কাঞ্চনবেলা পর্ব-১৮

0
6

#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৮

নৈরা’র স্বপ্নরা নতুন প্রত্যাশায় ডানা মেলেছে। মন কাননে লাজ, ভালোবাসা, আগমনী প্রাপ্তির সম্মেলনে উৎসব রটিয়েছে‌‌।
প্রভাতের সোনালী কিরণ তীর্যকভাবে
কাঁচে পড়তেই, বিলম্বহীন সেই আলোর তীর্যক প্রতিফলনে কুঁচকে গেলো নৈরার শুভ্র মুখ খানি। নাজুক বদন টেনে দ্রুত আরশির সামনে থেকে দুই পা সরে এসে নিজেকে রোদের আলো থেকে নিজেকে রক্ষা করলো। সদ্য কুঁচকে নেয়া চোখ মুখ স্বাভাবিক হলো। আরশিতে ভেসে ওঠা ছিমছাম গড়নের বদনে আজ অসুস্থতার লেশমাত্র নেই। শুভ্র বরফখন্ডের ন্যায় মুখটিতে নেই কোন উদাসীনতা, মলিনতা। আছে শুধু প্রিয় মানুষটির অধির অপেক্ষার উজ্জ্বলতা, উৎসুকতা। কখন অপেক্ষা ফুরাবে? কখন সকল দূরত্ব ঘুঁচবে? কখন মানুষটাকে নৈরা নিজের মানুষ বলে একটু ছুঁয়ে দেখবে?
ভাবতেই নৈরা’র লাজে রাঙা মুখটিতে ঠিকরে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো। ভাইজান বলেছে স্বরূপ আর তার পরিবার বিকাল তিনটা নাগাদ চলে আসবে। নেই আর কোন হারানোর ভয় আর না দুশ্চিন্তা। তবে কেনো এতো অনাচার করছে দেহের সাথে? সে ভাইয়ের কথামতো নিজের যত্ন নিতে লাগলো। সেন্টার টেবিলে থাকা এক একটা স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট সব অনাদরে ঘঁষতে লাগলো। এটা অতিদ্রুত ফলাফল পাওয়ার লোভে! বিকালে তাকে সুন্দর দেখাতে হবে। তথাকথিত নিজের যত্ন নিয়ে আরশিতে নিজেকে আরেকবার দেখে নেয় নৈরা। অতঃপর বেবি পিংক রঙের ফ্রক, বেবি পিংক সেলোয়ার এর সাথে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ধীরপায়ে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। ঘরময় মৃদু আড়ম্বরপূর্ণ। নিচে নামতে নামতে নৈরা দেখলো ড্রাইভার একে একে অনেকগুলো মিষ্টির প্যাকেট রান্নাঘরে নিয়ে রাখছে। সে ভ্রুক্ষেপহীন সোজা খাবার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। সদর দরজা থেকে সদ্য ঢোকা নুহাশ মাহমুদ হাতের প্লাস্টিকের বক্সগুলো বড্ডো যত্ন সহকারে এনে ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখলেন। ডাইনিং রুমে মেয়েকে দেখে তার দৃষ্টি চকচক করে উঠলো। প্রতিটা বাবার সুপ্ত বাসনা থাকে তার সন্তানটি সর্বাবস্থায় হাসিখুশি, প্রাণবন্ত সুস্থ সবল থাকবে। তার ও এটা সুপ্ত বাসনা। কিন্তু প্রায়শই সন্তানদের কাছে এই সুপ্ত বাসনাটুকু বড্ড অন্যায় চাওয়া মনে হয়। এই যে তার নৈরার কাছে এখন মনে হচ্ছে তার বাবা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা— অথচ তার প্রতিটা চাওয়াই থাকে তার নৈরা যেনো ভালো থাকে। একটা সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অন্তঃস্থল থেকে। সে জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে তুললো। প্রাণোচ্ছ্বল কণ্ঠে শুধায়,
–“আম্মা, ঘুম থেকে উঠে গিয়েছেন? দেখুন আপনার ফ্রুটস ও এসে গিয়েছে।”

হাতে করে আনা প্লাস্টিকের বক্সগুলো দেখিয়ে বলল নুহাশ মাহমুদ। মেয়ের খাবারের প্রতি অনেক অনেক উদাসীনতা থাকলেও কিছু কিছু খাবারের প্রতি সে খুব আকর্ষিত। তন্মধ্যে ড্রাই ফ্রুটস আর বেরি জাতীয় ফল অন্যতম। এগুলো দেশে সহজলভ্য না হওয়ায় প্রতি সপ্তাহে সে বিদেশ থেকে আনায়। কখনো এই নিয়মে অব্যহতি ঘটে না। শেষ হওয়ার আগে ঘর ভরিয়ে ফেলে ফলে—অথচ আজ তার সন্তানটি তার একটা কথা মানতে নারাজ। নৈরা মৃদু হাসলো বাবার বাড়িয়ে দেয়া ফলগুলো দেখে। ছোটবেলা থেকে এভাবেই বাবা প্রতিদিন তার জন্য তার পছন্দের ফল হাজির করে। সে বিগত বাকবিতন্ডা ভুলতে চাইলো। স্বরূপ যখন আসবে তখন যেকোন উপায়ে বাবাকে রাজি করিয়ে নেবে এতোটুকু বিশ্বাস তার মনে রয়েছে। সে শুধায়,
–“তুমি খেয়েছো বাবা?”

প্রফুল্লতা আঁছড়ে পড়লো নুহাশ মাহমুদের মাঝে। মৃদু হেসে বেশ চঞ্চলতার সাথে বলল,
–“আপনার সাথে খাবো বলে অপেক্ষা করছিলাম আম্মা। বসুন, খুব খিদে পেয়েছে বাবার।”

নুহাশ মাহমুদ মেয়েকে চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো। একে একে খাবার এগিয়ে দিতে লাগলো মেয়ের প্লেটে। রান্নাঘর থেকে এই দৃশ্য দেখে ডানে বামে মাথা নাড়লো মিতা। মানুষটা মেয়ে বলতে পাগল। হবেই না কেনো! মেয়ে যে অবিকল তার মায়ের প্রতিরূপ! আর নৈরার মায়ের জন্য নুহাশ মাহমুদ আজো কতো উন্মাদ তা হয়তো কেউ কল্পনা ও করতে পারবে না। তবে সে জানে ! তাকে কড়ায় গন্ডায় বুঝায় নুহাশ মাহমুদ! টলটল করা চোখদুটো সন্তপর্ণে লুকিয়ে নিলো মিতা। থমথমে মুখে পুত্রবধূ মেহের এর উদ্দেশ্যে বলল,
–“মেহেক, দেখো গিয়ে নৈরা আর ওর বাবার কিছু লাগে কি-না।”

মেহের মাথা নেড়ে ভারী দেহ টেনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ডাইনিং রুমে। নৈরা বাবার দেয়া সবকিছু নিরবে খেতে লাগলো। নুহাশ মাহমুদ মেয়েকে ফ্রুটস বের করে দিয়ে বলল,
–“আমি ভীষণ খুশি হয়েছি আম্মা আপনি স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করছেন দেখে।”

মেহেক ধীরপায়ে এগিয়ে আসলে, নুহাশ মাহমুদ খেতে খেতে প্রসন্ন মনে পুত্রবধূর উদ্দেশ্যে বলল,
–“দেখেছো মেহেক, আমার আম্মা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। বাবার যে কি ভালো লাগছে আপনাকে সতেজ দেখে। বিকালে সবাই একটা দারুণ ফ্যামিলি টাইম কাটাবো। আম্মাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেবে মেহেক বুঝলে! যদিও আমার আম্মার সাজগোজের একটুও প্রয়োজন নেই। সে এমনিতেই সুন্দর। ঠিক যেনো এক টুকরো বরফ!”

নৈরা’র খাওয়া থেমে গেলো বাবার কথায়। সদ্য মুখে তোলা ব্লু বেরিটা আর গলাধঃকরণ করতে পারলো না। কর্নকুহরে মৃদু উৎপাতের সৃষ্টি হলো নিজের সৌন্দর্যের বর্ণনার্থে এক টুকরো বরফের কথা শুনে। লোকটাও একদিন এমনি এক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছিল। নুহাশ মাহমুদ এক দৃষ্টিতে অদূরে তাকিয়ে থাকা মেয়ের পানে তাকায়। মৃদু সন্দিহানের কণ্ঠে শুধায়,
–“আম্মা, আপনি বাবাকে বুঝতে পেরেছেন তো? বিকালের জন্য আপনি নিশ্চয়ই প্রস্তুত?”

নৈরা’র দেহ ম্লান হয়ে আসলো বাবার প্রশ্নে। কথার নয় ছয় তার দ্বারা মোটেই হলো না। সে বাবার দিকে তাকিয়ে মিহি তবে দৃঢ় স্বরে বলল,
–“স্বরূপ আমায় কখনো অন্য কোন পুরুষ মানুষের সামনে দাঁড়াতে দেবে না বাবা। আর না আমি দাঁড়াবো।”

সহসা নুহাশ মাহমুদের সল প্রসন্নতা ফিকে পড়লো। সে অবাক চোখে তাকিয়ে শুধায়,
–“আপনি এখনো স্বরূপের মাঝে আঁটকে আছেন?

নৈরা ম্লান হাসলো। মিহি স্বরে বলল,
–“স্বরূপ আমার সেই না পড়া উপন্যাস, বাবা। যার প্রারাম্ভ পড়ার একটু প্রশ্রয় আমি বড্ডো ভাগ্য করে পেয়েছি। জানিনা উপসংহার আমার ভাগ্যে জুটবে কি-না। কিন্তু আমি এতোটুকু জানি, যেদিন এই উপন্যাস পড়ার সৌভাগ্য আমার কপাল থেকে খসে যাবে সেদিন আমি অস্তিত্বহীন হয়ে যাবো।”

বাস্তবিকতার চাদরে আচ্ছাদিত নুহাশ মাহমুদের কঠোর মন— বড্ডো ভারী মহত্ত্বপূর্ণ এই কথাটির মানে বুঝতে পারলো না। সে দাঁত খিচে বলল,
–“আম্মা আপনাকে আমি গতকাল সবটা বুঝিয়ে বললাম না? তবুও আপনি কেনো এইসব আবেগী খোয়াবে ডুবে আছেন? আমি বারবার বলছি আম্মা, এগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। জীবনে আপস এন্ড ডাউন আসবে। আপনি ভুল করেছেন বাবা মেনে নিয়েছি এবং আপনাকে শুধরে নিতে সাহায্য করছি। আপনার উচিৎ নিজের ভুল বুঝে বাবাকে সহায়তা করা।”

–“আমি এই অসম্ভব সুন্দর ভুলটা নিয়ে সারাজীবন থাকতে চাই বাবা। তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না? তুমি তো কখনো আমার কোন আবদার অপূর্ণ রাখোনি তবে আজ কেনো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন করছো?”, নৈরার অশ্রুসিক্ত চাহনিতে বলা অভিযোগে নুহাশ মাহমুদ দেহের ভর ছেড়ে উদাসীন কণ্ঠে বলল,
–“সেটাই আম্মা, আজ পর্যন্ত যখন আপনার কোন আবদার অপূর্ণ রাখিনি কিন্তু আজ যখন নিষেধ করছি তখন কেনো আমার কথা শুনতে চাইছেন না? আপনার আবদার গুলো আমার কাছে আপনার জন্য সঠিক মনে হলেই আমি পূরণ করেছি। কোন অনৈতিক চাওয়া যা আপনার দুঃখের কারণ হবে এমনকিছু আমি কখনো পূরণ করিনি আর না করবো। আমি সর্বাবস্থায় আমার নৈরাকে সুখী দেখতে চাই, এটা আপনি কান খুলে শুনে রাখুন।”

এতোটুকু বলে নুহাশ মাহমুদ দম নিলো। কন্ঠ থেকে নম্রতা সরিয়ে কিছুটা গম্ভীর আর কঠোর গলায় বলল,
–“আমি আপনার থেকে কোনরূপ বিরূপ আচরণ মানতে পারবো না নৈরা। বিকালে অতিথি আসবে আপনি তাদের সাদরে গ্রহণ করবেন, প্রাপ্য সম্মান দেবেন আর নতুন একটা শুরুতে মন দেবেন।”

নৈরা টলমলে আঁখিতে এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকায়। আর একটা দানাও তার মুখে ঢুকলো না। সে খাবার ছেড়ে উপড়ে চলে যায়। উপড়ে উঠতেই নোমান পথ আঁটকে দাঁড়ায় বোনের। বোনের অশ্রুসিক্ত চোখ দেখে বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে বলল,
–“আবার কাঁদছিস? তোকে বারন করেছি না নুরু?”

নৈরা অনুযোগ ভরা কণ্ঠে বলল,
–“তুমি শুনলে না বাবা কি বলছে?”

–“আমি কি বলেছি সেটা তোর মনে নেই?”

–“আছে।”

–“তবে?”

নৈরা মাথা নত করে নেয়। বাচ্চাদের মতো চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল,
–“আচ্ছা, আর কাঁদবো না।”

নোমান হাসলো বাধ্যগত বোনকে দেখে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–“এই তো গুড গার্ল। এখন ঘরে যা। ফল পাঠাচ্ছি চুপচাপ খেয়ে নিবি। নয়তো বিকালে তোর ব্যাংকার’কে ঝাড়ি দেয়ার শক্তি পাবি না। আমি তাদের আগমনের ব্যবস্থা করে আসি।”

নৈরা ম্লান হেসে মাথা নেড়ে সায় জানায়। উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
–“ভাইজান, স্বরূপ সরপুরিয়ার খেতে খুব ভালোবাসে। তুমি একটু মিষ্টি মহল থেকে সরপুরিয়ার নিয়ে এসো।”

নোমান মেকি বৃহৎ নয়নে তাকালো বোনের দিকে। মেকি বিস্ময়ের সাথে বিদ্রুপ করে বলল,
–“ওরে বাবা কি ভালোবাসা! ভাইজানের জন্য তো কখনো এমন চিন্তা করিস নি?”

নৈরা কপট রাগি দৃষ্টিকে তাকায় ভাইয়ের দিকে। বলল,
–“আমি তোমায় ভালোবাসি না?”

নোমান মুখ ছোট করে না বোধক মাথা নাড়লো। নৈরা ক্ষেপে গেলো। ধুম করে ভাইয়ের বাহুতে আঘাত করে বলল,
–“মিথ্যুক!”

নোমান হো হো করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বলল,
–“বাসিস কিন্তু স্বরূপ ইব্রাহীমের থেকে একটু কম বাসিস।”

নৈরা এযাত্রায় লজ্জা পেলো। সে চোখমুখ কুঁচকে জোর কদমে নিজের ঘরে চলে গেলো। নোমান হাসতে হাসতে নিচে নামলো। ডাইনিং রুমে গিয়ে একজন মেইডকে বলল নৈরা ঘরে ফল পাঠাতে। নুহাশ মাহমুদ লিভিং রুমের সোফায় ঝিমিয়ে বসে আছে। চেহারায় চিন্তার ছাপ। নৈরার চোখেমুখে ভরপুর দৃঢ়তা এখনো বিদ্যমান স্বরূপকে নিয়ে। তবে কি স্বরূপ যোগাযোগ রাখছে? তার ধারণা মতে স্বরূপ ইব্রাহীম কথার খেলাপ করার মতো মানুষ নয়। সে ভাবতে পারল না কিছু। শুধু ঘরের সকলকে বলল, নৈরার দিকে নজর রাখতে।
*****
এইতো আরেকটু! আর কিছু ঘন্টা! আর কিছু মিনিট! আর কিছু সেকেন্ড! অপেক্ষা ফুরাবে…..একটু পরেই ফুরাবে। এই তীব্র আকাঙ্ক্ষা যখন আকাঙ্ক্ষার জায়গাতেই থমকে যায়, তখন সেই অপূর্ণ প্রেমের করুণ সুর ঠিক কতোটা বিভৎস ভাবে নমনীয় অন্তঃস্থলকে গ্রাস করে?

দেয়াল জুড়ে এঁটে থাকা গোলাকৃতির দেয়াল ঘড়িটিতে তখন ঠিক তিনটা বেজে চব্বিশ মিনিট। থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা চিকন ফর্সা আঙুলগুলোর অস্বাভাবিক কম্পন থামাতে নৈরা জোরপূর্বক তাদের মুঠোবন্দী করে নিলো। দু’হাত জড়ো করে ফ্রকের মাঝে চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ প্রয়াস চালায় সে। অপ্রাপ্তির বেদনায় আ’ত’ঙ্কে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুখশ্রী লাল বরন ধারণ করেছে অচিরেই। হুটহাট অনুমতি ব্যতীত ভয়ের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে টপটপিয়ে পড়া নোনা জলগুলো। সে আরেকবার আড়চোখে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় ঘড়ির দিকে। চোখের পানি বাঁধন ছাড়া হলো ফের। কেনো ঘড়ি এতো দ্রুত চলছে? হয়তো স্বরূপরা পথেই আছে। নিজেকে স্বান্তনা দেয় নৈরা। বিড়বিড় করে নিজেকে সামলাতে লাগলো,
–“স্বরূপ পথেই আছে, আসছে। আরেকটু, এই তো এসে পড়বে। তুমি ওভার রিয়্যাক্ট করছো নৈরা।”

বলতে বলতেই নৈরা চাপা স্বরে ফুঁপিয়ে উঠলো। দরজায় মেহের নক করছে। শাড়ি পড়াবে। সে ঘামতে থাকা হাতটি অস্থিরভাবে ফ্রকে মুছতে লাগলো। স্বরূপদের তিনটার দিকে আসার কথা ছিল কিন্তু তারা এখনো আসেনি। সে ধীরস্থির মেঝে ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ায়। টলমলে পায়ে এগিয়ে যায় দরজার কছে। মেহের পুনশ্চঃ দরজা নক করে বলল,
–“নুরু, দরজা খোল। শাড়ি পড়তে হবে। অতিথিরা চারটা নাগাদ এসে পড়বে তো।”

নৈরা খোলেনা দরজা। সে ধিমি কণ্ঠে বলল,
–“ভাবি, ছোট ভাইজান কোথায়? তাকে একটু ডেকে দেবে?”

–“আগে দরজাটা তো খোল, নুরু।”

–“নাহ্, খুলবো না। তুমি ছোট ভাইজানকে ডেকে আনো ভাবি।”, নৈরার জেদি কণ্ঠে মেহের ফিরে গেলো। মিনিট দুই বাদ দরজায় পুনরায় ঠকঠক অওয়াজ হলো। নোমান অস্থির কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
–“নুরু? দরজা খোল, ভাইজান এসেছি।”

সাথে সাথে দরজাটি খুলে গেলো। নৈরা ভাইয়ের হাতটা আঁকড়ে ধরে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“ভাইজান, তুমি বলেছিলে স্বরূপরা তিনটার দিকে চলে আসবে। তবে তারা আসছে না কেনো? সাড়ে তিনটা বেজে গিয়েছে যে। অতিথিরা এসে পড়বে।”

নোমান বিবর্ণ মুখে বোনের কন্নাভরা মুখটি দেখছে। সে এখনো অজানা কেনো স্বরূপরা আসছে না। অনেক ফোন দিয়েছে কিন্তু ফোনে পাচ্ছে না। দুপুরেও কথা হয়েছে বিভোরের মায়ের সাথে। সে উৎফুল্লতার সাথে বলেছিল,তারা ঠিক সময়ে চলে আসবে। তবে….সে অনাহুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোনকে বলল,
–“তোর কাছে তোর ব্যাংকারের নাম্বার আছে না? আমায় দে তো!”

নৈরা অবাক পানে তাকায় ভাইয়ের দিকে। শুধায়,
–“তুমি কি কিছু জানো না তাদের বিষয়ে? ভাই…. ভাইজান তুমি তো বলেছিলে যে কোন মূল্যে স্বরূপকে হাজির করবে। তবে?”

নৈরা ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর বলছে। নোমান নিজের ব্যর্থতাকে সামলে অস্থির ভাবে বোনকে বুকে জড়িয়ে নিলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত করতে করতে বলল,
–“নুরু, বোনু কান্না করে না। ভাইজান তো আছি, তাই না? আমার তাদের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছে ঠিক সময়ে চলে আসবে। কিন্তু…তারা নিশ্চয়ই কোন ঝামেলায় পড়েছে নয়তো পথেই আছে। আমি দেখছি। তুই আমায় দশ মিনিট সময় দে। তাদের বাসা তো কাছেই। দরকার পড়লে গিয়ে তুলে আনবো সবাইকে। তবুও আনবো। তুই কান্না থামা।”

নোমান বোনকে কোনমতে বুঝিয়ে শুনিয়ে ছুটে বের হলো ঘর থেকে। অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত নুহাশ মাহমুদ ছেলের এমন ছোটাছুটি দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলেন। পিছু ডেকে শুধায়,
–“এমন ছোটাছুটি করছো কেনো নোমান?”

নোমান জবাব দিলো না। একপলক ক্রোধ জর্জরিত দৃষ্টি বাবার দিকে ফেলে সে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়। নুহাশ মাহমুদের ললাটে চিন্তার ভাঁজ দৃঢ় হয়। সে পিছু তাকাতে তাকাতে উপড়ে চলে গেলো।

কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতেই নোমান দ্রুত পায়ে হেঁটে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। জড়তাহীন সোজা তিন তলায় উঠতেই তার ললাটে ভাঁজ পড়লো। তালাবদ্ধ ফ্লাটটি দেখে। সে আশেপাশে জিজ্ঞাসা করলো ঐ ঘরের মানুষ কোথায় গিয়েছে। কিন্তু ফিরতি জবাবটা শোনার জন্য নোমান প্রস্তুত ছিল না। নিচতলার একটা লোক জানালো ,স্বরূপের মা স্ট্রোক করেছেন দুপুর দুইটা নাগাদ। তারা তাকে নিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে। অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখ, অসহায়ত্ব, দুশ্চিন্তা নিয়ে নোমানকে দ্রুত ফিরতে হয়। বাইক চালাতে চালাতে ভাবতে লাগলো কঠিন এই মুহুর্তটি থেকে ঠিক কিভাবে সবটা সামলে উঠবে। একদিকে বোনকে দেয়া কথা, একদিকে অপ্রতিরোধ্য বাবা অন্যদিকে স্বরূপ ইব্রাহীম নামক দায়িত্বশীল ব্যাক্তির বারংবার দায়িত্বের এই কঠিন পরীক্ষা!

নোমান খুব স্বল্প ভাবনার মানুষ। তার যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে খুব অল্প সময় লাগে। সে শুধু দুইটা পথের মধ্যে ভালো দিকগুলো বাছাই করে। বাছাইয়ে যেই পথ জিতে যায় সে নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে সেই পথে হাঁটা শুরু করে। আজো তার ব্যতিক্রম হলো না। বাইক বাড়ির সামনে থামতে থামতে নোমান নিজের সিদ্ধান্তে পৌঁছে যায়। সে গেটের সামনে বাইক থামিয়ে বোনকে ফোন লাগায়।

ঘরভর্তি মানুষের মাঝে নির্জীব অস্থির অন্তঃস্থল নিয়ে চুপটি করে বসে থাকা মেয়েটি বারংবার সেন্টার টেবিলের উপর থাকা ফোনটির দিকে তাকাচ্ছে। নৈরার কজিনরা সহ মেহের নৈরাকে সাজাতে সাজাতে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। এই আলাপ আলোচনায় নৈরার কোন অংশ নেই। কাজিনরা জোরপূর্বক ও নৈরার মুখ থেকে কোনপ্রকার কথা বের করাতে পারেনি। সে তো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নতুন ফোনটির দিকে। চোখে শুধু প্রতীক্ষা আর প্রতীক্ষা। তার প্রতীক্ষার প্রহর এযাত্রায় ফুরালো। মানবতৈরি যন্ত্রটি নৈরার মুখে এক ফালি হাসি এনে স্বশব্দে বেজে উঠলো। ভাইজানের নাম সহ তার ছবি ভেসে উঠতেই নৈরা বিলম্বহীন ফোনটি কানে ঠেকালো। একবুক আশা নিয়ে শুধায়,
–“ভাইজান পেয়েছো স্বরূপকে? তারা পথে ছিল কি?”

নোমান ফোঁস করে উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো। বদ্ধ নেত্রে বলল,
–“নুরু, ডোন্ট প্যানিক হ্যাঁ? ভাইজানের কথা মন দিয়ে শোন।”

নৈরার মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো ভাইয়ের এমন কথার ধরণে। সে ভয়ার্ত কণ্ঠে শুধায়,
–“ভাইজান তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো? সবকিছু ঠিক আছে না? স্বরূপ? সে ঠিক আছে না? তাকে পাওনি?”

নোমান কপালে আঙুল ঘঁষে লম্বা শ্বাস নেয়। ধিমি কণ্ঠে বলল,
–“নুরু, ব্যাংকারের মা স্ট্রোক করেছে দুপুরের দিকে। তাকে নিয়ে সবাই হাসপাতালে গিয়েছে।”

অপেক্ষারত দেহের এক একটা ছুটন্ত র”ক্ত কনিকাও তাদের গতি হারালো ঠিক যেমনটা মুখ থুবড়ে পড়লো নৈরার সকল উদ্বেগ, আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্নরা। আরশিতে ভেসে ওঠা মিষ্টি রঙের জামদানী শাড়ি আর ছোট ছোট হিরের গহনায় সেজে থাকা উজ্জ্বল নারী অবয়ব মুহুর্তেই তাদের সকল সৌন্দর্য হারিয়ে ফেললো। নিকষ কালোয় ঢেকে গেলো সেই শুভ্র আভিজাত্যে মোড়া সৌন্দর্য। এতো এতো দামী অলংকার সহ আভুষণ ব্যর্থ হলো নৈরার সৌন্দর্যের কারণ হতে। তারা তো জানেই না নৈরার সৌন্দর্য তার স্বরূপ।

নৈরা অনিমেষ তাকিয়ে আছে আরশির দিকে। ঝাঁপসা ঐ দৃষ্টিতে এখন আর কিচ্ছুটি নেই। না আছে স্বরূপের অপেক্ষা আর না আছে আকাঙ্ক্ষা। দৃষ্টি ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছে ঠিক তার জীবনটার মতো। সে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“এখন কি হবে ভাইজান?”

প্রশ্নটি করতেই নিরূপায় আর অসহায়ত্বের হাহাকার জুড়লো নৈরার স্বচ্ছ টলটলে দুই আঁখি। আচমকাই সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
–“আমি কি করে অন্য পুরুষের সামনে দাঁড়াবো ভাইজান?”

নোমান আদুরে গলায় বোনকে ডেকে ওঠে। মিহি স্বরে আশ্বস্ত করে বলে,
–“নুরু, ভাইজান বলেছি তো তোকে অন্য পুরুষের সামনে দাঁড়াতে দেবো না। শুধু ভাইজানের উপর ভরসা আর সাহস রাখতে হবে। পারবি?”

–“পারবো।”, নৈরা ছোট্ট করে জবাব দেয়। মেহের সহ তার কজিনরা সবাই অবাক চোখে দেখে চলেছে কান্নারত নৈরাকে। নোমান মৃদু হেসে বলল,
–“এই তো গুড। এখন আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমি নিচে গেটের সামনে বাইকে বসে আছি। তুই নিচে চলে আয়। শুনেছি, স্বরূপ তার মাকে নিয়ে সিটি হসপিটালে গিয়েছে। আমরা এখনি সেখানে যাবো, চলে আয়।”

ভাইয়ের কথায় নৈরা ছোট্ট করে উচ্চারণ করলো,
–“বাবা?”

নোমান উষ্ণ নিঃশ্বাস ফেললো। বলল,
–“এই মুহূর্তে শুধু দু’টো পথ খোলা নুরু। বাবার কথা ভাবলে তোকে যে কোন মূল্যে অন্য পুরুষের সামনে দাঁড়াতে হবে। অন্যটা তুই জানিস।”

দ্বিতীয়বার ভাবনায় পড়তে হলো না নৈরাকে। সে ফোন কেটে দ্রুত শাড়ি সামলে উঠে দাঁড়ায়। মেহেক হন্তদন্ত হয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠা নৈরাকে দেখে চিন্তিত গলায় শুধায়,
–“কি হলো নৈরা?”

নৈরা দ্রুত কদমে ঘর থেকে বের হতে হতে বলল,
–“আমি আসছি ভাবি।”

–“কোথায় যাচ্ছো নৈরা? অতিথিরা এসে পড়বে এখুনি।”, মেহেক অবাক কণ্ঠে বলল। নৈরার ফিরতি জবাব আসলো না সে ছুটছে। তারা সকলে নৈরার পিছু পিছু ছূটতে ছুটতে নামলো। লিভিং রুমে নিজের ছেলে, ছোট ভাই, তার সন্তান আর ও কিছু ব্যাক্তিবর্গের সাথে তৈরি হয়ে বসে নিজস্ব আলোচনায় মগ্ন ছিল নুহাশ মাহমুদ। হঠাৎ ই তার দৃষ্টি কাড়লো দোতালার সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নামতে থাকা মেয়ে। নৈরাকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা সদর দরজার দিকে যেতে দেখে নুহাশ মাহমুদ দাঁড়িয়ে যায়। আশ্চর্য হয়ে শুধায়,
–“নৈরা, আম্মা! আপনি এভাবে ছুটে যাচ্ছেন কোথায়?”

নৈরার গতিরোধ হয় বাবার উঁচু কণ্ঠে। সে দৌড় থামিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। ঊর্ধ্বশ্বাস সামলে বলল,
–“স্বরূপের কাছে বাবা। তার আমার খুব প্রয়োজন।”

নুহাশ মাহমুদ বজ্রাহত চাহনিতে তাকায় মেয়ের পানে।অবাক হয় মেয়ের দুঃসাহসিকতা দেখে। বিলম্বহীন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো সে। কঠোর দৃষ্টি ফেলে দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে আসতে বজ্র কণ্ঠে বলল,
–“নৈরা, এক পাও যেনো ঘরের বাইরে না পড়ে। বাবাকে কঠোর হতে বাধ্য করবেন না। চুপচাপ ঘরে যান।”

নৈরা যেনো আজ থামবার নয়। সে এক পলক বাবার কঠিন মুখটির দিকে তাকিয়ে শুধু ছোট্ট করে বলল,
–“বাবা, দুঃখিত! কিন্তু আজ থামলে আমি হয়তো তাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো। আ’ম স্যরি বাবা।”

বলেই নৈরা এক মুহুর্ত বিলম্ব করলো না, শাড়ি সামলে দূর্বার গতিতে ছুটতে লাগলো। নুহাশ মাহমুদ রেগে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল,
–“দারোয়ান গেট বন্ধ করো।”

নুহাশ মাহমুদের হুকুম দারোয়ানের কান পর্যন্ত যাওয়ার আগে নৈরা গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেলো। ব্যস্ত দৃষ্টি ফেলে ভাইকে খুঁজলো। নোমান বোনকে দেখতেই বাইক নিয়ে সোজা বোনের সামনে এসে থামায়। নৈরা দ্রুত ভাইয়ের পেছনে উঠে বসে। মুহুর্তেই বাইক’টি দৃষ্টি সীমানায় ঝাঁপসা হয়ে গেলো। নুহাশ মাহমুদ ছুটে এসে শূন্য গেটের সামনে থামলো।

~চলবে~