কার্নিশ ছোঁয়া অলকমেঘ পর্ব-০১

0
402

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা
সূচনা পর্ব.

নিশির দ্বিপ্রহর। জনমানবশূন্য ফ্লাইওভারটা হলুদ আলোময়৷ বেশিরভাগ ঠিকঠাক জ্বললেও, হাতেগোনা কয়েকটা ল্যাপপোস্ট সেকেন্ড তিন পরপর জ্বলছে, নিভছে। দুরের বহুতল ভবনগুলো আধারে ডোবা। তাদের মাঝেমাঝে মিটমিটানো স্থির আলো। রাতের গভীরতায় ব্যস্ত নগরী নিরব হয়ে আছে। শহরের অন্যতম ব্যস্ত সড়কগুলোর যোগসূত্র হিসেবে এ ফ্লাইওভার বেশিরভাগ সময়েই যন্ত্রযানে বিমগ্ন থাকে। কিন্তু রাত বেশি বলে আপাতত ফ্লাইওভার ফাঁকা। হঠাৎ একটা দুটো গাড়ি চলে যাচ্ছে কেবল। ফাঁকা রাস্তায় একটা গাঢ় খয়েরী রঙের টয়োটা পাইরাস প্রাইম আসতে দেখা যায়। উল্টোপথে,অতিরিক্ত গতিতে আসছে বলে আলাদাকরে চোখে পরে তাকে। সামনে থেকে আসা দুটো ট্রাক কোনোরকমে ব্রেক করে পাশ কাটালো গাড়িটাকে। ফ্লাইওভারের মাঝ বরাবর এসে, গাড়িটা একখানা জ্বলা নেভা ল্যাম্পপোস্টের নিচে থামলো। সেটাও স্বাভাবিকভাবে নয়। ফ্লাইওভারের পার্শ্বদেয়ালে ধাক্কা দিয়ে, তীব্র আওয়াজের সাথে। গাড়ির সামনের একটা হেডলাইট ভেঙে, গুড়ো গুড়ো কাচ ছড়িয়ে পরলো পিচঢালা পথে।

নিয়নের জ্বলা-নেভা আলো কাজের নয় বললেই চলে। আশপাশের কিছুকে খুব ভালোমতোন দৃশ্যমান করতে সে সক্ষম না। পাশের ল্যাম্পপোস্ট ঠিক থাকলেও সেটা আরো কয়েককদম দুরে। এদিকটায় আলোর অভাব মেটানের উদ্দেশ্য নেই তার। গাড়ির পেছনের লাইটদুটোও ওপরের আলোর উৎসের মতো একই ছন্দে জ্বলা-নেভা করছে। গাড়ির দরজা খুলে যায়। উচু সরু হিলপরিহিত একজোড়া পা পরে সড়কে৷ গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে এক ছায়াময়ী যুবতী। ঠকঠক আওয়াজ তুলে, মেয়েটা পা বাড়ায় ফ্লাইওভারের প্রান্তে। বাতাসে চুলগুলো উড়তে শুরু করে তার। আর সে নিস্প্রান চাওনিতে চেয়ে রয়, সামনে থাকা অগনিত আলোকবিন্দুর দিকে। কপালে কাটার মতো বিধছে কিছু একটা। কিন্তু তারচেয়ে বেশি যন্ত্রনা মেয়েটার বুকের ভেতর অনুভব হয়। স্থির স্তব্ধ পরিবেশের কেবল বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজটাই শোনা যায়। মেয়েটা এতোক্ষন যে বরফের ন্যায় কঠোর অশ্রু জমিয়েছিলো, অনর্থক জীবন নামক যন্ত্রণায় চোখের কোনা বেয়ে জল হয়ে বেরিয়ে আসে তা। ফ্লাইওভারের রেলিং শক্তকরে আকড়ে ধরে সে। মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে যাবে, ঠিক সেসময়েই সমস্ত নিস্তব্ধতা নির্জনতা পেরিয়ে ওর কানে আসে,

– ইঞ্চিতিনেক ডান নয়তো বাম থেকে লাফ দিন ম্যাডাম। এখান থেকে লাফ দিলে নিচে থাকা ছিন্নমূলদের তাবুর ওপরে পরে বেচে যাবেন। মরবেন না।

হাত নমনীয় হয়ে আসে মেয়েটার। মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে পরমুহূর্তেই পাশে তাকায় সে। ওর কিছুটা দুরে এক সুঠামদেহী পুরুষালি অবয়ব দাড়ানো৷ তার চেহারা অস্পষ্ট। বোঝা যাচ্ছে না। তবে ওই মুহুর্তেই একটা মালবাহী ট্রাক আসছিলো বিপরীতদিক থেকে। সেটার হেডলাইটের আলোতে যুবকের প্রতিচ্ছবির দেখা মেলে সেকেন্ড দুইয়ের জন্য। ওইটুক সময়ে মেয়েটার দৃষ্টিশক্তি জানান দেয়, ওর পাশে সাতাশ-আটাশ বয়সের এক যুবক। প্যান্টের পকেটে দুহাজ গুজে, চিন্তিতভাবে নিচে উকি দিচ্ছে সে। গায়ের ছাইরঙা শার্ট সোডিয়াম বাতিতে হলুদাভ দেখাচ্ছে। শার্টের বড়হাতা গুটানো বলে, ছেলেটার লোমশ হাত চোখে পরে সহজেই। গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই অন্ধকারে ডোবে যুবকের মুখ। চেহারা না দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় মেয়েটা। কিন্তু হুট করেই ওর বাহাত ধরে ফেললো ছেলেটা। মৃদ্যু টান লাগিয়ে ওকে আরেকটু ডানে দাড় করিয়ে, হাত ছেড়ে দেয়। আয়েশী গলায় বলে,

– ব্যস! এবার লাফ দিন। এদিকটায় নিচে কোনো তাবু নেই। এখান থেকে লাফ দিলে, নিচে না গিয়ে সোজা উপরে চলে যাবেন আপনি। ক্ক্যা!

মাথার ঠিক ওপর থাকা ল্যাম্পপোস্টটা অপ্রত্যাশিতভাবে জ্বলে উঠলো এবারে। মেয়েটাও পাশেরজনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে থমকে তাকায় যুবকের দিকে। পেশিবহুল হাত, সুঠাম গঠন, সঠিকমাপের চুলের ছাট, যেকোনো মেয়ের বিচারে সুদর্শনের দলে সে। মুখপানে তাকালে যেটা আগে চোখে পরবে, সেটা তার ভ্রুযুগল। কিন্তু সব পেরিয়ে তার ঠোঁটের কোনের সাবলীল হাসিটা চোখে পরে মেয়েটার। ওর গায়ে যেনো জ্বালা ধরে যায়। শক্ত হয়ে ও নিজেকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে, ওর তো কিছুর অভাব নেই। তাহলে ও কেনো এভাবে হাসতে পারছে না? এই পৃথিবী এতোটা অশান্তির জায়গা কেনো? এই অশান্তিময় পৃথিবীতে কেউ এতো খুশীই বা কেনো? বিশ্বাসঘাতকদের ভীড়ে কারো হাসি এতোটা নিখুঁত কিকরে? এতো নিখুঁত হাসি তো কেবল নিখুঁত সুখী মানুষের পক্ষে হাসা সম্ভব। এই অসুখে ভরপুর দুনিয়ায় কেউ এতোটা নিখুঁত সুখী কিভাবে হতে পারে? কিকরে?

যুবক এতোক্ষণে পাশে দৃষ্টিতাক করলো। সামনের রমনীর শক্তপোক্ত চাওনি দেখে হাসি কমে আসলো ওর। ল্যাম্পপোস্টের জ্বলা নেভা আলোয় আরো একবার মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে নিলো সে। উচু জুতা, পরনে জিন্স, কোমড়ের নিচ অবদি সাদা-নীলের ঢিলাঢালা ফ্রক। কনুই অবদি ছড়ানো হাতা। সেখানে ফিতে ফুল করে বাধা। ছাড়া চুলগুলো আহামরি বড় না। এলোমেলোভাবে গলার আগেপিছে পরে আছে তারা। সেকেন্ড পাঁচেকের আবছা দর্শনের পর, পেছনদিক থেকে আসা গাড়ির আলোয় মেয়েটার মুখ পুরোপুরিভাবে দৃশ্যমান হয়। তার উজ্জল চেহারায় কেবল ক্ষোভ। কপালের ডানদিকটায় কিঞ্চিৎ কেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। বা গালের একেবারে নিচে চোখ যায় এবারে চোখ যায় ছেলেটার। মেয়েটার গলা আর থুতনির মাঝামাঝি চারআঙুলের মতো প্রশস্ত একটা কালো জন্মদাগ আছে। এছাড়া বাড়তি যেটুকো, চোখের কোনে একটুখানি আইলাইনারের বাক, ঠোঁটে হালকারঙের লিপস্টিক, কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম। ছেলেটা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে নিলো। আগ্রহ নিয়ে বললো,

– কি হলো? থেমে আছেন কেনো? ঠিকঠাক সুইসাইড স্পট দেখে আর মরতে ইচ্ছে করছে না? মুড সুইং করছে?

ওর ওমন আগ্রহীস্বরে হুশে ফেরে মেয়েটা। বেশভুষা, চালচলন, কথাতেই বোঝা যায়, যুবক শিক্ষিত। জেনেশুনে ওকে সুইসাইড করতে বলছে, মানে ওর পরিস্থিতিকে মজা হিসেবেই নিয়েছে সে। মেয়েটা নিজেকে সামলে শক্তগলায় বলে উঠলো,

– নান অফ ইওর বিজনেস!

যুবক নিশব্দে হেসে দিলো এবারে। কিন্তু ওর শব্দহীন হাসিটাই ফাকা জায়গাটায় একপ্রকার হুল্লোড় তুলে দিলো যেনো। মেয়েটা রাগ নিয়ে কয়েকমুহুর্ত তাকিয়ে রইলো সামনের হাসোজ্জ্বল মানবের দিকে। ওর ধারনা ভুল নয়। ওকে নিয়ে মজা করছে এই লোক। চলে আসতে যাবে, যুবক দ্রুততার সাথে এসে ওর পথ আগলে দাড়ায়। বলে,

– ওয়েট, ওয়েট ম্যাডাম! আপনি ভুল বুঝছেন৷ একচুয়ালী ইট ইজ মাই বিজনেস। অকারনে আপনাকে সঠিক সুইসাইড স্পট সাজেস্ট করছি না আমি। এখান থেকে আপনি সুইসাইড করলে, সেটা সত্যিই আমার ব্যবসায়ীক কাজে লাগবে। ট্রাস্ট মি!

– আপনি…

রাগ উচ্চমাত্রায় পৌছালে আঙুল উচিয়ে চেচিয়ে ওঠে মেয়েটা। যুবক বোধহয় টের পায়, রমনীর রাগ সপ্তাকাশ ছুয়েছে। তাই তাকে শেষ করতে না দিয়ে ও হাত বাড়িয়ে দেয় নিজের। তড়িঘড়ি করে, হাসিমুখে বলে,

– তাশদীদ। আমি তাশদীদ ওয়াসীর।

কিছুটা পাত্তা না পেয়ে, কিছুটা সতর্কতা দেখাতে হাত তৎক্ষণাৎ নামিয়ে নিলো তাশদীদ। কে জানে সামনের রাগান্বিতা রাগে ওর হাত না ভেঙে দেয়। তাশদীদ দেখলো মেয়েটা চেচাতে গিয়েও চেচালো না। চোখ বন্ধ করে, দম নিয়ে, নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। স্বাভাবিক গলায় বললো,

– হোয়াটেভার। লিসেন, আমি কোনো সিনক্রিয়েট চাইছি না। নিজেকে সামলানোর পরিস্থিতিতে নেই আমি। আপনি নিজের কাজ করুন গিয়ে। এন্ড লিভ মি আলোন। প্লিজ!

– আমিতে সেটাই বোঝাতে চাইছি আপনাকে। আমি নিজের কাজই করছি। আপনি জলদিজলদি লাফ দিয়ে…

তাশদীদ কথা শেষ করার আগেই মেয়েটা অস্ফুটস্বরে ‘ ইউ ব্লাডি…’ অবদি উচ্চারণ করতে যাচ্ছিলো। তাশদীদ এবারো ওকে সুযোগ দিলোনা৷ ফট করে মেয়েটার হাত ধরে, টেনে ফ্লাইওভারের ধারে দাড় করিয়ে দিলো ও। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বললো,

– ওকে ওকে। নো মোর আর্গুমেন্ট। আমি আর একবর্ন বলে আপনাকে ডিস্টার্ব করবো না। পাক্কা! আপনি এখান থেকে নিশ্চিন্তে লাফ দিন। অল দ্যা বেস্ট।

বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তাশদীদ ক্যামেরা অন করলো। কিন্তু স্ক্রিনে মেয়েটার চাওনি দেখে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। মেয়েটা দুহাত মুঠো করে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে। রাগে ছলছল করছে তার চোখ। ফোনটা নামিয়ে নিলো তাশদীদ। ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে বললো,

– আমার ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রটা মনেহয় আপনি বুঝতে পারছেন না ম্যাডাম। বা বুঝলেও সিরিয়াসলি নিচ্ছেন না। ওকে। লেট মি এক্সপ্লেইন। আসলে আমি একজন ইউটিউবার। এখন আপনি এখান থেকে লাফ দিয়ে সুইসাইড করলে, আমি সেটার একটা ভিডিও করবো। তারপর সেটা ‘প্রেমিকের ধোকায় পরে প্রেমিকার সুইসাইড’ ক্যাপশন দিয়ে আমার চ্যানেলে ছেড়ে দেবো। অনলাইনে এমন ভিডিওর অনেক রিচ। প্রচুর ভিউ হবে আপনার সুইসাইড ভিডিওর। আমার চ্যানেলটায় আপাতত তিনহাজার আটশো একুশজন সাবস্ক্রাইবার আছে। ভিউ বেশি হলে সাবস্ক্রাইবার বাড়বে। সাবস্ক্রাইবার বাড়লে সেখান থেকে আমি টাকা পাবো। ভাবতে পারছেন? আপনার একটুখানি মরে যাওয়ার জন্য আমি টাকা পাবো। এক গরিবের দুবেলার আহার জুটে যাবে। তাই বলছি, আমার উপস্থিতিতে পুরোপুরিভাবে ইগ্নোর করে আপনি নির্বিঘ্নে লাফ দিন। আমি জাস্ট একটা ক্লোজ শট নেবো, আর কিছুনা। মরার আগে এটুকো ভালো কাজ তো করতেই পারেন। তাইনা?

– মজা করছেন আমার সাথে? হু? মজা করছেন? আপনি জানেন আমি কে?

দাঁতে দাঁত চেপে বললো মেয়েটা। শেষবাক্য বলতে গিয়ে, দুইপা এগিয়ে তাশদীদের অনেকটা কাছে চলে এসেছে ও। উচ্চবিত্ত মেয়েদের ভয় কম, সেটা জানে তাশদীদ। আপাতত মৃত্যুভয় না করা এই চোখজোড়াকে স্পষ্টভাবে দেখতে চায় ও। বয়সটা তো খুব বেশি না। বাইশ তেইশের যুবতীর রাগ এতোবেশি কেনো হবে যে তার আত্মহত্যা করতে হবে? উত্তর জানতে প্যান্টের পকেটে দুহাত গুজে গা ছাড়াভাবে দাড়িয়ে রইলো তাশদীদ। এরমাঝেই পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলো জ্বলে ওঠে। চকচক করে ওঠে মেয়েটার জলভরা চোখের তারা। একইসাথে ঝলক মেরে ওঠে ওর গলার লকেটটা। তাতে ইটালিক হরফে লেখা, ‘Tathai’.তাশদীদ ঠোঁট টিপে একটুখানি হাসলো। তারপর অপরাধীর মতো করে বললো,

– আমি মোটেও মজা করছি না। এন্ড আ’ম সরি। আপনি কে, সেটাও আমি জানিনা মিস তাথৈ।

তাশদীদের ঠাট্টা শুনে গায়ে আগুন ধরে যায় তাথৈয়ের। ও তাশদীদের এতোটাই কাছে এসে দাড়িয়েছে যে, ওর চোখে নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে ও। ওর মনে পরে যায়, গলার লকেটটায় ওর নাম লেখা আছে। রাগের বশে গলায় হাত দেয় ও। একটানে খুলে ফেলে চেইনটা। টপটপ করে জল গরাতে শুরু করে ওর চোখ দিয়ে। তাশদীদ কিছুটা হচকে যায়। তাথৈয়ের রাগের পরিমান এতোটাই বেশি যে, আঙুলের আঁচড়ে ওর গলা ছড়ে গেছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে গলা থেকে। তাথৈ শরীরের সমস্ত শক্তিতে ছুড়ে মারলো চেইনটা। মাথার চুল উল্টে ধরে, শব্দ করে কাদতে লাগলো ও। তাশদীদ কিছু বলতে যাবে, আঙুল উচিয়ে ওকে থামিয়ে দেয় তাথৈ। চেচিয়ে বলে,

– ডোন্ট ইউ ডেয়ার! আমাকে সহানুভূতি দেখাতে আসবেন না! সে অধিকার কারো নেই! আমাকে শান্তনা দেওয়ার যোগ্যতাও কারো নেই! কেউ সে দুঃসাহস করলে মে’রে ফেলবো তাকে আমি! মে’রে ফেলবো!

তাশদীদ পরলো বিপাকে। ফেরার পথে উল্টোদিকের রাস্তায়, থেমে থাকা গাড়ি আর ভাঙা হেডলাইট দেখে ভেবেছিলো, কেউ হয়তো এক্সিডেন্ট করেছে। কিন্তু সাহায্য করার জন্য কাছে এসে বুঝতে পারলো, চালক ইচ্ছাকৃতভাবে সংঘর্ষ ঘটিয়েছে। এমনকি তাতেও মৃত্যু হয়নি বলে, ফ্লাইওভার থেকে ঝাপ দেবে গাড়ি থামিয়েছে সে। তাশদীদ চেষ্টা তো করেছিলো মেয়েটার আত্মহননের সিদ্ধান্ত বদলাতে। কিন্তু এখানে সে নিজেই ভয়ংকরী হয়ে উঠছে। তাশদীদ বাহাত কোমড়ে রেখে দাড়ালো। ডানহাতে কপাল ডলতে ডলতে বিরবিরিয়ে বললো,

– এসেছিলো নিজে ম’রতে; এমন মোটিভেশন দিয়েছি, এখন বলছে আরেকজনকে মে’রে ফেলবে। ওয়াও!

মাথা ডানেবামে নেড়ে, ফু দিয়ে শ্বাস ছাড়লো তাশদীদ। এর কিছুই তাথৈয়ের কানে গেলোনা। নাক টেনে কান্না থামালো ও। দুহাতে চোখের পানি মুছলো। এদিকওদিক দেখে হাটা লাগালো সোজাপথে। তাশদীদ পেছন থেকে চেচিয়ে বললো,

– হো ম্যাডাম? গাড়ি, গাড়ির চাবি রেখে যাচ্ছেন; আপনার মৃত্যুর পর এটা বিক্রির টাকা কোথায় ডোনেট করবো সেটাও বলে যান? টাকাগুলো কোথায় দেবো? মসজিদে? এতিমখানায়? বৃদ্ধাশ্রমে? নাকি দুস্থফান্ডে?

তাথৈ চোখ খিচে চোখ বন্ধ করে নিলো। পুনরায় এসে ফ্লাইওভারের রেলিংয়ে রাখা গাড়ির চাবিটা নিলো ও। পরমুহুর্তে তাশদীদকে বিস্মিত করে দিয়ে, ওর হাতের ফোনটা কেড়ে নিলো তাথৈ। সেটার ভিডিও মোড অন করে, আবারো ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুতপদে গিয়ে গাড়িতে উঠলো। তাশদীদ স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে। তাথৈ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গাড়ি পেছনদিকে চালাতে লাগলো। গতি বেশি থাকায়, বরাবর পেছনে দাড় করানো বাইসাইকেলটা রাস্তায় পরে যায়। তাথৈ আয়নায় দেখলো, সাইকেল ওর গাড়ির নিচে। ইচ্ছে করে ওটার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিলো ও। ভেঙে চুরমার হয়ে যায় সাইকেলটা। এদিকে তাশদীদ যেনো প্রতিক্রিয়া করা ভুলে গেছে। সাইকেলটা ওর জন্য কতোটা প্রয়োজনীয়, তা কেবল ওই জানে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে ও পুরোটা দেখলো কেবল। তাথৈ ওর রাগ ওর সাইকেলের ওপর দেখাবে, কল্পনাতেও ছিলো না ওর। সাইকেল ভেঙে দিয়ে, গাড়ি থামালো তাথৈ। গাড়ি থেকে বেরিয়ে, উচু হাইহিলের আওয়াজ তুলে আবারো এগোলো তাশদীদের দিকে। একটা কার্ড তুলে ধরে বললো,

– সাইকেলের দাম যতো খুশি রাখতে পারেন। আর বাদবাকিটা চারভাগ করে এতিমখানা, মসজিদ, বৃদ্ধাশ্রম, দুস্থফান্ড সবগুলোতেই দিয়ে দিতে পারেন। কম পরবে না।

– আর হ্যাঁ! মোবাইলে থাকা এই ভিডিওটা আপনার ইউটিউব চ্যানেলে ছাড়বেন। ক্যাপশনে দেবেন, আলফেজ গ্রুপের চেয়ারম্যান, তৈয়ব আলফেজের মেয়ে, তাথৈ আলফেজ আপনার সাইকেল ভেঙে দিয়ে গেছে। এন্ড ট্রাস্ট মি, এটুকো এনাফ আপনার ভিউয়ার্স, সাবস্ক্রাইবার বাড়ানোর জন্য।

কথা শেষ করে তাশদীদের বুকপকেটে কার্ডটা গুজে দিলো তাথৈ। শক্তপোক্ত চাওনিতে অতি কাছ থেকে দেখে নিলো মানুষটাকে। এইতো কিছুক্ষণ আগেও তার চেহারায় হাসি ছিলো। এখন নেই৷ তাথৈ হাসির বাধকে নিজের স্রোতে ভাসিয়ে নিতে জানে৷ এটুক ভেবে নিজের ওপর সন্তুষ্ট হতে যাচ্ছিলো ও। শান্তস্বরে বললো,

– আই এম নট গোয়িং টু ডাই মিস্টার তাশদীদ।আপনি বরং প্রার্থনা করতে থাকুন, আমাদের আর কখনো দেখা না হোক।

তাথৈ থামলো। রীতিমতো হুমকি বুঝিয়েছে ও। ওর আত্নবিশ্বাস ছিলো, যেখানে তাথৈ আলফেজ একটা নামই যথেষ্ট হুল্লোড় পরে যাওয়ার জন্য, সেখানে ওর এমন সতর্কবানী অবশ্যই তাশদীদকে দমাতে সক্ষম। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে, দমে যাওয়ার পরিবর্তে ঠোঁটে হাসি ফোটালো তাশদীদ। সে হাসি এতোটাই স্নিগ্ধ ছিলো যে তাথৈয়ের তৃপ্তি, আত্মবিশ্বাস মিটে গেলো নিমিষেই। পুনরায় ঈর্ষা হলো ওর তাশদীদের সুখের ওপর। তাশদীদ ওর চমৎকার হাসিটা বহাল রেখে বললো,

– লোকে বলে পৃথিবী গোল। বেচে থাকলে দ্বিতীয়বার দেখা হয়েই যায়।

তাথৈ বড়বড় চোখে তাকালো। তাশদীদের বুকপকেট থেকে আপনাআপনিই হাত নেমে আসলো ওর। তাশদীদ পকেট থেকে কার্ডটা বের করে, ওর হাতে ধরিয়ে দিলো। কিঞ্চিৎ ঝুকে ফিসফিসিয়ে বললো,

– আর এই সুন্দর পৃথিবীতে আপনি বেচে থাকতে চলেছেন মিস তাথৈ। কনগ্রাচুলেশনস।

বলা শেষ করে তাশদীদ আর দাড়ালো না। এগিয়ে গেলো নিজের ভাঙাচোরা সাইকেলের দিকে। ওটাকে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে, কোনোমতে দাড় করালো। যেহেতু সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই, শীষ বাজাতে বাজাতে ওটা নিয়ে হাটা লাগালো ও। তাথৈ নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাশদীদের পিঠের দিকে। এতোক্ষণে ওর নিথর-নিস্প্রান দেহটা ফ্লাইওভারের নিচে পরে থাকার কথা। আত্মহত্যার দায়ে ওর প্রাণের শাস্তিভোগ পর্বও শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ কি ঘটলো? এই শুনশান ফ্লাইওভারে এক অতিসাধারণ মানব সেটায় বাধা হয়ে দাড়ালো। তাথৈ আলফেজের পরিকল্পনা বদলে গেলো তার উপস্থিতিতে। ফ্লাইওভারের দুধারে জ্বলা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলো চিড়ে, বেখেয়ালিভাবে হেটে চলেছে সে অদ্ভুত মানুষটা। চারপাশে রাতের স্তব্ধতা ভেদ করে, সে মানবের শীষে মৃদঙ্গ উঠেছে, ‘ আমি জানি কোনো এক দিন, কোনো এক নতুন ভোরে…দেখা হবে আমাদের আবার, এক স্বপ্নের শহরে…’

#চলবে…