিবর্তেই দিয়েছো। তোমার ব্যবসায় আমি বড়োসড়ো একটা এফোর্ড দেই। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।”

নুহাশ মাহমুদ ক্রুব্ধ চোখে তাকায় ছেলের পানে। মস্তিষ্ক এমনিতেই বিধ্বস্ত মেয়ের চিন্তায়। সে আর বাকবিতন্ডায় জড়ায় না। এমনিতেই তার এই ছেলেটা খানিক উগ্র। যা করবে তো করবেই। সে থমথমে মুখে ড্রয়ার থেকে সাউথ সেন্টার রোডের জায়গার কাগজপত্র বের করে ছুঁড়ে মারলো ছেলের দিকে। সাথে চেকটাও ফিরিয়ে দিলো। অতিষ্ট হয়ে বলল,
–” যা ইচ্ছা তাই করো গিয়ে।”

নোমান কপাল কুঁচকে পেপারস নিয়ে বেরিয়ে আসে। বাবার অফিস রুম থেকে বেরিয়ে স্বস্তির এক নিঃশ্বাস ফেললো। করিডর পেরুতে পেরুতে পকেট থেকে ফোন বের করে অনেক খুঁজে সিনিয়র ম্যাডাম নাম্বারটা বের করলো। বিনা দ্বিধায় ফোন দিলো। রিসিভ হলো বেশ সময় নিয়ে। রিসিভ হতেই ভেসে আসলো রসকষহীন ঝাঁঝালো কণ্ঠ।
–“আপনি আমায় আবার ফোন দিয়েছেন কোন সাহসে? আপনার মতলব কি? আপনি তো মোটেও ভদ্র লোকের মতো আচরণ করছেন না।”

নোমান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে মেকি মিঠি সুরে বলল,
–“জান, তুমি আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারলে? তুমি কি জানোনা আমার হৃদয় পুড়ে তোমার ঝাঁঝালো কণ্ঠে। কখনো তো একটু মিষ্টি সুরে কথা বলতে পারো!”

সাধনা হতভম্ব হয়ে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে মুখের সামনে ধরলো। লোকটা কি বলে সম্বোধন করলো? জান? সে তড়িৎ ফোনটা আবার কানে ঠেকায়। তেজি কণ্ঠে বলে,
–“অ”স”ভ্য বে”য়া”দ”ব লোক! আমি আপনাকে পুলিশে দেবো বে”য়া”দ”ব লোক। রাত বিরাতে মহিলাদের ফোন করে ছ্যাঁচড়ামো করা একদম বের হয়ে যাবে পশ্চাৎদেশ দু’টো ডান্ডার বারি পড়লেই।”

নোমান দাঁত খিচে দাঁড়িয়ে যায়। পাল্টা তেজি গলায় খেকিয়ে উঠে বলল,
–” আপনি আমায় পুলিশে দিয়ে আমার পশ্চাৎদেশ লাল করবেন আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখবো? ওহে সিনিয়র ম্যাডাম আপনার মস্তিষ্ক বয়স হয়ে গিয়েছে। তাই এতো শর্ট টেম্পারড আর বেশি বোঝে। আপনি কি ভেবেছিলেন আমি রাত বিরাতে ফোন দিয়ে আপনার সাথে প্রেমালাপ করতে চাই? আমার মাথা খারাপ হয়ে যায় নি যে জ্বলজ্যান্ত এক ম্যানার্সের প্রভাষক’কে প্রেম নিবেদন করবো। আমি বিভোরের সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছি। ওকে ফোনটা দিন।”

নোমান বেশ রাগের সাথে কথাটা বললো। সাধনা রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“বিভোরের সাথে আপনার কি কথা?”

–“ও আমার ফ্রেন্ড হয়। আর ফ্রেন্ডদের অনেক কথা থাকে। তা আপনাকে বলবো কেনো? দিন ফোনটা ওকে।”

–“একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা, আপনার মতো বুড়ো লোকের ফ্রেন্ড! মশকরা করছেন আমার সাথে?”

সহসা নোমান গর্জে উঠলো। মেকি রাগ নিয়ে বলল,
–“এই দেখুন বুড়ো বলবেন না। বুড়ো বললেন কেনো? আমার মতো ইয়াং ছেলে এখনো বিয়ে নামক বিষ খাইনি, বাচ্চার মুখে বাপ ডাক শুনিনি আর আপনি বলছেন বুড়ো? যদিও সন্দেহ আছে বাপ ডাক শুনতে পারবো কি-না। আপনার ছেলে তো আমার এল ই ডি বাল্বের নারী নক্ষত্র নাড়িয়ে দিয়েছে। আদৌও চলছে কি-না জানি না….”

সাধনা ব্যগ্র কণ্ঠে গর্জে উঠলো নোমানের লাগাম ছাড়া কথায়। সে শাসিয়ে বলল,
–“এই অ”ভ”দ্র লোক! মুখ সামলে কথা বলুন। আপনাকে আগেও বলেছি বয়স্কদের সমীহ করে চলবেন। আর আপনি আমার সাথে লাগাম ছাড়া কথা বলছেন?”

–“লাগাম ছাড়া কথাবার্তা? এটা আপনার কাছে লাগাম ছাড়া কথাবার্তা মনে হলো? এটা আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাই এনি চান্স যদি আমি বাবা ডাক না শুনতে পারি তবে আপানদের মা ছেলেকে দেখে নেবো। জরিমানা হিসেবে দু’জনকে তুলে আনবো।”, নোমান খেকিয়ে উঠে বলল।

সাধনা এ পর্যায়ে চুপসে গেলো। তার মাঝে মৃদু উদ্বেগ কাজ করলো যদি আসলেই এমন কিছু হয়? লোকটার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে যে। এবার সে ভেজা বেড়ালের মতো চুপচাপ ফোনটা বিভোরকে দিয়ে দিলো। বিভোর ফোন কনে নিয়ে চঞ্চল কণ্ঠে ডেকে উঠলো,
–“বন্ধু।”

বিভোরের আওয়াজ শুনতেই নোমান ও চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“ক্যাপ্টেন! তোমার জন্য সুখবর আছে। আজকের পর থেকে তুমি যখন ইচ্ছে মাঠে ক্রিকেট প্রাকটিস করতে পারবে। দালান উঠে যাওয়ার ভয় আর করতে হবে না।”

বুব্বোর চোখমুখ চকচক করে উঠলো। উচ্ছ্বসিত হয়ে শুধায়,
–“বন্ধু, তুমি সত্যি কথা বলছো?”

–“একদম! ঐ মাঠে আর দালান উঠবে না। ঐ মাঠ এখন তোমার। এখন খুশি তুমি?”

–“ঐ মাঠ আমার? ঐ মাঠে আর দালান উঠবে না?”, বুব্বোর অবুঝ কণ্ঠ।

–“হ্যাঁ, ঐ মাঠ তোমার। যা বন্ধুর তা তোমারো। আর কখনো ঐ মাঠে দালান উঠবে না। ওখনে তোমরা খেলবে, আনন্দ করবে।”

বুব্বোর খুশিরা সীমা হারালো নোমানের কথায়
সে ফোনেই নোমানকে অজশ্র আদর পাঠালো। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
–“বন্ধ, আই লাভ ইউ।”

নোমান হেসে বলল,
–“আই লাভ ইউ ঠু, ক্যাপ্টেন।”

নোমান বুক ভরা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে নৈরার ঘরের‌ দিকে যায়। মেয়েটার শরীর ভালো না। জ্বরে দূর্বল হয়ে পড়েছে। বিগত দিনগুলোতে ক্যানোলা দিয়ে রাখা হয়েছে। মনে মনে বুব্বোর আনন্দের ভেবে হাসলো। ঐ স্বল্প পরিচিত ছোট্ট ছেলেটার আবদার কদিন যাবৎ তাকে অস্থিরভাবে তাড়া করে বেড়াচ্ছিলো। মামু, মায়ের কষ্ট দূর করতে চাওয়া ছেলেটার বিশাল স্বপ্নের সিঁড়ি হতে ইচ্ছে হয় তার। তার যথেষ্ট সামার্থ্য রয়েছে কিন্তু….কোথাও একটা কিন্তু জড়িত জড়তা তো থেকেই যায়। আমরা চাইলেই সহানুভূতির জায়গা থেকে সবকিছু করতে পারি না। ইদানীং মনে হয় বিভোর নামক ছেলেটা আর তার পরিবারের সাথে সেও কিছুটা জুড়ে আছে। অবশ্য এর কৃতিত্ব তার বোকা বোনের। মানুষ পরখে সে সুদক্ষ বলেই তো বিশাল পৃথিবী ছাপিয়ে সে স্বরূপ ইব্রাহীম নামক দায়িত্বশীল এক নির্মলপ্রাণ সাদামাটা ব্যক্তির প্রেমে পড়েছে।
*****
গ্রীষ্মের খরতাপে পুড়তে পুড়তে তখন কাঞ্চনবেলার মিঠা নরম সোনালী আলোয় সদ্যই শহরতলী একটু শীতলতা ধারণ করেছিল। কিন্তু জারুল ফুলের গাছের কান্ড ধরে টানতে থাকা ব্যস্ত নরীটির এলোমেলো শাড়ি ভেদ করে উঁকি দেয়া মেদহীন সাফেদ উদর যেনো সেই শীতলতাটুকু গ্রাস করার প্রয়াসে মত্ত। এহেন দৃশ্যে পরিবেশ কতোটুকু উত্তপ্ত হলো কে জানে! কিন্তু একজনের অন্তঃস্থল সহ মেজাজ বেশ উত্তপ্ত হলো। চা ওয়ালীর সাথে ঝগড়া করতে করতে নৈরা জারুল ফুলের কান্ড আঁকড়ে ধরে ফুল পারছে। সদ্য ব্যাংকের সিঁড়ি থেকে নামা স্বরূপ ফোঁস ফোঁস করে উঠলো এহেন অসংলগ্ন দৃশ্যে। সে চাপা আক্রোশের সাথে বিড়বিড় করে,
–“এক ফুল আরেক ফুল পারছে।”

সে স্বভাবসুলভ কোনরকমে কলিগদের বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে মেয়েটির নিকট যায়। চাপা আক্রোশের সাথে বলে,
–“নৈরা, আপনি এখানে কি করছেন?”

নৈরা চকিতে গাছের কান্ড ছেড়ে দিলো। স্বরূপকে দেখতেই চমৎকার হেসে হাতের আর কানে গুঁজে রাখা জারুল ফুলগুলো দেখিয়ে বলল,
–“আপনি এসেছেন? ফুলগুলো খুব সুন্দর। আমি কানেও গুঁজে ছি। না ঐ বুড়ি গুঁজে দিয়েছে। কি সুন্দর লাগছে আমায়, দেখুন।”

স্বরূপ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ফোঁস ফোঁস করে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালো। হাত বাড়িয়ে কাঁধে উঠিয়ে রাখা আঁচলটা নামিয়ে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল,
–“ফুলের কানে ফুল বড্ডো বেমানান।”

নৈরা কপাল কুঁচকে নেয় লোকটির দ্বিচারিতায়। একদা তো বলেছিল ফুল ব্যতীত তাকে অসম্পূর্ণ লাগে। আবার কথা বদলে গেলো কেনো? সে সেদিকে মনোনিবেশ করলো না বরং লোকটির কথার চমৎকার পছন্দনীয় অর্থ বের করে সে এক গাল হাসলো। প্রফুল্ল চিত্তে প্রচন্ড উৎসুকতার সাথে এগিয়ে যায়। ভ্রু নাচিয়ে বিজ্ঞদের মতো গম্ভীর কণ্ঠে শুধায়,
–“ফুলের কানে ফুল? আমি ফুল? আপনি প্রশংসা করেছেন আমার? আমি ফুলের মতো সুন্দর? তারমানে আপনি আমায় নিয়ে ভাবেন? আমি নিশ্চিত আপনার ঐ নির্দয় মনটায় আমার জন্য কিছুমিছু আছে, তাই না? আমি ঠিক বলছি না, বলুন বলুন?”

স্বরূপের রাগ উবে যায় নিজের উপর ঝুঁকে আসা হাসিমাখা মুখটি দেখে। সে কপাল কুঁচকে থমথমে মুখে হাত বাড়িয়ে নিজের শাহাদাত আঙুলটা ঠেকালো মেয়েটির কপালের মাঝবরাবর। অতঃপর পুতুলের মতো এক আঙুলের সাহায্যে মেয়েটিকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,
–“পাকনি বুড়ি, বিগড়ে যাওয়া কাঞ্চনবালা! সারাদিন মাথায় শুধু এসব চলে। আপনার বাবাকে বলুন আপনাকে বিয়ে দিয়ে দিতে। আপনি বড্ডো পেঁকে গিয়েছেন।”

দূরে ঠেলে দেয়া নৈরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে ধুপধাপ পা ফেলে গিয়ে বেঞ্চিতে পা ঝুলিয়ে বসলো। যেতে যেতে উদাসীন কণ্ঠে বলে,
–“আপনি প্রস্তাব নিয়ে আসুন। আমি এখুনি বিয়ে করে নিচ্ছি।”

স্বরূপ বরাবরের মতো মেয়েটির কথা শুনেও না শোনার ভান করলো।

কাটিয়ে আসা মিষ্টি সেই অনুভূতি মিশ্রিত মুহূর্তটুকু স্মৃতিচারণ করে নৈরা ম্লান হাসলো। বুক জুড়ে কান্নারা দলা পাকায়। ইদানীং কেনো সবকিছু এতো ধরাছোঁয়ার বাইরে? কেনো স্বরূপের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আজ স্মৃতি তার কাছে? চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নৈরার। হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
–“ফোনটা একটু তুলুন না স্বরূপ? আজ দুদিন! আপনাকে এক পলক দেখা তো দূরের কথা, আপনার আওয়াজটুকু শুনিনি। আপনি আমায় কিসের শাস্তি দিচ্ছেন? অনুমতিবিহীন ভালোবাসার? এতোটা কঠিন শাস্তি? অন্তত দূরত্ব নামক কঠিন যন্ত্রনাদ্বায়ক শাস্তিটা থেকে রেহাই চাই, প্লিজ স্বরূপ! প্লিজ। এটা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই, প্লিজ।”

কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলটির উপর জোর খাটায় মেয়েটি। যেনো মোবাইলটার উপর চাপ প্রয়োগ করলেই স্বরূপ ফোন ধরবে। আজ দুদিন নৈরা ঘরবন্দি।
তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিয়ে রাখা হয়। নৈরা বুঝতেই পারে না তাকে কিভাবে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়, কেনো দেয়া হয়। পরিবারের সাথে ছলে পেরে ওঠে না বোকা মেয়েটি। সবাই কিভাবে যেনো তাকে বোকা বানিয়ে ঘুমের ওষুধ দিয়ে দেয়। আর সে হারিয়ে ফেলে তার জীবনের কয়েকটা কাঞ্চনবেলা। তাই আজ নৈরা লড়ছে পরিবারের বিরুদ্ধে, লড়ছে নিজের শরীরের সাথেও। সকাল থেকে নিজেকে ঘরবন্দি রেখেছে সে, এক গ্লাস পানিও মুখে দেয়নি। তার ভয় হয় যদি তাতেও ঘুমের ওষুধ থাকে। তবে আজ পরিবারের লোকজন হেরে গিয়েছে নৈরার চতুরতার কাছে। তারা কোনমতেই তাকে ঘুমের ওষুধ কেনো প্রয়োজনীয় কোন ঔষধ ও খাওয়াতে পারেনি।

–“নুরু? মাম্মা এসেছি। দরজাটা একটু খোল আম্মা! তোমার শরীরের কি অবস্থা একটু দেখবো শুধু। আমার হাতে কোন খাবার কিংবা ওষুধ নেই বিশ্বাস করো।”, অজশ্রবারের মতো মায়ের আওয়াজে নৈরা নিস্তেজ পড়ে রইলো বিছানায়। দরজা খোলার তাগিদ অনুভব করলো না। একটু আগেও নোমান নিরাদ ও চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি।

–“নৈরা? মাম্মার কথা শুনবে না? তুমি বিরঙ্গনায় যাবে ঠিক আছে আগামীকাল যেও। কিন্তু আজ তো কিছু খেয়ে শক্তি জোগাতে হবে?, মিতা কথা শেষ করতেই একজোড়া কঠিন দৃষ্টি তাকে দগ্ধ করলো। নুহাশ মাহমুদ কঠোর চোখে তাকায় স্ত্রীর পানে। চাপা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
–“মিথ্যা আশ্বাস দেবে না আমার মেয়েকে। তোমার প্রচেষ্টা দেখে আমার হাসি পাচ্ছে। এই করে তুমি দিনশেষে একজন ভালো মা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করো? এই তার নমুনা? মেয়ে সারাদিন না খেয়ে আছে আর তুমি মা হয়ে তাকে খাওয়াতে পারোনি কিন্তু নিজে ঠিকই খেয়েছো! গলা দিয়ে খাবার নেমেছে তোমার? নামবেই না কেনো কয়েকটা পশুর অংশ তুমিও যে। ওর যদি আজ এই অবস্থা হয়ে থাকে তার জন্য তুমিও দায়ী মিতা। মেয়ে কি করছে তা মায়ের খবর থাকে না। সারাদিন ওকে ঘরে একা ফেলে রেখে নিজে বিলাসীতায় মগ্ন থাকতে। সরো আমার চোখের সামনে থেকে, যাও এখান থেকে।”

শেষের কথাটা ধমকে উঠে বলল নুহাশ মাহমুদ। মিতা নিরুদ্বেগ , শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিচ্ছুটি বলে না। নুহাশ মাহমুদ হিংস্র দৃষ্টি ফেলে মিতার হাত থেকে খাবারের প্লেটটা নিয়ে নেয়। দড় আওয়াজে মেয়েকে ডেকে ওঠে,
–“নৈরা, আম্মা? দরজা খুলুন বাবা এসেছি। বাবা সারাদিনে কিছু খাইনি আম্মা। খুব খিদে পেয়েছে আপনার সাথে একসাথে এক খাবার খাবো। কোন ঘুমের ওষুধ নেই। দরজা খুলুন আম্মা।”

নৈরা অশ্রুসিক্ত নয়ন আরো সিক্ত হলো বাবার কথায়। এই মানুষগুলোকে এখন‌ ভয় লাগে তার। কেমন অচেনা মনে হয়। সে জেদি কণ্ঠে বলল,
–“আমার খিদে নেই। আমি খাবো না। তোমরা খেয়ে নাও। বারবার আমায় বিরক্ত করবে না।”

নুহাশ মাহমুদ আর নম্রতা বজায় রাখতে পারলেন না। সে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
–“আপনার দরজা ভাঙতে আমার পাঁচ মিনিট সময় লাগবে আম্মা। আমায় কঠোর হতে বাধ্য করবেন না।দুই মিনিটের মাঝে দরজা খুলবেন। আপনাকে খাবার খেয়ে রাতের ওষুধ খেতে হবে।”
বাবার কঠোরতায় অনভ্যস্তত নৈরা। দরজাটি মিনিটের মাঝে খুলে গেলো। ভেসে উঠলো মেয়ের বিধ্বস্ত দশা। নৈরা অশ্রুসিক্ত নয়নে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“তোমরা এমন কেনো করছো? কেনো আমায় জোর করছো সবকিছুর জন্য? আমি বারন করার পরেও কেনো রোজ ঘুমের ওষুধ দাও?”

–“কারণ আপনি অনিয়ম করেন। আপনার শরীরের যতোটুকু বিশ্রাম, যত্ন প্রয়োজন ততোটুকু করেন না। তাই আমায় বাধ্য হয়ে আপনাকে ঘুমের ওষুধ দিতে হয়।”

–“আর দেবে না।”

–“কেনো দেবো না? আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আপনি অনিয়ম করলে আমায় বারবার এমন করতে হবে।”, ফের বাবার অনমনীয় কণ্ঠে নৈরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে নম্র স্বরে অনুনয় করে বলল,
–“আমায় বিরঙ্গনায় যেতে হবে।”

–“কেনো?”

নৈরা বাক্য স্বলপ্তায় ভুগলো। অস্থির দৃষ্টি ফেলছে সে। প্রশ্নের যথার্থ জবাব দিতে পারলো না? বাচ্চা আদলে জেদি কণ্ঠে বলল,
–“যেতে হবেই।”

–“সেটাই জিজ্ঞাসা করছি কেনো যেতেই হবে আপনাকে বিরঙ্গনায়?”

কৈফিয়ত দিতে অনভ্যস্ত নৈরা আজো পারলো না সে কৈফিয়ত দিতে। অসহ্য মানসিক চাপ নিয়ে সে বিছানায় গিয়ে আবার বসে পড়লো। নুহাশ মাহমুদ খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। হাত ধুয়ে ভাত মাখতে মাখতে মেয়ের সামনে পা গুটিয়ে বসলেন। প্রথম লোকমা’টা নৈরার দিকে এগিয়ে দিতে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরে নুহাশ মাহমুদ নিরবে লোকমা’টা নিজের মুখে তুলে নিলো। শান্ত স্বরে বলল,
–“ঘুমের ওষুধ নেই, আম্মা। ভয়ের কিছু নেই। আপনাকে আর ঘুমের ওষুধ দেয়া হবে না আজকের পর থেকে।”

–“তবে আমি আগামীকাল থেকে বিরঙ্গনায় যেতে পারি? আমার জ্বর কমে গিয়েছে। দরকার পড়লে আমি সব ওষুধ খাবো নিয়ম করে। কোন অনিয়ম করবো না।”, নৈরার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ।

নুহাশ মাহমুদ মৃদু হাসলো মেয়ের কথায়। এক লোকমা খাবার মেয়ের মুখে তুলে দিয়ে বড্ডো শান্ত স্বরে বলল,
–“আপনি সব ওষুধ ও খাবেন আর অনিয়ম ও করবেন না, আম্মা। কিন্তু আপনি আর কখনো বিরঙ্গনায় যাচ্ছেন না।”

নৈরা বিস্মিত হলো বাবার কথায়। শুধায়,
–“বিরঙ্গনায় যাবো না মানে? তুমি কি বলছো? আমি বিরঙ্গনায় কেনো যাবো না? আমায় গান শিখতে হবে তো।”

–“অনেক গান শিখেছেন আম্মা। আর দরকার নেই। গানের বদলে যেখানে বাবাকে মিথ্যা বলতে শেখায় সেখানে আর যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”

নৈরার দেহ শ্রান্ত হয়ে আসে। নিভে আসা স্বরে শুধায়,
–“তুমি কি বলতে চাইছো বাবা?”

–“আপনি আর কখনো বিরঙ্গনায় যাচ্ছেন না, আম্মা। এটা শেষ কথা। আপনি বড়ো হয়েছেন, অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছেন। নিজেই প্রমাণ করছেন। তাই এখন আমায় আপনাকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে গুরুতরভাবে। আগামীকাল আপনাকে দেখতে আসবে আমার কিছু নিকটস্থ লোকজন। আশাকরি বাবার অসম্মান করবেন না আপনি। নুহাশ মাহমুদের মেয়েকে দেখতে এসে যতোটুকু সম্মান আর এটেনশন তাদের প্রাপ্য তারা
যেনো পায়।”, খাবার মুখে নিয়ে নৈরা নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে বাবার দিকে। স্তম্ভিত কণ্ঠে শুধায়,
–“আমি কি কোন শো পিস, যে —মানুষ আমায় দেখতে আসবে?”

–“এটা তো নিয়ম আম্মা। মেয়েরা বড়ো হলে এই নিয়ম সকলকে পালন করতে হয়। আপনাকেও করতে হবে।”

–“মেয়েরা বড়ো হলে কি গরুর মতো এভাবে হাঁটে উঠিয়ে জনে জনে দেখানো হয়, বাবা?”

–“জনে জনে নয় আম্মা। কার সাহস আছে আমার মেয়েকে হাঁটে উঠাবে? আগামীকাল তাদের আপনাকে দেখে পছন্দ হলে আগামীকাল’ই আকদ সেড়ে ফেলবো। বাবার পছন্দ নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনি এখানে যেমন জীবনযাপন করতেন, সেখানেও অবিকল তেমন জীবনযাপন করবেন।”

বাবার কথা বড্ডো তীক্ত শোনালো মেয়েটির কর্নকুহরে।মেয়েটি মানতেই পারলো না বিয়ে নামক শব্দটি স্বরূপ ব্যতীত। সব ভয়, জড়তা সংকোচ উবে গেলো নৈরার। স্বরূপ যে তার কাছে সংকোচ হীন এক অনুভুতির নাম। এই জীবনে এই নামজুড়ে সে তার জীবনে কোন সংকোচ তৈরি হতে দেবে না। কখনো না। সে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলল,
–“আমি স্বরূপ ইব্রাহীমকে ভালোবাসি বাবা। আমি যদি কারোর স্ত্রী হই সেটা একমাত্র স্বরূপের। আমি কখনো অন্য কোন পুরুষের সামনে দাঁড়াবো না।”

~চলবে~