কাননে ফুটিল ফুল — ৫ (১৬৩০+ শব্দ)
সাব্বিরের ভেতর তখন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির আগুন। সেই আগুন দিয়ে ও ভস্ম করে দিতে চাইল জ্যোতিকে।
সাব্বির যথাযথ সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল। সেই সুযোগটা ও পেল দিন দুয়েক পরে। সেদিন বিকেলে নৈশী আর আফরোজা বেগম বাইরে গেল কী একটা কাজে। জ্যোতি সেটা না জেনে নৈশীর সাথে গল্প করতে এলো৷
যতক্ষনে ও বুঝতে পারল যে বাসায় কেউ নেই৷ ততক্ষনে পালিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ। সাব্বির ওর হাত চেপে ধরে রেখেছে। প্রথমেই হুংকার দিয়ে উঠল ও,
“ফাহিমার ভাই বিসিএস ক্যাডার হবে তাই না?”
জ্যোতি ভয়ে ভয়ে বলল, “আমি, মানে…।”
“ফাহিমার ভাইয়ের গুনগানের শেষ নেই৷ প্রেমে পড়েছিস? নাকি সেই তোর প্রেমে পড়েছে? এত টান যেহেতু তার প্রতি, বোঝা যায় সম্পর্কের গভীরতা অনেক। কতদূর এগিয়েছিস? শুধু চুমু-টুমু নাকি আরও বেশি?”
ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না জ্যোতির। কান ঝাঁঝাঁ করে অপমানবোধে। পানি এসে গেল চোখের শার্সিতে। সাব্বিরের মন গলল না তাতে। বরং প্রতিশোধপরায়ণ সাব্বিরের পৈশাচিক আনন্দ হলো জ্যোতির দুঃখ দেখে। আরেকটু কথা শোনানোর সুযোগ হাতছাড়া করল না ও,
“ভালোই হলো, টাকাওয়ালা প্রেমিক পেয়ে গেছিস। তবে তোকে একটা পরামর্শ দেই জ্যোতি, এখনই খুব বেশি অন্তরঙ্গ হয়ে যাস না। দেখা গেল ক্যাডার হয়ে ভোল পালটে ফেলল। তখন আবার…।”
কথা শেষ না করেই বিশেষ ভঙ্গিতে হাসল সাব্বির। গায়ে জ্বালা ধরানো হাসি৷
জ্যোতি ফুঁপিয়ে কেদে ফেলল এবার৷ সাব্বিরের সাথে স্বাভাবিক দুটো কথা কবে হয়েছিল জ্যোতি মনে করতে পারে না। সবসময় লড়াই, ঝগড়া, একজন আরেকজনকে খোঁচানো এসবই করেছে ওরা৷ পেত্নি, ডাইনি, বাচাল, অসুন্দর বলে বহুবার সম্মোধন করেছে জ্যোতিকে। উপরে উপরে রাগ দেখালেও জ্যোতির এসব কথা কখনও গায়ে লাগেনি৷ কারণ ও জানতো, এসব শুধুই কথার কথা আর মানুষটা এমনই।
কিন্তু আজ যেসব কথা বলল সাব্বির, সেগুলো হজম করা জ্যোতির পক্ষে সম্ভব হলো না৷ ছি! সামান্য একটা কথার জের ধরে এত বাজেভাবে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। জ্যোতি কঠিন সংকল্প করল মনে মনে। এই হৃদয়হীন ছেলেটার সামনে আর কক্ষনো আসবে না ও।
সাব্বিরের হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা রাগটা প্রশমিত হতে শুরু করেছে। ও চেয়েছিল কথার তীব্রতায় জ্যোতিকে কাঁদাতে৷ কিন্তু এখন জ্যোতি কেঁদে ফেলার পর নিজের কাছেই খারাপ লাগছে৷ একটু বেশিই কি বলা হয়ে গেল? সাব্বিরের অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে জ্যোতি চট করে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল৷ তারপর একদৌড়ে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। সাব্বির বসে পড়ল খাটে। এতক্ষন জ্যোতির উপরে হওয়া রাগটা কনভার্ট হয়ে নিজের দিকে ফিরে এসেছে এখন৷ কথাগুলো বলার সময় জ্যোতির সেই কান্নাভেজা অবিশ্বাস্য চাহনি একেবারে ভেতরে কোথাও গিয়ে লাগছে খুব করে।
৬.
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার,
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার…।”
দুলাইন বলে থেমে গেল নৈশী।
“থামলে কেন, ভালোই তো লাগছিল।”
এই অসময়ে আন্দালিবকে একদমই আশা করেনি ও। আজকের এই গোধূলি বিকেলটা নিজের মতো করে কাটাতে নিরিবিলি ছাদে এসেছিল নৈশী। এখানে হঠাৎ আন্দালিবের আগমন কিছুটা অযাচিত মনে হলো ওর কাছে। প্রশ্নটা যেন আপনা-আপনি বের হয়ে গেল মুখ থেকে,
“আপনি হঠাৎ এই অসময়ে?”
“এমনিই। কাল রাতে নাকি খালাম্মা অসুস্থ হয়ে পরেছিল কিছুটা, তাই দেখতে এসেছিলাম। রাস্তায় বসে দেখলাম তুমি ছাদে আছো, তাই ভাবলাম তোমার কাছে আসি।”
“কিন্তু এটা কি ঠিক হলো? যাকে দেখতে এসেছেন তার কাছেই কি আগে যাওয়া উচিৎ ছিল না?”
“সত্যিই ভুল হয়ে গেল। এনিওয়ে, তুমি কি বিরক্ত হচ্ছ?”
“একদমই না। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে এলো, আমিও এখন নিচে যাব ভাবছিলাম। চলুন একসাথেই যাওয়া যাক।”
“ওকে, তবে তার আগে তোমার সাথে একটা কথা ছিল। আবদারও বলতে পারো।”
“জ্বি বলুন।”
“আমার বাসায় কাল একটা ছোট্ট পার্টির আয়োজন করেছি। তুমি যদি ওখানে জয়েন করো, আমার খুব ভালো লাগবে।”
“আয়োজনটা কী উপলক্ষ্যে?”
“জানো তো, একটা ছোটখাটো কোম্পানি আছে আমার। ওটার নেট আর্নিং এবার প্রায় দেড়গুন বেড়েছে। সেটার জন্যই কাছের মানুষদের নিয়ে একটা গেট টুগেদার করতে চাইছি।”
নৈশী ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর কথা শুনে। সেই চাহনি দেখে প্রশ্ন করল আন্দালিব, “এনিথিং রং?”
“নাথিং।” এতটুকু বলে এড়িয়ে গেলেও আবারও একটা প্রশ্ন জাগল নৈশীর মনে। ও জানে, আন্দালিব আর সারজিম বেস্ট ফ্রেন্ড। সারজিম দেশে ফিরবে আর একদিন পরেই। আন্দালিব বলছে নিজের কাছের মানুষদের সাথে নিয়ে সেলিব্রেশন, অথচ নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুর জন্য একটা দিন ওয়েট করতে পারল না?
পরেরদিন নৈশী গেল আন্দালিবের দাওয়াত রক্ষার্থে। কিছু কিছু ব্যাপারে সর্বদাই সচেতন থাকার চেষ্টা করে ও। আন্দালিবের নিমন্ত্রণে তাই ও একা গেল না। সাথে সাব্বিরকেও নিয়ে গেল।
সাব্বির তো সেখানে পৌঁছে অবাক। ওদের বাড়িতে সামান্য একটা অনুষ্ঠান হলেও সেখানে আন্দালিবকে বলা হয়। আজ এতবড় একটা আয়োজন করল আন্দালিব, অথচ সারজিমের জন্য একটাদিন অপেক্ষা করল না। আবার সুবিধামতো নাহয় করেছে অনুষ্টান, ওকেও তো একবার বলতে পারত। সেটা না করে সবার অগোচরে নৈশীকে ঠিকই দাওয়াত করেছে। এসব চিন্তায় বুদ হয়ে থাকল সাব্বির।
আন্দালিবও খুব একটা খুশি হয়নি সাব্বিরকে দেখে, সেটা ওর মুখাবয়ব দেখে আন্দাজ করতে পারল নৈশী। যদিও নিজেকে খুব দ্রুতই সামলে নিল আন্দালিব। সাব্বিরের পিঠ চাপড়ে বলল,
“আরে ব্রো, এসে গিয়েছিস তুই। ভালোই হলো।”
সাব্বির অপমানিত বোধ করল ভীষণ। ওর থমথমে গলার স্বর শুনে অন্তত তেমনটাই মনে হলো,
“স্যরি আন্দালিব ভাই। আমি আসলে জানতাম না যে এখানে এত আয়োজন চলছে। নৈশী আপু এখানে তোমার কাছে কী একটা দরকারে আসবে, তাই তার সাথে এসেছিলাম।”
“একটা মার খাবি, এভাবে কেন বলছিস? জানিসই তো, সারজিম এমন হট্টগোল, মিউজিক একেবারেই পছন্দ করে না, তাই ওর সাথে পরে আলাদা সেলিব্রেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আর ভেবেছিলাম সারজিমকে ছাড়া তুইও হয়তো এখানে ততটা কম্ফোর্ট ফিল করবি না, তাই বলা হয়নি।”
“আমরা কি এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলব?” প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য ওদের কথার মধ্যেই প্রশ্নটা করল নৈশী।
আন্দালিবের চটপট উত্তর, “একদম না, ভেতরে এসো প্লিজ। সাব্বির তুইও আয়।”
অনিচ্ছাসত্ত্বেও সাব্বিরকে যেতে হলো ভেতরে। মূলত নৈশীকে এই পরিবেশে একা রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না ওর। নইলে এতক্ষনে কোনো একটা বাহানা দিয়ে সটকে পড়ত সাব্বির। আর যাই হোক, অযাচিত মেহমান হয়ে কখনোই থাকতে চায় না ও।
সবাই পার্টিটা এঞ্জয় করল বেশ। তারপর একেবারে শেষ পর্যায়ে খাওয়দাওয়ার একটু আগে আন্দালিব যে কাজটি করল সেটার জন্য ওখানের কেউ প্রস্তুত ছিল না একেবারেই। নৈশীর সামনে গিয়ে এক হাটু ভেঙে বসে একটা ডায়মন্ড রিং ধরল সামনে। সাবলীল স্পষ্ট শব্দে প্রোপোজ করল নৈশীকে, “উইল ইয়্যু ম্যারি মি, নৈশী?”
নৈশী ওয়েস্টার্ন কালচারে বেড়ে ওঠা মেয়ে। এই একই দৃশ্য জীবনে বহুবার দেখেছে ও। তবুও আজ এই পরিবেশে নিজের সাথে এটা হতে দেখে হকচকিয়ে গেল ও।
পাশে থেকে সবার উল্লাস শোনা গেল। কেউ সিটি বাজাচ্ছে। কেউ মৃদু চিৎকার করে বলছে, “নৈশী, সে ইয়েস।”
নৈশী হাত বাড়াল। তবে সেটা আন্দালিবের গিফট করা আঙটিটা পরার জন্য নয়, খুলে রাখা আঙটির বক্সটা আবার বন্ধ করে দিতে। নৈশীর এই কাজে অবাক হলো সবাই। রুমের মধ্যের চাপা উল্লাস থেমে গিয়ে নীরবতা নেমে এলো। এবার নৈশী কথা বলল,
“স্যরি এভরিওয়ান। আই থিংক এই সুন্দর এনজয়েবল মোমেন্টগুলো আমি কিছুটা হলেও স্পয়েল করেছি। আই অ্যাপোলোজাইজ ফর ইট। একচ্যুয়ালি, আমাদের পরিচয়টা খুব অল্প সময়ের। আমার জীবনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তগুলো নিতেও আমি অনেকটা সময় নেই। সেখানে জীবনের এতবড় একটা সিদ্ধান্ত এত দ্রুত নেওয়া আমার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অ্যাগেইন স্যরি, গাইজ। আন্দালিব ভাই, আই অ্যাম স্যরি। প্লিজ ডোন্ট গেট হার্ট। আই নিড সাম টাইম।”
যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিমিষেই সামলে নেওয়ার অসামান্য দক্ষতা আন্দালিবের রয়েছে। আজও সেটাই করল,
“প্রয়োজনে তোমার জন্য অনন্তকাল দিয়ে দেব নৈশী৷ বুড়ো বয়সে তুমি এসে হ্যাঁ বললেও আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে শুধু এতটুকু নিশ্চয়তা দিয়ে যাও, আমি কি অপেক্ষা করব তোমার জন্য। কখনো তোমার মনের একান্ত জায়গাটুকুতে আমার স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা কি আছে?”
“আপনকে নিশ্চয়তাও দিচ্ছি না আবার একেবারে বাদও দিয়ে দিচ্ছি না। সময়ের সাথে সাথে আপনি যদি আমার ভরসা এবং বিশ্বাসের জায়গাটা দখল করতে পারেন তাহলে জবাবটা ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ইনশাআল্লাহ । আর যেহেতু আমি প্রচন্ডরকমের সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী তাই তার উপর ছেড়ে দিলাম সবটাই৷ তিনি আমার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন সেটাই হবে।”
“ব্যাস, তুমি এতটুকু শিওরিটি যে দিয়েছ, সেটাই আমার পরম পাওয়া। তোমার হৃদয়টা আমি একদিন ঠিক জিতে নেব, দেখে নিও।”
নৈশী আন্দালিবের কথার কোনো প্রত্যুত্তর না করে হাসল শুধু। অনুষ্ঠানে ওর পরের সময়টুকু কাটল ভীষণ অস্বস্তিতে। আশেপাশের সবাই আড়চোখে ওর দিকে চেয়ে গসিপ করছে। কয়েকটা মেয়ে অতি আগ্রহী হয়ে যেচে এসে সরাসরি বলে ফেলল, আন্দালিবের মতো সুদর্শন, রোমান্টিক এবং অঢেল টাকাপয়সাওয়ালা ছেলেকে রিজেক্ট করে নৈশী অনেক বড় ভুল করেছে। কেউ কেউ উপযাচক হয়ে পরামর্শ দিল, অন্য অনেক মেয়ে লাইন লাগিয়ে আছে আন্দালিবের অ্যাটেনশন পাওয়ার জন্য। আন্দালিব তাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার আগে যেন নৈশী নিজের ভুল শুধরে নেয়।
সবার কথা হাসিমুখে হজম করলেও অপ্রস্তুতবোধ করছিল ও। খাওয়ার পরপরই তাই মাথা ব্যাথার বাহানায় সাব্বিরের সাথে বের হয়ে এলো ও। আন্দালিব ওকে বিদায় দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করল। তারপর দেয়ালে সজোরে ঘুসি মারক কয়েকটা। নাহ! তাড়াহুড়োটা একটু বেশিই হয়ে গেছে বোধহয়।
আন্দালিবদের বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিল সাব্বির। নৈশী রিকশায় উঠে বলল,
“স্যরি, সাব্বির।”
“অদ্ভুত, তুমি স্যরি কেন বলছ?”
“আমি জানি, ওখানে যাওয়ার পর তোমার আত্মসম্মানে লেগেছে খুব। আসলে আমি এত গভীরভাবে ভাবিনি আগে। আমি ভেবেছিলাম ঘরোয়া কোনো অনুষ্ঠান হবে হয়তো। যতই হোক, আন্দালিব ভাইকে আমি খুব অল্প চিনি। সেখানে একা একটা মেয়ে যেতে ভরসা পাচ্ছিলাম না। তাই তোমাকে বলেছিলাম।”
“নৈশী আপু, প্লিজ। তুমি এভাবে কৈফিয়ত দিও না। আমি লজ্জা পাচ্ছি এবার। তোমার প্রতি তো আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে তুমি যা করেছ, ঠিকই করেছ। আমি ভাবছি আন্দালিব ভাইয়ের কথা। যাওয়ার পর থেকেই আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল, আমাকে কিংবা ভাইয়াকে এড়িয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন কেন করল সে। সেই উত্তরটাও আমি পেয়ে গেছি।”
“কেন করেছে?” প্রশ্ন করল নৈশী।
“কিছু না, বাদ দাও।” নৈশীকে এতটুকু বলে এড়িয়ে গেলেও সাব্বির মনে মনে বলল, “তোমাকে প্রস্তাব দেবে বলেই এরকমটা করল আন্দালিব ভাই। সে জানে ভাইয়ার সামনে সে জীবনেও এই কাজটা করতে পারত না। তাই ভাইয়া আসার আগেই এত তড়িঘড়ি করা।”
সাব্বিরের মেজাজ তেতে উঠল। সবচেয়ে কাছের বন্ধু হয়েও আরেকজনের সঙ্গে এমন জঘন্য খেলায় মেতে ওঠা যায়? আজ যেন নতুন এক আন্দালিবকে আবিষ্কার করল সাব্বির।
সাব্বির যে কিছু একটা এড়িয়ে যেতে চাইছে সেটা বুঝে চুপ হয়ে গেল নৈশী৷ সাব্বির সেটা খেয়াল করে বলল,
“ওখানের খাওয়াটা তেমন জমেনি। বাইরে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে৷ এই মোড়ের সামনেই নতুন একটা আইসক্রিম পার্লার হয়েছে৷ যাবে নৈশী আপু?”
“আমিও খেতে পারিনি তেমন। সবাই কেমন করে জানি তাকাচ্ছিল। চলো তাহলে আজকের ডিনারটা আমরা বাইরেই করি, তারপর নাহয় আইসক্রিম খাবো।”
সাব্বির বলল, “ওকে, ডান।”
নৈশীও হেসে ফেলল। কিন্তু মস্তিষ্ক আতিপাতি করে খুঁজে বেড়াচ্ছে শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর,
“কী এমন কারণ হতে পারে, যার জন্য আন্দালিব সাব্বির এবং সারজিমকে এড়িয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করল?”
৭.
সকালে সারজিম যখন থাইল্যান্ড থেকে রওয়ানা দিয়েছিল তখন চমৎকার রৌদ্রজ্বল একটি দিন ছিল, অথচ এখন ছোটবড় মেঘের আনাগোনা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে বলে অবস্থা। এই নভেম্বর রেইন নিয়ে মানুষের মাতামাতির শেষ নেই। কিন্তু সারজিমের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। ওর কাছে বৃষ্টি মানেই ভালোলাগা। সেটা বছরের যে সময়েই হোক না কেন।
সারজিমকে বের হতে দেখে সাব্বির ডাক দিল ওকে।
“এই যে, ভাইয়া। আমি এইদিকে।”
সারজিম এগিয়ে এলো। অন্তরঙ্গ আলিঙ্গন হলো দুই ভাইয়ের মধ্যে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
নোট:- এই পর্বে দেওয়া কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “অনন্ত প্রেম” কবিতার অংশবিশেষ।
–——-
হাসপাতাল জায়গাটা প্রচন্ড অপছন্দের মাহবুবের। বিশেষ করে মেডিসিন আর ফিনাইলের কড়া গন্ধে গা গুলিয়ে আসে ওর। অথচ আজ ঘন্টার পর ঘন্টা হাসপাতালে থেকেও ওর কোনো বিকার নেই। কয়েক ঘন্টা ক্রমাগত ছোটাছুটি করেছে কিন্তু মেডিসিনের গন্ধে আজ একবারের জন্যেও নাক কোঁচকায়নি ও। প্রচন্ড উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় মাহবুব আজ নিজের সহজাত খুঁতখুঁতে অভ্যাসটা থেকেও বের হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য।
শুভ্রতার সেন্স ফিরেছে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আধঘন্টার মধ্যেই। হাসপাতালের সমস্ত ফর্মালিটিজ সেরে ঘন্টা তিনেক পরেই ওকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হলো। দৌড়ঝাপ সব মাহবুবই করেছে।
শুভ্রতার বাবা জামশেদ সাহেব বললেন, “তুমি আমাদের জন্য অনেক করলে বাবা।”
“এভাবে বলবেন না চাচা। এ আর এমন কি।”
“তবুও, তোমাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তোমার বোনের সাথে মিশে অনেকদিন পর আমার মেয়েটাকে আগের মতো প্রাণবন্ত হতে দেখেছি। মেয়েটা আমার একেবারে মনমরা হয়ে থাকত। যেই মেয়েটার সাথে ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব ছিল সেই মেয়েটাও বিপদের দিনে ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। বেশিরভাগ বন্ধুবান্ধবরা ওকে এড়িয়ে চলত।”
মাহবুবের লজ্জা লাগছিল খুব। জামশেদ সাহেব কিছু জানেন না বলেই মাহবুবের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছেন এভাবে। যদি জানতে পারেন তার মেয়ের আজ এভাবে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার জন্য মাহবুব দায়ী, তাহলে এমন নরম সুরে কৃতজ্ঞতা জানাতেন কি? দিনের পর দিন শুভ্রতাকে করা অপমানগুলোর কথা মনে হতেই গুটিয়ে যাচ্ছিল মাহবুব।
আড়চোখে একবার বেডে বসা শুভ্রতার দিকে তাকাল ও। শুভ্রতা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। ফ্যাকাশে মুখটার দিকে তাকিয়ে মাহবুবের ভেতরে কিছু একটা হয়ে যাচ্ছিল।
মাহবুবের ভেতরের সেই তোলপাড় সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ল বৈ কমল না।
সেদিন হাসপাতাল থেকে শুভ্রতাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর আরও পাঁচদিন চলে গেছে। কিন্তু সেদিনের পর মেয়েটির সাথে দেখা হয়নি আর। মাহবুব যদিও পরেরদিন ওদের বাসায় গিয়েছিল, কিন্তু শুভ্রতার দেখা পায়নি। অসুস্থতার অযুহাতে নিজের রুম থেকেই বের হয়নি সে। মেয়েটাকে কয়েকদিন না দেখে অস্থিরতা বেড়েই চলেছিল মাহবুবের।
সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি বদলে যায়৷ তার সাথে বদলায় মানুষের মন। কখন সে কার জন্য ব্যাকুল হয়, সেটা বোঝা বড় দায়। আশ্চর্যজনকভাবে মাহবুবের মনও এখন আর নিজের কন্ট্রোলে নেই। বিশেষ একজনের জন্য সে আজ সর্বক্ষন উতলা হয়ে থাকে। আগে যে আশেপাশে থাকলেও বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে আসত, আজকাল তাকে একটু দেখতে মন আনচান করে। কিন্তু তার ছায়াটুকুও দেখা সম্ভব হয় না। রোজ নিয়ম করে ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যাথা করে, তবু তার দেখা পাওয়া যায় না। আজও অন্যদিনের মতো অফিস থেকে ফিরে বিল্ডিংয়ের গেটে ঢোকার আগে চারতলার ব্যালকনিতে একবার তাকাল মাহবুব। নাহ, কেউ নেই সেখানে।
❝পড়ুন ই-বই বিষাদবেলা ফুরায়ে যায় নিচের লিংকে
https://link.boitoi.com.bd/VWDt