#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#অন্তিম_পর্বঃপ্রথমাংশ
[দু’টো পর্ব দেয়া হয়েছে। নিজ দায়িত্বে পড়ে নিবেন।]
এক নতুন সুস্থ সুন্দর প্রারাম্ভের প্রত্যাশায় সাধনা ছুটতে ছুটতে চৌদ্দ তলা থেকে নিচ তলায় ভাইকে খুঁজতে নামে। নামার কোন প্রয়োজন ছিল না কিন্তু সে আনন্দ ধরে রাখতে পারেনি। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে, এখনি ভাইকে এই সুসংবাদ না দিতে পারলে সাধনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই পারবে না। তারা আবার সুস্থ সবল মাকে নিয়ে নীড়ে ফিরবে। ফিরে একটা পরী বউ আনবে ভাইয়ের জন্য। সে কি আনন্দ! কিন্তু সাধনা ভুলেই যায় তাদের মতো মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য আনন্দ ক্ষণস্থায়ী! তবে এবার আর হয়তো সুখ সাধনার ঘরের চৌকাঠ পেরুবে না।
ছুটতে থাকা সাধনার হঠাৎ গতিরোধ হলো এক জায়গায় অনেক মানুষের ভীড় দেখে। নার্স সহ কয়েকজন ওয়ার্ড বয় হন্তদন্ত হয়ে কাউকে মেঝে থেকে স্ট্রেচারে উঠাচ্ছে। কাকে উঠাচ্ছে, কি হয়েছে দেখার জন্য কৌতুহলী নয়নে উঁকি দিতেই সাধনার পায়ের তলার জমিন সরে গেলো। সে থমকে যায় নাক কান থেকে র”ক্ত গড়াতে থাকা ভাইয়ের নিস্তেজ মুখটি দেখতেই। চোখের কার্নিশ তখনো ভেজা। সাধনা থমকানো কণ্ঠে ডেকে ওঠে ভাইকে,
–“স্বরূপ?”
বিলম্বহীন সাধনার মিহি স্বর আর্তনাদে পরিনত হলো। সে ছুটে যায় ভাইয়ের কাছে। অস্থির হাতে পুরো র”ক্তমাখা মুখটি ছুঁয়ে দিতে লাগলো আর উন্মাদের মতো শাড়ির আঁচলে গড়িয়ে পড়া র”ক্ত গুলো মুছতে লাগলো। সে কি ভ’য়’ঙ্ক’র দৃশ্য! সাধনার হাত কাঁপছে ভাইয়ের র”ক্ত মুছতে গিয়ে। অস্থির কণ্ঠে শুধায়,
–“এই ভাই? তোর কি হয়েছে? চোখ খোল! হে খোদা কতো র”ক্ত! খুব কষ্ট হচ্ছে কি ভাই? এই মাত্র ই তো তুই আমার সামনে থেকে হেঁটে গেলি না? তবে….”
–“ওনাকে তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।”, নার্সের কথায় সাধনার হুঁশ ফিরলো। সে ঘন ঘন মাথা নেড়ে সায় জানায়। নার্স আর ওয়ার্ড বয় দ্রুত নিয়ে যায় স্বরূপকে। সাধনা ছুটে চলে ভাইয়ের পিছু পিছু।
এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ঢোকানো হয় স্বরূপকে। মুহুর্তেই আ’ত’ঙ্কে পরিণত হওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খেলো সাধনা। সে কাঁদছে আর অস্থির চিত্তে কেবিনের বাইরের দরজার হাতল ধরে অপেক্ষা করছে। ডাক্তারকে পই পই করে বলে দিয়েছে তার ভাইটাকে যেনো সুস্থ করে তুলে। তবে অদ্ভুত ভাবে ত্রিশ মিনিটের মাথাতেই কেবিনের দরজাটি খুলে গেলো। ডাক্তার পাণ্ডুর
শুকনো মুখটি নিয়ে বেরিয়ে আসে। সাধনা অধীর উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। এই তো ডাক্তার বলবে হয়তো, চিন্তা করবেন না। রোগী ঠিক আছে, প্রেশার অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সাধনাকে হতভম্ব করে দিয়ে ডাক্তার অসম্ভব এক কঠিন কথা বলল। এতোটাই কঠিন যে মুহুর্তেই সাধনার জীবনের মানে বদলে গেলো। ডক্টর সাধনার দিকে তাকিয়ে খানিক গম্ভীর মলিন কণ্ঠে বলল,
–“আ’ম স্যরি, আনফর্চুনেটলি আপনার ভাইকে কেবিনে ঢোকানোর আগেই সে মারা গিয়েছে। আমি ধারণা করছি এটা ব্রেইন স্ট্রোক! তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন। হয়তো কোন শকিং নিউজ পেয়েছিলেন যা তার মস্তিষ্ক নিতে পারেনি। সঠিক তথ্য সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট আসলেই বলা যাবে। ওটা আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তখন কারণটা পরিষ্কার হবে।”
সাধনা অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে। মেয়েটির সরব কেঁপে ওঠা বদন দেখলো ডাক্তার। সাধনা অস্ফুট স্বরে বলে,
–“স্বরূপ মারা গিয়েছে? এটা কি বলছেন ডক্টর? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে হয়তো। একটু ভালো করে চেকাপ করুন। ও জ্ঞান হারিয়েছে। এর বেশি কিছুনা। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। ওর প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল তাই হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে। একটু আগেই আমার সামনে থেকে হেঁটে গেলো। সুস্থ সবল ছেলে একটা। একটু প্রেশার বেড়েছিল শুধু। প্রেশারের ওষুধ কিনতেই গিয়েছিল। আর আ…আপনি এর মধ্যে বলছেন ও মারা গিয়েছে? আপনার মধ্যে কি বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই এতো কঠিন শব্দটা আমার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে কতো অবলীলায় বলে দিলেন? আপনি কি জানেন এটা কতো ভয়ঙ্কর শব্দ? আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি বেরিয়ে যাবেন না ওকে আরেকটু দেখুন। একটু ভালো চিকিৎসা করলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। ওর। কিচ্ছু হয়নি। কিছু হতেই পারে না। আমার ভাইটা কতো স্ট্রং, শক্ত তা আপনি জানেন না।”
অনুনয় করে বলতে বলতেই সাধনা ফের ফুঁপিয়ে উঠলো। ফের ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে অনুনয় করে বলল,
–“দেরি হয়ে যাচ্ছে তো! আমার ভাইটা ওখানে র”ক্তা”ক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে। ওর যন্ত্রনা হচ্ছে তাড়াতাড়ি যান না। দাড়িয়ে থাকবেন না, সময় নষ্ট হচ্ছে। কি হলো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আপনি দয়াকরে ওকে একটু ঠিক করে দেখুন ডক্টর। আপনাকে টাকা দেবো তো, যতো টাকা চান। তবুও ওকে একটু ঠিক করে দিন। কেউ ওর অপেক্ষায় আছে। এই তো আমরা বাড়িতে গিয়েই ওর জন্য একটা পরী বউ আনবো। বেনারসী ও কিনে রেখে এসেছি। ও ছাড়া আমার আর আমার মায়ের কেউ নেই। এই পৃথিবীতে ও ই আমার একমাত্র ছায়া। আমার ছেলেটা বাবার আদর পায়নি। ও একা ওকে সবার আদর দেয়। আমাদের ঘরটার একমাত্র সম্বল। ও না থাকলে আমরা পচে মরে গেলেও কেউ উঁকি দিয়ে দেখবে না। ও আমাদের সবার একমাত্র সুখ। আপনি এতো কঠিন কথা বলবেন না। আমি নৈরাকে কি জবাব দেবো বলুন?”
সাধনা ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর অনুনয় করছে। বয়স্ক ডাক্তারটি মলিন হাসলো। এমন কতোশত দৃশ্যের সাক্ষী সে প্রতিনিয়ত হয়। কিন্তু জীবন কি কারোর জন্য থেমে থাকে? না তো! সে সাধনার মাথায় হাত রেখে বলল,
–“আমি ভালো করেই দেখেছি মা। সে মারা গিয়েছে আরো ত্রিশ মিনিট আগে। তোমার ভাইকে বাইরে থেকে দেখে শক্তপোক্ত মনে হলেও সে ভেতরে ভেতরে অনেক ভঙ্গুর ছিল। ওর মস্তিষ্ক আর শরীরের অনেক কন্ডিশন ই অনেক ভঙ্গুর দূর্বল ছিল। আ’ম স্যরি। লা/শ একটু পরে সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট আসলেই হ্যান্ডওভার করা হবে।
সাধনার চোখের সামনে হঠাৎ সব ধোঁয়াশা হয়ে উঠলো নিজের একমাত্র আদরের ছোটভাইকে লা/শ সম্বোধন করতেই। সে আর্তনাদের সাথে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“ওকে লা/শ বলবেন না। ও আমার ভাই, আমার স্বরূপ। ওকে লা/শ বলছেন কেনো?”
বলতে বলতেই সাধনা ছুটে যায় কেবিনের ভেতরে। কি অদ্ভুত পাষণ্ড কঠিন দুনিয়া! তার ভাইটাকে সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। সে ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে উন্মাদের মতো সাদা কাপড়টি সরিয়ে ফেললো স্বরূপের মুখ থেকে। চেঁচিয়ে বলে,
–“আপনারা কোন সাহসে ওকে সাদা কাপড়ে ঢেকেছেন? আমার ভাই একদম ঠিক আছে। ওর কিছু হতেই পারে না। ও জানে ওর মা বোনের ও ছাড়া আর কেউ নেই। ও কখনো আমাদের এই কঠিন দুনিয়ায় এক ছেঁড়ে যেতে পারে না।”
সাধনা আঁকড়ে ধরে ভাইয়ের নিস্তেজ মুখশ্রী। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর ব্যর্থ প্রয়াস ব্যর্থ ই থেকে গেলো বদ্ধ নেত্রের নিস্তেজ মুখটি দেখতেই। সে আদুরে গলায় বলে,
–“এই ভাই! কি হয়েছে তোর? একটু আগেও তো আপার সাথে কথা বললি। আপা তোর জন্য ভাত মেখে রেখেছি তো! খাবি না? ওঠ ভাই। তুই এভাবে শুয়ে আছিস কেনো? কতো র”ক্ত! এখানকার ডাক্তাররা অনেক খারাপ রক্তগুলোও বন্ধ করার কোন ঔষধ দেয়নি।”
সে চকিতে পাশে থাকা নার্সটির দিকে তাকায়। অনুনয় করে বলল,
–“এই বোন, আমার ভাইয়ের গা থেকে কতো র”ক্ত বের হচ্ছে তুমি দেখছো না? একটু বন্ধ করার ঔষধ দাও না গো! তোমার ডাক্তার অনেক কঠোর। বলে কি-না ও ম”রে গিয়েছে! মিথ্যা কথা। সে ভালো ডাক্তার না, তাই না? তুমি একটু কিছু করো না। ওর অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই। তাই ও চোখ খুলছে না। একটু দেখো না ওকে।”
নার্সটি বিষন্নতা আঁকড়ে ধরে ছলছল নয়নে দেখছে এক বোনের আহাজারি। সে মৃদু স্বরে বলল,
–“এখন আর কিছু করার নেই ম্যাম। সে মা”রা গিয়েছে।”
–“এই চুপ! একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আপনারা সবাই খারাপ! ঠিক করে রোগী না দেখেই মৃত বলে দেন। আপনারা সবাই অনেক অনুভূতিহীন নির্দয়, পাষাণ।”
শেষের কথাটা সাধনা ক্ষীণ স্বরে বলল।পুনশ্চঃ অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায় ভাইয়ের নিথর দেহের দিকে। গাল দুটো আঁকড়ে ধরে অনুনয় করে বলে,
–“এই ভাই, আপার ভয় হচ্ছে ওঠ না। এই এতো বড়ো শহরে আমায় একা ফেলে শুয়ে আছিস কেনো? আমি সব একা হাতে সামলাবো কি করে? বুব্বো কতক্ষণ যাবৎ বায়না করছে মামুর কোলে উঠে ঘুমাবে। এই তুই কি জানিস মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। মা আবার আগের মতো এখন সুস্থ হয়ে যাবে। আমরা এখন তাড়াতাড়ি বাড়িতে যেতে পারবো। তারপর গিয়েই নৈরাদের বাড়িতে যাবো। গিয়ে ঐ লাল বেনারসী পড়িয়ে ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসবো। তুই দেখবি না ওকে বউ সাজে? ওঠ, জলদি ওঠ।”
না উঠলো না স্বরূপ। সে কি নিষ্ঠুরতা! মাত্র কয়েক মিনিটের মাঝে কঠোর স্বরূপ সাধনাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে। যেখানে বড়ো বোন হয়ে সাধনা ছোট ভাইয়ের লা/শে/র সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এতো কঠিন জীবন আল্লাহ কাউকে না দিক, কাউকে না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সাধনা। বলহীন দেহে আর্তনাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলো সে,
–“এই ভাই ওঠ নাআআআ! তুই তোর আপাকে এতোটা পাপী বানিয়ে মরতে পারিস না। তুই কি তোর আপার বোঝার ভার সইতে সইতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিস? তাই এভাবে পালিয়ে যাচ্ছিস আমায় ফেলে? আমি এই পাপ নিয়ে বাঁচবো কি করে স্বরূপ? আমার ভাইটা যে তার বোন, মা, ভাগ্নের স্বস্তি নিশ্চিত করতে করতে শেষ নিঃশ্বাস ছেড়েছে! আমি কি করে এতো বড়ো পাপের বোঝা নিয়ে বাঁচবো? নৈরা আর মাকে কি জবাব দেবো স্বরূপ? একটু ওঠ না ভাই!”
বরাবরের ন্যায় স্বজনহারা আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো হাসপাতালের পরিবেশ। সেই আর্তনাদের সুরের সাথেই বদলে গেলো গুটি কয়েক জীবন। সেখানেই থমকে গেলো দু’টো সহজ সরল প্রেমময় সত্ত্বার জীবনের গল্প।
হেমোরেজিক স্ট্রোক হয় স্বরূপের। ইন্টাক্রানিয়াল হেমোরেজিক স্ট্রোক! উচ্চ রক্তচাপে নুব্জ্য দেহ হঠাৎ শকিং নিউজ কিংবা ট্রমা নিতে না পেরে এই স্ট্রোক হয়। মায়ের চিন্তা , লোনের চিন্তা, বন্ধুদের টাকা ফেরত দেয়ার চিন্তায় এমনিতেই স্বরূপের মস্তিষ্ক বিধ্বস্ত ছিল! তাই প্রিয় মানুষটিকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনা সে সহ্য করতে পারে নি। মস্তিষ্কের অতিমাত্রায় রক্তক্ষরণে স্বরূপের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়।
*****
কঠিন সেই পৃথিবীতে স্বরূপ বোনকে একা চলতে বাধ্য করলো। মায়ের নিথর দেহ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল সাধনা, ফিরে আসলো ভাইয়ের লা/শ নিয়ে। কি অদ্ভুত তাই না?
সৃষ্টিকর্তার অভিপ্রায়ের কাছে আমরা নিছকই কিছু অসহায় দ্বায়বদ্ধ প্রাণী। বোন, ভাগ্নের সুখের জন্য কেনা বাড়িটির সামনে আজ পড়ে আছে স্বরূপের কাফনে মোড়ানো দেহটি। দালানটির সামনে আজ বহু মানুষের ভীড়। বিষন্ন চোখে এক বোনের আহাজারি দেখছে তারা। ছোট্ট বুব্বো বারবার অবুঝ কণ্ঠে মামাকে ডেকে উঠছে। বলছে,
–“সে কেনো এভাবে ঘুমিয়ে আছে। তাকে কেনো এভাবে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে! মামু যেনো ওঠে। উঠে তাকে আদর করে, তার সাথে ক্রিকেট খেলে।”
কিন্তু মামু ওঠে না আর না আদর করে। তবে এই জায়গাটিতে শুনিতার কোন চিহ্ন নেই। কঠিন দুনিয়ার কঠিন পরিস্থিতি একমাত্র ছেলেকে শেষ দেখার সুযোগ ও দেয়নি। সদ্য ব্রেইন অপারেশন করা এক মায়ের জানার সুযোগটুকু ও নেই তার ছেলেটা এই পৃথিবীতে আর নেই। স্বরূপের তিন বন্ধু পাগলের মতো ছটফট করছে আর কাঁদছে। তাদের একটাই কথা,
–“একটাবার চোখ খোল না! আমরা আবারো ঝড় বৃষ্টি পেরিয়ে চায়ের দোকানে তোর কাঞ্চনবালাকে একবার দেখাতে নিয়ে যাবো।”
প্রতিদিন এই ছেলের শান্তির ঘুম আনতে হতো তাদের বন্ধুদের। অন্য কোথাও আড্ডা দেয়া যাবে না। দিতে হলে ঐ চায়ের দোকানেই দিতে হবে। তারা কখনো নাকোচ করতো না। অথচ আজ তার কাছে এই বন্ধুদের কোন গুরুত্ব নেই। তাদের সাহায্যেই স্বরূপের মাকে খুলনা সিটি হসপিটালে ট্রান্সফার করা হয়। আর স্বরূপকে বাড়িতে আনা হয়।
দুপুর বারোটা তখন। জোহর নামাজ বাদ স্বরূপকে দাফন করা হবে। সাধনা’র আর্তনাদে ভারী পরিবেশটা তখন সরব নতুন মাত্রা যুক্ত হলো, সদ্য ভীড় ঠেলে চারটি কাঁধের উপর করে আরেকটি মুদ্রার খাট গেট পেরিয়ে ঢুকতেই। আর্তনাদ করতে থাকা সাধনা থমকে গেলো ভাইয়ের পাশে আরেকটি মুদ্রার খাট দেখতেই। নোমান পাথরের ন্যায় নিজের কাঁধ থেকে বোনের খাটিয়া নামালো। যেই মানুষটার জন্য নৈরা নামক মেয়েটি বাবা মা, ভাই সহ পুরো পৃথিবীকে তুচ্ছ করে চলে গেল, নোমান আজ তার পাশেই তাকে শুইয়ে দিল। ডাক্তার যেই মুহুর্তে তার বোনটিকে লা/শ বলে অবিহিত করলো সেই মুহুর্ত থেকে নোমান একদম নিরব হয়ে গিয়েছে। শুধু একবার বিড়বিড় করে বোনকে অভিযোগ করে বলেছিল,
–“নুরু কখনো তার ভাইজানকে ভালোবাসেনি আর না বিশ্বাস করেছে।”
সাধনা চমকে তাকায় নোমানের মুখপানে। উন্মাদের মতো বলহীন দেহ টেনে ছুটে আসে নতুন খাটিয়ার পাশে। অবাকের রেশ ধরে অস্থির হাতে সে ঐ দেহটির মুখের ওপর থেকে সাদা কাপড় সরাতে লাগলো। ভেসে উঠলো একটি স্নিগ্ধ বিবর্ণ মুখ। সাধনা নিগুঢ় দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে মুখটি। খুব স্বল্প সময়ের জন্য দেখা মেয়েটির হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ভেসে উঠতেই সাধনা বিস্মিত চোখে তাকায় নোমানের দিকে। বিশ্বাস করতে পারলো না সে। অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞাসা করে,
–“ও কে?”
স্বরূপের নিথর নিষ্প্রাণ মুখটি এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতেই নোমান চোখ তুলে তাকায় সাধনার পানে। আজ আর বোন বলতে ইচ্ছে করলো না। ওটা তার বোন নয়। সে ভারি ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দেয়,
–“আপনার ভাইকে প্রচুর পরিমাণে ভালোবাসা এক স্বার্থপর মেয়ে। যে কি-না আপনার ভাই ব্যতীত পৃথিবীর কাউকে কখনো ভালোবাসেনি।”
কর্নকুহরে না শুনতে চাওয়া জবাবটি প্রবেশ করতেই সাধনা ধপ করে বসে পড়লো গেলো মাটিতে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নোমানের মুখপানে। চোখেমুখে নিঃশেষিত শোকের ছায়া মিলিয়ে গেলো পাপের বোঝা অনুধাবন করতে পেরেই। বহুক্ষণ বাদ সাধনা কথা বলল। ঝাঁপসা হয়ে আসা চোখে, সাধনা ক্ষীণ স্বরে বলল,
–“আমার ভাইটা অল্প দুঃখে মা”রা যায়নি। আমার ভাইটা প্রচুর কষ্ট নিয়ে মা”রা গিয়েছে। আমি কি করে বাঁচবো এতো বড়ো পাপের বোঝা নিয়ে। আমার ভাইটার মৃত্যুর কারণ তো আমি আর আমার মা। নৈরার কাছে তার বেনারসী পৌঁছে দিতে পারেনি। নৈরা বউ সাজতে পারলো না আমার ভাইয়ের…পারলো না। সব আমার জন্য…”
বলতে বলতেই সাধনার দূর্বল দেহটা ঢলে পড়লো মাটিতে। নোমান নিরুদ্বেগ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো পাশাপাশি রাখা দুই প্রেমময় নিস্তেজ সত্ত্বাকে। একসাথে দেখতে খুব সুন্দর লাগছে যে! চোখের কার্নিশ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার। ততক্ষণে রাস্তা থেকে বিধ্বস্ত দেহে ছুটতে ছুটতে আসা নুহাশ মাহমুদ ক্ষিপ্র গতিতে এসে মদ্য বুক থেকে ছিনিয়ে আনা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলো। উদ্ভ্রান্তের মতো চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
–“এই আমার আম্মাকে কেউ দূরে নেবে না আমার থেকে। আমার আম্মাকে আমি ঐ অন্ধকার কবরে রাখবো না। আমার আম্মা ভয় পাবে। সে বাবাকে একটু শাস্তি দিচ্ছে! রাগ অভিমান ভাঙলেই আবার বাবার বুকে চলে আসবে। নোমান এক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখলো এক হতদরিদ্র পিতাকে। এই পিতা পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা, হতদরিদ্র পিতা যার সব থাকতেও সে দরিদ্র। কারণ তার বুক খালি! তার অহংকার, জেদ তার বুক খালি করে দিয়েছে। আজ নৈরা বাবাকে স্বরূপের দুয়ারে ঠিক মাটিতে এনে ছাড়লো। ডাক্তার যখন নুহাশ মাহমুদের ছোট্ট আম্মাকে লা/শ বলে ঘোষণা করলো, নুহাশ মাহমুদকে তখনি পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগা পিতা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
চা ওয়ালী আর ছোলা ওয়ালা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে পাশাপাশি রাখা দুটি নিষ্প্রাণ দেহের দিকে। ধীরস্থির দুটি খাটিয়ার মাঝখানে বসলো চা ওয়ালী। স্বরূপের দিকে তাকিয়ে ধিমি কণ্ঠে বলল,
–“স্যার, ও স্যার! ঐ বোকা মুখপুরীর মতো আপনিও কি আজ বোকা হয়ে গেছেন? এমন ভাবে ঘুমাইয়া আছেন কেনো? ওঠেন, উইঠা ঐ মুখপুরীরে দুইটা থাপ্পড় মাইরা উঠান। ওরে কন , ও যে এতো দিন লাল টুকটুকে বউ সাজার গপ্পো আমারে শুনাইতো, তা না পূরণ কইরাই চইলা গেলো কেনো? একটু ওঠেন না? আমি রোজ বিকালে কাদের প্রেম দেখে চোখ জুড়াবো? ও স্যার? এই মুখপুরী ওঠ না! তোর পিরিত শেষ? ওঠ একটু ওঠ। এই চা ওয়ালীর সাথে ঝগড়া করবি না? এই বোকা মাইয়া ওঠ না।”
চা ওয়ালী আজ কাঁদছে। অচেনা অজানা একটা বোকা মেয়ের জন্য কাঁদছে। কাঁদছে ছোলা ওয়ালাও।
এক একটা স্তব্ধ করা মুহুর্ত পেরিয়ে অবশেষে পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মানুযায়ী নৈরা আর স্বরূপের নিথর দেহ মাটির আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। নিষ্ঠুর পৃথিবী জীবিত অবস্থায় তাদের এক হওয়ার সুযোগ না দিলেও, তাদের রুহ বিহীন নিস্তেজ দেহটিকে পাশাপাশি কবর দেয়ার সুযোগ দিলো। সাউথ সেন্টার রোডে অবস্থানরত জামে মসজিদের সাথে থাকা কবরস্থানে নৈরা আর স্বরূপের দাফন করা হয়। সিমেন্টের উপর ধীরস্থির খোদাই করে পাশাপাশি লেখা হলো।
স্বরূপ ইব্রাহীম।
জন্মঃ১২ ই জৈষ্ঠ্য, ১৩৯৮
মৃত্যুঃ২২ ই জৈষ্ঠ্য ,১৪৩২
নৈরা মাহমুদ
জন্মঃ১২জৈষ্ঠ্য,১৪০৬
মৃত্যুঃ২২ ই জৈষ্ঠ্য, ১৪৩২
গল্পটা অসহনীয় অতৃপ্ততা নিয়ে সেখানেই থমকালো।
বোনের বিশ্বাসের কাছে হেরে যাওয়া এক ভাই রাতের অন্ধকারেও তার পাশে নিরবে চুপটি করে বসে রইলো। বাতাসে নতুন মাটির গন্ধ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে নতুন মাটির দিকে। দৃষ্টিতে অভিযোগ! বারবার শুধু বিড়বিড় করে বলে,
–“তুই স্বরূপ ব্যতীত আর কাউকে ভালোবাসিস’নি নুরু। তোর ভাইজানকেও না।”
পকেটের যান্ত্রিক সঙ্গীটি বড্ডো বিরক্তের সাথে বেজে উঠতেই নোমান পাথরের ন্যায় সেটি কনে ঠেকলো। ভেসে আসলো ছোট্ট এক কিচিরমিচির কণ্ঠ। বিভোর হেঁচকি তুলতে তুলতে ডেকে ওঠে,
–“বন্ধু?”
নোমান পলক ঝাপটালো। মিহি স্বরে ডেকে ওঠে,
–“ক্যাপ্টেন!”
–“বন্ধু, মা কেমন যেনো করছে! ঘরে আমি একা। দরজায় অনেকগুলো লোক দাঁড়িয়ে বারবার দরজা ধাক্কাচ্ছে। তুমি একটু মামুকে নিয়ে আসবে? আমার যে ভয় করছে একা একা। ঘরে কেউ নেই। নানুও নেই মামুও নেই। মাও চোখ খুলছে না। মাম্মার ফোন থেকে তোমার নাম্বার বের করেছি। একটু তাড়াতাড়ি মামুকে নিয়ে আসবে? সবাই মামুকে কোথায় নিয়ে গেল বলো তো!”
“মামুকে নিয়ে এসো!” নোমানকে আজ কতোটা অসহায় করে এই দুই স্বার্থপর মানুষ চলে গেলো তা কি জানে? জানে না। নোমান লালচে টলমলে আঁখি নিয়ে ধিমি কণ্ঠে বলল,
–“আসছি ক্যাপ্টেন।”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দশ বারো জন ব্যাংকের লোক। নোমান বলহীন দেহ টেনে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই তাদের দেখে ম্লান হাসলো। মৃত্যুর শোক সরতে পারেনি টাকার চিন্তায় হাজির কিছু পাষণ্ড লোক। সে তাদের পাশ কাটিয়ে দরজায় টোকা দিলো। বুব্বো তার আওয়াজ শুনতেই দরজা খুলে দিলো। ভয়ার্ত বদনে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার বুকে। বলল,
–“আমার একা একা খুব ভয় লেগেছে বন্ধু।”
সদ্য আঁছড়ে পড়া ছোট্ট দেহটির সাথে সাথে যেনো নোমানের উপর আঁছড়ে পড়লো নামহীনা অনেক দায়িত্ব। এক দায়িত্বশীল ছেলের আর ভাইয়ের দায়িত্ব।
নোমান বুব্বোকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কম্পিত কদমে ঘরে ঢুকলো। মেঝেতে পড়ে আছে সাধনা। সে চোখ সরাতে গেলেই ঠিক অদূরে টি টেবিলের উপর রাখা সোনালী বক্সে লাল টুকটুকে এক বেনারসী দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়। সাথে থাকা মিষ্টি, ফলগুলো দিয়ে পঁচা গন্ধ বের হচ্ছে। হাহাকার অতৃপ্ততা, আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠলো অন্তঃস্থল। দম বন্ধ হয়ে আসলো নোমানের। এক পা আগাতে পারলো না। বিভোর বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে শুধায়,
–“মামুকে সাথে করে আনোনি কেনো বন্ধু? তোমরা কোথায় নিয়ে গিয়েছিলে তাকে?”
নোমান তাকায় ছোট্ট মুখটির পানে। বলার মতো কিছু নেই তার কাছে। তাই সে নিরবতার আশ্রয় নিলো। ততক্ষণে তার ড্রাইভার এসে দরজায় নক করলো। নোমান ড্রাইভারের থেকে চেক বইটা হাতে নিয়ে মলিন হাসলো। তাকে সারাজীবন কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে তার বোনটা তার উপর একটু বিশ্বাস কেনো রাখলো না? যেই লোনের বোঝা বইতে বইতে আজ স্বরূপ ইব্রাহীম নিঃশেষ! সেই লোন দুই মিনিটে শোধ করে দিলো নোমান। ডাক্তার আসলো, বারংবার জ্ঞান হারানো, উন্মাদের মতো আচরণ করা সাধনাকে দেখে বলল,
–“মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে। একা একাই ঠিক হয়ে যবে। শুধু ঠিক হওয়ার মতো পরিবেশ থাকতে হবে। মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় এমনকিছু বলা বা করা যাবে না। একটা প্রাণবন্ত, হাসিখুশি পরিবেশ দিতে হবে।”
ডাক্তারের কথায় নোমান পুরো ঘরটিতে চোখ বুলালো। এই ঘরটিতে আর কোনদিন হাসি ফুটবে না আর না সুখ ধরা দেবে। কাঁধে শুয়ে থাকা বিভোর তখন দূর্বল কণ্ঠে বলল,
–“খুব খিদে পেয়েছে বন্ধু!”
নোমান ছলছল নয়নে তাকায় ক্ষুধার্ত বাচ্চাটির দিকে। ছেলেটি আর পারে না নিজেকে দমাতে। ছোট্ট দেহটিকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,
–“সবাই স্বার্থপর বিভোর! সবাই স্বার্থপর! কেউ আমার কথা ভাবলো না। একজন একটুও বিশ্বাস করলো না, আরেকজন কতো ভারী ভারী দায়িত্ব ফেলে চলে গেলো।”
নোমান বুব্বোকে অদক্ষ হাতে খাবার খাওয়ালো।
ক্লেশ ভুলতে লাগাতার নিঃসাড় হয়ে পড়া স্নায়ু গুলো দীর্ঘ আঠারো ঘন্টা পর জাগ্রত হলো। সাধনার পাথরের ন্যায় ভারী হয়ে থাকা দেহে একটু নড়াচড়া দেখাগেলো। আধো আধো চোখ খুলে তাকায় সে। চোখের সামনে ভেসে উঠলো ধীরপায়ে হাঁটতে থাকা এক পুরুষালী অবয়ব। বুব্বোকে বুকে জড়িয়ে অলস পায়ে হাঁটতে থাকা মানবকে দেখে শূণ্য মস্তিষ্কে সাধনা ডেকে ওঠে,
–“স্বরূপ?”
নোমান পা থামিয়ে পিছু ফিরে তাকালো। সাধনা চোখ পিটপিট করে আবছা চোখে চেয়ে বলল,
–“আপনি? স্বরূপ কি ব্যাংক থেকে এসেছে?”
নোমান একাধারে তাকিয়ে থেকে মাথা দোলালো। এসেছে। সাধনা তড়িৎ বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে শুধায়,
–“তবে আমরা এখন নৈরাকে আনতে যাবো?”
নোমান ম্লান হেসে আবারো মাথা নাড়লো। কতো কতো মিথ্যা জুড়ে আজ তার জীবন। নিজের জীবনের দোরগোড়া মাপলে আজ তার রুহ কেঁপে উঠে। এমন জীবন কারোর না হোক। কতো কঠিন জীবন এই কাঁধে সে বোনের খাটিয়া তুলেছে। বড্ডো ভারী!
*****
অতঃপর….আর্তনাদ, হাহাকার অতৃপ্ততার সাথে আজ বর্ষ পেড়িয়ে গেলো। পুরো মর্তধ্যামে এসেছে অদ্ভুত পরিবর্তন। প্রকৃতি বদলেছে , মানুষ বদলেছে বদলেছে তাদের জীবনধারা। ক্লেশগুলো মানব মনে অভ্যস্ততার সাথে এঁটে গিয়েছে, অতৃপ্ততাগুলো আজ দুঃস্বপ্ন।
আজ সমীরণে রোডসাইড বকুল ফুল গাছটার আদিপত্য। তার সুবাসে সুবাসিত পুরো সমীরণ। মিষ্টি সেই সুগন্ধ নাসারন্ধ্র ফুরফুরিয়ে ঢুকতেই বাচ্চা মেয়েটি এক গাল হাসলো ফুল অতিশয় প্রিয় কি-না। তবুও অলস আদুরে ভাবে পড়ে রইলো কাঁধ টিতে। এই কাঁধে বেশ শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়। সে ঘাড় কাত করে তাকায় অদূরে কবরস্থানের ভেতর ঘাস কাটতে থাকা দুই লোকের দিকে। প্রাণবন্ত হাসি তার মুখে। চঞ্চল কণ্ঠে চেঁচিয়ে ডাকে,
–“পাপাইইইই!”
ঘাস কাটতে থাকা একটি ঘর্মাক্ত মুখশ্রী ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় কবরস্থানের বাইরে এক অপ্রিয় মানুষের কাঁধে শুয়ে থাকা মেয়ের পানে। মেয়ের হাসিতে সেও মৃদু হাসি উপহার দিলো। অতঃপর আবার কাজে লেগে পড়লো।
চার বছরের ছোট্ট বিভা দাদাভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বলল,
–“দাদুভাই পাপাই চলো! কাছে কাছে।”
বয়স্ক লোকটি মাথা নেড়ে নাতনির কথা অনুসরণ করে কবরস্থানের নিকটে গেলো। দূর্বা ঘাস একে একে পাশাপাশি দুটি কবরস্থানের মাটির উপর থেকে আলতো ছেঁটে যেতেই দুটো নাম্বার ভেসে উঠলো। বিভা নিগুঢ় দৃষ্টিতে দেখলো সেই নাম্বার গুলো। সে নাম্বার চেনে। ভাইজান আর বাবা তাকে শিখিয়েছে। সে কৌতুহলী গলায় দাদার উদ্দেশ্যে শুধায়,
–“দাদুভাই, দেখো টুয়েলভ টুয়েলভ এন্ড টুয়েন্টি টু , টুয়েন্টি টু। মানে সেইম সেইম নাম্বার। কেনো?”
নাতনির কথায় নুহাশ মাহমুদ তার দিকে তাকায়। চোখদুটো লালচে হয়ে আছে। সেই ক্ষমতাশালী বিত্তবান বাবাটা হারিয়েছে আজ বহুবছর। সে দলা পাকিয়ে যাওয়া দুঃখ, অসহায়ত্ব, হাহাকার গুলো গিলে নিয়ে মিহি স্বরে বলল,
–“কারণ, তারা জন্মেছিল একই তারিখে আর…”
–“আর? দাদাভাই বলো!”
কণ্ঠনালী রোধ হয়ে আসলো। বহুকষ্টে জবাব দেয়,
–“আর মারাও যায় একই দিনে।”
–“ভেরি উইয়াড!”, বিভা বড়ো বড়ো নেত্রে অস্ফুট স্বরে বলল। তার এখনো বিভিন্ন কথা বেঁধে যায়।
পরপরই আবার শুধায়,
–“তারমানে মামু আর ফুপিমনি একই দিনে জন্মেছে, আবার একই দিনে মা”রা গিয়েছে?”
–“হুঁ।”, নুহাশ মাহমুদ অশ্রুসিক্ত নয়ন লুকিয়ে জবাব দিলো।
ততক্ষণে কবরস্থান থেকে বাবা’র বেশে থাকা নোমান হাত মুখ ধুয়ে, ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে আসে মেয়ের কাছে।
সম্মুখের বৃদ্ধার আকুতি ভরা দৃষ্টি উপেক্ষা করে মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে,
–“মা, চলে এসো। যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে।”
বিভা চোখ মুখ কুঁচকে বায়না ধরে বলল,
–“নো পাপাই! যাবো না, দাদুভাইয়ের সাথে আরেকটু থাকি।”
নোমান থমথমে মুখে বলল,
–“ভাইজানকে আনতে যেতে হবে মা। তাড়াতাড়ি এসো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
ভাইজানের নাম শুনতেই বিভা’র চোখ চকচক করে উঠলো। উল্লাসে ফেটে পড়ে শুধায়,
–“ভাইজানকে আনতে যাবো আমরা? স্টাডিতে?”
–“স্টাডি নয় স্টেডিয়ামে। হ্যাঁ, আসো, তাড়াতাড়ি। ভাইজানের খেলা শেষ এতক্ষণে।”, নোমান গম্ভীর গলায় বলল। বিভা লাফিয়ে পড়লো বাবার কোলে। হাত নেড়ে দাদাভাইকে বলল,
–“দাদাভাই টাটা! কাল নিতে এসো আমায়। কাল যাবো তোমার সাথে।”
নুহাশ মাহমুদ মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। নোমান মেয়েকে কোলে নিয়ে তার এলোমেলো ফ্রকটি ঠিক করে দিলো। টেনে টেনে বের করা বাবড়ি চুলগুলো দেখে হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে শুধায়,
–“আবার চুল টেনে টেনে খুলে ফেলেছো?”
বিভা চোরা মুখে হাসলো। চুল টানা তার বদভ্যাস। নোমান ডানে বামে মাথা নেড়ে মেয়েকে নিয়ে পা বাড়াতে নিলে নুহাশ মাহমুদ পিছু ডেকে ওঠে ছেলেকে। নোমান পুরোদস্তুর উপেক্ষা করতে পারলো না সেই ডাক। সে দাঁড়িয়ে যায়। নুহাশ মাহমুদ এক পা এগিয়ে গিয়ে নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
–“বউমা কেমন আছে?”
নোমান পিছু না ফিরেই গম্ভীর গলায় বলল,
–“আল্লাহ যেমন রেখেছে।”
–“ওদের নিয়ে বাসায় চলো। পরিবেশ পরিবর্তন হলে ভালো লাগবে। বিভা দাদুভাই ও সারাদিন একা থাকে।”
নোমান পিছু ফিরে তাকায় না। থমথমে মুখেই জবাব দিল,
–“আমার স্ত্রী, আমার ছেলে-মেয়ে! তাদের ভালোমন্দ আমি বুঝে নেবো। আপনার আর কারোর ভালোর কথা চিন্তা করতে হবে না।”
গমগমে স্বরে কথাটি বলেই নোমান গটগট করে চলে যায়। নুহাশ মাহমুদ স্থির দৃষ্টিতে ছলছল নয়নে তাকিয়ে থাকে সাদা পাঞ্জাবি পায়জামা পড়া আটত্রিশ বছরের পরিপূর্ণ ছেলেটির দিকে।
এটা সেই ভবঘুরে চঞ্চল, হাস্যরসাত্মক, ইমম্যাচিওর নোমান মাহমুদ নয়। এটা একজন দায়িত্বশীল স্বামী, দায়িত্বশীল বাবা।
তবে তার ফেলে রাখা ব্যবসার দায়িত্বটাও সে কাঁধে উঠিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের ঘর পরিবারের দিকে সে ফিরে তাকায়নি।
কয়েক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো চোখের কার্নিশ বেয়ে। বোনের লা/শ নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া নোমান আজ পর্যন্ত কখনো নিজের বাড়িতে পা দেয়নি। আজ ছয় বছর ছেলেটা বাড়ি ফেরে না, বাবার চোখে চোখ রাখে না, বাবার সাথে একটা কথা বলে না। পরিবারের সাথে তার অনেক অনেক দূরত্ব। আজো খালিহাতে ফিরে আসতে হয় তাকে। পাশাপাশি কবর দুটির দিকে এক পলক উদাসীন দৃষ্টিতে তাকায় সে। বিড়বিড় করে বলল,
–“আমার আম্মা এতোটা কঠোর হয়ে গিয়েছিল জানলে বাবা কখনো তার জীবনে হস্তক্ষেপ করতাম না। আপনি কতো দ্রুত বড়ো হয়ে গিয়েছেন তা বাবা বুঝিই না। বুঝিইনি আমার বোকা আম্মার কাছে তার ভালোবাসা ব্যতীত আর সবকিছু তুচ্ছ! জন্মদাতা, পরিবার সবকিছু! আজ আমায় জীবন্ত লা/শ বানিয়ে দিয়ে আপনি কি সুন্দর ঘুমিয়ে আছেন। অথচ আমার এক একটা শ্বাস নেওয়া দুঃসহ! কখন মৃত্যু আসবে আর আমি আম্মার কাছে যাবো। অপেক্ষা কতোটা যন্ত্রনাদ্বায়ক!”
সবটা আবেগ! এক ঠুনকো আবেগ। নুহাশ মাহমুদ খালি হাতে ফিরলেন। ছেলে মেয়ে হারা এই হতদরিদ্র বাবার মাঝে আর কোন বিত্তের অহংকার দেখা যায় না। তার দিনের চব্বিশ ঘন্টার অধিকাংশ সময় কাটে ঐ কবরস্থানের পাশে বসে। মেয়ে যে তাকে অপরাধী বানিয়ে রেখে গিয়েছে। যেই অপরাধের শাস্তি সে প্রতিনিয়ত পাচ্ছে আর তিলে তিলে তরপে তরপে মরছে।
বয়স আর জীবনের নিষ্ঠুরতায় নুব্জ্য দেহ টেনে বিছানায় এলিয়ে দিতেই, মিতা ত্রস্ত পায়ে ঘরে ঢুকলো। হাতে খাবার। খাবারটা বিছানার পাশে রেখে বলল,
–“সারাদিনে কিছু খাননি। এটা খেয়ে নিন। নয়তো শরীর খারাপ করবে।”
মিতা নত মস্তকে কথাগুলো বলল। নুহাশ মাহমুদ তাকিয়ে রইলেন সেই নত মুখটির দিকে। মৃত প্রায় ব্যক্তির ন্যায় দৃষ্টি তার। দৃষ্টিতে নেই কোন বাঁচার তাগিদ! তবে মনে প্রশ্ন সৃষ্টিকর্তা প্রত্যেকবার তার প্রিয় মানুষগুলোকে ভ”য়”ঙ্ক”র ভাবে ছিনিয়ে নেয় কেনো? আজ প্রশ্নের উত্তরটা জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়লো তার অন্তঃস্থলে। সে ধিমি কণ্ঠে মিতাকে জিজ্ঞাসা করে,
–“তুমি আমায় অভিশাপ দিয়েছিলে, তাই না মিতা? এর জন্যই আমার মেয়েটা আজ আমার বুকে নেই।”
মিতা অবাক পানে চোখ তুলে তাকায় অবুঝ মানুষটার দিকে। মানুষটা এ জীবনে তাকে একটুও বুঝলো না যে! সে অবাক নয়নে শুধায়,
–“কিসের জন্য অভিশাপ দেবো?”
–“আমি যে তোমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছি, তোমায় কখনো মা হতে দেইনি!”
নুহাশ মাহমুদের কথার প্রেক্ষিতে মিতা অবর্ণনীয় ক্লেশ নিয়ে ছলছল নয়নে মৃদু হাসলো। বলল,
–“আমার না, আজো আফসোস হয় আপনাকে দেখলে। আপনি মানুষটা কখনোই কাউকে বুঝতে পারেননি। না নিজের মেয়েকে আর না অন্যের মেয়েকে। আজো আপনি কাউকে বুঝতে পারেন না। আপনার এই অবুঝ পনার কারণে আপনার থেকে সব মানুষগুলো দূরে সরে যায়। অমি নিজে কখনো মা হতে পরিনি কিন্তু নৈরা, নিরাদ, নোমান আমায় মাতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছে। তাদের অভিশাপ দেয়ার আগে আমার মরণ হোক।”
বলেই মিতা আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো। বুক তার ও খালি হয়েছে। আজো সে নৈরার ঘরটা নিজের হতে পরিষ্কার করে রাখে। মেয়ের রেখে যাওয়া এক একটা অস্তিত্ব ছুঁয়ে স্মৃতিচারণ করে তার বাল্যকাল।
~চলবে~
#কাঞ্চনবেলা
#তোনিমা_খান
#অন্তিম_পর্বঃশেষাংশ
[ অন্তিম পর্ব প্রমাংশ আর শেষাংশ দুটি পর্ব দেয়া হয়েছে]
নোমান মেয়েকে কোলে নিয়েই গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। মেয়েকে হাঁটুর উপর বসিয়ে বাবরি চুলগুলো খুলে আবার নতুন করে মাথার তালুতে একটা খোঁপা করতে লাগলো। চুল বাঁধতে বাঁধতে নম্র স্বরে বলল,
–”তুমি যে বারবার চুলে হাত দিয়ে বাঁধা চুলগুলো নষ্ট করো, এতে পাপার কতো হ্যাজাল পোহাতে হয় জানো? তোমার চুল বাঁধতে পাপা খুব হিমশিম খাই মা। এরপর থেকে আর চুলে হাত দেবে না।”
বাবার বুকে গাল দাবিয়ে বসে থাকা বিভা ঘাড় নেড়ে ঘন ঘন মাথা নাড়লো। নোমান তা দেখে বিরক্তি নিয়ে বলল,
–“সবসময় এমনি বলো। কিন্তু এরপর আবার সব ভুলে যাও। আমার কোন কথা শোন না তুমি।”
বাবা ক্রমশই রেগে যাচ্ছে দেখে বিভা চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। থমথমে মুখ বাবার। সে মুখ ছোট করে নিলো। মিনমিন করে বলল,
–“রাগ করছো কেনো?”
–“তুমি পাপার কোন কথা কেনো শোন না?”, নোমান গম্ভীর মুখে বলল। দৃষ্টি মেয়ের শুভ্র আদলের নিষ্পাপ মুখটির দিকে। অতি আদুরে এই বাচ্চা মেয়েটির সবকিছু তার বাবাই। সে সহ্য করতে পারে না বাবা বকা দিলে। সে ঘন ঘন পলক ঝাপটাতে লাগলো। পাপড়ি গুলো অচিরেই ভিজে উঠেছে। থুতনি ঠেকেছে বুকে। নোমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়ের মাথাটা আলতো হাতে বুকে চেপে বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠে বলল,
–“সারাদিন বাবার সাথে থেকে, তোমার সব আচরণ মায়ের মতো হয় কি করে আমি বুঝি না।”
ফের এমন আদর বিহীন কথায় বিভা ঠোঁট বাঁকিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বিগড়ে যাওয়া মেজাজে নোমান হেসে উঠলো মেয়ের হঠাৎ কান্নায়। মা মেয়ের কান্না, মুড হঠাৎ কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো। কখন কোত্থেকে এসে হাজির হবে তার ধারণা কারোর নেই। সে হেসে মেয়ের কান্নারত মুখশ্রী দু হাতের আজলায় নিয়ে নেয়। কপালে, গালে অজশ্র চুমু দিয়ে বলল,
–”কিছু বললেই এভাবে কেঁদে ভাসতে হবে? ওকে পাপা স্যরি! আর কিছু বলবো না। কান্না থামাও।”
বিভা তখনো কাঁদছে। নোমান তা দেখে বলল,
–“কি হলো, এখন কান ধরতে হবে? আচ্ছা যাও আমি কান ও ধরছি।”
সে দুই হাতে দুই কান ধরলো। বিভা আড়চোখে তা দেখতে দেখতে শান্ত হলো। থমথমে মুখে জিজ্ঞাসা করল,
–“আর কখনো রাগ দেখাবে?”
–“দেখানোর উপায় রেখেছো? কিছু বললেই তো মায়ের মতো কেঁদে ভাসাও।”
বিভা ফের বলল,
–“আর কখনো বকবে না,রাগ দেখাবে না। তাহলে আমার খুব কষ্ট হয়।”
নোমান স্মিত হেসে মাথা নাড়লো বাধ্য ছেলের মতো। বলল,
–“আচ্ছা আমার মাকে আমি আর কখনো কষ্ট দেবো না। এখন চোখের পানি মুছে পাপাকে একটা কিসি দাও তো!”
বিভা বাবার বাধ্যগত মেয়ের মতো বাবার পাঞ্জাবির কোনা টেনে চোখের পানি মুছলো। নোমান চোখ মুখ কুঁচকে নিলো গাড়িতে অজশ্র টিস্যু থাকতেও তার পাঞ্জাবিটাকে টিস্যু বানাতে দেখে। বিভা চোখের পানি মুছে প্রফুল্ল হাসলো। মুখ বাড়িয়ে আনন্দের সাথে বাবার গালে মুখে সব জায়গাতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
–”দিয়েছি, লটস অফ কিসি’স।”
নোমান প্রশান্তির হাসি নিয়ে বলল,
–“থ্যাংক ইউ মা, ফর লটস অফ কিসি’স।”
বিভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। নোমান মেয়েকে প্যাসেঞ্জার সিটে বসিয়ে দিয়ে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিলো। আদেশের সুরে বলল,
–“চুপটি করে বসে মা। নড়াচড়া করবে না।”
–“ওকে পাপাই।”, বিভা একগাল হেসে বললো। নোমান গাড়ি স্টার্ট দেয়।
মাইকে তখন বিজয়ী দলদের পুরস্কার বিতরণের জন্য ভাষ্যকার লাগাতার কিছু বলে যাচ্ছে। ভাষ্যকার তখন মাইকে উচ্চস্বরে ম্যাচ অফ দ্যা ম্যানের নাম ঘোষণা করলো। সে উচ্চস্বরে বলল,
–“আজকের ম্যাচ অফ দ্যা ম্যান হচ্ছে, বিভোর মাহমুদ।”
সদ্য পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করা নোমানের মুখে স্মিত হাসি ফুটে উঠলো বিভোর মাহমুদের নাম শুনতেই। দিনশেষে অসম্ভব সুন্দর কয়েকটি শব্দ তার জীবনের প্রাপ্তির খাতায় লিপিবদ্ধ করে এই বিভোর মাহমুদ! এক গর্বিত বাবা সে। হ্যাঁ, নোমান মাহমুদের ছেলে একমাত্র ছেলে বিভোর মাহমুদ। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে স্টেজের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। পুরষ্কার তুলে দেওয়া হচ্ছে এগারো বছরের বিভোরের হাতে। নোমান নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখলো দৃশ্যটি। এই দৃশ্যটি আজকে নতুন নয়। বিগত ছয় বছর যাবৎ সে এমন বহু মুহুর্তের সাক্ষী হয়েছে।
–“আপনি একটা ছেলে পেয়েছেন! কোন একদিন জাতীয় পর্যায়ে খেলবে দেখবেন।”, পার্শবর্তী কারোর মন্তব্যে নোমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। বিভোরের দলের একজন খেলোয়াড়ের বাবা সে। নোমান মৃদু হেসে বলল,
–“আল্লাহ্ চাইলে অবশ্যই খেলবে। দোয়া করবেন।”
–“আল্লাহ অবশ্যই চাইবে। ছেলেটা কতো কষ্ট করে এই খেলা নিয়ে। একদিন ঠিক সফল হবে। কোন মাঠ থেকে ট্রফি আর সম্মাননা ছাড়া ফিরে যায়নি সে।”, ভদ্রলোকটি বলল। ততক্ষণে বিভোর ব্যাট হাতে স্টেজ থেকে নেমে আসে। নোমান ছেলেকে ফোন দিলো। মৃদু স্বরে বলল,
–“স্টেজের বাম পাশে চলে এসো ক্যাপ্টেন।”
মিনিটের মাঝে এক শুভ্র আদলের গম্ভীর মুখশ্রীর ছেলে এসে দাঁড়ায় নোমানের কাছে। ডেকে ওঠে,
–“পাপা!”
পাশের গার্ডিয়ানের সাথে কথা বলতে থাকা নোমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। ওষ্ঠকোনে মৃদু হাসি তার। এই যে পাপা নামক ছোট্ট সম্বোধনটুকু অর্জন করতে তার বহু বছর লেগেছে। বড্ডো মূল্যবান এক সম্বোধন! বিভা চিৎকার করে হাত বাড়িয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে,
–“ভাইজাননন কোলে!”
গাম্ভীর্য মাখা শক্ত মুখটি একটু শিথিল হলো ঐ ছোট্ট আদরমাখা কণ্ঠে। নোমান মেয়েকে ছেঁড়ে দিলো। এগিয়ে আসে ছেলের নিকটে। হাত বাড়িয়ে নাকের ডগায় জমে থাকা ঘামগুলো হাতের উল্টোপিঠে মুছে নিয়ে হাতে থাকা ইলেক্ট্রোলাইটের ড্রিংকস টা এগিয়ে দিলো। বিভোর নিরবে ড্রিংকসটা হাতে তুলে নিয়ে। এক ঢোক খেয়ে, হাতের ব্যাট সহ মাথার হেলমেট খুলে ধীরস্থির নোমানের হাতে দিয়ে দিলো। পরপরই এগিয়ে দিলো সদ্য পাওয়া টাকাগুলো। নোমান টাকাগুলো দেখে মিহি স্বরে বলল,
–“পকেটে রেখে দাও।”
পৃথিবীতে এই একটা জিনিসকে বিভোর ঘৃণা করে। প্রচুর ঘৃণা! ছেলেটি মান্য করতে পারলো না বাবার সেই কথাটি। সে নত মস্তকে ফের এগিয়ে দিলো টাকাগুলো। নোমান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
–“পাপার পকেটে জায়গা নেই ক্যাপ্টেন। তোমার বোনের চকলেট দিয়ে ভরে আছে। আপাতত রাখো। মাত্র দশ মিনিটের জন্য!”
বিভোর শুনলো। হাজার টাকার কয়েকটা নোট পকেটে রেখে দিয়ে পা জড়িয়ে থাকা বোনকে কোলে তুলে নিলো। গম্ভীর মুখটিতে সুপ্ত হাসির উজ্জ্বলতা। সে নিরবে গাল এগিয়ে দিলো বোনের দিকে। বিভা চমৎকার হেসে শব্দ করে সেথায় আদর করে দিলো। বিভোর পরপর আরেক গাল এগিয়ে দিলো, বিভা সেথায় ও আদর করে দিলো। বিভোর প্রসন্ন মনে বোনের কপালে আদর করে দিলো। নোমান ব্যাট আর হেলমেট নিয়ে গাড়ির দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,
–“ভাই বোন, আহ্লাদ গাড়িতে করবে। এখন চলো। সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে।”
বিভোর বোনকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। বিভা ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঠেকিয়ে বসে আছে। ভাই অতিশয় প্রিয় মানুষ যে! যার কাছে তার সকল উশৃঙ্খলতা প্রকাশ পায় এবং ভাই নিরবে সেগুলো সহ্য করেও নেয়। বিভোর হাঁটতে হাঁটতে নম্র স্বরে শুধায়,
–“বনু কি ভাইজানকে মিস করেছিল?”
বিভা বড়ো বড়ো নেত্রে বলল,
–“খুব।”
–”কতোটা?”
–“এতোটা, এই যে এতো গুলো।”, বিভা দুই হাত ছড়িয়ে বলল। বিভোর স্মিত হাসলো। জিজ্ঞাসা করে,
–“দুপুরে খেয়েছিলে?”
–“হুম। পাপাই, পঁচা পঁচা ভেজিটেবল আর ভাত খাইয়েছে।”, বিভা নাক মুখ কুঁচকে বলল। তার ভেজিটেবল পছন্দ নয়। কিন্তু সপ্তাহে একদিন তাকে জোরপূর্বক অনেক অনেক ভেজিটেবল খাওয়ানো হয়। বাবার পাশে গাড়িতে বসে বিভোর বোনকে কোলে বসিয়ে দিলো। নোমান গাড়ি স্টার্ট দিলো। দশ মিনিটের পথ পেরুতেই সে এক জায়গায় গাড়ি থামালো। বিভোর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাবার দিকে। নোমান বাম পাশে স্থাপিত এতিম খানাটির দিকে ইশারা করে বলল,
–“যাও টাকাগুলো দিয়ে এসো।”
বিভোর অভ্যস্ততার সাথে বোনকে কোলে করে বেরিয়ে গেলো গাড়ি থেকে। মাদ্রাসার দান বাক্সে হাজার টাকার পাঁচটি নোট ঢুকিয়ে দিলো। এক হুজুর দেখলো সেটা। এগিয়ে এসে শুধায়,
–“এতোগুলো টাকা এখানে দিলে কেনো?”
কেনোর কৈফিয়ত দিলো না বিভোর। শুধু থমথমে মুখে বলল,
–“বাচ্চাদের ভালো খাবার দেবেন, আসি। আসসালামুয়ালাইকুম।”
বলেই বিভোর চলে আসলো। গাড়িটি থামলো সেই দালানটির সামনে যেই দালানটির সামনে একদা দুটি খাটিয়া পাশাপাশি রাখা ছিল। যেখানে শুয়ে ছিল দুটি প্রিয় মানুষ। যারা আজ সময়ের বিবর্তনে কোথাও মিলিয়ে গিয়েছে অতৃপ্ততার আর্তচিৎকার হয়ে।
নোমান ছেলে মেয়ে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে ঢুকলো। বিভোর ঘরে ঢুকেই কাঙ্খিত কক্ষটির দরজা খুলে উঁকি দিলো। নিঃশব্দে শুধু এক পলক কক্ষে অবস্থানরত তিনজনকে দেখে আবার দরজা চাপিয়ে বেরিয়ে আসলো। বিভা ঘরে ঢুকতেই ক্লান্ত ভাইজানের লেজ ধরে গুটি গুটি পায়ে তার পেছন পেছন ঘরে চলে গেল। তার এটাই কাজ বাবা আর ভাইয়ের লেজ ধরে চরকির মতো পুরো ঘোরা। নোমান দ্রুত নিজের ঘরে গিয়ে পোশাক বদলে টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ে বের হলো। বের হতেই দেখলো মেইড তার প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে বের হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করলো,
–“চলে যাচ্ছেন?”
মেইড মাথা নেড়ে বলল,
–“সন্ধ্যা হয়ে গেছে স্যার।”
নোমান মাথা নেড়ে সায় জানায়। হাতে একটু ব্যস্ততা থাকায়। জিজ্ঞাসা করলো,
–“সে কি করছে?”
মেইড ফিরে তাকায়। কর কথা জিজ্ঞেস করছে সে জানে। মৃদু হেসে বলল,
–“নিশু এসেছে। ও খাইয়ে এখন ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।”
–“ওহ আচ্ছা। আপনি যান। কাল সময়মতো চলে আসবেন।”, নোমান বলেই দ্রুত রান্নাঘরে গেল। দুপুরে ম্যাচ থাকায় ছেলেটা বারোটার দিকেই বেরিয়ে গিয়েছে। কি খেয়েছে আদৌ জানা নেই। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। সে রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় প্যান বসালো। দ্রুত কিছু বানানোর প্রচেষ্টা তার। এই ভর সন্ধ্যায় ছেলে ভাত তো মুখে তুলবে না। সে পাস্তা বানানোর জন্য কিছু কর্ন আর সবজি কাটতে নিলো। কাটার জন্য ছুরিটা হাতে নিতেই গলায় তোয়ালে ঝুলিয়ে নিঃশব্দে বিভোর ঢুকলো। পাছে ঢুকলো বিভাও। ভাই বোনের হাতে দু’টো আধখাওয়া আপেল। বিভোর আপেল রেখে নিরবে বাবার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে নিলো। বলল,
–“আমি সবজি কাটছি তুমি অন্যকিছু করো।”
নোমান শান্ত দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। এটা সেই চতুর, চঞ্চল হাসিখুশি দুষ্টু বুব্বো নয়। যার চোখে অঢেল স্বপ্ন ছিল মামা মায়ের দুঃখ দূর করার। একজন বড়ো ক্রিকেটার হওয়ার। সেই বুব্বোটা সেদিন ই হারিয়ে গিয়েছে, যেদিন সে জানতে পারে, তার ভাগ্য থেকে তার মামুর বুকটায় ঘুমানোর সৌভাগ্য খসে পড়েছে। এই বুব্বো হলো একজন গম্ভীর, বুঝদার, দায়িত্বশীল, অনুভূতিহীন কঠিন ছেলে। সর্বদা নিরবতা তার সঙ্গী! আজ তার স্বপ্ন তার নিকটে কিন্তু যার জন্য স্বপ্নগুলো দেখতো সে আর নেই। তাই এগুলো আর তার স্বপ্ন নেই। শুধুই টাইম পাস! সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাস্তা সিদ্ধ করতে দিয়ে শুধায়,
–“পা কেটেছে কি করে?”
সবজি কাটতে থাকা বিভোর অপ্রস্তুত চোখ তুলে তাকায় বাবার দিকে। নোমান মৃদু হাসলো সেই অপ্রস্তুত দৃষ্টি দেখে। অন্য চুলায় হোয়াইট সস বানাতে বানাতে বলল,
–“আমি তোমায় একা ছাড়ি ঠিক আছে, কিন্তু কখনো দৃষ্টি সীমানার বাইরে যেতে দেই না, ক্যাপ্টেন! খেলতে গেলে ব্যথা পাবে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এটা আমার থেকে লুকানো মোটেও ভালো বিষয় নয়। পা কেটেছে কি করে?”
বিভোর তখনো নিরব। তার শুনশান নিরবতায় স্পষ্ট নারজি। সে বলতে চায় না নাকি কাউকে বাঁচাচ্ছে। চোখেমুখে কাঠিন্যতা ভর করে নোমানের। সোজাসাপ্টা জিজ্ঞাসা করলো,
–“কে করেছে?”
বিভোর দীর্ঘশ্বাস ফেললো। থমথমে মুখে বলল,
–“বড়ো কোন আঘাত নয়। এতো চিন্তার কিছু নেই।”
–“কে করেছে?”
–”বারবার জিজ্ঞেস করছো কেনো? কে করেছে তুমি তো সেটা জানোই।”, বিভোরের বিতৃষ্ণা ভরা কণ্ঠ।
–“আমি তোমার মুখে শুনতে চাই।”, নোমানের নিরুদ্বেগ শক্ত কণ্ঠ।
বিভোর সবজি কাটতে কাটতে গোমড়া মুখে জবাব দিলো,
–“সৌভিক।”
–“কেনো?”
–“আমি না থাকলে সে ম্যাচ অফ দ্যা ম্যান হতে পারবে। দলের সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়ের খেতাব অর্জন করতে পারবে।”, বিভোরের কথায় নোমান স্মিত হাসলো তবে কিচ্ছুটি বললো না। বিভোর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
–”তুমি ওকে কিছু বলবে না।”
–“সেটা তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি নিজের খেলা আর পড়ায় ফোকাস করো।”, নোমানের কথায় বিরক্ত হয় বিভোর। ছোট বেলা থেকে বিভোরের এই একটা স্বপ্নকে নোমান বিলীন হতে দেয়নি। সাহস জুগিয়েছে, এফোর্ড দিয়েছে তাই তো আজ বিভোর পুরো খুলনায় একজন পারদর্শী ক্রিকেট খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত। ও যেই ক্লাবে ক্রিকেট প্রাকটিস করে, সেই ক্লাবের হয়েই খেলে। এতোটুকু বয়সেই একের পর এক ম্যাচ খেলে ঘর ভরিয়ে ফেলেছে পুরষ্কারে। আর সেগুলো যত্ন করার দায়িত্ব নোমানের।
বাবা, ছেলে, মেয়ে ক্রিমি, স্পাইসি পাস্তা বানিয়ে টেবিলে রাখলো। তখনি বসার ঘর সংলগ্ন ঘরটির দরজা খুলে বেরিয়ে আসে বারো বছরের নিশু। নোমান তাকে দেখে মৃদু হাসলো। নিশুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
–“নিশুপিশু ছোট পাপা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলাম। তাই তোমার কাছে যাইনি। ভাইয়ের ক্ষুধা পেয়েছে খুব। এসো, ছোট পাপা পাস্তা রান্না করেছি খাবে।”
নিশু মৃদু হেসে চাচার বাড়িয়ে দেয়া হাতটি আঁকড়ে ধরে। নোমান চেয়ার টেনে তাকে বসালো, বিভোর আর বিভার পাশে। নোমান জিজ্ঞাসা করে,
–“সে কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?”
–“হুম, মাত্র ই ঘুমালো।”, নিশু জবাব দেয়। নোমান সবাইকে পাস্তা সার্ভ করতে করতে আবার জিজ্ঞেস করে,
–“খাবার খেয়েছিল পুরোটা?”
–“হুম, পুরোটা খেয়েছে।”
–“ছোট পাপার রাতটুকু সহজ করে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ নিশুপিশু।”, নোমান হেসে বলল। নিশুও হাসলো। বিভোর আর বিভা নিরবে পাস্তা খেয়ে যাচ্ছে।
রাত বাড়লো। বিভা ভইজানের সাথে পড়াশুনা করে পা টিপে টিপে কাঙ্খিত ঘরটির দরজা ঠেলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিলো। উজ্জ্বল আলোর মাঝে এক মধ্যবয়স্ক রমনী পুতুল খেলছে একমনে। বিভা বেশ সতর্ক দৃষ্টি ফেলে মন্থর গতিতে এগিয়ে গেলো রমনীটির কাছে। ভয়ে ভয়ে ডেকে উঠলো,
–“মাম্মা?”
বড্ডো মনোযোগ সহকারে পুতুলকে শাড়ি পড়াচ্ছে রমনীটি। বিভা আবারো ডাকলো,
–“মাম্মা?”
সাধনা চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। কপাল কুঁচকে আপাদমস্তক দেখে বাচ্চা মেয়েটির। রুঢ় কণ্ঠে শুধায়,
–“এই মেয়ে, কে তোর মাম্মা?”
বিভা মৃদু হেসে বলল,
–“তুমি। তুমি আমার মাম্মা।”
সাধনা তীব্র বিরোধিতা করে বলল,,
–“নাহ আমি তোর মাম্মা নই। আমি শুধু বিভোরের মাম্মা।”
বিভার মন খারাপ হলো। তবুও বলল,
–“তুমি ভাইজান আর আমার দু’জনের ই মাম্মা।”
–“নাহ।”, সাধনার জেদি কণ্ঠ। বিভা আর কিছু বলল না। সে আজকে যেই চমকপ্রদ তথ্যটি জেনেছে তাই উৎকণ্ঠা নিয়ে বলতে এসেছে মাকে। সে বলল,
–“মাম্মা জানো, আজ আমি ফুপিমনি আর মামুকে দেখতে গিয়েছিলাম। তুমি কি জানো উইয়াড বিষয় কি? তারা একদিনেই জন্মেছিল আর একদিনেই মারা গিয়েছে।”
সাধনার হাত থমকে যায় মারা যাওয়ার কথা শুনেই। সে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় বিভার দিকে। চোখ তার লাল হয়ে উঠেছে অচিরেই। বিভা ভয় পেয়ে গেলো। সাধনা তার ভয়কে আরো গাঢ় করে দিয়ে একটা চর মারলো। আর রাগান্বিত স্বরে বলল,
–“এই মেয়ে, কে মা”রা গিয়েছে? কেউ মা”রা যায়নি। তুই মা”রা গিয়েছে বললি কেনো? যা বের হ এখান থেকে।”
বিভা ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বিভোর গুরুত্বপূর্ণ নোটস করছিলো। বোনের চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে ওঠে তার বুকটা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বোন নেই তার পাশে। সে ছুটে বের হয় ঘর থেকে। মায়ের ঘরের দরজা খোলা দেখে সে এক ছুটে ভেতরে ঢুকলো। বিভা কাঁদছে আর সাধনা তাকে ধমকাচ্ছে। বিভোর এক ছুটে গিয়ে বোনকে কোলে তুলে নেয়। আদর করে শুধায়,
–“কি হয়েছে সোনা কাঁদছো কেনো? ভয় পেয়েছো? তুমি এখানে এসেছো কেনো?”
বিভা কাঁদতে কাঁদতে গাল দেখিয়ে বলল,
–“ভাইজান ব্যথা!”
বিভোর অবাক পানে তাকায় লাল গালটির দিকে। পরপরই রণমূর্তী হয়ে থাকা মায়ের দিকে। শুধায়,
–“তুমি ওকে মারলে কেনো, মাম্মা?”
সাধনা ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–“ও খারাপ তাই। ও বলে কি-না নৈরা আর স্বরূপ মা”রা গিয়েছে। তুই বল ওরা কি মা”রা গিয়েছে? ওরা তো এই বিছানায় ঘুমোচ্ছে। ঐ দেখ। কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে। স্বরূপ কিছুক্ষণ আগেই ব্যাংক থেকে এসেছে। আর এই মেয়ে কি-না বলে….একটা মাইর দিতে হয়।”
সাধনা আবার ক্ষিপ্ত হয়ে বলল। বিভোর কঠোর দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে। ছলছল নয়নে বোনকে বুকে চেপে বলল,
–“মাম্মা ওর সাথে আর খারাপ ব্যবহার করলে কিন্তু আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবো কোথাও। আর তোমার সাথে কথাও বলবো না, তোমার কাছে থাকবো ও না।”
সাধনা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায় ছেলের দিকে। হড়বড়িয়ে বলল,
–“একদম মাইর খাবি বুব্বো। তুই কোথাও যাবি না মাকে ছেড়ে। বড়ো হয়ে গিয়েছিস না? মাকে ছেড়ে কোথায় যাবি?”
নিশুকে বাড়িতে দিয়ে এসে নোমান মাত্র ই ঘরে ঢুকলো। তৎক্ষণাৎ কর্নকুহরে প্রবেশ করে মেয়ের কান্না। সে অস্থির চিত্তে এগিয়ে যায় উৎসের দিকে। সাধনার ঘরে ঢুকতেই শুনতে পেলো বিভোরের কণ্ঠ।
–“তবে বলো, তুমি আর আমার বোনের সাথে খারাপ ব্যবহার করবে না। গায়ে হাত তুলবে না।”, বিভোর কঠোর গলায় বলল। সাধনা তড়িঘড়ি করে বলল,
–“না করবো না, করবো না। তুই কোথাও যাবি না।”
ছেলের কথায় নোমান অস্ফুট স্বরে শুধায়,
–“গায়ে হাত তুলেছে?”
বিভোর ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। সাধনাও ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো নোমানের দিকে। বাচ্চাদের মতো করে বলল,
–“না না তুলিনি তুলিনি। মিথ্যা কথা বলছে।”
বিভা বাবাকে দেখতেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো আরো জোরে। গাল দেখিয়ে বলল,
–“পাপাই ব্যথা! খুব ব্যথা।”
নোমান ছলছল নয়নে তাকায় মেয়ের লালচে গালটির দিকে। চার বছরের এটুকু দেহে আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আদৌ আছে? সে এগিয়ে যায়। বিভোরের কাছ থেকে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। পিঠে হাত বুলিয়ে লাল গালটিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বলল,
–“কিছু হয়নি মা। ব্যথা সেরে যাবে পাপা ঔষধ লাগিয়ে দেবো।”
নোমান ছলছল নয়নে তাকায় সাধনার দিকে।
হ্যাঁ, দায়িত্বের কাছে হেরে যাওয়া এক ছেলে, এক ভাইয়ের ফেলে যাওয়া সব দায়িত্বগুলো সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। যেই দায়িত্ব পালন করতে করতে আজ এই ছোট্ট বিধ্বস্ত সংসারটির একমাত্র চালক হয়ে উঠেছে সে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটতে ছুটতে বয়সের পার্থক্যকে হার মানিয়ে মানসিক বিকারগ্রস্ত এক নারীর স্বামী হয়ে উঠেছে। বাবা না হয়েও কারোর বাবা হয়ে উঠেছে। এতো বছরে এই ঘরটি থেকে আরো একটি প্রাণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে শুনিতা পুরো এক বছর মৃত মানুষের মতো বাঁচে। ঠিক এক বছরের মাথায় আবার স্ট্রোক করে মারা যায়। সকলের রেখে যাওয়া এই দায়িত্ব গুলো বিগত ছয় বছর যাবৎ নোমান বড্ডো যত্নের সাথে পালন করে আসছে। আজ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালনে তার মাঝে কখনো ক্লান্তি, বিরক্তি দেখা যায় নি।
সে বিভাকে নিয়ে সাধনার নিকটে যেতেই বিভা ভয়ে কুঁকড়ে গেলো। নোমান মেয়েকে নিয়ে ঠিক সাধনার সামনে বসলো। থমথমে মুখে বলল,
–“ও নৈরার ভাইয়ের আর আপনার মেয়ে সাধনা। আমাদের মেয়ে! আপনি যদি এমন করেন ওর সাথে, তবে আমি নৈরাকে আপনার ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে যাবো। আর কখনো আসতে দেবো না।”
সাধনার চোখ পানিতে টলমল করে উঠলো। টলমলে আঁখি তুলে বলল,
–“না নিবি না। আমার স্বরূপ নৈরাকে ছাড়া থাকবে কি করে? ওর অনেক কষ্ট হবে।”
–“আমারো কষ্ট হয় যখন আপনি আমার মেয়েকে আঘাত করেন। আমি আর নৈরাকে এই বাড়িতে রাখবো না। নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে।”
–“না যাবি না। কোথাও নিয়ে যাবি না।”, সাধনার জেদি কণ্ঠ। নোমান থমথমে মুখে বলল,
–“তবে ওকে আদর করুন, ভালোবাসুন। কখনো আঘাত করবেন না।”
–“করবো না, করবো না।”, সাধনা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বললো। নোমান বিভাকে বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। বলল,
–“কোলে নিন। স্যরি বলুন, আদর করুন, গান গেয়ে গেয়ে ঘুম পড়িয়ে দিন।”
সাধনা কোলে নিলো বিভাকে। বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
–“ভালো ভালো আদর আদর।”
পরপরই বলল,
–“দিয়েছি আদর করে।”
–“এখন বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন নয়তো নৈরাকে নিয়ে যাব।” নোমানের হুমকিতে সাধনা তড়িঘড়ি করে বিভাকে বিছানায় শুয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জোরে জোরে বলতে লাগলো,
–“আয় আয় চাঁদ মামা
টিপ দিয়ে যা
চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা।”
–“এই মেয়ে ছড়া বলেছি এখন ঘুমা।”, মায়ের কথায় বিভা বাবার দিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
–“আর আদর লাগবে না পাপাই।”
নোমান আর বিভোর ছলছল নয়নে তাকায় বিভার কথায়। তারা বিভাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় কামড়া থেকে। নোমান মেয়ের গালে বরফ ঘঁষছে। বিভোর ছুটে যায় নিজের স্টাডি টেবিলের কাছে। সেখানে জমিয়ে রাখা রাজ্যের সব চকলেট নিয়ে ছুটে আসে বোনের কাছে। চকলেট অতিশয় প্রিয় খাবার হওয়ায় বিভার কান্নারত মুখশ্রীতে একফালি হাসি ফুটে উঠলো। বিভোর আর নোমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বিভার হাসি দেখে। তারা আশা রাখছে এই চকলেট গুলো বিভাকে ভুলিয়ে দেবে মায়ের এই কঠোরতা।
চার বছরের এই ছোট্ট বিভা মায়ের আদর কখনোই তেমন পায়নি। স্বরূপের মৃত্যুতে পাওয়া ট্রমা থেকে সাধনা আজ পর্যন্ত বের হতে পারেনি। ভাইয়ের মৃত্যু ভুলতে এই ছলনাকে আঁকড়ে ধরেছে। তাকে শুধু স্বরূপ আর নৈরার কথা বললেই আয়ত্তে আনা যায়। সে শুধু বুব্বোকেই আদর করে। কারণ সে জানে বুব্বোই তার একমাত্র ছেলে। আর তার কোন ছেলে মেয়েও নেই আর না তার বিয়ে হয়েছে। সে এখনো নিজেকে বিধবা বলে দাবি করে। নোমান কখনো ভেঙে পড়ে না। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত এই জীবনসঙ্গীকে সে দক্ষ হাতে সামলে আসছে আজ এতো বছর যাবৎ। তবে মানসিক বিকারগ্রস্ত স্ত্রীর থেকে পাওয়া এই অমূল্য রত্ন তার বড্ডো প্রিয়। যাকে পৃথিবীতে আনতে তাকে আর বুব্বোকে একটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল। বিভা যখন সাধনার গর্ভে আসে তখন হরমোনাল পরিবর্তনের করণে সে আরো ঔদ্ধত্য, হিংস্র হয়ে পড়েছিল। নিজেকে আঘাত করতেও দ্বিধা বোধ করতো না। এতো ঝুঁকি নিয়ে দীর্ঘ নয় মাস ছোট্ট বিভোর আর নোমান সামলায় সাধনাকে। এবং বহু প্রতিক্ষার পর বিভা’কে সুস্থ সবল পৃথিবীতে আনতে পারে। সেই থেকে নোমান আর বিভোর ই দেখাশোনা করে বড়ো করেছে বিভাকে। সাধনা তো কখনো স্বীকার ই করে না ও তার মেয়ে। যদি নোমান ভয় দেখায় তখন বিশ্বাস করে।
বুকের মাঝে ঘুমন্ত মেয়েকে দেখে নোমান মলিন হাসলো। মেয়েকে বিভোরের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সে নিরবে বেরিয়ে আসলো। বিভা ভাইয়ের সাথেই থাকে। তার সাথে রাখে না। সাধনার কর্মকান্ডে ভয় পায় বিভা। আর রাতে সাধনাকে কখনো একাও রাখে না সে। কখন কি অঘটন ঘটিয়ে বসে।
সে ধীরস্থির নিজের ঘরে ঢুকতেই কর্নকুহরে প্রবেশ করলো মিষ্টি সুর,
–“ঘুম পাড়ানী মাসিপিসি,
মৌ ঢালা চাঁদের হাঁসি,
ঘুমিয়ে পড়ে ছোট্ট খোকা,
চাঁদ তারে দেখছে হাসি।
আকাশ জুড়ে তারা কয়,
ঘুমিয়ে যা, তুই ঘুমিয়ে যা,
রূপকথার দেশে আজ,
খোকা যাবে ভেসে চুপিচা।”
সে ঘরে ঢুকে ওয়ার্ম লাইট জ্বালাতেই দেখতে পেলো সাধনা ছেলে পুতুল আর মেয়ে পুতুলটাকে ঘুম পাড়াচ্ছে। পড়নে একটা সাদা ম্যাটারনিটি ফ্রক আর সাদা সেলোয়ার। লাইট জ্বলতেই সাধনা চেঁচিয়ে উঠে বলল,
–“এই আলো আসছে, আলো। নৈরা আর স্বরূপ ঘুমাচ্ছে। বিরক্ত করবি না, বন্ধ কর লাইট।
নোমান নিরুদ্বেগ ঘরের এলোমেলো কাপড়গুলো উঠিয়ে রাখতে রাখতে কঠোর গলায় বলল,
–“আর একবার তুই তোকে করলে নৈরাকে সোজা বাপের বাড়ি রেখে আসবো।”
সাধনা তড়িৎ গতিতে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,
–“বন্ধ করো লাইট, আলো আসছে। ওরা ঘুমাতে পারছে না।”
নোমান লাইট বন্ধ করলো। সাধনার স্বস্তি হলো। তবে তার স্বস্তিতে পানি ঢেলে দু’টো বলিষ্ঠ হাত আষ্টেপৃষ্ঠে তাকে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। সাধনা রাগে চেঁচিয়ে উঠলো,
–“এই ছাড় ছাড়! ধরবি না। ছাড়।”
নোমান ছাড়লো না বরং আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরলো। বলল,
–“আপনি যে নৈরার ভাইয়ের সাথে এমন করেন নৈরা জানে?”
–“না জানে না। তুই বলবি না।”, সাধনার ক্ষিপ্ত কণ্ঠ। নোমান তাকে বুকে জড়িয়ে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
–“বলে দেবো। তখন নৈরা কষ্ট পাবে। তারপর এই ঘর আর আপনার ভাইকে ছেঁড়ে চলে যাবে অনেক দূরে।”
সাধনার চোখদুটো ছলছল করছে। অনুনয় করে বলল,
–“বলবি না।”
–“তাহলে ভালো ব্যবহার করতে হবে।”
–“করবো।”
–“সবসময় মুখেই এমন বলেন। কিন্তু একটু পর ভুলে যান।”
–“না না ভুলবো না। সত্যি বলছি।”
নোমান দৃষ্টি নামায় মেদহীন ফর্সা মুখটির দিকে। মৃদু হেসে বলল,
–“আমি যা বলবো তাই করবেন?”
–“করবো।”
বলতেই সাধনার ঠোঁটে উষ্ণ এক ছোঁয়া ছুঁয়ে গেলো। সাধনা চেঁচিয়ে উঠলো। ঠোঁট মুছতে মুছতে ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
–“ইশশ! আবার অসভ্যতামি করছিস? ছ্যাপ লাগিয়ে দিয়েছে। কি খচ্চর! থু থু…আর আমায় ছুবি ন বলে দিলাম।”
ত্যাড়া নোমান হেসে আরো অজশ্র চুমু দিলো পুরো মুখ জুড়ে। সাধনা ফোঁস ফোঁস করছে আর বলছে,
–“নৈরার ভাই ভালো না।”
নোমান ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–“কেনো সে কি করেছে?”
–“সারাদিন শুধু গা ঘেঁষাঘেঁষি করে। অসভ্য! চুমু দেয় শুধু।” সাধনা তীব্র রাগ নিয়ে বলল। নোমান ওর বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া নাক চেপে বলল,
–“নৈরার ভাই আপনার স্বামী হয়। চুমু তো খাবেই।”
–“কেনো খাবে?”
কারণ সে আপনার স্বামী হয়।”
সাধনা তীব্র রাগ নিয়ে বলল,
–“কচু হয়। কোন স্বামী নেই আমার।”
নোমান ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সে সাধানাকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বলল,
–“দেখি তো, আজ ই আমার বোনকে নিয়ে আমি চলে যাবো এখান থেকে।”
সাধনা এবার ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে নোমানের টিশার্ট খামচে ধরলো। অনুনয় করে বলল,
–“কোথাও যাবে না।”
ঠিক সম্বোধন শুনতেই নোমান আড়চোখে তাকায়। শুধায়,
–“কোন উশৃঙ্খলতা করবেন না তো? যা বলবো তা শুনবেন?”
–“হু।”
নোমান আবার শুয়ে পড়ে। সাধনাকে একহাতে আগলে নিয়ে বলল,
–“তবে একটু আদর করুন।”, নোমান গাল দেখিয়ে বলল।
সাধনা থমথমে মুখে তার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। নোমান আরো এক গাল এগিয়ে দিল। সাধনা রাগে গজগজ করতে করতে সেখানেও দিল। নোমান হাসতে হাসতে এবার ঠোঁট এগিয়ে দিলো। সাধনা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“আর দিতে পারবো না। ছ্যাপ লেগে যাবে, ছিঃ..”
সাধনা ঘৃণিত কণ্ঠে বলল। নোমান নাছোড়বান্দা তার কথা শুনলো না। তার থেকে চুমু নিয়েই ছাড়লো। দীর্ঘ সেই চুমুর প্রকোপ সামলে উঠতে উঠতে সাধনা নির্জীব হয়ে গেলো। চুপটি করে পড়ে রইলো নোমানের বুকে। নোমান মৃদু হেসে দেখে নির্জীব হয়ে যাওয়া মানুষটাকে। একটু গভীর ভাবে ছুঁয়ে দিলে এমনি নির্জীব হয়ে পড়ে। সে জানে বিকারগ্রস্ত স্ত্রীর মাঝে এখনো একটু অনুভূতি রয়েছে। সে তৃষ্ণার্ত একটু সুস্থ স্বাভাবিক স্ত্রীকে দেখার জন্য। সে নম্র কণ্ঠে শুধায়,
–“খিদে পেয়েছে, খাবেন কিছু?”
সাধনা না বোধক মাথা নাড়লো। অতঃপর কিয়ৎকাল বাদ চমৎকার হেসে নোমানের বুকে থুতনি ঠেকিয়ে তার দিকে তাকায়। চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
–“একটা গোপন কথা শুনবে?”
নোমান হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। সাধনা তার কানের মুখ এগিয়ে নিলো। নোমান কপাল কুঁচকে নেয় তার কান্ডে। সাধনা ফিসফিসিয়ে বলল,
–“নৈরা আর স্বরূপের না একটা ছোট্ট বাবু হবে শিঘ্রই। আমি খুব খুশি। বাবুর জন্য জামাও বানিয়েছি।”
নোমানের চোখদুটো টলটল করে উঠলো। হাঁসফাঁস করে উঠলো অন্তঃস্থল। এই কথাগুলো তাকে যন্ত্রনা দেয়। কিন্তু সাধনাকে কি করে বোঝাবে? সে মেকি হেসে বলল,
–“এ তো খুব খুশির সংবাদ।”
–“হুম। আমি নৈরার অনেক খেয়াল রাখবো।”
–“আচ্ছা। নৈরার ভাই আর তার মেয়ের ও একটু খেয়াল রাখলে নৈরা কিন্তু খুব খুশি হতো।”
–“আচ্ছা রাখবো।”
–“তবে আমায় একটু রান্না করে খাওয়ান।”, নোমান আবদার করে বলল। সাধনা মুখ ছোট করে নেয়। রান্না তো সে তেমন পারে না। রাঁধতে গেলে কিছু মনেই পড়ে না তার। তবুও সে রাজি হলো। নৈরা খুশি হবে বলে কথা! নোমান তাকে নিয়ে রান্নাঘরে গেলো। এতো বছরে সে স্ত্রীর হাতের কোন রান্না খায়নি। সেই রান্না করে। রান্না করে ব্যবসা সামলায়, ছেলে মেয়েকে সামলায়। সামলায় স্ত্রীকেও। সাধনা আধা ঘন্টা বসে একটা ডিম পোঁচ করতে সফল হলো তাও তেল ছাড়া। ডিম পোঁচ করতে যে তেল দিতে হয় তাই তার মাথায় নেই। নোমান হাসিমুখে খেলো ভাঙাচোরা ডিমটি।খেয়ে বলল, দারুণ হয়েছে। সাধনা খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। নোমান প্রসন্ন স্ত্রীকে কোলে তুলে নিয়ে ঘরে এলো আবার। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। রোজকার মতো বুকে জড়িয়ে নিয়ে একটাই আবদার করে,
–“সাধনা আগের মতো সুস্থ হয়ে যান না!”
সাধনা তীব্র প্রতিবাদ করে বলল,
–“আমি তো সুস্থ’ই।”
পরিশিষ্টঃ
এক ধূলোমাখা কাঞ্চনবেলায় নৈরা চঞ্চল পায়ে ছুটতে ছুটতে কুঞ্জ ভবনের গেট থেকে বের হয়। চোখেমুখে তার আনন্দ। তার অর্ডারকৃত উপন্যাসের বইগুলো এসেছে। প্রেমের উপন্যাস এগুলো। তার প্রেম বিষয়ক আগ্রহ না থাকলেও পড়তে খুব ভালোলাগে। অন্যের ভালোবাসা দেখতে, শুনতে পড়তে তার ভালোলাগে। সে অনেক আগ্রহী বইগুলোর জন্য। বই এর পার্সেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ডেলিভারি ম্যান গেটের সামনে বসে আরামসে সিগারেট ফুঁকছে। সেটি দেখতেই নৈরা চোখ মুখ কুঁচকে নিলো। মুখে ওড়না চেপে লম্বা লম্বা কদমে এগিয়ে গিয়ে খানিক ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
–“যারা সিগারেট খায় তারা ভালো মানুষ হয় না। আপনি সিগারেট খেতে খেতে বই ডেলিভারী দিতে এসেছেন কেনো?”
ডেলিভারী ম্যান বিরক্ত হলো অযাচিত হস্তক্ষেপে। সে সিগারেট খেয়ে বই ডেলিভারি দেবে নাকি কি করবে তার কৈফিয়ত কেনো দেবে? কিন্তু এই একই কথা আরো একজনের গায়ে লাগলো। অদূরে চায়ের দোকানে ফর্মাল বেশভূষায় দাঁড়িয়ে থাকা স্বরূপ অস্থির চিত্তে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছিলো। কিন্তু কারোর এহেন কু মন্তব্যে তার কপাল কুঁচকে গেলো। সে মুখ বিকৃত করে এক পলক নিজের সিগারেটের দিকে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল,
–“যারা সিগারেট খায় তারা খারাপ মানুষ? তারমানে আমিও খারাপ? কি অদ্ভুত বোকা কথা!”
সিগারেট টি ঠোঁটে চেপেই ফিরে তাকায় মন্তব্যকারীর দিকে। দৃষ্টি গিয়ে আটকায় সাদামাটা আপাদমস্তক একটা সাদা ফ্রক পায়জামা আর ওড়নায় আবৃত এক নারী অবয়বের দিকে। সাদা ওড়নার দ্বারা একহাতে চেপে রেখেছে নাক মুখ। শুধু স্বচ্ছ টলটলে নয়নদ্বয় দেখা যাচ্ছে। যেখানে সিগারেটের প্রতি ভরপুর ঘৃণা স্পষ্ট! দৃষ্টি অযথাই স্থির হয়ে আসে স্বরূপের। খুব আগ্রহ জাগলো ঐ স্বচ্ছ টলটলে আঁখিদ্বয়ের পূর্ণ অবয়ব দেখার। সে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতেই নিগুঢ় চোখে তাকিয়ে রইল।
তবে স্বরূপকে অপেক্ষা করতে হলো না। মেয়েটি সবেগে মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে ফেললো। কাঞ্চনবেলার সেই সোনালী আলোয় মেয়েটির শুভ্র মুখ থেকে গড়িয়ে পড়া ঘামগুলো দেখতে লাগছে ঠিক বরফ গলা পানির মতো! এক টুকরো বরফ রোদের আলোয় গলে গলে পড়ছে। আনমনে হাসলো স্বরূপ! সিগারেটটি তখনো তার হাতে অযথা জ্বলছে। স্বরূপ দেখলো কপাল বেয়ে সারসের ন্যায় গলদেশে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়া শ্বেদজল গুলো।
নৈরা মুখের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে বইগুলো ছিনিয়ে নিয়ে বলল,
–“নেহাৎ ই পছন্দের বই। নয়তো আপনার মতো খারাপ মানুষের কাছ থেকে আমি কখনো বই নিতাম না। আর কখনো আপনি আমায় বই ডেলিভারি দিতে আসবেন না।”
–“আমারো কোন ইচ্ছা নাই।”, ডেলিভারি ম্যান রেগে বলল। নৈরা কপাল কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে তাকায় তার দিকে। সে ওড়নায় ঘাম মুছে একবার চারি পাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলতে লাগলো। মেয়েটিকে নিগুঢ় চোখে দেখতে দেখতেই হঠাৎ স্বরূপ ধ্যানচ্যূত হলো মেয়েটিকে এদিকে তাকাতে দেখে। অজনা কারণেই তার মনে হলো, মেয়েটি যদি তাকে সিগারেট হাতে দেখে ফেলে তবে মস্তবড় পাপ হয়ে যাবে। পুরুষ মন নারী দেখলে ন্যানো সেকেন্ডের মাঝে নিজের রূপ বদলে নেয়। হাহ্ ! দিনশেষে স্বরূপ ও পুরুষ! তার সংযত মন ও তার অনুমতিবিহীন নিজের রূপ বদলে নিলো। নৈরা এদিকে তাকাতে তাকাতেই স্বরূপ দ্রুত সিগারেটটা পায়ে পিষে ফেলে পিছু ঘুরে গেলো। নাক দিয়ে তখনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। নৈরা কপাল কুঁচকে চারিপাশ অবলোকন করে আবার গেটের ভেতর ঢুকে গেলো।
স্বরূপ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেয়েটির গমনের পথে। মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বলে,
–“কাঞ্চনবালা! বোকা কাঞ্চনবালা!”
সব সিগারেট খাওয়া মানুষ গুলো যে খারাপ হয় না। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ স্বরূপ ইব্রাহীম। সে নিজের চিন্তা কমায় এই ধুম্রপানের দ্বারা। সে নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চা ওয়ালার দোকানে ঢুকলো। বিল দিতে দিতে শুধায়,
–“চাচা, ঐ যে গেটের কছে একটা মেয়ে বের হয়েছিল না? সে কে?”
চা ওয়ালা কিয়ৎকাল তাকিয়ে বলল,
–“কে নৈরা?”
স্বরূপ কপাল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
–“নৈরা?”
–“হুম, ওটা নৈরা। নুহাশ মাহমুদের ছোট মেয়ে।”
নুহাশ মাহমুদের মেয়ে? এতো সাদাসিধে? একটা সুতির পোশাক পড়া যেমনটা তার আপা পড়ে। সেদিন অবাক হয়েছিল স্বরূপ। তবে অনর্থ যে ঘটে গিয়েছে ততক্ষণে। পুরুষালী মন যে তার রূপ বদলে নিয়েছে। এরপর ঐ রাস্তা থেকে যাওয়া আসার সময় সর্বদা চোখ যাবে ঐ বাড়িটির দিকে। যদি ভাগ্যক্রমে দেখা মিলে কাঞ্চনবালার! সেই সর্বদা শব্দটি একদিন অভ্যাসে পরিণত হলো। সিগারেটের বদলে কাউকে দেখতে পাওয়াই স্বরূপের চিন্তা দূরীকরণের জন্য যথেষ্ট ছিল। ভাগ্য প্রতিদিন স্বরূপের সহায় হতো! মেয়েটির ঘর বোধহয় ঐ বারান্দাটুকুই। সারাদিন বই হাতে ওখানেই পড়ে থাকে। রোজ ব্যাংক শেষে স্বরূপ বাড়ি ফেরার পথে তার দেখা পেতো! রাতেও চায়ের দোকানে চা খাওয়ার বাহানায় পুরো এক ঘন্টা মেয়েটির সৌন্দর্য চোখ মুদে নিতো!
গল্পটা সেখানেই শুরু হয়। এরপর গল্পের গভীরতা বাড়তে লাগলো। সেদিন প্রথম সামনাসামনি দেখা হলো কাঞ্চনবালার সাথে। আমি এমন ভাব করলাম যেনো অচেনা এক মেয়ে! তবে দিন গড়াতেই মেয়েটি আমায় চমকে দিতে লাগলো। আমি যাকে এক নজর দেখতে যেতাম সেও নাকি দুই বছর যাবৎ আমায় এক নজর দেখার জন্য তরপায়। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ সেদিন নিজেকে মনে হলো। ধীরস্থির গোটা পরিবেশ প্রেমময় হয়ে উঠলো। চা ওয়ালীর ঐ এক কাপ চা, রিকশা ওয়ালার মুচকি হাসি, সন্ধ্যা বাজারের সবজির বিক্রেতাদের স্যার ম্যাডাম সম্বোধন সহ পুরো ব্রক্ষ্মান্ড প্রেমের বুনন বুনতে লাগলো। একদিন সেই বুননের তাল কেটে গেলো। প্রেম আমার জন্য সামার্থ্যের উর্ধ্বে গিয়ে ধরা দিলো। সে আমার কাছে একটা বেনারসী চাইলো কিন্তু আমি তাকে অশ্রু দিলাম। গল্পটা ওখানেই থমকায়। জানিনা তার আবদার পূরণ করতে পারবো কি-না! তবে তাকে এতো টুকু স্বস্তি তো দিতে পারি— যে তার স্বরূপ তার কাঞ্চনবালা ব্যতীত কখনো কোন নারীর সান্নিধ্যে যাবে না।
চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়তেই ডায়রিটা বন্ধ করলো নোমান। আলতো হাতে লুকিয়ে ফেলে অশ্রু গুলো। এটা স্বরূপের ডায়রি। সে সামলে রেখেছে স্বরূপের ডায়রি, নৈরার বেনারসী! বুক জুড়ে শুধু একটাই আক্ষেপ, নুরু কেনো তার ভাইজানের উপর একটু বিশ্বাস রাখলো না। তবে পৃথিবীটা আজ সহজ হতো, সুখী হতো।
কোলের মাঝে থাকা দেহটি নড়েচড়ে উঠতেই নোমান দৃষ্টি নামায়। বারান্দায় ম্যাট্রিসে , দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে সে। আর কোলের মাঝে শুয়ে আছে জ্বরগ্রস্থ বিভোর। শক্তিসামর্থ্যবান গম্ভীর এই ছেলেটার লুকায়িত নম্র সত্ত্বা শুধু জ্বর হলেই বেরিয়ে আসে। এই যে আজ জ্বর হয়ে বাবার গায়ের সাথে লেপ্টে বসে আছে। কোমড় জড়িয়ে বাবার কোলে শুয়ে থাকা বিভোর জড়ানো কণ্ঠে ডেকে ওঠে,
–“পাপা?”
নোমান মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
–“এই তো পাপা, বলো।”
বিভোর মাথা তুলে তাকায় বাবার মুখপানে। লাল হয়ে আছে চোখদুটো। নোমান খানিক চিন্তিত কণ্ঠে শুধায়,
–“খারাপ লাগছে আব্বু? ডাক্তারকে আবার ডাকবো?”
বিভোর না বোধক মাথা নাড়লো। নিভু নিভু চোখে চেয়ে অসম্ভব এক আবদার করে বলল,
–“মামুকে এনে দাও না পাপা। কতোদিন হলো তার বুকে ঘুমাই না, তার হাতে খাই না, তার সাথে ক্রিকেট খেলি না।”
সেই অসহায়ত্ব! কেনো পিছু ছাড়ে না নোমানের? সবাই তাকে কঠিন পরিস্থিতিতে একা ফেলে চলে গিয়েছে। বাবার অসহায়ত্বে জ্বরগ্রস্থ বিভোর মলিন মুখে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। নোমান অদূরে রুমের ভেতর তাকায়। মেরুন রঙা ফ্রক আর পায়জামা পরিহিতা সাধনার বুকের সাথে লেপ্টে আছে বিভা। মা মেয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমাচ্ছে। আজ কোন এক অজনা কারণে তাদের মধ্যে ভাব হয়েছে। খুব ভাব! একে অপরের পিছ ছাড়ছেই না দু’জনে । সকাল থেকে দু’জনে ঘাপটি মেরে ছিল এই ঘরে। কোন চিৎকার চেঁচামেচি হয়নি। নোমান অবাক হলেও খুশি হয়েছে। দেখতে দেখতেই দেখলো বিভা ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে। বিভার নড়াচড়ায় সাধনার ও ঘুম ভেঙে গিয়েছে। বিভার অভ্যাস ঘুম থেকে উঠেই বাবার আদর খাওয়ার। তাই সে অভ্যাস মাফিক বাবার কাছে চলে গেলো। সাধনার এতে বেশ রাগ হলো! বিভা তো তার নতুন বন্ধু। তবে ও ঐ অসভ্য লোকের কাছে গেল কেনো? সে রাগে গজগজ করতে করতে পুতুল নিয়ে খেলতে বসলো।
বিভা সোজা এসে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বসলো। নোমান মেয়ের আদরের ক্রেভিংস টুকু মেটালো। একহাতে অনবরত ছেলের মাথায় হাত বুলাচ্ছে অন্য হাতে মেয়েকে আঁকড়ে ধরে আছে। সাধনা পুতুল খেলতে খেলতে সেটা আড়চোখে দেখলো। দেখে রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
–“সবাইকে শুধু আদর করে আর আমায় শুধু বকে, রাগ দেখায়। আসিস আবার অসভ্যতামি করতে, খামচে তোর পিঠের ছাল তুলে ফেলবো।”
নোমান শুনলো। কপাল কুঁচকে থমথমে মুখে বলল,
–“আবার তুই তোকারি করছেন?”
সাধনা রাগে ফেটে পড়লো। চেঁচিয়ে বলল,
–“একশোবার করবো। তুই তুই তুই!”
সাধনার জেদি কণ্ঠে নোমান কঠোর দৃষ্টিতে তাকায়। সাধনা মুখ বাঁকিয়ে আবার পুতুল নিয়ে খেলতে লাগলো আর তাদের আহ্লাদ দেখছে। নোমান কিছুক্ষণ বাদে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“মা তোমার মাম্মাকে বলো, আদর চাইলে ভদ্র মেয়েদের মতো এখানে আসতে। চিংড়ি মাছের মতো লাফালাফি আর গন্ডারের মতো চিৎকার করলে আসতে বারণ করো।”
বাবার কথায় বিভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। সাধনা রাগে দুঃখে টলটলে নয়নে তাকায় তেজি গলায় বলে,
–“তুই আসিস আমার কাছে, তোর ঠ্যাং ভেঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। অসভ্য! আমি চিংড়ি মাছ? গন্ডার?”
সাধনা মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে শুধায়। নোমান থমকায় সেই পুরোনো হুমকি শুনতেই। নির্জীব হয়ে পড়ে তার অন্তঃস্থল। বহু সাইকায়াট্রিস্ট, ডাক্তার দেখিয়ে নিরাশা হলেও সে এখনো আশা রাখে সাধনা সুস্থ হবে। কোলের মাঝে ধপ করে কেউ শুয়ে পড়তেই নোমান কোলের দিকে তাকায়। বুব্বোকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাধনা শুয়ে আছে তার পায়ের উপর।
মা ছেলে দুই পায়ের উপর শুয়ে আধিপত্য বিস্তারে মগ্ন আর মেয়ে বুকে। এই তো কঠিন পৃথিবীতেও সৃষ্টিকর্তা বাঁচার জন্য সহজ মিষ্টি কিছু উপহার দেয়। সেও বাঁচবে এই তিনজনের জন্য!
তিনজনের মাঝে আদর বন্টন করতে করতেই নোমান আবারো উদাসীন সয়ে পড়ে কাঞ্চনবেলার সোনালী কিরণ দেখে। এই সোনালী আলো আজ কতোটা মলিন লাগছে। কাঞ্চনবেলার শেষটা যদি এতোই বিদঘুটেময় হওয়ার ছিল তবে প্রারাম্ভটা কেনো এতো মনোমুগ্ধকর ছিল? দালানের সামনা বরাবর জারুল গাছটার উপর সোনালী মিঠা রোদ দেখতে দেখতেই নোমান বিড়বিড় করে বলে,
–“কেমন হতো যদি সবটা স্বপ্ন হতো!”
______________________সমাপ্ত________________