#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#পর্বঃ২১
[কঠোরভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রাপ্ত মনস্কদের জন্য]
হাসপাতালের স্টিলের বেঞ্চিতে ঝিমিয়ে বসে থাকা ভারী দেহটার মাঝে চাপা অস্থিরতা, ঘন ঘন নিঃশ্বাসের তালে বক্ষস্থলের অস্বাভাবিক ওঠানামা স্পষ্ট নির্দেশ করছে ছেলেটার দৈহিক অস্থিতিশীলতা। নত মস্তকে স্বরূপ বারবার ঘাড় চেপে ধরছে। প্রেশার বেড়েছে বোধহয়। বাবা মায়ের মতো সেও উচ্চ রক্তচাপের রোগী। ডাক্তারের সাথে মাত্র ই কথা বলে আসলো, ডাক্তার বলেছিল চব্বিশ ঘন্টার আগেই জ্ঞান ফিরে আসবে। কিন্তু এখনো মায়ের জ্ঞান ফিরছে না। ডাক্তার নিয়ম করে এসে চেকাপ করে যাচ্ছে। কোন সমস্যা নেই। চিন্তা, অজানা অস্থিতায় কাবু হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছে ক্লান্ত দেহটি। কেনো এতো অস্থির লাগছে? বুকটার ভেতর কোন অজানা ব্যথারা কেনো দলা পাকাচ্ছে?
বিভোরকে খাইয়ে সাধনা মাত্রই মায়ের কেবিন থেকে বের হয়। চোখেমুখে তার নির্জীব মলিনতা। বিগত দুইটা দিন এই দুই ভাই-বোনের উপর দিয়ে কম ধকল যায়নি। একটু বিশ্রাম করার সুযোগ পায়নি। ভাইকে বেঞ্চিতে মাথা নুইয়ে বসে থাকতে দেখে সে এগিয়ে আসে। ঘাড়ে হাত ঘষতে থাকা ভাইয়ের চুলে হাত গলিয়ে দিয়ে আদুরে গলায় শুধোয়,
–“কখন এলি? এখানে বসে আছিস কেনো? খিদে পেয়েছে না, চল খাইয়ে দেই।”
স্বরূপ নিজের অস্থিরত লুকিয়ে বোনের দিকে তাকায়। ভাইয়ের চোখেমুখে স্পষ্ট অস্বাভাবিকতা সাধনার নজর এড়ায় না। সে ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধায়,
–“কি হলো এমন লাগছে কেনো? শরীর খারাপ করছে?”
স্বরূপ ডানে বামে মাথা নাড়লো। বুকের ভেতরে চলা অদৃশ্য উচাটন সামলে মিহি স্বরে বলল,
–“একটু প্রেশার বেড়েছে বোধহয়।”
সধনা মলিন চোখে দেখে চুপসে যাওয়া শুকনো মুখটি। বলল,
–“এতো চিন্তা করছিস কেনো? অপারেশন সাকসেসফুল তো হয়েছে না? ডাক্তার ও তো বলল সব ঠিক আছে, ফিরে আসবে মায়ের জ্ঞান।”
স্বরূপ মিহি স্বরে জবাব দেয়,
–“জানি আপা, আম্মার কিছু হবে না। হয়তো একটু সময় নিচ্ছে জ্ঞান ফিরতে, তবে ফিরবে।”
–“তবে কেনো এতো চাপ দিচ্ছিস নিজের উপর? যা এখন নিচে ফার্মেসিতে গিয়ে প্রেশারের ওষুধ নিয়ে আয় আর টক কিছু খেয়ে আয়।”
“এতো চাপ কেনো নিচ্ছিস!”কথাগুলো বলা যতোটা সহজ, স্বরূপ নামক ছেলেটার জীবনের সমীকরণ বোঝা যেনো ততোটাই কঠিন। বাড়ির লোন, মায়ের চিকিৎসার খরচ, দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন কতো কতো ভারের বোঝা এই একটা কাঁধের উপর। চিন্তা আনা যাবে না, আনা যাবে না করেও চিন্তা তো থেকেই যায়। এটা সাধনা বুঝবে ন! দায়িত্বের দোরগোড়ায় থাকা মানুষগুলোর চিন্তা আনার প্রয়োজন পড়ে না এটা তো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবে এই উদ্বিগ্নতা, অস্থিরতা যে অন্য কিছুর জন্য, কিন্তু কি? স্বরূপ নিজেও জানে না। সে বোনের হাতটা আঁকড়ে ধরলো। বড্ডো ক্ষীণ স্বরে মনের মধ্যে চলা উচাটনের কথা জানিয়ে বলল,
–“কেমন যেনো অস্থির লাগছে আপা। মনে হচ্ছে কিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে, আমি ধরে রাখতে পারছি না। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে!”
ভাইয়ের অস্থির কণ্ঠে সাধনা ছলছল নয়নে বলহীন দেহে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। এই নির্জীবন মুখটায় দুদিন আগেও সে কি খুশির আমেজ ছিল! কতোটা বছর পর তার ভাইয়ের এই ক্লান্ত জীবনে সুখ হয়ে আসার কথা ছিল নৈরা নামক মেয়েটির। পরীর মতো দেখতে মেয়েটি তার ভাইটাকে বড্ডো ভালোবাসে। তার ভাই দেখিয়েছে তাকে, বেনারসী কিনতে যাওয়ার যাত্রাপথে মেয়েটির পাগলামি গুলো বলেছে। সে দেখেছে সেদিন সকালে স্বরূপ নৈরাদের বাসায় প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার জন্য কতোটা উচ্ছ্বসিত ছিল। পুরো মার্কেট ঘুরে নিজে পছন্দ করে একটা লাল টুকটুকে বেনারসী কিনেছিল। কিন্তু তা আর পৌঁছে দিতে পারলো না মেয়েটির কাছে। ছেলেটার সব প্রত্যাশা, খুশি, উচ্ছ্বাস যেনো নিমিষেই ফিকে পড়ে গেলো! জীবন থেকে এক টুকরো সুখের কারণ যেনো ছুঁয়েও ছুঁতে পারলো না স্বরূপ। এর জন্যই কি এতো অস্থিরতা? সে জানে ভাইয়ের এই না বলা অস্থিরতার কারণ নৈরা! সে মিহি স্বরে বলল,
–“নৈরার ভাই আমায় কথা দিয়েছে, নৈরাকে তার স্বরূপ ব্যতীত আর কারোর হতে দেবে না। ঐ অভদ্র লোক প্রচুর জেদি আর নাছোড়বান্দা। আমি জানি সে যেকোন মূল্যে তার কথা রাখবে।”
বোনের কথায় স্বরূপ বিষাদে ভরা ম্লান হাসলো। চোখদুটো বিনা অনুমতিতে টলটল করে উঠলো। তার বোন যে জানেই না, তার বোকা কাঞ্চনবালা সব ছেড়েছুড়ে চলে এসেছিল তার কাছে। কিন্তু নৈরার পাষাণ স্বরূপ তাকে কিভাবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। সে জানানোর আগ্রহ ও প্রকাশ করলো না। ঐ পথে সে আর কখনো পা বাড়াবে না আর না টপিক সে তার জীবনে কখনো তুলবে। পিছু ফিরে আর তাকাবে না। সে কথা এড়িয়ে গিয়ে, এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মিহি স্বরে বলল,
–“তুই যা কেবিনে গিয়ে বস। আমি প্রেশারের ওষুধ নিয়ে আসি আর আচার পাই নাকি দেখে আসি।”
সাধনা মলিন মুখে মাথা নেড়ে সায় জানালো। স্বরূপ টলটলে আঁখি নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। সাধনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভাইয়ের পালিয়ে যাওয়া দেখে। ছেলেটা নিজেকে মেকি স্ট্রং দেখাতে চাইছে। সে দ্রুত কেবিনে ঢুকলো। চার্জের অভাবে এতো দিন বন্ধ হয়ে থাকা ফোনটি আজ ই চার্জ দিয়েছে। সে ফোনটা খুলতেই দেখলো, নোমানের অজশ্র ফোন আসা। সে দ্রুত নোমানকে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন সুইসড অফ! তার ভয় হতে লাগলো, নৈরার বিয়ে হয়ে যায়নি তো? সে আরো কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে, অস্থিরতা অপেক্ষা করলো নোমানের ফোন অন করার।
*****
স্বরূপ হাসপাতালের নিচেই ফার্মেসিতে গিয়ে প্রেশারের ওষুধ কিনে, কনফেকশনারি দোকান থেকে দুই প্যাকেট তেঁতুলের চাটনি কিনলো। অতঃপর হাসপাতালের নিচ তলায় রিসিপশনের পাশে বিশাল খালি নির্জন জায়গায় সাড়ি সাড়ি পেতে রাখা একটি বেঞ্চিতে বসলো। দুপুরের দিক হওয়ায় মানুষের আনাগোনা একটু কম। সে নিরবে আচারের প্যাকেট ছিঁড়ে খেতে লাগলো। ঘাড়ের বা পাশের ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম। মাথার পেছনটাও ব্যথায় ভার হয়ে আছে, মনে হচ্ছে বমি হবে। উদাসীন দৃষ্টি অদূরে রেখে অপছন্দনীয় টক আচারের দুটি সে অনায়াসেই নিরবে বসে বসে খেয়ে ফেললো। আমাদের জীবন বড়োই অদ্ভুত ! অপছন্দের জিনিসগুলো আমাদের সামনে সবসময় বাধ্যতামূলক করে তুলে ধরে আর পছন্দের জিনিস গুলোকে করে নিষিদ্ধ! মলিন হাসে স্বরূপ। কিয়ৎকাল বাদ সে ধীরস্থির পকেট থেকে ফোনটা বের করে হাতে নেয়। ঘড়িতে বাজে ঠিক তিনটা। কয়েকদিন আগেও সে সুপ্ত উত্তেজনা নিয়ে পুরো দিনভর অপেক্ষা করতো কখন বিকেল হবে। অথচ আজ তার বিকেল গুলো কতোটা বেরঙ, ক্লেশদায়ক। এখন আর কাঞ্চনবেলায় স্টিলের বেঞ্চিতে বোকা কাঞ্চনবালার দেখা পাওয়ার অধীর অপেক্ষা থাকবে না।
মানুষ বোধহয় বড্ডো দূর্বল বদ অভ্যাস গুলোর কাছে। নয়তো কেনো বারবার যাবে না, যাবে না, করেও তার দুয়ারে হাজির হয়? ব্যাক কভারের ভেতর খুলে রাখা সিমটা আবার বদ অভ্যাসের জোরেই বের করলো স্বরূপ। কিয়ৎকাল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো সিমটির দিকে। মনকে মেকি বুঝ দিল, সিম ঢুকালে তো আর মেয়েটি জানতে পারবে না। সে সিমটা আবার ফোনে ঢুকালো একটু অস্থিরতা কমানোর জন্য! মেয়েটির থেকে আর কোন বার্তা এসেছে কি? না-কি মেয়েটি অন্য কারোর নামে হয়ে গিয়েছে?
স্বরূপের উদাসীনতা চমৎকারভাবে ভঙ্গ হলো, সিমটি অন করার সাথে সাথে কাঞ্চনবালা নাম্বারটি থেকে অজশ্র নোটিফিকেশন পেয়ে! স্বরূপের নির্জীব মুখশ্রী ঠিকরে এক ফালি হাসি বেরিয়ে আসলো। সে বড্ডো উৎসুকতার সাথে হোয়াটসঅ্যাপের মেসেজ অন করলো। ধীরস্থির সময় আর যত্নের সাথে মেয়েটির পাঠানো মেসেজ গুলো পড়তে লাগলো। নিমগ্ন চিত্তে মেয়েটির প্রেমে পড়ার গল্প শুনে সে স্মৃতিচারণ করলো সেই ঝড়ের রাতটি। খুলনার মোংলা পোর্ট সহ আশেপাশের সব জায়গায় সেদিন নয় নাম্বার বিপদসংকেত ছিল। তবুও সেই ঝড়ের রাতে সে আর তার বন্ধুরা গিয়েছিল ঐ চায়ের দোকানে চা খেতে। সবচেয়ে সুস্বাদু চা কি-না! কেনো সুস্বাদু সেটি আর বলা হলো না। স্বরূপ হেসে নিচের মেসেজ গুলো পড়তে লাগলো। মেয়েটির স্বপ্নগুলো পড়তে গিয়ে মুহুর্তেই আঁখি দ্বয়ে অনুশোচনা অনুতপ্ততা ঘিরে ধরলো। সেই অনুশোচনা নিয়েই সে পরবর্তী স্বপ্নগুলোও সে পড়তে লাগলো। পড়তে পড়তেই ছোট্ট একটা পুতুল আর পুতুলের জন্য নির্ধারিত নাম শুনে সে সরব হো হো করে হেসে উঠলো—অথচ চোখের কোনা অশ্রুসিক্ত। সে হাসি থামায়। ঠোঁট নেড়ে উচ্চারণ করলো,
–“ছোট্ট একটা পুতুল! স্বরূপ আর নৈরার অংশ, নৈরূপ! নৈরা’র—নৈ আর স্বরূপে’র—রূপ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন!”
বলতে বলতেই স্বরূপের চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। অশ্রুভরা নয়নে বড্ডো আক্ষেপের সাথে বিড়বিড় করলো,
–“সৃষ্টিকর্তা এতো সুন্দর স্বপ্ন শুনেও কি করে আমীন বললো না, নৈরা?”
সে চোখের পানি মুছে আবার পড়তে লাগলো। কিন্তু পরবর্তী লাইন গুলো পড়তেই তার অনুভূতিরা বদলে যেতে লাগলো। তার দৃষ্টি থেকে মুগ্ধতা সরে যায় মুহুর্তেই। সে হতচকিত মাথা নুইয়ে বারবার পলক ঝাপটে পড়তে লাগলো শেষের লাইনগুলো! মুহুর্তেই তার দেহের সকল সুখ, আনন্দ ভয়ে পরিণত হতে লাগলো। সে আরেকবার পড়লো শেষের মেসেজটি।
–“আপনার কাছে একটা লাল বেনারসী চেয়েছিলাম অথচ আপনি কাফনের কাপড় ধরিয়ে দিলেন।”
অশনিসংকেতের রেশ স্বরূপের চোখেমুখে। সে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
–“কাফন?”
তার অস্থিরতারা নতুন মাত্রা পেলো! ভয়ানক মাত্রা। স্বরূপ ছটফট করে উঠলো। ঘেমে উঠলো, মস্তিষ্কে একের পর এক কুচিন্তা জেঁকে বসতেই। সে জানে নৈরা
নরম! কিন্তু কতোটা? তা কি সে জানে? না জানে না। এতোটা জানার সাহস তার কখনো হয়নি যে! অন্তঃস্থলের উচাটন একদমই হেলা করার মতো নয়। তাই সব দ্বিধা ভুলে স্বরূপ দ্রুত রিদওয়ানকে ফোন দিলো। একমাত্র ও ই নৈরার সঠিক খবর দিতে পারবে। রিদওয়ান একটু বলুক মেয়েটি ঠিক আছে। তাতে যদি সে অন্যের ঘরে, অন্যের বউ হিসেবে ও থাকে তবুও থাকুক। কিন্তু সে ঠিক থাকুক। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় ফোনটি দুইবারেই রিসিভ হলো। স্বরূপ হন্তদন্ত হয়ে শুধায়,
–“রিদওয়ান, আমায় একটু সাহায্য করবে? তুমি একটু খোঁজ নিয়ে বলবে নৈরা কেমন আছে? ঠিক আছে তো?”
বা হাতে কানে ফোন ঠেকিয়ে রিদওয়ান এক পলক তাকায় নিজের সম্মুখের স্ট্রেচারের দিকে। আরেকপলক তাকায় নিজের রক্ত মাখা ডান হাতের দিকে। একটা ঢোক গিলে ক্ষীণ স্বরে ডেকে ওঠে,
–“স্বরূপ ভাই?”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ রিদওয়ান। বলো, একটু নৈরার খোঁজ দিতে পারবে? তুমি তো ওদের বাসাতে প্রায়ই যাও, তাই না? আমায় একটু দ্রুত ওর খোঁজ দাও না ছোট ভাই!”, স্বরূপ ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল। কণ্ঠেই তার তাড়া! রিদওয়ান থমথমে মুখে বলল,
–“ভাই একটু ভিডিও কলে আসবেন?”
–“হ্যাঁ,আমি এখনি আসছি।”, স্বরূপ দ্রুত ফোন কেটে রিদওয়ানকে ভিডিও কল দিলো। রিসিভ হতেই রিদওয়ানের মুখটি ভেসে উঠলো। মুখে তার এক নিঃশেষিত শোকের ছায়া। সাথে সাথেই কর্নকুহর চিরে প্রবেশ করে অজশ্র হাহাকার, আর্তচিৎকার সহ এম্বুলেন্সের কান জ্বালাময়ী ভীতিকর আওয়াজ। যেটা বিগত কয়েকদিন যাবৎ লাগাতার শুনে আসছে স্বরূপ। বড্ডো বিদঘুটে ভয়ানক এই আওয়াজ। তার ভয় হয় এই আওয়াজ শুনলে। বক্ষস্থলে কাঁপন ধরে। স্বরূপের চঞ্চল, অস্থির ফেলতে লাগলো। তার চঞ্চল দৃষ্টি আচমকা স্থির হয়, স্ক্রিন থেকে রিদওয়ানের মুখটি সরে গিয়ে আপাদমস্তক একটা সাদা কাপড়ে আবৃত অবয়ব ভেসে উঠতেই। অবুঝ কৌতুহলী নয়নে তাকায় সে স্ক্রিনের পানে। তার স্থির চোখদুটি হতচকিত থমকায় রিদওয়ান হাত বাড়িয়ে সাদা কাপড়টি মুখের ওপর থেকে সরাতেই। স্বরূপের রুহ কেঁপে উঠলো সাদা কাপড়ের আড়ালে থাকা অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাশে প্রিয় মুখটি দেখতেই। দেহের এক একটা রক্ত কনিকা থমকে যায়। শ্বাস প্রশ্বাস ক্ষীণ হয়ে আসে। কাঁপতে থাকা হাতটি থেকে ফোনটি পড়তে নিলেই সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো ফোনটি। অবিশ্বাস্য নয়নে সে নুইয়ে যায় ফোনের দিকে। বদ্ধ নেত্রে কেমন নিথর শুয়ে আছে মেয়েটি। বিবর্ণ চোখেমুখে মৃত্যু যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। সে কি বিদঘুটে চেহারা ধারণ করেছে আদুরে মেয়েটির বরফখন্ডের ন্যায় শুভ্র মুখটি। সে অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো,
–“নৈরা?”
অবিশ্বাস্য, অবাকের সুরে বলা অস্ফুট কণ্ঠটি এতোটাই স্বাভাবিক শোনালো, যে এর থেকে অস্বাভাবিক কণ্ঠ যেনো পৃথিবীতে কেউ শোনেনি। তার দৃষ্টিদ্বয় কোনক্রমেই মানতে পারলো না এহেন যন্ত্রনাদ্বায়ক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। মেয়েটি ওভাবে শুয়ে আছে কেনো? আর তাকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকেই বা রাখলো কেনো? মন মস্তিষ্ক যে চিৎকার করে বলছে এগুলো সব মিথ্যা, ফাজলামো। কিন্তু এগুলো কেমন ফাজলামো? সে তড়িৎ গতিতে কঠোর দৃষ্টি ফেললো ফোনের স্ক্রিনে নিথর শুয়ে থাকা মেয়েটির পানে। প্রকম্পিত কঠোর গলায় ধমকে উঠলো মেয়েটিকে,
–“নৈরা? এগুলো কি হচ্ছে? কোন ধরণের ফাজলামো এগুলো? এভাবে শুয়ে আছেন কেনো? উঠুন, এখুনি উঠুন। এই রিদওয়ান নৈরার মুখের ওপর সাদা কাপড় দিয়ে রেখেছো কেনো? সরাও সব কাপড় সরাও। এই নৈরা আপনি এখনো আমার কথা শুনছেন না কেনো উঠুন। আমার সাথে কথা বলুন। দেখুন আমি ফোন দিয়েছি। নৈরা? কি হলো উঠছেন না কেনো?”
শেষের কথায় স্বরূপ চেঁচিয়ে উঠলো। কণ্ঠে তার ভরপুর তাড়াহুড়ো। মেয়েটি উঠছে না কেনো? সে তার স্বরূপের কথা শুনেও না উঠে থাকতে পারে? সে রেগে আরোকিছু বলতে যাবে তার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসলো একটা পুরুষালী কণ্ঠে ভয়ানক বাক্য,
–“ভাই, দশ মিনিট হয়েছে ডাক্তার নৈরা’কে মৃত ঘোষণা করেছে। হাতের শিরা কে”টে ফেলেছিল নৈরা। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়।”
হ্যাঁ, নৈরা নামক বোকা মেয়েটি নিজের যন্ত্রনাদের মুক্তি দিতে বড্ডো কঠোর পথ বেছে নেয়। প্রিয় মানুষটি আর বাবা কতোটা কঠোর তার থেকে ও কঠোর সিদ্ধান্ত আজ নৈরা নিয়েছে। যন্তনাদ্বায়ক মন্থর গতির সেই মৃত্যুর ভ্যাপসা গন্ধ আর অতৃপ্ততার আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠা নৈরার রুহ ত্যাগ করেছে দশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। এতো এতো অতৃপ্ততা নিয়ে ছোট্ট রুহটি ও হয়তো বের হতে নারাজ ছিল। নৈরার দুঃখে দুঃখে এগিয়ে চলা মৃত্যুর পথটি ছিল কঠিন আর যন্তনাদ্বায়ক। মেয়েটির এক একটা ঊর্ধ্বশ্বাস, ছটফটানি জানান দেয় প্রেমে পড়া বারণ। নির্দয় এই দুনিয়ায় কাউকে ভীষণ রকমের ভালোবাসার পরিবর্তে অতৃপ্ততা আর যন্ত্রনা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সকল অতৃপ্ততা, না পাওয়ার ক্লেশ ফিকে পড়ে গেলো। একরাশ অভিমান অভিযোগ, অপূর্ণ ইচ্ছে, আর স্বপ্ন গুলো মিলিয়ে গেলো ঐ নেত্রদ্বয় বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই। মেয়েটি কাউকে ভালোবেসেছিল, প্রচুর ভালোবেসেছিল। যাকে ভালোবেসে সে ইহকাল পরকাল দু’টো নষ্ট করতেই দ্বিধা বোধ করলো না। শোকের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠা বাতাবরণ আরেকবার চিৎকার করে বলল,
“নৈরা মেয়েটি বড্ডো বোকা।”
স্বরূপের কর্নদ্বয়ে সহ বক্ষস্থলে কেউ সজোরে আঘাত হানলো। থমকে গেলো তার দেহ সহ মস্তিষ্ক। অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
–“নৈরা আর মৃত্যু? রিদওয়ান তুমি কি বলছো ভাবতে পারছো? তুমি কি জানো না মৃত্যু কতোটা কঠিন আর যন্ত্রনাদ্বায়ক শব্দ? আমার বোকা কাঞ্চনবালা তো নম্র। তুমি এতো কঠিন শব্দ কেনো ব্যবহার করছো তার জন্য? তুমি কি করে বলতে পারলে নৈরা মারা গিয়েছে, হ্যাঁ? কিচ্ছু হয়নি নৈরার।”
স্বরূপ ধমকে উঠে বলল। সব হারিয়ে ফেলার ক্লেশ তার অস্থির চোখে চোখে মুখে। স্বরূপ ঘেমে ওঠা বদন, উর্ধ্বশ্বাস সামলে থমথমে মুখে আবার মেয়েটিকে ডেকে উঠলো। তবে কণ্ঠে এবার ভরপুর জোর আর কঠোরতা।,
–“নৈরা, আপনি আমার কথা শুনছেন না কেনো? তাড়াতাড়ি উঠে পড়ুন। আমার কিন্তু প্রচুর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সবসময় জেদ ভালো লাগে না নৈরা। আপনাকে এভাবে দেখতে একটুও ভালো লাগছে না। আপনি কি বুঝতে পারছেন না? ইশশ্ কেমন দেখাচ্ছে। এই আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন তাই না? আমি কিন্তু একটুও ভয় পাচ্ছি না। আমি তো জানি আমার নৈরা, এতো কঠোর কখনো হতে পারবে না। এখুনি উঠুন বলছি, উঠুন না নৈরাআআআআ…..।”
স্বরূপের শান্ত কণ্ঠ মুহুর্তেই চিৎকরে পরিণত হলো। বসে থাকা সিটটিতে আর বসতে পারলো না স্বরূপ। দেহ মন ছুটে চলে যাচ্ছে যে অসীম দূরত্বে থাকা অস্পর্শি মেয়েটির কাছে। স্বরূপ অস্থির চিত্তে মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। ফোনটা উন্মাদের মতো ঝাঁকাতে লাগলো আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
–“নৈরা, এই মেয়ে উঠুন প্লিজ। উঠে সবাইকে বলুন আপনি মজা করেছেন। আমায় মিছে মিছে ভয় দেখাতে মজা করেছেন। বলুন না নৈরা, প্লিজ। এই রিদওয়ান কি বলছে? ওকে উঠে একটা চর মারুন তো! ওর কতোবড় সাহস! ও এমন কথা কি করে বলল? আপনি নাকি ম…না না কিচ্ছুটি হয়নি আপনার। উঠে পড়ুন। এই নৈরা? কি হলো উঠছেন না কেনো?”
বলতে বলতেই স্বরূপ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। চেঁচিয়ে ডাকে ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা নিস্তেজ প্রাণহীন মেয়েটিকে। তবে এবার কণ্ঠে অনুনয়। স্বরূপ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে উন্মাদের মতো মেঝেতে চাপড়াচ্ছে আর অনুনয় করছে,
–“এই বোকা মেয়ে উঠুন না। কাউকে এতোটা ভালোবাসা যায় না তো। একদমই যায় না। আপনি এতো বড়ো শাস্তি আমায় দিতে পারেন না নৈরা। আপনি কি করে এতোটা কঠোর হতে পারেন? লক্ষ্মী মেয়ে উঠুন প্লিজ! আচ্ছা, আপনি যা চাইছেন তাই হবে। আপনি বললেন না— আমরা বিয়ে করবো, একটা ছোট্ট ঘর হবে, আপনি শাড়ি পড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবেন, আমাদের লোন পরিশোধ হয়ে যাবে তখন আমরা একটা ছোট্ট পুতুল আনবো। সে আমাদের অংশ হবে, তার নাম দেবো আমরা “নৈরূপ।” আমি সব মেনে নিচ্ছি। আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করবো নৈরা। একটা সুন্দর সংসার গড়বো …তবুও উঠুন নৈরা।”
উঠলো না। নৈরা উঠলো না। আজ লোকটি নিজের মুখে স্বপ্ন পূরণের কথা স্বীকার করতেও নৈরা উঠলো না। তার অভিমান হয়েছে বড্ডো অভিমান। স্বরূপ সহ্য করতে পারলো না অপরপ্রান্তের সেই নিস্তেজ নির্লিপ্ততা। সে শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে চেঁচিয়ে উঠলো ফের,
–“এই রিদওয়ান ওনাকে ধরে একটা থাপ্পড় মারো তো। বেয়াদব মেয়ে আমার কথা শুনছেই না। চরম জেদি! সবসময় এমন জেদ দেখায়। জেদ দেখিয়ে ভালোবেসেছে, জেদ দেখিয়ে মায়া বাড়িয়েছে এখন জেদ দেখিয়ে মায়া ছাড়িয়ে চলে যেতে চাইছে। ধরে একটা থাপ্পড় মারো তো! তাহলেই উঠবে।”
রিদওয়ান ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অপরপ্রান্তে স্বরূপের উদ্ভ্রান্ত আচরণ দেখে। ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল,
–“উঠবে না ভাই , নৈরা উঠবে না। সে আর নেই।
স্বরূপ হুঙ্কার ছাড়লো ছেলেটির কথায়।
–“থাপড়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো বেয়াদব ছেলে। আমার নৈরাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবি না। উনি ঠিক আছে একদম ঠিক আছে। দেখবি একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে।”
বলেই স্বরূপ ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা নিস্তেজ প্রাণহীন দেহটির দিকে তাকায়। ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে উঠলো অসহায়ত্বের চাপা যন্ত্রনায়। কতো দূরত্ব। একটু যে ছুঁতে ও পারছে না। সে অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে ফের ডেকে উঠলো মেয়েটিকে,
–“কাঞ্চনবালা শুনছেন, আপনাকে তো বলাই হয়নি, আপনার জন্য একটা লাল টুকটুকে বেনারসী কিনে রেখেছি। পড়বেন না? বউ সাজবেন না? লাল টুকটুকে বউ?”
আজ কোনকিছুতেই নৈরার অভিমান ভাঙছে না দেখে নিরুপায় স্বরূপ পুনরায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। তার কান্না, কথায় দেহে সবকিছুতে অস্থিরতা অসহায়ত্ব। স্বরূপ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো,
–“এই জেদি মেয়ে একটু উঠুন না। আপনি আপনার স্বরূপকে এতো কঠিন শাস্তি দিতে পারেন না। একটু মন ভাঙার দ্বায়ে আপনি আমার প্রিয় প্রাণটি শেষ করে দিতে পারেন না নৈরা। আপনি তো বলেছিলেন, আমরা একসাথে একটা কঠিন পথ পাড়ি দেবো তবে কেনো মাঝপথে হার মেনে নিচ্ছেন? একটু উঠুন না নৈরা। আপনার সাথে কতো কথা বলার আছে। আপনাকে তো বলাই হলো না, আপনি বোকা নন। আপনি একদম ঠিক। আপনি যা বলতেন সব সত্য! আমি আপনাকে আগে থেকে চিনি, অনেক আগে থেকে চিনি। বিগত পাঁচ বছর….
আচমকাই স্বরূপের কণ্ঠ তীব্র বেগে গতিরোধ হলো। মস্তিষ্কের বা পাশে অসহনীয় প্রদাহ অনুভব হতেই, সে আহ্ করে একহাতে চেপে ধরলো মাথার বা পাশ। স্বরূপ হাঁটু ভেঙে সামনের দিকে হেলে পড়লো। মেঝেতে এক হাত ঠেকিয়ে স্বরূপ নিজের দোদুল্যমান দেহের ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করলো। মস্তিষ্কের এক পাশে মনে হলো সবেগে কেউ লৌহ দন্ড দিয়ে আঘাত করেছে। এতোটা ব্যথা! ব্যথায় চোখ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যায় স্বরূপের। দেহ ভর ছেঁড়ে দেয়। ক্ষীণ হয়ে আসে কণ্ঠ। তবুও কথা থামালো না সে। আজ যে কোনমতেই থামা যাবে না। তবে যে অনেক দেরি হয়ে যাবে। সে বদ্ধ নেত্রে মস্তিষ্কের অসহনীয় প্রদাহ বহুকষ্টে সহ্য করার চেষ্টা করলো। অতঃপর বদ্ধ নেত্রে ক্ষীণ কম্পিত স্বরে ফের বলতে শুরু করলো,
–“আপনাকে তো বলাই হলো না, বিগ…বিগত পাঁচ বছর যাবৎ আমি ঐ চায়ের দোকানে শুধু আপনাকে এক নজর দেখতে যেতাম। আপনি ঠিক বলেছিলেন, আমি আপনার নাম আগে থেকে জানতাম।
আপনার জন্মদিন আগে থেকে শুরু করে আপনার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ সব তথ্য আমি আগে থেকে জানতাম। যেদিন থেকে আপনি বিরঙ্গনায় আসেন, সেদিন থেকে বিরঙ্গনার সামনে দশ মিনিট শুধু আমি আপনার গান শুনতে বসতাম। আপনাকে একটু দেখার জন্য অপেক্ষা করতাম ঐ স্টিলের বেঞ্চিটিতে। ঝড় বৃষ্টি বাদল সব কিছু ভুলে শুধু একটু শান্তির ঘুমের জন্য আপনার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। আমার বোকা কাঞ্চনবালার এক ঝলক দেখলেই আমার সব অস্থিরতা কমে যেতো, চিন্তা কমে যেতো একটা শান্তির ঘুম হতো রাতে। আপনি আমার শান্তির ঘুম কেড়ে নিতে পারেন না নৈরা! আমি কাকে দেখে নিজের চিন্তা, ক্লান্তি দূর করবো…”
এ যাত্রায় মস্তিষ্কের অসহনীয় প্রদাহে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া স্বরূপের মুখে অসহায়ত্ব, ক্লেশ, সব হারিয়ে ফেলার ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। কণ্ঠ তার গতি হারাতে লাগলো অসহ্য শারীরিক যন্ত্রণায়। মস্তিষ্কের ঠিক মাঝ বরাবর ও ঐ একই অসহনীয় প্রদাহ অনুভব হতেই স্বরূপের দেহ নিঃসাড় হয়ে আসলো। দেহের বা পাশ খিচে অবশ হয়ে যাচ্ছে। তবুও স্বরূপ নিজের উপর বলপ্রয়োগ করলো। না বের হতে চাওয়া ধীর কণ্ঠে আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলো,
–“লক্ষ্মী কাঞ্চনবালা উঠুন না, আপনাকে তো বলাই হলো না বিগত পাঁচ বছর যাবৎ আমি আপনাকে কতোটা….”
সে কি অসহায়ত্ব, অবর্ণনীয় ক্লেশ! শেষ লহমায় এসেও স্বরূপ ব্যর্থ হলো মেয়েটিকে জানাতে—যে সে তাকে বিগত পাঁচ বছর যাবৎ একতরফা ভালোবেসে আসছে। গলগল করে বমি বেরিয়ে আসতেই স্বরূপের বলহীন দেহটি ধুম করে মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে গেলো। ফোনটি ছিটকে পড়লো খিচে যাওয়া হাতটি থেকে। স্বরূপ ঘাড় কাত করে ঝাঁপসা দৃষ্টিতে তাকায় দূরে সরে যাওয়া ফোনটির দিকে। সাথে সাথেই তার নাক এবং বাম পাশের কান থেকে রক্তের শীতল এক সরু স্রোত গড়িয়ে পড়লো। স্বরূপের ক্লেশে জর্জরিত ভেজা দৃষ্টি অদূরে গড়িয়ে পড়া ফোনটির দিকে। কতো দূরত্ব, নির্মমতা! সৃষ্টিকর্তা এতো কঠোর কেনো? স্বরূপ মেয়েটিকে শেষবার ছুঁতে পারলো না, কাছ থেকে দেখতে পারলো না এখন ফোনটাও দূরে সরিয়ে দিলো? এতো এতো দূরত্ব সে কি করে মেটাবে? অসহায়ত্ব, হারানোর যন্ত্রণা আর দৈহিক যন্ত্রনায় চোখের কার্নিশ থেকে অনর্গল গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। অসহনীয় প্রদাহে অচল মস্তিষ্কেও চোখের সামনে ভেসে উঠলো, “সে ব্যতীত তার মা বোন ভাগ্নে পথে বসে যাবে। তাদের দেখার মতো পৃথিবীতে আর কেউ থাকবে না।” আর অন্যদিকে, মন বলছে মেয়েটিকে অন্ধকার ঐ মাটির নিচে একা রেখে তার পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব! তবে এবার আর দায়িত্ব স্বরূপ’কে কাবু করতে পারলো না। এবার দায়িত্বের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপ ইব্রাহীম স্বার্থপরতা করলো। শরীরের শেষ ঝাঁকিটা ছিল স্বরূপের শেষ নড়চড়। সেই ঝাঁকির সাথে দুই নাকের নাসারন্ধ্র থেকে গলগলিয়ে রক্তের সরু স্রোত বেরিয়ে আসলো, সাথেই নাসারন্ধ্র থেকে বেরিয়ে আসলো আফসোস, অতৃপ্ততা, হাহাকার মিশ্রিত শেষ নিঃশ্বাসটিও। দায়িত্বের ভার বইতে বইতে ভারী দেহটা একটাসময় শিথিল হয়ে পড়ে রইলো সাফেদ টাইলসের মেঝেতে। সকল দায়িত্ব, লোনের বোঝা, সকল ক্লেশ, সকল অসহায়ত্ব আজ পিছু ছুটে গেলো। সেই সোনালী কাঞ্চনবেলায় বিদায় নিলো আরেকটা অতৃপ্ত আত্মা।
বাতাবরণে শুধু মৃত্যুর গন্ধ আর অতৃপ্ততা। এক সোনালী কাঞ্চনবেলায় দেখা হওয়া দুই সহজ সরল নির্মল সত্ত্বা, কাঞ্চনবেলার উজ্জ্বল বরনকে ধূসর বর্ণে পরিণত করে মিলিয়ে গেলো আফসোসের সুর হয়ে।
সমীরনে আর প্রেমের সুর বাজবে না। কেউ আর অযাচিত আবদার নিয়ে হাজির হবে না, কেউ আর অযাচিত অধিকার নিয়ে স্বরূপ ইব্রাহীমের কনুইয়ের শার্ট আঁকড়ে ধরবে না। আর কারোর বোকা বোকা কথা, কাজ, ভালোবাসায় স্বরূপ ইব্রাহীম নিজের ক্লান্তি, দায়িত্বের ভার ভুলে প্রাণ খুলে হাসবে না।
~চলবে~