কারন আমি মেয়ে পর্ব-০৩

0
31

#কারন_আমি_মেয়ে
#সমুদ্রিত সুমি
পর্ব ৩

“ওদের পরিবার হঠাৎ কি ভেবেই ওদের খুলনা থেকে ঢাকা পড়ালেখার জন্য পাঠিয়ে দেয়। যাওয়ার ছয়মাস ওরা আমাদের সাথে যোগাযোগ রাখলেও আস্তে আস্তে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে অবশ্য কারণটা জানতে পারি। কেউ নিঝুম আর রিফাতের বাবা-মা-কে বলে দেয় ওরা আমাদের কিভাবে সাহায্যে করতো। তাই তাদের এই প্ল্যান। নিঝুম আর রিফাত ছিলো চাচাতো ভাই বোন। এটাকেই কাজে লাগিয়ে ওদের বাবা-মা এক সাথে আমাদের জীবন থেকে ওদের সরিয়ে দেয়। সব কিছু ভাগ্য বলে মেনে নিলাম। কিছু দিনের মধ্যে আমিও একটা শপিংমলে চাকরি পেলাম। সাত হাজার টাকা বেতন। সকাল দশ’টা থেকে বিকাল ছয়’টা পর্যন্ত। আর মা কাজ করে দুহাজার পেতো। আমি কিছু ছোট বাচ্চা রাতে পড়ানো শুরু করলাম। এইসব টাকা দিয়েই সংসার চালাতে থাকলাম। একটু কষ্ট হতো ঐ টাকায় সব কিছু করতে কিন্তু তবুও আমরা মানিয়ে নিলাম।”

এতোটুকু বলেই রাবেয়া সামনে রাখা এক গ্লাস পানি নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আর তার সামনের চেয়ারে বসে আছেন সুমন রহমান। সুমন রহমান বুঝতে পারলেন এখনো অনেক কিছু বলা বাকি রাবেয়ার। তিনি শুধু ভাবছেন তার সামনে বসা এই রমণীর কত বয়স? পঁচিশ কি ছাব্বিশ, এর বেশি হবে না। আর এই বয়সে কত কিছু সহ্য করে ফেলেছে রাবেয়া।

“স্যরি স্যার, পানির পিপাসা পেয়েছিলো।”

“ঠিক আছে, সমস্যা নেই। বলো।”

“তারপরের দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিলো। অর্নাস ২য় বর্ষে যখন তখন আমার একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়। আমি যে শপে কাজ করতাম সেই শপেই একদিন কিছু শপিং করতে আসে ছেলে’টি। আমাকে তার বোনের জন্য কিছু গাউন পছন্দ করে দিতে বলে। আমি সব কিছু শুনে কিছু সুন্দর গাউন পছন্দ করে দেই। সেদিন সে চলে যায়। এরপর সে মাঝে মাঝেই আসতো আমাদের শপে। প্রথমে ব্যাপার’টা অতটা গুরুত্ব না দিলেও পরে ব্যাপার’টা নিয়ে আমি ভাবি। কারণ ছেলে’টা আমি যেখানে যেতাম, তার আশেপাশেই ঘুরঘুর করতো। আমি ভাবতাম ছেলে’টা কি আমায় পছন্দ করে? নাকি অন্য কোন কারণ। কিন্তু কিছুই খুঁজে পেতাম না। একদিন কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে তিনি আমার পথ আঁটকে দাঁড়ান। আমি কিছু বলতে যাবো তখন তিনি বলেন।

“আমার আপানার সাথে কিছু কথা আছে। প্লিজ আমাকে দশ মিনিট দিবেন।”

“দেখুন আমার সাথে আপনার এমন কোন কথা থাকতে পারেনা যার জন্য আপনাকে আলাদা ভাবে টাইম দিতে হবে।যা বলার এখন আর এখানেই বলুন।”

“ওকে, ঠিক আছে। আমি আপনাকে পছন্দ করি। আই মিন লাভ। আমি আপনাকে ভালোবাসি।”

লোকটার কথা শুনে আমি অবাক হলাম। পাগল টাগল নাকি! আমি উনাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলে উনি আমার আবার পথ আঁটকে দাঁড়ান।

“কি সমস্যা আমার পথ কেন আটকাচ্ছেন?”

“আমার উত্তর দিয়ে যান।”

“কিসের উত্তর? আমি কোন উওর দিতে বাধ্য নই।”

“ওকে তাহলে আমিও রাস্তা ছাড়ার পাত্র নই।”

“আচ্ছা মুশকিলতো! কি সমস্যা আপনার?”

“সমস্যা তো আপনার। আপনিই কোন উত্তর দিচ্ছেন না।”

“দেখুন আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।”

“আমিতো ধরে রাখিনি। উত্তর দিন আর চলে যান।”

“দেখুন আমার পক্ষে এই প্রেম ভালোবাসায় জড়ানো সম্ভব নয়।”

“কেন?”

“কেন এরর কোন কারণ নেই।”

“দেখা যাক।”

এই কথা বলেই লোকটা চলে গেলো। আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। বাড়িতে গিয়ে দেখি মা শুয়ে আছে মা’কে বললাম।

“কি হয়েছে মা? তুমি এই অসময়ে শুয়ে আছো!”

“আরে তেমন কিছু না শরীরটা একটু গরম।”

আমি মায়ের শরীরে হাত দিয়ে দেখি একটু না অনেকটাই গরম। মায়ের মাথায় জ্বল পট্টি দিয়ে চলে গেলাম রান্না ঘরে। সেখানে গিয়ে দেখি কিছু রান্না হয়নি। হয়তো মা কাজ থেকে এসেই শুয়ে আছেন। শরীর হয়তো একটু বেশিই খারাপ। তাই আমি নিজেই ডালে চালে খিচুড়ি বসিয়ে বাবার কাছে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবার চোখের কোনা বেয়ে জল পরছে। দ্রুত বাবার কাছে এগিয়ে গেলাম।

“বাবা, কি হয়েছে কাঁদছো কেন?”

“আমাকে কেন আল্লাহ এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে বলতে পারিস মা?”

“বাবা এমন করে কেন বলছো?”

“আমাকে তোদের ঘাড়ে ফেলে রেখেছে। না পারছি হাঁটতে না পারছি তোদের সাহায্য করতে। শুধু তোদের কষ্ট দু-চোখ ভরে দেখছি।”

“না বাবা এমন করে বলো না। তুমি আমাদের মাথার উপরের ছায়া। তুমি ছাড়া আমাদের এই জীবন যুদ্ধে কখনো আমরা সফল হতে পারবো না। তুমি শুধু দোয়া করো বাবা।”

“মা’রে এই দু-চোখ আর দেখতে পারছে না তোদের কষ্ট। আমার যে আর ভালো লাগছে না। একটু বিষ এনে’দে খেয়ে তোদের মুক্তি দেই। পোড়ার কপালে একটু হাঁটারও শক্তি নেই, যে ওই চার রাস্তার মোড়ে গিয়ে ভিক্ষা করবো।”

“কী বলছো বাবা। আমিতো আছি আমি থাকতে কেন তুমি ভিক্ষা করবে? চুপ করো বাবা এগুলো কখনো বলো না। কেন বোঝো না বাবা, তোমরা সবাই আমার লড়াই করার শক্তি। তোমাদের কারো কিছু হয়ে গেলে যে আমিও বেঁচে থাকার কারণ হারিয়ে ফেলবো।”

“মা-রে আর কত, আর কত বলতে পারিস, মহান আল্লাহ আর কত ধৈর্যের পরিক্ষা নিবেন।”

“আব্বু আর দু’টো বছর কষ্ট করতে পারলেই দেখবে আমাদের আর কষ্ট থাকবে না। তখন আমি একটা ভালো চাকরি পেয়েই যাবো।”

“আমি জানি না এই দুঃখের শেষ কোথায়। আল্লাহর কাছে এতোটুকু প্রার্থনা তোদের সুখ দেখে যেন মৃত্যু হয়।”

“না’ বাবা তুমি শুধু সুখ না সুখি হবে আমাদের সাথে। আর কখনো এসব বলবে না। তুমি যদি আর এসব বলো আমি নিজেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মাহ ত্যা করবো।”

“না মা, এগুলো বলিস না বুকে লাগে।”

“ওওও আর তুমি বললে বুঝি আমার কষ্ট লাগে না।”

“তারপর বাবা নিজের চোখের জল মুছে আমাকে কাছে টেনে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো।”

“আল্লাহর কাছে শুকরিয়া তোর মতো একটা মেয়ে আমাকে দিয়েছে।”

“আমি বাবার গালে চুমু খেয়ে বললাম, আমিও অনেক খুশি তোমার মতো বাবা পেয়ে।”

বাবা আমার কথায় হেসে দিলেন।

তারপর আমি রান্না ঘরে গিয়ে সব কিছু গুছিয়ে, রান্না শেষ করে গোসল করলাম। তারপর বাবা-মা’কে খাবার খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে ঘুমাতে বলে আমি ফাতেমার কাছে গেলাম।

“ফাতেমা।”

“আপু তুই, আয়”

“খেয়েছিস”

“না’রে”

“কেন?”

“এমনি ভালো লাগছেনা আপু।”

“আর কত দিন ফাতেমা নিজেকে ঘর বন্দী করে রাখবি।”

‘“আপু এখন আমি সব বুঝি, এটাও বুঝি তুই আমার এমন রূপটা পছন্দ করিস না। তুই আমার সেই চঞ্চলতা খুঁজিস। কিন্তু কি বলতো আমি এখন এতেই অভস্ত্য হয়ে গেছি। আপু জানিস এখন আমি জানি, মা কেন ডিমে ঝাল পেঁয়াজ দিতো। কেন সবার ঘরে গোশ রান্না হলে আমাদের ঘরে ডাল রান্না হতো। আমি কতোটা অবুঝ ছিলাম। আমার থেকে তো তুই বেশি কষ্ট করিস, ঘরে বাহিরে সব জায়গায়। আর আমি তো ঘরে বসে আরাম করি।
আচ্ছা আপু কি করলে বেশি টাকা রোজকার করা যায় জানিস। আমাদের পাশের ওই জিয়ান ভাই আছেনা, তিনি আমায় রাতে দেখা করতে বলেছে। আর সাথে এটাও বলেছে দেখা করলে আমাকে পাঁচশো টাকা দিবে। অথচ আপু ধার চাইলে তো না করে দেয়। আর শুধু দেখা করলেই পাঁচশো দেবে। তুই বুঝতে পারছিস দুনিয়ায় মানুষ কত মহান? আচ্ছা আপু আমরা মেয়েরা ওদের কি এমন খাদ্য। যে টাকার বিনিময়েও ওদের আমাদের চাই? তুই বলতে পারিস, ঐ পাড়ার মেয়েরা কেন দেহ ব্যবসা করে? আমি জানি ওরাও জীবনের যুদ্ধে বিজয়ী না হতে পেরে ওই জিয়ান, নোমান, রফিক ওদের মতো কিছু নরপিশাচের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়। ভেবে দেখ না মা সারামাস খেটে এক হাজার টাকা পায়। আর আমি এক রাত দেখা করলেই আমাকে পাঁচশো দিবে। চল না আপু তুই আমিও এই কাজ করি। তাহলে অন্তত ভালো কাপড়’ভালো খাবার খেতে পারবো। বাবার উন্নতমানের চিকিৎসা করাতে পারবো। মা’কে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দেবো না।”

আমি ফাতেমার কথা শুনে ওকে একটা থাপ্পড় মেরে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

“এসব তুই কি বলছিস বোন! এগুলো বলতে নেই,সব ঠিক হয়ে যাবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

“কখনো ঠিক হবে না আপু, কখনো না। তুই বলনা আপু আমাদের সাথেই কেন এমন হলো? আমরা তো ভালোই ছিলাম। বাবা দিন আনতো আমরা দিন খেতাম। তাহলে কেন বাবার ওমন এক্সিডেন্টেটা হলো! কেন মা’কে শুনতে হলো সে যদি এক রাত ওই নরপিশাচ’কে সঙ্গ দেয় মা’কে সে টাকা দিবে। আমাকে কেন ওতটুকু বয়সে ধর্ষেণের মুখোমুখি হতে হলো? কেন আপু কেন? আপু বল, আমি জানি তোর কাছে উত্তর নেই। তুইও মাঝে মাঝে আমার মতো ভাবিস আর উত্তর খুঁজিস। কেন আমাদের সাথেই এমন হয়। তুই কি মনে করিস আমি রাতে ঘুমাই, না আপু। তোর মতো আমিও প্রতিটা রাত নির্ঘুমে কাটাই। তোর চোখের জলের প্রতিটা ফোঁটার সাক্ষী হই আমি। ঐ চাঁদ’তারা আর রাতজাগা পাখির মতো। আমিও দেখি তোর সবার থেকে আড়াল করে রাখা চোখের পানি। তোর বুক’চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস, কতটা ধারালো। আর সেই ধারালো দীর্ঘশ্বাস ছুরির মতো তোকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করে। সব দেখি, হ্যাঁ সব।”

সেদিন ওকে বলার মতো কোন কথা ছিলো না, তাই চুপ করেই ছিলাম।

পরের দিন আমি সব গুছিয়ে, কাজে চলে গেলাম। পথেই আবার ঐ ছেলের সাথে দেখা।

চলবে…