#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৮
তাজ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কপাল ও ঘাড় বেয়ে চিকন ঘামের ধারা নামছে!স্নায়ুযুদ্ধ চলছে অবিরত!
নীতু হাসছে কিন্তু চোখ হাসছে না মেয়েটার, আশ্চর্য! চোখের চাহনি কেমন রুঢ়!
নীতু হেসে পুনরায় বললো,”উঠছো না কেন তাজ?চলো এখান থেকে মার্কেটে তারপর সোজা কাজি অফিস!”
তাজ নিজের হাতের দিকে তাকালো। নীতু এখনো ধরে আছে হাতটা!তাজ বড়সড় দম ফেলে বললো,”কেনো হেয়ালী করছো নীতু?”
নীতু হাতটা ছেড়ে দিলো।পুনরায় চেয়ারে বসে সরাসরি তাজের চোখে চোখ রেখে বললো,”হেয়ালী?তাও আমি?”
“হ্যা করছো!এবং হেয়ালীর পাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছো আমাকে!”……..তাজ চোখে মুখে অসন্তোষ ফুটিয়ে বললো।
নীতুর মুখ থেকে এবার হাসি মুছে গেলো।চোখের দৃষ্টি কঠিন করে বললো,” আর তুমি করছোটা কি?তুমি হেয়ালী করছো না?নিজের জীবনটাকে তো তছনছ করছোই সাথে সেতুর জীবনটাও শেষ করে দিচ্ছো! ”
তাজ চোখের দৃষ্টি সরিয়ে ফেললো নীতুর মুখ থেকে। একঝাঁক অভিমান নিয়ে কাচের দেয়াল গলে বাহিরে দৃষ্টি ফেললো।
নীতু তাকিয়ে রইলো।পুরুষের অভিমানী রুপ কি ভয়ংকর সুন্দর হয় তা আজ বুঝতে পারলো!
নীতু নরম স্বরে বললো,” আমার দিকে তাকাও তাজ।”
তাজ তাকালো না। নীতু ফের বললো,”তাকাও। মুখ ঘুরিয়ে রাখলে কথা বলবো কি করে?”
তাজ তাকালো। নীতু বললো,”এভাবে চলতে পারে না তাজ।একটা সমাধানে আসা দরকার।জোর করে তো আর কিছু হয় না।তাই সমাধান হিসেবে চলো বিয়ে করে ফেলি।তাহলে অন্তত তুমি আমি ভালো থাকবো।একজন কষ্ট পাবে!”
তাজ নীতুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো কথা শুনে।বুঝতে পারলো না,এ কেমন সমাধান? হুট করেই মেঘে ঢাকা সূর্যের মত একটি মুখ মানসপটে খুব আলতো করে উঁকি দিলো।সেতু!তাজ নিজেও কিছুটা চমকালো!এটা হবার কথা নয়,তবুও হয়েছে!
নীতু মৃদু হাসলো।তাজের অস্থির দৃষ্টি দেখে!তারপর বললো,”তুমি ভালো নেই তাজ।নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো, ঠিকঠাক লাইফ লিড করছো না অথচ ভালো থাকার সমাধান হিসেবে তোমাকে বিয়ে করতে চাইলাম,কিন্তু তোমার চোখে আমি বিন্দুমাত্র খুশির ঝলকানি দেখতে পেলাম না! আশ্চর্য না?”
তাজ বিপন্ন বোধ করলো। অস্থির কন্ঠে বললো,”আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি নীতু!খুবই……বিশ্বাস করো!”
“ভালোবাসলে আমাকে এতটা বিপদে ফেলতে না তাজ।তুমি যেটা করছো তাকে ভালোবাসা বলে না!বলে জেদ দেখানো।আচ্ছা নিজ ইচ্ছায় যে এভাবে সব কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছো, গুছানোর চেষ্টা কি একটুও করেছো?এমন পাগলামো করলেই কি সব সমাধান হয় যাবে?আমি ফিরতে পারবো তোমার কাছে?আচ্ছা ধরো না হয় সব কিছু ফেলে দিয়ে তুমি আমি এক হলাম।তারপর কি?কেউ ভালো থাকবো?মাঝখানে সেতু নামটা কাঁটার মত বিঁধবে না?বিঁধবে!সবাইকে হারিয়ে তোমাকে পেলেও পুরোপুরি কি পাওয়া হবে?হবে না। তবে কেন করছো?”
“তবে কি করবো?মানিয়ে নিবো সবকিছু।হাতের পুতুল হতে বলছো নীতু।”….. …তাজের কন্ঠে আক্ষেপ।
” সমাজের কিছু নিয়ম থাকে যা কখনো অস্বীকার করা যায় না।না চাইতেও সেই শিকল পায়ে পড়তে হয়।মানিয়ে নিতে বলছি না তাজ,তোমাকে ভালো থাকতে বলছি।নিজে ভালো না থাকলে অন্যকে ভালো রাখা যায় না!সত্যটা হলো যত যাই হয়ে যাক আমি কখনোই তোমার কাছে ফিরবো না।কারো বৈধ অধিকারে কখনোই আমি হস্তক্ষেপ করবো না।তুমি যেটাকে মানিয়ে নেয়া বলছো তা হলো বৈধতার সম্পর্ক! নিষিদ্ধ সম্পর্কের অনুভূতি প্রখর হলেও দিনশেষে বৈধতা জিতে যায়!সৃষ্টিকর্তা বৈধতা পছন্দ করে, তাজ!”
তাজ কিছুটা চিৎকার করে বললো,”না আমার তোমাকে চাই, না আমার সেতুকে চাই।আমি কিচ্ছু চাই না!”
নীতুর মেজাজ এবার খারাপ হলো।ঝাঁঝালো স্বরে বললো,” আমার বলতে একটুও দ্বিধা হচ্ছে না যে,তুমি একজন কাপুরষ ধরনের মানুষ! না তুমি ভালো প্রেমিক হতে পেরেছো না তুমি যোগ্য স্বামী হতে পেরেছো।অন্যায় ক্ষমা করা যায় কিন্তু অপমান নয়!সেতুকে বেছে নিয়ে আমাকে তুমি অপমান করেছো তবুও আমি তোমাকে ক্ষমা করেছি।কেন জানো?মা বাবাকে প্রাধান্য দিয়েছো তাই।
ভালোবাসতে সবাই জানে, দায়িত্ব সবাই নিতে পারে না!এই জেদটা যদি তুমি আগে দেখাতে তবে আজ আমি তোমার বউ হতাম তাজ, এখন এসব করা অমূলক!তুমি ভালো সন্তানের রোল প্লে করে সেতুকে বিয়ে করলে।বিয়ের পরেই অনুধাবন করলে আমাকে ছাড়া তুমি সত্যিই ভালো নেই তখনই জেদ ধরলে।আমার তোমাকে নিয়ে ভয় হয় তাজ।একসময় যখন তুমি অনুধাবন করতে পারবে সেতুকে তোমার চাই তখনও তোমার এমন দেরি হয়ে না যায়!আফসোস! ”
তাজের বুকে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে নীতুর কথার বাণে! অভিযোগের স্বরে বললো,”তোমরা কেউই আমাকে বুঝলে না!”
নীতু কি করবে ভেবে পেলো না।কি করে এই ছেলেকে বুঝাবে ভালোবাসার বাহিরেও অনেক কিছু থাকে!
নীতু এবার তাজের পাশের চেয়ারে গিয়ে বসলো।তাজের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে গলার স্বর নরম করে বললো,”তাজ আমরা খুবই ভালো বন্ধু ছিলাম।আমার একমাত্র বন্ধু তুমি!এরপরে সম্পর্কের মোড় ঘুরলেও আজও আমি তোমার বন্ধু! তাজ তুমি ইচ্ছে করলে জেদ দেখাতে পারো,ছেড়ে চলে আসতে পারো।কিন্তু আমি পারিনা।একটা কালো মেয়ে হয়ে জন্মানোর পর থেকেই আমি কটু কথা শুনে বড় হয়েছি।হাতেগোনা ক’জন ছাড়া কেউ সত্যি ভালোবাসা দেখায়নি আমাকে ।তার মধ্যে তুমি একজন! সেই ভালোবাসা টুকুও যখন আমি হারালাম তখন আমিই কিন্তু সবার থেকে বেশি ভেঙে পড়েছি।কিন্তু উঠে দাঁড়িয়েছি আবার!সবার আগে নিজেকে নিয়ে ভাবতে হয় তুমি শিখিয়েছো তাজ।তবে আজ কেন ছেলেমানুষী করছো? জানো তো তাজ,জগতে কিছু মানুষ জন্মায় সর্বসুখী হতে আর কিছু মানুষ জন্মায় অন্যকে সুখী করতে!তুমি আমি না হয় দ্বিতীয় কাতারেই পরলাম।সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করো দেখবে সব ঠিক না হলেও তুমি নিজে ভালো থাকবে!”
তাজ এবার নিজেও আর একটা হাত নীতুর হাতের উপর রেখে বললো,”আর তুমি?তোমার কথা মনে হলেই যে আমার ঘুম পালিয়ে যায়,হৃদয়ে ঝড় শুরু হয়!খেতে পারিনা,হাসতে পারি না।মনে হয় সব শেষ করে ফেলি!তার বেলা?”
নীতুর চোখেও এবার পানি এসে গেলো।যতযাই হোক ভালো তো বাসে এই মানুষটাকে!সেতুর নিষ্প্রাণ মুখটা মনে পড়তেই নীতু নিজের আবেগ সামলে নেয়। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,”ভালোবাসার মানুষটা নিয়তির ফেরে অন্যের হলেও ভালোবাসা নামক অনুভূতিটুকু থেকে যায় দিনশেষে! সে আমার নয় তাই বলে তাকে আমি ভালোবাসি না তা তো নয়!তাকে আমি ভালোবাসি কারণ ভালোবাসাটুকু আমার! এখানে ভালোবাসা টুকুই মুখ্য!দিনশেষে ভালোবাসার মানুষটা ভালো থাকুক এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়?থাকুক না কিছু অনুভূতি অন্তরালে,তাজ তুমি আর সেতু ভালো থাকলেই আমার ভালো থাকা হবে! ”
তাজ কিছুই বললো না।শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো নীতুর দিকে।এই মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি তাও ভেবে পেল না।হাসিমুখে বিসর্জনের ক্ষমতা সবার থাকে না,আর যার থাকে তাকে সবাই আগলে রাখতে জানে না!হিরে ভেবে কাচ ক্রয় করা মানুষ আমরা যে!
তাজ উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে থমকে দাঁড়িয়ে বললো,”সেতু কি তোমার ওখানে?”
নীতু মাথা দুলিয়ে হ্যা বললো।তাজ চলে যেতে নিলে নীতু বলে ওঠে,”একটু দাঁড়াও তাজ।”
তাজ দাঁড়িয়ে পরে।নীতু সামনে এসে দাঁড়িয়ে সহজ ভঙ্গিতে বলে,”ভালো সন্তান, ভালো প্রেমিক,ভালো বর হতে না পারো।ভালো পিতা হয়ে দেখিয়ে দিও সবাইকে।আমাকে ভুল প্রমানিত করো না। শুভ কামনা রইলো হবু পিতাকে!”
তাজের দৃষ্টি স্তম্ভিত, বিস্মিত!মুখ হা হয়ে গেছে।নীতু আর কোন কথা না বলে সেখান থেকে চলে গেলেও তাজ নড়তে পারলো না একচুলও।বজ্রহত মানুষের মত দাঁড়িয়ে রইলো!
**************
নীতু অফিসে পৌঁছালো বেলা বারোটার দিকে! উত্তপ্ত রোদের ছোঁয়ায় ক্লান্ত শরীর আর মন আচ্ছন্ন হরেক চিন্তায়! তাজ বুঝবে তো এবার সেতুকে?সেতু ভুল বুঝবে না তো কখনো তাকে?সব ঠিক না হলে অপরাধ বোধে নিজেই যে শেষ হয়ে যাবে।হেনতেন চিন্তায় যখন নীতু অস্থির তখনই খেয়াল করলো, এসেছে একঘন্টা হলো।এরমধ্যে একবারো পলাশ এলো না!একটু দেরিতে এলেই তো আসামাত্র জিজ্ঞেস করে, কেন লেট হলো? তবে আজ কি হলো?
নীতু অফিসে বসে কাজ করছে। একটু বাদেই খেয়াল করলো সবাই তাকে অন্যরকম চোখে দেখছে।কি একটা বিষয় নিয়ে ফিসফিস করছে! ব্যাপার কি? নীতু আগে কাজ মনোযোগ দিল।পরে না হয় জেনে নিবে।
অফিস শেষে সবাই যখন যে যার মত বের হচ্ছে তখন নীতু পলাশের ডেস্কের কাছে গেলো।হাসিমুখে বললো,”কি ব্যাপার পলাশ ভাই?আজকে কি কাজের খুব প্রেসার? ”
পলাশ চেয়েও রাগ লুকাতে পারছে না।তাই রাগ আর বিরক্ত মিশিয়ে মুখটা বাঙলার পাঁচ বানিয়ে বললো,”একটু ব্যস্ত ছিলাম ম্যাম।আপনার কিছু প্রয়োজন ম্যাম?”
নীতু গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো, “আপনার মাথা ঠিক আছে পলাশ ভাই? আমাকে ম্যাম ম্যাম করছেন কেন?”
এবার আর পলাশ নিজের রাগ লুকাতে পারলো না।কিছুটা কটাক্ষের সুরে বললো,”স্যারের হবু স্ত্রীকে কি বলে সম্বোধন করতে হয়?আমার জানা মতে তাকে ম্যামই বলা উচিত নাকি অন্য কিছু?”
নীতুর মেজাজ খারাপ হলো।কপাল কুঁচকে বললো,”কে হবু স্ত্রী? কোন স্যার?”
“ম্যাম আপনাকে অভিনয়ে মানাচ্ছে না।অভীক স্যারের বাগদত্তা নন আপনি?অভীক স্যার তো আর মিথ্যে বলবে না।এছাড়া এটা আজকের অফিসের হট নিউজ।”
নীতুর কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেলো।একেতো মন শরীর কোনটাই ভালো ছিল না।তারউপর এই কথায় মেজাজের পারদ সপ্তমে পৌঁছালো। ত্রস্ত পায়ে হেঁটে অভীকের কেবিনে নক ছাড়াই প্রবেশ করলো।অভীক তখন কোট পরছিল।নীতুকে এভাবে আসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,”মিস নীতু এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? নক না করে এসেছেন কেন?”
নীতু যেন মুহূর্তেই ভুলে গেলো এটা অফিস।কোন বাসা বাড়ি নয়।ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মত হুঙ্কার ছেড়ে বললো,”আমিও জানতে চাই এটা কোন ধরনের অভদ্রতা? আমি কবে আপনার বাগদত্তা হলাম?আমি নক না করে আসলে দোষ আর আপনি তো বিনা অনুমতিতে আমার লাইফে এন্ট্রি নিচ্ছেন! এর কারণ কি?”
“কোন কারণ নেই।”…….অভীকের দায়সারা উত্তর।
নীতু কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেলো।চোখের দৃষ্টিতে রুক্ষতা। ঝাঁঝালো স্বরে বললো,”সোজাসুজি বলুন, কোন ডিপ্লোমেটিক এন্সার চাই না।!”
অভীক হাসলো।নীতুর রাগ দেখতে ভালো লাগছে! আজ পলাশের কিছু কর্মাকান্ডে অভীক এই কথা বলতে বাধ্য হয়েছে।পলাশের কদম বাড়ানোর আগেই থামিয়ে দিয়েছে।
অভীক বেপরোয়া কন্ঠে বলে,”মিথ্যে কি বললাম?আপনি আমার বাগদত্তা। সত্য যা তাই বলেছি।”
নীতু প্রত্যুত্তরে কি বলবে ভেবে পেলো না।খানিক পরে হিসহিসিয়ে বললো,”আমি আপনার বাগদত্তা কবে হলাম,কাইন্ড লি বলবেন?”
অভীক পকেটে দু হাত পুরে আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে নীতুর মুখের দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো,”ঠিক যেদিন আপনার হাতে আমার নামের আংটিটা উঠেছিল সেদিনই আপনি আমার বাগদত্তা হয়ে গিয়েছিলেন মিস নীতু!”
“অযোগ্য বলে সেই আংটি আমাকে খুলে ফেলতে হয়েছিল মি.অভীক!আশাকরি তা আপনার মনে আছে?”
“অফিসিয়ালি এনগেজমেন্ট হলো অথচ আংটি রিটার্ন করা হয়েছে আনঅফিসিয়ালি।তাই কোন কিছুই ব্রেক হয়নি।এখনো আপনি আমার বাগদত্তা! “……
অভীকের বেপরোয়া,জোরালো কথায় নীতুর মনে চাচ্ছে সামনের মানুষটা খুন করতে।তাই বললো,” যা একবার শেষ হয়ে যায় তা আর নতুন করে গড়া যায় না।এখন এসব অফিসে চড়াও করে আমাকে অপমানিত করার মানে কি স্যার?”
অভীক দুর্ভেদ্য ভাবে হাসলো।তারপর বললো,”এখানে অপমানিত করার কি আছে?আপনারও বিয়ের বয়স হয়েছে আর আমারো।তাই শুভ কাজে দেরি করে লাভ কি মিস নীতু?”
নীতু এবার হালকা স্বরে বললো,”মি.অভীক,আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের ভীতটা জোড়ালো করতে আমাকে অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে।আশাকরি আপনি নিজের সীমাবদ্ধতা জানেন।আমাকে বাধ্য করবেন না জবটা ছাড়তে!”
অভীক ব্যগ্র কন্ঠে বলে,”আমাকে ভুল বুঝছেন আপনি। মিস নীতু আপনার আত্মবিশ্বাস আর আত্মসম্মানের পথসঙ্গী হতে চাই।আর কিছু নয়!”
“আমার কোন করুণা চাই না।আবারো বলছি আমাকে বাধ্য করবেন না জবটা ছেড়ে দিতে।আসছি।”….. নীতুর কন্ঠে কাঠিন্য!
নীতু দ্রুত পায়ে রুম থেকে বের হলো।অভীক সবকিছু একবার দেখে নিজেও নীতুকে ফলো করে এগোলো।
অভীকের বেপরোয়া মনোভাব, তাজের আকুলতা,সেতুর অসহায়তা সব কিছু যেন মাথার উপর চেপে বসলো নীতুর।নীতু অন্যমনষ্ক হয়ে পা ফেললো চলন্ত রাস্তায়।অভীক যখন অফিস গেটে এসে দাঁড়ালো দেখলো নীতু রোড ক্রসিং করছে।অভীক কয়েক কদম হাঁটতেই বিকট চিৎকার দিয়ে উঠলো।অভীকের করুণ চিৎকারে চলন্ত রোডের ব্যস্ত যানবাহন সব যেন থমকে গেলো।অভীক ধপ করে বসে পড়লো রাস্তায়।
হুট করেই একটা ট্রলি গাড়ি নীতুকে ধাক্কা দিলো।নীতু ছিটকে কয়েক গাত দূরে গিয়ে পড়লো।টকটকে লাল রক্তের স্রোতে যেন ভেসে যেতে লাগলো সবটা!অভীক কিংকর্তব্যবিমূর হয়ে বসে পড়লো।অভীক ছলছল চোখে দেখলো, গোধূলির শেষ লগ্নে কনে দেখায় আলোয় কৃষ্ণবতীর লাল রং-এ মিলে মিশে একাকার হয়ে পিঁচঢালা রাস্তাটাকে কৃষ্ণচূড়ার রাঙা আলোয় রুপ দিয়েছে যেন!
****************
রাত তিনটা!হসপিটালের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সেখান থেকে হন্তদন্ত হযে বের হলো একটি মেয়ে!দ্রুত পায়ে হসপিটালের ভিতরে ঢুকে পড়লো। কালো জিন্স,সবুজ ফতুয়া পরনে মেয়েটির।ববকাট চুলগুলো রুক্ষ। চোখদুটো টকটকে লাল।হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।মেয়েটি কাঁদছে না অথচ ঠোঁট দুটো বারবার ফুঁপে ফুঁপে উঠছে। কি আশ্চর্য! যার জন্য মেয়েটির চোখে মুখে উদ্যোগের ঢেউ সেই মেয়েটি তখন এই ধরায় নিঃশ্বাস বাঁচিয়ে রাখতে লড়ে যাচ্ছে অবিরাম! তাজের কৃষ্ণবতী, অভীকের কাননবালা ফিরবে তো?
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ২৯
রাতের শেষ ভাগ।পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে।কেবল ঘুম নেই হসপিটালে কাৎরাতে থাকা মানুষগুলোর। তারা ঘুমাতে পারে না।অসুস্থতা তাদের ঘুমাতে দেয় না।
রুশিয়া বেগম আতঙ্কিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।অভীক যে ঠিক নেই তা বেশ বুঝা যাচ্ছে! ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বড় ছেলেকে কল দেন রুশিয়া!অনীক কতদূর এলো জানা প্রয়োজন। অভীকের যে এখন বড্ড প্রয়োজন তার ভাইকে।
অভীক বসে আছে বিধ্বস্ত অবস্থায়! চোখ মুখে বিষাদের কালিমা।শার্টের বুকের কাছে এখনো লেগে আছে নীতুর রক্ত।তাজা তাজা ফোয়ারার মত রক্তে ভেসে গিয়েছিল অভীকের বুকটা!এখন অবশ্য শুকিয়ে গেছে।কেবল ছোপ ছোপ লাল রংয়ের দাগ বসে আছে।কি আশ্চর্য!শুকিয়ে আসা রক্ত থেকে কেমন অদ্ভুত ঘ্রাণ আসছে!নীতুর রক্ত বলেই কি?রক্তের কি আলাদা কোন ঘ্রাণ থাকে?ভেবে কোন উত্তর পায় না অভীক!
কেবল জানে যতদিন বেঁচে থাকবে এই রক্তের দাগ বুকের ভিতর স্থায়ী দাগ হয়ে বসে থাকবে!অভীকের বুক ভার হয়ে আসে!চোখের সামনে ভেসে ওঠে নীতুর নিস্তেজ দেহ! উফফ!কি অসহ্য ভয়ংকর দৃশ্য! অভীক এলোমেলো দৃষ্টিতে হসপিটালের করিডোরে চোখ বুলায়।কেমন অশান্তি অশান্তি অনুভূতি চারপাশে!বাতাসে অক্সিজেনের অভাব! দমবন্ধ হয়ে আসে অভীকের।কেন তার চোখের সাসনেই নীতুর এমন পরিস্থিতি হলো?কেন?
নীতুকে যখন হসপিটালে নিয়ে আসছিল অভীক গাড়িতে করে।মেয়েটা কেমন বাবুই পাখির মত বুকে মুখ গুজে নিস্তেজ হয়ে পরেছিল।নীতুর শাড়ি রক্তে একাকার!যে শাড়ির ভাঁজে, এলোমেলো কুঁচিতে অভীক নিজেকে হারিয়ে ফেলতো ক্ষণে ক্ষণে, শাড়ির ওই লুটানো আঁচলে সদা আভিজাত্য খুঁজে পেতো… সেই সব লুকানো অনুভূতি কেমন ভেসে যাচ্ছিল রক্তের নহরে!সাথে অভীকের অদৃশ্য মনটাও। অভীক ফোঁস করে দম ফেলে।পালিয়ে যেতে মনে চায়! কিন্ত কোথায় যাবে নীতুকে ছেড়ে।কোথাও কি এমন কোন জায়গা আছে? যেখানে গেলে এই মেয়েটাকে তার মনে পড়বে না!কোথাও নেই….
অভীক বিড়বিড় করে বলে, “ফিরে এসো নীতু।প্লিজ, ফিরে আসো আমার কাছে..আমার কাননবালা!আমি অপেক্ষা করছি দেখো….কষ্ট হচ্ছে আমার!হৃদয়ে রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে অবিরত, তুমি কি বুঝতে পারছো না?এতটা পাষন্ড তো তুমি নও!”
নীতুকে রক্ত দেয়া হচ্ছে।বর্তমানে আই সিউ তে আছে নীতু!খুবই ধীর গতিতে শ্বাস ফেলছে অক্সিজেনের মাধ্যমে। ডক্টররা আশংকিত। এত বড় মেজর এক্সিডেন্টের পর কোন মানুষের ফিরে আসা কেবল মিরেক্কলের ব্যাপার।তিনঘণ্টা ওটি শেষে নীতুকে আই সিউ তে রাখা হয়েছে।সেই সময় শুধু অভীক উপস্থিত ছিলো হসপিটালে।বনপেপারে সাইন করার সময় কেমন হাত কাঁপছিল অভীকের!মনে হচ্ছিল নিজ হাতে মৃত্যুদন্ড লিখছে।অভীক পাথরের মত বসে আছে।কান্নার শব্দে করিডোরের বাতাস বিরক্ত লাগছে।বেশি কাঁদছে সাথি আর সেতু।থেকে থেকে কাঁদছে!অভীক বিরক্ত চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে তাজের দিকে তাকালো।এই ছেলেটা অভীককে ভীষণ অবাক করেছে।কেমন নিষ্প্রাণ হয়ে বসে আছে ফ্লোরে পা ছরিয়ে।অনবরত নিঃশব্দে কাঁদছে। বারবার শরীর কেঁপে উঠছে তাজের।মাথা নত করে বসে আছে।
নীতুর বাবাকে সুরভির কাছে রেখে পরিবারের সবাই উপস্থিত আছে হসপিটালে।এত দ্রুত কি করে আসলো অভীক বুঝতে পারছে না। জায়েদ কোন কারণ ছাড়াই হুড়োহুড়ি করছে।ভীষণ অস্থির কর্মকান্ড।বুঝা যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে ভেঙে পরেছে।মিলন গোমড়ামুখে তুতুনকে কোলে নিয়ে বসে আছে।মহিমা বেগম নামাজ পরছে।পাটিতে বসেই চোখের জল ফেলছে। নিখিল আই সিউ রুমের দিকে চেয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। নিখিল অপেক্ষা করছে নীতুর ফিরার।নীতুর জ্ঞান ফিরলেই নিখিল একটা কথা বলবে,….”নীতু তুই খুব ভুল ধারনা পুষে রেখেছিস এতদিন মনে।আমরা তোকে অগণিত ভালোবাসি।কেবল বলা হয়নি বলে তুই বুঝতে পারিস নি।”
ইতু ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো জায়েদের দিকে।ইতু ভীষণ শক্ত মেয়ে হয়েও আজ নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতে বললো,”ভাইয়া তোমার সব কথা তো নীতু আপা শুনে।আজ কেন তাকে বলছো না?চোখ মেলে তাকাতে! তুমি না আপার দাদাভাই,তুমি বললেই আপা শুনবে।বলে দেখো না?”…..জায়েদ নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।ইতু জায়েদের কনুই পেঁচিয়ে ধরে কাঁদছে।হুট করে মিতু এসে জায়েদের বুকে মাথা গুজে কাঁদতে শুরু করলো।জায়েদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।তার দুপাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকা কাউকে কোন সান্তনা দিল না।একসময় নিজেও নিরবে চোখের জল ফেলতে শুরু করলো। প্রতিটি ব্যক্তি অপেক্ষা করছে নতুন ভোরের!যে ভোরে কমলা রঙা রোদের মত নীতু খিলখিলিয়ে হেসে উঠবে!
ঠিক সেই সময় এলোমেলো পা ফেলে উপস্থিত হলো রিশা। রিশা হাঁটছে আর পাশ থেকে একজন নার্স বলছে,”ম্যাম হসপিটালে সিগারেট পান করা নিষিদ্ধ! ”
রিশা খেঁকিয়ে বললো,”এই বালের আইন কোন শালায় করছে?”
নার্স মেয়েটা হতভম্ব। রিশা সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেললো ডাস্টবিনে।নার্স মেয়েটা থমথমে মুখে চলে গেলো। রিশা বড় বড় পা ফেলে জায়েদের সামনে এসে মুখোমুখি দাঁড়ালো।তারপর বললো,”বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?”
সবাই গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো রিশার কথা শুনে।মিতু চেঁচিয়ে উঠে বললো, “কিসব অলক্ষণে বলছো? মাথা ঠিক আছে?”
রিশা যেন মিতুর কথা শুনলোই না।ফের বললো,”বেঁচে আছে?”
জায়েদ রুক্ষ স্বরে বললো,”বেঁচে আছে।”
রিশা মারমুখী হয়ে বললো,”তবে মরাকান্না করছেন কেন সবাই?আমার ডার্লিং বেঁচে আছে,তবে কিসের এত কান্না?ডার্লিং আমার ফাইটার!এতটুকু কষ্ট ঠিক সয়ে নিবে।”
অভীক খুবই অবাক হলো রিশার আচরণে কিন্তু কিছুই বললো না। রিশা সবার কান্নারত মুখের দিকে একবার করে চোখ বুলালো।তারপর নিজের উরুতে হাত দিয়ে বাড়ি মেরে বললো,”শালা একে বলে বাঙালি।নেতা মরলে তার কবরে ফুলের তোড়া দিয়ে ভরিয়ে ফেলি আর বেঁচে থাকতে গালি গালাজ, নিন্দে মন্দ করতে ছাড়ি না!আরেব্বাস,নীতু ডার্লিং দেখি নেতার কপাল নিয়ে জন্মেছো!ভালো,খুব ভালো। ”
জায়েদ ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।তারপর চলে গেলো রুমের এক কোণে।রিশার এই মানুষ গুলোর কান্না দেখে শরীর জ্বলে যাচ্ছিল।ফ্লোরে বসা তাজকে দেখে রিশা সেদিকে এগিয়ে গেলো।তারপর মিচকা হাসি দিয়ে বললো,”আরে এ যে দেখছি, ডিজিটাল যুগের দেবদাস! পার্বতী,চন্দমুখী দুজনই তার চাই।একেই বলে ছেলেদের কপাল,ঘরে বউ রেখে প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে ভাববে।আর মেয়েরা করলে পরকিয়া হয়ে যায়!কেন রে ভাই? প্রেমিকাকে যদি এতই ভালোবাসিস তবে বিয়ে করলি কে? আর অপারগ হয়ে বিয়েই যদি করলি তবে মুক্ত করে দিচ্ছিস না কেন প্রাক্তনকে?কেন তাকে ধরে বেঁধে বারবার মনে করিয়ে দিস,ভালোবাসিস! প্রোপারলি বেঁধে রাখতে না পারলে প্রোপারলি ছেড়ে দিতে কেন পারিস না তোরা?প্রাক্তনকেও বাঁচতে দে।তা না খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আরো কষ্টে বাড়িয়ে দিস তোরা।যেন সব ভুল একজনের।”
তাজ টকটকে লাল চোখে রিশার দিকে তাকিয়ে রইলো।হুট করে মনে হলো,নীতু যেন তার জন্যই এত কষ্ট পাচ্ছে। রিশা ঠিকই বলছে।মুক্ত করে দেয়া উচিত ছিল নীতুকে, যাতে উড়তে পারে খোলা আকাশে!
সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বললো,”চুপ করো রিশাপু।আমরাও আপির জন্য কষ্ট পাচ্ছি। এরকম কথা বলো না।”
রিশা চেঁচিয়ে উঠে বললো, “মেয়েদের এই গদগদ ভাবই আমার পছন্দ নয়।আমি আজ বলছি আমার ডার্লিংয়ের কিছু হলে, প্রত্যেকটাকে জেলের ভাত খাওয়াবো শালা!ঢং দেখাস এখন তোরা?মেয়েটা যখন সব হারিয়ে শূন্য হয়ে গিয়েছিল তখন কই ছিলি।আর আজ যখন নিজের মত বাঁচতে চাচ্ছিল মেয়েটা তখনও তোরা তোদের মত ডিসিশন চাপিয়ে বেড়িয়েছিস সবাই!যেন মেয়েটারই সব দোষ!শালা হারামখোর!”
রিশার কথার তোড়ে কেউ কোন কথা বলতে পারলো না।রিশা ধপ করে এসে অভীকের পাশে বসলো।অভীক উরুতে হাতের ভর রেখ থুতনি বুকের কাছে গুজে রেখেছে।নীতুর কোন খবর না পাওয়া পর্যন্ত একদন্ডের শান্তি পাবে না।বার বার নিজের ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকাচ্ছে!ঠিক তখনই একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ডক্টর এসে বললো,”রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ। রোগীর শরীর ব্লাড গ্রহণ করছে না।হাত পা নীল হয়ে আসছে।অক্সিজেন দেওয়ার পরও নিঃশ্বাসের উঠানামা খুবই কম।এরকম চললে….. ”
ডাক্তার কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই রিশা খেঁক করে উঠে বললো,”বাকি কথা মুখেও আনবেন না ডক্টর। তাহলে আমার হাত উঠে যেতে পারে।বাপ মায়ে ডাক্তারি পড়াইছে রোগীর সেবা করার জন্য, এত লম্বা প্যাচাল পাড়ার জন্য না।যান আপনার রোগীর কাছে যান।এত লম্বা প্যাচাল পারলে ট্রিটমেন্ট করবেন কখন?”
ডাক্তার আহাম্মকের মত চেয়ে থেকে চলে গেলো।এই প্রথম অভীক ভেঙে পরলো।হু হু করে কেঁদে উঠলো।রুশিয়া বেগম দৌড়ে এসে ছেলেকে জরিয়ে ধরলেন।অভীক শেষ কেঁদেছিল বাবার মৃত্যুতে আর আজ কাঁদছে কৃষ্ণবতী কাননবালার জন্য! পরিণত পুরুষের কান্না হয় ভয়ংকর! তাদের কান্না দেখলে মনে একধরনের মায়ার উদয় হয়!এরা সহজে কাঁদে না।যখন কাঁদে তখন চারপাশে তোলপাড় শুরু হয়।
রিশা টেনশনে উত্তেজনায় আবার একটি সিগারেট ধরালো।রিশা জানে নীতুকে ফিরতেই হবে।একটা মানুষ পৃথিবীতে এসে শুধু দুঃখ পেয়ে যাবে তা তো হয় না।শুধু দুঃখ কারো জন্য বরাদ্দ থাকেনা।একসময় সুখ আসে।সে পর্যন্ত কেবল ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়।সৃষ্টিকর্তাও হেরে যাওয়া পছন্দ করেন না।দুঃখের ঘড়া পূর্ণ হলেই সুখ আসবে।নীতুকে সেই সুখ উপভোগ করতে হবে……
চলবে,