#কারণ_আমি_মেয়ে
(পর্ব৭)
#সমুদ্রিত_সুমি
“সেদিন চাইলেই তুমি এই টাকা গুলো দিয়ে তোমার চিকিৎসা করাতে পারতে। তাহলে আজ আর পঙ্গু হয়ে বিছানায় পরে থাকতে হতো না।”
মায়ের কথাটা শুনে বুকটা ভারী হয়ে এলো। কিসের টাকার কথা বলছে মা? মুখ টাকে চেপে ধরে দরজার আরো একটু কাছে গিয়ে কান পাতলাম।
“কি যে বলো রাবেয়ার মা!”
“যা বলছি সত্যি বলছি। সেদিন কেন এই টাকা গুলো রেখে দিতে বললে? সেদিন যদি টাকা গুলো তোমার অপারেশনের সময় তুমি খরচ করতে দিতে, তাহলে অন্তত তোমাকে এমন বিছানায় দিনরাত পরে থাকতে হতো না।”
“রাবেয়ার মা তুমি বড্ড অবুঝ। আমার পা দিয়ে কি হবে। আমার তো দিন চলেই যাচ্ছে। কিন্তু ভেবে দেখো না সেদিন ওই গাড়ির মালিক যে টাকা গুলো দিয়েছে তা দিয়ে যদি আমার চিকিৎসা করাতাম তাহলে কি এমন মহৎ কাজ হতো? তোমাকে তো একটা ভালো জীবন উপহার দিতে পারিনি। মেয়েদেরও যদি তোমার মতো করে রাখি কি করে হবে বলো? তাই তো সরকারি হাসপাতালে গিয়ে পা’টা কাটিয়ে ফেললাম। আর এই টাকা গুলো রেখে দিলাম। আর এখন এই টাকা দিয়ে মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিবো। সেদিন টাকা গুলো খরচ করলে আজ কি ভাবে বিয়ে দিতাম মেয়ের? আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্য করেন।”
“আমি বেশি বুঝতে চাই না। যে বোঝায় দেখতে হয় তোমায় কষ্ট। আজ তুমি চাইলেই নিজের পায়ে হাঁটতে পারতে, কিন্তু তুমি সেটা পারছো না। আমাদের সবার উপর তুমি নির্ভরশীল।”
“তোমরা কি আমায় ফেলে দিচ্ছ?”
“আজ নাহয় আমরা আছি, কিন্তু রাবেয়ার বিয়ে হবে ক’দিন পর তারপর ফাতেমার। আমি যদি তার আগেই মরে যাই তাহলে কে দেখবে তোমায়?”
“রাবেয়ার মা তোমাকে একদিন বলেছি। এই মৃত্যু নিয়ে কোন কথা বলবে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক একদিন না একদিন আমাদের মৃত্যু হবেই। কিন্তু আমরা এমন মেয়ে জন্ম দেইনি যে তোমার কিছু হলে আমাকে তারা দেখবে না।”
“বিয়ে হয়ে গেলো মেয়েরা পর হয়ে যায়। তখন তাদের শ্বশুর বাড়ির লোকের অনুমতি ছাড়া বাপের বাড়ি আসতে পারে না।”
“সে দেখা যাবে। জোর করেতো মেয়ের বিয়ে দিচ্ছো, ভেবে দেখো পরে যেন পস্তাতে না হয়।”
“তুমিও”
“না আমি কিছু বলছি না। শুধু বলছি যা করবে ভেবে করো।”
“হুম”
“আমি বলি শোন এই টাকা গুলোর কথা রাবেয়া যেমন এতোদিন জানেনি, এরপরেও যেন না জানে।”
“হুম”
আমি বাবা-মায়ের কথা শুনে সব বুঝে নিলাম। যার গাড়িতে বাবার এক্সিডেন্ট হয়েছে। সে হয়তো ক্ষতি পূরণ হিসেবে টাকা দিয়েছিলো, যেটা বাবা নিজের জন্য খরচ করেনি। বুকটা ভারী হয়ে এলো, আজ এমনটা বাবা না করলে সে নিজের পায়ে চলতে পারতো। আমি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেই বাবার পা জড়িয়ে ধরলাম।
“আব্বু কেন করলে এমনটা? কেন আব্বু? তোমার এই পা আজ চাইলেই তুমি রাখতে পারতে! আমাদের কথা ভেবে কেন আব্বু নিজের এতো বড় ক্ষতি করলে? আব্বু তোমার এই পা দিয়েই তো তুমি প্রথম আমাকে পথ চিনিয়েছিলে! এই হাত দিয়ে হাঁটতে। যে হাত-পা দিয়ে তুমি আমাদের হাঁটতে এবং পথ দেখিছিলে, আজ সেই হাত-পা অবশ হয়ে পরে আছে বিছানায়। কেন আব্বু নিজের কথা ভাবলে না? কেন নিজের এতবড় অংশেকে বলি দিলে আমাদের কথা ভেবে। উত্তর দাও আব্বু, উত্তর দাও! আমি আব্বুর নেই পায়ে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছি আর ভাবছি সেদিন যদি আব্বু সঠিক সময়ে টাকা গুলো ব্যবহার করতো! তাহলে এখানে আমার আব্বুর পা’টা থাকতো। এতো অকালে হারাতে হতো না আব্বুর পা, নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।”
“মা’রে এভাবে কাঁদিস না, তুই কাঁদলে আমার ঘরের রহমতের ফেরেস্তা চলে যাবে। তুই আমার ঘরের রহমত মা, তুই কাঁদলে ভালো লাগে না।”
“তুমি কেন করলে আব্বু এমন?”
“যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে। এখন এগুলো নিয়ে কান্নাকাটি করলে কিছু তো আর ঠিক হবে না। তাই যা হয়েছে ভালো হয়েছে এই ভেবে শান্ত হ। আয় আমার কাছে আয়।”
আমি বাবার কাছে গিয়ে বসতেই, বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“আমি আর ক’দিনই বা বাঁচবো বল? আর বয়স হয়েছিলো, তাই তোদের কথা ভেবে আর টাকা গুলো খরচ করিনি। এই টাকা গুলো খরচ করে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো। আমার সেই ছোট্ট মেয়েটার শ্বশুর বাড়ি হবে। একজন বাবা-মায়ের আর কি পাওনা আছে বল মা।”
আমি নিজের চোখের জল মুছে মা’কে উদ্দেশ্যে করে বললাম,
“এই টাকা দিয়ে আব্বুর নতুন করে চিকিৎসা হবে। আর হ্যাঁ, এর বাহিরে যদি তোমরা এক পা-ও চলো তাহলে আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দিবো। আর হ্যাঁ মা তুমি একা মরতে পারো না আমিও পারি। তাই আর কিছু আমার অজান্তে করার চেষ্টা করো না। তাদের যদি আমাকে বউ করার ইচ্ছে থাকে তাহলে কোন কিছু না নিয়েই করবে। আর না হলে না
বলে দিলাম। আমার কথার এক চুল পরিমাণ সরলেই আমি আত্মহ ত্যা করতে পিছুপা হবো না বলে দিলাম।”
কথা গুলো বলেই আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। আমি জানি আর বাবা-মায়ের সাহস হবে না আমাকে কিছু না জানিয়ে করার। আর ঐ হাড়হাবাতে গুলোর শিক্ষা দিবো। খুব শখ না মেয়ের বাড়ি থেকে যৌতুক নিবে! নেওয়াচ্ছি।
————–
গরমে অতিষ্ঠ জীবন, মাথার উপর গটগট করছে সিলিং ফ্যান। শরীরে লাল বেনারসি শাড়ি, মুখে কিসব আজেবাজে জিনিস মাখানো। পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। বাহিরে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে, ছেলেদের পরিবারের সাথে আমার পরিবারের। আমার পরিবার বলতে রাজ কাকু। তাকে আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। এটাও বলেছি তারা যদি একান্ত এগুলো মেনে না নেয়, তাহলে বিয়ে যেন ভেঙে দেয় কাকু। আমার এমন চিন্তার মাঝেই রাজ কাকু ঘরে এলেন সাথে আরো একজন মুরুব্বি এলেন।
“রাবেয়া”
“জ্বি কাকু”
“উনি হচ্ছে ছেলের মামা, তিনি তোমার সাথে কথা বলতে চান”
“আচ্ছা”
“তোমরা কথা বলো আমি বাহিরে আছি।”
“ঠিকাছে”
কাকু চলে গেলে আমি উনাকে একটি চেয়ার এগিয়ে দিলাম।
“মা, তুমি তোমার সিদ্ধান্তে অটুট।”
“জ্বি”
“দেখো আমি রাজ ভাই’জানের কাছে সব শুনলাম। কিন্তু মা এখন যদি বিয়েটা তোমার না হয় তোমার বদনাম হবে সাথে আমাদেরও। আমাদের ছেলের ওতটা না হলেও তোমার বেশি হবে। আর আমি যদি বিয়েটা নিজ দায়িত্বে করিয়েও দি তোমার উপর যে ঝড় যাবে তা তুমি সইতে পারবে তো?”
“মামা আজ যা করছি আমার বাবা-মায়ের ভালোর জন্য করছি। এতে যা সইতে হোক না কেন আমি মেনে নিবো।”
“আচ্ছা মা দোয়া করি তুমি তোমার লক্ষ্যে সফল হও।”
তারপর উনি চলে গেলেন।
উনি চলে যাওয়ার দশ মিনিট পর কাজী সাহেব এলেন বিয়ে পড়াতে।
চলবে…