কাননবালা পর্ব-১৬+১৭

0
644

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৬

ধূসররঙের কোট মেরুন রঙের ফুল স্লিভ শার্ট আর কালো প্যান্টে সজ্জিত অভীক।শুভ্র মুখশ্রীতে স্ট্রিম করা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি!ঘন চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা।গভীর চোখ দুটিতে বুদ্ধির ঝিলিক!ঠোঁটের ভাঁজে একরাশ কঠোরতা নিয়ে অভীক লম্বা লম্বা পা ফেলে অফিসে প্রবেশ করে।
নীতুর মনে হলো তার ভ্রম হচ্ছে। চোখের সামনে অভীকের অবয়ব তার উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি! ইনি কি সত্যিই অভীক?
নীতু ধপ করে চেয়ারে বসে পরে।পাশে দাঁড়ানো রিপার হাত খপ করে চেপে ধরে।রিপা তখনও অভীককে হা করে গিলছে।বেহুশের মত! নীতু বিরক্ত হয়ে রিপাকে ধাক্কা দেয়।রিপার সম্বিত ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞেস করে, “এই মাত্র কে আসলো?”
রিপা সম্মোহনী কন্ঠে বলে,”আমাদের অফিসের একমাত্র রাফ এন্ড টাফ স্যার!তাশরীফ অভীক!”
নীতুর চোখ মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।দুদিন আগেও যে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছে আজ তাকে দেখে নীতুর শরীর মন দুটোই অস্তিত্বে আছন্ন হলো।সেদিন কি ভেবেছিল এই অভীককেই চোখের সামনে দেখতে হবে সারাটাদিন। নীতুর মাথা চক্রাকারে ভনভন করে ঘুরতে লাগলে।নীতু যতোই নিজেকে কঠোর বলে প্রেজেন্ট করুক,আদতে তো সেটা সত্যি না!কঠিন আবরুর আড়ালে নীতু এখনও সেই শান্ত ধীর মেয়েটি! যে পুরুষটা তাকে অযোগ্য বলে রিজেক্ট করেছে তার সামনে কিভাবে সারাক্ষণ স্বাভাবিক থাকবে?ভেবে পায় না নীতু।
এই অভাবের বাজারে নতুন একটা চাকরি পাওয়া যে কতটা কঠিন তা নীতুর থেকে ভালো আর কে জানে?
একরাশ চিন্তায় নীতুর মুখ অন্ধকার হয়ে আসে!

***-***—***
তাজ ব্যস্ত হাতে নিজের আলমিরা ঘাটছে।চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে আছে।অফিস থেকে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ ফাইলটা তাজ প্রথম ড্রয়ারে রেখেছিল তার স্পষ্ট মনে আছে।অথচ এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাজ গুছানো প্রকৃতির মানুষ। সবকিছুই তার গুছানো থাকে।অথচ আজ তার ব্যবহৃত এক একটা জিনিস এক একেক জায়গায়।
সেতু বারান্দায় বসে হাত পায়ের নখ কাঁটছে।তাজের এই খোঁজাখুঁজি পর্ব দেখেও সেতু নড়লো না। সেতু চায় এই ছুতোয় অন্তত তাজ তার সাথে কথা বলুক।একটু কথা বলায় তো আর দোষ নেই!
তাজ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। অফিসের লেইট হয়ে যাচ্ছে! বারান্দার কাছে এসে কপালে বিরক্তির ভাঁজ ফেলে বলে,”সেতু ফাইলটা কোথায়?”

সেতু একবার ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে আবার নখ কাটতে মনোযোগ দেয়।ওই উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ মুখটির দিকে সেতু বেশিক্ষণ তাকাতে পারেনা। তাহলেই ভীষণ প্রেম পায় তার!নিজের এই দূর্বিষহ অবস্থায় সেতু নিজেই বিরক্ত।

“আপনার ফাইল কোথায় তা আমি জানবো কি করে?”

তাজ কোমড়ে দু’হাত রেখে বলে,”প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করবে না সেতু।এ ঘরে তুমি ছাড়া আর কে থাকে?আমার জিনিস তুমি ছাড়া কে ধরেছে?তাড়াতাড়ি বলো। ”

সেতু কন্ঠে একরাশ উদাসীনতা নিয়ে বলে,”একঘরে থাকলেই বুঝি সব ছোঁয়া যায়?সব জানা যায়?”
সেতু পরক্ষণেই মনে মনে বলে,”কই আপনাকে তো আমি ছুঁয়ে দিতে পারলাম না?আর আপনার মন? সে তো সেতুর নাগালের বাইরে! ”

“একদম হেয়ালি করবে না সেতু।আমার গুরুত্বপূর্ণ একটা ফাইল।অফিসে যেতে পারবো না ফাইলটা না পেলে।সকাল থেকেই দেখছি আমার ব্রাশ বাথরুমের বদলে ড্রেসিং টেবিলে,আয়রন করা শার্ট এলোমেলো,তোয়ালেটা ভেজা,আলমিরার সবকিছু একেকটা একেক জায়গায়। এসবের কারণ কি?”

সেতু কিচ্ছু বললো না।পায়ের নখ যত্ন সহকারে কাটতে শুরু করলো।তাজ কতক্ষণ সেতুর দিকে তাকিয়ে থেকে রুমে ফিরে অফিসের জন্য রেডি হতে শুরু করলো। শার্টে বোতাম লাগাতে লাগাতেই তাজ দেখতে পেলো সেতু এলোমেলো পায়ে আলমিরার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।কাপড়ের স্তূপের মধ্যে থেকে সবুজ ফাইলটা বের করে বিছানায় রেখে চুপচাপ রুম ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো সেতু। তাজ গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।দিনকে দিন সেতু অধৈর্য হয়ে পড়ছে আর তাজ বিরক্ত! এভাবে একটা সম্পর্ক কি বয়ে নেয়া যায়?

**************

অভীক নীতুকে অফিসে দেখে কেন জানি অবাক হলো না।ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখা দেখা দিল কেবল।হসপিটালে নীতুকে দেখে যেমন দমবন্ধকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল এখন সেরকম লাগলো না বরং কোথাও যেন একটা স্বস্তির আমেজ দেখা গেলো।
নীতুকে অভীক ডেকে পাঠিয়েছে তার কেবিনে।শুনেই নীতুর হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।নীতুর কিছুতেই অভীকের মুখোমুখি হতে মনে চাইছে না। পলাশ এসে তাগাদা দিয়ে বললো,”নীতু তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো কেন?নতুন সব এমপ্লয়িয়ের সাথে অভীক স্যারের দেখা হয়েছে কেবল তুমি বাকি।যাও তাড়াতাড়ি যাও।অভীক স্যার মোটেও গাফলতি পছন্দ করেন না।”
নীতু বারকয়েক দম ফেলে নিজেকে আস্বস্ত করলো।এত ভয় পাওয়ার কি আছে?বলে নিজেকে শাসালো।মাথা সোজা করে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার বৃথা চেষ্টা করলো। এরপরই অভীকের কেবিনে নক করে বললো,” মে আই কাম ইন স্যার?”

অভীক নতুনদের গ্রুমিং ফাইল দেখছিলো। দরজার দিকে একপলক তাকিয়ে কাম ইন বলে আবার ফাইলে মনোযোগ দিলো। সেই একপলকেই অভীকের নীতুকে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে গেলো।বড় নেকের ব্লাউজ, বাঙ্গি রঙের শাড়ি। ঘাড়ে এলানো হাত খোঁপা।হাতে চিকন বেল্টের ঘড়ি আর কাকচক্ষু জলের গভীর চোখ দুটিতে কাজল দিয়ে সজ্জিত নীতু।
পারমিশন নিয়ে নীতু চেয়ারে বসে পড়লো।
অভীক সরাসরি নীতুর দিকে তাকিয়ে বললো,”কি নাম আপনার?”
নীতু অবাক চোখে তাকালো অভীকের প্রশ্নে।নাম জানা স্বত্বেও কেন জিজ্ঞেস করলো নীতু বুঝতে পারলো না।
“আফসানা নীতু।”
অভীক টেবিলের উপরে রাখা ফাইলের ভিতর থেকে একটা ফাইল বের করলো।নীতু বুঝতে পারলো ফাইলটা তারই।এসি রুমের মধ্যে বসেও নীতু নার্ভাসনেসের কারণে ঘামতে শুরু করলো।নাকের ডগায় মুক্তোর মত বিন্দু বিন্দু ঘাম চকচক করছে। অভীক ভ্রু কুঁচকে একবার নীতুর দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো। রুম জুড়ে পিনপন নিরবতা। পুরোটাসময় নীতু অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইলো। একটাসময়ে অভীকের ফাইল দেখা শেষ হলো।চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে নীতুর দিকে সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,”মিস নীতু আপনি দেখছি রিকোয়েস্ট ক্যান্ডিডেট।আমার জানা মতে সুপারিশ তার জন্যই করা হয় যে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসে ভুগে।আমি কি ঠিক বলছি মিস নীতু?”

অভীকের কথায় নীতু একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি নত করে ফেললো। নীতুর চোখ স্পষ্ট দেখেছে অভীকের ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি।মি.অভীক কি নীতুকে বিদ্রুপ বা কটাক্ষ করে হাসলো?নীতু তা বুঝতে পারলো না।কেবল মনের মধ্যে খুঁত খুঁত করতে লাগলো। নীতুর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আসলো।
অভীক ফের বললো,”মিস নীতু আপনি দৃষ্টি নত করে কেন রেখছেন?কারো সম্মুখে চোখের দৃষ্টি তারাই নত করে যারা কোন অন্যায় করে থাকে বা কোন বিষয়ে লজ্জা পেলে।আপনি কি সেরকম কিছু করেছেন?”

নীতু বহুকষ্টে ভার হয়ে আসা কন্ঠে বললো,”না!”

“গুড।এখন থেকে আমার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। মনে থাকবে?”

“অবশ্যই স্যার!”
গ্লাসে ঢেকে রাখা পানি অভীক নিঃশব্দে ঠেলে নীতুর দিকে এগিয়ে দেয়। নীতু প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে।
অভীক বলে ওঠে, “আপনার দরকার মিস নীতু।”
নীতু গ্লাসে চুমুক দিয়ে নিজের শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজিয়ে নেয়।কপালে ছড়িয়ে পরা ক’গাছি অবাধ্য চুল কানের পাশে গুজে নেয়।সবকিছুই অভীক পর্যোবেক্ষণ করে। এরপর টেলিফোন কানে তুলে বলে,”পলাশ আমার কেবিনে আসো।”
কিছুক্ষণ পরই পলাশ অনুমতি নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে।
অভীক পলাশের দিকে তাকিয়ে বলে,”পলাশ আমি জানি তুমি তোমার কাজে খুবই দায়িত্বশীল। কিন্তু মাঝে মাঝে তোমার মধ্যে সফট কর্ণার কাজ করে, কেন?এটা যে কোম্পানির জন্য হুমকি স্বরুপ তা অবশ্যই তুমি জানো?”

পলাশ কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলে,”কোন ভুল হয়েছে স্যার?”

অভীক নীতুর দিকে একবার তাকিয়ে আবার পলাশের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,”একজন অভিজ্ঞতাহীন এমপ্লয়ির কাজে তুমি কি করে জব পারফরম্যান্স এইটটি পার্সেন্ট রাখো?তোমার কি সত্যিই মনে হয় মিস নীতুর পারফর্ম এতটা ভালো?”
পলাশ আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিলে অভীক কথা থামিয়ে দিয়ে বলে,”আমার তো মনে হয় মিস নীতুর ওয়ার্ক পারফরম্যান্স বুঝে তাকে ফিফটিতে ফেলা যায়!”

“মিস নীতু আপনাকে বলছি। কি কারণে পলাশ আপনাকে এতটা ফেবার করলো আমি জানি না।তবে আমি এরপর অবশ্যই দেখবো আপনার কাজ। যদি কোন ভুল পাই তবে আপনার পূর্বে আপনার মেন্টরকে আমার কাছে যথাপোযুক্ত জবাবদিহী করতে হবে।এবার আপনারা দুজনেই আসুন!”

নীতু এলোমেলো পা ফেলে কেবিন থেকে বের হয়। চোখের দৃষ্টি বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে কোন ঝড়ের সামনে থেকে বেঁচে ফিরেছে। পলাশ আস্বস্ত ভঙ্গিতে বলে,”নীতু তুমি কিছু মনে করো না।অভীক স্যার কাজের বেলা খুবই কঠোর হলেও তিনি মানুষটা চমৎকার! ”
নীতু পলাশের কথায় ফ্যাকাশে হাসলো।ধীর পায়ে নিজের ডেস্কে ফিরে গেলো।
নীতু চলে যেতেই অভীক গলা ছেড়ে হো হো করে হেসে দিলো।নীতুর ভেজা বেড়াল মুখটা এত স্নিগ্ধ লাগছিল। অভীকের ইচ্ছে করছিল নীতুর গাল টেনে বলতে,”এই মেয়ে এত ভয় পাচ্ছা কেন?আমি কি বাঘ নাকি ভালুক? আমি তো তাশরীফ অভীক!”
অভীক আবার হেসে উঠলো।পরক্ষণেই হাসি মুছে গিয়ে অভীকের শরীরে জুড়ে আলাদা শিহরণ বয়ে গেলো।চোখের সামনে ভেসে উঠলো, নীতুর নাকের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা মুক্তোর মত ঘামের বিন্দু!কাকচক্ষু জলের পদ্মদিঘির মত অবাক করা ভীষণ সুন্দর দুটি চোখ।
অভীক মুহুর্তেই চোখ বন্ধ করে ফেললো!তার সাথে এসব কি হচ্ছে ভেবে পেল না!

নীতু অভীকের আচরণে এতটুকু বুঝতে পারলো।মি.অভীক পারসোনাল লাইফে আর প্রোফেশনাল লাইফে একই ব্যক্তির আলাদা সত্তা! নীতু কেন যেন অভীকের এই আচরণে মুগ্ধ হলো।অফিসে কাজ করা কঠিন হবে না ভেবে নিশ্চিন্ত হলো।

চলবে,

#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ১৭

সুরভি বেসিনে শব্দ করে থালাবাসন মাজতাছে।মুখে অনবরত গজগজ করে চলছে।নিখিল আজ অফিসে যায়নি।শরীরটা ভালো না। থালাবাসনের শব্দে টিভি থেকে মনোযোগ সরিয়ে কিচেনে এসে জিজ্ঞেস করে,”আহা!সুরভি কি করছো?এত আওয়াজ করে কেউ কাজ করে?”
সুরভি আগুন চোখে স্বামীর দিকে তাকায়। রাগে শরীর জ্বলে পুড়ে যায়।সুরভি তেজ নিয়ে বলে,”বান্দির মত কাজও করবো আবার তোদের কথাও শুনবো।কেন? কিসের এত ঠেকা আমার?”
নিখিল ঠান্ডা স্বভাবের মানুষ কিন্তু ঠান্ডা মানুষই যখন রাগ করে তারা ভয়ানক হয়ে যায়।তাই কিছুটা গলা চড়িয়ে বলে,”মুখ সামলে কথা বলো সুরভি।তুই তোকারি করবে না।বাসায় দুজন বয়স্ক মানুষ অসুস্থ। আর তুমি এরকম বিহেভ করছো।এই সংসার তোমার নয়? নিজের কাজ করাকে বান্দি বলে?”
বোবার মুখে বুলি ফুটতে দেখে সুরভি কোমড়ে আচল পেচিয়ে বলে,”এই সংসার মোটেও আমার নয়।ঘাড়ের উপর কেউ না কেউ থাকে।তাদের কাজ আমি কেন করবো?”
নিখিল ভীষণ আহত হলো।সুরভির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।বুঝতে পারলো অনেক আগেই হাত থেকে রশি ফসকে গেছে এখন আর লাগাম ধরে কাজ নেই!
“আমার বাবা মা তোমার কাছে বোঝা?মা দুদিন ধরে অসুস্থ নতুবা সেই তো করে সব কাজ।দুদিনেই তুমি হাঁপিয়ে উঠছো?বাবা মাকে তুমি বাড়তি মানুষ বলে বিবেচনা করছো?”

“করছি।সব অসুখের বাহানা।তোমার শয়তানি বোনদের কানপড়া! একেকটা ডাইনি…আগে ঘরে থেকে জ্বালাইত এখন দূরে গিয়ে জ্বালায়।”

তরকারি পোড়ার গন্ধ নাকে লাগতেই নিখিল গ্যাসের চুলাটা অফ করে দেয়।তারপর বলে,”আমার বোনদের নিয়ে কোন বাজে কথা বলবেনা।ওরা তোমার মত কুৎসিত মনের না।”

সুরভির মনে হলো তার শরীরে কেউ ফুটন্ত তেল ঢেলে দিয়েছে।প্রচন্ড শব্দে হাতে থাকা আধোয়া কাচের প্লেট ফ্লোরে ছুড়ে মেরে বলে,”থাক তুই তোর মা বোন নিয়ে। এই সংসারে আর এক মুহুর্ত থাকবো না।”

“আমার পরিবারের সাথে যদি থাকতে না পারো তবে তোমার চলে যাওয়াই ভালো।”

সুরভি থপথপ পা ফেলে নিজের রুমে চলে গেলো। ছেলে আর ছেলে বউয়ের সব কথা কানে গেলেও এতক্ষণ রুম থেকে বের হননি মহিমা বেগম।এবার জ্বর শরীর নিয়ে উঠে পড়লেন।ছেলেকে নতুন করে সবজি কাটতে দেখে বললেন,”নিখিল বউমার কাছে যা।আমি রান্না করছি।”

“মা সাবধানে পা ফেলো কাচের টুকরা ফ্লোরে।পা কেটে যাবে।তুমি ঘরে যাও। রান্নাঘর পরিষ্কার করে আমিই রান্না করবো।”

সুরভিকে এক কাপড়ে বের হয়ে যেতে দেখে মহিমা বেগম আৎকে উঠে বললেন,”নিখিল সুরভিকে আটকা।ওকে যেতে দিস না।রাগ করেছে মেয়েটা।যা বাবা!”

নিখির নড়লো না একচুল।সবজি কাটা রেখে ঝাড়ু হাতে ফ্লোরের কাচ উঠাতে শুরু করলো।মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলো,”মা অসুস্থ শরীরে দাঁড়িয়ে থেকো না।যে যাবার সে যাবেই।এরকম করে আর কত?আমারই ভুল ছিল।চুপচাপ সব মেনে নিয়েছি।এবার সুরভিকে বেছে নিতে দাও ওর সঠিক স্থানটা!”

মহিমা বেগম ভারাক্রান্ত মন নিয়েই ধীর পায়ে রুমে ফিরলেন।
চকচকে কাঁচের টুকরোর পাশে এক ফোঁটা চোখের জল এসে পড়লো নিখিলের।নিখিল সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো!জটিলতা নিখিল পছন্দ করে না।এতদিনের চুপ থাকার মানে এই না যে নিখিল নির্বোধ!সুরভিকে যদি ফিরতেই হয় এবার সরল মনেই ফিরতে হবে! নীতুর সাথে সেতুর সাথে যা তা ব্যবহার মেনে নিলেও মা বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার কিছুতেই নিখিল মেনে নিবে না।

*************
নীতু নিজের ডেস্কে বসে কাজ করছিল। হটাৎই পলাশ এসে নীতুর সামনে বসে একগাল হাসি দিলো।নীতুও প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো পলাশের দিকে তাকিয়ে। অভীক বড় স্যারের রুমের দিকে যাচ্ছিল।তখনই দেখতে পেলো নীতুর পেলব ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি।অভীক একমুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।পরক্ষণেই কাঁচের দরজা ঠেলে বড় স্যারের কেবিনে ঢুকে পড়লো। বড় স্যারের সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শেষে অভীক বিশ মিনিট পর বের হলো।তখনও দেখলো পলাশ নীতুর সাথে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছে আর নীতুও হেসে জবাব দিচ্ছে। অভীকের কেন যেন এই দৃশ্যটা পছন্দ হলো না।চোখের তারা ধিক করে জ্বলে উঠলো!
অভীক গত একটা মাসে নীতুকে খুবই ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে।মেয়েটা প্রকৃতির মত শান্ত কিন্তু চালচলনে ঝড়ের মত নিষ্ঠুরতা!কৃষ্ণবর্ণ মেয়েটির মুখশ্রীতে আত্মবিশ্বাসের দৃঢ় ছাপ! তিনবছর আগের সেই নত মস্তকে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা নীতুর সাথে আজকের নীতুর অনেক পার্থক্য!
নীতুর আচরণ অভীককে মুগ্ধ করে।নিজেকে নিজে মিথ্যে বলতে পারে না অভীক।নীতুর আচরণ তাকে সত্যিই মুগ্ধ করে।কর্মক্ষেত্রে ভীষণ মনোযোগী।এখন পর্যন্ত অভীক কোন ভুল ধরতে পারে নি।এই অফিসের সবার সাথে নীতুর ব্যবহার খুবই আন্তরিক! সবথেকে যেটা ভালো লাগে নীতু তার আপনজনদের আগলে রাখতে পছন্দ করে।এই দিকটা অভীককে মুগ্ধ করেছে।
অভীক ফোন কানে তুলে গমগমে স্বরে বলে,”মিস নীতু আমার কেবিনে আসুন।”

পলাশ গায়ে পড়া টাইপের লোক।একবার কথা বলতে শুরু করলে থামে না।এতক্ষণে পলাশের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে নীতু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।মনে মনে অভীক স্যারকে ধন্যবাদও দিয়ে ফেলে।
অনুমতি নিয়ে অভীকের কেবিনে প্রবেশ করেই নীতু থমকে যায়। অভীক চেয়ারের উপর বাম হাতে রেখে একপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সীগ্রীন কালারের শার্টের হাতাটা কনুই পর্যন্ত গুটানো।চোখে মুখে কঠোরতা।টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা তুলে অভীক তাতে চুমুক দেয়।সরু দৃষ্টি নীতুর দিকে নিবদ্ধ। হাতের ইশারায় বসতে বলে।নীতুর কেমন যেন বেক্ষাপ্পা লাগে অভীকের আচরণ। পানি পান করে টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছে একটা ফাইল হাতে তুলে নীতুর কাছে এসে দাঁড়ায় অভীক। নীতু আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বসে আছে।কেন যেন তার অভীকের সামনে এলেই এমন অদ্ভুত রকমের অস্বস্তি হয়!অভীক ফাইলটা টেবিলে উপর মেলে নীতুর পাশে দাঁড়ায় টেবিলে একহাতে ভর রেখে।নীতু এতকাছে অভীককে দেখে আরো আড়ষ্ট হয়ে পড়ে।শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের ঢল নামে! অভীকের শরীরের পারফিউমের স্মেল পাওয়া যাচ্ছে এতটা কাছে অভীক দাঁড়িয়ে আছে!
নীতু বারকয়েক চোখের পলক ফেলে বড় করে দম নেয়।সম্পূর্ণ মনোযোগ ফাইলের উপর নিবদ্ধ করে।অভীক ব্যস্ত স্বরে নীতুকে ডকুমেন্টস বুঝিয়ে দিচ্ছে। আঙুল দিয়ে প্রতিটা লাইন দেখিয়ে দিচ্ছে। নীতুর পায়ের তলা শিরশির করে ওঠে। পুরুষের হাতও এত সুন্দর হয় বুঝি?নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে।টানা দশমিনিট বুঝানোর পর অভীক নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি বুঝতে পেরেছেন নীতু?আমার সম্পূর্ণ কাজই কিন্তু এমন চাই।”
নীতু প্রতিত্তোরে ঘাড় কাত করে বুঝায় সে বুঝেছে। সবটা বুঝে নিয়ে নীতু চলে যেতে নিলেই অভীক আদেশের স্বরে বলে,”এক মিনিট মিস নীতু?”
নীতু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পরে।অভীক হেটে কয়েকপা নীতুর দিকে এগিয়ে বলে,”অফিসটা কাজের স্থান।এখানে খোশগল্প করার জন্য বেতন দেয়া হয় না।একান্তই ব্যক্তিগত কোন আলোচনা করার জন্য অনেক কফিশপ আছে।কফিশপের মালিকেরও তাতে লাভ হবে আর আপনাদের হাসিঠাট্টাও হবে।বুঝতে পেরেছেন?”
নীতু কিছুই বুঝতে পারেনি।বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো কেবল।অভীক নিজের চেয়ারে বসে পড়ে বললো,”এবার আপনি আসতে পারেন!”

নীতু কিছুই বুঝতে পারলো না।বোকার মত হেটে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে ঢকঢক করে পানি পান করলো। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা ভিজিয়ে বড়সড় দম ফেললো।

নীতু চলে যেতেই অভীক ক্লান্ত ভঙ্গিতে শরীর এলিয়ে দিল চেয়ারে।তার এমন কেন লাগছে বুঝতে পারলো না।এমন তো না নীতু আগের থেকে সুন্দরী হয়ে গেছে।বাহ্যিক নীতু একইরকম আছে।কেবল শরীরের অতিরিক্ত মেদ ঝড়িয়ে ছিপছিপে লতানো দেহের অধিকারী হয়েছে।শরীরের কৃষ্ণবর্ণ রঙটা আগের থেকে কিছুটা উজ্জ্বল হয়েছে। হয়তো অতিরিক্ত যত্নের ফলেই।হাটাঁচলায় এসেছে আশ্চর্য রকমের আভিজাত্য!অভীকের হুট করে মনে হলো,নীতুর এত পরিবর্তন কার জন্য হয়েছে?কে সে? অভীকের কাছে পূর্বের নীতুই গ্রহণযোগ্য মনে হলো।যাকে সে অযোগ্য বলে একসময় আখ্যায়িত করেছিল।অভীকের পুরুষালী জহুরীর চোখ নীতুকে খুব সুক্ষ্ম ভাবে মেপে ফেলেছে।এই বদলে যাওয়া নীতু তাকে যতটা অবাক করেছে তার থেকে ঐ জড়সড় হয়ে বসে থাকা নীতুকেই অচেতন মন দেখতে চাইছে।কেন?এই প্রশ্ন কার কাছে করবে?

************
তাজ অফিস থেকে ফিরেই অফিসের পোশাকে বিছানায় শুয়ে পড়ে।সেতু তাকিয়ে দেখলো তাজকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে কিন্তু এগিয়ে এসে তাজকে জিজ্ঞেস করলো না।
তাজের মনটা আজ বড় অস্থির।রোজ নিয়ম করে একবেলা তাজের নীতুকে দেখতেই হয়।হয়তো সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নতুবা পরে। নীতুর অফিসের সামনে থেকেই চুপিচুপি দেখে চলে আসে। কখনো সামনে গিয়ে দাঁড়ায় না।সেই অধিকারও নেই।নীতুকে দেখেই তাজ বুঝতে পেরেছে এই নীতু সেই শান্ত মেয়েটি নয়।এই নীতু তার পত্যাখানের পরে পুনরায় জ্বলে ওঠা নীতু!বড়ই আরাধ্য এই নীতু!
আজ নীতুর সাথে দেখা হয়নি।তাজের অফিসে কাজের প্রেসার ছিল।পরে গিয়ে আর নীতুকে পায়নি। তাজের এই কর্মকান্ড হয়তো সমাজ সংসারের কাছে অন্যায়।কিন্তু তাজের কাছে তা মনে হয় না।যে মুখটা দেখলে বুকের ভিতর অদ্ভুত শান্তি লাগে, সেই মুখের মানুষটাকে দেখা কোন অন্যায় হতে পারে না।কখনো না!

অনেকটা সময় চোখ বুজে শুয়ে ছিল তাজ।চোখ মেলতেই সেতুকে দেখতে পেল লাগেজ গুছাচ্ছে।তাজের জানতে মনে চাইলো না কেন সেতু লাগেজ গোছাচ্ছে তবুও বলে বসলো,”কি ব্যাপার কাপড় চোপড় প্যাক করছো কেন? কোথাও যাচ্ছো নাকি?”

সেতু হতাশ হলো না।যেই মানুষটার তার থাকা আর না থাকায় কিছু যায়-আসে না। সেই মানুষটা ভুলে যেতেই পারে তার কাল বাড়ি যাওয়ার কথা পরিক্ষার জন্য! সেতু তাজের প্রশ্নের উত্তরে ত্যাড়া ভাবে বললো,”মরতে যাচ্ছি।”

তাজ টিটকারির সুরে বলে, “মরতে গেলে যে লাগেজ নিয়ে যেতে হয় তা জানতাম না তো?”

“আপনি অনেক কিছুই জানেন কিন্তু না জানার ভাব ধরে বসে থাকেন। ঠিক ভ্যাদা মাছের মত!”

তাজ আর কিচ্ছু বললো না।সেতু নিজেই মনখারাপের সুরে বললো,”আমি কাল বাড়ি যাচ্ছি আপনার কি তা সত্যিই মনে নেই।”

তাজ উদাসিন ভাবে বলে,”সরি মনে ছিল না।”

সেতুর চোখের পানি এসে গেলো।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলো তাজ না ডাকা অবধি আর ফিরবে না।

**********
জায়েদ এসেছে নীতুর সাথে দেখা করতে।লাঞ্চ টাইম চলছে।নীতু আর তাজ বসে আছে একটা রেস্তোরাঁয়। নীতুর সাথে দেখা করে জায়েদ সেতুকে নিয়ে ফিরবে খুলনা।নীতু খাবারে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“দাদাভাই, মায়ের জন্য দুটো শাড়ি আর বাবার জন্য ফতুয়া কিনে দিলাম।আর এই টাকা গুলো মায়ের হাতে দিবে।বলবে হাত খরচের টাকা।এই টাকা দিয়ে যা খুশি তা যেন মা করে।কেউ কৈফিয়ত চাইবে না।”

জায়েদ স্নেহের দৃষ্টিতে নীতুর দিকে তাকালো।নীতু লজ্জা পেলো।জায়েদ হেসে দিয়ে বললো,”আচ্ছা আর কাচুমাচু করতে হবে না।মায়ের কাছে সব পৌঁছে যাবে।”

নীতু ইতস্তত করে বললো,”দাদাভাই আর একটা কথা।”

“বল…”

“তোমার মোবাইলে আমি রিচার্জ করে দিয়েছি কিছু মনে করবে না প্লিজ! ”

“আমাকেও হাত খরচ দিচ্ছিস?ভালোই হলো এখন থেকে আর আমায় টাকা লোড করতে হবে না।সবার সাথে আর কিপ্টামি করে কথা বলতে হবে না”

নীতু হেসে ফেললো কিন্তু মনে পড়ে গেলো একটা সময় দাদাভাই হাত খরচের টাকা দিত, মোবাইল রিচার্জ করে দিয়ে বলতো,”তুই তো কিপ্টা রাণী।নিজে থেকে ফোন দিসনা। রিচার্জ করে দিলাম এবার অন্তত কল টল করিস।”

নীতু ফের বললো,”দাদাভাই মায়ের জন্য যে টাকা দিয়েছি সেখানে একহাজার টাকা তোমার।সিগারেট খরচা!”

জায়েদ খাওয়া থামিয়ে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”তুই এটা কি করলি নীতু?এমনিতেই তোর বোন সিগারেট খেতে দেয় না তারউপর তুই তাকে বিধবা বানাতে চাইছিস।তোর বোন জানলে আমাদের দুজনের গর্দান নিবে তার মাছ কাটা বটি দিয়ে। ”

নীতু আৎকে উঠে বললো,”বালাইষাট!আমার আয়ুও আল্লাহ আমার দাদাভাইকে দিক।আমি তো জানি তুমি সিগারেট ছাড়তে পারবে না।বউয়ের থেকেও তোমার সিগারেট পছন্দ।তাই দিলাম,কিছু মনে করো না।আমার দেখা শ্রেষ্ঠ দ্বিতীয় পুরুষটি তুমি।আমার দাদাভাই!”

জায়েদের গলা ধরে আসলো।কে বলে তার বোন নেই।এইতো তার সামনে বসা মেয়েটি তার বোন। তারপর বলল,
“প্রথম পুরুষটি বুঝি তোর বাবা?”

“হুম!”….. বলেই নীতু মাথা নত করে ফেললো।তার চোখে পানি এসে গেছে বাবার কথা মনে হতেই।বাবাকে কতদিন হলো দেখে না….

***********
গতকালের প্রতিজ্ঞা সেতু বেমালুম ভুলে গেলো।কমলাপুর স্টেশনে বসে শত লোকের মাঝেও কেঁদে ফেললো। সেতুর প্রচন্ড খারাপ লাগছে।তাজকে ছেড়ে যেতে মনে চাইছে।মানুষটার অবহেলাকেও ভালোবেসে ফেলেছে। স্ত্রী জাতি কি অদ্ভুত! তাজ সেতুকে উঠিয়ে দিতে এসেছে।জায়েদের সাথে দাঁড়িয়ে সৌজন্যেমূলক কথা বলছিল। সেতুর কি হলো কে জানে? ওত লোকের মাঝেই লজ্জা শরম ভুলে তাজকে জরিয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ফেললো।তাজ প্রথমে অবাক হলো তারপর বিরক্ত। সবাই তাকিয়ে দেখছে সেতুর পাগলামো।জায়েদ মৃদু হেসে লাগেজ নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লো। তাজ ধমকের সুরে বলে,” এসব কি সেতু?কি করছো?ছাড়ো।”
সেতু ছেড়ে দিলেও সরে গেলো না।তাজের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।তাজ অধৈর্য্যের সাথে বললো,
“কাঁদছো কেন সেতু?”

“আপনি খারাপ।চরম লেবেলের খারাপ। আমার চলে যাওয়াতে আপনি খুশি হয়েছেন, তাই না?”….. সেতুর কন্ঠে অনুনয় ঝড়ে পড়লো!

” তুমি ঠিক সেতু।আমি মানুষটা খুবই খারাপ।”

“আমি না ফিরলে কি আপনি খুশি হবেন?বলুন না?” ….কান্নাচোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করে সেতু।

” আমার খুশি-সুখ তুমি থাকায় বা না থাকায় বিদ্যমান না।তবে আমি চাইবো তুমি ভালো থাকো।সেটা যেখানেই থাকো না কেন?আমি কখনো নিজেকে বদলাতে পারবো না।এরকম একটা মানুষের কাছে তোমার না ফেরাই ভালো।”

“আমি আপনার কাছেই ভালো থাকবো।আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।”…. একগুঁয়ে কন্ঠে বলে সেতু।

” তোমার তো পরিক্ষা। ঠিকাছে কান্না থামাও।পরিক্ষা শেষ হলেই ফিরে এসো।”

সেতু দুই হাতে চোখের জল মুছে।তাজ একটা খাবারের দোকানের দিকে ইশারা করে বলে,”তোমার কিছু লাগবে সেতু?”

“আমার আপনাকে লাগবে।”….. ফট করে বলে বসে সেতু।কেন যেন বলতে পেরে ভালো লাগলো সেতুর।

তাজ বিরক্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়ে ত্যাঁদোড় টাইপের।কান্না থামানোর জন্য ভালো ব্যবহার করতেই আহ্লাদ করতে বসেছে।ট্রেনের হুইসাল পড়তেই তাজ ঠেলে সেতুকে ট্রেনে উঠিয়ে দেয়। ট্রেন ছেড়ে দিতেই তাজ টেক্সট করে সেতুর নম্বরে, ” আমি কোন খেলনা সামগ্রী নই সেতু।যে ফট করে চাইলেই পাওয়া যায়।কখনো কাউকে চাইতে নেই সেতু।অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আকাঙ্ক্ষার মানুষ বা বস্তু যখন শত আরাধনা করেও পাওয়া যায় না।তখন এই পৃথিবীতে স্বস্তির শ্বাস ফেলে বেঁচে থাকা কষ্টের হয়ে পড়ে।”

সেতু মেসেজটা দেখে ঠোঁট ভেঙচায়।পরক্ষণেই লিখে ফেলে,”আপনি কোন ব্রান্ডের মাল?হু?যে চাওয়া যাবে না।ওসব ব্রান্ড এই সেতু পরোয়া করে না।আপনাকে আমি শতবার চাইবো।দেখি আপনি কতবার ফিরাতে পারেন।”

মেসেজটা দেখে তাজের রাগ হওয়ার কথা কিন্তু রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেললো।

***********
জায়েদ বড় বড় চোখ করে সেতুর দিকে তাকিয়ে আছে।সেতু জানালার দিকে মুখ করে বললো,”ভাইয়া এভাবে তাকাবে না।আমার লজ্জা করছে।”

“ভরা স্টেশনে জামাইকে জড়াই ধরে ভে ভে করে কাঁদতে লজ্জা লাগেনি আর এখন লাগছে?তুই আসলেও অদ্ভুত! বড় দুলাভাইয়ের সামনে তারও দ্বিধা নেই তোর।দুদিনেই এত প্রেম।”

“নিজের সিল করা জামাই।তাকে জড়াই না ধরে কোলে বসে থাকবো তাতে কার কি?মুখ বন্ধ রাখবে ভাইয়া।এমনিতেই একমাত্র বর ফেলে চলে আসার দুঃখে আমি বিরহী।তুমি কি করে বুঝবে বর ফেলে চলে আসার কি কষ্ট?”

জায়েদ গলা ছেড়ে হো হো করে হেসে দিল।পরক্ষণেই একরাশ মায়া নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”তুই সত্যি সত্যি ভালো আছিস সেতু?”

সেতু কিছু বলতে পারলো না।জায়েদের কাঁধে মাথা রেখে হু হু করে অনবরত কাঁদতে থাকলো।

চলবে,