#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ১৯
কয়েকটা জীবন জুড়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শুধুমাত্র এক বাবার ভালো থাকার ভুল সংজ্ঞা জানার কারণে। ভালো থাকতে টাকার প্রয়োজন পড়লেও, ভালো রাখতে টাকার প্রয়োজন পড়ে না—এতোটুকু উপলব্ধি করতে পারলেই আজ হয়তো নৈরার মুখে হাসি থাকতো। নৈরা প্রাণপনে বিশ্বাস করে মানুষটা নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে তাকে ভালো রাখবে। কিন্তু এতোটুকু যে তার অবুঝ বাবাকে বিশ্বাস করানো কষ্টসাধ্য! দশ মিনিটের মাঝে দ্রুতগামী বাইকটির গতিরোধ হলো সিটি হাসপাতালের সামনে। নোমান গাড়ি পার্ক করে, বোনের হাত ধরে ত্রস্ত পায়ে হাসপাতালে ঢুকলো। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রোগী আর তার সহযোগীদের বসার জন্য পেতে রাখা সোফা গুলোর একটায় বোনকে বসিয়ে বলল,
–“এখানে বস নুরু, ভাইজান দেখে আসি স্বরূপরা কোন ফ্লোরে আছে।”
নৈরা হাত কচলাতে কচলাতে মাথা নেড়ে সায় জানালো। এই কয়েক ফ্লোরের দূরত্ব ও তার মাঝে অসহ্য অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। তবুও সে বিচলন সামলে ঘাপটি মেরে বসে রইল। নোমান রিসিপশনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলো স্বরূপ ইব্রাহীমের কথা যে কি-না কিছুক্ষণ আগেই একজন স্ট্রোকের রোগী নিয়ে এসেছে। রিসিপশনিস্ট খোঁজ করে দশ মিনিট পর বলল, তারা এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রয়েছে। নোমান জানতে চাইলো সেটা কোথায়, যাওয়া যাবে কি-না। রিসিপশনিস্ট জানালো, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে অতি প্রয়োজন ব্যতীত কেউ যেতে পারবে না। নোমান মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ফিরে আসতে যাবে তখনি কারোর সাথে ধাক্কা লেগে তার ফোনটা স্বশব্দে ছিটকে পড়লো অদূ্রে মেঝেতে। ধাক্কা দেওয়া ব্যক্তি তড়িঘড়ি করে দুঃখিত বললেও মেজাজ বিগড়ে যায় নোমানের। সে দাঁত খিচে শুধু বলল,
–“দেখে চলাফেরা করতে পারেন না?”
ব্যক্তিটি আরো কয়েকবার বিনীত ভঙ্গিতে ক্ষমা চাইলো। নোমান বিকৃত মেজাজে ফোনটা হাতে তুললো। স্ক্রিন ফেটে চৌচির। ফোন অন করতে গেলেও অন হলো না। সে দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় বোনের কাছে। নৈরা চোখ তুলে তাকায় ভাইয়ের দিকে। উদ্বিগ্নতা নিয়ে শুধায়,
–“পেয়েছো ভাইজান? তারা কোন ফ্লোরে আছে?”
–“তারা এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে আছে নুরু। সেখানে যাওয়া নিষেধ। আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।”, নোমান নম্র কণ্ঠে বলল। নৈরা ছোট্ট করে জবাব দিলো,
–“ওহ্।”
নোমান মলিন হাসলো বোনের নিভে যাওয়া আদল দেখে। কতোটা উদ্বিগ্নতা মেয়েটির মুখ জুড়ে। সে বোনের মাথায় হাত রেখে বলল,
–“এখনো এতো চিন্তা নুরু? ভাইজান তো নিয়ে এসেছি তোর স্বরূপের কাছে। আর কেউ দূরে করতে পারবে না। আরেকটু অপেক্ষা করতে পারবি না?”
নৈরা মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। সে পারবে। নোমান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
–“নুরু তুই কি এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবি? ভাইজানের ফোনটা ভেঙে গিয়েছে। অন হচ্ছে না। জরুরি কল আসলেও ধরতে পারবো না। পাশেই সার্ভিসিং এর দোকনে আছে একটু দেখিয়ে আসি? দশ পনেরো মিনিট লাগবে হয়তো!”
নৈরা মৃদু স্বরে আশ্বস্ত করে বলল,
–“তুমি যাও। আমি অপেক্ষা করছি এখানে, তুমি চিন্তা করো না। স্বরূপ ও হয়তো একটু পরেই এসে পড়বে এমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে।”
–“আচ্ছা, তুই এখানেই থাক তবে। ভাইজান তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”, বলেই নোমান পা বাড়ায়। কিছু মনে পড়তেই নৈরা দ্রুত ভাইকে পিছু ডাকলো। নোমান পিছু ফিরে তাকায়। শুধায়,
–“কিছু লাগবে নুরু?”
নৈরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
–“এক বোতল পানি লাগবে ভাইজান।”
নোমান তাকে পানি এনে দিয়ে ফোন সার্ভিস করাতে গেলো।
কামড়া জুড়ে শুধু শঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর ভয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাসের ছড়াছড়ি। স্বরূপ, সাধনা নিগুঢ় চাহনিতে দেখছে মায়ের সিটি স্ক্যানের রিপোর্টটি। মস্তিষ্কের দুটো রক্তনালী ফেটে গিয়েছে শুনিতার। ডাক্তার জানায় গতকাল রাতেও শুনিতা ঘুমের মাঝে স্ট্রোক করেছে কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি। আর আজ ব্রেইন স্ট্রোক করেছে। তাদের ঘোর ভাঙলো ডাক্তারের ব্যর্থতা ভরা কণ্ঠে,
–“আ’ম স্যরি মিস্টার স্বরূপ। আপনার মায়ের মস্তিষ্কের দুটো রক্তনালী ব্লাস্ট হয়েছে। তার অতিসত্বর অপরেশনের প্রয়োজন। নয়তো মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের করণে তার মৃত্যু হতে পারে। ব্লাস্ট হওয়া ঐ রক্তনালী দুটোতে ক্লিপ বসাতে হবে। এই অপারেশন অনেক রিস্কি। এটা ঢাকায় করালে আপনি আশানুরূপ ভালো ফলাফল পাবেন। আমি সাজেস্ট করবো আপনি অতিদ্রুত ঢাকায় চলে যান আপনার মাকে নিয়ে।”
স্বরূপ লালচে নয়নে একবার নিস্তেজ শুয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে ধিমি কণ্ঠে শুধায়,
–“অপারেশন করতে কতো টাকা লাগবে স্যার?”
–“সাড়ে সাত লক্ষ্য টাকার মতো।”, স্বরূপের দেহ ম্লান হয়ে আসলো। তবুও বক্ষস্থলে লুকিয়ে থাকা মনটিতে ভরপুর জোর। একমাত্র সম্বল মায়ের ছায়া সে কখনো সরতে দেবে না মাথার উপর থেকে তাতে যা হয়ে যাক। সে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
–“আমরা এখনি ঢাকায় নিয়ে যাবো মাকে। আপনি যা যা প্রয়োজন তা করুন ডাক্তার।”
হাতে মাত্র আড়াই হাজার টাকা নিয়ে, সত লক্ষ্য টাকার অপারেশন করার জন্য স্বরূপ সম্মতি তো প্রকাশ করে দিলো; কিন্তু এতো গুলো টাকা সে জোগাড় করবে কিভাবে? মস্তিষ্কে এই একটা চিন্তা নিয়ে স্বরূপ ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেরিয়ে গেলো ফার্মেসী থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী আনতে।
শুব্রত, আমান, তৈমুর হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোর দিয়ে ঢুকতেই তাদের চোখ যায় সোফায় চুপটি করে বসে থাকা নৈরার দিকে। তারা অবাক পানে তাকায় একে অপরের দিকে। তৈমুর কৌতুহলী গলায় শুধায়,
–“নৈরা এখানে কেনো? আজ না ওকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল?”
শুব্রত অবুঝ কণ্ঠে বলল,
–“স্বরূপ তো তাই বলেছিল।”
–“তবে ও এখানে কি করছে? ও কি স্বরূপের কাছে এসেছে? ওর বাবা আসতে দিয়েছে?, পুনশ্চঃ তৈমুরের কৌতুহলী কণ্ঠ। বন্ধুর জীবনের ছন্দপতন সম্পর্কে আদ্যোপান্ত তারা অবগত।
–“এখানে বসে গবেষণা না করে চল তাড়াতাড়ি স্বরূপের কাছে। ওকে গিয়ে বলতে তো হবে মেয়েটা ওর জন্য বসে আছে এখানে।”, আমান তাড়া দিয়ে বলল। তারা দ্রুত ছুটলো কঙ্খিত ফ্লোরের দিকে। তারা এই স্বরূপ নামক বন্ধুর বিপদে সুখে সর্বদা তার পাশে দৃঢ়তার সাথে দন্ডায়মান থাকে। তাতে নিজেদের পরিস্থিতি যতোটাই শোচনীয় হোক না কেনো!
তারা লিফটের কাছে যেতেই দেখলো সদ্যই লিফট থেকে বের হচ্ছে স্বরূপ। বন্ধুদের দেখে স্বরূপ বলহীন পায়ে এগিয়ে আসে। টলমলে আঁখিতে তাকিয়ে বড্ডো ক্ষীণ স্বরে বলে,
–“সাড়ে সাত লক্ষ্য টাকা শুধু অপারেশনেই লাগবে। আমি এতিম হয়ে যাবো শুভ!”
শক্ত সামার্থ্যবান পুরুষটাকে হয়তো ছোট্ট একটা আলিঙ্গন দিলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়বে। বন্ধুরা জানে তার এই বন্ধুটার সম্বল বলতে এই পরিবারটুকুই। তারা আজ মোটেই আলিঙ্গন করলো না বন্ধুকে, স্বান্তনা দিলো না। বরং তিনজনে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে সমস্বরে বলল,
–“সাত লক্ষ্য লাগুক আর সাত কোটি— আমরা আমাদের বন্ধুকে কখনো এতিম হতে দেবো না। আমাদের তিনজনের সেইভিংস মিলিয়ে আট লক্ষ্য হয়ে যাবে তুই চিন্তা করিস না। এতক্ষণ তিনজনের টাকার হিসেব করছিলাম তাই দেরি হয়ে গিয়েছে আসতে। তুই নিশ্চিন্তে ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নে।”
স্বরূপ হতবুদ্ধি হয়ে যায় বন্ধুদের কথায়। এই মানুষগুলো কেনো এতো ক্ষমতাবান? কিভাবে মুহুর্তেই তার সকল চিন্তাদের নিজেদের কাঁধে তুলে নিলো। সে সবেগে আঁছড়ে পড়লো তিনজনের বুকে। শুব্রত আমান, তৈমুর ম্লান হেসে বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে নেয় একসাথে। স্বরূপের লালচে চোখ দিয়ে টপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে ফিসফিসিয়ে বলে,
–“আমি তোদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না। আমি তোদের সব টাকা ফিরিয়ে দেবো, শুধু এই মুহূর্তে আমায় একটু এতিম হওয়া থেকে বাঁচিয়ে নে।”
তৈমুর ওর পিঠ বরাবর সপাটে এক চাপড় মারলো। তেজি কণ্ঠে বলল,
–“শালা এখানে বসে সেন্টি না খেয়ে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের বলা সব কাজ গুলো শেষ কর। আন্টিকে নিয়ে রওনা হতে হবে।”
স্বরূপের বলহীন দেহ উজ্জ্বীবিত হতে লাগলো। সে ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানায়। তার বন্ধুরা শুরু থেকেই তার সাথে ছিল, মাঝে তিনজনে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়। ফিরে আসে তার সকল দুঃখের উপশম হয়ে। সে চোখের পানি মুছে দ্রুত পায়ে হাঁটা ধরলো। শুব্রত, তৈমুর অদূরে বসে থাকা নৈরার দিকে এক পলক তাকিয়ে স্বরূপকে পিছু ডেকে উঠলো,
–“স্বরূপ?”
স্বরূপ পা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। জিজ্ঞাসা করে,
–“কি?”
–“তোর সাথে কেউ হয়তো দেখা করতে এসেছে।”
–“কে?”, স্বরূপ স্বপ্রতিভ চাহনিতে চেয়ে শুধায়। শুব্রত ইশারায় গ্রাউন্ড ফ্লোরের পশ্চিম দিক বরাবর সোফার দিকে নির্দেশ করলো। স্বরূপ বন্ধুর ইশারা অনুসরণ করে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায়। বড্ডো শান্ত, এলোমেলো দৃষ্টিতে খুঁজলো পরিচিত কোন মুখ দেখার নিমিত্তে। তার দৃষ্টি হঠাৎ হকচকালো পশ্চিম দিকের ব্রাউন রঙা সোফাটিতে গোলাপী রঙা শাড়িতে আবৃত নৈরাকে ঝিমিয়ে বসে থাকতে দেখতে। চেহারায় অপেক্ষার ক্লান্তি স্পষ্ট। স্বরূপ চমকালো! সে অবাক চোখে একবার বন্ধুদের দিকে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকায়। পা দুটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এগিয়ে গেলো মেয়েটির দিকে। গিয়ে দাঁড়ায় ঠিক মেয়েটির সামনে। অস্ফুট স্বরে শুধায়,
–“নৈরা আপনি এখানে?”
বড্ডো ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষা নামক যন্ত্রনা সহ্য করতে করতে, ঝিমিয়ে পড়া মেয়েটির কর্নকুহরে হঠাৎ উল্লাসের সাথে আন্দোলিত হলো সেই অস্ফুট পুরুষালী কণ্ঠ। নৈরা চমকে মাথা তুলে তাকায়। সর্বশান্ত হয়ে যায় তার দেহ আত্মা সহ স্বচ্ছ টলটলে দৃষ্টিদ্বয়! কতো গুলো দিন! আজ কতো গুলো প্রহর বাদ সে দেখলো প্রিয় মুখটি। নৈরার সকল বিচলন মিলিয়ে গেলো। অন্তঃস্থল থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস ঠিকরে বের হয় মেয়েটির। বলহীন দেহে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো ঐ ঘামে জবুথবু বিবর্ণ মুখটির দিকে। সর্বদা ইন করা শার্টে দেখা মানুষটা আজ কতোটা এলোমেলো, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ! মাত্র
কয়েক ঘন্টায় স্বরূপের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। সে মলিন মুখে উঠে দাঁড়ায়। স্বরূপের থমকানো দৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় দূরত্ব কমায়। তার বড্ডো ভয় লাগে এই দূরত্বকে। নৈকট্য বাড়িয়ে নৈরা দম নিলো। খুব ইচ্ছে হলো ঐ শ্বেদ জল গুলো আলতো হাতে মুছে দিতে কিন্তু সেই অধিকার লোকটি তাকে এখনো দেয়নি। সে অতি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতে থাকা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“এসেছেন! পানিটা পান করে নিন। ঘেমে গিয়েছেন।”
স্বরূপ অবুঝের ন্যায় পানির বোতলটা হাতে নিলো। নৈরা ফের শুধায়,
–“মায়ের কি অবস্থা? ডাক্তার কি বলেছে? চিকিৎসা শুরু করেছে কি? মা ঠিক হয়ে যাবে তো দ্রুত?”
নৈরা হাতের কনের গলার ছোট ছোট পাথরের অলংকার গুলো খুলতে খুলতে শান্ত স্বরে শুধায়। স্বরূপ তখনো হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করে,
–“আপনি এখানে কি করছেন নৈরা? আজ আপনাকে দেখতে আসার কথা ছিল না?”
–“আপনি তো গেলেন না দেখতে তবে আমি দেখাবো কাকে?”, বলেই নৈরা সদ্য খোলা অলংকার গুলো স্ব উদ্যোগে হাত বাড়িয়ে স্বরূপ হাতে গুঁজে দিলো। বলল,
–“এগুলো অনেক দামী। বন্ধক রেখে অনেক টাকা আনতে পারবেন। মায়ের চিকিৎসা হয়ে যাবে তাতে। আপনার যখন আবার সামার্থ্য হবে আপনি আমায় ফিরিয়ে দেবেন।”
স্বরূপ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে হাতের জ্বলজ্বল করা হিরের গহনাগুলোর দিকে। কিয়ৎকাল বাদ চোখ তুলে তাকায় মেয়েটির মলিন মুখটির দিকে। কেমন শুকনো, পাতার মতো নির্জীব লাগছে মেয়েটিকে। সে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। ফের শুধায়,
–“আপনি এখানে কেনো নৈরা?”
নৈরা ম্লান হাসলো। বড্ডো সরল কণ্ঠে বলল,
–“চলে এসেছি আপনার কাছে। আর ফিরে যাবো না বাড়িতে। ও বাড়িতে গেলেই সবাই জোরপূর্বক অন্য পুরুষ মানুষের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। তাই আমি চিরদিনের জন্য চলে এসেছি। আপনার সাথেই থাকবো, একটা কঠিন পথ পাড়ি দেবো।”
–“কিন্তু আমি চাই না।”, নৈরার কথা শেষ হতে না হতেই, স্বরূপের কঠিন ফিরতি জবাবে নৈরা হকচকালো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো স্বরূপের কঠোর মুখশ্রীটির দিকে। স্বরূপ চোয়াল শক্ত করে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে। ফের বলতে লাগলো,
–“আমি, একদমই আমার জীবনের এই কঠিন পথটাতে আপনাকে চাই না নৈরা। তবুও কেনো বারবার অযাচিত আবদার নিয়ে হাজির হন?”
নৈরার দেহ ঈষৎ কেঁপে উঠলো প্রিয় মানুষটির কঠোর আচরণে। নৈরা ছলছলে নয়নে তাকায়। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে মিহি স্বরে বলল,
–“এসব কথা এখন থাক স্বরূপ। আগে মায়ের চিকিৎসা হোক, সুস্থ হোক। তারপরে সব কথা হবে। আমি যাবো মায়ের কাছে, চলুন।”
বলেই নৈরা দুই পা এগিয়ে যায়। কিন্তু স্বরূপ স্থির দাঁড়িয়ে। নৈরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় কঠোর মানুষটার দিকে। লোকটা কেনো এমন করছে? সে কি জানে আজ কতোদিন পর তার কাছে সুখ ধরা দিয়েছে? তবে কেনো তার সুখে দুঃখের ছিটা দিচ্ছে? সে অনুনয় করে বলল,
–“কি হলো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? চলুন না!”
স্বরূপ এগিয়ে আসে মেয়েটির দিকে। চোখে চোখ রাখে, অনুভূতি হীন কঠোর সেই দৃষ্টি দেখে মেয়েটি ক্রমশই মূর্ছে যেতে লাগলো! স্বরূপ থমথমে মুখে মেয়েটির দেয়া অলংকার গুলো পুনরায় মেয়েটির হাতে গুঁজে দিলো। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বুঝিয়ে বলল,
–“আমার কথা শুনুন নৈরা। আমি অভ্যস্ত আমার এক কঠিন জীবনে একা পথ চলতে। এই পথ চলাতে আমি কখনো কাউকে সঙ্গী হিসেবে চাইনি আর না চাইবো। আপনি বুঝতে পেরেছেন তো? আমি আপনাকেও কখনো এই কঠিন জীবনে সঙ্গী হিসেবে চাইনি আর না চাইবো। আপনি কেনো বারবার আমার প্রতি আকাঙ্ক্ষা রাখেন? আমি কি শুরু থেকে আপনাকে কখনো কোন আশা দেখিয়েছি? বলেছি কখনো আপনাকে এই কঠিন জীবনে সঙ্গী বানাতে চাই? বলিনি তো! তাই আমার প্রতি কোন আকাঙ্ক্ষা রাখবেন না। বাড়ি ফিরে যান নৈরা। ভুলে যান স্বরূপ ইব্রাহীম নামক কারোর সাথে স্টিলের ঐ বেঞ্চিটিতে আপনার দেখা হয়েছিল, ভুলে যান আপনি কারোর সবজি কেনার সঙ্গী ছিলেন। সবটা ভ্রম! স্বরূপ ইব্রাহীম একটা ভ্রম যার কোন বাস্তবতা নেই। তার বাস্তবতা বড্ডো কঠিন! যেখানে আপনার কোন ঠাই নেই।”
নৈরার ছলছল স্থির নয়ন ততক্ষণে অবমুক্ত। মেয়েটি একদমই নিতে পারলো না লোকটার এতো এতো কঠিন কথা। সে তবুও যথাসাধ্য নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। মিহি স্বরে বলল,
–“স্বরূপ আমি বুঝি আপনি নিজের সব পরিস্থিতি বিবেচনা করে এমন করছেন। মায়ের অসুস্থতার কারণে আপনার মাথা গরম হয়ে আছে। আমারো তো কোন উপায় ছিল না। ঐ বাড়িতে থাকলে বাবা আমায় যেকোনো উপায়ে অন্য পুরুষের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। আর আপনি তো জানেন আমি আপনি ব্যতীত আর কারোর সামনে দাঁড়াতে পারবো না। প্লিজ, এতোটা কঠোর হবেন না। আমি শুধু আপনার সাথে নিরবে এই পথটুকুতে থাকবো। আমায় ফিরিয়ে দেবেন না।”
নৈরার কথার মাঝেই নুহাশ মাহমুদ হন্তদন্ত হয়ে হাসপাতালের গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢুকলো। মেয়েকে দেখে সে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ক্রুব্ধ চোখে তাকায়। বজ্রকণ্ঠে ডেকে ওঠে,
–“নৈরা!”
নৈরা চমক উঠলো বাবার কণ্ঠে। বিলম্ব হীন ভয় আঁছড়ে পড়লো মেয়েটির মাঝে। স্বরূপ ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নুহাশ মাহমুদ আর নিরাদের দিকে। বাবা ভাইকে দেখে নৈরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। এই মুহূর্তে ছোট ভাইজানকে খুব মনে পড়লো মেয়েটার। সে দ্রুত পায়ে গিয়ে লুকায় স্বরূপের পেছনে। আঁকড়ে ধরে স্বরূপের কনুইয়ের কাছের শার্টটা
শক্ত করে। যতোটা শক্তিতে কুলায়। স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ভয়ার্ত মুখটির দিকে। নৈরা তার প্রতিক্রিয়াহীন চোখের দিকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
–“আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না স্বরূপ।”
স্বরূপ মলিন হেসে বলল,
–“থেকে যাওয়ার কোন কারণ নেই, কাঞ্চনবালা।”
–“আপনি চাইলেই সেই কারণ হতে পারেন।’
–“আমার সামার্থ্য নেই সেই কারণ নেই।”
–“আমি আপনার অসামার্থ্যের মাঝেই খুশি। প্লিজ স্বরূপ, আমি আপনার পায়ে পড়ছি এবার ফিরিয়ে দেবেন না। এবার ফিরিয়ে দিলে আর আমার ফিরে আসার উপায় থাকবে না।”, নৈরা প্রাণপনে অনুনয় করে যাচ্ছে। ঠিক যতোটা নিচে নামা যায় ততোটাই নামলো! স্বরূপ বলহীন দেহে স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। সে কি মায়া ভরা মুখ সৃষ্টিকর্তা নিজ হাতে গড়েছে। অনবদ্য! চোখ ভরে দেখলো স্বরূপ মেয়েটিকে। অতঃপর ম্লান হেসে ঠিক প্রথমবার এবং শেষ বারের মতো মেয়েটির মাথায় হাত রাখলো। বড্ডো নমনীয় আর আদরের সাথে বলল,
–“আজকের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি আমায় বানানোর জন্য ধন্যবাদ কাঞ্চনবালা। আপনি আমায় সেই স্থান দিয়েছেন যার হকদার আমি নই। কারোর এতো ভালোবাসা পাবো এটা আমার কল্পনাতীত ছিল। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে। কিন্তু আপনাকে কৃতজ্ঞ করার সমার্থ্য আমার কখনো ছিল না, আজো নেই। তাই আজো আমার কাছে আপনাকে দেয়ার মতো কিছু নেই। আপনাকে আজো আমায় ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে, সর্বহারা করে। আমায় ক্ষমা করে দেবেন। বাবাকে কষ্ট দেবেন না। হাসিমুখে নতুন জীবনে নিজেকে গুছিয়ে নিন। আমার তাড়া আছে নৈরা। যেতে হবে। ভালো থাকবেন, আপনাকে অবশ্যই ভালো থাকতে হবে। নিজেকে কখনো কষ্ট দেবেন না, কাঞ্চনবালা।”
মাথায় হাত রেখে কথাগুলো বলেই স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অতঃপর নিস্তেজ, নির্জীব দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির হাত মুঠোবন্দী করে নিয়ে এগিয়ে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় একদম নুহাশ মাহমুদের মুখোমুখি। নুহাশ মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বরূপের দিকে। স্বরূপ মৃদু হেসে নৈরার হাত নুহাশ মাহমুদের হাতের মুঠোয় দিয়ে দিলো। মিহি স্বরে বলল,
–“আমার সামার্থ্য নেই তাকে রেখে দেয়ার। তাই আপনার আমানত আপনার হাতে তুলে দিলাম। আপনি তাকে যেকোন মূল্যে সুখী করবেন, আসি।
বলেই স্বরূপ পা বাড়ায় অসীম দূরত্বের দায়িত্বের এক কঠিন পথে। যেখানে সর্বপ্রথম কদম ফেলার শর্ত হচ্ছে কখনো পিছু ফিরে তাকানো যাবে না। এবং দ্বিতীয় শর্ত হলো কখনো ভালোবাসা শব্দটির সাথে সন্ধি করা যাবে না। নয়তো দুঃখের পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। ঝরতে থাকা অশ্রু গুলোকে দ্রুত হাতে মুছতে মুছতে স্বরূপ সানন্দে গ্রহণ করলো শর্ত দুটি। সে আর পিছু ফিরে তাকালো না। ভালোবাসা শব্দটির সাথেও সন্ধি বিচ্ছেদ করলো।
নিস্তেজ বলহীন দেহে নৈরা তখনো পাথরের ন্যায় অনুভূতি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জোর কদমে হাঁটতে থাকা স্বরূপের দিকে। একটা সময় হারিয়ে গেলো প্রিয় মানুষটি নৈরার দৃষ্টি সীমা থেকে। ঠিক যেভাবে হারিয়ে গেলো নৈরার সকল চেতনা। যেই চেতনা জুড়ে শুধু স্বরূপ ইব্রাহীমের রাজত্ব ছিল।
শুব্রত, আমান, তৈমুর ছুটে গেলো স্বরূপের পিছু্ পিছু। বাহু টেনে দাঁড় করিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো তারা।
–“কি করলি তুই এটা। এতো ভালোবাসার পরেও তুই একটা মেয়েকে এভাবে ফিরিয়ে দিলি?”
স্বরূপ লালচে ঝাঁপসা চোখ তুলে তাকায় বন্ধুদের পানে। থমথমে মুখে বলল,
–“যেই ছেলেটার, নিজেকে এতিম হওয়া থেকে রক্ষা করার সমার্থ্য নেই। সে কি করে একটা মেয়ের দায়িত্ব নেবে? এসব ভালোবাসা আমার মতো অক্ষম মানুষের জন্য নয়।”
~চলবে~