কার্নিশ ছোঁয়া অলকমেঘ পর্ব-৩+৪

0
209

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৩.

পশ্চিমা বাতাসে ভরে আছে তাশদীদের ঘরটা। পুরো বাড়ির ওপর ছায়া করে রেখেছে সুবিশাল গাছপালাগুলো। প্রাকৃতিক শীতলতা এতোবেশি যে, গরমের দিনেও এ ঘরের ফ্যান ছাড়ার প্রয়োজন পরে না বললেই চলে। টিনের ছাদ বলে তাশদীদের ঘরে গাছের ডালের ঘর্ষনের আওয়াজ শোনা যায়। টুংটাং পাতা পরার শব্দও আসে প্রায়শই। তাশদীদ পড়ার টেবিলে বসে পাঁচ আঙুলে পেন্সিল ঘোরাচ্ছে। ওর খাতায় থাকা চিত্র আর লেখাগুলোর স্পষ্টতা এতোটাই বেশি যে, কয়েককদম দুর থেকেও বোঝা যাবে, ও কি লিখেছে। বেশ কিছুক্ষন খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে, চেয়ারের পেছনে হেলান দিয়ে বসলো তাশদীদ। খাতা ছেড়ে চোখ তুলে তাকালো জানালার ওপারের সবুজ পরিবেশটায়। পুকুরের সামনের ফাকা জায়গাটুকো ঘাসে ভরা। সেখানে ছোটছোট ভৃঙ্গরাজ কমলা রঙের সজ্জার মতো জ্বলজ্বল করছে। পুকুরের এপাশটায় সিড়িবাধানো ঘাট। সিড়ির একপাশে একটা হেলানো হিজল গাছ আছে। ছোটবেলায় ওই গাছ থেকে পুকুরে তাশদীদ কতো ঝাঁপাঝাপি করেছে, হিসেব নেই। অথচ এখন ওখানে বসলেই পা পানি ছোঁয়।

সময় কতো দ্রুত গরায়। এসব ভেবে মুচকি হাসলো তাশদীদ। হঠাৎই ওর চোখ যায় হিজলগাছে বসা এক কাঠঠোকরার দিকে। বড়বড় ঠোঁট দিয়ে, গাছের গায়ে গজানো একপ্রকার ছত্রাক খাচ্ছে সে। তাশদীদ মৃদ্যু আওয়াজে ‘সুবহানাল্লাহ্’ আওড়ালো। যা এক প্রাণীর জন্য বিষস্বরুপ, সেটাকেই কোনো এক প্রাণীর জন্য ভক্ষনযোগ্য করে দিয়েছে সৃষ্টিকর্তা। তার সৃষ্টি কতোটা সুষম সমীকরনে চলে। তাশদীদের দৃষ্টি বদলে নিজের খাতায় তাকালো। ওর মনে পরে গেলো, মানুষের হাতে তৈরী অসম সমীকরন কতোটা ভয়াবহ হতে পারে। ঠিক সে সময়েই ক্রিকেটব্যাট আর স্ট্যাম্পের ব্যাগ কাধে করে ঘরে ঢুকলো তামজীদ। এককোনে রেখে তোয়ালে দিয়ে গলার ঘাম মুছতে মুছতে বললো,

– আব্বু আমাকে ম্যাথ কোচিংয়ে দিলো না কেনো রে ভাইয়া? অলরেডি জেএসসি অটোপাশ বলে মেয়ে জুটবে না এই চিন্তায় আছি৷ তোরা কি আমার এসএসসি ব্যাকগ্রাউন্ডে ম্যাথে ফেল, এ কথাটাও এড করতে চাইছিস নাকি?

তাশদীদ খাতাপত্র বন্ধ করলো। পেছন ফিরে ভ্রু কুচকে বললো,

– কেনো? তোর ম্যাথের কোচিং করা লাগবে?

– তো?

তামজীদের পাল্টা প্রশ্ন শুনে কপাল শিথিল হয়ে আসলো তাশদীদের। বললো,

– তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি তোর ওই এসএসসি ম্যাথের বাপ, হায়ারম্যাথ পড়াই। সেটাও এইচএসসি, এডমিশনের।

তামজীদ গলায় তোয়ালে ডলতে ডলতে থামলো। কিছু একটা ভেবে বললো,

– তো? তারমানে তো আর এই না তুই এসএসসি জেনারেল ম্যাথও পড়াতে পারবি।

তাশদীদ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ওরদিকে পেন্সিল ছুড়ে মারলো। বাকা হয়ে সেটা পাশ কাটিয়ে নিলো তামজীদ। হেসে দিয়ে বললো,

– সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করবি, হলে উঠবি না? তুই প্রীতিকার্নিশ ছাড়বি, হলে থাকবি, ওখানকার খালের পানির মতো ডাল দিয়ে তিনবেলা আহার করবি, ছাড়পোকার কামড় খাবি, আমিতো এই ভেবেই খুশি হচ্ছিলাম।

– তোর সে আশায় গুড়েবালি। এদিক থেকে ভার্সিটির বাস যায়।

বলা শেষে তাশদীদ আবারো খাতায় মনোযোগ দিলো। তামজীদ এগিয়ে এসে টেবিলের একপাশে চড়ে বসলো। সেখানে ছোট একটা বাটিতে কিছু ড্রাইফ্রুটস রাখা ছিলো। তার কয়েকটা মুখে পুরে বললো,

– জানতাম মায়ের আঁচল ছেড়ে তুই কোথাও যাবি না। আচ্ছা না গেলি হলে। আমার জন্য একটু কামলা খেটে দিস। বেতন কতো নিবি সেটা বল?

– দশ হাজার।

প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের কন্ঠে দরজায় তাকালো দুই ভাই। সেখানে ওয়াসীর সাহেবের বন্ধু সৈয়দ সাহেব দাড়ানো। অনেকবছর বিদেশে ছিলেন উনি। তাশদীদ তাকে চিনতে পারলো সহজেই। প্রায়ই যোগাযোগ হয় তার সাথে ওর বাবার। ও হাসিমুখে উঠে এলো। সালাম দিয়ে বললো,

– আরে সৈয়দ আঙ্কেল! হোয়াট আ সারপ্রাইজ! আসো ভেতরে আসো। কেমন আছে বলো? দেশে আসলে কবে?

সৈয়দ সাহেব ভেতরে ঢুকলেন। তাশদীদের কাধে হাত রেখে বললেন,

– গতকাল ফিরেছি। আছি ভালোই! তুমি কেমন আছো ইয়াংম্যান? মাত্র কয়েকবছরে বেশ বড়, বেশ হ্যান্ডসাম হয়ে গেছো দেখছি!

তাশদীদ কেবল হাসলো। তামজীদ অলসের মতোকরে টেবিলেই বসেই রইলো। আরোকিছু ড্রাইফ্রুট মুখে নিয়ে বিরবিরিয়ে বললো, ‘এইটারই বাকি ছিলো! প্রথমে রিংকি আপু, তারপর ওর মা, এখন ওর বাপ! যেই আসে, সবার কাছে ভাইয়াকে হ্যান্ডসাম লাগে। এদের ফ্যামিলির সবগুলোরই সমস্যা আছে।’
কথাটা কানে গেলো না কারোরই। খুবই স্বাভাবিকভাবে সবার সাথে আলাপ করলেন সৈয়দ সাহেব। শামীমা বেগম হালকা নাস্তায় আপ্যায়ন করলেন তাকে। সবই ঠিক ছিলো। কিন্তু সমস্যা হলো অন্যত্র। সৈয়দ সাহেব যাওয়ার আগে হুট করেই এক আবদার করে বসলেন তাশদীদের কাছে। তার ছোট মেয়ে রিংকি এবার ইন্টারে উঠলো। যেহেতু তাশদীদ এদিকটাতে টিউশন করা, সে চায়, রিংকিকেও তাশদীদই পড়াক। সময়-বেতন এসব কোনো বিষয় না। ওর যখন খুশি তখন রিংকিকে পড়াবে। ব্যাপারটায় তাশদীদের আপত্তি থাকলেও প্রকাশ করার সুযোগ পেলো না ও। কারন ওয়াসীর সাহেব বন্ধুর সাথে একমত ছিলেন। হ্যাঁ সূচক জবাব নিয়ে খুশিমনে বেরিয়ে গেলেন সৈয়দ সাহেব। উনি বেরিয়ে যেতেই মুখটা পানসে হয়ে গেলো তাশদীদের। তামজীদ ভাইয়ের মুখ দেখে বিটকালী টাইপ হাসি দিলো একটা। মাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে বললো,

– ও মা? তোমার ছেলেবউ হিসেবে কেমন মেয়ে পছন্দ গো? ইন্টারপড়ুয়া নিব্বি হলে চলবে?

আশপাশে তাকিয়ে ফুলঝাড়ুটাই চোখে পরলো তাশদীদের। তামজীদ ওর আগেই ওটা নিয়ে বাইরে ছুট লাগালো। তাশদীদও ছুটলো ওর পেছন পেছন। পুকুরপাড়ে যেতেই তাশদীদ ধরে ফেললো তামজীদকে। ওর এতোবেশি লেগেছে কথাটা, বগলদাবা করে তামজীদকে ও পুকুরে ছুড়ে মারলো রীতিমতো। তারপর পাড়ে হাটু ভাজ করে বসে গিয়ে বললো,

– ছোট ছেলের বউ হিসেবে ইন্টারপড়ুয়া নিব্বি মায়ের হেব্বি পছন্দ তামজীদ। আরেকদিন এ জাতীয় কিছু বলবি তো যেভাবে জোর করে তোর সুন্নাতে খাতনা করিয়ে দিয়েছিলাম, সেভাবে জোর করে ওই নিব্বির সাথে তোর বিয়েটাও দিয়ে দেবো। মনে রাখিস!

বলা শেষ করে তাশদীদ উঠে দাড়ালো। টিশার্ট টান মেরে ঠিকঠাক করে, পকেটে হাত গুজে শীষ বাজাতে বাজাতে চলে গেলো ও। তামজীদ অতল পানিতে কোনোমতে ভেসে থেকে চেচিয়ে বললো,

– আজ তুই যা করলি, অভিশাপ দিলাম ভাইয়া। তোর কপালে বেনারসির লাল বউ না, রাগে লাল হয়ে থাকা বউ জুটবে। যে কিনা উঠতে বসতে এই পুকুরে ছুড়ে মারবে তোকে। সেকেন্ডেসেকেন্ডে তার রাগে ভস্ম হয়ে যাবি তুই। নতুন ক্যাম্পাসে দীপান্বিতা না, রাগান্বিতা পেতে চলেছিস তুই! রাগান্বিতা!

তাশদীদ থামলো। নিরস চাওনিতে তাকালো ভাইয়ের দিকে। তারপর তাকালো পায়ের নিচে থাকা ভৃঙ্গরাজের দিকে। কি ভেবে আনমনে বলে উঠলো, ‘আমার ভাবনা থেকে দুরে থাকুন মিস তাথৈ আলফেজ। আপনার আর আমার পৃথিবী সম্পুর্ন আলাদা। সম্পুর্ন!’

বড়সড় ঘরটায় জানালা নেই। তবে ঘর আর ব্যালকনির মাঝে কাচের দেয়াল। সেখান দিয়েই বেলা এগারোটার সবখানি রোদ ভেতরে আসতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। পর্দা টানিয়ে তাদেরকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিছানার ঠিক নিচেই পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে তাথৈ। ওর ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। চোখের নিচে কালি পরে গেছে। মাথার ভেজা চুলগুলো ভিজিয়ে দিচ্ছে বেডশিট। দৃষ্টি ছাদের দিকে। কিন্তু চোখে ভাসছে নানান মুহুর্ত। ওকে পাওয়ার জন্য অন্তুর করা পাগলামোগুলো। তাথৈয়ের জেদী মনে বরাবর কেবল একটাই মতবাদ ছিলো, ‘পুরুষ মানুষ কখনো কাউকে ভালোবাসে না। ওকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।’ কিন্তু নানাভাবে, নানা পাগলামিতে সে বেড়া ভেদ করেছিলো অন্তু। যে তাথৈ কিনা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই পুরুষ, নিজের বাবা-ভাইকেও কোনোদিন গুরুত্ব দেয়নি; প্রথমবারের মতো সেই তাথৈ কোনো পুরুষের প্রেমকে স্বীকার করে নিয়েছিলো। তাথৈ মেনে নিয়েছিলো, ওকে বোঝার মতো, ভালোবাসার মতো পৃথিবীতে কেবল একজনই আছে। সেটা অন্তু। কিন্তু না! সময় এবারেও ওকে বুঝিয়ে দিলো, ছেলেরা ভালোবাসতে জানে না। যা দেখায়, সেটা কেবলই নাটক! ছল! ওর জন্য আকাশপাতাল এক করে দিতে চাওয়া সেই অন্তু আজ বদলে গেছে। এমনভাবে বদলে গেছে যে, ওকে ছেড়ে অন্যকারো সাথে সংসার করছে সে। ওদের নতুন সংসারের আজ একসপ্তাহ পুর্ণ হলো। তাথৈয়ের চোখের কোনা বেয়ে জল গরায়। কি মনে করে উঠে কাবার্ডের দিকে এগোয় ও। কাবার্ড হাতড়ে খুজে বের করে দুটো আংটি, একটা ব্রেসলেট, আরেকটা পেন্ডেন্ট। ওগুলো দেখে দাঁতে দাঁত চেপে যায় তাথৈ। ছুড়ে মারে দরজার দিকে।

পায়ের নিচে আংটি, ব্রেসলেট আর পেন্ডেন্ট দেখে দরজাতেই থেমে যায় তুল্য। পুরো ঘরে চোখ বুলায় ও। পুরো এক সপ্তাহ এ ঘরে আসেনি কেউ। তাথৈ দিনে একবার করে নিচে নেমেছে, একটাদুটো ফল আর ফ্রিজ থেকে পানির বোতল নিয়ে রুমে ঢুকেছে। জোর করে বেচে থাকার চেষ্টা যাকে বলে। ঘরের একটা জিনিসও নিজের জায়গায় ঠিকঠাক নেই। টেবিলের বইখাতা, শেলফের বই, শো পিস, ফুলদানী, দেয়ালের কাচের মোড়কের পেইন্টিংগুলো সব ফ্লোরে পরে আছে। মেঝেতে কেবল কাগল আর কাচের টুকরো। কাচের দেয়ালের সাদা পাতলা পর্দাদুটো টেনে ছিড়ে ফেলা। বিছানার চাদর উল্টেপাল্টে দেওয়া। ফুলদানীর নকল ফুল, দেয়ালে আঁটা নকল পাতা সব বিক্ষিপ্তভাবে পরে আছে। বেডসাইড টেবিলে থাকা ল্যাম্পশেডটাও ছাড় পায়নি। তাথৈ তুল্যকে দেখেনি। অন্তুর দেওয়া জিনিসপত্র ছুড়ে মেরে বিছানায় গেছে সে। একপা ভাজ করে বসে, দ্রুততার সাথে ল্যাপটপ খুললো ও। নাক টেনে কিবোর্ডে আঙুল চালাতে লাগলো। তুল্য ওর পেছনে দাড়ানো সার্ভ বয়কে ইশারা করলো কিছু একটা। সে চুপচাপ ওয়ারড্রবের ওপর হাতের ট্রে টা রেখে চলে গেলো। তাথৈ নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ল্যাপটপে ব্যস্ত৷ তুল্য নিচ থেকে আংটিগুলো তুলে হাতে নিয়ে বললো,

– কোনটা আসল ডায়মন্ড, আর কোনটা নকল, সেটা আজও বুঝে উঠতে পারলি না তাথৈ।

তাথৈ শক্তচোখে তাকালো। বললো,

– নক না করে ভেতরে এসেছিস কেনো?

তুল্য পাত্তা দিলো না। ভেতরে ঢুকে ট্রে থেকে পাউরুটির একফালি হাতে নিলো। চাকুতে জ্যাম নিয়ে পাউরুটিতে লাগিয়ে তাতে কামড় বসালো। লাফিয়ে লাফিয়ে কাচের টুকরো পার করে তাথৈয়ের বিছানার কাছে এসে দাড়ালো ও। ডানহাতে পাউরুটি ধরে রেখে, বাহাত প্যান্টের পকেটে গুজলো। চিবোতে চিবোতে বললো,

– তোর ভাই হয়ে পরে গেছি বিপদে। হেড অফ এক্সাম পিয়নের মতো খাটাচ্ছে আমাকে। তোকে দেখা করতে বলেছে। এটেনডেন্স সিক্সটির কম হয়ে গেছে নাকি?

তুল্য প্রশ্নসুচক দৃষ্টিতে বোনের দিকে মাথা ঝুকালো। তাথৈয়ের তেমনি শক্ত চাওনি। ছোটবেলা থেকেই ওরা দু ভাইবোন যথেষ্ট মেধাবী। জীবনের কোনো তাল ঠিক না থাকলেও, পড়াশোনা ঠিকঠাকমতো ধরে রেখেছে দুজনেই। অবশ্য এরও কারন আছে। একই বিভাগে পড়াশোনা করছে ওরা। তাই দুজনের কারো কিছু এদিক ওদিক হলে খবর নেওয়াটা আহামরি কিছু না। জবাব না পেয়ে তুল্য ঘাড় ঘুরিয়ে ওর ল্যাপটপের দিকে তাকালো৷ অনেকগুলো ফাইল ডিলিট হচ্ছে সেখানে। তুল্য তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,

– আসলেও তুই একটা লেইম। জানিস না? স্মৃতিহত্যার চেয়ে আত্মহত্যা সহজ। এইযে না খেয়ে আছিস, কদিন পর এমনিতেও মরে যাবি। এই ছবিটবি ডিলিট করার কি দরকার?

– গেট আউট অফ মাই রুম তুল্য!

রাগে গর্জে ওঠে তাথৈ। ঠেলে ল্যাপটপটাও নিচে ফেলে দেয়। ওর চিৎকারে কেপে ওঠে পুরো অম্বুনীড়। তুল্য পকেট থেকে হাত বের করে উচিয়ে বললো,

– উউউউউ….রিল্যাক্স বেহেন। রিল্যাক্স।

তাথৈ রাগে জোরেজোরে শ্বাস ফেলছে। তুল্য পাউরুটিটা পুরোপুরি মুখে নিয়ে বললো,

– আমি তো তোকে ভালো পরামর্শ দিতে এসেছিলাম। বুঝলি না। অবশ্য তুই ভালো হলে তবেতো আমার ভালো পরামর্শ কানে তুলবি। সে যাকগে। আসলে ব্যপারটা কি বলতো? তৈয়ব আলফেজকে আমার একবিন্দু বিশ্বাস নেই। তাই তোকে একটু আলাদাভাবে ট্রিট করি। প্রোপার্টির ফিফটিপার্সেন্ট শেয়ার করার মতো বাড়ে দিলওয়ালা আমি নই। আই ওয়ান্ট টোটাল ওয়ান হান্ড্রেট পার্সেন্ট অফ ইট।

তাথৈ বিছানা ছাড়লো। ঘরের এককোনে থাকা হকিস্টিক নিয়ে ছোট্ট সেন্টারটেবিলের দিকে এগোলো। তুল্য ঠোঁট টিপে হাসছে। ঘরের ওই একটা বস্তুই অক্ষত ছিলো। আর সেটাও এখন নজরে পরে গেছে তাথৈয়ের। সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যে তীব্র আওয়াজে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো তুল্য। দুদন্ড সময় নিয়ে চোখ মেলে দেখে, সত্যিই টেবিলটা ভেঙে একাকার। তাথৈ হকিস্টিক মেঝে ছুয়েছুয়ে এলোমেলো পায়ে ভাইয়ের দিকে এগোলো। ওর চোখে চোখ রেখে বললো,

– এই প্রোপার্টির হান্ড্রেট কেনো, ফিফটি কেনো, পয়েন্ট জিরো জিরো ওয়ান পার্সেন্টও তোর জুটবে না। এভাবেই তোর স্বপ্নে ভেঙে চুরমার করে দেবো আমি তুল্য। জাস্ট ওয়েট, এন্ড ওয়াচ।

তুল্য ‘হেহে’ করে হেসে উঠলো। তাথৈয়ের মাথার এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে বললো,

– তার আগে বেচে থাক।

লম্বালম্বা পা ফেলে, মেঝের কাচ ডিঙিয়ে দরজা অবদি পৌছালো তুল্য। ট্রে থেকে একটুকরো আপেল নিয়ে মুখে পুরে বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। তাথৈ ধপ করে বিছানায় বসে পরে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় মেঝের দিকে। তুল্য ভুল বলেনি। বেচে থাকাটাই পর জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাড়িয়েছে এখন। ওর জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তুল্য করিডোরে আসতেই অসতর্কতার জন্য ধাক্কা খায় কারো সাথে। চোখ তুলে তাকালো ও। এতোক্ষন ঠিকঠাক থাকলেও, সামনের দুজনকে দেখে তৎক্ষনাৎ মেজাজ বিগড়ে গেলো ওর। দুজনের একজনের নাম রুমন। হ্যাংলাপাতলা ছেলেটা তাথৈয়ের স্কুলের বন্ধু। আপাতত নাট্যকলায় পড়ছে। রুমনের বৈশিষ্ট্য, ছেলে হলেও, ছোটবেলা থেকেই মেয়েলী স্বভাব নিয়েই চলাফেরা করে ও। ওর কথা বলার ভঙিমা, চলাফেরা সবই মেয়েদের মতো। মাথার চুলও ঘাড় অবদি। বেশভুষাতেই বোঝা যায়, নারীসত্ত্বা তার অনেক প্রিয়। আজেও তার ভিন্নতর না। টিশার্টের সাথে ওড়নার মতো কিছু একটা গলায় মুড়িয়ে রেখেছে, হাতে আংটি, ঢোলাঢালা জিন্স পরিহিত রুমন তুল্যকে দেখেই সুর তুলে বললো,

– হাই হ্যান্ডসাম। কেমন আছো? ধাক্কাটা সবসময় শার্লির সাথে না খেয়ে, কখনোসখনো আমার সাথে খেলেও তো পারো!

তুল্য পাশে তাকালো। শার্লি নামক মানবীও ওর দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে। তাথৈয়ের সাথে শার্লির চেনাজানা ভার্সিটিতে এসে। একই ডিপার্টমেন্টে ওরা। ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসের বাইরে, এদের তিনজনকে একসাথেই পাওয়া যায়। বেশ ভালোমতোই তাথৈয়ের স্বভাবকে বুঝে গেছে ওরা দুজন। তবে শার্লি রুমনের উল্টো। মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও তার মাঝে মেয়েদের কোনো বেশভূষন নেই। ছেলেদের মতো শার্ট-প্যান্ট পরিহিত, হাতা গুটানো, হাতে মোটা ফিতের ঘড়ি, পায়ে সাদা বুট জুতা। তুল্য ভেবে পায়না, দুনিয়ার সবচেয়ে আজব প্রাণীদুটোকে তাথৈ একইসাথে কিকরে জুটালো। তুল্য মেজাজ দেখিয়ে শার্লিকে বললো,

– তোরা এখানে কেনো? তোদের না বারণ করেছি তাথৈয়ের সাথে মিশতে!

শার্লি ওর কথাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা দিলো না। পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ওর ওমন গা ছাড়া ভাব দেখে তুল্যর রাগ চাদি ছুলো যেনো। চেচাতে যাবে, রুমন তৎক্ষনাৎ ওর পথ আগলে দাড়ালো। ওর বুকে আঙুল ঠেকিয়ে জড়ানো কন্ঠে বললো,

– তাথৈয়ের সাথে মিশবো না তো কার সাথে মিশবো হ্যান্ডসাম? তুমি ফ্রি আছো?

তুল্য অন্যদিক ফিরে মুখ দিয়ে শ্বাস ফেললো। ও বরাবর আশ্চর্য হয় এটা ভেবে, এতো রাগী তাথৈ এটাকে সহ্য করে কিভাবে? এইটার যন্ত্রনায় কবে ও নিজেই না সুইসাইড করে। কি ভেবে পরপরই রুমনের দিকে তাকিয়ে জোরালো হাসি দিলো তুল্য। দুষ্টুমিমিশ্রিত কন্ঠে বললো,

– ইয়াহ বেব। তোর জন্য আজ আমি পুরোপুরি ফ্রি। সকালে জিমে যাইনি। সো…উইল ইউ বি মাই বার্বেল?

তুল্যর বুক থেকে আঙুল সরিয়ে নিলো রুমন। চকচকে চোখে চেয়ে, আঙুল কামড়ে ধরলো নিজের। উত্তেজিত হয়ে বলে,

– ইয়েস ইয়েস! প্লিজ!!!

তুল্য সময় নেয়নি৷ শুধু ডানহাতে জড়িয়ে রুমনকে অনেকটা উচু করে নেয় ও। রুমন কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুল্য করিডোরের কিনারায় চলে আসে। দুহাতে উচু করে ওকে নিচতলায় ফেলে দেবার ভঙিমায় ঝুলিয়ে দেয় রুমনকে। অবস্থান টের পেতেই আত্মা বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয় রুমনের। চোখজোড়াও বিস্ফোরিত। তুল্য কেবল একহাতে ওর হাত জরিয়ে রেখে, ওর কানের কাছে মুখ নিলো। ফিসফিসিয়ে বললো,

– নাও টেল মি বেব। উইল ইউ বি মাই….আনবেয়ারেবল ডাম্বেল?

রুমন আঁতকে উঠে তুল্যর টিশার্ট খামচে ধরে। নিচদিক তাকাতেই জান উড়ে যাওয়া অবস্থা হচ্ছে ওর। ভয় পেয়ে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেদে দিয়ে বলে,

– না তুল্য প্লিজ! আমার ওজন মাত্র তেতাল্লিশ। শুধু আমাকে কেনো, আমার মতো আরো তিনটাকে হাওয়ায় নাচাতে পারো তুমি। প্লিজ আমাকে আনবেয়ারেবল বলো না। আমি আর তোমার বার্বেল হতে চাইবো না! প্লিজ এবারের মতো ছেড়ে দাও! প্লিজ? প্লিজজজজ!

– ওকে ছাড়লাম…

তুল্য হাত আলগা করতে যাচ্ছিলো। রুমন হাউমাউ করে কেদে ওঠে। শার্লি তাথৈয়ের রুমের অবস্থা দেখে ইতিমধ্যে স্তব্ধ হয়ে ছিলো। তাথৈকে ডাকা হয়ই নি ওর। রুমনের চিৎকার শুনে আবারো রুমের বাইরে ছুট লাগায় ও। শব্দটা কানে আসে তাথৈয়েরও। গলাটা রুমনের টের পেয়ে বেরিয়ে আসে ওউ। বেরিয়ে দেখে করিডোরের রেলিংয়ের নিচে তুল্যর হাতে রুমনে ঝুলছে আর কাদছে। তাথৈ হনহনিয়ে এগিয়ে আসলো। তুল্যর আরেকহাতে টান মেরে চেচিয়ে বললো,

– হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? লিভ হিম ড্যামিট! লিভ হিম!

– আগে বল ও হিম নাকি হার। তারপর ছাড়ছি।

তাথৈ একপলক তুল্যর দিকে তাকিয়ে নিজেই হাত বাড়ালো রুমনের দিকে। শব্দ শুনে তৈয়ব আলফেজ সোফা থেকে এগিয়ে এসে ওপরে তাকালেন। ওপরতলার অবস্থা দেখে ধমকির স্বরে বললেন,

– কি হচ্ছে টা কি তুল্য-তাথৈ! বাসাকে পুরো সার্কাস বানিয়ে দিয়েছো দুজনে মিলে!

তুল্যর এতোক্ষণ বেশ মজা লাগলেও এবার রাগ হলো। তৈয়ব আলফেজের মতো মানুষ ওর ভুল ধরুক, সেটা ও চায়না। রুমনকে টেনে ওপরে ওঠায় ও। রুমনের কাশি উঠে গেছে। তাথৈ তুল্যর দিকে আঙুল উচিয়ে বললো,

– নেক্সটটাইম ওদের সাথে মিসবিহেভ করলে আমি তোকে ছেড়ে কথা বলবো না তুল্য।

– তারচেয়ে বরং এটাকে বল আমার ত্রিসীমানায় না আসতে। পারলে তুইও দুরে থাক। ওদের জন্য তুইও মানুষ চিনতে ভুল করিস। ছেলে মেয়ে সাজে, মেয়ে ছেলে। আর অন্তু? লম্পট থেকে সাধু।

হাত ঝারা মেরে তুল্য আরেকপলক রুমনের দিকে তাকায়। তারপর চলে যায় ওখান থেকে। শার্লি এগিয়ে আসলো৷ ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে দিলো রুমনকে৷ তুল্য আড়াল হতেই তাথৈ রুমনের কলার চেপে ধরলো। কড়া গলায় বললো,

– পীরিত উতলেছে বলে আমাকে দেখতে এসেছিস মানলাম। তুল্যর গায়ে পরতে যাস কেনো? ইচ্ছে তো করছে আমিই তোকে এখন নিচে ফেলে দেই ইডিয়ট!

ধাক্কা মেরে রুমনকে পেছনে ঠেলে দিলো তাথৈ। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আবারো দরজা লাগিয়ে দিলো শব্দ করে। শার্লি-রুমন পাথরের মতো দাড়িয়ে রইলো। একে অপরের দিকে ফাঁকাদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো দুজনে। ওদের মন বোধহয় একই কথা আওড়ালো, ‘ওরা অত্যন্ত জলিল স্যারের তৈরি কোনো এক ছায়াছবির দর্শক। আর সে ছবির নাম, রাগ- দ্যা আলফেজ ডটার এন্ড সন।’

#চলবে…

#কার্নিশ_ছোঁয়া_অলকমেঘ
লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

৪.

– অন্তু ভাই তোমাকে ঠকাইনি তাথৈ। তুমি নিজে হারিয়েছো তাকে।

অতি সাবলীলভাবে কথাটা বললো সামনের মেয়েটা৷ ওর নীমিলিত চোখে চোখ রেখে টেবিলে রাখা দুহাত মুঠো করে নিলো তাথৈ। মেয়েটা ওর থেকে চোখ নামিয়ে নিলো। দুদন্ড এদিকওদিক তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি তুলে বললো,

– সবাই জানছে, ভার্সিটির নজরকারা জুটিটা শেষ হওয়ার জন্য দায়ী অন্তু ভাই। সত্যিই কি তাই তাথৈ?

– মন থেকে বলোতো? তোমাদের বিচ্ছেদের জন্য কি ভাই দায়ী? সে কি সত্যিই তোমাকে ঠকিয়ে অন্যকাউকে বিয়ে করে নিলো? নাকি ঠকে যাওয়া থেকে বাচতে তোমার থেকে দুরে সরে গেলো? কোনটা?

– স্টপ ব্লেমিং মি আলো! আমার সহ্য হচ্ছে না তোমার এইসব কথা।

বলে বড় একটা দম ছাড়লো তাথৈ। রাগে রীতিমতো কাপছে ও। আলো ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো। দুনিয়াতে ওই একটা মানুষ, যার সাথে এখনো অবদি তাথৈ উচ্চস্বরে কথা বলেনি। প্রথম সেমিস্টারের রেজাল্ট পর, ডিপার্টমেন্টে তৃতীয় স্থান দখল করা মেয়েটা আলো। তার আগঅবদি ওকে কেউ না চিনলেও, রেজাল্টপর সবার পরিচিতমুখ হয়ে ওঠে ও। তবে তাথৈয়ের সাথে ওর কথাবার্তার শুরুটা আলাদাভাবে হয়েছিলো। একবার পরীক্ষার প্রশ্নে টপিকের বাইরে থেকে কিছু প্রশ্ন এসেছিলো৷ পুরো ক্লাসে হুল্লোড় পরে গেলেও, সবগুলো প্রশ্নের উত্তর লিখেছিলো তাথৈ। বাকিসবের উন্মাদনা দেখে পরীক্ষার একঘন্টা পেরোনোর পর পরীক্ষক এসে প্রশ্ন শুধরে দেন। সাথে অতিরিক্ত সময়ও বরাদ্দ করেন। কিন্তু তাথৈয়ের তাতে অমত ছিলো। ওর অন্য দরকারী কাজ আছে৷ অতিরিক্ত একঘন্টা পরীক্ষা দেবে না ও। তাই ও আগের প্রশ্নেই পরীক্ষা দিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো। পরীক্ষক বাধ সাধলেন। এক তাথৈকে আলাদা প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে দেবেন না উনি। অনেকবার বলার পর এক পর্যায়ে তাথৈয়েররাগটা এতোবেশি বেড়ে গিয়েছিলো যে, পরীক্ষার খাতা ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে যায় ও।
পুরো ক্লাস হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো শুধু। কিন্তু আলো বসে থাকেনি। ওয়াশরুমের কথা বলে বেরিয়ে আসে ও। ছুটে এসে তাথৈয়ের পথ আগলে দাড়ায়। ভ্রুকুটি করে ওরদিক তাকিয়ে ছিলো তাথৈ। আলোর মুখটা পরিচিত লাগেনি ওর সেদিন। আলো জানতে চায়, ও কেনো বেরিয়ে আসলো। ঠিক সেসময়ই তাথৈর ফোনে কল আসে একটা। জবাব না দিয়ে ফোন কানে তোলে ও। আলোকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে ফোনে বলে, ‘হ্যাঁ। আসছি আমি। যতো ব্লাড লাগে দেবো। সমস্যা নেই।’
রগচটা মেয়েটাকে সেদিন কেবল বিস্ময় নিয়ে দেখেছিলো আলো। আর বিস্ময়ে মিশে ছিলো সীমাহীন মুগ্ধতা। ক্লাসের আরোকিছু ছেলেমেয়েকে নিয়ে সোজা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে চলে যায় আলো। তাথৈয়ের হয়ে ওর পুনরায় পরীক্ষা নেবার জন্য আবেদন করে। আর ওর সে আবেদন মন্জুরও হয়। আলোর অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটা দমিয়ে দেয় তাথৈকে। পরিচয় হয় ওদের। তাথৈ জানতে পারে, নিম্নবিত্ত পরিবারের মেঝো মেয়ে আলো টিউশনি করিয়ে একাধারে নিজে পড়ছে, ছোটবোনকে পড়াচ্ছে, বাড়িতে মা বোন বাবার ভরনপোষণ করছে। তারপর থেকে আলো হয়ে ওঠে ওর সম্মানের নাম। এক এবং একমাত্র। ঘরে-বাইরে সব মিলিয়ে তাথৈ যার কথা কান পেতে শোনে, সেটা আলো। আজও তার বিপরীত হলোনা৷ নোটস নিতে সেমিনারে এসে আলোর একটাএকটা কথা শুনলো তাথৈ। ছলছল চোখে চেয়ে বললো,

– আমার ভুলটা কোথায়?

টুপটাপ জল গরায় তাথৈয়ের চোখ থেকে। আশপাশে তাকায় আলো। লুকিয়েচুরিয়ে হলেও সবাই কমবেশি তাথৈকেই দেখছে। এতোগুলো দিনে যাকে না হাসতে দেখেছে, না কারো কথায় চুপ থাকতে, সেই মেয়েটা আজ প্রকাশ্যে কাদছে। তাথৈয়ের মুঠে করা হাত মুঠো করে নিলো আলো। নমনীয় কন্ঠে বললো,

– লাভ ইউ টু বলার পরিবর্তে, শেষ কবে নিজে থেকে অন্তু ভাইকে ভালোবাসি বলেছো? ছ মাসে একবারো বলেছিলে?

প্রশ্নটা শুনেই তাথৈ আলোর থেকে দৃষ্টিচ্যুত করলো। নিরবতার জবাব বুঝে নিলো আলো। আবারো বললো,

– শেষ কবে অন্তু ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে ভাইকে মিস করেছো? কবে তার জন্য নিজেকে সাজিয়েছো? কবে তাকে বলেছো তোমাকে নিয়ে বেরোতে? কবে তার বলার আগে বলেছো লাভ ইউ? নিজে থেকে কখনো তাকে গিয়ে বলেছো, তুমি তাকে ভালোবাসো?

– উই হ্যাড রিলেশনশিপ।

জবাব দিয়ে আলোর হাত থেকে হাত সরিয়ে নিলো তাথৈ। আলো সামনে থেকে উঠে টেবিল ঘুরে এসে তাথৈয়ের পাশের চেয়ারটায় এসে বসলো। আবারো ওর হাত মুঠো করে নিয়ে বললো,

– হ্যাঁ। কেবল একটা সম্পর্ক ছিলো তোমাদের। যেটাতে ভালেবাসা ছিলো শুধু অন্তু ভাইয়ের আর তোমার কেবল সঙ্গ ছিলো। তার বেশি কিছুনা। ভাই তো ভালোবেসেছিলো তোমাকে, কিন্তু তুমি তাকে ভালোবাসোনি। নিজেকে একম্পানিড বুঝাতে তাকে হ্যাঁ বলেছিলে শুধু। এটা তুমিও জানো।

তাথৈ চুপ। আলো ওর চোখের কোনা মুছে দিলো। উঁকি দিয়ে ওর শক্তপোক্ত মুখটা দেখে নিলো একবার। তারপর থুতনি ধরে ওকে নিজের দিকে ঘোরালো। বললো,

– ভালোবাসা নামক চার অক্ষরের শব্দটা অনেক জটিল তাথৈ। এই চার অক্ষের শব্দে মানুষ নিঃস্ব হয়, দিশেহারা হয়। এই চার অক্ষরের শব্দ মানুষকে সব করতে শেখায়। নিজেকে গড়তে, পৃথিবীর সব নিয়মকে ভাঙতে, সব! এই চার বর্ণের অনূভুতি তোমায় চারবার মৃত্যুপরিমান যন্ত্রণা দেবে, আবার চারবার নবজন্মের সুখ দেবে। এতো সহজে ভালোবাসা হয়না। লাভ ইউ এর বিপরীতে লাভ ইু টু বললেই ভালোবাসা হয়না। আর ভালোবাসলে, তাকে ঘৃণা করা যায়না। থমকে যেতে হয়। ওই একজনে আটকে যেতে হয়। আজন্মের তরে।

– যে অনূভুতি আমাকে আটকে দেবে, সে বিশ্রি চারবর্ণের অনুভূতির কোনো প্রয়োজন নেই আমার আলো। ভাগ্যিস আমি ভালোবাসতে জানিনা!

আলোর হাত সরিয়ে দিয়ে বই নিয়ে উঠে আসছিলো তাথৈ। আলো পেছনে বসা থেকে বলে উঠলো,

– সেটা তো ভাবছি, যেই তুমি ছুটেছো ভালোবাসবে না বলে, সেই তুমি যখন কাউকে ভালোবাসবে, তা কতোটা ভয়ানক হবে। ভদ্রলোক নিসন্দেহে ভাগ্যবান!

তাথৈ আর একমুহুর্ত দাড়ালো না। দ্রুতপদে বেরিয়ে আসলো ওখান থেকে। মুলভবন থেকে বেরোতেই দেখে রুমন সামনের সিড়িতে বসে। নেইলকাটার দিয়ে ও বা হাতের নখ পলিশ করছে আর ফুঁ দিচ্ছে। ঠিক পাশেই জিন্স-চেক শার্ট পরিহিত শার্লি দাড়ানো৷ দেয়ালে একপা পা ঠেকিয়ে দাড়ানো। ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুল প্যান্টের পকেটে বাঝিয়ে, বিরক্তি নিয়ে নখের প্রতি রুমনের যত্মশীলতা পরখ করছে ও। তাথৈ এগোলো। ওকে দেখেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে, সোজা হয়ে দাড়ালো শার্লি। তাথৈ আগেরদিন ম্যাসেজ করে স্পষ্ট জানিয়েছিলো, ‘কাল ক্যাম্পাসে যাবো। তোদের দুটোকে আমার ধারেকাছেও যেনো না দেখি।’ শার্লি মানলেও মানেনি রুমন। শার্লি জানতো, তাথৈ নোটস নিতে সেমিনারে যাবে। দুইবছরের ভার্সিটি জীবনে সেখানে একবারের জন্যও উঁকি দেয়নি ও। কিন্তু রুমনকে নিয়ে আজ ঠিকি চলে এসেছে। তাথৈয়ের চাওনি দেখে কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে গেলো শার্লি। আমতা আমতা করে বললো,

– অব্…আ্ আমি কিছুই জানিনা। রুমন নিয়ে এসেছে আমাকে।

এতোক্ষন নিজের মতো ব্যস্ত থাকলেও, শার্লির কথায় ঘাড় তুললো রুমন। তাথৈকে দেখেই ফোকলা একটা হাসি দিলো। ওর রাগকে মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই থামিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

– ত্ তোকে আজ দেখতে অনেকসুন্দর লাগছে তাথৈ! একদম বার্বি!

তাথৈয়ের মেজাজ যেনো আরো বিগড়ে গেলো। ডানহাতে বইখাতা থাকায় বাহাতে রুমনের মাথায় মার লাগালো ও। ঝোঁক সামলাতে না পেরে, সিড়িতে বসা অবস্থা থেকে মুখ থুবড়ে নিচের ঘাসের মধ্যে গিয়ে পরলো রুমন। এমনিতেও ওজন কম বলে বাতাসের আগেআগে ছোটে ও। তারওপর এই মুহুর্তে তাথৈয়ের মারের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। গায়ে একটু বল পরতেই সবটা সম্মুখমুখী ত্বরণ দেখিয়ে দিয়েছে। রুমন পরতে পরতে পরতে মেয়েলী ভঙ্গিতে গেয়ে উঠলো,

– মার ডা’লা…আল্লাহ…মার ডালা…

তাথৈয়ের পায়ের তলা গরম হয়ে গেলো। শুধু ক্ষান্ত হলোনা রুমন। ঘাসের মধ্যে মুখ গুজে রেখে আবারো বলে উঠলো,

– আহ্! এ কোথায় ফেললি আমাকে তাথৈ! আহ কি সুবাস! এ তো মাটি নয়, যেনো মমতাময়ী মা!

– বেশি পছন্দ হলে বল, একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দেবার পর্যায়ে পাঠিয়ে দেই।

তাথৈয়ের কড়া কথায় রুমন মাথা তুললো। মুখ বাকিয়ে কাধের ব্যাগ থেকে ছোট আয়না আর টিস্যু বের করলো ও। চেহারা দেখে মুখে লেগে থাকা মাটি মুছতে মুছতে বললো,

– এক চুটকি মিট্টি কি কিমাত, তুম কেয়া জানো তাথৈ আলফেজ। তোর ভাই বললো তার থেকে দুর থাকতে। তুই শার্লিকে বলেছিস তোর সামনে না আসতে। দুভাইবোন মিলে উল্টাপাল্টা ডায়লগ কেনো দিস? আমি দেবদাস নই। আ’ম ড্রিমগার্ল। ওকে?

শব্দ করে হেসে দিলো শার্লি। তাথৈ শীতল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো। যার মানে, আমার জীবনের এমন চুড়ান্ত অশান্তির মাঝে তুই রুমন নামক অশান্তিকেও দাওয়াত করে এনেছিস। শার্লি হচকিয়ে যায়। এমনিতে রুমনের মার খাওয়াটা নতুন কিছু না। ও আর তাথৈ দুজনে মিলে নিয়মিত মার লাগায় ওকে। কিন্তু আজ তাথৈ ওর ওপরও ক্ষেপেছে। ছেলেদের মতো বেশভুষার জন্য চেনাপরিচিতরা ওকে বেশ সাহসী বলেই জানে। কিন্তু ও জানে, তাথৈ ওর সব সাহসের খন্ডন করতে পারে। ভীতিগ্রস্ত চোখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো শার্লি। একটুখানি নড়েচড়ে বারান্দার পিলারের সাথে লেপ্টে দাড়ালো ও। একটা শুকনো ঢোক গিলে বললো,

– আ্ আমি কিন্তু বাসায় পুশআপ করি তাথৈ। বাইসেপস আছে আমার।

– পরশু মিড। এক্খন লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়তে না বসলে তোর বাইসেপস গুড়োগুড়ো করে দেবো আমি।

দাঁতে দাঁত চেপে বললো তাথৈ। শার্লি আরেকবার ঢোক গিললো। ঠিকঠাকমতো দাড়িয়ে, তাথৈয়ের হাতে থাকা বইগুলোর দিক উকি দিলো ও। বললো,

– কোন কোর্সের মিড?

– জু-জিওগ্রাফি।

পুরুষালি আওয়াজ শুনে পেছনে তাকালো তাথৈ। শার্লি, রুমনও ওর পেছনে উকি দিলো। তুল্যকে দেখে এমনিতেও রাগ হয় তাথৈয়ের। কিন্তু ওর শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তুল্যর হাতের সিগারেটটার দিকে। তুল্য সিগারেট মুখে তুলে টান দিলো একটা। ধোয়া ছেড়ে বোনের দিকে তাকালো। বিজ্ঞদের মতোকরে বললো,

– এইসব ব্যাকবেঞ্চার ছেলে, মেয়েদের সাথে মিশলে সিজি কম আসবে, এটাই স্বাভাবিক। ব্যাপার না সিস, আই ক্যান ফিল ইওর পেইন!

ছেলে বলার সময় শার্লি, আর মেয়ে বলার সময় রুমনের দিক ইশারা করেছে তুল্য। কপালের সামনে একটাও চুল না থাকা সত্ত্বেও রুমন আঙুলে কানে চুল গুজে দেওয়ার মতো ভাব নিলো একটা। লজ্জা পেয়ে দৃষ্টিও নামিয়ে নিলো। কিন্তু শার্লির মন চাইছিলো তুল্যর মুখ বরাবর ঘুষি ছুড়তে। কিন্তু ও খুব ভালোমতোই জানে, এমনটা করলে তুল্য গতদিন যেভাবে রুমনকে করিডোর থেকে ফেলে দিচ্ছিলো, তেমনভাবে আজ ওকেও চ্যাঁঙদোলা করে ড্রেনে ফেলে দেবে। দুবার ভাববে না। তাই ও তাথৈয়ের প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষায় রইলো চুপচাপ। তাথৈ একপা এগোলো। তুল্যর চোখে চেয়ে, স্পষ্ট গলায় বললো,

– তোর মনে হচ্ছে না তুই মাত্র পয়েন্ট জিরো থ্রি বাড়তি সিজি নিয়ে ওভারকন্ফিডেন্স দেখাচ্ছিস?

– আমার রেজাল্ট তোরচেয়ে ভালো, আর আলফেজ ইন্ডাস্ট্রির টোটাল হান্ড্রেড পার্সেন্টের ওনার তাথৈ আলফেজ, এই দুইটা দেখার আগে মরিস না। অল দ্যা বেস্ট।

তুল্য নিজের হাতে জ্বলতে থাকা সিগারেটটার দিকে তাকালো। তাথৈ ওকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। শার্লিও আড়চোখে চেয়ে ওকে দেখে নিয়ে চললো তাথৈয়ের পেছন পেছন। রুমন বসা থেকে উঠে দাড়ালো এবারে। ব্যাগটা কাধে নিয়ে, তুল্যর বরাবর দাড়ালো। ওর বুকের দিক হাত বাড়িয়ে চিরাচরিত জড়ানো আওয়াজে বললো,

– সিগারেট ছোড় দো তুল্যবাবু।

– তোর এই গা জ্বালানো কথাসমেত তোকেও আজ এই সিগারেটের আগুনে জ্বালিয়ে দেবো দাড়া!

তুল্য তেড়ে এগোচ্ছিলো। ‘ওহ নো!’ বলে ছুট লাগায় রুমন। তুল্য দেখলো হাত নাড়াতে নাড়াতে ছুটছে রুমন। কয়েকসেকেন্ডের ব্যবধানে পাটকাঠির মতো শরীরটা ওর দৃষ্টিসীমার আড়াল। অনেকটা হাওয়ায় মিশে যাওয়ার মতো। সব ভুলে হাতের সিগারেটের দিকে তাকালো তুল্য। ওর ঠোঁটের কোনে কিঞ্চিৎ হাসির রেশ ফোটে। সিগারেটটা আবারো মুখে পুরে কয়েকটানে শেষ করলো ওটা। হাটা লাগালো টংয়ের দিকে। আজ আরোদুটো সিগারেট বেশি খাবে ও।

#চলবে…