কাননে ফুটিল ফুল পর্ব-০৪

0
315

কাননে ফুটিল ফুল — ৪ (১৭৮০+ শব্দ)

সেদিনের পর আয়েশা ভয়ে বাসা থেকে বের হওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। কিন্তু সময়ে অসময়ে সেই বিদেশী যুবককে দেখা যেতে লাগল আফরোজাদের বাসার সামনের রাস্তায়। এই আগমন যে শুধু ওর জন্যই সেটা বুঝে গেল আয়েশা।

দিনগুলো চলে যেতে লাগল, দেখতে দেখতে আয়েশার দেশে ফেরার সময় হয়ে এলো। ততদিনে আয়েশার মনেও ভালোবাসার স্ফুরণ হচ্ছে একটু একটু করে৷ কিন্তু সাহস করে এগিয়ে গিয়ে বলতে পারছিল না কিছুই। অপরপক্ষও এগুচ্ছে না। শেষে আয়েশা নিজেই প্রথম পদক্ষেপ নিল। সুন্দর এক রৌদ্রস্নাত সকালে বাসার অপজিটের রাস্তায় পার্ক করে রাখা গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেল ও। যুবকটি কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। আয়েশা আলাপ শুরুর জন্য হাসি দিয়ে বলল,
“হ্যালো, মিস্টার…।”

“সুলাইমান জায়ান। ইয়্যু ক্যান কল মি জায়ান।”

প্রচন্ড নার্ভাস লাগা সত্ত্বেও নিজের ইংরেজি ভাষার দৌড় যতটুকু ছিল সবটা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল আয়েশা। কিছুদিন পরে আয়েশা দেশে ফিরে যাবে। যেহেতু সে কিছুদিন আগে আয়েশাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল, তাই আয়েশা কৃতজ্ঞ তার প্রতি।

জায়ান মনোযোগ দিয়ে শুনল আয়েশার কথা। কি বুঝল সে কে জানে। তবে কিছুক্ষন চুপ থেকে সরাসরি প্রস্তাবটা দিল সে,
“আই থিংক, আই অ্যাম ইন লভ উইদ ইয়্যু। উইল ইয়্যু ম্যারি মি, মিস আয়েশা?”

কোথা থেকে যেন একরাশ লজ্জারা এসে আছড়ে পড়ল আয়েশার উপর। তবুও স্পষ্ট জবাব দিল ও, “ক্যুড ইউ প্লিজ ডিসকাস দিজ ম্যাটার উইদ মাই ফ্যামিলি? ইফ দে এগ্রি, দেন আই হ্যাভ নো প্রব্লেম।”

তারপরে চড়াই উৎরাই কম যায়নি। যদিও জায়ান মুসলিম ছিল তবুও আফরোজা বেগম এবং তার স্বামী আপত্তি করলেন শুরুতেই৷ আয়েশার মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ্য একসময় মেনে নিতে হলো। কিন্তু তবুও চিন্তা একটা রয়ে গেল আয়েশার বাবা আতিউর রহমানকে নিয়ে৷ ওরা সবাই বুঝতে পারছিল, আতিউর রহমান খুব সহজে মেনে নেবেন না এসব।

অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো, জায়ান তার বাবা মাকে সাথে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে প্রস্তাব দেবে সরাসরি। সবাই মিলে বোঝালে নিশ্চই তিনি অমত করবেন না। আয়েশা দেশে ফিরে গেল। তার কয়েকমাস পরে জায়ান সত্যিই তার বাবা মাকে নিয়ে বাংলাদেশে গিয়ে প্রস্তাব দিল আতিউর রহমানের কাছে। আয়েশা ভেবেছিল বাবা অমত করলেও নুন্যতম সম্মানটুকু দেবেন তাদের। কিন্তু জায়ান এবং তার বাবা মাকে অপমান করে তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন আতিউর রহমান। আয়েশার জেদ চাপল সেদিনই৷ বাবার অমতে গিয়ে সবার সামনে সেদিন ও বলল, বিয়ে করতে হলে সে ওখানেই করবে।

আতিউর রহমান মেয়ের এমন স্পর্ধা মেনে নিতে পারলেন না। সেদিন নিজ দায়িত্বে কাজি ডেকে জায়ানের সাথে আয়েশার বিয়ে দিলেন তিনি৷ এবং তারপরেই তার এবং তার পরিবারের জন্য আয়েশাকে মৃত বলে ঘোষনা করলেন। দুজনের কেউই তার ইগো থেকে একচুল নড়তে রাজি ছিল না। আয়েশা সেদিন এক কাপরে বাড়ি ছাড়ল। সেই শেষ। নিজের জীবদ্দশায় আর একবারের জন্যও দেশের মাটিতে পা রাখেনি সে।

রাতের পর রাত নিজের আপনজনের কথা মনে করে কেঁদেছে, কিন্তু একবারেরও জন্যও তাদের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়নি কখনও। আয়েশা সবসময় নৈশীর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেশে ফিরতে চাইলেও পরিবারের কারও মুখ দেখতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

জায়ান মাঝেমধ্যে বলত,একবার অন্তত তাদের কাছে যেতে। বাবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইতে, কিন্তু আয়েশাকে রাজি করাতে পারেনি কখনও। আয়েশার একমাত্র যোগাযোগ ছিল আফরোজা বেগমের সাথে। সেই যোগাযোগও একসময় অনেকটা কমে এলো। আয়েশার বিয়ের এক বছর পরে আফরোজা বেগমের স্বামী ওখানকার চাকরির পাট চুকিয়ে দেশে এসে থিতু হলো। ফোনে দুবোনের যোগাযোগ হতো সবসময়, তবুও কোথাও একটা শূন্যতা, হাহাকার থেকেই যেত। আফরোজা বেগমের স্বামী অন্যতম একজন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন আয়েশা এবং জায়ানের। কিন্তু তার মৃত্যুতেও দেশে আসেনি আয়েশা শুধু ওর পরিবারের মুখোমুখি হতে হবে বলে।

জায়ান তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করত আয়েশাকে ভালো রাখার৷ একটা মেয়ে তার সব কাছের মানুষের বিরুদ্ধে গিয়ে মাত্র কয়েকমাসের পরিচয়ে বিশ্বাস করে হাত ধরেছিল ওর। তাই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে এতটুকু কার্পন্য করেনি কখনও জায়ান।

আয়েশা অবশ্য মানিয়ে নিয়েছিল নিজেকে। জায়ানের ভালোবাসা, নৈশীর জন্ম, সব মিলিয়ে খুব সুন্দর যাচ্ছিল ওর সময়। শূন্যতা যেটুকু ছিল তা শুধু আপনজনের থেকে দূরে থাকার।

বাবা মায়ের পরিচয় থেকে শুরু করে এই পুরো ঘটনা নৈশী শুনেছে বিক্ষিপ্তভাবে। কিছুটা মায়ের কাছে, কিছুটা বাবার থেকে আর বাকিটা খালার কাছ থেকে৷

নৈশী স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিরল। কয়েকটা জোনাকি তখনও এলোমেলো উড়ে বেড়াচ্ছে ওর চারপাশে।

৫.
সাব্বিরের সহজাত বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা হলো, ও প্রচন্ড ঘুমকাতুরে। দুবেলা না খেয়ে ও দিব্যি থাকতে পারবে, কিন্তু না ঘুমিয়ে কক্ষনো নয়। গতকাল পুরো রাতটাই জাগতে হয়েছে ওকে। ডেনমার্কের একটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোগো ডিজাইন করতে হয়েছে সারারাত জেগে। সকালে ঘুমঘুম চোখে কোনোরকমে নাস্তা করে তারপর ঘুমাতে গেছে ও। যাওয়ার আগে মাকে বলে গেছে, বাসায় টর্নেডো হয়ে গেলেও দুপুরের আগে ওকে যেন কেউ না ডাকে।

বিছানায় শোয়ার মিনিটখানেকের মাথায় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সাব্বির। কিছুক্ষনের মধ্যে স্বপ্ন দেখাও শুরু করে দিল ও৷ কোনো এক কিশোরী বালিকা খিলখিল শব্দে হাসছে। সুললিত সেই হাসির শব্দ শুনে সাব্বির এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে৷ মেয়েটাকে শুধু পেছন দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে৷ সাব্বিরের খুব ইচ্ছে হলো সামনে থেকে মুখটা দেখার জন্য৷ ও ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। তারপর মেয়েটির মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতেই আঁতকে উঠল। মেয়ে কই? এযে একটা ভূত। হাসিটাও এখন আর সুন্দর নেই, কেমন বীভৎস।

সাব্বির একলাফে উঠে বসল বিছানায়। রাত জেগে কাজ করায় এবং ঠিকভাবে ঘুমাতে না পারার জন্যই এসব উল্টোপাল্টা ব্যাপার দেখছে স্বপ্নে। সাব্বির আবার ঘুমাতে গেল, তখনই খেয়াল করল, সত্যি সত্যিই কেউ হাসছে।

ওর মেজাজ চটে গেল পুরোপুরি৷ হন্তদন্ত হয়ে ও হেঁটে গেল পাশের রুমে। সেখানে গিয়ে ওর চোখ ছানাবড়া। আফরোজা বেগম, নৈশী আর জ্যোতি নতুন জামাকাপর পরে সাজগোজ করছে। সাব্বির হুংকার দিল, “হচ্ছেটা কী এখানে?”

আফরোজা বেগম জবাব দিলেন,
“সেকি, ভুলে গিয়েছিস? গতকাল রাতেই তো বললাম, আজ দুপুরে রায়হানদের বাসায় দাওয়াত আছে।”

সাব্বিরের মনে পড়ল হঠাৎ। গতকাল রাতে মা গিয়েছিল ওর রুমে কী একটা বলতে। কিন্তু তখন সাব্বির ল্যাপটপে এতটাই ডুবে ছিল যে মায়ের কথা একটাও শোনেনি মনোযোগ দিয়ে। ও বলল,
“দাওয়াত আছে ভালো কথা, চুপচাপ রেডি হয়ে যাও না। এত চ্যাঁচামেচির কী আছে? আর এই জ্যোতি, এত জোরে হাসে কেউ? বাড়িতে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে তোর হাসিতে৷ এই বিদঘুটে হাসির শব্দে ঘুমাতে পারছি না। দূর হ চোখের সামনে থেকে।”

জ্যোতির অবশ্য এসব কথায় কোনো ভাবান্তর হলো না। খাটের এককোনে বসে পা দুলিয়ে ও বলল, “অদ্ভুত কথা বলো, এখন কি তোমার জন্য ঘরের মানুষ সব মৌনব্রত পালন করবে? কেন হে? কোথাকার কোন লাটসাহেব তুমি? সারাদিন খাওয়া আর ঘুমানো ছাড়া তো কোনো কাজ নেই। এতই যদি ঘুমের সমস্যা হয় তাহলে যাও, নিজের রুমটা সাউন্ডপ্রুফ করে নাও। আমি এভাবেই হাসব।”

সাব্বিরের মেজাজ তেতে গেল পুরোপুরি,
“চেহারা তো দেখতে পেত্নির মতো, এদিকে ডাইনি বুড়ির মতো শব্দ করে হাসিস, চোপার জোরও কম না। এত দোষ নিয়ে শ্বশুড়বাড়ি কীভাবে যাবি? তোকে তো সামনের দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পেছনের দরজা থেকে বের করে আবার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।”

সাব্বিরের কথায় এবার কাজ হলো। এতক্ষন ডোন্ট কেয়ার মুডে থাকা জ্যোতি ক্ষেপে গেল ভীষণ,
“চাচি, তোমার ছেলে আমাকে ডাইনি এবং পেত্নি বলেছে। তুমি এক্ষুনি এর একটা বিহিত করবে। নইলে আমি আর তোমাদের বাড়ি জীবনেও আসব না।”

জ্যোতির বলতে দেরি নেই তার সাথে সাথেই আফরোজা বেগম এগিয়ে গিয়ে সপাটে চড় বসালেন সাব্বিরের গালে।
“ঘুমটুম সব বাদ। তুই এখন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হবি। তারপর আমাদের সাথে রায়হানদের বাসায় যাবি।”

সাব্বিরকে চড় খেতে দেখেও জ্যোতির রাগ কমল না। আফরোজা বেগম এবার ওকে বললেন,
“তুই রাগ করিস না, মা। জানিসই তো, ওর মতো অকর্মণ্য পাগলের কথায় আমরা কেউ কান দেই না।”

সাব্বির বজ্রাহতের মতো তাকাল মায়ের দিকে, “আম্মু, তুমি ওর জন্য আমাকে এভাবে অপমান করতে পারলে? আমি তোমার ছেলে আম্মু।”

“সেটাই তো মুসিবত। আমার সারজিম বাবা কতো ভালো। আর আমার পেটে হয়ে তুই এমন বদমাইশ যে কীভাবে হলি সেটাই আমি ভেবে পাই না।”

এত অপমান! সাব্বির আর এক মিনিটও দাঁড়াল না। নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরল। এত অপমান সহ্য করে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো মানেই হয় না। পেছন থেকে আফরোজা বেগমের গলা শোনা গেল আবার,
“দশ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বের হবি রুম থেকে। নইলে আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।”

সাব্বির দশ মিনিটের মধ্যেই রেডি হয়ে নিল। ওকে এখন দেখাচ্ছে যুদ্ধে পরাজিত সৈনিকের মতো। সেই চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে জ্যোতি হেসে ফেলল আবার। সাব্বির চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে। পাশে আফরোজা বেগম আছে বিধায় কিছু বলতে পারল না।

তাড়া দিল সাব্বির, “কই, চলো।”
“নৈশী আসুক আগে।”

নৈশী কাল রাতেও একবার বলেছিল। আজ আবারও সেই কথাই রিপিট করল,
“খালামনি, আমি না গেলে হয় না? তোমাদের ইনভিটেশন, তোমরাই নাহয় যাও।”

“ধূর বোকা মেয়ে। তোকেও তো রায়হান দাওয়াত করেছে। না গেলে ও খুব মনে কষ্ট পাবে। ছেলেটা আসলে আমাদের খুব আপন মনে করে। রায়হানের বাবা আর তোর খালু খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। আমাদের দুই পরিবারের সদস্যরা তাই মিলেমিশে থাকি সবসময়। তুই যেহেতু এখানে আছিস তাই তুইও এই পরিবারেরই একজন।”

রায়হানদের বাসা দুই বিল্ডিং পরে বলে হেঁটেই রওয়ানা হলো সবাই। সাব্বির তখনও ঘুমে ঢুলছিল। আফরোজা বেগম আর জ্যোতিকে সামনে এগুতে বলে সাব্বিরের পাশাপাশি এসে হাঁটতে শুরু করল নৈশী,
“কী ব্রো? এখনও ঘুমের রেশ যাচ্ছে না?”
সাব্বিরের কন্ঠস্বর করুণ শোনালো, “একদম না, এখন ঘুমাতে না পারলে আমি মনেহয় মরেই যাব নৈশী আপু।”
নৈশী হাসল, “তোমার এই সমস্যার একটা ইফেক্টিভ সলিউশন আমি তোমাকে দিতে পারি।”
“তাহলে আর ওয়েট কেন করছ! জলদি দাও।”

“ব্যাপারটা পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক। চোখ বন্ধ করো, লম্বা একটা শ্বাস নাও। তারপর নিজেই নিজেকে মনে মনে বলো, কাল রাতে তোমার চমৎকার একটা ঘুম হয়েছে। এটা শুধু বললে হবে না, নিজেকে বিশ্বাস করাতে হবে যে সত্যিই তোমার রাতে ভালো ঘুম হয়েছে। যদি মন দিয়ে কাজটা করতে পারো, তাহলে কিছুটা হলেও তোমার এই ঘুমের রেশ যাবে আশা করি।”

সবাইকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে সাব্বির সত্যিই নৈশীর কথামতো কাজটা করল। এবং অবাক হয়ে খেয়াল করল ওর ঘুম ঘুম ভাব অনেকটাই কমে এসেছে। শরীরটাও কিছুটা ফুরফুরে লাগছে।

রায়হান-রুবিনা দম্পতিকে দেখে নৈশীর প্রচন্ড রকমের ভালো লাগল। এত সুন্দর আন্ডারস্ট্যান্ডিং দুজনের মধ্যে। বিশেষ করে রায়হান লোকটা এত মজার একটা মানুষ। নিমন্ত্রিত বাসায় যাওয়ার পর সবার আগে যেটা নিয়ে খচখচ করল নৈশীর মনে সেটা হলো বাড়িতে কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই। জ্যোতির থেকে জানা গেল বিষয়টা। তারা নিঃসন্তান দম্পতি। বিয়ের বয়স বারো বছর হয়ে গেলেও রুবিনার সমস্যার জন্য সন্তান নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছে রুবিনা কখনোই মা হতে পারবে না।

দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে আড্ডা জমে উঠল। নৈশী তেমন কোনো কথা বলছিল না। একপাশে বসে সবার কথোপকথন শুনছিল। রায়হান খেয়াল করল সেটা। নৈশীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল ও,
“নৈশী, বয়সে তুমি আমার চেয়ে অনেক ছোট হবে। তোমাকে তুমি করেই বলি তাই।”
“অবশ্যই, বলুন।”
“আশার পর থেকে সম্মোধনহীন কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছ, তুমি চাইলে আমাকে ভাইয়া বলে ডাকতে পারো। আর তুমি বোধহয় এখনও ইজি হতে পারছ না ঠিক। মনে করো, এটা তোমার নিজের ভাইয়ের বাসা, তাহলেই দেখবে সব সহজ হয়ে যাচ্ছে।”

সত্যিই নৈশীর কিছুটা অপ্রস্তুত লাগছিল এতক্ষন। রায়হানের আন্তরিক কথাগুলো শুনে আগের চেয়ে কিছুটা সহজ হতে পারল ও।

আফরোজা বেগম উপযুক্ত একটা সুযোগ খুঁজছিলেন, কথায় কথায় এবার সাব্বিরের কথা তুলেই ফেললেন তিনি, “রায়হান, তোমার সাথে একটা দরকারি কথা ছিল।”

“জ্বি খালাম্মা, বলেন।”

“না মানে, আমাদের বাসায় তো একটা গরু আছে। সারাদিন খাওয়া, ঘুমানো আর বসে বসে জাবর কাটা ছাড়া তো তার আর কোনো কাজ নাই। সেই গরুটাকে মানুষ করতে চাই। তোমরা একটু বুঝিয়ে দেখ তো, চাকরিবাকরি কিছু করে যদি।”

সাব্বির এই ভয়টাই পাচ্ছিল এতক্ষন। শেষপর্যন্ত ইজ্জতের ফালুদা হয়েই গেল। রুবিনা ওর পক্ষে সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করল,
“খালাম্মা, এভাবে কেন বলছেন। এরকম কি আর বসে থাকবে ও আজীবন। কিছু না কিছু তো করবে একদিন।”
“কবে যে আর করবে মা।”

এতক্ষন আগুন তুষের নিচে চাপা পড়ে ছিল। সেই আগুনকে আরেকটু উস্কে দিল জ্যোতি,
“জানো চাচি, ফাহিমার বড় ভাই তো বিসিএস রিটেনেও টিকে গেছে কয়েকদিন আগে। মনে হয় এবার চাকরি পেয়েই যাবে।”

“পোড়া কপাল আমার, সারাজীবন শুধু অন্যের ছেলের সাফল্যের কথাই শুনে যেতে হবে।”

সাব্বিরের ভেতর তখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির আগুন। সেই আগুন দিয়ে ও ভস্ম করে দিতে চাইল জ্যোতিকে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)
____
কথা তো দূর, চোখ দেখাদেখিও বন্ধ আজকাল। একই ছাদের নিচে বসবাস বিধায় দেখা হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। তখন দুজন দুজনকে এমনভাবে এড়িয়ে যায় যেন কস্মিনকালেও কখনও তাদের দেখা হয়নি। ছেলেটি কায়মনোবাক্যে মেয়েটিকে উপেক্ষা করে গেলেও মেয়েটি কোনো এক অদৃশ্য সুতোর টানে আড়ালে আবডালে দেখে যায় ছেলেটিকে। কখনও ছাদের এককোনে দাঁড়িয়ে থেকে, আবার কখনও জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে অফিসগামী ছেলেটিকে দেখতে থাকে যতক্ষন সম্ভব।

আরও দেড়মাস চলে গেল। তারপর কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে আবার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল দুজনের।

ভ্যাপসা গরম, তারউপর আবার সকাল থেকেই লোডশেডিং। সেদিন মাহবুব অফিস থেকে ফিরল বিকেলেই। গরমে ঘরে টিকতে না পেরে একসময় ছাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সিঁড়ির শেষধাপে উঠেই দাঁড়িয়ে গেল মাহবুব। ছাদ থেকে চাপা স্বরে মেয়েলি আওয়াজ ভেসে আসছে।

পড়ুন ই-বই “বিষাদবেলা ফুরায়ে যায়” এই লিংকে
https://link.boitoi.com.bd/VWDt