#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ২০
[কঠোরভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য]
যেই দেহে এক ফুলের টোকা পড়তে দিতে নারাজ, আজ সেই দেহেই নুহাশ মাহমুদ আঘাত করেছে। মেয়ের গালে সপাটে এক চর মেরে নিজের রাগ দমায় নুহাশ মাহমুদ। হিসহিসিয়ে বলে,
–“এতোটা নিচে নেমে গিয়েছেন আপনি? ছোট থেকে এই পর্যন্ত মান সম্মানের সাথে বড়ো করেছি এর জন্য— যে আপনি বাবার মুখে চুনকালি মেখে পরপুরুষের জন্য ঘর ছেড়ে পালাবেন?”
ছাব্বিশ বছরের এই জীবনে প্রথমবার বাবার থেকে পাওয়া এই কঠোরতায় অনভ্যস্তত নৈরার মাঝে আশ্চর্য ভাবে আজ কোনরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না। নত মস্তকে মেয়েটি পাথরের ন্যায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে কোন ক্লেশ, ব্যথার চিহ্ন নেই। পরিবারের লোকজন ও নিরব দাঁড়িয়ে। রণমূর্তী এই নুহাশ মাহমুদের সামনা করার সাধ্য তাদের নেই। মিতা আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। নৈরার মতো মেয়ের থেকে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সে মানতেই পারছে না। সদ্য সদর দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকা নোমান বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো বাবার আচরণে। সে ছুটে এসে বোনকে বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজের বক্ষমাঝে। ক্ষিপ্ত স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে,
–“পাগল হয়ে গিয়েছো? ওর গায়ে হাত তুলছো কেনো?”
কথাটি শেষ না হতেই সপাটে এক চড় পড়লো নোমানের গালেও। নুহাশ মাহমুদ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
–“তোমার সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার? আমি জানি নৈরার এই কাজ করার সাহস নেই, তুমি ওকে আস্কারা দিয়েছো।”
নোমান চোয়াল শক্ত করে নিলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–“তো কি করবো তোমার মতো জোরপূর্বক কারোর সাথে ঘর বাঁধতে বাধ্য করবো? প্রত্যেকের নিজস্ব একটা জীবন রয়েছে, নিজস্ব চাহিদা রয়েছে বাবা। বাবা হয়েছো বলে, তুমি জোরপূর্বক ওকে বিয়ে দিতে পারো না।”
নুহাশ মাহমুদ ছেলের চোখে চোখ রেখে বলল,
–“ছেলে মেয়েরা ভুল পথে গেলে বাবা মাকে কঠোরতার সাথে তাদের সঠিক পথে আনতে হবে এটাই নিয়ম। আমি আমার মেয়েকে এমন কারোর হাতে কখনো তুলে দেবো না যার জন্য তিন বেলা খাবার জোগাড় করাই কষ্টকর। তার উপর ঐ ঘরে বিধবা বোন রয়েছে।”
নোমান অবাক হয় বাবার নিম্ন চিন্তাভাবনায়। অবাকের সুরে বলল,
–“হোয়াট ননসেন্স! বিধবা বোন রয়েছে তাতে কি হয়েছে?”
–“আজীবন তো ঐ ভাইয়ের ঘাড়ে বসেই খাবে। বোনের সংসার টানবে না-কি নাজের সংসার? আজীবনের পিছুটান হয়ে ঐ বিধবা বোন আর ভাগ্নে ওর জীবনে থেকে যাবে। কখনো জাগতে পারবে না ঐ ছেলে।”
–“তুমি একজন শিক্ষিত মানুষ হয়েও এতো নিচু চিন্তাভাবনা কি করে রাখতে পারো? তুমি অর্থবিত্তে সমৃদ্ধ হলেও তোমার মনটা যে সংকীর্ণ ই রয়ে গিয়েছে বাবা। তুমি এতোটুকু দেখলে ঐ ছেলেটা এতো কষ্টের পরেও বিধবা বোনকে আল্লাহর ওয়াস্তে ছেঁড়ে দেয়নি বরং শক্ত করে আগলে রেখেছে। ঐ মানুষ টার সান্নিধ্যে দু’টো ভাত ভাগ্যে জুটলেও বড্ডো শান্তি অনুভব হবে। আর তোমার মেয়ে সঠিকটা চিনতে শিখেছে দেখেই অমন একজন মানুষ কে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইছে।”, নোমান তীব্র নিন্দা ছুঁড়ে বলল।
–“কিন্তু আমি চাই না। আমার মেয়ের ভালোমন্দ আমি বুঝবো তুমি না। আমার আর আমার মেয়ের মাঝে একদম নাক গলাবে না নোমান।”, নুহাশ মাহমুদের শানিত কণ্ঠে নোমান ত্যাড়া কণ্ঠে বলল,
–“আমি কখনো তোমায় ওকে জোরপূর্বক বিয়ে দিতে দেবো না। তুমি তোমার দিক থেকে তোমার মেয়ের ভালো দেখবে, আর আমি আমার দিক থেকে আমার বোনের ভালো দেখবো।”
–“খবরদার বলছি নোমান! আমার মেয়ের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করার চিন্তাও মাথায় আনবে না। নয়তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। মেহের নৈরাকে ঠিক করে আবার সাজিয়ে দাও। জুলফিকার ভাইজান রা এখনি এসে পড়বে।”, বজ্রকণ্ঠে আদেশের সুরে বলল নুহাশ মাহমুদ।
এতোকিছুর পরেও যেনো শেষ রক্ষা হলো না। মেয়ের হঠকারিতায় নুহাশ মাহমুদ বিকালে জুলফিকার সাহেবদের আসতে বারণ করেছিলেন। মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে আনতে সে আবার তাদের ফোন করে আসতে বলল। অতঃপর নোমান ব্যর্থ হলো বোনকে দেয়া কথা রাখতে। প্রিয় মানুষটির প্রতি অগাধ বিশ্বাস ভাঙলো বোকা মেয়েটির। বাবার কঠোরতা, প্রিয় মানুষটির দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়ায় মেয়েটিকে দাঁড়াতে হয় অন্য এক পুরুষের সামনে, যাকে সে নিজের জীবনে কখনো কল্পনাও করতে পারে না।
মেয়েটির অভিমান জন্মালো বাবার উপর, অভিমান জন্মলো বারবার ফিরিয়ে দেয়া মানুষটার উপর।
জুনায়েদ নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে নিজের সম্মুখে বসা এক যত্নে মোড়া আদুরে মেয়ের দিকে। যে কি-না বিগত বিশ মিনিট যাবৎ মূতির ন্যায় সোফার এক কিনারায় বসে আছে। তাদের আলাদা কথা বলতে দেয়া হয়েছে বিশ মিনিট হবে। এই বিশ মিনিটের মধ্যে মেয়েটি একবার ও তার দিকে তাকায়নি, কথা বলেনি আর না কোন নড়াচড়া করেছে। ঠিক যেনো এক কাঠের পুতুল। সে মৃদু হাসলো। নিরবতা ভেঙে বলল,
–“আপনার বাবা বলেছিল আপনি একটু অন্যরকম। আজ দেখেও নিলাম ভিন্ন ব্যক্তিত্বের এক মানুষকে। বরাবরই ভিন্ন কিছুতে আমার প্রচুর আগ্রহ কাজ করে নৈরা। জীবনসঙ্গী হিসেবে ও যদি এমন ভিন্নধর্মী কিছু পাই তবে মন্দ হবে না। নতুন করে চিনতে জানতে একটা চমৎকার প্রেম হয়ে যাবে, তাই না? আপনি বোধহয় আনকম্ফর্টেবল হচ্ছেন। আমি আপনার অস্বস্তি আর বাড়াবো না। আজ তবে আসছি। কিন্তু ফিরে আসবো শিঘ্রই আপনার জীবনে স্বস্তির জায়গা করে নিতে।”
জুনায়েদ শেষের কথাটা প্রগাঢ় হেসে বলল। সে ঢাকার স্বনামধন্য এক ব্যবসায়ীর ছেলে হলেও নিজেকে এই পেশা থেকে একদম দূরেই রেখেছে। সে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত। জীবনে সবকিছু রয়েছে এখন প্রয়োজন শুধু একজন ব্যক্তিগত মানুষের। তার পছন্দ হয়েছে ভিন্ন ব্যক্তিত্বের ঐ মেয়েটিকে। সে আগ্রহী মেয়েটিকে জানতে। অবশ্য যদি মেয়েটি জানার অধিকার দেয়।
জুনায়েদ চলে যায়। নত মস্তকে বসে থাকা মেয়েটি এতক্ষণে চোখ তুললো। আজ আর চোখে পানি নেই। উদাসীন দৃষ্টি জানালা ভেদ করে ঘুঁটঘুঁটে অমানিশায় হারিয়ে যায়। বহুক্ষণ বাদ ফিসফিসিয়ে বলে,
–“আমার বিশ্বাসকে এভাবে গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ স্বরূপ। দিনশেষে সবার মতো আপনিও প্রমাণ করে দিলেন আমি বোকা। বোকা নাহলে ভুল মানুষের উপর বিশ্বাস করতাম না আর না ভালোবাসতাম।”
সেই রাতের বৈঠকে নুহাশ মাহমুদ আর জুলফিকার সাহেবদের পরিবারের সম্মতিতে একদিন বাদ নৈরা আর জুনায়েদের ঘরোয়া আকদের দিন নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে অনুষ্ঠান করে তুলে নেয়া হবে।
*****
সময় গড়ায়। কাটে মাঝে একটা দিন। আজ নৈরার বিয়ে। নোমান অস্থির চিত্তে সিগারেটে ফুঁক দিচ্ছে। চিন্তিত তার মুখশ্রী। বন্ধু শাফাকের উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“ব্যাংকারের আর তার পরিবারের কোন খবর পেয়েছিস?”
শাফাক মাথা নেড়ে বলল,
–“হু আমান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল। সে বলল, গতকাল সন্ধ্যা সাতটায় স্বরূপ ভাইয়ের মায়ের অপারেশন হয়েছে, সাকসেসফুললি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফেরার কথা বলছে ডাক্তার। সেই অপেক্ষায় রয়েছে তারা।”
নোমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“যাক আলহামদুলিল্লাহ! এখন শুধু তাদের ফেরার অপেক্ষা।”
রিদওয়ান তার দিকে তাকিয়ে শুধায়,
–“তুই কি করে এতো শান্ত আছিস? আজ নৈরার বিয়ে মনে নেই?”
নোমান সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে বলল,
–“বর ছাড়া বিয়ে কি করে হবে? বর আগে আসুক তারপর তো বিয়ে হবে।”
–“মানে?”, শাফাক, রিদওয়ান কপাল কুঁচকে শুধায়।
নোমান ফিচলে হেসে বলল,
–“আমার বাপের টাকা দিয়ে আমি আমার বাপের বিরুদ্ধেই ষড়যন্ত্র করবো। শালার জুনায়েদ আগে পৌঁছে নিক তারপর নাহয় বিয়ে হবে!”
রিদওয়ান আর শাফাক খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। তারা জাপ্টে ধরলো নোমানকে। নোমান হেসে বলল,
–“নুরুকে কথা দিয়েছি তাকে যেকোন মূল্যে তার স্বরূপের হাতে তুলে দেবো। দেবোই দেবো। আমার বোনটা একদম পাথর হয়ে গিয়েছে। ঐ ব্যাংকারকে পেলে খবর আছে।”
কারোর প্রতি দূর্দমণীয় তীব্র অনুভূতিদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে, দীর্ঘ একটা সময় ঘুমের ওষুধের সাহায্যে নিদ্রাচ্ছন্ন থাকে নৈরা। কিন্তু দীর্ঘ সেই নিদ্রার ঘোর কাটতে না কাটতেই সেই প্রকট অনুভূতিরা ফের তল্পিতল্পা গুছিয়ে হাজির হলো। হাতে গাল দাবিয়ে শুয়ে থাকা মেয়েটি বহুক্ষণ বাদ বদ্ধ নেত্রদ্বয় খুললো; সাথে সাথেই গড়িয়ে পড়তে লাগলো আঁটকে রাখা নোনাজল গুলো। নৈরা ম্লান হাসলো আটকাতে চাওয়া অশ্রুদের আটকাতে ব্যর্থ হয়ে। এভাবেই সে আজ সবকিছুতে ব্যর্থ। কারোর সাথে লড়ে জিততে পারে না নৈরা। কারোর সাথে না। মানুষটার সাথে লড়েও হেরে গেলো সে, বাবার সাথে লড়েও হেরে গেলো, নিজের অনুভূতিদের সাথে লড়েও হেরে গেলো—আজ সামান্য অশ্রু দের সাথেও হেরে গেলো। কেউ একটু দয়া করেও তাকে জিততে দিলো না। কেউ না! আজকের জন্য নৈরা তার জীবন, পরিস্থিতি, অনুভূতি —সবকিছুর কাছে হেরে যাওয়া এক দূর্বল সত্ত্বা।
সাফেদ দেয়ালের দিকে স্থির ভাবে এঁটে থাকা দৃষ্টিদ্বয় মৃদু নড়েচড়ে উঠলো বক্ষমাঝে ছোট্ট নমনীয় এক দেহ সেঁটে যেতেই। নৈরা দেয়াল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নুইয়ে নিজের বুকের সাথে লেপ্টে থাকা ছোট্ট দেহটির দিকে তাকালো। নিশু প্রগাঢ় হাসলো ফুপিকে তাকাতে দেখে। নৈরাও স্মিত হাসলো ভাতিজিকে দেখে। অলস হাতে আরো নিবিড়ভাবে বুকে জড়িয়ে নিলো নিশুকে। নিশু প্রগাঢ় হেসে আদুরে ভাবে ঠোঁট এগিয়ে ফুপির গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। আদুরে গলায় শুধায়,
–“ফুপিমনি তুমি কাঁদছো কেনো?”
নৈরা ম্লান হেসে বলল,
–“কান্না আমার বন্ধু নিশুপিশু তাই কাঁদছি।”
–“কান্না কি করে কারোর বন্ধু হতে পারে?”,নিশুর অবাক কণ্ঠ। নৈরা আলতো হাতে নিশুর বেবি হেয়ারগুলো গুলো গুছিয়ে দিতে দিতে ধিমি ভারী কণ্ঠে বলল,
–“যাদের, জীবন দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাদের বন্ধু হয় কান্না। কখনো ছেড়ে যায় না। খুবই বিশ্বস্ত তবে যন্ত্রনাদায়ক!”
নিশু পিটপিট করে তাকিয়ে রইল ফুপির দিকে। অবুঝ কণ্ঠে শুধায়,
–“যন্ত্রনা দেয়?”
নৈরা টলমলে চোখে মাথা নেড়ে সায় জানায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
–“প্রচুর….যা সহ্য করা যায় না।”
–“তবে কেনো বন্ধু বানালে কান্নাকে?”, নিশু ফের অবুঝ কণ্ঠে শুধায়। নৈরার চোখ থেকে টপটপ করে নোনাজল গুলো গড়িয়ে পড়লো। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
–“আমি বানাই নি তো। সবাই জোর করে কান্নাকে আমার বন্ধু বানিয়ে দিয়েছে। আমি একদম তাকে বন্ধু বানাতে চাইনি। আমি তো হাসিকে বন্ধু বানাতে চেয়েছিলাম কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না জানো নিশু! কেউ শুনলো না। সবাই আমার ভালো চায়। ভালো চাইতে চাইতে কান্নাকে আমার সঙ্গী বানিয়ে দিল।”
নৈরা নিরবে নিঃশব্দে কাঁদছে। নিশু হন্তদন্ত হয়ে দু’হাতে ফুপির চোখের পানি মুছছে। অস্থিরতা তার মুখশ্রীতে। সে কারোর কান্না দেখতে পারে না। অস্থির কণ্ঠে বলল,
–“কেঁদো না ফুপিমনি, নিশুর কষ্ট হয়। নিশুর ও কান্না পায়।”
থামতে না চাওয়া কান্না জোরপূর্বক থামায় নৈরা। নিশুকে বুকে জড়িয়ে তার চোখেমুখে অজশ্র চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
–“নিশুপিশু, তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসবে না।”
–“কেনো?”, নিশুর অবুঝ কণ্ঠ। ভালো কেনো বাসবে না? মাম্মা তো বলে সবাইকে ভালোবাসতে। গুড বেবিরা সবাইকে ভালোবাসে। অজশ্র প্রশ্ন তার মনে।
নৈরা না বোধক মাথা নেড়ে বলল,
–“না বাসবে না। কখনো কাউকে ভালোবাসবে না, কারণ কাউকে ভালোবাসাটা যতোটা সহজ—তাকে নিজের করে পাওয়া ততোটাই কঠিন বুঝেছো? খুব কঠিন। তাই কখনো কাউকে ভালোবাসবে না। ভালোবাসলে কঠিন শাস্তি পেতে হয়। ফুপিমনিকে কথা দাও।”
নিশু অবুঝপানে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বলল,
–“কথা দিলাম কাউকে কখনো ভালোবাসবো না।”
নৈরা কান্নারত মুখশ্রীতে হাসলো। নিশুর বা গালে আরেকটা চুমু দিয়ে বলল,
–“এইতো গুড গার্ল। কখনো কাউকে ভালোবাসবে না, এটা সবসময় মনে রাখবে। নাহলে ফুপির মতো একদিন নিঃশেষ হয়ে যেতে হবে।”
নিশু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নৈরা মৃদু হেসে নিগুঢ় চোখে তাকায় ভাতিজির দিকে। ঠিক তার মতো ফ্যাকাসে বরনের দেখতে নিশু। সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–“আমার নিশু কতো বড়ো হয়ে গিয়েছে। আরো বড়ো হও, অনেক বড়ো। অনেক কিছু শেখো, মানুষ চিনতে শেখো, অনুভূতি, আবেগ সামলাতে শেখো, অনেক স্ট্রং মেয়ে হও। কিন্তু ফুপিমনির মতো কখনো বোকা, অনুভূতির কাছে দূর্বল হবে না। কাউকে কখনো এতোটা ভালোবাসবে না, যতোটা ভালোবাসলে তোমার বেঁচে থাকা কষ্টকর হয়ে যাবে।”
নিশু পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ফুপির কথা। অবুঝ কণ্ঠে বলল,
–“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না ফুপিমনি।”
নৈরা মলিন চোখে তাকায় নিশুর দিকে। জোরপূর্বক কৃত্রিম হেসে বলল,
–“আচ্ছা, বোঝার প্রয়োজন নেই। শুধু এতো টুকু মনে রাখবে কখনো কাউকে ভালোবাসবে না।”
নিশু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। নৈরা তার চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরলো। কিছুক্ষণ বাদ ছেড়ে দিয়ে বলল,
–“ফুপিমনি তোমায় অনেক ভালোবাসি নিশু। আচ্ছা, এখন যাও, মায়ের কাছে যাও। ফুপিমনির সময় ফুরিয়ে আসছে। ফুপি যে আর যন্ত্রনা সহ্য করতে পারছি না।তার যন্ত্রনাদের এখন মুক্তির প্রয়োজন।”
নিশু অবুঝের ন্যায় বিছানা ছেড়ে নামলো। নৈরাও ধীরস্থির বিছানা ছেড়ে নামলো। দিনের দুই প্রহর পেরিয়েছে তখন। সে বড্ডো বদ অভ্যাসের জোরেই ফোনটি হাতে নিলো। কাঙ্খিত নাম্বারটি একবার দেখে সে ম্লান হাসলো। নিশু ছোট ছোট কদমে ঘর থেকে বের হতে হতেও পিছু ফিরে তাকায় ফুপির দিকে। মৃদু আনন্দের সাথে বলে,
–“রাতে তোমার বিয়ে। তুমি কি রাতে লাল টুকটুকে বউ সাজবে? তারপর আমাদের ছেড়ে চলে যাবে? আমি কিন্তু খুব কষ্ট পাবো।”
নিশুর শেষের কথায় মৃদু ক্লেশ ছিল। হাত খোঁপা বাঁধতে থাকা নৈরা’র হস্তদ্বয় শিথিল হয়ে আসে। সে পিছু ফিরে নিশুর দিকে তাকায়। বিষাদে ভরা ম্লান হাসি নিয়ে বলল,
–“আমার লাল টুকটুকে বউ সাজার অধিকার নেই নিশুপিশু। আমি যার জন্য লাল টুকটুকে বউ সাজতে চেয়েছিলাম সে আমায় সেই অধিকার দেয়নি। ফিরিয়ে দিয়েছে।”
–“তুমি এগুলো কি বলছো?”, নিশু বিরক্ত হয়ে শুধায়।
নৈরা ঝাঁপসা হয়ে আসা চোখে কিছু না বোঝালো। নিশু চলে গেলো একরাশ না বোঝা কথা শুনে। আজ যদি ছোট্ট নিশু এই কথাগুলোর মানে বুঝতো, তবে হয়তো এক মুহুর্তের জন্য ও ছাড়তো না ফুপির সঙ্গ। নিশু যেতেই মেহের আর তার এক কাজিন আসলো তার ঘরে। হাতে তাদের রাতে পড়ার জন্য শাড়ি আর গহনা। মেহের নৈরার ফোলা ফোলা মুখটি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো। আলতো হাতে মেয়েটিকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
–“নৈরা, বাবা যা করছে তা তোমার ভালোর জন্য করছে। একটু কষ্ট করে হাসিমুখে মেনে নিয়ে দেখো, একদিন দেখবে তুমি সত্যিই অনেক সুখী হয়েছ। তখন তুমি বুঝবে যে, বাবা ঠিক ছিল আর তুমি ভুল। আমরা কেউ চাই না তোমাকে পস্তাতে দেখতে। তাই একটু কঠোর হচ্ছে বাবা। নিজেকে এতোটা গুটিয়ে নিও না।”
নৈরা কোনোরূপ প্রত্যুত্তর হীন পড়ে রইলো ভাবির কাঁধে। নৈরাকে নিরব দেখে মেহের ভারী নিঃশ্বাস ফেললো। কিছুক্ষণ আদর করে দিয়ে তারা নৈরাকে গোসল করতে বলে বের হয়ে যায়।
আরশিতে ভেসে ওঠা লতানো ছিমছাম গড়নের দেহটিতে আজ দ্বিতীয়বারের মতো প্রিয় মানুষটির দেয়া শাড়িটি জড়িয়েছে নৈরা। আজ আবারো সাজছে নৈরা তবে পার্থক্য শুধু! এতোদিন সাজতো প্রিয় মানুষটির জন্য, আর আজ সাজছে মৃত্যুর জন্য। মৃত্যুর যাত্রা পথটিতেও প্রিয় মানুষটির ছোঁয়া থাকুক। হয়তো যন্ত্রনা কম হবে।
মেরুন রঙা শাড়ির সাথে স্বরূপের কিনে দেয়া মাটির আর কাঠের অলংকার গুলো যত্ন সহকারে দেহে জড়িয়ে নিলো নৈরা। প্রত্যেকটা জিনিসে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিতে ভুলেনি সে। এই তো শেষ ছোঁয়া। এতোটুকু ছোঁয়ার অধিকার তার রয়েছে। তাই সে মন ভরে প্রিয় মানুষটির দেয়া জিনিস গুলোকেই ছুঁয়ে দিয়ে নিজের অতৃপ্ততা পূরন করার মৃদু ব্যর্থ প্রচেষ্টা করলো। অবশ্য অসফল ও হলো। মানুষটাকে ছোঁয়ার, ভালোবাসার অতৃপ্ততা তার এজন্মে যে আর মিটবে না আর না মেটার সুযোগ আছে। চোখে কাজল টেনে নৈরা মেঝেতে পা গুটিয়ে বসলো। পিঠ ঠেকিয়ে দেয় বিছানার সাথে। পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু তৈজসপত্র! বদ অভ্যাসের জোর বেশি হওয়ায় সর্বপ্রথম সে ফোনটি হাতে নিলো। লোকটি, তার সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ রাখেনি। সিমটাই ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছে। নৈরা হাসলো লোকটার কঠোরতায়, হাসলো নিজের উপর ও। ঐ নাম্বার ব্যতীত স্বরূপের সাথে যোগাযোগ করার আর কোন উপায় নেই নৈরার কাছে। আজ সেটুকুও ভাগ্য থেকে খসে পড়তেই, নৈরার নিঃশেষ হওয়ার পয়গাম ও জারি হয়ে গেলো। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নাম্বারটির দিকে। ঠোঁটের আগায় থাকা এই গুটি কয়েক সংখ্যা ও আগে নৈরাকে কতো সুখ এনে দিত। নৈরা আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখতে লাগলো তার বোকা মনের অপূর্ণ স্বপ্নগুলো সেই মানুষটির কাছে যেই মানুষটির কাছ থেকে এতো দিন এই স্বপ্নগুলো লুকিয়ে আসছে। বলার সাহস হয়নি!
–“এক প্রলয়ঙ্কারী ঝড়ের রাতে আমি বারান্দায় বসে বই পড়ছিলাম, কিন্তু তখনি বিদ্যুৎ চলে যায়। আমি চরম বিরক্ত হলাম। বিরক্ত হওয়ার কারণ ছিল বই পড়া ছাড়া আমার আর কোন পছন্দের কাজ ছিল না। তারমানে পরবর্তী সময়গুলো আমার খুবই বোরিং কাটবে। আমি বড্ডো উদাসীন দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকালাম, ঝড়ো হাওয়া বইছে সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। মানবশূন্য পথঘাট দেখতে দেখতেই সেই ঝড়ের তীব্র হাওয়ার বেগ পেরিয়ে কয়েকটা ছেলে দৌড়ে এসে চায়ের দোকানে ঢুকলো। স্ট্রিট আলোয় আমি দেখলাম কাকভেজা হয়ে সদ্য চায়ের দোকানে ঢোকা ছেলেগুলো কে। তা দেখেও বিরক্ত হলাম এই ঝড়ের মাঝে কেনো এই ছেলেগুলোর বের হতে বলে। কিন্তু ততক্ষণে আমার বিরক্তিতে উদ্বেগ আঁছড়ে পড়লো, হঠাৎ ঝড়ের মাঝে সাদা টিশার্ট আর লুঙ্গি পড়া এক ছেলেকে একটা নোংরা বাচ্চা কুকুরকে কোলে নিয়ে চায়ের দোকানে ঢুকতে দেখে। জানি না অযথা আমার বেশ আগ্রহ হলো বিষয়টি খুঁটে খুঁটে দেখার জন্য , এটা জানার জন্য কেনো ছেলেটা নোংরা কুকুরটিকে এতো যত্ন করে কোলে নিয়ে আছে?
কুকুরের বাচ্চাটিকে ছেড়ে দিতেই দেখলাম সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। সাদা টিশার্ট পড়া ছেলেটা তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে তাকে আদর করছে আর পা টা দেখার চেষ্টা করছে। আমি দূর থেকে ধারণা করলাম হয়তো কুকুরটি ঝড়ের কবলে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আর ঐ ছেলেটা কুকুরটিকে উদ্ধার করে এনেছে। ছেলেটা চায়ের দোকানে বসেই কুকুরটির পায়ে গরম ভাব দিলো, তেল মালিশ করলো। কিন্তু আমি যে কখন আমার বিরক্তি ভুলে ঘন্টা এক তাদের কর্মকাণ্ড দেখেই কাটিয়ে দিলাম তা বুঝতে পারলাম না। আমার বড্ডো স্বাভাবিক ভাবে দেখা দৃশ্যে হঠাৎ আরেকবার বাঁধা সৃষ্টি হলো, যখন সাদা টিশার্ট পড়া ছেলেটিকে তার বন্ধুরা সিগারেট খেতে বলল কিন্তু ছেলেটা নাকোচ করলো। বন্ধুরা বারবার জোর করলেও ছেলেটা ছুঁয়েও দেখলো না সিগারেট। ছেলেটির সেই কাজে আমি বেশ প্রসন্ন হলাম। ছেলেটি এক কাপ চা খেয়েছিল পুরো সময়টাতে। সেইদিন বই ব্যতীত কেউ আমার সময় গুলোকে বোরিং হওয়া থেকে রক্ষা করেছিল। তবে ভাবতে পারেনি সাধারণ একটা সিগারেট নাকোচ করায়, ছেলেটি আমার থেকে ঠিক দু দুটি বছরের পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নেবে বই নামক প্রিয় জিনিস থেকে। হ্যাঁ, দ্বিতীয় দিন ও ছেলেটা একই ভাবে সিগারেট নাকোচ করলো। এভাবে প্রতিদিন সিগারেট নাকোচ করা ছেলেটার এক একটা কর্মকাণ্ড দেখতে আমার আঁখিদ্বয় বড্ডো কৌতুহলী হয়ে পড়ে। অদ্ভুত ভাবে ছেলেটাও রোজ ঐ একই সময়ে ঐ চায়ের দোকানে আসতো! সেই অযাচিত কৌতুহলের সাথে আমি কখন যে দুইটি বছর কাটিয়ে দিলাম সেটা আমার অজানা। ছেলেটা প্রতিদিন নিয়ম করে রাত সাড়ে নয়টা থেকে সাড়ে দশটা আমার বারান্দার সামনে চায়ের দোকানে কাটাতো। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত ভাবে ছেলেটার চোখে আমার চোখ পড়ে যেতো। আমি তখন অপ্রস্তুত, ভয় পেয়ে যেতাম মুখ লুকাতাম বইয়ে। তারপর হঠাৎ একদিন সর্বদা দূর থেকে দেখা সেই ছেলেটির সাথে আমার সামনাসামনি দেখা হলো। মানুষটা দূর থেকে যতোটা সুন্দর কাছ থেকে ঠিক ততোটাই মনোমুগ্ধকর। তেমনি মনোমুগ্ধকর তার ব্যক্তিত্ব। দূর থেকে যতোটা তার প্রেমে পড়তাম কাছে থেকে তার থেকেও দ্বিগুণ বাজেভাবে আমি তার প্রেমে পড়ি। দেখুন আজ সেই প্রেম আমায় সর্বহারা করে দিল।
–“একটা ছোট্ট ঘর, যেই ঘর আপনার কষ্টের অর্জনে গড়া হবে। সেই ঘরটির যেই কামড়ায় আপনার বাস, সেই জায়গায় আমারো ছোট্ট একটা অবস্থান হবে আপনার স্ত্রী হিসেবে। আপনার সামার্থ্যের মধ্যে যেইটুকু পোশাক আপনি আনবেন সেটুকুই আমার দেহে শোভা পাবে। আপনার সামার্থ্যের মধ্যে তিনবেলা যতোটুকু জুটবে ততোটুকুতেই নিজের খিদে মিটিয়ে নেবো। যদি কখনো খাবার জোগাড় করতে না পারেন— তবে অনেক বেশি বেশি ভালোবাসা দিয়ে তা নাহয় পুষিয়ে দেবেন। রোজ শাড়ি পড়ে আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো। কখন আপনি ক্লান্ত শরীরে, বাজার করে নিয়ে ঘরে ফিরবেন আর আমি চোখ ভরে দেখবো। যখন আপনার লোন শেষ হয়ে যাবে তখন আমরা সবটা গুছিয়ে নিয়ে একটা সুখের সংসার গড়বো। তারপর সেই সুখের সংসারে একটা ছোট্ট পুতুল নিয়ে আসবো। নৈরা আর স্বরূপের অংশ। নাম হবে নৈরূপ! মেয়ে হোক ছেলে হোক তার নাম হবে নৈরূপ ইব্রাহীম। আমরা তাকে একসাথে বড়ো করবো। সে ছোট ছোট হাত পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বড়ো হয়ে যাবে। আধো আধো কণ্ঠে আপনাকে বাবা ডাকবে আর আমায় মা। এইতো এতোটুকুই চাওয়া ছিল আপনার কাছে। খুব বেশি কঠিন স্বপ্ন দেখে ফেলেছি কি স্বরূপ? কঠিন ই বোধহয়।
নয়তো আপনি এভাবে বারবার ফিরিয়ে দেবেন কেনো? এতো এতো অতৃপ্ত তা নিয়ে তো মৃত্যু ও আমার কাছে দুঃস্বপ্ন অথচ আপনি আমায় সুখে বাঁচতে বলেন এই অতৃপ্ত তা নিয়ে। আপনি বড্ডো কঠোর স্বরূপ?”
লিখতে লিখতেই নৈরার গাল বেয়ে অজশ্র আক্ষেপ জড়িত নোনাজল গড়িয়ে পড়লো। সে একাধারে তাকিয়ে থাকে স্বরূপের একটা ছবির দিকে।
বড্ডো আক্ষেপের সাথে বিড়বিড় করে বলে,
–“আপনার কাছে একটা লাল বেনারসী চেয়েছিলাম অথচ আপনি কাফনের কাপড় ধরিয়ে দিলেন। কাউকে ভালোবাসার শাস্তি এতোটা কঠোর জানলে আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতাম না বিশ্বাস করুন। কখনো না। আপনি বলেন আপনার সামার্থ্য নেই কিন্তু আপনি জানেন ই না আপনি কতোটা সামার্থ্যবান।”
নৈরা চোখের পানি নিয়েই এবার খাতাটা হাতে তুলে নিলো। গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,
–“বাবা, আমি জানি তুমি কখনো আমার খারাপ চাওনা। কিন্তু আমি যে নিরূপায়, কি করবো বলো, লোকটা কখন যে আমার ভালোথাকার কারণ হয়ে গেলো আমি নিজেই বুঝলাম না। তবে আজ আর আমার কোন অভিযোগ নেই তোমার উপর। আমার সব অভিযোগ লোকটার উপর। কেনো আমায় আগলে নিলো না? একটু আগলে নিলে কি হতো! আমায় দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। দেখো আজ আমি সর্বহারা।
জীবনের দুয়ার আমার জন্য চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে আজ। আমার জীবন তো সে! সেই তো আমায় ফিরিয়ে দিয়েছে তবে আমি কিসের জন্য বাঁচবো বলো। এভাবে বেঁচে থাকা তো তিলে তিলে গুমড়ে মরা। তার চেয়ে একবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়াই উত্তম। আমায় ক্ষমা করে দেবে বাবা। ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। তবে এ জীবনে স্বরূপ ব্যতীত কাউকে গ্রহণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
এতোটুকু লিখে নৈরা ঐ পৃষ্ঠার নিচে ছোট্ট করে লিখলো,
–“ছোট ভাইজান ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি।”
খাতাটা বন্ধ করে রাখলো নৈরা। কাঁপা কাঁপা হাতে পাশে রাখা ডিসসেকশন কিট থেকে ছোট্ট একটা নাইফ হাতে তুলে নিলো। সেটি চোখের সামনে তুলে ধরতেই বাবার কিছু স্মৃতি ভেসে উঠলো। এটা বাবার কেনা একটা কিট ছিল। স্নাতকে পড়াকালীন তার অনেক সময় ল্যাবে কাটাছেড়া করার প্রয়োজন পড়তো তখন বাবা এই কিটটা কিনে দিয়েছিল। সে হাসলো বাবারা সবসময় সন্তানদের দুঃখ দূর করে। এই যে আজ তাকে অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিচ্ছে বাবার দেয়া এই ছোট্ট নাইফটি। নৈরা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাইফটির দিকে। বিষাদের হাসি লেপ্টে আছে তার মুখে।
*****
নোমান ঘরে ফিরলো দুপুর আড়াইটার দিকে। সোজা বোনের ঘরের দিকে গেলো। এই দুদিনে মেয়েটির সাথে একটাও কথা হয়নি তার। কোন মুখে বলবে সেদিন যে তার দেয়া কথা রাখতে পারেনি। তাই আজ বিয়ে বন্ধ করার সবটা ঠিক করে এসেই বোনের মুখোমুখি হচ্ছে। বোনের কান্না মাখা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলবে,
–“তাকে স্বরূপ ব্যতীত আর কারোর জন্য বউ সাজতে হবে না।”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বদ্ধ দরজায় নক করে ডাকলো বোনকে।
–“নুরু? ভাইজান এসেছি দরজা খোল।”
নোমান ডাকলো বার কয়েক কিন্তু সাড়াশব্দ আসলো না। নোমানের ললাটে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ দেখাগেলো। সে জোরে দরজা ধাক্কাতে যাবে তার আগেই তার পায়ে অদ্ভুত কিছু অনুভব হলো। সে কপাল কুঁচকে নিজের পায়ের দিকে তাকায় সহসা তার দৃষ্টি হকচকায়। দরজার ফাঁক গলিয়ে সরু লাল তরল পদার্থের স্রোত দেখতেই। সে চকিতে বৃহৎ নয়নে তাকায় বদ্ধ দরজার পানে। বিলম্বহীন গগনবিদারী চিৎকার করে ডেকে উঠলো,
–“নৈরাআআআ?”
সেই মুহূর্তে পাঁচ জনের শক্তি ভর করলো মনে হয় নোমানের মাঝে। নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে নোমান দরজা ভাঙতে লাগলো। মস্তিষ্ক এতোটাই অচল হয়ে পড়লো যে তার মাথাতেই নেই সে চাইলেই দরজার দ্বিতীয় চাবি দিয়ে দরজা খুলতে পারতো। একজন মেইড নোমানের এমন হম্বিতম্বি দেখে দৌড়ে গিয়ে চাবি আনলো। নোমান হতবুদ্ধি হয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলতেই সর্বশান্ত হয়ে গেলো তার দেহ। শুভ্র টাইলসের মেঝেতে সুবিস্তৃত লাল তরল পদার্থের মাঝে নিথর পড়ে আছে নৈরার দেহ। কাটা কব্জি দেখতেই নোমান চেঁচিয়ে উঠলো। সে কি বিভৎস দৃশ্য! বোনের রক্তে পা দিয়ে বোনের কাছে যেতে হচ্ছে নোমানকে। বোনের নিথর দেহ কোলের মাঝে নিয়ে নোমান গলা কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে করতে চিৎকার করে বলতে লাগলো,
–”নুরু? এই নুরু? এই পাগল মেয়ে তুই এটা কি করলি? তুই এটা করতে পারিস না নুরু। তোর ভাইজানের উপর তোর একটুও বিশ্বাস ছিল না? তোর ভাইজান তোকে কখনো অন্য কারোর সাথে বিয়ে হতে দেবো না বলেছি না? তুই একটু বিশ্বাস রাখতে পারলি না? এই বেয়াদব মেয়ে! তুই কথা বলছিস না কেনো? ওঠ নুরু। চোখ খোল। ভাইজান তোকে তোর স্বরূপের হাতে তুলে দেবো যেকোনো মূল্যে নুরু, ওঠ। কিছু হয়নি ভাইজান আছি তো। আমরা এখনি হাসপাতালে যাবো। তুই ঠিক হয়ে যাবি।”
নোমান ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বোনের নিথর দেহটা কোলে তুলে ছুটতে লাগলো। হাওয়ার বেগে। নুহাশ মাহমুদ মেয়েকে দেখার উদ্দেশ্যে উপড়ে উঠছিলেন। সকল থেকে সে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মেয়ের বিয়ের প্রস্তুতি চলছে যে! কিন্তু পাঁচ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই তার দৃষ্টি থমকায় র”ক্তা”ক্ত অবস্থায় মেয়েকে কোলে নিয়ে উন্মাদের মতো নোমানকে দৌড়াতে দেখে। সে ভয়ার্ত অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে,
–“আম্মা?”
মুহুর্তেই সে চিৎকার করে উঠলো,
–”আম্মাআআ? আপনার কি হয়েছে? নৈরার গায়ে এতো রক্ত কেনো নোমান?”
নুহাশ মাহমুদ পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে উপড়ে উঠলো। মেয়েকে ছুঁতে গেলেই নোমান কান্নারত চোখে হুঙ্কার ছাড়লো,
–“খবরাদর! একদম ছুবে না আমার বোনকে। দূরে সরো। আজ ওর এই পরিণতির জন্য তুমি দায়ী। আমার বোনের যদি কিছু হয়েছে তবে আমি তোমায় কোনদিন ক্ষমা করবো না।”
নোমান ফের ছুটতে লাগলো। দৌড়ের তালে বারংবার কেঁপে উঠছে তার পা দু’টো। মনে মনে প্রার্থণা করে, বোনের নিথর রক্তাক্ত দেহ নিয়ে কোন ভাইকে ছুটতে হয় এমন অভিশপ্ত মুহূর্ত যেনো কোন ভাইয়ের কপালে না জুটে।
~চলবে~