#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৮
মাথার উপর সূর্য মামা তার প্রতাপশালী উত্তাপ ছড়াতে একটুও কার্পণ্যবোধ করছে না।চারদিক যেন রোদে পুড়ে খাঁ খাঁক করছে।নীতু শাড়ির আঁচলে ঘাড় মুছে বারকয়েক ঢোক গিলে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। কলিজা পানির জন্য হাহাকার করছে যেন!
নীতু চোখ মুখ কুঁচকে ব্যস্ত রাস্তায় দৃষ্টি মেলে।কোথাও অভীককে দেখা যাচ্ছে না। নীতু আজ হাফবেলা অফিস করে বের হয়েছে।হাতে একটুও সময় নেই।সামনে কত কাজ!অথচ সময় যেন একমুঠো!
সকাল থেকে অভীকের সাথে দেখা হয়নি নীতুর, মানুষটা ভীষণ ব্যস্ত।সামনে অনেক দিনের ছুটি নিতে হবে তাই যতসম্ভব কাজ গুছিয়ে রাখছে। নীতু ফের হাতঘড়ি দেখে।চোখে মুখে জড়ো হয় একরাশ ক্লান্তি! বিরক্তিতে ছেয়ে আসে মন।উফফ! জাতীয় শব্দ নির্গত হয় মুখ থেকে।
ঠিক তখনই অভীককে দেখে রাস্তা ক্রসিং করে এগিয়ে আসতে।গ্রে রঙের শার্ট,কালো প্যান্ট পড়া।ক্লান্তিতে পরিপূর্ণ মুখটিতে অজস্র মায়া! নীতু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। নিজের উপর নিজেও খানিকটা বিরক্ত হয়। ইদানীং অভীককে দেখলেই কেমন কেমন করে যেন বুকের ভিতরটা।এই যে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল দেরি করে আসার জন্য বকবে একচোট। কোথায় কি? উল্টো বরংচ মায়া হচ্ছে! ভীষণ প্রগাঢ় মায়া! শাড়ির আঁচল দিয়ে মানুষটার সকল ক্লান্তি মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছে!হায়….এ কেমন সর্বগ্রাসী মায়া?
নীতু নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকে।অভীক এসে সামনে দাঁড়ায়। পেটানো শরীর ঘামে ভিজে উঠেছে। নাক মুখ লাল হয়ে আছে।অভীক একপলক নীতুকে দেখে দিগ্বিদিক দৃষ্টি ঘুরায়।তারপর কিছুটা হতাশাজনক চাহনি মেলে শার্টের হাতা গুটায়,বুকের কাছের দুটো বোতাম খুলে ফেলে কলারটা ঈষৎ পিছনে ঠেলে কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে ফেলে বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে। নীতু কেঁপে ওঠে! শার্টের ফাঁক গলে ওই উন্মুক্ত লোমশ বুকটা শরীরে হীম কাঁপুনি তুলে! নিজেকে বড্ড বেহায়া মনে হয়। নীতু ফের বারকয়েক ফাঁকা ঢোক গিলে। নীতুর চাহনি লক্ষ্য করতেই অভীকের ক্লান্ত মুখটায় দুষ্টু হাসি ফুটে উঠে। চোখে মুখে একরাশ দুষ্টুমি ফুটিয়ে বলে,”অফিসের গাড়িটা মাঝপথে নষ্ট হয়ে মন্দ হয়নি। কি বলো?না হলে কি কখনো জানা হতো, আমার লজ্জাবতী কাননবউ আমাকে বেহায়া চাহনিতে পরখ করে!”
নীতুর কৃষ্ণ মুখশ্রী ক্রমশই লাল হতে শুরু করে।দৃষ্টিতে ভর করে অস্থিরতা! খানিকটা কপট রাগ নিয়ে বলে,”একে তো লেট করে এসেছেন, তারউপর আবোল তাবোল কথা বলে মেজাজ খারাপ করছেন।আপনি আসলে কি চাইছেন বলুন তো?”
“কাননবউর বেহায়া দৃষ্টি আরো কিছুটা বেহায়া হোক!লজ্জাবতী কাননবালা শুধু আমার জন্যই লাজ লজ্জার বিসর্জন দিক!……এই বান্দা তাই চাইছে।”
অভীকের কথায় রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে নীতু।নীতুকে হাসতে দেখে অভীকও মৃদু হেসে একটা রিকশা ডেকে দাঁড় করায়।নীতুকে উঠিয়ে শাড়ির আঁচলটা গুছিয়ে কোলের উপর রাখে।তারপর একটু অপেক্ষা করতে বলে একটা দোকানে প্রবেশ করে।নীতু চেয়ে থাকে।এই সব ছোট ছোট যত্ন নীতুকে মুগ্ধ করে। অভীক দোকানে দাঁড়িয়েই দেখতে পায় নীতু তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে।অভীক ভ্রু কুঁচকে জানতে চায়, “কি?”
নীতু মাথা নাড়িয়ে হাসে।অভীক বিড়বিড় করে বলে,”পাগলী!”
নীতু তবুও চেয়ে থাকে।মাঝখানে তিনটা মাস চলে গেলো। এই তিনটা মাস নীতুর জীবনে শ্রেষ্ঠ তিনটা মাস ছিল। একটা মানুষ এতটা কেয়ারিং কি করে হতে পারে? নীতু ভেবে পায় না।বাবার মৃত্যুর পর খুব ভেঙে পড়েছিলো।সেই সময় এই অভীক ছায়ার মত পাশে থেকেছে।প্রচন্ড ডিপ্রেশন থেকে নীতুকে বের হতে সাহায্য করেছে।নীতু প্রতিটা মুহুর্তে অনুভব করেছে,অভীক একজন যোগ্য সঙ্গী! এই মানুষটা পাশে থাকলে নীতু সব পারবে, সব! ইদানীং বড্ড বেশি অস্থিরতা অনুভব করে নীতু।মানুষটার খুব কাছে যাওয়ার তাড়া বোধ করে।খুব কাছে….যতটা কাছে গেলে হৃৎস্পন্দনের শব্দ গুনা যায়! নিজেকে সত্যিই চরম বেহায়া মনে হয়।
হাতে ঠান্ডা পানির বোতল আর চিপসের প্যাকেট নিয়ে রিকশায় উঠে বসে পড়ে অভীক।নীতুর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলে,”মামা বেনারসী পট্টি নিয়ে চলো তো।তোমার মামীর জন্য একটা চকচকে, টকটকে লাল বেনারসি কিনতে হবে।”
রিকশাওয়ালা মামা হেসে প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করে। নীতুকে পানির বোতল ধরে বসে থাকতে দেখে অভীক ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,”পানির বোতল ধরে বসে থাকার জন্য দেইনি। এই রোদে এতক্ষণ অপেক্ষা করেছো।পানি খাও ভালো লাগবে।”
নীতুর চোখে জল এসে যায়। কে কবে ভেবেছিল এই কৃষ্ণ মেয়েটির কপালে এমনতর সুখ এসে ভির করবে? নীতু আলতো করে পানি পান করে কিছুটা।নীতুর হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে এবার অভীক গলা ভিজায়।নীতু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।নীতু ঠোঁট লাগিয়ে ছিল বোতলের মুখটায় ….
পানি পান করা শেষে অভীক মিষ্টি করে বলে,”ওভাবে তাকিয়ে দেখতে নেই কাননবউ, নজর লাগতে পারে তোমার বরের!”
নীতুর ছলছল পদ্মদিঘি চোখে ভর করে একমুঠো আদুরে মায়া।সেই চাহনি মেলেই নীতু ভেজা কন্ঠে বলে,”আমার কৃষ্ণ রঙেই আপনার নজর কাঁটা হোক!এই কালো রঙই হোক আপনার শুদ্ধতম বন্ধক! এই শুভ্র মানুষটা শুধু আমাকেই ভালোবাসুক!আমি ছাড়া সকল নজর এই মানুষটার উপর হারাম হয়ে যাক!”
অভীক মাথা নত করে ঠোঁট কামড়ে হাসে।বুকে লিলুয়া বাতাসের মত বইতে থাকে ভালো লাগার তীব্র আবেশ।বুকের পাটা ফুলে ফেঁপে উঠতে চায়….. প্রেয়সীর শুদ্ধতম ভালাবাসার অহমে নিজেকে রাঙাতে পেরে!
হাতের মুঠোয় শক্ত করে নীতুর হাত পেঁচিয়ে ধরে অভীক।নীতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। অভীকও তাকায়।কপালের কাছে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো ঝাকি দিয়ে পিছনে সরায়।চোখের দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন ভাব নিয়ে বলে,” বালিকার প্রথম প্রেম যদি হয় সর্বনাশী,তবে তরুণীর প্রথম ভালোবাসা হয় সর্বগ্রাসী! বুঝেছো নীতু? ”
নীতু লাজুক হাসে।দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে বলে,”ওসব প্রেম ভালোবাসা আমি বুঝি না জনাব।”
“আচ্ছা…..?তাই বুঝি!”….. অভীকের কন্ঠে প্রকাশ্য বিদ্রুপ।
” হুম,ঠিক তাই।”…..নীতু হেসে বলে।
অভীকও হেসে সম্মতি প্রকাশ করে।হুট করেই এই উত্তপ্ত রোদেলা প্রকৃতিও যেন কেমন হেমন্তের শেষ বিকেলের মত নরম পেলবতা মনে হয়! ভালোবাসায় বুঝি সবই এমন মিষ্টি লাগে?সুন্দর আর পবিত্র মনে হয়?কি জানি?
**********
ডা.কানিজ ফাতেমা সকল রিপোর্ট মনোযোগ সহকারে দেখলেন। তারপর বললেন,”বাচ্চার গ্রোথ ঠিক আছে মিসেস সেতু।কিন্তু আপনার প্রেসার হাই।তাছাড়া প্রেগ্ন্যাসি জনিত কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে।ডায়বেটিস বেড়ে গেছে, চিন্তা করবেন না।এসময় এরকমটা হয় ডেলিভারির পরে ঠিক হয়ে যাবে।আমি ঔষধ লিখে দিচ্ছি।…… আর মি.তাজ পেশেন্টের দিকে প্রোপার খেয়াল রাখবেন।আমার মনে হচ্ছে সেতু ঠিকঠাক মত রেষ্ট নেয় না।এই সময় যতটা সম্ভব নিজেকে রিলাক্সে রাখতে হবে।আশা করি বুঝেছেন?”
তাজ মাথা দুলিয়ে সম্মতি প্রকাশ করে।সেতুর মেজাজ খিঁচড়ে যায়।এতসব কিছু ভালো লাগে না আর।আজকাল হুটহাট অল্পতেই মেজাজ গরম হয়ে যায়। চেম্বার থেকে বের হতেই সেতু তাজের বাহু খামচে ধরে বলে,”আপনি এখানে কি করছেন?”
“এটা হসপিটাল সেতু।ঝামেলা করবেনা কোন।”‘….তাজের নির্লিপ্ত কন্ঠ।
সেতু তাজের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তেতে ওঠে।কিছু বলতে নিলেই তাজ সেতুকে নিয়ে হসপিটালের সামনের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ওদেরকে আসতে দেখে মেহেদিও এগিয়ে আসে।মেহেদি পৌঁছাতেই শুনতে পায় তাজ রাগান্বিত স্বরে বলছে,” তুমি আসলে কি চাইছো সেতু? কেন এত কষ্ট করছো?কারো কথা শুনছো না কেন?তোমার টাকা পয়সা লাগলে আমি দিবো।তবুও এত খাটনি কেন করো?”
সেতুর ফর্সা মুখ রাগে থইথই করছে। মাথার দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। হ্যা সেতু বিশ্রাম নেয় না।সকালে ভার্সিটি করে তারপর তিনটে টিউশনি করিয়ে বাসায় ফিরে।নীতু বারণ করে।জায়েদ, নীতু, তাজ প্রতিমাসে নীতুকে হাত খরচার টাকা দেয় কিন্তু সেতুর সেসব ভালো লাগেনা।তাই ঝাঁঝালো স্বরে বলে,”কারো করুণা আমি নিবো না।কারো না।”
তাজ হালছাড়া ভঙ্গিতে আশেপাশে দৃষ্টি বুলায়।নিজেকে অসহায় মনে হয়।বাসায় গেলে বাবা মা সেতু কে নিয়ে আসতে বলে আর সেতুর কাছে আসলে সে যাবে না বলে।তাজের আসলে কি করা উচিত বুঝে পায় না।
সেতু কন্ঠস্বর রুক্ষ করে বলে,”আপনার মা যেন রোজ ফোন না করে।এতে আমি বিরক্ত হই।আর আপনাকেও বলছি, আমি কোন স্কুল খুলে বসিনি যে রোজ রোজ হাজিরা দিতে হবে। তাই আমাকে বাঁচতে দিন।”
তাজ অনুনয় করে বলে,”ফিরে চলো সেতু।অন্তত বাচ্চাটার কথা ভাবো।বাবা মা চায় তুমি ফিরে চলো।”
সেতু উপহাসের হাসি হাসে।চোখা স্বরে বলে,”বাবা মা, বাচ্চা,সংসার,লোকে কি বলবে এসব ভয় আমি পাই না।আসলে কি আপনি সত্যিই চান আমি ফিরে যাই? আচ্ছা আজকে আমি ডাক্তার দেখাবো এইটা নিশ্চিত আপি বলেছে।তাই এসেছেন…..না হলে সেতু কে?”
তাজের এবার মেজাজ গরম হয়।নীতু তাকে টেক্সট করে শুধু জানিয়েছে জাষ্ট টাইমটা।আর কিছু তো বলে নি। না কোন জোর করেছে। তাই রাগত্ব স্বরে বলে,”খবরদার নীতুকে এসবের মাঝে টানবে না।বোনকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো তো নাকি মুখোশ পড়ে আছো? আমি এখনো বলছি সেতু ফিরে চলো। সব সম্পর্কে ভালোবাসা থাকাটা জরুরী নয়!”
সেতুর চোখে পানি জমে।বুকের ভিতর তীব্র দহন।তবুও ঘৃণা করতে পারে না একফোঁটাও!তাই আঙুল শাসিয়ে বলে,”চোখের সামনে থেকে দূর হন আমার।এসব লোক দেখানো কোন কিছু আমার চাই না।বলে দিবেন আপনার মাকে বাচ্চা হলে তার কাছে পাঠিয়ে দিবো।তবু আপনারা মা ছেলে বিরক্ত করবেন না।”
তাজ ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে মেহেদির উদ্দেশ্যে বলে,”মেহেদি তোমার বন্ধুকে যখন নিয়ে এসেছো তেমন দিয়েও এসো।আর একটা কথা তোমার বন্ধুকে বলে দিও,আমি আর তাকে ফিরে যেতে বলবো না।দায়বদ্ধতা থেকে যতটুকু করার ছিল করেছি।এবার একান্তই তোমার বন্ধুর সিদ্ধান্ত। “……বলে তাজ হনহন করে চলে যায়।
সেতু অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে।গোলাপি ঠোঁট দুটো ভেঙে আসতে চায় কান্নায়। মেহেদি বাইক এনে সামনে দাঁড় করায় স্টান ফেলে।মৃদু কন্ঠে বলে,” ওঠ,এখন এরকম পেঁচির মত মুখ করে আছিস কেন?…. শালার,মেয়ে জাতী আসলেই কম্পিলিকেটেড, তাদের মুখ আর মন কখনোই এক কথা বলে না!”
সেতু ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।মেহেদি ব্যথিত দৃষ্টিতে বাইক থেকে নামে। সেতুকে টেনে এনে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করায়।হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বলে,”ভুল সবাই করে সেতু কিন্তু ভুল সুধরে নিবার সুযোগ সবাই পায় না।”
সেতু ভেজা চোখে তাকায়। মেহেদি কেঁপে ওঠে সেই চাহনিতে।প্রেগ্ন্যাসির সকল চিহ্ন সেতুকে যেন দিগুণ সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।ফোলা ফোলা গাল দুটো আরো কিছুটা ফুলে আছে। তাই চোখের কাছটা আরো আদুরে লাগে! ফোলা পেটে ছোট খাটো লাড্ডু মনে হয় সেতুকে মেহেদির। সেতু ভেজা চোখে ভেজা কন্ঠে বলে, “আমি সত্যি ফিরে যেতাম বিশ্বাস কর মেদু।মানুষটা যদি নিজ থেকে চাইতো তবেই ফিরে যেতাম।আমি সব ভুলে যেতাম যদি তাজ একবার জরিয়ে ধরে বলতো,ভালো আমি যাকেই বাসি বউ তো তুমি আমার।আমার বউ আমার কাছে থাকবে।কিন্তু সে শুধু দায়িত্ব দেখায়।দেখলি না কেমন করে বলে গেলো,আমি তার দায়বদ্ধতা! ”
মেহেদি কি বলবে ভেবে পেলো না।প্রিয় মানুষটিকে পাওয়ার আকুলতা সবার থাকে না।হয়তো যার আকুলতা থাকে তার চাওয়ার বৈধতা থাকে না।
**********
অভীকের দৃষ্টি রসগোল্লার মত হয়ে আছে।সে পারে না নীতুকে ছিনিয়ে আনে সমাবেশ থেকে।কিন্তু তা সম্ভব নয়।নীতুর নাক ফোঁড়ানো নেই।তাই অফিস শেষে নীতু পার্লারের একটা মেয়েকে আসতে বলেছিল। মেয়েটি যতবার গানের মত দেখতে যন্ত্রটা হাতে নেয় ততবার অভীক আৎকে উঠে। নীতুর সাথে সাথে রুশিয়া বেগমেরও মেজাজ খারাপ হয়।ছেলেটা এত বউ পাগল! একদম বাবার মত হয়েছে।মানুষটা বেঁচে থাকতে রুশিয়া বেগমের প্রতিটা দীর্ঘ শ্বাসেও যেন ব্যথা পেতেন।
পার্লারের মেয়েটি অধৈর্য্য হয়ে হুট করেই নীতুর নাকে চাপ দিলো।নীতু আহ্ করে উঠতেই অভীক তীব্র চিৎকার দিলো।নীতু নিজের ব্যথা ভুলে অভীকের দিকে বোকার মত চেয়ে রইলো। মানুষটা কি পাগল?এত জোরে কেউ চিৎকার দেয়?
অভীকের কান্ডে সেতু আর সাথি হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। পারেনা একটার গায়ের উপর একটা পড়ে যায়। রুশিয়া বেগম নিজেও মুখ টিপে হাসছেন।পার্লারের মেয়েটা চলে যেতেই অভীক ধপ করে নীতুর পাশের সোফায় বসে পড়ে চোখা চোখে নীতুর নাক পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে।সদ্য ফোঁড়ানো নাকে নাকফুল,চোখে টলমল অশ্রু,ঠোঁটের কোণে লজ্জার আঁচ।এ যেন কৃষ্ণচূড়ার রাঙা আলোয় কৃষ্ণবতীর লাজুক সাজ!অভীক ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে…বেহায়া চোখে।নীতু সবার সামনে ভীষণ বিব্রত বোধ করে ।চোখ গরম করে তাকায়। কিন্তু অভীক তো অভীকই! সেতু দুষ্টুমি করে বলে,”ভাইয়া মিষ্টি খাওয়ান,আপনার বউর নাকে এবার স্বর্ণ উঠবে।”
অভীক বিস্মিত দৃষ্টিতে বলে,”নির্দয় বালিকারা তোমরা মোটেই ন্যায়বিচারক নও।বউ আমার,নাকে ব্যথা পেলে পেয়েছে আমার বউ,তার কষ্টে অলমোস্ট হার্টঅ্যাটাক হতে হতে বেঁচে ফিরেছি আমি!কোথায় তোমরা আমাকে মিষ্টিমুখ করাবে…তা না করে উল্টো আমিই কিনা তোমাদের মিষ্টি খাওয়াবো?নো ওয়ে বালিকারা….”
“ইট’স নট ফেয়ার ভাইয়া!”…..সেতুর কন্ঠে অনুযোগ।
রুশিয়া বেগম ছেলের আর নীতুর হাসিখুশি মুখের দিকে তাকাতেই আর একটা মুখ ভেসে ওঠে। তিনি নিঃশব্দে উঠে গিয়ে নীতুদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কল করেন একটা নম্বরে।
ওপাশ থেকে ‘হ্যালো’ বলতেই রুশিয়া নরম স্বরে জিজ্ঞাসা করেন,” অনীক বললো তোমার শরীর খারাপ।এখন কেমন আছো রুমি?”
রুমি চমকালো।শাশুড়ী তার কাছে কখনোই ফোন করেন না।সম্পর্কটাই কেমন টালমাটাল। হুট করে আজ কল করায় রুমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছে।
“ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?”…. রুমির কন্ঠে জড়তা।
” মা বলে ডাকতে সংকোচ হচ্ছে? মা বেঁচে থাকলে বুঝতে,
মায়েরা ভালোবাসেন আড়ালে আর শাসন করে সম্মুখে। ”
হুট করে রুমি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।মায়ের মুখটা তার মনে নেই।মায়ের আদর, শাসন কেমন হয় রুমি জানে না।
রুশিয়া বেগম আদুরে স্বরে বলেন,”আমার ভুল হয়ে গেছে মা।আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি বাঁধন ছাড়া বড় হয়েছো হুট করে বাঁধা পড়লে বিগড়ে যেতে পারো।আমার তোমার প্রতি আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিলো।আমি শাশুড়ী হিসেবে বড়ই ব্যর্থ!”
রুমি এবার উচ্চ স্বরে কেঁদে বলে,”মা আমার জগৎটাই ছিলো বন্ধু-কাজিনমহল।উন্মুক্ত! কখনো কেউ বলে নি, এত দেরি কেন?এটা খাওনি কেন?আজ সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত,আমার জন্য কারো সময় নেই।আমার বড় অনুতাপ হচ্ছে মা।আপনার ছেলের কাছেও দিনদিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছি।আমি কি করবো বলুন তো?”
রুশিয়া বেগম হাসেন। তারপর বলেন,”বোকা মেয়ে।এরজন্য কাঁদতে হয় নাকি?ছোটর বউটা ঘরে তুলেই আমি তোমার কাছে চলে আসবো।দুই মা মেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিবো।মাগো, নিজে সুখী তখনই হবে যখন তুমি অন্যের দুঃখের কারণ না হবে। ”
“মা আমিই চলে আসি?”
“শরীর খারাপ নিয়ে আসতে হবে না।ক’দিন পর তো আমরাই আসছি।আর একবার চেকাপ করে নিও। আমার মনে হচ্ছে অনীক গাধাটা এবার আমাকে দাদু ডাক শোনাতে চলেছে।”
রুমি লজ্জিত স্বরে,”রাখছি। “….বলে কল কেঁটে দেয়।
রুশিয়া বেগম ফোন হাতের মুঠোয় নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলেন,” হে আল্লাহ তুমি সব মঙ্গল করো।আমার সন্তানদের সুখে কোন আঁচ আসতে দিও না।আমার সকল ভয় যেন অমূলক হয়!”
********
সেতু পড়ার টেবিলে পড়ছে।পাশে কফির মগ।সাথি শানকে কোলে নিয়ে রিপনের সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে। ঠিক তখনই কলিং বেল বেজে ওঠে। নীতু বসার রুমে বসে অফিসের কিছু কাজ করছিল।হটাৎ কলিং বেলের শব্দে নীতুর কপালে ভাঁজ পড়ে। রাত বাজে বারোটা,এই সময় কে এলো?
দরজা খুলতেই নীতু নিজেকে মনে মনে গালি দেয়।তার বোঝা উচিত ছিল অভীক নামক পুরুষটা একটা পাগল।আর পাগলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। নীতু দরজার কপাট ঘেষে দাঁড়িয়ে বলে,”কি চাই? ”
“আমার বউ!”….. অকপটে স্বচ্ছ উত্তর অভীকের।
নীতু চোখ বড় বড় করে তাকায়। দরজার ওপাশে পকেটে একহাত পুরে কি সুন্দর আয়েশি ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা!চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে প্রশস্ত কপালে।ঠোঁটের কোণে ঈষৎ দুষ্টু হাসি! চোখের চাহনি প্রখর, প্রগাঢ়! নীতু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলে,” আপনি দিনদিন চরম বেহায়া হয়ে যাচ্ছেন অভীক।আপনার ব্যক্তিত্ব পৃথিবী থেকে ডায়নাসোরের মত বিলুপ্ত হচ্ছে। ”
“বউয়ের কাছে ব্যক্তিত্ব বজায় রাখতে গিয়ে রোমান্সের বারোটা বাজাবো,এতটা বোকা নই আমি!”
নীতু হতাশ হয়।হুট করেই অভীক দু’পা এগিয়ে নীতুর মুখটা তালুবন্দী করে। নীতুর দৃষ্টি এলোমেলো, বিভ্রান্ত!অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসে।চোখ আটকে যায় সদ্য ফোঁড়ানো লাল হয়ে থাকা নাকের নাকফুলে। অভীক জড়ানো গলায় বলে,”ব্যথা করছে?”
“উহু…!” মৃদুস্বরে অসম্মতি প্রকাশ করে নীতু।
অভীক আর একটু ঝুঁকে অদ্ভুত সুন্দর করে বলে,”একটু চুমু দেই কাননবউ?জাষ্ট একটু,ঠিক এক চিমটির মত!দেখবে ঠিক ব্যথা সেড়ে যাবে।বরের চুমু বউয়ের জন্য এন্টিবায়োটিকের থেকেও বেশি কার্যকারী!জানো তো?”
নীতু উপলব্ধি করে তার পা দুটো থরথর করে কাঁপছে।মাথায় চক্কর কাঁটছে।চুমু কবে থেকে ব্যথানাশক ঔষধ হলো?আর একটু চুমু আবার কেমন কথা? নীতুর হতভম্ব চাহনি আরো একধাপ হতভম্বিত করে অভীক আলতো করে নীতুর নাকের ডগায় মুক্তোর মত জমে থাকা ঘামের উপর ঠোঁট ছোঁয়ায়! নাকফুলে চুমু দেয় না,পাছে নীতু যদি ব্যথা পায়।
নীতুর মনে হতে লাগলো হাওয়াই মিঠাইয়ের নরম স্পর্শ তার নাকের ডগায় ছুঁয়ে দিয়েছে অভীক!এতটাই আলতো,এতটাই কোমল! মানুষটা সত্যিই পাগল।এতটা সুখ নীতুর কপালে সইবে তো?অজানা ভয়ে ক্রমশই নীতুর চোখ জলে পদ্মপুকুরের মত টলমল করে ওঠে!
চলবে,
#কাননবালা!
#আয়েশা_সিদ্দিকা
পর্বঃ৩৯
নিখিলের ঢিলে ঢালা গেঞ্জিটা ঘামে ভিজে উঠেছে। কপালেও বিন্দু বিন্দু ঘাম। তীব্র রোদে যেখানে মানুষের দম ফেলতেও অস্বস্তি হচ্ছে সেখানে নিখিল সকাল থেকে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে ডেকোরেশনের কাজ করাচ্ছে।নিজের মন মত বাড়িটা সাজাচ্ছে লোকদের দিয়ে।বিয়ের বাকি সাতদিন হলেও এখনি রঙ বেরঙের লাইটিং আর রঙের সাজে বাড়িটাকে ভিন্ন রুপে রাঙাচ্ছে।
ডেকোরেশনের কাজ হয়ে গেলে নিখিল বাড়িটির দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্টির নিঃশ্বাস ছাড়ে!তার বোনের জীবনটা এতকাল ঘোর অন্ধকারে কেঁটেছে।সেই অন্ধকারে আলো হয়ে এসেছে অভীক।নিখিল চায় না বোনের বিয়েতে কোন কমতি হোক।এই শহরের মানুষ জানুক তার বোনের জীবনটা কতটা আলোকিত!নিখিলের সামর্থ্য থাকলে গোটা শহরটাই লাল নীল মরিচ বাতিতে সাজিয়ে ফেলতো!
নীতুরা রওনা করেছে।কতদূর এলো জানার জন্য বাড়ির ভিতরে যেতেই শুনতে পেলো সুরভিকে তার চাচি বলছে,” শুনো বউ,নিখিল একটা পাগল।তার সাথে কি তুমিও কি পাগল হইলা নাকি?এত টাকা পয়সা যে খরচ করছো তোমার নিজের একটা ছাওয়াল আছে জানো তো?সবই যদি বোনের পিছনে খরচ করে,তবে কি হইবো?”
সুরভি ভয়ে ভয়ে এদিক সেদিক তাকায়। নিখিল শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।হ্যা এটা সত্যি নিখিল সব কিছু বাড়তি খরচা করছে…বিয়ের বাকি এখনো সাতদিন, এরই মধ্যে অর্ধেকের বেশি আত্মীয় স্বজনে ভরে গেছে বাসা।তাদের জন্য বাড়তি বাজার!তার উপর কতশত আয়োজন!
নিখিলের গমগমে স্বরে সুরভির হাত থেকে ফলের বাটি পরে যায়।ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে!রোদে পুড়ে মুখশ্রী লাল হয়ে আছে,সাথে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত রাগ!কি ভয়ংকর লাগছে!সুরভি ফাঁকা ঢোক গিলে!
“শুনুন চাচি,আমার বোনের বিয়েতে আটদিন আগে এসেছেন।ভালো কথা।আমার বোনের আনন্দে আনন্দিত হন,খাওয়া দাওয়া করুন।কিন্তু বাড়তি কথা বলে আমার বউয়ের কান ভারি করবেন না। এই যে দেখছেন এতকিছু আমি করছি তাতেও আমার প্রায়শ্চিত্ত হবে কিনা সন্দেহ আছে!আমি ভাই হিসেবে ব্যর্থ, সেই ব্যর্থতা আজীবন আমাকে বইতে হবে।আপনারা আর কোন বোঝা চাপাবেন না দয়া করে ।”……বলে নিখিল হন্যেপায়ে চলে যায়। সুরভি সেদিকে বোকার মত তাকিয়ে থাকে!
*************
মিলন বিরক্ত! যারপরনাই বিরক্ত। নিজের ছেলে কবে বড় হবে?সেই প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে! ছেলেটা এত দুষ্ট। ছেলের কান্ডে বিরক্ত হয়ে এবার বউয়ের দিকে তাকাতেই দেখতে পায়,ইতু একটার পর একটা শাড়ি বাছাই করছে কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না।
মিলনের মুখ থেকে আবার বিরক্তি সূচক শব্দ বের হয়।এত সুন্দর সুন্দর শাড়ি। আর ইতুর কিনা কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না।
নীতুর বিয়ে উপলক্ষে ইতুকে একটা সাধারণ ইতুর সাথে বেমানান শাড়ি কিনতে দেখে মিলন বেশ খানিকটা অবাকই হলো!
বাপ ছেলের জন্য একই রকমের ভালো মানের পাঞ্জাবি কিনে বের হলো তিনজনই।মিলন তখনও হতভম্ব! এত এত শাড়ি বাছাই করে ইতুর ওমন একটা রুচিহীন পোশাক কিনতে দেখে মনের মধ্যে কুটকুট করছে।
রিকশায় চেপে বসেছে তিনজন।তুতুন ঘুমিয়ে পড়েছে।মিলন আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,” একটা ভালো শাড়ি কিনলে হতো না,ইতু?”
“কেন?”…. ইতু নাক মুখ কুঁচকে বলে।
” না মানে…. বিয়েতে পড়ার জন্য একটু বেশিই সাধারন হয়ে গেছে।তবে তোমার পছন্দ হলে থাক….!”
মিলনের কথায় ইতু ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে!উদাস কন্ঠে বলে,”বিয়েটা আমার আপার।যার গায়ের রঙটা কালো।কতশত কথা শুনেছে আমার আপা!বিয়েটা আদৌ আপার কোনদিন হবে কিনা?এই প্রশ্নের বাণে আপা কতবার নিজেকে আয়নায় দেখে কেঁদেছে।নিজেকে নিয়ে কতবার আপা হীনমন্যতায় ভুগেছে।আমি চাই না আপা অন্তত বিয়ের দিন সেই হীনমন্যতায় ভুগুক।….আমার আপার বিয়েতে আপাকেই সব থেকে সুন্দর দেখাতে চাই! সবার থেকে সুন্দর! আর কাউকে না।যে বোনগুলো আপার সুখের পথে কাঁটা হয়েছিলো তাদের থেকেও সুন্দর। একদম রাণীর মত!আমার আপা রাণীর মত বসে থাকবে! কোন রাজপুত্র নয় স্বয়ং রাজা কৃষ্ণমেয়েটিকে বরণ করতে এসেছে, সেসব দেখে ওই কটুভাষিণীরা জ্বলুক ঠিক সেটুকু আমিই চাই!আমার আপার কাছে সকল সৌন্দর্য ভাটি পড়ে যাক!”…….বলতে বলতে ইতু ফুঁপিয়ে কেঁদে দেয়।
মিলন তাকিয়ে থাকে।এই অসম্ভব সুন্দর মেয়েটি তার বোনকে কতটা ভালোবাসে তাকি নীতু আপা জানে?
***********-
মিতু বাবার বাড়ি যাবে সেই উপলক্ষে রেডি হয়ে এসে দেখে জায়েদ গম্ভীর মুখে বসে আছে বিছানায়। স্বামীকে এতটা চিন্তিত দেখে মিতু পাশে বসে।জায়েদ ফিরে তাকায়। চোখ দুটো কেমন টকটকে লাল।মিতু আৎকে উঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে তোমার?”
জায়েদ কিছু বলে না।চুপ হয়ে থাকে।মিতু পুনরায় বলে,” বিকেল হয়ে গেলো।ও বাড়িতে যাবা না নাকি?নীতু এসে তোমাকে না দেখলে মনখারাপ করবে?”
“যাবো তো।”….. অলস কন্ঠে বলে জায়েদ।
মিতু ভেবে পায় না তার স্বামীর হটাৎ কি হলো? জায়েদকে একই ভাবে বসে থাকতে দেখে জায়েদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চুলে হাত বুলিয়ে বলে,” আমাকে বলো কি নিয়ে এত চিন্তা করছো?”
“মিতু তোমাকে যেদিন বউ করে আনলাম সেদিন সবাই আমাকে দুলাভাই বললেও নীতু কিন্তু বলেনি।নীতু সবসময় ডেকেছে দাদাভাই! নীতু কিন্তু তোমার বোন নয়।ও আমার বোন।বড়ই আদরের।সেই বোনটার বিয়ে হচ্ছে অথচ আমার মন মানছে না।বাবা বেঁচে নেই,নিখিল সবটা একা একা করছে।ব্যবসাটাও ভালো যাচ্ছে না।একজনের কাছে কিছু টাকা পাবো ভেবেছিলাম সেটা পেলে নীতুকে হার গড়িয়ে দিবো।কিন্তু সে টাকা দিতে পারবে না।কেমন ভাই হলাম বলতো?বোনের বিয়েতে বোনের জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না।বড় আফসোস হচ্ছে! বুঝলে….?”…….জায়েদ ভেজা কন্ঠে বলে।
মিতু অপলক চোখে চেয়ে থাকে।চোখের কোণে হালকা জলও জমে।স্বামী হিসেবে এই মানুষটাকে একশো তে হাজার নম্বর দিতে ইচ্ছে করে!
মিতু আলমিরার চাবিটা নিয়ে একটা গয়নার বক্স বের করে।নিজের মেয়ের জন্য একটা ছোট হার গড়িয়ে রেখেছিলো।সেই হারটা বের করে স্বামীর হাতে দিয়ে বলে,” উপহার ভালোবাসার কাছে তুচ্ছ! ভালোবাসাটাই বড়।”
মেয়ের জন্য বড় সাধ করে গয়না গড়িয়ে ছিলো মিতু।সেই গয়না দেখে জায়েদ আপত্তির স্বরে বলে,”এটা কি করে দেই?”
মিতু হাসে।চোখে একরাশ ভরসা নিয়ে বলে,”আজ ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে কালো ভালো হবে।তখন না হয় গড়িয়ে দিলে।মেয়ে তো এখনো ছোট। নাকি তোমার বোনকে পুরানো গয়না দিতে চাচ্ছো না?তোমার বোনের জন্য এখন কি আমায় স্বর্ণের পাহাড় তুলে আনতে হবে?”
জায়েদ হেসে দেয়। বউয়ের মশকরা প্রশ্রয় দিয়ে মিতুকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে।মিতু তার সংসারের ঢাল!এই ঢাল ভেঙে পড়লে জায়েদ নিঃশেষ হয়ে যাবে!
*********-
গাঢ় গোলাপি রঙের সালোয়ার কামিজ। নাকে নাক ফুল।চোখে কাজল।চুলে বেণী।যা দীর্ঘ জার্ণির ফলে এলোমেলো হয়ে আছে নীতুর।ক্লান্ত পায়ে নীতু গাড়ি থেকে নামতেই নিখিল দৌড়ে আসে। ভাইকে এমন ছুটতে দেখে নীতু ব্যস্ত কন্ঠে বলে,”আস্তে ভাইয়া পড়ে যাবি তো?”
নিখিল হেসে বোনকে জরিয়ে ধরে। পাশে সেতু দাঁড়িয়ে কান্নার ঢং করে বলে,”আমিও আছি ভাইয়া।”
ছোট বোনের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়ে নিখিলের বড় মায়া হয়।প্রেগ্ন্যাসির ঝাপটা যেন এক মুহুর্তেই ছোট বোনটাকে বড় করে দিয়েছে।আরেক হাতে সেতুকে জড়িয়ে ধরে বলে,”কেমন আছিস?”
নীতু আনমনে বাড়িটার দিকে তাকাতেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে।রঙ বেরঙের আলোয় বাড়িটা ঝলমল করছে।চারদিকে একঝাঁক আলোর বন্যা!যেন একরাশ সুখেরা হুটোপুটি করছে!
নীতুকে বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিখিল আদুরে স্বরে বলে,”পছন্দ হয়েছে?”
নীতু একগাল হেসে বলে,”খুউউব!”
নিখিল চেয়ে দেখে তার বোনের চোখ দুটো চকচক করছে।নিখিল সন্তোপর্ণে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
নীতুরা একা আসে নি।সাথি তার বাচ্চা নিয়ে এসেছে।তাজ সহ তাজের পুরো পরিবার এসেছে।এমনকি মেহেদিও এসেছে।
সবাই বাসায় প্রবেশ করতেই মহিমা বেগম এগিয়ে আসেন।দুই হাতে দুই মেয়েকে বুকের মাঝে জরিয়ে ধরেন পরম মমতায়। নীতুর কপালে চুমু খেয়ে ছোট মেয়ের ফোলা পেটে হাত বুলিয়ে হাসেন।সেতু -নীতু হাসে।মায়ের হাসির থেকে সুন্দর আর কিছু কি আছে পৃথিবীতে?
********
রাত দশটা।বাসার ফ্লোরে ঢালাও বেড পাতা হয়েছে।নীতু সেখানে শুতে নিলে জায়েদ চেঁচিয়ে ওঠে।যে মেয়ের দুদিন পর বিয়ে হবে সে কেন ফ্লোরে শুবে?
তাজ নতুন জামাই তার উপরে সেতু অসুস্থ তাদের জন্য সুরভির রুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।চাচি মামিদের জন্য এক রুম আর একরুমে ইতুর বাচ্চা,সুরভির ছেলে আর মামাতো ভাইয়ের বউয়ের জন্য একরুম ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।শুধু মায়ের রুমটা খালি।সকল কাজিনেরা ফ্লোরিং করে শুয়েছে।নীতু শত বলেও নিচে ঘুমাতে পারলো না।মায়ের রুমে সাথি আর শানের সাথে ঘুমাতে যেতে হলো। একটু পরই নিখিল এলো বোন ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে।নীতুকে চোখ বুজে শুয়ে থাকতে দেখে চলে যেতে নিলে নীতু উঠে বসে। নিখিল আদুরে স্বরে বলে,”উঠলি কেন?”
“মাথা ধরেছে ভাইয়া।”….. ক্লান্ত কন্ঠে বলে নীতু।
নিখিল হাঁক দিয়ে সুরভিকে ডেকে চা দিতে বলে।নীতুর মাথা ব্যথা শুনে জায়েদ নাপা নিয়ে হাজির হয়।নীতু হাসে।এক জীবনে যতটা অবহেলা সে পেয়েছিল তার হাজার গুন যত্ন যেন এখন ফিরে পাচ্ছে!
সুরভি চা নিয়ে আসে সবার জন্য। নীতু গরম চায়ে চুমুক দেয়। সুরভিকে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীতু কপাল কুঁচকে তাকায়। বিছানা থেকে উঠে হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে ভাইয়ের হাতে দেয়। নিখিল কপাল কুঁচকে প্যাকেট নাড়িয়ে দেখে।প্যাকেটের মুখ খুলতেই টাকার বান্ডিল বের হয়।নিখিল বোনের দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকায়। ঠিক তারপরই সুরভির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি ফেলে।সুরভি আৎকে ওঠে। নিখিল চিবিয়ে চিবিয়ে সুরভিকে বলে,” তুই সব বলেছিস আমার বোনকে তাই না?”
নীতুর মেজাজ চড়ে যায়। ভাইয়ের হাতটা ধরে ঝাকি দিয়ে বলে, “ভাইয়া, বোনকে ভালোবাসতে গিয়ে বউকে অসম্মানিত করবে।এটা কেমন কথা?ভাবি আমাকে কিছু বলেনি।এই টাকাটা আমি নিজেই এনেছি।জমানো ছিলো।এত টাকা খরচা করছো তোমার লাগতে পারে তাই।ভাই হিসেবে যেমন তুমি বোনকে পাত্রস্থ করতে কোন ত্রুটি রাখছো না তেমন বোন হিসেবে ভাইকে সাহায্য করা আমার কর্তব্য।বুঝেছো? এখনি ভাবিকে সরি বলবে তুমি।একটা পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে প্রপার সম্মান করে না তখন অন্য কেউ সেই মেয়েটিকে অসম্মানিত করতে দ্বিধা বোধ করে না।তাই এখুনি সরি বলবে তুমি!”
নিখিল ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। সুরভি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে।নিখিল নিস্তেজ স্বরে বলে,”সরি।”
নীতু কঠিন স্বরে বলে,”জোরে বলো, যেভাবে একটু আগে ভাবিকে বলেছিলে সেভাবে।”
নিখিল সেরকম ভাবে চেঁচিয়ে বলে”সরি, সরি।”
নিখিলের বলার ভঙ্গিতে নীতু জায়েদ মুখ টিপে হেসে দেয়।
সুরভি অভিমানী মুখে ঘর থেকে চলে যেতেই নিখিলও হন্ত পায়ে বউয়ের পিছু নেয়। জায়েদ হেসে এসে নীতুর পাশে বসে। ব্যথায় ভারী মাথাটা নীতু জায়েদের কাঁধে এলিয়ে রাখে।জায়েদ কিছুটা নত হয়ে বসে,নীতুর মাথা সুবিধা মত রাখতে। নীতু মৃদুস্বরে ডাক দেয়, “দাদাভাই?”
“হু…।”
“এত সুখ আমার কপালে সইবে তো?এত কেন ভয় হচ্ছে বলো তো দাদাভাই?”
“ওসব তোর মনের বিভ্রান্তি বোন।অহেতুক চিন্তা! এখন বলতো আমার ভায়রা ভাইয়ের খবর কি?”
নীতু আচ্ছন্ন হাসে।চোখের পাতা মুদে আসে।বিড়বিড় করে বলে,”দাদাভাই, মানুষটা পাগল!বড্ড বেশিই পাগল!একঝাঁক ভালোবাসা নিয়ে যখন আমার সম্মুখীন হয় তখন বড় হাঁসফাঁস লাগে!বুকের ভিতর তীব্র ঝড় শুরু হয়!এ কেমন অনুভূতি দাদাভাই?এত নিখুঁত ভালোবাসা কারো চোখে আমার জন্য দেখতে পাবো,কল্পনাই করিনি।জানো তো, বিশ্বাস হয় না।একটুও বিশ্বাস হয় না।অভীক যেন আমার জীবনের নতুন সূর্য।তার তীব্র আলোয় আমি সিক্ত! আচ্ছা দাদাভাই একেই কি ভালোবাসা বলে?তাহলে কি তাজের প্রতি আমার অনুভূতি মিথ্যে ছিল দাদাভাই?”
জায়েদ নীতুর হাত ধরে বলে,”বৈধতার স্বাদ বড়ই মিষ্ট হয়, নীতু!”
“দাদাভাই,তুমি একটু উনাকে শাসিয়ে দিও তো।আমাকে যেন একটু কম কম ভালোবাসে।এত ভালোবাসায় যে তোমার বোনের বড্ড বেশিই ভয়!বড্ড বেশি!”…….নীতু জড়ানো কন্ঠে বলে।
জায়েদ চেয়ে থাকে অপলক চোখে কৃষ্ণ মেয়েটির দিকে।যার চোখ মুখ ভাসছে তীব্র ভালোবাসার আবেশে!যা দেখতে জায়েদের বড়ই ভালো লাগছে।
************
রাত আনুমানিক তিনটা।সেতুর ঘুম আসছে না।এপাশ ওপাশ করছে।পাশে তাজ শুয়ে আছে লম্বা লম্বি ভাবে।সেদিকে তাকিয়ে সেতু সুপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রেগ্ন্যাসির কারণে এমনিতেই ঘুম হয় না।হাত পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমাতে হয়।অনেকদিন পর তাজ আর সে একরুমে, এক বিছানায়।রুমের চার দেয়ালেও যেন একরাশ অস্বস্তি মিশে আছে! সেতু আস্তে করে উঠে বসে।ঘাড় কাত করে তাজের দিকে তাকায়।নরম মৃদু নীলচে আলোয় তাজের অবয়ব স্পষ্ট।গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।প্রশস্ত বুকটা নিঃশ্বাসের তালে উঠা নামা করছে।সেদিকে তাকিয়ে সেতু ফুঁপিয়ে ওঠে।ঠোঁট ভেঙে আসে অভিমানে।মনটা যে বড়ই লোভী! ওই প্রশস্ত বুকটায় একটু ঠাই পেতে চাচ্ছে।এতটা অপমানেও বেহায়া মনটার এমন আকুপাকু ইচ্ছায় সেতু কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা লজ্জিত বোধ করছে।
সেতু উঠে মৃদুপায়ে ফ্যানটা বাড়িয়ে দেয়,একগ্লাস পানি খেয়ে বিছানায় আলতো করে শুয়ে পড়ে।চোখের কার্নিশে নির্লজ্জ জলের আনাগোনা!বড়ই অসহ্য! সেতু পাশ ফিরে শুতেই তাজ এক হাতে পেঁচিয়ে ধরে ঠিক কোলবালিশের মত।সেতু বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায়! শ্বাস প্রশ্বাসের গতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়।ঘুমের ঘোরে তাজ আরো একটু পেঁচিয়ে ধরে একদম বুকের কাছে নিয়ে আসে সেতুকে।সেতু সরে যেতে চায়।কিন্তু জোর পায় না।হাত পা অসাড়! তাজ ঘুমিয়ে আছে,সেতু আর সরে যায় না।তার চোখে রাজ্যের ঘুম জড়ো হয়েছে।সেতু গাঢ় ঘুমে ঢলে পড়তেই তাজ নিঃশব্দে সরে যায়!একদম আলতো করে। সেতুর শরীরটা কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়! পুরো বাড়িটা লাল নীল মরিচ বাতিতে ঝলমল করছে।তাজ সেদিকে তাকিয়ে থাকে বিষন্ন চোখে।চোখের ঘুম পলায়ন।বুকের ভাঁজের তীব্র ব্যথা জানান দেয় প্রিয় মানুষটার বিসর্জন কতটা যন্ত্রণাদায়ক!
*********
গোটা একটা দিন চলে গেলো নির্ভেজাল ভাবে।সবাই ব্যস্ত।নীতু সবার খুশিতে নিজেও খুশি।সব থেকে বেশি খুশি যেন ইতু আর সেতু।ক্ষণে ক্ষণে হাসছে,কাঁদছে!সেতু মাঝে মাঝে অভিযোগও করছে,কেন তার বিয়েটা আগে হলো?এখন ফোলা পেট নিয়ে কি করে নাচবে?আনন্দ করবে?বোনের বিয়ে বলে কথা।
মুহুর্ত যেতেই সেতু আর মেহেদি মিলে প্লান করতে শুরু করে সমস্ত পোগ্রাম কেমন কি হবে। তাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিলন আর জায়েদের সাথে হাত বাটায়।রাবেয়া বেগমের বড় আফসোস হয় ছেলের গোমড়া মুখখানি দেখে।
তাজ একটা লিষ্ট করছিলো।প্রচন্ড গরমে ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।পাশ থেকে নীতু যাচ্ছিল।তাজ খেয়াল না করেই নত মস্তকে বলে ওঠে, “আমাকে এক গ্লাস পানি দিতে বলবেন?”
নীতু বলে, “দিচ্ছি। ”
নীতুর কন্ঠে তাজ তাকায়। মুহুর্তেই অস্বস্তি এসে দানা বাঁধে পুরো রুম জুড়ে।তাজ ব্যগ্র কন্ঠে বলে,”সরি আমি খেয়াল করিনি।”
নীতু কিছু না বলে চলে যায়।কিছুক্ষণ পরেই এক গ্লাস লেবুর শরবত এনে পাশে রাখে।তাজ আহাম্মকের মত তাকায় নীতুর মুখপানে।নীতু স্বাভাবিক স্বরে বলে,”আমি আপনার বউয়ের আপন বোন।আমার কাছে কিছু চাইতে এতটা অস্বস্তি হওয়ার কথা না।খেয়ে নিন।সেতু ব্যস্ত।মেহেদির সাথে কিসব নাচের প্রোগ্রাম ঠিক করছে।”…..বলে নীতু চলে যায়। তাজ সেদিকে একদন্ড তাকিয়ে লেবুর শরবত টুকু ঢকঢক করে খেয়ে ফেলে।তার যে বড়ই তেষ্টা! লেবুর ঠান্ডা শরবতে কি সেই তেষ্টা মিটবে?
*********
বাহিরে মিউজিক বক্সে ধুমাধাম গান বাজছে।চুপচাপ সন্ধ্যাটা যেন মুহূর্তেই কোলাহলে ভরপুর হয়ে গেলো।নীতুর কাজিনদের হলুদের নাচের প্রিপ্রাশেন চলছে।পরন্ত সন্ধ্যাটা যেন বড়ই ব্যস্ত! সারাদিন ছোটাছুটির ফলে সেতু ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পরেছিলো।তাজ ঘরে এসে সেতুর ক্লান্ত মুখটা দেখে কপাল কুঁচকে ফেলে।তাজের উপস্থিতি পেয়ে সেতু উঠে বসে।তাজ চিন্তিত স্বরে বলে,”উঠছো কেন? রেষ্ট নাও ভালো লাগবে।”
“আমি থাকলে আপনার ভালো নাও লাগতে পারে।তার থেকে আপনি বসুন আমি চলে যাচ্ছি। “….. স্পষ্ট খোঁচা মেরে সেতু বলে।
তাজ কোমড়ে দুই হাত রেখে বলে,” সবসময় বেশি বুঝো কেন?আমি কখন বললাম, তুমি থাকলে আমার ভালো লাগবে না।”
সেতু মুহূর্তেই অগ্নিঝাঁজে ফুঁসে উঠে বলে,”সবকথা বলতে হয় না।আমার সাথে একরুমে থাকা আপনার জন্য অস্বস্তিকর আমি তা বুঝি।কালকে অর্ধেক রাতটা যে আপনি বারান্দায় কাটিয়েছেন তা বুঝি আমি জানি না,ভেবেছেন?আপির বিয়েটা হয়ে গেলেই আপনাকে আমি মুক্তি দিয়ে দেবো।এত দায়বদ্ধতা আপনাকে বইতে হবে না।পরিবারের সকলকে জানিয়ে দিবো আমার সিদ্ধান্ত। ”
তাজ বোকার মত চেয়ে থেকে বলে,”তুমি কি দিনদিন একটু বেশিই বুঝতেছো না?”
“একদম কথা ঘুরবেন না।আপনি অস্বীকার করতে পারবেন,আপির বিয়েটা আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে না?আপনি গোটা রাতটা সিগারেট খাননি?আপিকে যতবারই আপনি দেখেন ততবারই আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন,বলুন অস্বীকার করতে পারবেন?”
তাজ ফোঁস করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। নিজের উপর নাকি সেতুর উপর বুঝতে পারছে না।সেতুর রাগে টসটসে হয়ে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”হ্যা,আমার কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোমার বোন যত সহজে মুভ অন করেছে ততটা সহজ আমার জন্য নয়। আমি না পারছি গিলতে না পারছি ফেলতে।বুঝেছো?সবটা বুঝে তবুও চেঁচামেচি কেন করো? তবে এতটুকু নিশ্চিত থাকো তোমার বোনের সুখে আমি কখনো বাঁধা হবো না।”
তাজের কথায় সেতুর মেজাজ চড়ে যায়।হাতের কাছে থাকা তোয়ালেটা তাজের মুখের উপর ছুড়ে মেরে রুম থেকে বের হয়ে যায়। তাজ সেদিকে তাকিয়ে ফের দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে!সবকিছু কেমন এলোমেলো! বিধ্বস্ত!
**********
ছাদের এককোণে সেতু বসে আছে পা ছড়িয়ে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।বুকের ভিতর তীব্র দহন।চোখ জ্বলছে,কলিজা পুড়ছে।কার দোষে তার জীবনটা এমন হলো?কাকে জিজ্ঞেস করবে সেতু?
ধপ করে এসে পাশে বসে মেহেদি।সারা গা ঘামে ভেজা। প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,”তোর চাচাতো বোন গুলা কি বিচ্ছুরে সেতু।আমাকে বোকা পেয়ে পুরো নাকানিচুবানি খাওয়ালো!”
সেতু ভেজা চোখে তাকায়।সেতুর ভেজা দৃষ্টি মেহেদির বুক এফোড় ওফোড় করে দেয়। আলতো হাতে সেতুর চোখ মুছে দিয়ে বলে,”একটা গল্প শুনবি সেতুমন্ত্রী? ”
সেতু প্রশ্নচোখে তাকায়। মেহেদি বলতে শুরু করে।
“ভার্সিটির প্রথম দিন।নতুন ক্লাস।সবাই এক্সাইটেড! আমার ঠিক সামনের বেঞ্চে টকটকে ফর্সা একটি মেয়ে টকটকে লাল সালওয়ার কামিজ পড়ে বসা।একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারলাম,মেয়েটি একটু পর পর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে।আমি জিজ্ঞেস করলাম,কোন সমস্যা? মেয়েটি তাকালো।বিশ্বাস কর ঠিক সেই মুহুর্তে মেয়েটিকে ভালো লেগে গেলো।কি ধারালো চাহনি!মেয়েটি নিষ্পাপ স্বরে বললো,’পানি হবে?আমার বড় তেষ্টা পেয়েছে।’ ঠিক তখনই মেয়েটি আমার বুকে এক সমুদ্র তেষ্টা বাড়িয়ে দিলো।আমার দেওয়া পানিতে মেয়েটি তার পিপাসা মিটালেও আমার বুকে ধরিয়ে দিয়ে গেলো এক তীব্র তৃষ্ণার্ত হাহাকার! মেয়েটির চাহনি,হাসি,হাঁটা ক্ষনে ক্ষণে আমাকে মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে দিলো। যতদিন যেতে লাগলো একটু একটু করে মেয়েটির সাথে নিজের মেলবন্ধন গাঢ়তর হতে লাগলো। কি অদ্ভুত না? তারপরে কি হলো জানিস?মেয়েটি তিনদিন ক্লাসে আসলো না।আমার পাগলপ্রায় অবস্থা। বুঝতে পারলাম,মেয়েটিকে আমার চাই!ওই ওতটুকুন মেয়ে আমার পুরোটা জয় করে নিয়েছে।কি আশ্চর্য! মেয়েটি এরপরে যেদিন আসলো ক্লাসে।আমি কি করলাম জানিস?বন্ধুদের ফুলফিল ট্রিট দিলাম।কতটা খুশি ছিলাম বোঝাতে পারবো না।এরপরে একদিন মেয়েটি আমার সামনে এসে কেঁদে দিয়ে বললো,” মেহেদি তোমার কাছে নোটস হবে?খুব বড় ফেঁসে গেছি।স্যার যে ভীষণ বকা দিবে।” মেয়েটির সেই কান্না আমার বুকে ঝড় তুললো। আমি বুঝতে পারলাম।কোন প্রেম টেম না,ভালোবাসি মেয়েটাকে।তীব্র ভালোবাসি! কোন নোটস ছিল না আমার কাছে তবুও মেয়েটির জন্য রাত জেগে আমি নোট তৈরি করলাম।কি পাগল আমি।এরপরে এলো সবচেয়ে ভয়াবহ দিন।আমি জানতে পারলাম মেয়েটা বিবাহিত।বিশ্বাস কর ভেঙে পড়েছিলাম।পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠে ছিলো।মনে হয়েছিলো মরে যাই।একটা মাস ক্লাসে গেলাম না।কেউ না জানুক আমি তো জানি আমি মেয়েটাকে কতটা পবিত্র ভালোবাসি।আমার বিধ্বস্ত অবস্থা মার দৃষ্টি গোচর হলো ।সব শুনে মা আমাকে বুঝালো।আমি পাগলের মত কেঁদেছিলাম জানিস? মা তখন কি বললো জানিস? ভালোবাসাটাই মুখ্য!ভালোবাসায় কোন প্রতিদান,বিনিময় থাকতে নেই।তবে সে অনুভূতি মূল্যহীন হয়ে যায়। এরপরে সেই মেয়েটির সামনে আমি আবার দাঁড়ালাম।মেয়েটা নিজেও তখন এলোমেলো। শুদ্ধতম সম্পর্কের হাত বাড়িয়ে ধরেছিলাম তার দিকে।সেই মেয়েটি আজ আমার বন্ধু! আমি আজন্ম যেমন তাকে ভালোবাসবো,তেমন আজন্ম তার পবিত্র বন্ধু হয়ে থাকবো।আমি হয়তো প্রেমও করবো,ভালো দেখে কোন মেয়েকে বিয়েও করবো তবুও সেই মেয়েটির প্রতি আমার ভালোবাসা এতটুকু কমবে না।সেই অনুভূতি প্রখর,প্রগাঢ় থাকবে।ভালোবাসা এমনই!খুব যত্নে গড়া অনুভূতি। আমি মেয়েটি বিবাহিত জেনেও তাকে কখনোই ভালবাসতে ভুলে যাবো না।কেননা আমার ভালোবাসা টুকু কেবল একান্তই আমার।সেখানে কারো অধিকার নেই।যত্নে গড়া ভালোবাসা টুকু যত্নেই লালিত করবো বুকের মাটিতে।কাউকে খুঁড়তে দিবো না।তাজকে দোষ দিস না সেতু।মানুষটা ভালোবেসেছে।যেমন তুই তাকে বাসিস।তুই কিন্তু জানতি সে পরিস্থিতির স্বীকার।তবুও ভালোবেসেছিস।ভালোবাসায় কারো হাত নেই।আমি তোর বন্ধু, ভুল বুঝিস না।তুই প্রথমেই চলে আসতে পারতি এলি না।তোকে মানিয়ে নিতে বলবো না।তোর সকল সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নেবো। তবু এতটুকু বলবো বিনিময়হীন ভাবে সবাই ভালোবাসতে পারে না।যদি সারাটাজীবন এক পাক্ষিক ভাবে ভালোবেসে মানুষটার হাত ধরে রাখতে পারিস তবেই আগাস।নতুবা না! যদি মানিয়ে নিয়ে পথ চলতে চাস তবে মুখ থুবড়ে পড়ে যাবি আর যদি ভালোবেসে হাতটা ধরে রাখিস তবে সবটা সহজ হবে।ভালোবাসার তীব্র ক্ষমতা! ভালোবেসে সংসারী সন্ন্যাসী হয় আর সন্ন্যাসী হয় সংসারী, কেউ খুন করে আবার কেউ শত খুন ভুলে মন পড়ে! ”
সেতু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকিয়ে থাকে প্রিয় বন্ধুটির দিকে।যে কখনোই সেতুকে বুঝতে দেয়নি তার সুপ্ত অনুভুতি।সেতু মুখ ঢেকে কেঁদে ওঠে। বিড়বিড় করে বলে,”আমি আমার প্রিয় বন্ধুকে হারাতে চাই না।কখনোই না।”
“হারাতেও হবে না।তুই কখনোই জানতে পারতি না যদি আমি না বলতাম।আজও বাধ্য হয়ে বলেছি তোকে সবটা বুঝানোর জন্য! আমি তোর বন্ধু, কেবল বন্ধু। এখন কান্না থামা!”
“কেন তোর সাথে আমার আগে দেখা হলো না মেদু?কেন?কেন এতটা ভালোবাসা আমার কপালে বৈধতা হয়ে এলো না?”
“কারণ আমরা খুব ভালো বন্ধু হবো তাই।আর কখনোই আমার অনুভূতি টুকুকে অবৈধ বলবি না সেতু।ভালোবাসা টুকু একান্তই আমার।খুব পবিত্র আর নিষ্পাপ! আজকের পর সব ভুলে যাবি। ”
সেতু তবুও কাঁদে।মেহেদি উঠে চলে যায়। সেতু অনেক অনেক ক্ষণ পর ধীর পায়ে হেঁটে রুমে যায়।চোখে মুখের পরিস্থিতি বিধ্বস্ত! তাজ শুয়েছিল সিলিং এর দিকে তাকিয়ে। সেতুর কি হলো কে জানে।একছুটে তাজের বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে।হু হু করে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় বুক।তাজ চমকে ওঠে। বেসামাল সেতুকে কি করে সামলাবে বুঝে পায় না।সেতু যেন পাগল প্রায়!কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে তাজের বুক।তাজ বাঁধা দেয় না।সেতু অনুযোগের স্বরে বলে “কেন ভালোবাসলেন না আমায়?কেন?কোথায় কমতি আমার?বলুন তাজ?আমার কষ্ট কেন মুছে যায় না বলুন তো?কেন ভালোবাসলাম আমি আপনাকে?ভালোবাসায় কেন এত তীব্র কষ্ট? ”
সেতুর এলোমেলো কথায় তাজ আহত চোখে তাকিয়ে থাকে।সেতুর কষ্টে তাজের নিজেরও কষ্ট হচ্ছে। তাজ শক্ত করে সেতুকে বুকের মাঝে জরিয়ে ধরে।তবুও সেতু শান্ত হয় না।পিঠের কাছটা আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করে ফেলে। তাজ বিড়বিড় করে বলে,”আমাদের দু’জনের মনের মিল না হয়েও কতটা মিল দেখেছো সেতু?আমরা দু’জনেই ভালোবেসে অভাগ্যকে বরণ করেছি!”
সেতু তবুও হাত পা মুচড়িয়ে কাঁদে।তাজের কথা তার শ্রবণ হয় না।এত দিনের ধৈর্যের বাঁধ যেন ঝরঝর করে ভেঙে পরেছে।মিউজিকের জোড়ালো শব্দে সেতুর কান্নার শব্দ ভাটা পরলেও তাজের বুকটা ঠিকই ক্ষত বিক্ষত করে দিল!
**********
ভোর চারটা।সাথি মরার মত ঘুমাচ্ছে।শান নড়েচড়ে নীতুর বুকের মাঝে শুয়ে পড়ে।নীতু মৃদু হেসে আলতো করে শানকে বিছানায় শোয়ায়।ঠিক তখনই মোবাইলটা ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে। এত ভোরে অভীককে কল করতে দেখে নীতু চমকিত! কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে চাপা কন্ঠে অভীক আদেশের স্বরে বলে,”এখখুনি নিচে আসো নীতু।জাষ্ট পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ”
নীতু ঠিকঠাক চমকানোর সময়ও পেলো না।দ্রুত পায়ে নিচে বের হতেই দেখতে পায় অভীক রাস্তার অপজিটে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। নীতু রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে,”আপনি?”
অভীক মুহুর্তেই নীতুকে যেন বুকের ভিতর লুফে নেয় যেমন করে বল ক্যাচ করে।ঠিক সেভাবে নীতুকে ক্যাচ করে চোখে চোখ রেখে বলে,
“হুট করেই আমার তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছিলো নীতু।মনে হচ্ছিল তোমাকে এখন না দেখলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসবে।তাই চলে এলাম। ভালো করিনি কাননবউ?”
নীতু মনে মনে নিজের কপাল চাপড়ায়।অভীকের উদ্ভট কথায় বিরক্ত হয়ে বলে “ছাড়ুন….কেউ দেখে ফেলবে।”
“দেখুক….আমার বউ আমি তাকে ধরে না থাকি কোলে নিয়ে থাকি, তাতে কার কি?আমার কষ্ট তো কেউ দেখছেনা?”…..অভীকের কন্ঠে অভিমান গলে গলে পড়ে।
নীতু ঠোঁট চেপে হাসি রোধ করে বলে,” কোথায় কষ্ট আপনার?”
অভীক এক হাতে নীতুকে আগলে রেখে আরেক হাত দিয়ে প্রথমে চোখ তারপর কপাল,গাল,ঠোঁট, শেষে বুকের বা পাশটা দেখিয়ে বলে “এই সবখানেই কষ্ট! তীব্র কষ্ট!একদম ঝাঁজালো কষ্ট!”
“কি করে দূর হবে এতো এতো কষ্ট?”…..নীতু মৃদুস্বরে বলে।
” এর জন্য এখন কাননবালার সাথে কিছুটা একান্ত সময় কাটাতে চাই।”……নীতুকে ছেড়ে দিয়ে বলে অভীক।
নীতু আপত্তি জানাতে গেলে অভীক কঠিন স্বরে বলে,”আমি কোন ট্যা টু শুনতে চাই না।বাড়িতে আসার পর আমাকে ভুলে বসে আছো।তাই এখন আমার তোমাকে চাই।”
*********
অভীকের আবদারে নীতুকে থ্রিপিস পাল্টে শাড়ি পড়ে আসতে হয়েছে।অভীক আর নীতু দাঁড়িয়ে আছে রুপসার চার নম্বর ঘাটে।সবে মাত্র ভোরের আকাশ উজ্জ্বল হতে শুরু করেছে।ঘাটে একটা নৌকা বাঁধা। নৌকাটায় একটা অল্প বয়সী ছেলে বসে আছে কুড়ো মুড়ো দিয়ে। হাতে বৈঠা।নীতুর হাত ধরে অভীক ঘাটের বড় বড় সিড়ি মাড়াতে সাহায্য করে।নীতু হাঁটা থামিয়ে বলে,”আমরা কি নৌকা ভ্রমণে যাচ্ছি?”
“না প্রেম করতে যাচ্ছি,নৌকা প্রেম।”….. অভীকের ত্যাড়া উত্তর।
নীতু ভেঙচি কেটে সিঁড়ি মাড়িয়ে ঘাটের নীচে চলে আসে।
অভীক হাসে,নীতুর রাগ দেখে।
চারপাশে টলমল নদীর পানি।দুয়েকটা স্টীমার দাঁড় করানো।ঠান্ডা বাতাসে নীতুর শাড়ির আঁচল উড়ছে,সাথে উড়ছে অবাধ্য চুলগুলো! অভীক চেয়ে চেয়ে দেখে।ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ হয়।ওই পদ্মদিঘির মত গভীর চোখ দুটোতে ডুব দিতে ইচ্ছে করে!অভীক আর একটু কাছে এগিয়ে বসে নীতুর কপালে পরে থাকা চুলগুলো কানের পিছনে ঠেলে দিয়ে বলে,” ভালো লাগছে?”
নীতু আঁড়চোখে একবার নৌকার মাঝির দিকে তাকায়। ছেলেটা একবারো এদিকে তাকাচ্ছে না।এক মনে নৌকা বাইছে।তার মানে সে এসব কাজে অভ্যস্ত। পরক্ষণে নীতু অভীকের দিকে ফিরে বলে,”খুব…আচ্ছা আপনাদের ওদিকের কি খবর?”
অভীক নীতুর বাম হাতটা টেনে নিজের হাতের মুঠোয় আনে।মাথা নত করে আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে বলে,”সবাই বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। ভালো কথা বড়ো বাবা হতে চলছে।ছোট্ট একটা পুচকু আসবে আমাদের ঘরে।”
নীতু প্রশস্ত হেসে বলে,”অভিনন্দন পুচকুর চাচ্চু!”
অভীক একবার ঘাড় উচু করে নীতুর দিকে তাকিয়ে হাসে।তারপর বলে,”তোমাকেও অভিনন্দন পুচকুর কাকিমণি!দোয়া করি খুব দ্রুত পুচকুর জন্য একটা ভাই বোন নিয়ে আসো।”
“নির্লজ্জ পুরুষ মানুষ!”….. নীতু কপট রাগ নিয়ে বলে।
অভীক নীতুর উক্তিতে গা দুলিয়ে হাসে।ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝি ছেলেটাকে বলে,” ইবলু তোমার ভাই ভাবী প্রেম করছে ভুলেও এদিকে তাকাবে না কিন্তু। তোমার ভাবী আবার একটু বেশিই লাজুক কিনা!”
অভীকের কথায় ছেলেটি মাথা ঝাকিয়ে হাসে।
নীতু আরক্ত চোখে তাকায়। বিড়বিড় করে বলে, অসভ্য!
অভীক গালি শুনে বড় বড় চোখ করে বলে,”আপনার তো ভীষণ সাহস মিসেস নীতু।অফিসের স্যারকে লোক সম্মুখে গালি দিচ্ছেন।ছি! ছি! ”
নীতু অভীকের অভিনয়ে বিস্মিত।আবার মানুষটার ছেলে মানুষিতে ভালোও লাগছে।
অভীক গলা খাকারি দিয়ে বলে,”মিসেস নীতু,মিস থেকে মিসেস হয়ে গেলেন অনুভূতি কি?”
“অনুভূতি খুবই ঝাঁজালো স্যার।কখনো প্রখর,কখনো প্রগাঢ়! ”
“বর বুঝি খুব ভালোবাসে?”…… অভীকের আচ্ছন্ন কন্ঠ।
” খুউউউব!…..”
“তাহলে কি আপনি ভীষণ সুখী মিসেস নীতু?”…..অভীক প্রশ্ন করলেও হাতের মুঠোয় তখনও বিদ্যমান নীতুর আঙুল গুলো।যা ক্রমাগত নড়াচড়া করছে অভীক।
” আমি ঠিক ততটাই সুখী যতটা সুখী হলে নির্ঘুম রাতগুলোয় হাজারো নিশ্চিন্ত ঘুম এসে জড়ো হয়!নির্দ্বিধায় আয়নার সামনে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজেকে কারো আরাধ্যা মনে করে কাটিয়ে দেয়া যায় ঠিক ততটুকুই সুখী আমি!ঠিত এতটুকুই সুখী আমি যতটুকু হলে আমার চৌকাঠে, আমার উঠোনে সুখেরা একের গায়ে আরেকজন লুটিয়ে পড়ে, ঠিক ততটুকুই সুখী!’
বলতে বলতে নীতুর চোখ ছলছল করে ওঠে।
অভীক ঠোঁট কামড়ে হাসে। নীতু এবার প্রশ্ন করে,”আর আপনার কাননবউ?সেকি ভালো টালো বাসে আপনাকে স্যার?”
অভীক এবার মাথা নত করে নীতুর ভাঁজ করা হাটুর উপর থুতনি রেখে মুখোমুখি বসে।চোখে কেমন মাদকতার আভাস!ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি। নদীর হীম বাতাসে অভীকের কপালে ছড়িয়ে পড়া চুলগুলো উড়ছে।শুভ্র গাল দুটো রক্তিম!নীতু চোখ ফিরিয়ে নেয়।মানুষটা বড়ই সুন্দর!চোখ ধাঁধানো সুন্দর! বেশিক্ষণ চেয়ে থাকা যায় না। নীতুর দৃষ্টি ফিরানো দেখে অভীক আলতো হাসে। ফিসফিস করে বলে,”জানো তো নীতু,আমার কাননবউ আমাকে ভালোবাসে না তবে আমার দূরে থাকাও সহ্য করতে পারে না।কাছে আসলে আবার ভীষণ অস্থিরতায় নিমজ্জিত থাকে।তখন কেমন হাঁসফাস করে!আমার অগোচরে আমাকে সে নিঁখুত পর্যবেক্ষণ করে,ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে থাকে।আমার ছোট ছোট আদরগুলো ভীষণ আদরে আগলে রাখে!আমার ভালোবাসায় তার চোখ ভারী হয়!এসব শুনে তোমার কি মনে হয়?আমার কাননবউ আমাকে ভালোবাসে?”
নীতু কিছু বলতে পারে না।চোখ দুটো ভিজে আসে ক্রশশই।অভীক নামক পুরুষটি কেবল তার,মানুষটার সকল ভালোবাসা তার ভাবতেই চোখ ভিজে আসতে চায়!
নীতুর চোখে পানি দেখে অভীক নীতুর হাতের উল্টোপিঠে আদুরে চুমু দিয়ে বলে,”ভালোবাসি তো কাননবউ, তবুও কি তুমি কাঁদবে?”
নীতু চোখে জল নিয়েই হেসে দেয়।অভীকের কথায় মনে হচ্ছে নীতু অভীকের ভালোবাসা পাওয়ার
জন্য কাঁদছে।কিন্তু এই এত এত ভালোবাসা পেয়ে যে নীতু কাঁদছে তা কি বুঝতে পারে না মানুষটা?
অভীকের প্রখর, প্রগাঢ় চাহনি নীতুকে বেসামাল করে! দৃষ্টি দিগ্বিদিক ঘুরিয়ে ফাঁকা ঢোক গিলে।ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ।চারদিকে কত পানি তবুও কেন এত পিপাসা!নীতু অভীকের ওমন দুর্ভেদ্য চাহনি নিতে পারে না।লুকানোর স্থান খুঁজে হতাশ হয়!যেদিকে চোখ যায় সেখানেই পানি। কোথায় যাবে নীতু? নীতুর এলোমেলো চাহনি অভীকের ভীষণ ভালো লাগে। সে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে। ঠিক তখনই নীতু তার লুকানোর যোগ্য স্থান খুঁজে পায়।একদম নিরাপদ, পবিত্র স্থান!
নীতু কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে ওঠে, “আমি একটু আপনার বুকে মাথা রাখি অভীক?জাস্ট একটুখানি!ঠিক এক চিমটির মত!একটুও বিরক্ত করবো না বিশ্বাস করুন।দেখুন না কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে।ঠিকঠাক নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।আপনার বুকের বা পাশে যে আমার শুদ্ধতম শ্বাস-প্রশ্বাসের বাস, তাকি আপনি জানেন অভীক?”
অভীক ভীষণ অবাক হয়।নীতু ঠিক তারমত করেই বলছে।ভেরি ইম্প্রেসিভ!তার বউটা ভালোবাসা শিখে যাচ্ছে খুব দ্রুত। শিক্ষক হিসেবে নিজের পিঠে নিজেরই বাহবা দিতে ইচ্ছে করছে।
অভীক হাত বাড়িয়ে নীতুকে বুকের ভিতর নিয়ে আসে।বাধ্য মেয়ের মত নীতু চুপটি করে মাথা রাখে অভীকের বুকে।নীতুর মনে হলো একপশলা ঝুম বৃষ্টির মত প্রশান্তি চোখের উপর ভর করেছে!চোখ দুটোও ক্রমেই জড়িয়ে আসতে শুরু করে।প্রশান্তিতে নাকি ঘুমে, নীতু বুঝতে পারে না। কেবল বুঝতে পারে এখানেই তার চির সমাপ্তি!
অভীক চেয়ে থাকে নদীর অদূর পাড়ে!দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন এক সমুদ্র ভালোবাসা, শুধুই কৃষ্ণবতী মেয়েটির জন্য! যে মেয়েটি তার কাননবালা!কাননবউ!
চলবে,